দেবযানী বসু ~ সাক্ষাৎকার

 

 

রংরুট:  আমাদের সমাজে সংসারে মেয়ে হয়ে জন্মানো সত্যিই কি বিড়ম্বনা বলে মনে হয়েছে কখনো জীবনের কোনো পর্বে?

 

দেবযানী বসু: না কখনো বিড়ম্বনা বলে মনে হয় নি। শিক্ষালাভ, পারিবারিক নানা গড়পড়তা অশান্তি ইত্যাদির ভিতর দিয়ে হাঁসের মতো সাঁতার দিয়েছি। মেয়েদের মধ্যে যে কমনীয়তা আনুগত্য সহ্যশক্তি থাকা দরকার সব প্রচুর পরিমাণে ছিল। তা দিয়েই বাধাবিপত্তি কাটিয়ে এসেছি। মেয়ে হয়েছি বলে কখনো কোন হীনমন্যতায় ভুগি নি। আমি আমার অন্তর্নিহিত গুনাবলী সম্পর্কে সচেতন ছিলাম বলে পুরুষ তার ঘরে হোক বা বাইরের হোক কাউকে ভয় পাই নি। কারো প্রতি শত্রুতাবোধেও আক্রান্ত হই নি।জীবনে পরিবর্তন বলতে ঐ শ্বশুর বাড়িতে আসা।শুধু নিজেকে সহজাত ব্যক্তিত্বময়ী করে তোলার চেষ্টা করেছি নিজের কাজের প্রতি কর্তব্যনিষ্ঠ থেকে। সমাজের সঙ্গে আদানপ্রদানে সামান্য মাটির প্রদীপ হয়ে জ্বলছি এ টুকুই যথেষ্ট।

 

 

রংরুট:  শৈশব কাটিয়ে কৈশোরে পৌঁছে ছেলে মেয়েদের চলাফেরা ওঠা বসার মধ্যে পার্থক্য গুলো কেমন লাগতো আপনার?

 

দেবযানী বসু: আমাদের বাড়ি থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরেই ছিল ধানক্ষেত। ঝোপঝাড় জঙ্গলে ভরা পাড়া। অনেক দূরে একটা সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ইত্যাদি। টিভি তখনো আসে নি। ধানক্ষেতে নকশালিস্টদের মৃতদেহ। একটা ট্রানজিস্টার রেডিও ছিল বাড়িতে। অনেক বয়স পর্যন্ত বাল্যের সারল্য বজায় ছিল। তবে এখনো সরলতা আঠার মতো জমৈ থাকে মনে। একটু গেছো টাইপের ছিলাম।  ছেলেরা হবে পাহাড়ের মতো আর মেয়েরা তাদের বুকে ঝরনাধারার মতো বয়ে যাবে এরকম একটা ধারণা ছিল। পার্থক্যর দিকে তাকানোর মতো নজর তৈরি হয় নি। অত জোরে হেসো না। অত দাপাদাপি কোর না  বললে শুনছে কে! হু হু করে পিচরাস্তায় সাইকেল চালাতাম। দুমদাম ঝাঁপ দিয়ে পুকুরে সাঁতার কাটতাম। পঁচিশে বৈশাখ নাটক গান  নাচ পাড়ার ছেলেমেয়েরা মিলে।এই করতে করতে ষোল পেরিয়ে গেলাম। গুরুজন পাড়া পড়শি অচেনা ছেলেরা যে যার মতো করে গালাগালি টিটকারি দিত। শুনতাম না। পরের দিকে লেখাপড়া এসে শান্ত করে দিল আমাকে। সে ভাবে বন্ধুবান্ধব মেলামেশা হৈচৈ কিছুই ছিল না আর। জানতাম পার্থক্য আছে কিন্তু তা নিয়ে কখনো বিদ্রোহিনী হই নি। ছেলেদের মতো হাফপ্যান্ট পরে থাকার কথা ভাবাই যেত না। সন্ধ্যার পরে বাড়ির বাইরে থাকা যেত না। অভিযোগ ছিল না তাই নিয়ে। খুব শাসন ছিল বাড়িতে। প্রেম করার তীব্র বিরোধিতায় ছিলেন গুরুজনরা। বাবা কোএডুকেশন স্কুলে কলেজে পড়তে দেন নি। পৃথিবীতে একমাত্র বন্ধু ছিল বই। নানারকমের বই। সমবয়সী ছেলেবন্ধুরা দূরের জগতের লোক।

 

 

রংরুট:  আমাদের বাঙালি সমাজে একেবারে সংসারের ভেতরেই ছেলেমেয়েদের মধ্যে ছোট থেকেই একটা বৈষম্যমূলক আচরণের ধারাবাহিকতা চলে আসছে আবহমানকাল ব্যাপী। পরিতাপের কথা যে মেয়েটি নিজের বাড়িতেই এই বৈষম্যের পরিবেশে বেড়ে ওঠে , সেই কিন্তু গৃহকর্ত্রীরূপে আবার নিজের সংসারেও এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। এই বিষয়টি আপনাকে কতটা ও কিভাবে নাড়া দেয় ?

 

দেবযানী বসু: আমার বাবা মার মধ্যে এরকম কোন জটিলতা বা সংস্কার ছিল না। আমরা ভাইবোনেরা সমান যত্ন পেয়েছি। সমানভাবে উপহার পেয়েছি। দুজনেই শিক্ষিত চাকুরিরত উন্নতমনের অধিকারী ছিলেন।  তারা ছেলেমেয়ে ভেদাভেদ করতেন না। দ্বিতীয়ত এইধরণের লিঙ্গবৈষম্যজনিত নানা মানসিক বৃত্তি যা কিনা দমনমূলক তার প্রয়োগেরও শিকার হই নি বা আত্মীয় পরিজনদের কাউকে এরকম মনোভাবাপন্ন দেখি নি। আমার শাশুড়িও কখনো প্রতিশোধমূলক আচরণ করেন নি। পরস্পর বেশ বন্ধুত্বভাবাপন্ন  ছিলাম। এই জাতীয় মানসিকতা ধারাবাহিক বাংলা সিরিয়ালেই দেখায় বোধহয়। কিউকি শাসভি কভি বহু থী মনে পড়ে যাচ্ছে। এই প্রতিশোধপরায়ণা শাশুড়ি যদি বাঙালির ঘরে এখনো থাকে তবে তারা নিপাত যাক আমি বলব। আছে হয়তো হারমিট ক্র্যাব হয়ে। চিনে নিতে হবে। তবে এইসব শাশুড়িরা কি মেয়ের ঘরে গিয়ে জামাইয়ের উপর অনুশাসন বলবৎ করেন এটা আমার কৌতূহল।

 

 

রংরুট:  পিতৃতন্ত্রের যে ঘেরাটোপে নারীর জীবন সেইটি আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে কতোটা প্রভাবিত করে?

 

দেবযানী বসু: এখন তো ছোট পরিবার সুখি পরিবার। বাবাদের অপূর্ণ আকাঙ্খা পূর্ণ করতে বাচ্চাদের সময় কেটে যায়। অনেক বাচ্চা সংসারে ট্রাজেডি ঘটিয়ে ফেলে সেই দায় থেকে মুক্তি পেতে। বড়ো বাচ্চারা প্রেম বিবাহ সম্পত্তিজনিত নানা তর্ক বিতর্কের শিকার হয়ে হয় বাবার থেকে বিচ্ছিন হয়ে যায় নতুবা আত্মসমর্পণ করে।একটা বয়স পর্যন্ত বাবার শাসন থাকবেই। নতুবা সন্তান বিপথে চলে যায়। আদর্শ বাবা মানেই সবসময় আদর ও শাস্তি তুল্যমূল্য অবস্থানে থাকবে। ঘেরাটোপ ক্ষতিই করে। বরঞ্চ সন্তানদের সামান্য স্বাধীনতা দেওয়া ভালো। তবে সুখের কথা এই যে ছবি বিশ্বাস বা পাহাড়ি সান্যালের মতো বাবার সংখ্যা সমাজে কমে আসছে। সোনার হরিণদিগকে এখনো কি পাগল প্রতিপন্ন হতে হয়? সন্তান বিপদে আপদে পড়লে সেই তো বাবা মাকে ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়। ক্ষতি যা হয় তা বাবা মাকে সহ্য করতে হয়। উদ্দাম উচ্ছৃঙ্খল সন্তান কোন বাবা মা চান না। এখন সমাজে অনেক ওপেন মাইন্ডেড বাবা সহজলভ্য।পিতার কিছু ব্যাকসেট সন্তানকেও বুঝতে হবে দরদ দিয়ে। একেবারে গোড়া মৌলবাদী বাবা আমার পছন্দের নয়। বাবাদের নানারকম মৌলবাদিতার শিকার সন্তানরাই হন।সন্তানদের তার বিরুদ্ধে প্রায় যুদ্ধ ঘোষণা করতে হয়। এ বিষয়ে নারীরা বিপদগ্ৰস্ত হয় বেশি। বিবাহে অনিচ্ছুক কন্যাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়। যতক্ষণ না মেয়েটি রাজি হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবারে মেলোড্রামাটিক সিচুয়েশন তৈরি করা হয়। ভেজাতে বিয়ে করতে চাইলে আর রক্ষা নেই। মেয়েদের যে কোন প্রেমকে ইনফ্যাচুয়েশন ধরে নেওয়া হয়। কিছু দিন আগে রিজওয়ানুর রহমান এর ঘটনাটার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি আমরা। নারীর জীবন নারী নিজেই তৈরি করে নেবে নিজের নিরাপত্তাকে ঠিক রেখে। চাকরি পেশা বিবাহ উচ্চশিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে দ্বন্দ্বের সময়ে বোঝা যায় পিতৃতন্ত্র কতোটা শক্তিশালী। পণ  দেওয়া ও নেওয়ার মধ্যে ঐ পিতৃতন্ত্রের মূল প্রতিষ্ঠিত থাকে। ছেলেরা সেই সময়ে বাবার সুবোধ বালক হয়ে যায়।

 

 

রংরুট:  নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যে খুবই জরুরি সে নিয়ে আজ আর বিতর্কের অবকাশ নেই। কিন্তু দুঃখের সাথে লক্ষ করা যায় অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী নারীও সমাজ সংসারে অভিভাবকত্ব অর্জনে বাধাপ্রাপ্ত হয়‌। এই বিষয়ে আপনার অভিমত কি?

 

দেবযানী বসু: সংসার হচ্ছে সেই ছুরির ধারের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া। পরিবার ও কাজের ক্ষেত্র দাড়িপাল্লার দুটো দিক।চাকরি করার পর ঘরের কাজে স্বাভাবিকভাবেই একটু কম মনোরোগ পড়ে। কাজ বাকি থাকে।সেই ফাটল দিয়েই অশান্তি ঢুকে পড়ে। তাছাড়া এরকম পরিবারও আছে চাকরি করলেই সেখানে হাতে নাড়ুর মতো ব্যক্তি স্বাধীনতা আসে না মেয়ে বৌদের। চাকরি করা মেয়েরা বেশির ভাগই শোষিত হন। যার বৌকে যে যতটা পারে বোকা বানিয়ে রাখতে চায়। বাড়ির আর পাঁচজন সেই তালে তাল মেলায়।চাকরি করা বৌয়ের কাছে বাড়ির সবাই কিছু না কিছু প্রাপ্তিযোগ আশা করে। কিন্তু সম্মান ততটা দেয় না। গুরুত্বপূর্ন কোনো আলোচনায় তার মতামত গ্ৰাহ্য হয় না। জীবনের শেষে তার সংসারও হাতছাড়া হয়ে যায় টাকাপয়সাও যায়। দেখা যায় তার সন্তানরাই তাকে পাত্তা দিচ্ছে না। সন্তানদেরকে মা সম্পর্কে অনেক ভুল বোঝানো হয়। বাড়ির মহিলা সদস্যদের এতে প্রয়োজনীয় ভূমিকা থাকে। কাঁচের মানুষরাই ভুলিয়ে ভালিয়ে টাকা আত্মসাৎ করে। শ্বশুর বাড়িতে সংসারের প্রয়োজনে টাকা দিতে সে বাধ্য নতুবা বিচ্ছেদের ভয় দেখানো হয়। এইসব মহিলারা যদি মৃদুভাষী আর দয়াময়ী হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। মেয়েদের অতিরিক্ত কমপ্যাসনেট হওয়া ও আত্মত্যাগের ব্যাপারটা ছাড়তে বলব। নিজের না টাকে না আর হ্যাঁ টাকে হ্যাঁ রাখতে হবে। যথেষ্ট ব্যক্তিত্ব ও প্রতিবাদী স্বভাবের হতে হবে। স্বার্থপর হবার তকমা গায়ে লেগে যেতে পারে। নারীকে দাসীভাবা একগুঁয়ে বদমেজাজি পুরুষদের স্ত্রীরাই এভাবে কোনঠাসা হয়ে থাকে। সামাজিক ক্ষেত্রে স্বামীর প্রতাপ অতিরিক্ত থাকা ইনফ্লুয়েন্সিয়াল থাকা এইসব নারীদের গুটিয়ে থাকার কারণ। বোকা আবেগময় কোমল থাকার অভ্যেস নারীকে ত্যাগ করতেই হবে। মেয়েদেরকে বেশি করে ডাউন টু আর্থ হয়ে যেতে হবে।

 

 

রংরুট:  এই প্রসঙ্গে আমাদের সমাজ বাস্তবতায় লিঙ্গবৈষম্যর বিষয়টি একজন সমাজসচেতন মানুষ হিসেবে আপনাকে কতটা বিচলিত করে। সেই বিচলনের রূপ ও বিকাশ সম্বন্ধে যদি আমাদের অবহিত করেন।

 

দেবযানী বসু: One man one value one vote -- এতদিন বাদে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ভোটাধিকার পেল। আর মেয়েদের অধিকার মেয়েদেরই আদায় করতে হবে এরকম কথা তো রবীন্দ্রনাথও বলেছিলেন। মেয়েরা কাঁদলে তবে সরকার দৃষ্টি দেবে তাদের সমস্যার প্রতি। তবে কাঁদতে হবে বিরক্তিকর ঘ্যানঘ্যান করে। না কাঁদলে তো মায়েও দুধপান করায় না। বাচ্চা যারা গায়ে গতরে খেটে মানুষ করে তাদের জন্য বাচ্চাকোলে লেডিস ট্রেনে বাসে সর্বত্র অগ্ৰাধিকার পাক বসার জন্য। বাসে ট্রামে অশ্লীল নিপীড়নের শিকার মহিলারা কি সাম্যের কথা বলবে! লিঙ্গবৈষম্য অনেক দিন থাকবে যতদিন না পুরুষরা নিজেদের মানসিকতার পরিবর্তন করে। মেয়েদের জন্য সংরক্ষণও চলবে। চাকরির ক্ষেত্রে টাকার ফারাক একটা বিরাট ব্যাপার। প্রোমোশান আটকে যাওয়াটাও লক্ষনীয়। বলিউডের নায়িকারা এ বিষয়ে সর্ব হয় বেশি। একসময় মিটু আন্দোলন জোরদার ছিল। এখনো নায়করা বেশি টাকা পায়। একদল মেয়েদেরকে বোরখায় ঘোমটায় ঢাকতে চায়।আরেক দল স্বল্পবেশা করে তুলতে চায়। শিক্ষার ক্ষেত্রেও পরিবারে পুত্রসন্তানের প্রতি খরচ করা হয় বেশি। মেয়েরা বেশি লম্বা হলে, বেশি পড়াশোনা করলে সাধারণত পাত্র খোঁজা এক হ্যাপা-- এরকমই শুনে এসেছি। মেয়ে তো বিয়ে হয়ে যাবে এজাতীয় বিচার কাজ করে বেশি। আদালতে ধর্ষণের বিচার এক প্রহসণ। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা সাধারণ মানুষ থেকে আরো বঞ্চিত। এমনকি জেলের তথাকথিত সুরক্ষা বলয়ের ভিতর সেক্স ডিসক্রিমিনেশন চলে।একটা কোরাপ্টেড দেশে ভালো কিছু হওয়া মুস্কিল। মেয়েরা এটা বুঝছে না মত চুপ করে থাকবে তত সমস্যা বাড়বে। অতএব কণ্ঠ ছাড় জোরে। হাতগরম সুফল হয়তো এখনি পাবে না। তবু কণ্ঠ ছাড় জোরে। বিদেশের মেয়েরা অনেক আগেই সচেতন হয়েছে। সেখানে মেয়েদের যৌনতা সম্পর্কিত যত্নাদি এবং শিশুস্বাস্থ্যরক্ষা দায়িত্ব সহকারে দেখা হয়। নারীদের নিয়ে শ্রমের বাজারে নানা অসাম্য আছে। এখানে আছে বেশি মাত্রায়। এখানে মেয়েদের গৃহবধূদের শ্রমকে থ্যাঙ্কলেস জব বলা হয়। আবার এও ঠিক যে পুরুষরা যেভাবে যৌনজীবন উপভোগ করে খুব মুষ্টিমেয় নারী তা পায়,ভয়ে লজ্জায় বঞ্চিত রাখে নিজেকে।

 

 

রংরুট:  বর্তমান সমাজে নারী নির্যাতনের বিষয়টি কি রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে বলে মনে হয় আপনার ? সামাজিক ভাবে আমাদের ভূমিকাই বা কি হওয়া উচিত এই বিষয়ে ?

 

দেবযানী বসু: ক্ষমতাসীন সরকার (কেন্দ্র ও রাজ্য) কখনো ফোর ফ্রন্টে আসতে চায় না। কারণ তাহলে জনপ্রিয়তা হারাবে। জনসচেতনতাই একমাত্র পথ। সরকার বলতে সরকারি কুরসিতে উপবিষ্ট মানুষদের ক্ষমতাবলে সু আইনের অপপ্রয়োগ চলতে থাকে। পুলিশ উকিল রাজনীতির মানুষ দাদাদের ত্রয়ী আঁতাতে সাদাকে কালো কালোকে সাদা প্রতিপন্ন করা হয়। সাক্ষী খুন লক আসে পিটিয়ে মারা চলতেই থাকে। আইন আদালতের দীর্ঘসূত্রিতা ক্রিমিনাল লইয়ারদের  মৌরুসিপাট্টা নারী নির্যাতনের বিষয়টিকে মর্যাদাহীন ও গুরুত্বহীন করে তোলে। এক অ্যাসিড মারার ইতিবৃত্ত লিখতে বসলে হাজার পাতায়ও কুলোবে না। মানুষ কোথায় যাবে? সেই থানা ও আদালতের গাড্ডায় গিয়ে উপস্থিত হতে হবে তাদের। কথায় বলে মামলার পাহাড় জমে গিয়েছে। সাধারণত পণপ্রথা একটা ওপেন সিক্রেট হয়ে আছে। নাবালিকা বিবাহ হরবখত চলছে। দারিদ্রক্লিষ্ট মানুষকে আইনের সুফল বোঝানো একা সরকারের দায় নয়। সরকার যেখানে ঠুঁটো জগন্নাথ বেসরকারি উদ্যোগে দেশের কাজ চালানো যেতে পারে। একদিক থেকে দেখতে গেলে সরকারকে অন্ধ করে রেখেছে আমাদেরি মধ্যেকার কেউ কেউ। অন্যায় করা হচ্ছে দেখেও মানুষ আজকাল চুপ করে থাকে। কে কোথায় সাহসী হচ্ছে? তারা সাহসী হচ্ছে তাদেরকে ব্যতিক্রম বলে গণ্য করা হয়। তৃণসম সবাই দাহ্য হয়ে জীবনযাপন করছি। সামাজিক ভাবে সাহসীর ভূমিকায় প্লে করা মেরুদন্ডহীন স্বার্থপর মানুষের পক্ষে সম্ভব না। অর্থনৈতিক শ্রেণী বৈষম্যের ধাঁধায় ও ধাঁচে তৈরি এই গণতান্ত্রিক দেশে উচ্চশ্রেণী থেকে দয়া নিম্নশ্রেণীতে চুঁইয়ে পড়ে। সেইটুকুনিকে ভরসা করে চলতে হবে।

 

 

রংরুট:  বাড়ির বাইরে মেয়েদের সুরক্ষার বিষয়টি আজো কেন এত অবহেলিত ! কি মনে হয় আপনার?


দেবযানী বসু: পূর্ববর্তী প্রশ্নের প্রসঙ্গ ধরেই পরবর্তী প্রশ্নের উত্তরে আসা যায়। পরবর্তী প্রশ্নটি একই দৃষ্টিভঙ্গী বহন করছে। মেয়েদের সুরক্ষার প্রশ্ন। যেহেতু মেয়েদের রক্ষা মেয়েরা করতে পারছে না। স্বামী বা ভাই সঙ্গে থাকলে তারাও খুন হয়ে যাচ্ছে। জানি মেয়েদের সুরক্ষায় নিয়োজিত লংকাগুঁড়ো ও জুডো ক্যারাটে। যদিও বাড়িতে দুধটা আপেলটা মাংসটার ভাগ জোটে কিনা সন্দেহ। এসব প্রাচীনপন্থী মায়েদের দূরদর্শিতার ফল। পুরুষ সন্তানটি রোজগেরে হবে। সুতরাং ভালোবাসাটুকু একমুখী হয়ে যায়। কন্যাসন্তান আজও অবাঞ্ছিত। তবু পশ্চিমবঙ্গে কিছু কন্যাসন্তান জন্মে যায়। নতুবা এখানেও যে সব ক্লিনিকগুলো সেয়ানা অন্ধের রোল প্লে করে তার সংখ্যা বোধ হয় কম। ব্যতিক্রমী সংসারগুলো ধর্তব্যের মধ্যেই আসছে না। সুতরাং গোড়ায় গলদ এই সংসারেই। বিন্দু বিন্দু অবহেলা জমেই না এত বড় অন্ধ সমাজ তৈরি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মহিলা হলেই মেয়েদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে , এ এক বাতুলতা।ইন্দিরা গান্ধী এত বছর রাজত্ব করে কোন সীতারাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন? ভেবে দেখবেন গ্ৰামবাংলা অবহেলিত , পরিবেশের সুরক্ষা অবহেলিত , পানীয় জল অবহেলিত, সৌরবিদ্যুৎ অবহেলিত প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা অবহেলিত। এবং সংখ্যা বেড়েই যাবে। নারীসুরক্ষা সুন্দর ভাবে মেইনটেইন করা হচ্ছে তাই কখনো হয়? যে সব বরুণ বিশ্বাস চলে যায় তাদের শূন্যস্থান আর পূর্ণ হয় না। সব মেয়েরা গীতা ফোগত না হলেও তার এক শতাংশ গুন মেয়েদের থাকা দরকার। খেলার জগতেও মেয়েরা নানা বঞ্চনা ও কুৎসিত আচরণের শিকার হন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এটা আমরা স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছি। তারা প্রতিবাদ করছে তারাই অ্যাসিডের মার খাচ্ছে। বিবাহিত নারীদেরকে হত্যাসিরিজ বন্ধ হবার নয়। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কোনো শক্তপোক্ত আইন নেই। এর মধ্যে ধর্মের ভন্ড  ধ্বজাধারীরা আরেক ধরণের জনগণের মাথায় হাত বুলিয়ে ধান্দাবাজি করে যাচ্ছে। এতে নারীরা কম ক্ষতিগ্ৰস্ত হচ্ছে না। সরকারে মহিলা এলে তাদেরকে হত্যা করা হয় না? সরকার সাধারণ নারীদের কথা ভেবেই আলাদা করে ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে। কন্যাশ্রী করেছে তার অপব্যবহার করছে বাড়ির গুরুজনেরা। সরকারি টাকা নয়ছয়ের তো শেষ নেই। ঠিক বাছতে গা উজাড়। আথেনিয়ান ডেমোক্রেসি থেকে  যাত্রা শুরু করে তার পরিণতি পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যে এমন ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে কে আশা করেছিল ?

 

 

রংরুট:  আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন আর সারাবছর নারী নির্যাতনের ধারাবাহিক ব্রেকিং নিউজ এর মধ্যে সমন্বয় হবে কি করে? মেয়েদের এই বিষয়ে কি কর্তব্য আপনার মতে?


দেবযানী বসু: এই প্রশ্নটার মধ্যেও রয়ে যাচ্ছে সেই সুরক্ষা ও কর্তব্যের প্রশ্ন। নারীদের সুরক্ষার সমস্যা একটা ভারতবর্ষের নয়। বাইরের দেশ থেকে এসেছে নারীমুক্তি আন্দোলনের ঢেউ। সে সব দেশের লড়াই এখনো থামেনি। হাজার হাজার নারীকল্যান সমিতিতে দেশ ভরে গেছে আর ব্যাঙের ছাতার মতো হোম। বিশেষত হোমগুলোর দুর্নীতি তো দেখা যাচ্ছে টিভিতে খবরে। নারীপাচার, শিশুবদল, নারীবিক্রি, শিশুবিক্রির কোনো খামতি নেই। রেডজোনকে একটা ডিসিপ্লিনড ও সুস্বাস্থ্যময় করে তোলাও শাসকদের দায়িত্বের মধ্যে পড়া উচিত। সভ্য দেশ হিসেবে এখানে আছে স্বচ্ছাসেবী গোষ্ঠী, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। সাধারণ ব্যক্তির নিজস্ব উদ্যোগ আছে। সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করে থাকে। তবে কোন সংস্থা সৎ কোনটি অসৎ নিজেকে বুঝে নিতে হবে। 'প্রেরণা' নামের একটি সরকারি সংস্থা আছে। গুড়িয়া ইন্ডিয়া রয়েছে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করার জন্য। ভয়ংকর এইডস রোগী নিয়ে কল্যানমূলক সংস্থা রয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টা হেল্পলাইন খুলে বসে আছে আয়োধ্যা সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান গুলি। পশ্চিমবঙ্গে মেয়েদের ওপর নানা অত্যাচার শ্লীলতাহানির জন্য ফোরনাইনটি কেস ও তার দশরকম বিভাগীয় আইনি ব্যবস্থা রয়েছে। গার্ল পাওয়ার নামে একটা বেশ বড় গুরুত্বপূর্ণ কথা শোনা যায় আজকাল। রয়েছে সরকারের চাইল্ড ডেভেলাপমেন্ট ও সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার দপ্তর রয়েছে। হেল্পএজ ইন্ডিয়ার মতো ফিলানথ্রোপিক  প্রতিষ্ঠান  বেশ নজরকাড়া।   তাও সর্ষের মধ্যে ভূত থেকে যায়। ট্রাফিক কন্ট্রোল ব্যবস্থা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতকিছুর পরেও রাস্তাঘাট বিশেষত রাত্রিতে মেয়েদের পক্ষে নিরাপদে চলার উপযোগী নয়। মেয়েদের জন্য দুর্ঘটনা ঘরে বাইরে ওৎ পেতে থাকে। ওলা উবরকৃত  বীভৎস কর্ম ঘটে চলে। নারীদিবস পালন করা এক ধরণের অ্যাওয়ারনেস , সেই চিন্তাধারাকে গুরুত্ব দেওয়া। জুলিয়া ক্রিস্তেভা , আয়ান র্যান্ড, সিমোন ডি বোভয়া, রোজ ওয়াইল্ডার শেষের সদর্থক ক্রিয়াশীলতাকে  সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া উচিত। সবসময়ই নারীবাদকে হাস্যকর টিকাটিপ্পনীসহ পরিবেশন করা কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের লক্ষণ নয়। মুস্কিল হয় নারী কল্যান সমিতির মাথার উপর রাজনীতির দাদা দিদিরা  খন ছড়ি ঘোরায়। মেয়েরা ভয় না পেয়ে প্রতিবাদ করবে এটাই বাঁচবার ও অন্য মেয়েকে বাঁচানোর একটিই রাস্তা।

 

 

রংরুট:  সমাজে নারীর সম্মান প্রতিষ্ঠিত না হলে কোনো দেশ জাতি সমাজ উন্নত হতে পারে না। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?

 

দেবযানী বসু: এবিষয়ে বাংলা সিরিয়ালগুলো বিশেষ নারী চরিত্রকে কেন্দ্র করে মেয়েদের অসম্মান বঞ্চনা সংগ্ৰাম ইত্যাদি দেখিয়ে যাচ্ছে। অসম্ভব শিক্ষিত ও ইন্টেলেকচুয়াল মহিলাদের বাদ দিলে বাংলা টিভি সিরিয়াল আপামর নারীসাধারণের উপযুক্ত। তাদের কাছে এর একটা সদর্থক প্রভাব আছে। বর্তমান কালের সাধারণ যুবক যুবতীরা বিবাহপ্রথায় বিশ্বাস রাখতে পারছে না।লিভ ইন করছে,যেটা আগে শুধু সিনেমা আর্টিস্টরা করত। রোগারক্ষম হলে নিজেদের চাহিদা গুলোকে রূপ দিতে পারছে। অনেক মেয়ে অবিবাহিত থাকছে। যৌনজীবনযাপনও বাঁধাধরা পথে এগোচ্ছে না। মেয়েদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হবার দৃঢ়তা জন্মাচ্ছে। বাংলায় সেই কোন নবজাগরণের কালে শিক্ষিত জমিদার ফিউডাল প্রভুদের হাত ধরে নারীশিক্ষার ( বিদ্যাসাগর সামন্তপ্রভু ছিলেন না) অবতারণা হয়েছিল, নারীরা শিক্ষিত হয়ে উঠছিলেন। তেমন বাল্যে পিতা, যৌবনে স্বামী, বার্ধক্যে পুত্র দ্বারা সংরক্ষিত গৃহপালিত প্রাণি হিসেবে থাকছেন না মহিলারা। গৃহে তারা আছেন তারা মর্যাদা সহ থাকতে চাইছেন। আশাবাদী তো আমি একশো শতাংশ। নামমাত্র বিবাহে ডিভোর্সিরা বিয়ে করছেন আবার। শ্বেতপাথরের থালার মতো বিবাহিত জীবনের তরঙ্গময়তাকে উপেক্ষা করছেন না। তবু উচ্চমধ্যবিত্ত  মধ্যবিত্ত ও নিম্ন বিত্তের নারীরা যতটা স্বাধীনভাবে সংসার করে এখন উনবিংশ শতাব্দীতে এতটা সুখ ছিল না। তবে পরিবারে নারী স্বাধীনতার পরিবেশ থাকলে শুভ। এখানেই একটি বাচ্চার ভবিষ্যৎ ,মন, স্বাস্থ্য ও উন্নত উদার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হবে। মেয়েরা বুঝেশুনে স্বার্থত্যাগ করুক অথবা স্বার্থরক্ষা করুক বাস্তবজীবনে মোকাবিলা করার সময়ে। ডিভোর্সকে আগে ততটা কলঙ্ককর মনে করা হতো এখন আর তা হয় না। বিবাহের আগে যৌনতাও অনেকটা সহজ ঘটনা। সতীত্ব নিয়ে ফালতু জলঘোলা করে কোন লাভ হয় না। যৌনতাময়কেলেঙ্কারির  ভয় দেখিয়ে মেয়েদেরকে সহজেই কোনঠাসা করা বা দাবিয়ে রাখা যায় সহজেই। মেয়েরা একটু বুদ্ধিমতী আর কুসংস্কারমুক্ত হলেই এ সব সমস্যার সমাধান করতে পারবে। পুরুষদের মস্তিষ্কের ওজন বেশি বলেই তারা বেশি বুদ্ধিমান এও তো নয়। সুযোগ সুবিধা পেলে মেয়েরা দায়িত্বশীল পদ সামলাতে পারে। গবেষক আবিষ্কারক হতে পারে। সৈনিক হয়। এখনো তাদের সংখ্যা মুষ্টিমেয়। একমাত্র বিবাহের হাঁড়িকাঠে  বেঁধে না ফেলে তাদেরকে সময় দেওয়া হোক দাঁড়াতে। সেকেন্ড সেক্স সেকেন্ড সিটিজেন তকমা গুলো ঝেড়ে ফেলতে সময়ের অপেক্ষা।


দেবযানী বসু: শূন্য দশকের কবি। বর্তমান নিবাস টালিগঞ্জ। গৃহবধূ। জন্ম ১৯৬০। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ও বি. এড.। পিতা : প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক ড. শীতল ঘোষ। স্বামী আইনজীবী। তিন  সন্তান বর্তমান। কৃত্তিবাস থেকে প্রথম কবিতার বই : দেবযানীর স্বীকারোক্তি। প্রতিভাস থেকে : স্বপ্নিল বর্ণমালা। সহযাত্রী থেকে : তৃতীয়া পৃথিবী। কবিতা ক‍্যাম্পাস থেকে : আইভরি খাতা। নোনামিঠে জলচিহ্ন। রেডিও অ‍্যাক্টিভ মিনারেল বৃষ্টি। সুতরাং থেকে : চৌরেখাবতী পিরামিডের অরোরা। সুতরাং থেকে স্ট্রবেরিগন্ধার যোজনপথ প্রকাশিত।

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন