সম্পাদকের কলমে


সম্পাদকের কলমে

যুদ্ধটা কৃষকদের। সরকারের আনা আইনের বিরুদ্ধে। সরকারের সাথে। যে দেশে ৭০% মানুষ কোন না কোনভাবে কৃষির সাথে জড়িত, সেদেশে কৃষকদের কে কে সমর্থন করলো আর করলো না, তাতে কৃষক আন্দোলনের বিশেষ কিছু যাবে আসবে না। সমগ্র কৃষক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হলে প্রয়োজনে সরকার পতনও ঘটে যেতে পারে। সমস্যা সেখানে নয়। সমস্যা হল সমগ্র কৃষক সমাজের ঐক্যবদ্ধ হওয়া নিয়ে। এবং সেই ঐক্য মজবুত রাখা নিয়ে। সরকারপক্ষ তার সমস্ত মেশিনারি দিয়ে কৃষক সমাজকে বিভক্ত রাখার চেষ্টা করবে। সেটাই সরকারের কাজ। সরকারী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলও তার সকল শক্তি নিয়োগ করবে কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে। এবং রাজনৈতিক বল প্রয়োগ করে কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধে লাগাতার অপপ্রচার চালিয়ে যাবে। বিগত বছরের ২৬শে নভেম্বর থেকেই যা করা হচ্ছে। এবং আরও জোরদার অপপ্রচার শুরু হয়ে গিয়েছে ২৬শে জানুয়ারীর লালকেল্লা ষড়যন্ত্রের পর থেকে। ফলে ছবিটা এখন পরিস্কার। একদিকে কৃষক সমাজের একটা বড়ো অংশের, রাজপথে দুর্বার কৃষক আন্দোলন। অন্যদিকে সরকার তার সমস্ত শক্তি নিয়ে। এবং সরকারী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল, তার রাজনৈতিক শক্তির দৌলতে লাগাতার অপপ্রচারের কার্যক্রম নিয়ে। এই দুই মুখোমুখি পক্ষের মাঝে আমি আপনি কখন কোন পক্ষে, সেটা খুব একটা জরুরী বিষয় নয় বলেই মনে হয়।

 

যেটা জরুরী বিষয়। সেটি হলো। আমার আপনার এই কৃষক আন্দোলন সম্বন্ধে ব্যক্তিগত অবস্থান কি, সেটি। তাতে কৃষক আন্দোলনের গতি প্রকৃতি পরিণতি কোন কিছুই নির্ভর করছে না ঠিক। কিন্তু নির্ভর করছে আমার আপনার আত্মপরিচয়ের আসল ছবিটি। এই যে আমি আপনি। কেউ অশিক্ষিত। কেউ স্বল্প শিক্ষিত। কেউ উচ্চ শিক্ষিত। এবং অনেকেই অর্ধশিক্ষিত। আমরা এই আন্দোলনলকে কিভাবে দেখছি। বুঝছি। জানছি। এবং অনুধাবন করছি। সেখানেই কিন্তু আমাদের আত্মপরিচয়ের স্বরূপ। অনেকেই মুখে কুলুপ এঁটে থাকায় বিশ্বাসী। থাকবও। অনেকেই সরব হতে ভালোবাসি। হই্। কেউ একজনের পক্ষে তো কেউ আর একজনের পক্ষে। কিন্তু যারা মুখে কুলুপ এঁটে থাকায় পারদর্শী, তারাও অন্তরে কোন না কোন একটি পক্ষের হয়ে ওকালতি করতে থাকি। ফলে খোলা আকাশের নীচে হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় দিল্লীর সীমানায় ব্যারিকেডের ওপারে রাজপথে অবস্থানরত কৃষকদের আন্দোলনের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে আমরা সকলেই। কেউ ভোকাল। কেউ সাইলেন্ট।

 

এখন আন্দোলনের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে আমাদের এই অবস্থান আমাদেরকে প্রথমেই যে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, সেটি হলো। আমরা কে কতটা সৎ। একজন অসৎ মানুষ যে কখনোই চলমান কৃষক আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়াবেন না। সেটা কিন্তু চোখ বুঁজেই বলে দেওয়া যায়। কিন্তু তাই বলে একথাও বলা যায় না যে কৃষক আন্দোলন বিরোধী সকলেই অসৎ। তার একটা অন্যতম কারণ এই, আমাদের দেশে স্বাধীন ভাবে চিন্তা করার মতো ক্ষমতা খুব বেশি মানুষের থাকে না। প্রায় অধিকাংশ মানুষই প্রচারের দাসত্ব করে থাকে। কি অশিক্ষিত। কি অর্ধশিক্ষিত। কি শিক্ষিত। ফলে এই শ্রেণীর মানুষের একটাই ভরসা। প্রচার যন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ। এবং তাঁরা সেটাই করে থাকেন। কোন না কোন পক্ষের প্রতি অন্ধভক্তিই এই কাজে সহায়তা করে থাকে। এবং এই অন্ধভক্তি এমনই সুদৃঢ় যে নিজের ঘাড়ে কোপ না পড়লে ভক্তি টলে না। বস্তুত চলমান কৃষক আন্দোলনে অংশ নেওয়া প্রায় সকল কৃষকের ক্ষেত্রেই এই ঘটনাটিই ঘটে গিয়েছে। এই কৃষি আইন পাশ হওয়ার আগে বিগত সাত বছরে সরকারের আনা একাধিক অন্যায্য আইন প্রয়োগের সময়েও এই কৃষকদের সরকারের প্রতি অন্ধবিশ্বাসে টাল খায়নি। কারণ সেই আইনগুলি সরাসরি তাদের জীবনজীবিকায় মারণ কোপ বসায় নি। তাই তাঁরা সরকারের প্রতি তাদের অন্ধবিশ্বাসের ধারাটিকে মজবুত করেই ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু এইবার, নতুন এই কৃষি আইন চালু হতেই সেই সুদৃঢ় অন্ধবিশ্বাসে এমন ফাটলই ধরলো যে, আজ অধিকাংশ কৃষকই সরকার বিরোধী অবস্থানে পৌঁছিয়ে গিয়েছেন। কারণ এই আইন সরাসরি তাদের জীবনজীবিকাকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কথায় আছে আপনি বাঁচলে বাপের নাম। ভারতবর্ষের কৃষকরা আজ সেটি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। তাই রাজপথই আজ তাদের একমাত্র আশ্রয়। একমাত্র অস্ত্র।

 

অন্ধবিশ্বাস যখন ভাঙে তখন এইভাবেই বন্যার জলে বাঁধ ভাঙার মতো করেই ভেঙে পড়ে। এখন কৃষক আন্দোলন আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের স্বরূপ উন্মোচনেও একটা বড়ো ভুমিকা রেখেছে। এই আন্দোলন প্রমাণ করে দিচ্ছে, আমরা কে কতটা অন্ধভক্ত। আর কে কতটা প্রকৃত শিক্ষিত। যাঁর স্বাধীন ভাবে চিন্তা করার সক্ষমতা রয়েছে। সমাজের পক্ষে মাঝে মাঝে এই ঝাড়াঝাড়ির খুব দরকার। কুলোয় করে ঝাড়ার মতোন, আমরা দুই পক্ষে ভাগ হয়ে যাচ্ছি। কে অন্ধভক্ত। আর কে চক্ষুষমান। এটার সত্যিই খুব দরকার ছিল। যাঁরা সমাজ ও সমকাল নিয়ে পড়াশুনা করেন। গবেষণা করেন সমাজ ও রাজনীতির সমকালীন ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে। তাঁদের পক্ষে এ এক মেঘ না চাইতেই জল। তাঁরা দেখতে পারছেন সমাজের সামগ্রিক চিত্রটা। বুঝতে পারছেন সেই চিত্রের বাস্তবিক সত্যের স্বরূপ।

 

এখন প্রশ্ন, আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? আমাদের নিজেদেরকে? দিল্লীর সীমান্তে অবস্থানরত এই কৃষক আন্দোলনের পরিণতি যাই হোক না কেন। এই আন্দোলন আমাদেরকে এক যুগসন্ধিক্ষণের আগাম বার্তা দিচ্ছে। সেই যুগসন্ধিক্ষণের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আমরা কি চিনে নিতে পারছি নিজেদের স্খলন পতন কিংবা অর্জন? উপলব্ধি করতে পারছি নিজেদের ব্যক্তিস্বরূপের একান্ত উন্মোচনকে? আমাদের ব্যক্তিস্বরূপের একান্ত এক উন্মোচন তো হচ্ছেই। কুয়াশা কেটে যেতে থাকা ভোরের মতো। হ্যাঁ, সেই ঘটনা স্বীকার করা না করা, প্রত্যেকের মৌলিক অধিকারের বিষয় অবশ্যই। চলমান কৃষক আন্দোলনের এই এক বড়ো সাফল্যের দিক। আজ আর নিজের কাছে নিজেকে লুকিয়ে রাখার উপায় থাকছে না। যে কাজটি আমরা বিশেষ দক্ষতার সাথে বছরের পর বছর ধরে চালিয়ে এসেছি। আর এসেছি বলেই হয়তো আজ শুধু কৃষকরাই পথে বসে নি। বাকিরাও সময়ের সাথে সাথে একে একে বসতে চলেছে। কেউ একটু আগে কেউ একটু পড়ে টের পাবে শুধু।

 

কৃষক আন্দোলনের পক্ষে বিপক্ষে থাকা নিয়ে আমরা নিজেদের সাথে অন্যদেরকেও চিনে নিতে পারছি। কার দৌড় কত। কে কোন দরের। এবং তাই নিয়ে সমাজে জল ঘোলাও কম হচ্ছে না। কে কি টুইট করলো। কে কার কোন টুইট রিটুইট করলো। কে কি বাইট দিল। ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার কৃষক আন্দোলনের উপরে নেমে আসা রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নের পক্ষে বিপক্ষে থাকার ভিতর দিয়েও আত্মস্বরূপের উন্মোচন হচ্ছে। বেশ দ্রুতই। এর ভিতর আবার অনেকে আছেন। যাঁদের সাহেব মেমদের কথার উপরে বিশ্বাস বেশি। ফলে ভারতীয় কৃষক আন্দোলন ও সেই আন্দোলন দমনে কেন্দ্রীয় সরকারের ভুমিকা নিয়ে সাহেব মেমরা কে কি বলছেন, তার উপরেও অনেকের গভীর বিশ্বাস। এবং সেই মতো নিজেদের চিন্তা ভাবনা সমর্থন বিরোধীতার ভুখণ্ড সাজিয়ে নিচ্ছেন।

 

এই সব খণ্ড খণ্ড ছবিগুলি সামগ্রিক ভাবে একটা ছবি সুস্পষ্ট করে তোলে। সেটি হলো আত্মনির্ভর মানসিকতার অভাব। অপুষ্টির মতো এই একান্ত মানসিক পরনির্ভরতাও এক রোগ। এই রোগ সমাজের ভিতরে যত গভীরে শিকড় বিস্তার করবে এবং যত ব্যাপক ছড়িয়ে পড়বে একটি দেশ একটি সমাজ ততই দুর্বল হয়ে পড়বে। রাজনৈতিক শক্তিগুলি এই মানসিক পরনির্ভতার ভিতের উপরেই তাদের রাজত্ব বিস্তার করে। এবং নিজেদর শক্তি ও সম্পদ বৃদ্ধি করে নেয়। তাতে রাজনৈতিক শিবিরগুলি আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে ঠিকই। কিন্তু জাতি ও দেশ তত বেশিই দুর্বল হয়ে পড়ে। চলমান কৃষক আন্দোলনের দীপ্তিতেও যদি আমাদের চেতনার রুদ্ধ দ্বার না খোলে, তবে সেটা হবে আত্মহত্যার সামিল। এই কৃষক আন্দোলন সফল হোক বা ব্যর্থই হোক। জাতির পক্ষে একটা স্থায়ী ছাপ রেখে যাবে নিঃসন্দেহে। সেই ছাপ আমাদেরকে নিজেদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে আমাদেরকে আত্মনির্ভর করে তুলতে পারলে, সেটাই হবে এই কৃষক আন্দোলনের ঐতিহাসিক ভুমিকা।

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন