অর্থিতা মণ্ডল ~ সাক্ষাৎকার

 

রংরুট:  আমাদের সমাজ সংসারে মেয়ে হয়ে জন্মানো সত্যিই কি বিড়ম্বনা বলে মনে হয়েছে কখনো জীবনের কোন পর্বে?

 

অর্থিতা মণ্ডল: আমি এমন একটা পরিবারে জন্মেছি, যে পরিবার উনবিংশ শতাব্দীর শেষ  ভাগেই প্রথাগতভাবে নারী শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়েছিলআমার মায়ের ঠাকুমা শৈলবালা ছিলেন ঢাকার ইডেন ইস্কুলের ছাত্রীতাঁর আরেকটি পরিচয় তিনি ছিলেন মেঘনাদ সাহার বন্ধু ও বিজ্ঞান সাধক অধ্যাপক নিখিল রঞ্জন সেনের আপন বোনবিয়ের পরে তিনি যে বাড়িতে এলেন সে বাড়িতেও পড়াশোনার চর্চা অব্যহত ছিলআমার দাদামশাই কল্যাণ কুমার সেনের বাবা শৈলবালার স্বামী গনেশচন্দ্র সেনও ছিলেন শিক্ষকফলে  শৈলবালার কন্যা সন্তানরা অর্থাৎ আমার মায়ের চার পিসিই ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত এবং এঁদের মধ্যে তিনজন অধ্যাপনার জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত আরেক দিকে আমার দিদিমার বাড়িও নারী শিক্ষার আলোতে আলোকিত ছিলদিদিমার মা ছিলেন প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত নার্সআমার দিদিমা মাধ্যমিক ইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা এবং তখনকার দিনে অর্থনীতিতে এম. এআমার বাবার বাড়িতে অবশ্য নারী শিক্ষার আলো ঢুকেছে অনেক পরেমায়ের বাড়ির সঙ্গে প্রায় দেড়শ বছরের তফাৎ তবুও আমার বাবা যথেষ্ট আধুনিক মনস্ক এবং জ্ঞান চর্চায় নিয়োজিত আমার মা একটি উচ্চমাধ্যমিক ইস্কুলের শিক্ষিকা ছিলেনএই রকম একটি বংশপরম্পরায় উদারচেতা আধুনিক মনস্ক বাড়িতে জন্মেছি আমি ঠিক সেকারণেই আমাদের পরিবারে ছেলে মেয়ের মধ্যে ভেদাভেদ কোনোদিনই নেইছোট্ট থেকে জেনেছি তথাকথিত ‘ভালো মেয়ে’ না,  ‘ভালো মানুষ’ হতে হবেআমাদের বাড়িতে কখনো কেউ বিয়ের জন্যে টাকা জমাননি, উচ্চশিক্ষার জন্যে টাকা জমানোর কথা ভেবেছেনআরেকদিকে আত্মসম্মান বোধ সম্পন্ন নারী সত্তার বিকাশ ঘটিয়েছেন  তাই কোনো দিনই মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলে জীবনের কোনো পর্বেই বিড়ম্বনা বলে মনে হয় নিআমি মানুষ হয়ে এই পৃথিবীতে জন্মেছি বলে যেমন আনন্দিত, তেমনই নারী হিসেবে সুখী

 

 

রংরুট: শৈশব কাটিয়ে কৈশরে পৌঁছে ছেলে মেয়েদের চলা ফেরা ওঠা বসার মধ্যে পার্থক্য গুলো প্রাথমিক ভাবে কেমন লাগতো আপনার?

 

অর্থিতা মণ্ডল: আগেই বলেছি আমি কোন পরিবারে  কেমন পরিস্থিতিতে বড়ো হয়ে উঠেছি  ছোটো থেকেই মা, বাবা একটা রুচি বোধ গড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন  তাই হয়তো মাসি, পিসি, কাকু, জেঠুদের ছেলে মেয়েরা অর্থাৎ আমরা সব ভাই বোনেরা এক সঙ্গে খেলাধুলো করে বড়ো হয়েছি, ঝগড়া করেছি, খাবার ভাগ করে খেয়েছি, একসঙ্গে ঘুমিয়েছি কিন্ত কখনোই চলা, ফেরা ওঠা , বসার পার্থক্যগুলো কৈশোরে বুঝতে পারিনি

 

 

রংরুট: আমাদের বাঙালি সমাজে একেবারে সংসারের ভেতরেই ছেলে মেয়েদের মধ্যে ছোট থেকেই একটা বৈষম্য মূলক আচরণের ধারাবাহিকতা চলে আসছে আবহমান কাল ব্যাপীপরিতাপের কথা, যে মেয়েটি নিজের বাড়িতেই এই বৈষম্যের পরিবেশে বেড়ে ওঠে, সেই কিন্তু গৃহকর্ত্রীরূপে আবার নিজের সংসারেও এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখে এই বিষয়টি আপনাকে কতটা ও কিভাবে নাড়া দেয়?

 

অর্থিতা মণ্ডল: ভীষণভাবেই নাড়া দেয়কিন্ত আমাদের সমাজে এই ব্যাপারটাকে উপর উপর দেখলে বা বিশ্লেষণ করলে হবে নাএর শেকড় অনেক দূর পর্যন্ত  চলে গেছে, তা প্রায় দু’হাজার বছর পেছনেআসলে পুরুষতন্ত্রের শাসন ব্যবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে এবং পাকাপোক্ত ভাবে শ্রেণী বিভক্ত সমাজকে স্থায়ী করার জন্যে খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতক থেকে মনু নামক নির্দিষ্ট কয়েকজন চতুর সুবিধাভোগীর হাত ধরে যে সমাজ পুনরায় গড়ে উঠল, সেই সময় থেকে সেই সমাজে নারীরা তাদের মানবিক সত্তার স্বীকৃতি হারালএই সময় থেকে নারীরা প্রকৃতির দেওয়া তিনটি জন্মগত অধিকার খাদ্য, বাসস্থান ও যৌন কামনার উপরও তাদের স্বাভাবিক অধিকার হারিয়েছিলব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রভাব তাদের কাছ থেকে শিক্ষার অধিকারও কেড়ে নিয়েছিলফলে শিক্ষার আলোহীন নারীদের ভেতর ‘ইনসিকিউরিটি কমপ্লেক্স’ তীব্রভাবে কাজ করতে শুরু করলযে সমস্ত অধিকার তাদের স্বাভাবিক ভাবে পাওয়ার কথা তার জন্যে ‘পুরুষের’ উপর নির্ভরশীল হতে হলআর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা নারীকেই তাদের প্রধান অস্ত্র বানিয়ে তুললচতুর, লোভী  উচ্চবর্ণের সেই নির্দিষ্ট কিছু শাসক-পুরুষ বংশ পরম্পরায় নারীর অস্থি মজ্জায় সুকৌশলে মিশিয়ে দিল বংশ মর্যাদার মোহ,  তৈরি করা মঙ্গল-অমঙ্গলের মোহপাপ-পুণ্যের এই মোহ এবং ইন্সিকিউরিটি কমপ্লেক্স তাদেরকে ভাবতে বাধ্য করল, নারী জন্ম পূর্বজন্মের পাপের ফলযে নারী হয়ে জন্মেছে তাকে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ সব সহ্য করে অসম্মানের জীবন কাটাতে হবেছেলে মাত্রই দেবতার আশীর্বাদসংসারের সব ভালোটুকু তার জন্যেই বরাদ্দসেজন্যেই পুরুষতন্ত্র বজায় রাখার প্রধান হাতিয়ার ‘নারী’ নিজে সেই বৈষম্যের স্বীকার হয়েও গৃহকর্তী রূপে সেই ধারা বজায় রাখেএক্ষেত্রে অস্থি-মজ্জায় মিশে যাওয়া ‘পাপ-পুণ্য ও মঙ্গল-অমঙ্গলের ভ্রান্ত ধারনাটাও কাজ করেতাছাড়া যেখানে চিন্তা ভাবনার মুক্তি ঘটে না, বৃহত্তর জীবনের পরিবর্তে গণ্ডীবদ্ধ জীবন কাটাতে বাধ্য হয় সেখানে স্বার্থপরতা আসাটাও খুব স্বাভাবিকসেক্ষত্রে ‘আমি খারাপ থেকেছি, তাই তুমিও খারাপ থাকো, আমার শাশুড়ি অত্যাচার করেছে, আমিও করব’ এই ধরনের  স্বার্থপর মনোভাবও কাজ করে

 

 

রংরুট:  পিতৃতন্ত্রের যে ঘেরাটোপে নারীর জীবন,  সেইটি আপনাকে ব্যক্তিগত ভাবে কতটা প্রভাবিত করে?

 

অর্থিতা মণ্ডল: আগেই বলেছি

 

 

রংরুট:  নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যে খুবই জরুরী সে নিয়ে আজ আর বিতর্কের অবকাশ নেই কিন্তু দুঃখের সাথে লক্ষ করা যায় অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী নারীও সমাজ সংসারে সঅভিভাবকত্ব অর্জনে বাধা প্রাপ্ত হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই বিষয়ে আপনার অভিমত কি?

 

অর্থিতা মণ্ডল: অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে আত্মসম্মান বোধটাও জরুরীনিজেকে একজন নারী হিসেবে ভাবার আগে একজন আত্মনির্ভরশীল পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে ভাবা প্রয়োজনএকজন সাবালক মানুষ কোনো অভিভাবকের উপর নির্ভর করে না, তার অভিভাবক সে নিজেইএই জায়গাটা আগে একজন নারীকে বুঝতে হবে, বিশ্বাস করতে হবেতাছাড়া সে যেমন তার  লাইফ পার্টনারকে শ্রদ্ধা ভরসা ও বিশ্বাস করবে, তেমনই লাইফ পার্টনারও তাকে শ্রদ্ধা, ভরসা ও বিশ্বাস করবেপারস্পরিক সম্পর্কের এই ভিত্তিটুকুকেও বুঝতে হবেএই ব্যাপারগুলো অনুধাবন যতক্ষণ না করা হচ্ছে ততক্ষণ স্বাবলম্বী হয়েও সঅভিভাবকত্ব অর্জন করা সম্ভব না

 

 

রংরুট:  কথায় বলে সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে কিন্তু এর পেছনে পুরুষতন্ত্রের কৌশলগত অবস্থানটি সম্বন্ধে সাধারণ ভাবে আমরা কতটা ওয়াকিবহাল?

 

অর্থিতা মণ্ডল: যদি ওয়াকিবহাল হতাম তাহলে এত বধূ হত্যা, নারী নির্যাতন হত কিনারী কিভাবে পুরুষতন্ত্রকে বজায় রাখার হাতিয়ার হয়ে  উঠেছে তা আগেই বলেছিসংসার তো সুখের হয় নারী এবং পুরুষ দুজনের গুণে, দুজনের পারস্পরিক বোঝা পড়া, পারস্পরিক ভালোবাসা আর পারস্পরিক শ্রদ্ধায়

 

 

রংরুট:  পেশাগত জগতে একজন নারী কতটা স্বাধীন আর কতটা পরিস্থিতির শিকার,  সেটা নারীর ব্যক্তিত্বের উপর কতটা নির্ভর করে, আর কর্মজগতের বাস্তব অবকাঠামোর উপর কতটা নির্ভর করে?

 

অর্থিতা মণ্ডল: নারীর ব্যক্তিত্বের উপর অনেকটাই নির্ভর করে কিন্তু বাস্তব অবকাঠামোকে অস্বীকার করার উপায় নেই আমাদের সমাজে পুরুষরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছোটো থেকেই শুধুমাত্র ‘পুরুষ’ হিসেবে বড়ো হয়ে ওঠে , ’মানুষ’ হিসেবে নাঠিক সে কারণেই নারীকে তারা পূর্ণ মানুষ ভাবতে পারে না, সব সময় ছোটো করে দেখার প্রবণতা থাকেকর্মক্ষেত্রে কোনো নারী পুরুষের থেকে কর্মদক্ষতায় সফল হলে তাদের পুরুষ শ্লাঘা আহত হয়অবশ্য সব সময় যে জ্ঞানত ভাবে হয় তা নয়, অনেক সময় অবচেতন ভাবেও হয়কেননা সামাজিক কাঠামোই এর জন্যে দায়ী

 

 

রংরুট:  এই প্রসঙ্গে আমাদের সমাজ বাস্তবতায় লিঙ্গ বৈষম্যের বিষয়টি একজন সমাজ সচেতন মানুষ হিসাবে আপনাকে কতটা বিচলিত করে সেই বিচলনের রূপ ও বিকাশ সম্বন্ধে যদি আমাদের অবহিত করেন!

 

অর্থিতা মণ্ডল: ওই যে বললাম, লিঙ্গ বৈষম্যের ব্যাপারটি কোনো উপরের ব্যাপার নয়, শিকড় পর্যন্ত ছড়িয়ে যাওয়া ব্যাপারছোট্ট একটা কথা বলি, সাহিত্য সৃষ্টির ব্যক্তিগত জগৎটা বাদ দিয়ে, বিরাট সাহিত্য জগৎ কিন্ত একটি বড়ো কর্মক্ষেত্রএখানেও কিন্তু উপর উপর চোখে না পড়লেও লিঙ্গ বৈষম্যের ব্যাপারটা রয়েই গেছেএই যেমন ধরুন ‘তুমি নারী, সূতরাং তুমি নারীদের দুঃখ কষ্টের কথা লিখবে, কবিতাও হবে নারীর আত্মকথন’এই ধরনের মনোভাব রয়েছে অনেক  সাহিত্যিকদের মধ্যেযেন, লেখার জগতে এটুকুই একজন নারীর অধিকারকিন্তু বাস্তব কি তাই বলে? বলে না তোএকজন সমাজসচেতন লেখকের কোনো লিঙ্গ হয় নাতিনি মানুষের কথা লেখেনশুধু নারীর কথা লেখা বা শুধু পুরুষের কথা লেখা বলে কিছু হয় নাআমার কথাই ধরুন, আমি যখন লিখি তখন তো আমি কোনো নারী নইআমি যে চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে চাই, তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাইসে চরিত্র যদি পুরুষ হয় তবে পুরুষ, উভলিঙ্গ হলে তাই, আবার নারী হলে নারী কিংবা শিশু হলে শিশু আর কবিতার ক্ষেত্রে আত্ম অনুভূতির রসে জারিত হয়ে বিশ্বানুভূতির প্রকাশ ঘটানোই হচ্ছে আসল কথাতাই লেখকের কোনো লিঙ্গ হয় না কিন্ত আমাদের লিঙ্গ বৈষম্যে অভ্যস্ত সমাজ একজন লেখককে লেখক হিসেবে না দেখে নারী-পুরুষে ভাগ করে দেখেসেই লেখক যদি প্রকৃতিগতভাবে নারী হন, তবে তাঁর লেখাকে ইচ্ছে করে অনুধাবন না করেই শুধুমাত্র ‘নারীত্বের অনুভূতি’র তকমা সেঁটে দেওয়া হয়যে নারী, শুধু নারীদের যন্ত্রণার কথা লেখেন না, তাকে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা না দেওয়ার ক্ষেত্রে জ্ঞানত এবং অজ্ঞানত প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে

 

 

রংরুট:  বর্তমান সমাজে নারী নির্যাতনের বিষয়টি কি রাষ্ট্র ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে বলে মনে হয় আপনার? সামাজিক ভাবে আমাদের ভূমিকাই বা কি হওয়া উচিত এই বিষয়ে?

 

অর্থিতা মণ্ডল: রাষ্ট্র ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায় নি, কিন্ত শুধু আইন বা শাস্তি কখনই নারী নির্যাতন বন্ধ করতে পারবে নানারী সুরক্ষার জন্যে আইনি ব্যবস্থার যেমন প্রয়োজন আছে তার সঙ্গে বর্তমানে সাধারণ মানুষের সচেতনতার প্রয়োজনটাও দরকারযে কোনো বড়ো কাজ তো নিজের বাড়ি থেকে শুরু করা প্রয়োজনআমরা যারা সমাজে শিক্ষিত মানুষ বলে  নিজেদের পরিচয় দেই, তাদের নিজেদের প্রথম সচেতন হতে হবেবাড়ির ছোটোদের মধ্যে ছেলে এবং মেয়ের ভেদাভেদ না করে প্রথমে মানুষ হিসেবে বড়ো করে তুলতে হবেআগে তো আমরা প্রত্যেকে মানুষ, তারপর কিন্তু বায়োলজিক্যালি নারী বা পুরুষ কিংবা রূপান্তরকামী বা উভলিঙ্গ এই ব্যাপারগুলো আসেএটা প্রত্যেককে বুঝতে হবে, বিশ্বাস করতে হবে এবং পাশের মানুষদের বোঝাতে হবেনিজেদের সন্তানদের মধ্যে ছোটো থেকে আত্মসম্মান বোধটাকে জাগিয়ে তোলা খুব দরকারতারসঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতা এবং স্বেচ্ছাচারিতার পার্থক্যটাও তো বুঝতে হবেএটা না বুঝলে আত্মসম্মান বোধ গড়ে উঠবে নাএই বোধ না গড়ে উঠলে নারীরা নির্যাতিত হয়েই চলবেতাছাড়া নারীর হাতে পুরুষ নির্যাতনের সংখ্যাও  কিন্ত ধীরে ধীরে বাড়ছেসেদিকটাও খেয়াল রাখতে হবেকেননা কোনো নির্যাতনই সচেতন মানুষ হিসেবে আমাদের কাম্য নয়  এই প্রসঙ্গটা সামান্য বিষয় বহির্ভূত হলেও সুন্দর ভবিষ্যৎ কামনায় উল্লেখ করলাম  প্রত্যেকটা মানুষকে অন্তত মানুষ হিসেবে তার প্রাপ্য শ্রদ্ধা ও সম্মান দেওয়া উচিত এটা যদি ছোটো থেকে শেখে তাহলে পারস্পরিক শ্রদ্ধা বোধটা তৈরি হয়ে যাবে আমাদের মনে রাখতে হবে নারী, পুরুষ এবং শিশু কেউই কিন্তু কারুর সম্পত্তি নয়আরও একটা ব্যাপার যৌনতা নিয়ে আমাদের মধ্যে একটা বাহ্যিক ছুঁৎমার্গ রয়ে গেছেএই ভাবনাটা বদলাবার চূড়ান্ত সময় হয়ে গেছেছেলে মেয়েরা যখন বড়ো হচ্ছে অর্থাৎ অ্যাডোলেসেন্স পিরিয়ড থেকেই তাদের বোঝানো দরকার কারুর অনুমতি না নিয়ে কাউকে স্পর্শ করা ঠিক নাশারীরীক চাহিদা সম্পর্কিত এবং নিজেদের শরীর সম্পর্কে যে কৌতূহল এই সময় তৈরি হয় এই সব বিষয় নিয়ে ওদের মতো করে ওদেরকে আলোচনার মাধ্যমে বোঝানো দরকার আসলে সামাজিক অচল রীতিনীতিকে পাল্টে মা বাবাকে সন্তানের বন্ধু হয়ে উঠতে হবেযৌন কামনা একটি প্রাকৃতিক ব্যাপার এবং খাদ্য, বাসস্থানের মতোই অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার কিন্ত তা সাবালক হওয়ার পরে নারী এবং পুরুষের পারস্পরিক অনুমতি সাপেক্ষ এই জায়গাটা নিজেদের বিশ্বাস করার সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মকেও বোঝাতে হবে বৈকি এই সময়ই খেয়াল করতে হবে কারুর মধ্যে যৌনতা সম্পর্কিত কোনো অ্যাবনর্মালিটি গ্রো করছে কি না, সেক্ষেত্রে মনোবিদদের সাহায্য নিতে হবে  তাছাড়া মেয়েরা তো ভোগ্য পণ্য নয়, এটা যেমন সত্যিতেমনই দৈহিক সতীত্ব বলে কিছু হয় না, এটাও তো বুঝতে হবে সামাজিক বা আইনি বিবাহ মানে যৌনতার ছাড়পত্র নয়, এর মানে মেয়ের বাড়ি এবং ছেলের বাড়ির যৌথ ভাবে প্রত্যেকের প্রতি প্রত্যেকের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়াএটা ভাবতে পারলে বা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে বোঝাতে পারলে সুদূর ভবিষ্যতে নারী নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব  আরেক দিকে নারীর সতীত্ব বলে কিছু হয় না এটা যদি বোঝানো সম্ভব হয়, তবে কোনো মেয়ের প্রতি বা তার পরিবারের প্রতি ‘বদলা’ নেওয়ার জন্যে ধর্ষণ বন্ধ হবে  সামাজিক ভাবে মানুষের মধ্যে এই বোধ জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব লেখক শিল্পী সহ শিক্ষিত মানুষদেরতারা যদি নিজেদের মধ্যে এই পরিবর্তনটুকু আনতে পারেন, তখনই সম্ভব হবে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষদের মধ্যে এই ভাবনাকে পৌঁছে দেওয়াআর তখনই সম্পূর্ণভাবে লিঙ্গ বৈষম্য দূর হবে  জানি, সামাজিক অচলতা দূর করা একদিনে সম্ভব না, বা শুধু আইনি ভাবেও সম্ভব না কিন্তু এভাবে আইনের সঙ্গে সঙ্গে চেতনাকে জাগিয়ে তুললে অদূর ভবিষ্যতে নারী নির্যাতন বন্ধ হবে ও লিঙ্গ বৈষম্য দূর হবে

 

 

রংরুট:  বাড়ির বাইরে মেয়েদের সুরক্ষার বিষয়টি আজও কেন এত অবহেলিত! কি মনে হয় আপনার? দেশের প্রশাসনের শীর্ষপদে মহিলারা নেতৃত্ব দিলেও অবস্থার উন্নতি হয় না কেন? গলদটা রয়ে যাচ্ছে কোথায়?

 

অর্থিতা মণ্ডল: এই গলদের কথা আমি আগেই আলোচনা করেছি আপনার প্রশ্নের মধ্যে কিন্তু ‘মহিলা/পুরুষ’ কথাটি উঠে এলমহিলারা  মহিলাদের সুরক্ষার কথা বেশি ভাববেন আর পুরুষরা পুরুষের সুবিধার কথা ভাববেন তা তো নয় কর্মক্ষত্রে নারী ও পুরুষ সবাই সমানসেজন্যেই নেতৃত্ব মহিলা দিচ্ছেন না পুরুষ তার উপর মেয়েদের সুরক্ষার ব্যাপার নির্ভর করে না গলদটা তো গোড়ায়ভীষণ ভাবেই তা সামাজিকআর সমাজ মানুষের ভালোর জন্যে তৈরি হয় নিসমাজ তৈরি হয়েছে মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থসিদ্ধির প্রয়োজনেতাই যতদিন না সামাজিক অচলতা দূর হচ্ছে ততদিন নারী নির্যাতন বন্ধ হবে নাএই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আগের প্রশ্নের উত্তরেই করেছি

 

 

রংরুট:  আন্তর্জাতিক নারীদিবস পালন আর সারা বছর নারী নির্যাতনের ধারাবাহিত ব্রেকিং নিউজ,  এর মধ্যে সমন্বয় হবে কি করে? মেয়েদের এই বিষয়ে কি কর্তব্য আপনার মতে?

 

অর্থিতা মণ্ডল: মেয়েদের কর্তব্যের কথা বিস্তারিত বলেছিআন্তর্জাতিক নারীদিবস না, প্রতিটি দিন হোক নারী ও পুরুষের যুগ্ম দিনএকে অপরের পরিপূরক এবং আরেকদিকে প্রত্যেকেই হয়ে উঠুক স্বয়ং সম্পূর্ণ ও সম্পূর্ণা

 

 

রংরুট:  সমাজে নারীর সম্মান প্রতিষ্ঠিত না হলে কোনো দেশ জাতি সমাজ উন্নত হতে পারে না ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?

 

অর্থিতা মণ্ডল: আশাবাদী

 

অর্থিতা মণ্ডল পেশাঃ অধ্যাপনা,  শিক্ষাঃ পি .এইচ. ডি প্রকাশিত বইঃ কবিতার গ্রন্থঃ ১) বৈষাদিক ,  ২) তোমায় উড়িয়ে দিলাম কথা,  ৩) অন্ধ বাউলের দোতারা ছোটোদের গল্প গ্রন্থঃ ১)জ্যান্ত ভূতের গপ্পো,  ২) ইচ্ছে পাতার দেশে

 

 

 


২টি মন্তব্য:

  1. ভীষণ ভালো লাগলো। আজকের নারীদের প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে উনি সুন্দর ভাবে উপস্থাপনা করেছেন।

    উত্তরমুছুন