চম্পা ভট্টাচার্য্য ~ সাক্ষাৎকার

 


রংরুট:  আমাদের সমাজ সংসারে মেয়ে হয়ে জন্মানো সত্যিই কি বিড়ম্বনা বলে মনে হয়েছে কখনো জীবনের কোন পর্বে?

 

চম্পা ভট্টাচার্য্য: আজ এই বয়েসে এসে নারী সম্পর্কে আমার যে ধ্যান ধারণা সেটা দীর্ঘদিন বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নিজের ভেতরে তৈরী হয়েছে এখনকার আমি আর আগের আমি জীবনের এই দুই ভাগে চিন্তা ভাবনার ক্ষেত্রে বিস্তর পার্থক্য আছে ছোট্ট থেকেই উদার মনস্ক বাবা মায়ের ছাতার নীচে পাঁচ ভাইবোন এর সমভাবে  বেড়ে ওঠা, সেখান কোনও পক্ষপাতীত্বের জায়গা ছিলো না, মনে কোনোও অনুভূতি তৈরি হয়নি কিন্তু অল্প বয়েসে বিয়ে হয়ে যেখানে দ্বিতীয়বার আমার শিকড় প্রোথিত হয়েছিলো সেখানকার মানসিকতার সাথে আমার আগের শিক্ষা, ধারণার বিস্তর পার্থক্য সেই সময়ে কখনও মনে হয়েছে মেয়ে মানেই রান্নাঘর, সকলের সেবাদাসী, ও বিছানা যদিও খুব তাড়াতাড়ি সেটা কাটিয়ে উঠে মাথা সোজা করে দাঁড়াতে পেরেছিলাম তবুও বলবো সে দিনের তিক্ত স্মৃতি আজও আমায় তাড়িয়ে বেড়ায়। 

 

রংরুট: শৈশব কাটিয়ে কৈশরে পৌঁছে ছেলে মেয়েদের চলা ফেরা ওঠা বসার মধ্যে পার্থক্য গুলো প্রাথমিক ভাবে কেমন লাগতো আপনার?

 

চম্পা ভট্টাচার্য্য: শৈশব থেকেই বাড়িতে বাবা মায়ের প্রশ্রয়ে ভাই বোনেরা সমভাবে বেড়ে ওঠার দরুন এসব ভাবনা মনে আসে নি, তবে একটু বড়ো হবার পর সব মেয়েরা যখন পুতুল খেলছে - আমি তখন হয়তো ভাই এবং ওদের বন্ধুদের সাথে ডাংগুলি খেলছি, ঘুড়ি ওড়াচ্ছি, সাইকেল নিয়ে সাঁইসাঁই করে ছুটছি তখনই হয়ে গেলো মুস্কিল... সমাজ তা মানবে কেন! শুরু হয়ে গেলো গেলো ফিসফাস গুঞ্জন তখনও মেয়ে জন্ম নিয়ে - ভাবার মতো বয়েস বা অনুভূতি কিছুই তৈরী হয় নি কিন্তু যখন এই গুঞ্জন আমার কানে এসে পৌঁছুতে লাগলো তখন থেকেই আমি যেন মেয়ে হতে শুরু করলাম, আমার মনেও নানা রকম প্রশ্ন দেখা দিতে লাগল ...আমি তো অন্যায় কিছু করছি না...একটি ছেলে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারতে পারে রাস্তায় মাঠে খেলতে পারে ..সাইকেলে সারা শহর ঘুরতে পারে কিন্তু একটা মেয়ে যদি সেটা করে তাহলেই সমাজে গেলো গেলো রব! কেন ? ? ?  তবে আজ বোলতে বাঁধা নেই এই সব গুঞ্জন কারীদের ভেতরে মাসীমা কাকিমা ও  মেয়েদের সংখ্যাই বেশী ॥

 

 

রংরুট: আমাদের বাঙালি সমাজে একেবারে সংসারের ভেতরেই ছেলে মেয়েদের মধ্যে ছোট থেকেই একটা বৈষম্য মূলক আচরণের ধারাবাহিকতা চলে আসছে আবহমান কাল ব্যাপী। পরিতাপের কথা, যে মেয়েটি নিজের বাড়িতেই এই বৈষম্যের পরিবেশে বেড়ে ওঠে, সেই কিন্তু গৃহকর্ত্রীরূপে আবার নিজের সংসারেও এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। এই বিষয়টি আপনাকে কতটা ও কিভাবে নাড়া দেয়?

 

চম্পা ভট্টাচার্য্য: একটি শিশু যখন যখন জন্ম নেয় তখন কিন্তু সে পুরুষ কিংবা নারী হয়ে জন্মায় না কিন্তু পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসনের ঘেরাটোপে খুব তাড়াতাড়ি একটি শিশু মেয়ে কিংবা ছেলেতে পরিণত হয় একটি কন্যা সন্তান তখন থেকেই নানান বিধিনিষেধের ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে মেয়ে মানেই আস্তে চলা ধীরে বলা, ঘরের কাজ, বাইরে মানা আর ছেলে মানেই ঘরের সব কিছুতেই তারই অগ্রিম অধিকার, সাথে রয়েছে বাইরের মুক্ত জগত এই বৈষম্য মূলক আচরণ একটি কন্যা শিশুকে প্রতিবাদহীন মেয়েমানুষে পরিণত করে তোলে তাঁর পুঁথিগত শিক্ষা থাকলেও মানসিক শিক্ষার  কোনোও উন্নতি হয় না ..এটাকেই চিরাচরিত নিয়ম বলে মেনে নেয় এরই ফল স্বরূপ পরবর্তী ক্ষত্রে একটি নারী আর একটি নারী দ্বারা শোষিত হতে থাকে সংসার পরিচালনায় তাঁর মনের অন্ধকার দিকটাই প্রকাশ পায় তবে হ্যাঁ ব্যতিক্রম তো আছেই নাহলে পৃথিবী এগুচ্ছে কি করে

 

 

রংরুট:  পিতৃতন্ত্রের যে ঘেরাটোপে নারীর জীবন, সেইটি আপনাকে ব্যক্তিগত ভাবে কতটা প্রভাবিত করে?

 

চম্পা ভট্টাচার্য্য: "নারী সম্ভবতঃ জগতের সবচেয়ে আলোচিত প্রাণী " বলেছিলেন ভার্জিনিয়া উলফ। নারীর অবস্থান অনুধাবন করতে আমার বেশ অসুবিধেই হয় বারবার মনে হয় নারী নামক এই যে প্রাণী সেটা কি আমার এই পরিচিত পৃথিবীর নাকি অন্য কোনোও গ্রহের! সভ্যতা সৃষ্টির সূচনা থেকে আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও  নারী শোষিত এবং পুরুষ শোষক মানুষ বোলতে এখনও কেবলমাত্র পুরুষকেই বোঝায় আর নারী মানুষ নয় অন্য শ্রেণীর প্রাণী নারী যাতে মানুষ পদবাচ্য না হয়ে শুধুই মেয়েমানুষ হয়ে  থাকতে পারে তাই শ্রম বিভাজনের সময় থেকে দৈহিক ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে নারীকে গৃহ বন্দী করা হলো তৈরি হলো পুরুষ কেন্দ্রিক পরিবার আর নারীকে হতে হবে ভালো রাঁধুনী, ভালো সেবাদাসী, ভালো যৌন সঙ্গী আর এগুলোকে কায়েম করার জন্য তাঁর উপরে চাপিয়ে দেওয়া হলো নানান ধর্মীয় অনুশাসন যেটা মানুষের সবচেয়ে দুর্বলতম স্থান নারীর কোনোও চাহিদা থাকবে না তাঁর নিজস্ব কোনোও সময় নেই, তাঁর শিক্ষার অধিকার নেই, নেই নিজের পছন্দ মতো সঙ্গী নির্বাচনের অধিকার, এভাবেই সে পরিণত হলো প্রতিবাদহীন যন্ত্র মানবীতে আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও নারীর অবস্থান খুব একটা উন্নত হয়নি কিন্তু আর কতদিন? কবে নারী নিজেই সমস্ত অনুশাসন থেকে বেরিয়ে নিজের মুক্তির পথ খুঁজে নেবে॥

 

 

রংরুট:  নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যে খুবই জরুরী সে নিয়ে আজ আর বিতর্কের অবকাশ নেই। কিন্তু দুঃখের সাথে লক্ষ করা যায় অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী নারীও সমাজ সংসারে সঅভিভাবকত্ব অর্জনে বাধা প্রাপ্ত হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। এই বিষয়ে আপনার অভিমত কি?

 

চম্পা ভট্টাচার্য্য: বিভিন্ন আন্দোলনের ভেতর দিয়ে নারী ভোটদানের অধিকার, শিক্ষার আধিকার স্বাবলম্বী হবার অধিকার অর্জন করলেও পরিবারের কিংবা সমাজে তাদের অবস্থানের কিছুমাত্র উন্নতি হয়নি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপার্জনশীল নারী নিজেদের আয়ের অংশ নিজেদের ইচ্ছে মতো ব্যবহার করতে পারে না, বেতনের টাকা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবারের হাতে তুলে দিতে হয়, বাইরের কর্মজগত থেকে ফিরেই পরিবারের কাজে যুক্ত হতে হয় যখন ঘরের পুরুষমানুষটি  বাড়ী ফিরে বিশ্রাম নিচ্ছে তখন নারীকে তাদের সামনে ধরে দিতে হচ্ছে ভোগের উপকরণ আজও স্বাবলম্বী মেয়েদের আলাদাভাবে কোনোও সম্মান নেই পারিবারিক ক্ষেত্রেও কোনোও সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার নেই, বিশ্রাম নেবার সময় নেই এভাবেই উপার্জনশীল হয়েও শোষনের হাত থেকে নারীর নিস্তার নেই তবে হ্যাঁ কিছু কিছু ক্ষেত্রে মেয়েরাও এখন প্রতিবাদী হয়ে উঠছে এটাই আশার কথা ॥

 

 

রংরুট:  কথায় বলে সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। কিন্তু এর পেছনে পুরুষতন্ত্রের কৌশলগত অবস্থানটি সম্বন্ধে সাধারণ ভাবে আমরা কতটা ওয়াকিবহাল?

 

চম্পা ভট্টাচার্য্য: যবে থেকে লিঙ্গভেদ শুরু হলো, পরিবারতন্ত্র শুরু হলো তখন থেকেই নারীকে অবদমিত করে রাখার জন্য ঘরে বন্দী করে রাখার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করা হলো নানা ধর্মীয় অনুশাসন চাপিয়ে দেয়া হলো, তাকে সুকন্যা হতে হবে, সতী লক্ষ্মী স্ত্রী হতে হবে, ভালো রাঁধুনী হতে হবে ভালো ধোপা, ভালো সেবাদাসী হয়ে সংসারে সবার মন জুগিয়ে চলতে হবে আবার রাতে কর্মক্লান্ত শরীরে ইচ্ছের বিরুদ্ধে স্বামীর যৌন সঙ্গী হতে হবে, সন্তান জন্ম দিতে হবে, আর এ সব করতে বিনা পারিশ্রমিকের শ্রমিক হয়ে বিনা বাক্যব্যায়ে আনত মস্তকে তবেই সংসারে শান্তি রক্ষা হবে সংসার সুখের হবে! আর এই কথাগুলো মেয়ে হয়ে - জন্মানোর পর থেকেই তাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তাই আজও বেশীর ভাগ মেয়ে সংসারে এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আছে আশার কথা এই যে অল্প হলেও ধীরে ধীরে মেয়েরা বুঝতে পারছে যে সে শুধুই সংসারে পেষণ যন্ত্রের শিকার তবে এই ধারণা নারী জাতির ছোট্ট একটা অংশের ভেতরে সীমাবদ্ধ বেশিরভাগ মেয়ে আজও মনে করে নত মস্তকে সংসারের দায়িত্ব পালন করে যাওয়া তাদের কর্তব্য বর্তমান সময়ে এই বাক্য বন্ধনীর কোনোও সারবত্তা নেই ..নারী ও পুরুষের যৌথ সহযোগিতায় একটি সংসার শান্তির হয়, সুখের হয়॥

 

 

রংরুট:  পেশাগত জগতে একজন নারী কতটা স্বাধীন আর কতটা পরিস্থিতির শিকার, সেটা নারীর ব্যক্তিত্বের উপর কতটা নির্ভর করে, আর কর্মজগতের বাস্তব অবকাঠামোর উপর কতটা নির্ভর করে?

 

চম্পা ভট্টাচার্য্য: কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ অনেক বেড়েছে ঠিকই কিন্তু সামাজিক ভাবে কিংবা পারিবারিক ক্ষেত্রে তাদের অবস্থার উন্নতি হয়নি সরকারী কিংবা বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে কি ব্যাবসার ক্ষেত্রে সব জায়গায় নারীকে লড়াই করেই মর্যাদা আদায় করে নিতে হয় স্বাধীনতা মানে যদি যা ইচ্ছে, যখন ইচ্ছে করা হয় তবে সেটা একমাত্র নিজস্ব ব্যাবসা ছাড়া কোনোও ক্ষেত্রেই সম্ভব নয় কারণ প্রত্যেক কর্মক্ষেত্র বা প্রতিষ্ঠানে কিছু বিধি নিষেধ আছে সেটা নারী পুরুষ উভয়কেই মেনে চলতে হবে তবে কিছু সরকারী প্রতিষ্ঠান ছাড়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই পদোন্নতির ক্ষেত্রে উপরওয়ালার মন যুগিয়ে চলার একটা রেওয়াজ চলে আসছে যৌন হেনস্থার শিকারও হতে হয় অনেক প্রতিষ্ঠানে যোগ্যতা থাকা সত্বেও পদোন্নতির জায়গায় মেয়েদের প্রায় ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার হতে হয় এছাড়াও সমাজের বিভিন্ন কাজে মেয়েরা অংশ নেয় একজন  মহিলা শ্রমিক ও একজন পুরুষ শ্রমিকের দৈনিক মজুরীর ক্ষেত্রেও বিস্তর পার্থক্য থাকে বেশিরভাগ কর্মক্ষেত্রে আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা পর্যন্ত নেই ' সুষ্ঠ কজের পরিবেশ, মাতৃত্ব জনিত ছুটি, সন্তান পালনের মিনিমাম সুবিধেটুকু মেয়েরা পায়না এখনও বেশিরভাগ কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের আপোষ করে চলতে হয় তবে মেয়েদের পক্ষে এখন দেশে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন হচ্ছে স্বপ্ন দেখতে ভালো লাগে অদূর ভবিষ্যতে মেয়েরা মাথা উঁচু করে মর্যাদার সাথে কর্মক্ষেত্রে কাজ করছে

 

রংরুট:  এই প্রসঙ্গে আমাদের সমাজ বাস্তবতায় লিঙ্গ বৈষম্যের বিষয়টি একজন সমাজ সচেতন মানুষ হিসাবে আপনাকে কতটা বিচলিত করে। সেই বিচলনের রূপ ও বিকাশ সম্বন্ধে যদি আমাদের অবহিত করেন!

 

চম্পা ভট্টাচার্য্য: সংক্ষেপে বলা যেতে পারে লিঙ্গ বৈষম্যের পত্তন যবে থেকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার উদ্ধব দুর্বলের উপরে সবলের অত্যাচার ও শোষণ লিঙ্গ বৈষম্যের মূলে রয়েছে দৈহিক শক্তি ও শারীরিক গঠনের পার্থক্য সেই সুযোগে একদল মানুষ আরেক দল মানুষের উপরে আধিপত্য করে সেটা পুরুষ ও নারীর, পৃথিবীর সব দেশেই এই বৈষম্য বিদ্যমান গঠনগত বৈষম্যের জন্য পুরুষ প্রতিনিয়ত নারীর উপরে কতৃত্ব করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যে সামাজিক অধিকারের ক্ষেত্রে লৈঙ্গিক বৈষম্যবিদ্যমান আজও নারী সমভাবে সব অধিকার ভোগ করতে পারে না, আজও পুরুষের দৈহিক শক্তির কারণে জোর করে স্থাপিত হয় যৌনমিলন নারীর ইচ্ছের কোনোও মূল্য থাকে না একটি কন্যা শিশুকে বিয়ে দিতে হবে,অন্য সংসারে গিয়ে মানিয়ে নিতে হবে এই কথাগুলো ছোট থেকেই তাঁর মনে গেঁথে দেওয়া হয় শিক্ষার অধিকার, উন্নতির অধিকার, সুরক্ষা পাবার অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার ইত্যাদি থেকে তাকে বঞ্চিত করে ঘর সংসারের কাজে দক্ষ করে তোলার আয়োজন চলতে থাকে ভালো মন্দ বিচারের অধিকার, জীবনে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা না অর্জন করতে পারে তাঁর জন্য, পুরুষের আধিপত্য কায়েম রাখার জন্য নারীকে ঘরের ছোট্ট গন্ডির ভেতরে আটকে রাখার জন্য যুগে যুগে চলে আসছে এই ব্যবস্থা ঘটে চলেছে নির্বিচারে কন্যাভ্রূণ হত্যা, বধূ হত্যার মতো নৃশংস ঘটনা একটাই সমাধান আমার মনে হয় পুরুষ নারী উভয়কেই মানসিক শিক্ষায় উন্নত হতে হবে, তাদের বিশ্বাস করতে হবে দেহের গঠনগত পার্থক্য ছাড়া তারা একই গোষ্ঠীভুত আর সেটা হলো মানব গোষ্ঠী, জন্মসূত্রে একই অধিকার উভয়ের প্রাপ্য কিন্তু প্রতিটি নারীকে দায়িত্ব নিয়ে তাদের সন্তানদের এই শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে তবেই হয়তো এই সমাধান সম্ভব মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন " একজন পুরুষকে শিক্ষিত করা মানে একজন মানুষকে শিক্ষিত করা আর একজন নারীকে শিক্ষিত করা মানে গোটা সমাজকে শিক্ষিত করা " ভারতীয় সংবিধানে নারীর অধিকার রক্ষার স্বপক্ষে শিক্ষা, সাম্য, মর্যাদা, বৈষম্য থেকে স্বাধীনতা ইত্যাদি নানারকম বিধি আছে কিন্তু দুঃখের ব্যাপার আজও এর সঠিক প্রয়োগ হয়নি আইনের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হয় না ॥

 

 

রংরুট:  বর্তমান সমাজে নারী নির্যাতনের বিষয়টি কি রাষ্ট্র ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে বলে মনে হয় আপনার? সামাজিক ভাবে আমাদের ভূমিকাই বা কি হওয়া উচিত এই বিষয়ে?

 

চম্পা ভট্টাচার্য্য: পরিবারের সূচনা থেকে পুরুষ দ্বারা নারী নির্যাতিত হয়ে আসছে শারীরিক নিগ্রহের সাথে মানসিক ভাবেও তাকে নির্যাতিত করা হয় নারীর উদ্দেশ্যে অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ করে, কটু ব্যবহার করে, শারীরিক নিগ্রহ করে তাকে প্রতি মুহূর্ত নির্যাতিত করা হচ্ছে সমাজে ইভ টিজিং, ধর্ষণ মহামারিতে পরিণত হয়েছে সুশিক্ষার অভাব, নৈতিক শিক্ষার অভাব, উন্নত মানসিক চিন্তার অভাব, লিঙ্গ বৈষম্য নারীর নিগৃহীত হবার মূল কারণ নারীর প্রতি হিংস্র আচরণ ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে, প্রতিমুহূর্তে কোথাও না কোথাও নারী নির্যাতিত হচ্ছে, বিরামহীন ভাবে চলেছে ধর্ষণ এই নির্যাতন শুধু বাড়ীর বাইরে হচ্ছে তা নয় একটি কন্যা শিশুর উপরে নিগ্রহের শুরুই হয় পরিবারের ভেতর থেকে দুই মাসের  শিশু, আশি বছরের বৃদ্ধা..করো রেহাই নেই পবিত্র শিক্ষাঙ্গনও আজ কলুষিত, শিক্ষকতার মহান দায়িত্বে থাকা মানুষ আজ ধর্ষকের ভূমিকায় সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত যে কোনোও মূল্যে এই অবক্ষয় থেকে মানুষকে বাঁচাতে হবে, সমাজকে বাঁচাতে হবে সমস্ত মানব জাতিকে সম্মিলিত ভাবে এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে আজও ধর্ষণ, পণপ্রথা, বধূহত্যার মতো জঘন্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে সুবিচার পেতে বছরের পর বছর বিচারের বানী নীরবে নিভৃতে কাঁদে সম অধিকার, লিঙ্গ বৈষম্য, নারীর সুরক্ষা ইত্যাদি প্রকল্পে রাষ্ট্র ও রাজ্য সরকার নানবিধ উন্নয়ন মূলক আইন প্রণয়ন করলেও কোনোও সময়ই এর যথাযথ প্রয়োগ না করার জন্য নারীরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এতো সব কিছুর পরেও যতদিন না সমগ্র মানবজাতি চিন্তা চেতনার ক্ষেত্রে উন্নত হচ্ছে, লিঙ্গ বৈষম্য দূর হচ্ছে ততদিন নারীর মুক্তি নেই ॥

 

 

রংরুট: বাড়ির বাইরে মেয়েদের সুরক্ষার বিষয়টি আজও কেন এত অবহেলিত! কি মনে হয় আপনার? দেশের প্রশাসনের শীর্ষপদে মহিলারা নেতৃত্ব দিলেও অবস্থার উন্নতি হয় না কেন? গলদটা রয়ে যাচ্ছে কোথায়?

 

চম্পা ভট্টাচার্য্য: একজন মহিলা যখন প্রশাসনিক উচ্চপদে যান তখন তিনি একটা নিয়মবদ্ধতার মধ্যে আবর্তিত হতে থাকেন যে নিয়মবদ্ধতা বা সিস্টেম স্বাধীনতার সত্তর বছর পর এখনও সর্বশ্রেণীর মানুষের জন্য কল্যাণকর হয়ে ওঠে নি যে দেশে শিক্ষা হীনতা, দারিদ্রতা এবং ক্ষুধা আজও ব্যপক সংখ্যক মানুষের জীবনের সাথে জড়িয়ে রয়েছে - পাশপাশি সিস্টেমের সহায়তায় একশ্রেণীর মানুষ প্রতিনিয়ত ধনতন্ত্রের মাধ্যমে উচ্চবিত্ত শ্রেণী গড়ে চলেছে, সেই বৈষম্যতার মাঝে দাঁড়িয়ে প্রশাসনের উচ্চপদে থেকেও মহিলা বা পুরুষ এই বৈষম্যের নিয়মতান্ত্রিক জাঁতাকলে আবদ্ধ হয়ে আছেন ফলতঃ তারা চাইলেও কিছু করতে পারছেন না এবং পারবেনও না যতদিন না এই নিয়মবদ্ধতার মূলে আঘাত করে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলা যাবে ॥ 

 

 

রংরুট:  আন্তর্জাতিক নারীদিবস পালন আর সারা বছর নারী নির্যাতনের ধারাবাহিত ব্রেকিং নিউজ, এর মধ্যে সমন্বয় হবে কি করে? মেয়েদের এই বিষয়ে কি কর্তব্য আপনার মতে?

 

চম্পা ভট্টাচার্য্য: নারী দিবস ও আমি  ৮ই মার্চ ¦ "আবার কবে বছর পরে" - র মত বার্ষিক উচ্চারণের লগ্ন সমাসীন প্রশ্ন ওঠে, কেন আলাদা করে এই শব্দবন্ধটি সৃষ্টি করা হয়েছিল ? কেন লেখার প্রয়োজন হয়েছিল "নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার".....,  কেন "পৃথিবীর অর্ধেক আকাশ" বলে বার বার মনে করানোর চেষ্টা করানো হয় ---------এই সার্বিক অধিকার তোমার আছে কি ? তোমাকে যেটুকু দেওয়া হয়েছে - সেটুকুতেই হোক তোমার সন্তুষ্টি¦ কেন ? এ প্রশ্ন আসে বারবার ¦

কেন নয় পূর্ণ আকাশ ? কেন নয় সমতার পৃথিবী? কেন উচ্চারিত হয় "অর্জন করো অধিকার"? অথচ সোচ্চারে বলা হল না,  মানব সমাজ এক ও অখন্ড ¦ বরং ভিন্নতা সৃষ্টি করতে আবহমান কাল ধরে চিন্হিত হয়েছে দুটি শ্রেণী¦ একথা কোনদিন অন্তর দিয়ে ভাবা হলনা- পৃথিবীতে মানব সমাজের অস্তিত্ব রক্ষার্থে নারী পুরুষ যৌথ উপস্থিতি অপরিহার্য ¦ জীবনকে বাদ দিয়ে জীবনের অস্তিত্ব কল্পনা করা কি কখনও সম্ভব? আসলে জীবন একটাই ¦ শুধু আকার আকৃতি গঠন অবয়বে আছে ভিন্নতা ¦ আর এই ভিন্নতার উপর কতৃত্ব সৃষ্টির কাল, পৌরাণিক যুগ - ব্রাহ্মণ্যবাদ ¦ এখানেও শোষক আর শোষিতের শ্রেণী বিভাজন সৃষ্টি করে প্রভুত্ববাদ কায়েম এবং আবহমান কাল ধরে তাকে সযত্নে লালন করার চিরন্তন প্রয়াসবহুযুগ পেরিয়ে এসে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সমৃদ্ধ মানবজাতির সিংহভাগ মনন, আজ তবুও কোথায় যেন উচ্চারণে প্রগতির ধ্বজা উড়িয়ে, গৃহকোণ নিরালায় ৮ই মার্চের প্রতি করুণাময় দৃষ্টিপাতে অভ্যস্ত¦ তাই, শেষ হোক আজ ৮ই মার্চের পুনরুচ্চারণ - গণকণ্ঠে ধ্বনিত হোক - আজ  " বিশ্ব গণ জাগরণ দিবস" - যে দিবসে কোন লিঙ্গভেদের গল্প থাকবে না,থাকবে না লড়াই করে অধিকার অর্জনের প্রশ্ন, থাকবে শুধুই জন্মগত সম অধিকার - আর থাকবে মানব হৃদয় জাগরুক করে তোলার সর্বত: শপথবাণী উচ্চারণ¦ সম্ভব? সম্ভব কি?

 

 

রংরুট:  সমাজে নারীর সম্মান প্রতিষ্ঠিত না হলে কোনো দেশ জাতি সমাজ উন্নত হতে পারে না। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?

 

চম্পা ভট্টাচার্য্য: পৃথিবীর যেখানে নারী সম্মানের আসনে সেই দেশ সবসময়ই উন্নতির শিখরে অবস্থান করে নারীকে বাদ দিয়ে কোনোও দেশ বা জাতির উন্নতি সম্ভব নয় পৃথিবীতে বেশ কয়েকটি দেশ আছে যেখানে কর্মক্ষেত্রে নারী পুরুষ ভাগ নেই বললেই চলে, সেখানে মেয়েরা প্লেন চালান থেকে বড়ো বড়ো ডিপার্টমেন্টাল দোকান চালানো সব করছে আবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে আসীন বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে অজানাকে আবিষ্কার করায় যুক্ত সেসব দেশে মেয়েরা মাঝরাতে অনায়াসে নিজের ইচ্ছে মতো চলাফেরা করতে পারে নারীকে সম্মান দিতে পারলে সমাজ তাতে উপকৃত হবে এই বোধটা নারী পুরুষ নির্বিশেষে লালন করতে হবে।। যেসব দেশে নারীদের  যত মর্যাদা দেওয়া হয় সেই দেশ বিশ্বের দরবারে তত প্রতিষ্ঠিত, আমেরিকা, বৃটেন, জাপান,  জার্মান, কানাডা দেশের কথা আমরা বোলতে পারি নেপোলিয়ন বলেছিলেন " তোমরা আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি দেবো ॥

 

চম্পা ভট্টাচার্য্য শিলিগুড়ি, ভারত অবসর প্রাপ্ত সরকারী কর্মচারী, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য কর্মী সাংস্কৃতিক কর্মী, আবৃত্তিকার, সাথে একটু লেখালেখির চেষ্টা


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন