সম্পর্ক
সুধাদেবীর কথা
খুব
সকালে উঠেই এক কাপ চিনি ছাড়া লিকার চা দিয়ে দুটো থিন এরারুট বিস্কুট খেয়েছেন
সুধাদেবী। সময় আজকাল আর যেন কাটতেই চায়না তাঁর। বারান্দায় শূন্য দৃষ্টি মেলে বসে
আছেন একখানা প্লাস্টিকের চেয়ারে। টবের
মধ্যে নিজের হাতে লাগানো পাম গাছের কেয়ারী করা একতলার এই ব্যালকনিটি তাঁর নিজস্বী।
কখনো হাঁটেন আপনমনে সামনের লনে। ছোট্ট ছোট্ট ঘাসে পা ফেলতে ফেলতে ভাবেন ফেলে আসা
কত যে কথা। বড়ই প্রিয় ভোরবেলার এই মুহুর্ত টি। সামনে পিছনে মিলিয়ে ছয় কাঠা জমির
উপরে বেশ খানিকটা জায়গা ছেড়ে বাড়িটা করেছিলেন তাঁর স্বামী। পিছনের দিকটায় খুব শখ
করে বানানো ফলের বাগান। আম জাম কাঁঠালের সবুজ ছায়াঘেরা কুঞ্জ যেন। কত পাখ- পাখালির
বাসা। বড়ই উপভোগ্য তাদের সাঁঝ সকালের মেলা। পায়চারি করেন আর ভাবেন...বয়স যেন ছুঁতে
পারেনি তাঁর সদা তরুন মন কে। সামনের বাগানের নানা রঙের রংগন আর বোগেনভিলিয়ার মতই
ঢেউ দিয়ে যায় ছোট্ট ছোট্ট ভাবনার তরংগ গুলো!
"
নাহ্, লনের চারধারে হেজের
সারি... বড্ড ঝাপলা হয়ে গেছে। আজই অনিল কে ডেকে একেবারে ছোট করে ছাঁটিয়ে দিতে
হবে।"
কর্তার আমলের মালি, বড্ড বাধ্য। মা অন্ত প্রাণ।
সুধাদেবীও ভালবাসেন ছেলের মত। নিজের ছেলেরা তো কবেই পর হয়ে গেছে। দিনান্তে একবার
মা ডাকার ও ফুরসৎ নেই। কর্তা চোখ বুজেছেন আজ বছর চারেক আগে। ভেঙে পড়েন নি তিনি।
একটু একটু করে সামলেছেন নিজেকে। টাকা পয়সা, স্বামীর অবর্তমানে উইডো পেনশন, এল.আই.সির পলিসি, মেডিক্লেম সবকিছু। তারপর আছে এই সুবিশাল বাড়ির রক্ষনা
বেক্ষনের দায়িত্ব। ষোল সতেরো বছরের কালো কুলো এক আদিবাসী মেয়ে বেলি তাঁর
সর্বক্ষনের সংগী। দিদা বলতে অজ্ঞান। ছাই
ফেলতে ভাঙা কুলো এই বেলিই দিদার সম্বল। আর আছে দোতলার ভাড়াটে উড়িষ্যার অধিবাসী এক
ডাক্তার পরিবার। কতদিন ভেবেছেন আর ভাড়াটে
রাখবেন না,
তুলে
দেবেন এইবার। কিন্তু ভাড়ার ওই ক'টা টাকা বড়ই সম্বল যে তাঁর। তারপর হঠাৎ অসুখ বিসুখ করলে
ডাক্তার বাবু বড় ভরসা। থাক না যেমন আছেন ওঁরা, কি লাভ তুলে দিয়ে? কথা বলার ও তো মানুষ জন
দরকার।
বড়
ছেলের তো বিশেষ রোজগারপাতি তেমন নেই। দু মাস হল বসে আছে। কিন্তু সে মস্ত বড়
কথাশিল্পী। কথাশিল্পের কোনদিনই তেমন দর ছিল না। আজও কই? সবাই সাবাসি দেবে, ফেস বুকে ফটো পোস্টাবে, এদিকে দক্ষিনার বেলায়, সে গুড়ে বালি! বড় ছেলের
এই এক স্বভাব, সে কোন চাকরীতেই আজ অবধি থিতু হয়ে বসতে পারল না! কখনো এ
ডাল... কখনো ও ডাল...। সেই দুঃখেই বোধ হয় বউ মেয়ে তাকে ছেড়ে চলে গেছে...! কি জানি, তিনি তো আর ওদের
দাম্পত্য সম্পর্কে প্রবেশ করতে পারেন না। যদিও বড় বৌমা তাঁকেই দোষী সাব্যস্ত করে
বাড়ি ছেড়েছে।
ছোট
ছেলে, বৌমা ও তাদের একমাত্র
সন্তান... তাঁর নাতি ঋজু। তিনজন তিনটি শহরে থাকে। বাপ মা কর্পোরেট কেরিয়ার গড়তে
ব্যস্ত। আর ছেলে প্রায় ২০০০ কিমি দূরে অজানা অচেনা শহরে কম্পুটারের নতুন নতুন
প্রযুক্তির নেশায়... নাওয়া খাওয়া ভুলে আছে।
ছোট
বৌমার ঝাঁঝালো কথাবার্তায় এখন আর রাগ করেন না তিনি। স্বামী সংগ বিহীনা নারী একা
একা জীবনের এতগুলো বসন্ত পার করে দিল, তার কথায় অল্প বিস্তর ঝাঁঝ থাকবেই বৈ কি! এ হল অভিমান
পুষে রাখার অপারগতা! সুধাদেবী বোঝেন সবটুকুই। তাই আর সাহস করে ঘাঁটান না।
দূর
প্রবাসী নাতির জন্য মন টা থেকে থেকেই হুহু করে ওঠে। নাতি অন্ত প্রাণ মানুষ টা যে
কতদি..ন আদুরে ঠামু.... ডাক টা শোনেন নি! আজকাল আর ভাল করে ঘুম আসেনা। তাঁর
অবর্তমানে তাঁর এই বাড়ি, যৎসামান্য টাকাকড়ি, গয়নাগাটির কি হবে? তিনি তো উইল করতে পারেন
না। কারন বাড়িটা স্বামী তাঁর নামে লিখে যান নি। তাহলে... তিনি একটি ইচ্ছাপত্র তো
লিখতেই পারেন...তাঁর একমাত্র মেয়ে ও ছোট বৌমার উদ্দেশ্যে! তারা নিশ্চিত মান্যতা দেবে তাঁর এই পত্রটিকে।
সব্বাইকে সবকিছু সমান ভাগ করে দিয়ে যেতে চান তিনি। প্রত্যেকের ব্যথার সমব্যথী হতে
হতে তিনি নিজে যে কি অপরিসীম ব্যাথার ভার বয়ে চলেছেন...তার তল কোথায়?
ঋজুর
কথা
অনেকদিন
হয়ে গেল বাড়ি যাওয়া হয়নি ঋজুর। দিনের পর দিন, মাস, বছর... মনে হচ্ছে যেন কত দিন।
বাড়ির জন্য বড়ই মন খারাপ করে আজকাল... শরীরটা যে কি ভীষণ খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার! জানেনা কেন যে রাতে ঘুম আসেনা! জ্বর জ্বর
ভাব সবসময়। খেতে ইচ্ছে করেনা প্রায় কিছুই। খাবার দেখলেই কেন যে বমি পায়? চেন্নাই এর এক নামী
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র সে। পড়াশোনায় বরাবরই ভাল। কিন্তু বাড়ির থেকে, ঋজুর প্রিয় শহর থেকে, স্কুলের বন্ধুদের থেকে
বড্ড যে দূর। বড্ড দূর তার প্রিয় গাছপালা থেকে। অবাক মাঠ ও তার বিস্তার থেকে...!
মন কেমনের পাল্লা ভারী হয়ে আসে আজকাল...
মা'র জন্য...ঠামুর
জন্য...কান্না পায় ভারী! কিন্তু সে যে ছেলে, ম্যাচিওরড গায়...! কান্না পেলেও
কি দেখাতে আছে?
তাই সে
রোজই যায় কলেজ...হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে প্রজেক্ট করে, গরমে ঘেমে নেয়ে একসা হয়! এসি
ঘরে বসে থেকেও স্বস্তি নেই, গলা ব্যাথা...কাশি। কেন যে শরীরটা তার দিনকে দিন বিট্রে
করছে? সেমেস্টার শেষে দিন
গোনার পালা...শেষ হলেই প্লেনে চড়ে হুউউস করে নিজের শহরে! আহ্! কতদিন যে ফুটবল
পেটায়নি! বর্ষা নেমে গেছে। সেক্টর টু সি র মাঠে বেলা পর্য্যন্ত ফুটবল পেটাপেটি...।
বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং আর মেডিক্যাল কলেজ হস্টেল থেকে স্কুলের বন্ধুরাও এসে গেছে
নিশ্চয় এতদিনে। ভাবতেই মনটা ভাল হয়ে গেল ঋজুর। কিন্তু পরীক্ষাটা তো শেষ করতে হবে!
জ্বরটা যে কেবলই আসছে, এদিকে
বাড়ি থেকে রোজ রাত্রিবেলা মা-ঠামুর ফোন। "ওরে একটা এক্স রে করা বুকের"
অথবা " ওরে ডাক্তারের কাছে যা, কিছু তো একটা কর!"
"দূউউর ভাল্লাগেনা, এত গরমে....রোদ্দুরে রোদ্দুরে কে যে বাইরে বেরোয়!"
নিজের মনেই মায়ের ইচ্ছে ধামাচাপা দেয়। আসলে ও
নিজের প্রতি বড়ই উদাসীন। কেন যে এত
উদাসীনতা...জানেনা সে! এই যা...হচ্ছে হোক...এই ভাবটা মনের মধ্যে তাড়িয়ে বেড়ায়
সর্বক্ষন।
সুধাদেবী
কতদিন
হয়ে গেল...নাতি বাড়ি আসেনা! সেই গত ডিসেম্বর এ এসেছিল ফিফথ সেমেস্টার এর পরে।
জানুয়ারি মাস টা লম্বা থেকেই ফিরে গিয়েছে
কলেজে। এখন আর ও কলেজ হোস্টেলে থাকেনা। পাঁচ বন্ধু মিলে কুক সহ একটা বাড়ি ভাড়া
করেছে।
তাহলে?... কেন এমন কঠিন অসুখ হল ওর? আচ্ছা, ও কি কোন নেশা করে? নাহ্, তাহলে তো ও তার প্রিয় ঠামুর
কাছে লুকোতে পারত না! না না আর ভাবতে পারেন না সুধাদেবী। নিজের স্বামীর মৃত্যু কোনরকমে সয়েছেন! তার ও
বহু আগে বনিবনার অভাবে হঠাৎ ডিভোর্স হয়ে যাওয়া বড় ছেলের বউ ইন্দ্রাণী ও ফুলের মত
নাতনী রিনির সমস্ত জিনিষ পত্র নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াটা তাঁর বুকের ভিতর খানা
একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে। আসবাবহীন খাঁ
খাঁ ঘরে একা দাঁড়িয়ে মনে হত বুকের পাঁজরখানা খসে পড়বে বুঝি! তখন তাঁর স্বামী
জীবিত। অবিনাশ বাবু সামলেছেন তাঁকে আর তিনি দুহাতে এই সংসার।
আবার
ঋজুর চিন্তা...,
এই তো মে
মাসের শেষেই বাড়ি ফেরে ছেলেটা। উৎকর্ণ হয়ে
আছেন তিনি,
এই বুঝি
ফোন এল...'ঠামু আমি বাড়ি আসছি।' গাছে গাছে কত আম হয়েছে।
নিজের হাতে আমসত্ত্ব বানিয়েছেন। ছেলেটা বড্ড ভালবাসে। বিলিও করেছেন পাড়ার
প্রত্যেকটি বাড়িতে। এত আম খাবে কে? কিছু পাঠিয়েছেন মেয়ের
বাড়ি। ঝড়ে পড়ে যাওয়া কাঁচা মিঠে আমগুলো দিয়ে বানিয়েছেন মিষ্টি আচার। আজকাল আর
খাবার মুখে রোচেনা আচার ছাড়া, বয়সের জিভ তো!
সন্ধ্যে
হয়ে এল,
ছোট বউমা
অফিস থেকে ফেরেনি এখনো। ঘরে সন্ধ্যে দেখিয়ে টিভির দু চারটে প্রিয় সিরিয়াল দেখতে
দেখতে মনে পড়ে যায় সেন্ট জেভিয়ার্সে ঋজুর ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ের কথা। বড্ড
সংবেদনশীল ছিল ও। সেই সময় তিনি ও অবিনাশ বাবু বেড়াতে গিয়েছিলেন মেয়ের বাড়ি
আসানসোলে। বউমাও ছোট ছেলের কাছে রাঁচিতে। বাড়িতে ঋজু একা। হঠাৎই সেই ফোনটি এল।
ধড়ফড় করে উঠেছিলেন তিনি। সেই মুহুর্তেই স্বামী কে বুঝিয়ে মেয়ের বাড়ি থেকে ফেরত
আসলেন তাঁরা,
আকুল
কান্নায় ভেঙে পরা নাতিকে সামলাতে। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে, পথ দুর্ঘটনায় মারা গেছে ঋজুর প্রিয়তম বন্ধু ও তার গোটা পরিবার। কলকাতা
থেকে ফেরার পথে হাইওয়ের ওপরে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যায়! খারাপ খবর পৌঁছয় বাতাসের
ও আগে। কিশোর বেলার সমস্ত বন্ধুকে ঋজুর পাশে দাঁড় করালেও মনের এত কাছাকাছি এমন
সাথির এমনভাবে অজানার দেশে হঠাৎ চলে যাওয়া কি সহজে মেনে নেওয়া যায়?
ছোট
বেলার খেলার সাথী কে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান এই অবোধ কিশোরের পাশে সত্তোরোর্দ্ধ
ঠাকুমা মানসিক ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন।
সেদিনের
সেই কিশোর আর ছোট্টটি নেই। সাবালক... তরুন। কিন্তু কোথায় যেন... কি যেন...নেই! ওর
চোখের দিকে গভীর ভাবে তাকালেই বোঝা যায়। জীবনের প্রতি অবচেতন বিতৃষ্না খেলা করে
যেন সেখানে।
ফোনটা
এল গভীর রাতে। ল্যান্ড লাইনে কাজের মেয়েটি ফোনটা ধরেই দিদাকে ডেকেছে। অন্ধকারে সামলাতে না পেরে হোঁচট খেলেন তিনি।
কাঁপা হাতে কোনমতে রিসিভার হাতে নিয়েই বুঝতে পারলেন... অঘটন যা হবার হয়ে গেছে। ঋজু
অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি।
এ
কি শুনছেন তিনি! হা ঈশ্বর, এ ও কি সত্যি! কি হয়েছে
তাঁর নাতিসাহেবের ? তাঁর
প্রাণাধিক সত্ত্বা! এত অযত্ন করে শরীরের....! কতদিন যে ছেলেটা কে নিজের হাতে
খাওয়ান না! ঠিক যেমন করতেন ছোটবেলাটায়। ওর বাবা মায়ের এত সময়ই বা কোথায়? সব আদর আবদার গিয়ে পড়ত
ঠামুর ওপরে! আহা গো! কি হল ছেলেটার? কেন হল?
রিনির কথা
রিনি....রিনিইইইইই...., কলেজ থেকে বেরোতে গিয়ে
পা আটকে গেল রিনির। ঠিক যা ভেবেছে তাই। শিভম্ পথ আটকে দাঁড়িয়ে।
-
কি রে, কানে তুলো নাকি তোর? কখন থেকে ডাকছে ও, কানেই যাচ্ছেনা বল?
মেহুলির
কথায় সংবিত ফিরল রিনির।
-
আরে ছোড়
দে ইয়ার,
ইয়ে ত
মেরা আদত সা হো গ্যায়া! দেখ কর ভি ইয়ে দেখতি নেহি হ্যায় মুঝে আজকাল!
-
আরে নেই
ইয়ার, য়্যসা বাত ভী তো নেহি
হ্যায় রে কি তুঝে বিন দেখকে রিনি চলা যায়!
য়্যসা
কভি হুয়া হ্যায় বোল্?
-
হুয়া তো
নেই, লেকিন আজকাল তু বহোত
খোয়ি সি রহতি হ্যায়। কিঁউ রে, মুঝে বাতানা, বাত ক্যায়া?
-
চল কঁহি
ব্যঠকে বাত করতে হ্যায়। মেহুলি যাবি না চলবি??
-
নাহ্ রে, তোরা যা। কাবাব মে
হাড্ডি বননে কা শখ নেহি হ্যায় মুঝে।
-
চল ব্যঠ, কফি বোলুঁ?
-এক স্যান্ডউইচ ভি বোল
দেনা, কাশকে ভুখ লগি হ্যায়।
-
ঠিক হ্যায়, কফি পিতে পিতে আরামসে
বাত করতে,
হ্যায় না!
ভাইয়া
দো কফি জলদি সে।
হাঁ
বোল রিনি! ক্যায়া হুয়া তুঝে? কিঁউ ইতনি খোয়ি সি হো গয়ি রে?
-
নেই রে, শিভম, পাপা মাম্মি কে বারে মে
শোচ শোচকে ম্যায় পাগল হি বন যাউঙ্গা রে একদিন।
-
দ্যাখ, পাপাকে সাথ মাম্মির
ডিভোর্স খালি হয়েছে, লেকিন
কোই কিসিকো ভুল হি নেহি পায়ে!
-
সাচ বাত, ভুল না ভি নেহি চাইয়ে, হ্যায় না!
-
পাপা
আমাদের কুছ খরচাপাতি দেয়, লেকিন উসে ক্যায়া হোতা বোল্? মাম্মি গান শেখায় বাড়িতে, আর আমি দু চারটে টুইশনি
করি ব্যাস। এতে কি চলে বল তো? পাপার এত রোজগার ও নেই আর পাপা ইতনা শোচতে ভী নেই।
-
হুউম, ইয়ে বাত! আন্টি কা
তবিয়ৎ আভি ক্যাসা হ্যায় রে রিনি? উসদিন দেখা থা তুমহারে সাথ। রিক্সা মে ব্যাঠকে কঁহি যা
রহে থে তুমলোগ।
-
মাম্মি
ঠিক নহি রহতি আজকাল, হমলোগ উসদিন গয়ে থে গাইনি কে
পাস। বোলা কি মাম্মি কা এক সিস্ট হ্যায় ওভারি মে। দাওয়াই দিয়ে হ্যায়। ঠিক হো যায়গি
শায়দ।
-
আরে তু খা
লে, স্যান্ডউইচ তো ঠান্ড্
পর গয়ি তেরা।
-
তু মেরা
বচপন কা দোস্ত। সমঝতা তু মুঝে বহোৎ। য়্যাসা take care করোগে ক্যায়া জীবন ভর?
-
উও বাদ মে
দেখা যায়গা। আভি তো তু শান্তি সে কাম লে!
-
চলতে
হ্যায় রে শিভম্,
বাই ইয়ার।
মাম্মি একেলি বয়ঠি হ্যায় রে ঘরমে।
-
বাই...রিনিইইইইই। Take care dear!
-
Love you!
ঋজুর
কথা
চোখ
বন্ধ করে শুয়ে আছে ঋজু হাসপাতালের কেবিনে। মাথার দুইপাশে উদ্বিগ্ন মা বাবার মুখ।
মাসিরাও এসে গেছে, যে
যেমনভাবে পেরেছে। চিরকালের ফরোয়ার্ড প্লেয়ার ঋজু আজ ডিফেন্সে খেলছে! এ ও কি সম্ভব? পিসিমনি ও ছুটে এসেছে তাড়াতাড়ি। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে ঋজু ওরফে অমৃতেশ বাসু।
ব্যাংগালুরুর এইচ সি জি হাসপাতালের সিস্টার এই নামেই ডাকছে ওকে, ওর পোষাকি নাম, এখানে ঋজু নাম অচল!
ডাক্তারবাবু
বলেছেন ছয় মাসের ধাক্কা। কলেজ, প্রজেক্ট, ক্যাম্পাস ইন্টার্ভিউ
সব সওব যেতে বসেছে প্রায়! ভেবেছিল, পরীক্ষা হয়ে গেলেই এম বি এর কোচিং জয়েন করবে! হায়
ভগবান... কি যে করে সে? নিরূপায় হয়ে
কেমোথেরাপির হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়া ছাড়া আর তো কোন উপায় নেই! ভিতর থেকে কে যেন
বলে উঠল..." ফাইট ঋজু ফাইট, এ লড়াই তোকে জিততেই হবে।"
কতদিন
ভাল করে নাওয়া খাওয়া নেই। বড় দুর্বল শরীর, তার ওপরে কেমোর ধকল। সব মিলিয়ে
ঋজু নাজেহাল। একেকটা দিন যেন একেকটা বছর। কখনো পেটে অসহ্য যন্ত্রণা... কখনো বা ভয়ংকর শ্বাস কষ্ট... উফফফ গড তুমি কেন
এত শাস্তি দিচ্ছ আমায়? ভাবে
ঋজু... শুধুই ভাবে...শুয়ে শুয়ে... শুধু ভাবে। সংগে রয়েছে মা, আর বাবা সেই রাঁচিতে
তার চাকরির জায়গায়। কত গুরুত্ববহন করতে হয় তার বাবাকে। ঋজুর একেক সময় ভয়ানক গর্ব
হয় তার বাবাকে নিয়ে। আচ্ছা রিনিটা কি খবর পেয়েছে? আর জেম্মা?? রিনি রে... একটা ফোন
করিস আমায়..... তোদের সবার জন্য বড্ড মন কেমন করে যে!
পারবে
জিততে,
সে
পারবেই! হার সে কিছুতেই মানবেনা। ক্যান্সার কে হারিয়ে দিয়ে, জয়ীর মত ফিরবে আবার
২০০০ কিমি দূরে,
নিজের শহরে, ঠামুর কাছে, প্রাণপ্রিয় বন্ধুদের
কাছে। আবার কলেজের ছুটিতে বাড়ি এসে ফুটবল পেটাবে সে সেক্টর টু-সি র মাঠে! মাথার
কাছে তার মা আছে না! মা যে স....ব ঠিক করে দেবেন! আছে ঠামুর আশীর্বাদ... পিসিমনির
ভালবাসা আর বাবার উৎকন্ঠা!
নিজের
জন্য বাবাকে সে হারতে দেবেনা...না না কোত্থাও না...এ কিছুতেই হয়না যে! এখন থেকে মা'র সব কথা শুনবে, নিয়মিত ওষুধ
খাবে...ডাক্তারবাবুদের কথা মানবে। দুরারোগ্য ব্যাধি কে হারিয়ে বিজয়ী হয়ে ফিরবে সে!
সুধাদেবী
গতকাল
রাতে ঘুমের মধ্যে অবিনাশ বাবু এসেছিলেন। মাঝে মাঝেই আসেন আজকাল। বিশেষত ছোট দেওরের
মৃত্যুর পর যেন বেশি করেই স্বপ্নে দেখা দিচ্ছেন। ডাকছেন যেন..."গিন্নী ও
গিন্নী অনেককাল ত হল একা থাকার পালা"।
কিন্তু এই সংসার, এই মায়া বিশেষত তাঁর অসুস্থ নাতিসাহেব কে ছেড়ে তিনি যান
কি করে?
মেয়ের
ঘরের বড় নাতনির বিয়ে ঠিক হয়েছে, কত কেনাকাটা, কত আনন্দ, কত লোকজন, তাঁর জায়েরা, ননদেরা সবাই আসবে... দেখা সাক্ষাৎ এর বড় একটা সুযোগ তো
চট করে মেলেনা আজকাল। এখন শুধু ঋজুবাবুর বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়। নাতিসাহেব ফিরলেই
বিয়ের আনন্দে মেতে উঠবে সবাই। এমতাবস্থায় তাঁর থাকাটা বড়ই জরুরি, তিনি জীবন বিমুখ হবেন কি করে? অবিনাশ বাবু হেসে বলতেন, " মায়া কাটাও গিন্নী...
মায়া কাটাও...সংসার বড়ই অসার বস্তু"। বললেই বা শুনছে কে? সারাটা ক্ষন ই ফোনের
কাছে বসে থাকেন আজকাল... এই বুঝি ঋজুর কোন
খবর অথবা মেয়ের ফোনে বিয়েবাড়ির আপডেটস। একে একে দিন চলে যায়.... মাস গড়িয়ে বছর...
এদিকে আসন্ন বিয়েবাড়ির উত্তেজনা...অপরদিকে নাতিসাহেবের বাড়ি ফিরে আসা...সব মিলিয়ে
হুহু করে সময় কাটছে যেন।
অনুষ্ঠান
আসে যেন সময় মেপে। এল আবার হৈহৈ করে মিটেও গেল। নাতনি ও নাতজামাই এর বিদেশে
মধুচন্দ্রিমা যাপন আবার এদিকে ঋজুবাবুর চাকরি পাওয়া... সবই যেন নিয়মানুগ। চোখ বন্ধ করে মনে মনে তিনি
ভাবেন...ব্যাস সব দায় দায়িত্ব তো মিটেই গেল, আর কেন রেখে দেওয়া ভগবান?
লকডাউন
ও উপসংহার
কি
যে আজকাল হয়েছে না! কাগজে টিভি তে প্রায়ই কিসব দেখাচ্ছে টেখাচ্ছে। কি নাকি মস্ত এক
মহামারি আসতে চলেছে... চীন দেশ থেকে তার উৎপত্তি। এক মারণ ভাইরাস এসেছে নাকি, পৃথিবীর মানুষ আর তার
ব্যপ্তি ধ্বংস করতে! একি জ্বালা বলত বাপু, ঘর থেকে বাইরে বেরোনো
বন্ধ, হপ্তায় একদিন কোনমতে
বাজার হাট,
মুখে
একখানি কাপড় এর ঠুলি এঁটে রাখো সারাক্ষন। ছোট বউমা, ঋজুবাবু, ছোটছেলে সব্বাই ঘরে
বসেই কাজ কর্ম সারছে। ওই যাকে বলে ওয়ার্ক ফ্রম হোম। মেয়ে আর নাতনিও বাড়ির থেকেই
অনলাইন ক্লাস নিচ্ছে তাদের ইন্সটিটিউট এর। মাগো একি পড়াশোনার ছিরিছাঁদ এল? এ তো তিনি জীবনে
শোনেননি। তার মধ্যেই শরীর এক্কেবারেই
জুতের নেই আজকাল।
চারিদিকে মৃত্যু মিছিল....শুধু চলে যাবার পালা।
কি জানি... বড় ভয় হয়... এভাবেই কি তাহলে....একদিন! নাহঃ আর ভাবতে পারেন না।
বেলাশেষে
শরীরটা ম্যাজম্যাজ করাতে... দূর ছাই বলে টিভির সামনে থেকে একপ্রকার জোর করে উঠেই পড়লেন তিনি। বেলিকে দিয়ে পায়ে
একটু তেল মালিশ করিয়ে সামান্য দুধ রুটি খেয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন। বেলি রাত্রে
একবার খোঁজ নিতে গিয়ে দ্যাখে তার দিদা ঘুমিয়ে কাদা।
শেষ
রাত্রির দিকে অবিনাশ বাবুর অবয়ব যেন পরিস্ফুট হয়ে উঠল....একে একে তাঁর স্বর্গ গত
শাশুড়ি মাতা...শ্বশুরমশাই...দেওর... বড়
ননদ.. সবাইকে যেন দেখতে পেলেন। ঘর আলো করে বসে ...পুরোনো দিনের মত আড্ডার ছলে। শীত
শীত করে উঠল হঠাৎ, জৈষ্ঠ্যের মাঝামাঝি এত ঠান্ডা
হাওয়া আসে কোত্থেকে? ধীরেধীরে
পায়ের কাছে রাখা চাদরটা টেনে নিলেন।
অশ্রুত
শংখ ধ্বনির সাথে সাথে... ভেসে এল গুরুগম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণ
অসতো
মা সদগোময়...
তমসো
মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যুঃ
মা অমৃতঙ্গময়...
ওঁ
শান্তি... শান্তি... শান্তি....হি...!
----------------------------------------------------------------------------সমাপ্ত।
কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন