অমিতাভ সাহা ~ নিদ্রা সঙ্কট


নিদ্রা সঙ্কট



একটা সমস্যায় পড়েছি। গুরুতর কিছু নয়। খুব সাধারণ ব্যাপার, কিন্তু মাঝেমধ্যে খুব ভোগাচ্ছে। কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি, দুপুরে ঘুমোলে রাতে আর কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না। তাই ঠিক করেছি দুপুরে আর ঘুমাব না। ছুটির দিনে দুপুরবেলা করার কিছু থাকে না। বইপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে ঘুমে চোখ এমন জড়িয়ে আসে যে বিছানায় কাত না হয়ে পারিনা। আর রাত্রিবেলা ঘুমানোর জন্য রীতিমত কসরত করতে হয়। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রবিবার, ছুটির দিন ছিল। কাজকর্ম বিশেষ কিছুই ছিল না। দুপুরে মুরগির মাংস সহযোগে জম্পেশ খাওয়াদাওয়া হল। তারপর রোববারের পত্রিকার সাহিত্যের পাতা খুলে বসলাম। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ঘুমাব না; দুপুরটা গল্প পড়েই কাটিয়ে দেব। কিন্তু কখন যে চোখ লেগে গেছে, বুঝতেই পারিনি।

কলিং বেলের আওয়াজে ঘুম ভাঙল। দরজা খুলে দেখি, অ্যাকোয়াগার্ড কোম্পানি থেকে দুজন ছেলে এসেছে। বলল, দেখুন পানীয় জল ভালো না হলে অনেক রকম পেটের রোগ হতে পারে। ভালো অফার আছে, সস্তা পড়বে, লাগিয়ে নিন। আমি বললাম, আমি জানি ভাই। তাই তো জারের জল কিনে খাচ্ছি, আপাতত বেশ ভালো আছি। হাতে এখন টাকাপয়সা সর্ট আছে। কার্ড দিয়ে যাও, যখন লাগাবো তোমাদের ফোন করে ডেকে নেব। ওদের বিদায় করে দিয়ে এসে ঘড়িতে দেখি, বিকেল পাঁচটা। আমি ফ্ল্যাটে একাই ছিলাম। ব্যাচেলর মানুষ। ল্যাপটপ খুলে ইউটিউবে ৯০’এর দশকের একটা উদ্ভট বাংলা সিনেমা দেখতে লাগলাম। না আছে কোন গল্পের মাথামুণ্ডু, না কোন অভিনয়দক্ষতা। অতিরঞ্জিত মারামারির দৃশ্যে নায়ক উড়ে এসে আটদশজন ভিলেনকে একএক করে লাথি বা ঘুষি মারছিল আর তারা দূরে ছিটকে গিয়ে পড়ছিল। মাধ্যাকর্ষণের কোন ধার ধারছিল না। নায়কনায়িকার উদ্দাম নাচের দৃশ্যে দুজনের কেমিস্ট্রি দেখে হাসতে হাসতে পেট ফাটছিল। সন্দীপ মাহেশ্বরির চ্যানেলে গিয়ে কিছুক্ষণ মোটিভেশনাল ভিডিও দেখলাম কিভাবে অবচেতন মনকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বুঝলাম, মনকে নিয়ন্ত্রণ করাই সবথেকে কঠিন কাজ। আমাদের অজান্তেই মনের গভীরে কিছু চিন্তাভাবনা চলতে থাকে যেগুলো আগাগোড়া ভ্রান্ত এবং ভিত্তিহীন। সেগুলোকে প্রশ্রয় দিলে ধীরে ধীরে বিশ্বাসে পরিণত হয় এবং বিভিন্ন মানসিক বিকৃতি যেমন হীনমন্যতা, ভীতি, হতাশা ইত্যাদির জন্ম দেয়। তাই থট সিলেকশন খুব গুরুত্বপূর্ণ। আজেবাজে চিন্তাভাবনা যাতে মনে বাসা বাঁধতে না পারে, সে ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

এত ভালো একটা বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম, আবার কলিং বেল। দরজা খুলে দেখি, রান্নার মাসী। মাসী রান্নাঘরে ঢুকল আর আমি বিছানায় এসে বসে আরও কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তা করছিলাম। রাতের খাবার তৈরি করার পর মাসী এসে চা-বিস্কুট দিয়ে গেল আর টিভিটা অন করে বাংলা সিরিয়াল চালিয়ে টিভির সামনে বসে পড়ল। আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে আয়েস করে চা-বিস্কুট খাচ্ছিলাম। আমি সাধারণত বাংলা সিরিয়াল দেখিনা, টাইম পাস করার জন্য আমিও দেখতে লাগলাম। সিরিয়ালের ক্যারেক্টাররা ঝা চকচকে মেকআপ করে বাড়িতে বসে ছিল আর যেন তেন ছুতোয় এ ওর পেছনে লাগছিল। ঝগড়া করার একটা বাহানা পেলেই হলো। সিরিয়ালের মেয়েরা এ ব্যাপারে বিশেষ অগ্রণী। একটি মেয়ে খুন হবার পরেও আবার কিছুদিন পরে বেঁচে ফিরে এসেছে। তাকে দেখতে পেয়ে যারা ষড়যন্ত্র করে খুন করেছিল, তাদের চক্ষু ছানাবড়া। এই মেয়েই কি সেই মেয়ে, নাকি তার মত দেখতে অন্য একটি মেয়ে (মানে ডবল রোল) সেই নিয়ে বাড়ির লোকেদের মধ্যে মতানৈক্য তৈরি হল। অনেকে মানতেই চাইছে না, এই মেয়েই সেই মেয়ে যে মারা গিয়েছিল কারণ তারা নিজেরা উপস্থিত থেকে মেয়েটিকে দাহ করেছে। সুতরাং অন্য কোন মেয়ে সম্পত্তির লোভে প্লাস্টিক সার্জারি করিয়ে ফিরে এসেছে। মৃত মেয়েটির স্বামী আবার আরেকজনকে বিয়ে করে বসে আছে। একেবারে তালগোল পাকানো ব্যাপার। এইভাবে জট পাকিয়ে আর জট ছাড়িয়ে শয়ে শয়ে এপিসোড চলছে। বুঝলাম, আরো কিছুক্ষণ কন্টিনিউ করলে আমার মাথার ভেতরেও সব তালগোল পাকিয়ে যাবে। তাই চ্যানেল পাল্টে দিয়ে দেশদুনিয়ার খবর দেখতে লাগলাম। মাসীর আবার এ সব সিরিয়ালই পছন্দ। তাই বিরক্ত হয়ে উঠে চলে গেল। অনেকক্ষণ টিভি দেখার পর মাথাটা কেমন করছিল, তাই টিভি বন্ধ করে উঠে পড়লাম। 

বাইরে বেরিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করার পর পাড়ার চায়ের দোকানে গিয়ে দেখি, ওখানে দু’তিনজন বন্ধুবান্ধব আগে থেকেই উপস্থিত। ওদের সাথে ঘন্টাদুয়েক আড্ডা মেরে ও দু’কাপ চা সাবাড় করার পর বাড়ি ফিরে এলাম। মাথায় একটা গল্পের আইডিয়া ঘোরাঘুরি করছিল। টেবিলে খাতাকলম নিয়ে বসে গেলাম। ত্রিকোণ প্রেমের গল্প। এক নায়িকাকে নিয়ে দুই নায়কের টানাটানি। শেষমেশ নায়িকা কোন নায়কের কপালে জুটবে,সেটা নিয়ে রীতিমত সাস্পেন্স ক্রিয়েট করে ফেলেছি কিন্তু রেজোল্যুশনটা কিছুতেই টানতে পারছিলাম না। অনেকক্ষণ ভাবনাচিন্তা করে উঠে পড়লাম।

রাত্রে খাওয়াদাওয়া সেরে মশারি খাটিয়ে যখন বিছানায় শুতে গেলাম, তখন চোখে ঘুমের লেশমাত্র ছিল না। টেবিলের উপর রাখা একটা ম্যাগাজিনের উপর চোখ গেল। ওটা নিয়ে এসে পাতা ওলটাতে থাকলাম। ওখানে স্টাইলিশ মডেলদের ফটোগ্রাফির জন্য পোজ দেওয়া সে কী ছবি! মনমোহিনী হৃদয়হরণী। যেমন মেকাপ তেমন তাদের অঙ্গভঙ্গী আর তেমনি চোখের চাউনি। এমন লাস্যময়ী ভঙ্গিমা, যে রাতের ঘুম কেড়ে নিতে পারে। যদিও সত্যিকারের সুন্দরী না মেকআপ মারা সুন্দরী বলা কঠিন। আজকাল তো বিভিন্ন ভিডিওতে দেখছি, মেকআপ মেরে পেত্নিকেও অপ্সরা বানিয়ে দিচ্ছে। না, এদের থেকে দূরে থাকাই ভালো। নাহলে ঘুমের মধ্যে এসে ডিস্টার্ব করবে। তার চেয়ে বরং ভক্তিমূলক বা শ্যামাসংগীত জাতীয় কিছু গান শোনা যাক। তাহলে মনে প্রশান্তি আসবে এবং ঘুমও এসে যাবে। ইয়ারফোনটা খুঁজতে গিয়ে মনে পড়ল ওটা তো আগেরদিন অফিসেই ফেলে এসেছি। ঘরের আলো নিভিয়ে মোবাইলের ভলিউমটা কমিয়ে মাথার পাশে রেখে চোখ বুজে শ্যামাসংগীত শুনতে লাগলাম। আহা! “দোষ কারো নয় গো মাআআআআআ...” শুনতে শুনতে কানের কাছে মশা এসে মশাসঙ্গীত আরম্ভ করল। এত হাই ফ্রিকুয়েন্সি মিউজিক যে আর সহ্য করতে পারলাম না। বেড সুইচ জ্বেলে দেখি, মশারির একটা দিক একটু খোলা ছিল, সেই দিক দিয়েই মশা ঢুকেছে। মশামারা অভিযান আরম্ভ করলাম। মারতে যাই, এমন সেয়ানা মশা, আগে থেকে আমার অ্যাকশন প্রেডিক্ট করে সরে যায়। চারটে মশা মারতে অন্তত চব্বিশ বার হাততালি দিতে হল। আলো নিভিয়ে আবার শুয়ে গান শুনতে লাগলাম। গান শুনেই যাচ্ছি কিন্তু ঘুম আর কিছুতেই আসে না। এ তো মহা জ্বালা হল।

বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে রাস্তার দিকে তাকালাম। আমি ফ্ল্যাটের দোতলায় থাকতাম। রাস্তায় হ্যালোজেনের আলো জ্বলছিল। রাত মোটামুটি সাড়ে ১১টা। রাস্তায় লোকজন ছিল না। রাস্তার পাশেই একটা লম্বা দীঘি ছিল। বাইরের মৃদুমন্দ বাতাসে দীঘির জলে হাল্কা ঢেউ তুলছিল। একজন লোক দেখলাম সাইকেল চালিয়ে গান গাইতে গাইতে আমার ফ্ল্যাটের সামনের রাস্তার দিকেই আসছে। হাঁক দিলাম, “এই যে দাদা শুনছেন?”

লোকটি সাইকেল থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কি হয়েছে ভাই?”

-“আপনি কি বাড়ি যাচ্ছেন?”

-“না, দিগ্বিজয় করতে যাচ্ছি। কি বলবেন বলে ফেলুন”।

-“আমার না কিছুতেই ঘুম আসছে না। কি করা যায় বলুন তো”।

-“একবার স্নান করে নিন। দেখবেন শরীরটা ঠাণ্ডা হবে। ঘুমও আসবে”।

-“বাহ, খুব ভালো। থ্যাঙ্ক ইউ দাদা”।

বাথরুমে গেলাম স্নান করতে। গিয়ে কল ঘোরাতেই দেখি, জল নেই। কি আপদ! এত রাতে আবার নীচতলায় নেমে পাম্প চালাতে হবে ভাবতেই বিরক্ত লাগছিল। তবু যেতে হবে। নইলে স্নান করব কিভাবে? সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে যাচ্ছি, হুট করে লোডশেডিং হয়ে গেল। না, স্নানও করতে দেবে না দেখছি। হুট করে মাথায় এলো, দীঘিতে গিয়ে ডুব দিয়ে আসলে কেমন হয়। লাস্ট কবে ওপেন এনভায়রনমেন্টে স্নান করেছি, মনে পড়ে না। বেশ একটু অ্যাডভেঞ্চার টাইপ হবে মনে করে গ্রাউন্ড ফ্লোরে গ্রিল শাটার খুলে রাস্তা পেরিয়ে দীঘিতে গিয়ে নামলাম। এদিকওদিক তাকিয়ে কোমর জলে নেমে ঝপাঝপ কয়েকটা ডুব মেরে দিলাম। দীঘির জল বেশ ঠাণ্ডাই ছিল। ঘরে এসে গা মুছে নতুন গেঞ্জি-পাজামা পরে চুল আঁচড়াচ্ছিলাম। দীঘির জলে ভাইরাস না ব্যাক্টিরিয়া না প্রোটোজোয়া কি ছিল কে জানে, সারা গা কুটকুট করতে লাগল। এতক্ষণে কারেন্ট এল। একটু আগে এলেই আমাকে আর পুকুরে গিয়ে নামতে হত না। আমি অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে সারা ঘরে চুলকানির মলম খুঁজতে লাগলাম। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও পেলাম না। পরে ভাবলাম একটু নারকেল তেল লাগাই সারা গায়ে, তাতে যদি চুলকুনি একটু কমে। নারকেল তেলের কৌটো নিয়ে তেল ঢালতে গিয়ে দেখি, তেল একেবারে তলানিতে। তেলও তখুনি শেষ হবার ছিল। অতি কষ্টে তিন-চার ফোঁটা তেল বের হল। সেই মহামূল্যবান তেল সারা গায়ে ঘষে বিছানায় গিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। যদিও চুল্কাচ্ছিল, তবু সেই চুলকানি গ্রাহ্য করলাম না। সংযমের পরীক্ষা দিয়ে ঘুম আনার দিকে কন্সেন্ট্রেট করলাম। 

ঘুমানোর চেষ্টা করছি, কানে এল রাস্তায় একটা কুকুর বিনা কারণে চিৎকার করতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ চুপ থাকে, মিনিটখানেক বিরতি দিয়ে আবার শুরু করে। না,ঘুমাতে দেবে না। ভাবি এইবার বুঝি ঘেউঘেউ বন্ধ হবে, কিন্তু আবার শুরু করে। মিনিট বিশেক এইভাবে চলার পর বিরক্ত হয়ে উঠলাম। ব্যাল্কনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। কাঁঠালের মরশুম ছিল। কিছু কাঁঠালের বিচি ব্যাল্কনিতে শুকোনোর জন্য দেওয়া ছিল। তারই কয়েকটা তুলে নিয়ে কুকুরটার দিকে তাক করে মারলাম। একটা কাঁঠাল বিচি কুকুরটার মাথায় টাং করে গিয়ে লাগল। সঙ্গেসঙ্গে ছুটে পালাল। যেতে যেতে কেঁউ কেঁউ সুরে নালিশ জানাতে লাগল। তারপর অনেকটা দূরে গিয়ে কাঁদতে লাগল। সেই শব্দ ইগ্নোর করে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। এবার ঘুমবোই, বদ্ধপরিকর হলাম। তবু ঘুম আসতে চায়না।

আজ আমার কি যে হল, কিছুই বুঝতে পারছি না। ঘুম আসতে এত তপস্যা কোনদিন করতে হয়নি। আবার বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। সাহস করে দরজা খুলে সামনের ফ্ল্যাটের কলিং বেল টিপে দিলাম। এত রাতে লোককে বিরক্ত করতে খুব খারাপ লাগছিল। কিন্তু কি করব! বয়স্ক ভদ্রলোক সদ্য কাঁচা ঘুম ভেঙে ঘুমঘুম চোখে দরজা খুলে আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে?”

আমি বললাম, “কাকু, আপনার কাছে ঘুমের ওষুধ আছে নাকি?”

উনি বিরক্তিভরে বললেন, “কেন? ঘুমের ওষুধ কি হবে? তোমার কিও কোন আক্কেল জ্ঞান নেই, এত রাতে ঘুমের মানুষকে জাগিয়ে ঘুমের ওষুধ চাইছ?”

-“সরি কাকু। প্লিজ একটু দিন। আমার খুব উপকার হয়”।

-“আচ্ছা দাঁড়াও, দেখছি” বলে ভদ্রলোক ভেতরে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে একটা স্ট্রিপ নিয়ে এসে আমার হাতে দিলেন।

একটি ট্যাবলেট গলাধঃকরণ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মনে মনে একটা আনন্দ হচ্ছিল, কিছুক্ষণের মধ্যে নিশ্চয়ই ঘুম চলে আসবে। টুং করে কলিং বেল বেজে উঠল। ধুর! একটু শান্তি নেই। আবার কে এল এত রাতে, ভেবে বিরক্তিভরে দরজা খুলে দেখি বয়স্ক ভদ্রলোক মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছেন।

-“সরি শুভ্র, তোমাকে না ঘুমের ওষুধের জায়গায় জোলাপ দিয়ে দিয়েছি। ঘুমঘুম চোখে ঠিক দেখতে পাইনি। প্লিজ। এই নাও ঘুমের ওষুধ”।

মাথা প্রচন্ড গরম হল।

আমার আর ঘুমের ওষুধের দরকার নেই। যান আপনি”। বলে দরজা বন্ধ করে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আজ আমাকে ঘুমোতে দেবে না, দেখছি। সমস্ত পরিস্থিতি একত্রিত হয়ে ষড়যন্ত্র করেছে, আমাকে ঘুমোতে দেবে না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে এসব কথা ভাবছি, কিছুক্ষণ বাদে মনে হল পেটের মধ্যে গুড়্গুড় গুড়্গুড় করছে।

ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। তাই টয়লেটে গিয়ে বসে রইলাম। হঠাৎ মনে হল,দরজা-দেয়াল-ভেন্টিলেটার সমানে কাঁপছে আর ঝাঁকুনি দিচ্ছে। আরে এ তো ভূমিকম্প। দশ-পনের সেকেন্ডের মত চলল। আশেপাশে চিৎকার চেঁচামেচি আরম্ভ হল। ফ্ল্যাটের লোকজন সব ঘুম ভেঙে দৌড়ঝাঁপ করে সিঁড়ি দিয়ে নামার শব্দ শুনতে পেলাম। তাড়াতাড়ি শৌচ কর্ম সেরে জানলায় গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখি সবাই রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আশেপাশের বাড়ি থেকে শঙ্খধ্বনি উঠতে থাকলো। এক কাকু আমাকে দেখতে পেয়ে বললেন,“সঙের মত ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? দেখছিস না সবাই নীচে চলে এসেছে”।

আমার বিশ্বাস ছিল, ভূমিকম্পে আমার মরণ নেই। হেলতে দুলতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম। এসে দেখি রাস্তায় লোকজনের ভিড় জমে গেছে। বাড়ির মহিলারা অনেকে বাইরে বেরিয়ে এসে শঙ্খধ্বনি দিচ্ছিল। আমি এক কাকিমার কাছ থেকে শঙ্খ নিয়ে ফুঁ দেওয়ার চেষ্টা করলাম। দীর্ঘদিন অভ্যেস নেই। ফুঁ দিচ্ছি কিন্তু কোন আওয়াজই বেরচ্ছে না। বড় নিঃশ্বাস নিয়ে প্রবল বেগে শঙ্খ ফুঁ দিতে গেলাম কিন্তু তাতে এমন এক বিচিত্র শব্দের উৎপত্তি হল যে, সবাই হাসাহাসি করতে লাগল। লোকজনের সামনে অপদস্থ হয়ে শঙ্খ ফুঁ দেওয়া থেকে বিরত হলাম। একটি স্বাস্থবতী মেয়ে এক নিঃশ্বাসে একটানা অনেকক্ষণ ধরে শঙ্খ ফুঁ দিয়ে যাচ্ছিল। আমি মেয়েটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম। মেয়েটা আমি লক্ষ্য করছি বুঝতে পেরে ভ্রু কুঞ্চিত করে আমার দিকে তাকাল। আমি অপ্রস্তুত হয়ে ওর দিকে আর তাকালাম না।

পাশ থেকে নবীনকাকা এসে বলল, “জানো ভায়া, ইস্পাতের মানই হল বিল্ডিঙের জান। রিইনফোর্সমেন্ট যদি ঠিক থাকে, তাহলে জানবে বিল্ডিং চাপা পড়ে মরার কোন সম্ভাবনা নেই। তোমাদের বিল্ডিং কোন টিএমটি দিয়ে তৈরি জানো তো। না জানলে তোমাদের বিল্ডারকে একবার জিজ্ঞেস করে নিও”।

-“আচ্ছা, ঠিক আছে”। মনে মনে বললাম, যত সব ফালতু লোকের কারবার। কাজকর্ম কিছু নেই, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো।

ঘরে এসে সবে বিছানায় শুয়েছি, একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোনে এলো। তখন রাত মোটামুটি তিনটে। কল রিসিভ করার পর একজন ফিসফিস করে বলল, “হ্যালো”

আমি বিরক্তির স্বরে জোরগলায় বললাম, “হ্যালো!”

-“একি এত জোরে কথা বলছ কেন? তোমার রুমমেট আছে না!”

নারীকন্ঠ শুনে একটু নড়েচড়ে বসলাম। এত রাতে আবার কোন মেয়ে আমাকে ফোন করল। আমি ত সিঙ্গেল। নিশ্চয়ই কোন মেয়ে তার বয়ফ্রেন্ডকে ফোন করতে গিয়ে ক্রস কানেকশন হয়ে আমার নম্বরে কল ঢুকে গেছে। বহুদিন কোন মেয়ের সাথে আলাপ করার সুযোগ হয়নি। তাই আমি মৃদুস্বরে বার্তালাপ চালিয়ে গেলাম।

-“আচ্ছা আচ্ছা। ঠিক আছে”।

-“ইস কী ভূমিকম্প! তুমি ওই সময় কি করছিলে জানু?”

-“কি আর করব। তোমার কথাই ভাবছিলাম। তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে!”

-“খুব ঢঙ না? হস্টেলের বাইরে বেরও নি?”

-“হস্টেল!!! হ্যাঁ হ্যাঁ। বেরিয়েছিলাম তো”

-“আমার ঘরের জানলার কাঁচটা কি কাঁপছিল! আমি তো ভয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছি”

-“এত ভয়ের কি আছে? শঙ্খ ফুঁ দিলেই পারতে”

-“শঙ্খ কোথায় পাব আমি হস্টেলের মধ্যে? তোমার কি মাথা খারাপ হল নাকি”

-“ না, না এমনি বললাম আর কি”

-“তোমার কথাগুলো যেন কেমন কেমন লাগছে”

-“কেমন লাগছে ডার্লিং?”

-“ ডার্লিং! কে আপনি বলুন তো”

-“আমি আবার কে! আমি তোমার জানু”

-“ফাজলামো মারছেন না! রাখুন ফোন”

সাথে সাথে ফোন কেটে দিল। আমার মনে হল এভাবে একটা অপিরিচিত মেয়ের সাথে কথা বলে ফাজলামি মারা উচিত হয়নি। যাক, একটা আত্মগ্লানি নিয়ে মনে মনে মেয়েটির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলাম। সারারাত অজস্র যন্ত্রণার পর অবশেষে ভোরের দিকে ঘুম এলো। সকাল সাড়ে ছ’টায় আবার কলিং বেল। অনেক কষ্টে দরজা খুলে দেখি প্রতিবেশি বন্ধু অয়ন।

-“কিরে আজকে মর্নিং ওয়াকে যাবি না?”

-“আজ আমি যাব না ভাই, আজ তুই একাই যা”।

 

কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন