রংরুট: আমাদের সমাজ সংসারে
মেয়ে হয়ে জন্মানো সত্যিই কি বিড়ম্বনা বলে মনে হয়েছে কখনো জীবনের কোন পর্বে?
কাবেরী
রায়চৌধুরী: আমার পারিবারিক গঠনটি ছিল অত্যন্ত আধুনিক ও ব্যালেন্সড। সেখানে কখনো লিঙ্গ বৈষম্যের বিষয়টি দেখিনি কিন্তু বন্ধুদের অনেকের পরিবারেই তা দেখেছিলাম।
পরবর্তী সময়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে অনেকসময়েই মনে হয়েছে পুরুষের স্বাধীনতা
অনেকটাই অবাধ।
রংরুট: শৈশব কাটিয়ে কৈশরে পৌঁছে ছেলে মেয়েদের চলা ফেরা ওঠা
বসার মধ্যে পার্থক্য গুলো প্রাথমিক ভাবে কেমন লাগতো আপনার?
কাবেরী রায়চৌধুরী: কৈশোরে পৌঁছেও তেমন পার্থক্য অনুভব করিনি কারণ বালিকা
বয়স থেকেই জেনে গেছিলাম আমাদের প্রত্যেকের করণীয় কী এবং স্বাধীনতা কখনো অবাধ হতে
পারেনা। একটি ছেলের ও মেয়ের শারীরিক গঠন প্রকৃতিগতভাবেই পৃথক। সেই হিসাবে কৈশোরে
উত্তীর্ণ হয়ে যদি আমি বলি দাদা খালি গায়ে ঘুরতে পারে আমি পারিনা কেন, তা নিতান্তই অর্বাচীন প্রশ্ন হতো। কিন্তু চলাফেরার
স্বাধীনতা, পড়াশোনার স্বাধীনতা, বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশায় কোনোরকম বাধানিষেধ ছিলনা। কারণ
ছোট থেকেই প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রাপ্ত হয়ে বুঝে গেছিলাম কতটা কার সঙ্গে মেলামেশা করা
উচিত। অথবা ভালো মন্দর শিক্ষা পাঠ থাকার জন্যই কখনোই অসুবিধা হয়নি।
রংরুট: আমাদের বাঙালি সমাজে একেবারে সংসারের ভেতরেই ছেলে
মেয়েদের মধ্যে ছোট থেকেই একটা বৈষম্য মূলক আচরণের ধারাবাহিকতা চলে আসছে আবহমান
কাল ব্যাপী। পরিতাপের কথা, যে মেয়েটি নিজের বাড়িতেই এই বৈষম্যের পরিবেশে বেড়ে
ওঠে, সেই কিন্তু
গৃহকর্ত্রীরূপে আবার নিজের সংসারেও এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। এই বিষয়টি আপনাকে
কতটা ও কিভাবে নাড়া দেয়?
কাবেরী রায়চৌধুরী: শাস ভি কভি বহু থি, এক
জনপ্রিয় ধারাবাহিক। ঠিক এই জায়গা থেকেই
যদি আমরা দেখি তাহলে দেখবো এই ধরনের
বৈষম্যের মূল লুকিয়ে আছে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার মধ্যে। যে বউটির কোনো কর্তৃত্ব তার
স্বামী বা শ্বশুর বাড়িতে খাটেনি তারমধ্যে একপ্রকার সাপ্রেশন থাকবেই। সে দীর্ঘদিন
শোষিত বঞ্চিত অতএব তারমধ্যে শোষক হবার বীজটি প্রোথিত হয়েই গেছে। ফলত পুত্রবধূই
একমাত্র সদস্য যাকে সে শোষণের অধিকার পায়।
অথচ উল্টোটা হওয়া উচিত ছিল। যথেষ্ট
যন্ত্রণাদায়ক বিষয়টি। আসলে পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক মহিলারাই।
রংরুট: পিতৃতন্ত্রের
যে ঘেরাটোপে নারীর জীবন, সেইটি আপনাকে ব্যক্তিগত ভাবে কতটা প্রভাবিত করে?
কাবেরী রায়চৌধুরী: কোনোরকম শর্ত আমি আমার ওপরে চাপিয়ে দিক কেউ যেমন পছন্দ
করিনা তেমন অন্য কারোর ওপরে শর্ত চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে আমি নই। পিতৃতন্ত্রের এই
ঘেরাটোপ একপ্রকার তালিবানি শাসন যা অবরুদ্ধ করে নারীর সার্বিক বিকাশ। পিতৃতন্ত্রের
মূল সুরটির মধ্যেই আছে পুরুষের
স্বেচ্ছাচারিতার সমর্থন ও নারীর অবদমন। নারীকে একটি যৌন পুতুল ব্যতিরেকে অন্যকিছু
ভাবার অবকাশ দেয়না পিতৃতন্ত্র। আজ থেকে কয়েকশো বছর পিছিয়ে গেলে নারীর ও পুরুষের
জীবনচর্চাটি লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবো জীবনযাপনে কী অসম্ভব ব্যবধান! নারীর
শিক্ষার অধিকার নেই। নারীর জীবন শুধুমাত্র পুরুষের যৌন দাসত্ব স্বীকার করে নেওয়া। glorified prostitution! সন্তান ধারণ পালন, গৃহকর্ম
সুনিপুণ ভাবে পালন! তার শখ
থাকতে নেই। তার নিজস্ব ইচ্ছা থাকতে নেই। সে একজন সেবাদাসী ব্যতিরেকে অন্য কিছু নয়।
অন্যদিকে পুরুষের বহুগমন, স্বেচ্ছাচার।
পৃথিবীতে সমস্ত সুখ আহ্লাদ তার জন্যই যেন বরাদ্দ। সেখানে স্পষ্টত নারীর কোনো
অধিকার স্বীকার করেনা পুরুষতন্ত্র। সুতরাং এই ধরনের জীবনযাপন যে কতটা অসুস্থ তা
অনুমেয়। তা আমাকে ভাবায় কারণ অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন না থাকার ফলে বহু নারীর জীবন আজও
ভয়াবহ।
রংরুট: নারীর
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যে খুবই জরুরী সে নিয়ে আজ আর বিতর্কের অবকাশ নেই। কিন্তু
দুঃখের সাথে লক্ষ করা যায় অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী নারীও সমাজ সংসারে
সঅভিভাবকত্ব অর্জনে বাধা প্রাপ্ত হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। এই বিষয়ে আপনার অভিমত
কি?
কাবেরী রায়চৌধুরী: নারী প্রকৃতিগতভাবেই
স্রষ্টা। সে সন্তান ধারণ করে পালন করে এবং সংসারের কাঠামোটিকে পূর্ণতা দিতে চায়।
যার ফলে একজন কর্মরতা নারী বাইরের জগত সামলেও সংসারে পূর্ণ দৃষ্টি দেয়। এবং এই
কারণেই অবাধ স্বাধীনতা যার থেকে স্বেচ্ছাচারীতার সম্ভাবনা থাকে তা এড়িয়ে যায়। স্ব অভিভাবকত্ব অর্জনে বাধাপ্রাপ্ত হয় ঠিক এই
জায়গা থেকেই। সমাজ বা পরিবার নারীর আধিপত্য মেনে নিতে এখনো কুন্ঠিত। সংসারে শান্তি
বজায় রাখার জন্যেই বেশিরভাগ সময়ে অধিকাংশ মহিলাই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলেও
কম্প্রোমাইজের পথে হাঁটেন। অন্যদিকে আধুনিক এই সময়েও একজন নারী একা বসবাস করবে তা
সমাজ অনুমোদিত নয়। একা মহিলাকে আজও অনেক জায়গায় বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়না শুধুমাত্র
পুরুষ অভিভাবক নেই বলে! দৃষ্টিভঙ্গি
পরিবর্তন করতে হবে আমাদের। নারীকে অর্জন করতে হবে পূর্ণ মানুষের অধিকার। আমরাই
সমাজ। আমরাই সমাজ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।
রংরুট: কথায় বলে
সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। কিন্তু এর পেছনে পুরুষতন্ত্রের কৌশলগত অবস্থানটি
সম্বন্ধে সাধারণ ভাবে আমরা কতটা ওয়াকিবহাল?
কাবেরী রায়চৌধুরী: বাস্তবিকই আমরা ওয়াকিবহাল নই অনেকেই।
খুব সুচতুরভাবে পরিবার সমাজ আমাদের শিরায় ধমনীতে ঢুকিয়ে দিয়েছে এমন কিছু
বিষয় যা নিয়ে অনেকেই খুশি। এখনো অনেক মেয়েদের বলতে শুনি, এই আপ্ত বাক্যটি। আজও বিবাহবিচ্ছেদের কালে মেয়েদের দায়ী করা হয় এই কথা বলে।
যেন মেয়েটির উচিত সমস্ত অন্যায় সহ্য করেও সংসার টিকিয়ে রাখা। পিতৃতন্ত্রের ভয়াবহ
রূপটি এতটাই ডিপ্লোম্যাটিক যে অনেকেই এর চাতুর্যের জায়গাটি অনুধাবন করতে পারেনা। "তোমাকে ভাল মেয়ে হতে হবে। লক্ষ্মী বউ হতে হবে। তোমার হাতেই সংসারের
উন্নতি...ইত্যাদি এই জাতীয় বাক্যের মধ্যে সুচতুরভাবে ফ্যাব্রিকেটেড থাকে
নিয়ন্ত্রণ।
রংরুট: পেশাগত জগতে
একজন নারী কতটা স্বাধীন আর কতটা পরিস্থিতির শিকার, সেটা নারীর ব্যক্তিত্বের উপর
কতটা নির্ভর করে, আর
কর্মজগতের বাস্তব অবকাঠামোর উপর কতটা নির্ভর করে?
কাবেরী রায়চৌধুরী: সমগ্র পৃথিবীই মূলত
পুরুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কর্মক্ষেত্রেও পুরুষ ও মহিলার ratio দেখলেই তা বোঝা যাবে। স্বভাবতই পুরুষ প্রধান
কর্মক্ষেত্রে বহু মহিলাই অন্যায় যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। অনেকেই কম্প্রোমাইজের
রাস্তাকেই পদোন্নতির চাবিকাঠি হিসাবে মেনে নেয়। এই ধরনের বৈষম্যের গল্প প্রায়ই
প্রকাশ্যে আসে। সে ক্ষেত্রে অনেক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মেধাবিনীকে যথেষ্ট পরিমানে বেগ
পেতে হয়। পুরুষের দীর্ঘকালীন স্বেচ্ছাচারিতার ও বহুগামীতার চরিত্রটি এক্ষেত্রে শোষকের
ভূমিকা পালনে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি লাঞ্ছনা প্রতিরোধে
বিভিন্ন আইন প্রনোয়ন করা হলেও তার সুবিধা কতটা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
সমস্যাটি বাস্তবের নিরিখে দেখতে হবে। ধরা যাক, একটি মেয়ের অব্যবহিত বস তার কাছ থেকে যা কামনা করছে তাতে সম্মত নয় মেয়েটি।
এরপর শুরু হয় তাকে প্রতিনিয়ত অপমান করা, তার সামান্যতম ভুল ত্রুটি গুলো নিয়ে অপদস্থ করা এবং অফিসের পরিস্থিতিই
এতটাই অপ্রিয় করে তোলা যাতে মেয়েটির কাছে দু'টো পথ খোলা থাকবে। এক, চাকরী
ছেড়ে দেওয়া, দুই, কম্প্রোমাইজ করা। অব্যবহিত বস সম্পর্কে তার উর্ধতনের কাছে অভিযোগ জানালে
অধিকাংশ সময়েই তা মেয়েটির বিরুদ্ধে যায়। তাই নিজের মেধা বুদ্ধির ওপর আত্মবিশ্বাস
রাখতে হবে এবং এই আত্মবিশ্বাসই জয়ের মূল চাবিকাঠি। মনে রাখতে হবে আপনার উন্নতির
পথটি হয়ত কঠিন হল কিন্তু পথ বন্ধ করার ক্ষমতা কারোরই নেই। কারণ পৃথিবীতে সব পুরুষই
খারাপ বা শোষক অথবা মানসিক অসুস্থ ও প্রতিহিংসাপরায়ন নয়। যোগ্যতমকে শেষ পর্যন্ত
জায়গা দিতেই হয়।
রংরুট: এই প্রসঙ্গে
আমাদের সমাজ এ বাস্তবতায়লিঙ্গ বৈষম্যের বিষয়টি একজন সমাজ সচেতন মানুষ
হিসাবে আপনাকে কতটা বিচলিত করে। সেই বিচলনের রূপ ও বিকাশ সম্বন্ধে যদি আমাদের
অবহিত করেন!
কাবেরী রায়চৌধুরী: অবশ্যই বিচলিত করে। কারণ কর্মক্ষেত্রে এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন আমিও হয়েছি।
লিঙ্গ বৈষম্য এমন একটি বিষয় যা পুরুষতন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আমূল বসে আছে জগদ্দল
পাথরের মত। আর এই পুরুষতন্ত্র আবারও বলছি
নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত যদি নারীরা তার বাহক ও ধারক না হত। যদি মেয়েরা পরস্পরের পাশে
থাকতো এই অপ্রিয় বিষয়টিতে তাহলে মেয়েরা কর্মজগতে অনেকদূর এবং অনেকে এগিয়ে যেতে
পারতো। শিল্প সাহিত্য চিত্রকলা এই জগতে কেন আজও পুরুষ নারীর ratio সমানুপাতিক নয়? তাহলে কি ধরে নিতে হবে
পুরুষ ও নারীর মেধার মধ্যেও লিঙ্গ অবস্থান করছে? না। বিজ্ঞান তা স্বীকার
করেনা। সমস্যা, নিহিত লিঙ্গ বৈষম্যের ভেতরে।
অনাকাঙ্ক্ষিত চাওয়া পাওয়ার বিষম অঙ্কের মধ্যে অনেক মেয়েই হারিয়ে যায় বিপর্যস্ত
হয়ে। অথচ সৃষ্টিশীল মানুষের এই হীন দীন মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে লিঙ্গ নির্বিশেষে
মেধাকেই প্রায়োরিটি দেওয়া উচিত। অথচ তা যে হয়না তার প্রমাণ যথেষ্ট। অনেক অপ্রিয়
সত্য মেয়েরা আজও গোপন করে আত্মসম্মান নিয়ে এগিয়ে চলেছে। আগে ধর্ষিতা ও তার পরিবার গোপন করে যেত এই
অন্যায়, বর্তমানে মেয়েদের কণ্ঠস্বর
আওয়াজ তুলেছে। ফলে অপরাধ গুলো প্রকাশ্যে আসছে। আমরা সমাজের অন্ধকার দিকটা জানতে
পারছি। কিন্তু কর্মজগতের অন্যায় প্রস্তাব ও দুর্নীতি গুলো ক'জন মহিলা সোচ্চার হয়? হয়না তার কারণ এই সমাজ।
প্রথমেই মেয়েরাই অভিযোগকারিণীর দিকে আঙুল তুলবে। তার চরিত্র হনন ও সমালোচনায় মুখর
হয়ে দোষী স্যবস্ত করবে তাকেই। এই ধরনের সমালোচনা গুলোই কমন, যেমন, কই
আমাদের সাথে তো এমন হয়না? (হয়ে থাকলেও), মেয়েটার সাজগোজ দেখেছো? অমন ভাবভঙ্গী করলে ক'জন পুরুষের মাথার ঠিক থাকে? হয়ত যা চেয়েছিল তা পায়নি
তাই মিথ্যে অভিযোগ আনলো... ইত্যাদি ইত্যাদি।
ইনিয়েবিনিয়ে অন্যায় আব্দারের সম্মুখীন হয়নি জীবনে একবারও এমন মহিলা খুঁজে পাওয়া
দুষ্কর। কিন্তু সমাজে সবটাই খারাপ এই ব্যাপারটিও ভুল তাহলে মাথা তুলে কাজ করা
সম্ভব হতোনা অনেক মেয়েরই। সব পুরুষও যেমন খারাপ নয় সব মহিলাও! সমাজে
ভালোমন্দ উভয়ই আছে। ব্যক্তিত্ব নিয়ে মেধা যোগ্যতার ওপর ভরসা রাখলে যুদ্ধটা কঠিন
হলেও এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।
রংরুট: বর্তমান সমাজে
নারী নির্যাতনের বিষয়টি কি রাষ্ট্র ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে বলে
মনে হয় আপনার?
সামাজিক
ভাবে আমাদের ভূমিকাই বা কি হওয়া উচিত এই বিষয়ে?
কাবেরী রায়চৌধুরী: রাষ্ট্রের সদিচ্ছা থাকলে নারী নির্যাতন অনেকটাই রুখে দেওয়া যায়, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। যথাযথ আইন প্রনোয়ন ও তা বলবত করা এই
দুটি বিষয় assure করা গেলে নারী নির্যাতন
অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রিত হবে। বিশেষত বধূ নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণের হুমকি ও চেষ্টা, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা সিকিওর করা ইত্যাদি বিষয়ে কঠোর
আইনি প্রনোয়ন ও তা বলবত মহিলাদের অনেকখানি
সুরক্ষা দেবে। এটি রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। রাষ্ট্রের আরেকটি বড় ভূমিকা, পিছিয়ে
পড়া দুর্বলতর নারীদের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা, তাদের হাতে প্রয়োজনীয় অর্থ তুলে দেওয়া ( যেমন কন্যাশ্রী
প্রকল্প) এতে মেয়েদের শিক্ষা ক্ষেত্রে
প্রতিবন্ধকতা দূর হয়েছে। চাকরীর ক্ষেত্রেও কিছু পরিমানে সংরক্ষণের পক্ষপাতী।
আর্থিক স্বনির্ভর নারী তার ওপরে হওয়া নির্যাতন নিজেই রুখে দিতে পারে তাহলে। স্বল্প
বা বিনা সুদে লোন ; ক্ষুদ্র
ব্যবসায়ে নিযুক্ত করতে পারে অনেক মহিলাই। বর্তমানে রাষ্ট্র পরিচালনায় নিরপেক্ষতার
অভাব সর্বত্র পরিলক্ষিত। বিভিন্ন যৌন নির্যাতনে নেতা মন্ত্রী বা দলীয় কর্মীরা
জড়িয়ে পড়ার কারণে রাষ্ট্রের দায়িত্ব রাষ্ট্র পালন তো করেইনা উপরন্তু অভিযোগকারনীর
জীবন দুর্বিষহ, তা আমরা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা
করছি। রাষ্ট্রের কাজ, প্রতিটি
রাজনৈতিক দলের কাজ আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হোক এবং
আইনি সাহায্য বিনামূল্যে পাবার অধিকারটি বাধ্যতামূলক করা হোক নির্যাতিতের
জন্য। সামাজিক দায়িত্বটি এ বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি প্রতিবেশী সচেতন থাকলে অঞ্চল ভিত্তিক
নির্যাতন বন্ধ করা যায়। কিন্তু আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার আত্মকেন্দ্রিক রূপটি এতটাই
প্রবল যে " এটা আমার দায় নয়" বলে এড়িয়ে যাই আমরা। রাষ্ট্রের চেয়েও সাধারণ নাগরিকদের দায়িত্ব অনেক
বেশি বলে মনে করি। পরিবারের দায়িত্ব আরো বেশি। পরিবারের কন্যা অথবা বধূটি
নির্যাতিত হলে সর্বাগ্রে পরিবারের তার পাশে থাকা উচিত। কন্যা সম্প্রদানের পরেও পরিবারের দায়িত্ব থাকে।
ভন্ড সমাজের ভ্রান্ত সম্মানবোধের দোহাই দিয়ে অনেক পিতামাতা তাদের অত্যাচারিত
কন্যাকে মানিয়ে নিয়ে সংসার করার পরামর্শ দেয়। অবশেষে আত্মহনন বা খুন হয়ে গেলে তারা
আইনের দ্বারস্থ হয়। আমাদের সকলকে নিয়ে সমাজ। আমাদের সামাজিক দায়িত্ব সম্বন্ধে
অবহিত হতে হবে ছোট থেকেই।
রংরুট: বাড়ির বাইরে মেয়েদের
সুরক্ষার বিষয়টি আজও কেন এত অবহেলিত! কি মনে হয় আপনার? দেশের প্রশাসনের শীর্ষপদে
মহিলারা নেতৃত্ব দিলেও অবস্থার উন্নতি হয় না কেন? গলদটা রয়ে যাচ্ছে কোথায়?
কাবেরী রায়চৌধুরী: পুরুষ শাসিত সমাজে মেয়েরা ঘরে বাইরে কোথাও সুরক্ষিত নয়।
বহু জায়গায় পরিবারের মধ্যেই মেয়েরা যৌন অত্যাচারের শিকার। বাইরের জগতও ততোটাই
অনিরাপদ। এ ক্ষেত্রেও সামাজিক দায়িত্ব সকলেই যথাযথ পালন করলে সুরক্ষিত থাকতে পারে
মহিলারা। পুলিশ দিয়ে সমস্ত অপরাধ কন্ট্রোল
করা যায়না এবং তা সম্ভব নয়। সচেতনতা
বৃদ্ধি। এবং তা বাল্য কৈশোর থেকেই এই ধরনের শিক্ষা দিতে পারে একমাত্র পরিবার ও
বিদ্যালয় গুলো। সমস্ত সমস্যার মূল যৌনতা, এবং এই সম্বব্ধে অর্ধেক জ্ঞান।
যৌনতা কী কেন এই বিষয়ে ধোঁয়াটে ধারণার শিকার সমাজের একটি বৃহত্তর শ্রেণী। তাদের কাছে
একটি মেয়ে এবং তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খাদ্য খাদকের সীমিত গন্ডীর মধ্যেই আবদ্ধ। এই
বিষয়ে সুস্থ জ্ঞান, সুচেতনার
জাগরণ ; আমাদের সামাজিক পারিবারিক
দায়িত্ব। মহিলারা রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনায় শীর্ষ স্থানে থাকলেও সমাজ যেহেতু
পুরুষ প্রধান তাই অনেকসময় ইচ্ছা থাকলেও রাজনৈতিক কারণেই কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারেনা
তারা। অথচ এটি তাদের দায়িত্ব। রাজনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত করতে না পারার কারণেই শীর্ষ
স্থানে থাকা সত্ত্বেও এই অব্যবস্থা আজও চিন্তার কারণ।
রংরুট: আন্তর্জাতিক
নারীদিবস পালন আর সারা বছর নারী নির্যাতনের ধারাবাহিত ব্রেকিং নিউজ, এর মধ্যে সমন্বয় হবে
কি করে?
মেয়েদের
এই বিষয়ে কি কর্তব্য আপনার মতে?
কাবেরী রায়চৌধুরী: আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন বর্তমানে ফ্যাশনে পরিণত
হয়েছে। ঠান্ডা ঘরে বসে তথাকথিত শিক্ষিত দর্শকদের সামনে বসে বক্তৃতা দেওয়া এবং
রেস্তোরাঁতে ডিনার করার মধ্যেই তা শেষ হয়ে যায়। অথচ ইচ্ছা করলেই less privileged মহিলাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির
কাজটি করা যায়। তাদের সমস্যা শোনা এবং সে বিষয়ে সেমিনারে আলাপচারিতা, আইনি পরামর্শ দেওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন কাজ করা যায়। আজও
পুরুষ ও নারীর বেতনে অসাম্য বিশেষত অসংগতি শ্রমিকে শ্রেণীর মধ্যে যে বিভেদ তা দূর
করতে পারেনি নারী দিবস। বেতনে অসাম্য, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নিয়েই মহিলা শ্রমিকরা মুখ বুঁজে কাজ করে যাচ্ছে! বিভিন্ন নারী সংগঠন গুলোর মধ্যেই অরাজকতা প্রকাশ্যে
বেরিয়ে আসে মাঝেমাঝে। এমনই একজন নারী অধিকার নিয়ে ব্যস্ত থাকা আত্মীয়াকে দেখেছি
যিনি বৃদ্ধা শাশুড়িকে ছাদে চিলেকোঠায় নির্বাসিত করেছেন! এই দ্বিচারণ থেকে যতদিন না মেয়েরা বেরিয়ে আসবে ততদিন নারীর পূর্ণ বিকাশ ও
মুক্তি সম্ভব নয়। নারী মুক্তির চাবিকাঠি নারীরই হাতে।
রংরুট: সমাজে নারীর
সম্মান প্রতিষ্ঠিত না হলে কোনো দেশ জাতি সমাজ উন্নত হতে পারে না। ভবিষ্যতের দিকে
তাকিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?
কাবেরী রায়চৌধুরী: আশাবাদী না হলে এগিয়ে যাওয়া যাবেনা। তাই আমি আশাবাদী। আমাদের ঠাকুমা দিদিমা
বা তাদেরও পূর্ববর্তী নারীরা যে অন্ধকারাচ্ছন্ন দিন অতিবাহিত করেছেন, সন্তান প্রসবের যন্ত্র হিসাবে শুধু সন্তান উৎপাদন করে
গেছেন, গৃহেই যৌন লালসার শিকার হয়েছেন
অনেকে, কখনো অত্যাচার চূড়ান্ত হলে বাড়ি
থেকে পালিয়ে দেহ ব্যবসায়ে নাম লিখিয়েছেন সেই অবস্থা থেকে আজ অনেকটাই মুক্তি পেয়েছে
নারী। শিক্ষার সমানাধিকার, চাকরীর
অধিকার পেয়েছে মেয়েরা। ভবিষ্যতে মেয়েরাই তাদের নিজস্ব দু:খ অবহেলা, দায়িত্ব কর্তব্য গুলো বুঝে নিয়ে মেয়েদের পাশে থাকবে এই
বিষয়ে আশাবাদী। পুরুষেরাও দিন বদলের সঙ্গে পাল্টাচ্ছেন অনেকাংশেই। চারপাশে অনেক
পুরুষ নারীর অধিকার সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। ঘরেও স্ত্রীর সমমর্যাদা রক্ষা করছেন।
ভবিষ্যতে আরো বেশি সচেতন হব আমরা এই বিষয়ে আশাবাদী আমি।
কাবেরী রায়চৌধুরীর জন্ম কলকাতায় ১৯৭২ সালের ২৩শে
ফেব্রুয়ারি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস অনার্স স্নাতক। লেখালেখির হাতেখড়ি
বাল্যেই। কিন্তু লেখক হবার স্বপ্ন দেখেননি কখনওই। সহস্রাব্দের শুরুতে সিরিয়াস
লেখার শুরু ও প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর কবিতা ও ছোট গল্প বিভিন্ন ছোট পত্রিকাতে।
প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় ২০০৬ এ দে'জ পাবলিশিং হাউজ
থেকে। অল্প সময়ের মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত
বানিজ্যিক পত্রিকা গুলোতে উপন্যাস, গল্প ও কবিতা
প্রকাশিত হতে থাকে। অদ্যাবধি ছাব্বিশটি উপন্যাস, চারটি গল্প গ্রন্থ, একটি কাব্য সংকলন
প্রকাশিত। উল্লেখযোগ্য পুরস্কার গুলোর মধ্যে শৈলজানন্দ স্মৃতি পুরস্কার, লীলা মজুমদার স্মৃতি পুরস্কার, মহাদেবী ভার্মা স্মৃতি পুরস্কার ( বিহার/ পাটনা), বুক সেলার্স পাবলিশার্স গিল্ড দ্বারা প্রতিশ্রতিমান সাহিত্যিক পুরস্কার
প্রভৃতি। বিভিন্ন অনাথ আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত। পশুপাখিদের অধিকার ও পরিচর্যায়
নিয়োজিত। ফটোগ্রাফি, অভিনয়, ছবি আঁকা ও ভ্রমণ তাঁর প্রিয় শখ।
ইন্টারভিউ পড়ে সমৃদ্ধ হলাম...প্রতিটা খুঁটিনাটি জিনিস খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে...আধুনিক সমাজ যতটা বাইরে থেকে জমকালো লাগে বাস্তবিক ভাবে আসলে যে সেটা নয় সেটা সাহিত্যিক কাবেরী দেবীর দৃষ্টিভঙ্গি তে স্পষ্ট... আর সবচেয়ে যেটা মন ছুঁয়ে গেলো সেটা হলো ওনার বোল্ড উত্তর দেয়ার ব্যাক্তিগত স্টাইল...
উত্তরমুছুনইন্টারভিউ পড়ে সমৃদ্ধ হলাম...প্রতিটা খুঁটিনাটি জিনিস খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে...আধুনিক সমাজ যতটা বাইরে থেকে জমকালো লাগে বাস্তবিক ভাবে আসলে যে সেটা নয় সেটা সাহিত্যিক কাবেরী দেবীর দৃষ্টিভঙ্গি তে স্পষ্ট... আর সবচেয়ে যেটা মন ছুঁয়ে গেলো সেটা হলো ওনার বোল্ড উত্তর দেয়ার ব্যাক্তিগত স্টাইল...
উত্তরমুছুন(প্রসন্ন সেনগুপ্ত )