রংরুট: আমাদের সমাজ সংসারে মেয়ে হয়ে
জন্মানো সত্যিই কি বিড়ম্বনা বলে মনে হয়েছে কখনো জীবনের কোন পর্বে?
সৌমী চৌধুরী: না।
বাবা মা বিশেষত মা সবসময়ই আমাকে শিখিয়েছেন,
সবরকম কাজ শিখতে এবং কোন কাজই
শুধুমাত্র ছেলে বা মেয়েদের হয় না। ফলে,
আমি স্বাবলম্বী হতে পেরেছি, অর্থনৈতিকভাবে তো বটেই, মানসিকভাবেও। আর তাই
কখনই নিজেকে মেয়ে বলে কুণ্ঠিত বোধ করি না।
রংরুট: শৈশব কাটিয়ে কৈশরে পৌঁছে ছেলে
মেয়েদের চলা ফেরা ওঠা বসার মধ্যে পার্থক্য গুলো প্রাথমিক ভাবে কেমন লাগতো আপনার?
সৌমী চৌধুরী: যেহেতু আমার বেড়ে ওঠা
নানান সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এবং আমার পড়াশোনা প্রথম থেকেই সহ-শিক্ষা মাধ্যমে, তাই কখনই ছেলে এবং
মেয়েদের চলা ফেরার মধ্যে পার্থক্য বিশেষ চোখে পড়ে নি। বরং, পরবর্তীকালে চাকরি সূত্রে
ভারতের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে এই পার্থক্য প্রথম নজরে পড়ে। এবং বুঝি আমরা বাঙালিরা এই
লিঙ্গ বৈষম্যের ব্যাপারে বেশ উন্নত চিন্তা ভাবনা পোষণ করি।
রংরুট: আমাদের বাঙালি সমাজে একেবারে
সংসারের ভেতরেই ছেলে মেয়েদের মধ্যে ছোট থেকেই একটা বৈষম্য মূলক আচরণের
ধারাবাহিকতা চলে আসছে আবহমান কাল ব্যাপী। পরিতাপের কথা, যে মেয়েটি নিজের
বাড়িতেই এই বৈষম্যের পরিবেশে বেড়ে ওঠে, সেই কিন্তু গৃহকর্ত্রীরূপে আবার নিজের সংসারেও এই
ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। এই বিষয়টি আপনাকে কতটা ও কিভাবে নাড়া দেয়?
সৌমী চৌধুরী: আবারও বলি, আমি যে পরিবেশে বড় হয়েছি, সেখানে এরকম বৈষম্য বেশ কম। তবে, এটা ঠিক যে, মেয়েদের প্রতি সংসারে
বৈষম্যমূলক আচরণ হয়েই থাকে। আর যে মেয়েটি এর শিকার সে গৃহকর্ত্রীরূপে সেই কাজটি করে
থাকে, কারণ সেও সে মুহূর্তে
পরিস্থিতির ও সমাজের শিকার। আমার মনে হয়, এক্ষেত্রে গৃহকর্তারও এগিয়ে এসে এর প্রতিবাদ করা উচিৎ।
ইদানীং কালে অনেক বিজ্ঞাপনে ছেলে মেয়েদের সমান দেখানো হচ্ছে এবং তাতে সমাজেও
যথারীতি প্রভাব পড়ছে, পরিস্থিতি
বদলাচ্ছে। ছেলে এবং মেয়েদের মধ্যে বৈষম্য কমছে।
রংরুট: পিতৃতন্ত্রের যে ঘেরাটোপে নারীর জীবন, সেইটি আপনাকে ব্যক্তিগত
ভাবে কতটা প্রভাবিত করে?
সৌমী চৌধুরী: এটার
একটা কুপ্রভাব আমি খুব সম্প্রতি চাক্ষুষ করেছি। পুলিশ স্টেশনে জেনারেল ডায়েরি
করাতে গিয়ে আমাকে স্বামী অথবা পিতার নাম আমার অভিভাবক হিসেবে লিখতে বলা হয়। এবং
যেহেতু আমি মহিলা তাই অভিভাবকহীন মহিলার থেকে কোন ডায়েরি নেওয়া হবে না জানানো হয়।
সেক্ষেত্রে আমার যুক্তি ছিল, আমার স্বামী নেই, বাবা বরিষ্ঠ নাগরিক, সুতরাং আমিই আমার বাবার
দেখভাল করি,
বরং আমি
তাঁর অভিভাবক। কিন্তু সেটা মেনে নেওয়া হয় নি। আমাকে আমার অভিভাবক হিসেবে বাবার নাম
লিখতে বাধ্য করা হয়। আমার মতে, অবিলম্বে আইন সংশোধন করা প্রয়োজন। একজন বরিষ্ঠ নাগরিক কখনই
একজন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের অভিভাবক হতে পারেন না। বরং উল্টোটাই হওয়া উচিৎ। একজন বরিষ্ঠ
নাগরিকের অভিভাবকের প্রয়োজন আছে, কারণ তাঁরা জরার কারণে শারীরিক ও মানসিক ভাবে অথর্ব হতে
শুরু করেন।
রংরুট: নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যে খুবই জরুরী সে
নিয়ে আজ আর বিতর্কের অবকাশ নেই। কিন্তু দুঃখের সাথে লক্ষ করা যায় অর্থনৈতিক ভাবে
স্বাবলম্বী নারীও সমাজ সংসারে সঅভিভাবকত্ব অর্জনে বাধা প্রাপ্ত হয় বেশির ভাগ
ক্ষেত্রেই। এই বিষয়ে আপনার অভিমত কি?
সৌমী চৌধুরী: আগের
প্রশ্নেই এর উত্তর দিয়েছি। প্রসঙ্গত, বিভিন্ন মাল্টি ন্যাশানাল কোম্পানি তে আজকাল লিঙ্গ উল্লেখ
অপশনাল হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং, ভারতীয় সরকারী ও বেসরকারি চাকরিতেও এটিকে ঐচ্ছিক করা
হোক। নারী পুরুষ না ভেবে মানুষ ভাবা শুরু হোক।
রংরুট: কথায় বলে সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। কিন্তু
এর পেছনে পুরুষতন্ত্রের কৌশলগত অবস্থানটি সম্বন্ধে সাধারণ ভাবে আমরা কতটা
ওয়াকিবহাল?
সৌমী চৌধুরী: আমি
কথাটার সাথে মোটেই একমত নই। সংসার দুজনের। স্বামী স্ত্রী দুজনের অবদান না থাকলে
সংসার সুখের হয় না। তাই, শুধু রমণীর গুণ বললে বলবো, এক, কুঁড়ে পুরুষরাই এরকম উক্তি করতে
পারেন,
দুই, নারীদেরও এটা শুনে
বিগলিত হয়ে প্রাণপাত করে সংসার সুখী করার দায় একার কাঁধে নেওয়ার প্রয়োজন নেই।
কিন্তু নারীরা সেটা করে এসেছে এককালে বলেই এমন প্রবচনের প্রচলন হয়েছে। যদিও, শিক্ষিত সমাজে এই
প্রবচনের প্রতিবাদী নারীর সংখ্যা বাড়ছে।
রংরুট: পেশাগত জগতে একজন নারী কতটা স্বাধীন আর কতটা
পরিস্থিতির শিকার, সেটা
নারীর ব্যক্তিত্বের উপর কতটা নির্ভর করে, আর কর্মজগতের বাস্তব অবকাঠামোর উপর কতটা নির্ভর করে?
সৌমী চৌধুরী: কোন
নারী কোন পেশার সাথে যুক্ত, তার ওপরে বিষয়টা নির্ভর করে। পরিস্থিতির শিকার যেমন, তেমনই কিছু নারীও
নিজেকে পরিস্থিতির শিকার বলে ভাবতে ভালবাসেন এবং তার সুযোগও নিয়ে থাকেন। ফলত, পেশাগত জগতে বৈষম্য আরও
গেড়ে বসতে থাকে। এখন মানব সম্পদ আইনে অনেক নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তাই, কর্মজগতের কাঠামোতেও
পরিবর্তন এসেছে। এখন নারীদের ক্ষেত্রে কাজ করাটা অনেক সহজ হয়েছে। তবে, এতদিনের সামাজিক
অনুন্নতি একদিনে তো মিটে যাওয়ার নয়, তাই নারীদেরকে তাঁদের কর্ম কুশলতা আরও বেশি করে প্রদর্শন
করতে হবে,
যাতে
তাঁদের প্রাপ্যটা তাঁরা অবলীলায় পেতে পারেন, অবহেলায় নয়।
রংরুট: এই প্রসঙ্গে আমাদের সমাজ বাস্তবতায় লিঙ্গ
বৈষম্যের বিষয়টি একজন সমাজ সচেতন মানুষ হিসাবে আপনাকে কতটা বিচলিত করে। সেই
বিচলনের রূপ ও বিকাশ সম্বন্ধে যদি আমাদের অবহিত করেন!
সৌমী চৌধুরী: আগের
প্রশ্ন গুলিতেই এর উত্তর দেওয়া হয়েছে
রংরুট: বর্তমান সমাজে নারী নির্যাতনের বিষয়টি কি
রাষ্ট্র ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে বলে মনে হয় আপনার? সামাজিক ভাবে আমাদের
ভূমিকাই বা কি হওয়া উচিত এই বিষয়ে?
সৌমী চৌধুরী: না।
রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। তবে তার বাহকেরা দুর্নীতি গ্রস্ত হওয়ার
কারণে সঠিক পদক্ষেপ সঠিক সময়ে নেওয়া হচ্ছে না বা যাচ্ছে না। আইন কে নিজের হাতে না
তুলে নেওয়াটাই যুক্তি যুক্ত। নারীর প্রতি নির্যাতন ও তার প্রতিবাদে আইন ব্যবস্থাকে
তুচ্ছ জ্ঞান করা দুটোই সমানভাবে বর্জনীয়। কারণ, অপরাধীকে শাস্তি দিতে গেলে সেই
আইনি ব্যবস্থারই সাহায্য নিতে হবে।
রংরুট: বাড়ির বাইরে মেয়েদের সুরক্ষার
বিষয়টি আজও কেন এত অবহেলিত! কি মনে হয় আপনার? দেশের প্রশাসনের শীর্ষপদে
মহিলারা নেতৃত্ব দিলেও অবস্থার উন্নতি হয় না কেন? গলদটা রয়ে যাচ্ছে কোথায়?
সৌমী চৌধুরী: শীর্ষপদে
যে মহিলা আছেন তিনি তো দেশের প্রত্যেকটি মহিলার সাথে গিয়ে গিয়ে তো আর সুরক্ষিত
করতে পারবেন না। নারী সুরক্ষার দায় সকলেরই। যে পুরুষটি বাড়ির বাইরে বেরোনো কোন
মহিলা সাথে জবরদস্তি করতে চায়, তার বন্ধুদের উচিৎ তখনই তাকে নিরস্ত করা। দুর্ভাগ্যের
কথা তা হয় না। পাঠক্রমে এই বিষয়ে পড়াশোনা শুরু হলে সমাজে সচেতনতা বাড়বে ও অপরাধের
সংখ্যা কমবে।
রংরুট: আন্তর্জাতিক নারীদিবস পালন আর সারা বছর নারী
নির্যাতনের ধারাবাহিত ব্রেকিং নিউজ, এর মধ্যে সমন্বয় হবে কি করে? মেয়েদের এই বিষয়ে কি কর্তব্য
আপনার মতে?
সৌমী চৌধুরী: আন্তর্জাতিক
নারীদিবস পালন করতে বাধা কোথায়? পুরুষদের জন্যেও বছরের একটা দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। আর
আন্তর্জাতিক নারীদিবস পালন আর নারী নির্যাতন দুটো যদি একই মানুষ করে থাকেন
সেক্ষেত্রে বিষয়টা ভয়ংকর। মুখোশ ধারী মানুষজন – নারী ও পুরুষ উভয়ই, যারা নারীকে নির্যাতন
করছে। তাই,
শুধু
মেয়েরা কেন?
মেয়েদের
সমস্যা শুধু মেয়েদের কেন? এটা সমাজের সমস্যা। মেয়েদের সাথে ছেলেদেরও তাই এই দুটি
বিষয়ই মাথায় রাখতে হবে। তবেই সমন্বয় সাধিত হবে।
রংরুট: সমাজে নারীর সম্মান প্রতিষ্ঠিত না হলে কোনো দেশ
জাতি সমাজ উন্নত হতে পারে না। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?
সৌমী চৌধুরী: আশাবাদী
তো হতেই হবে,
নইলে
নৈরাশ্য ঘিরে ধরবে। এতো দীর্ঘ বছরের বদ অভ্যেস পাল্টানো তো সহজ নয়। তবে, পাল্টাচ্ছে, খুব ধীরে হলেও।
সৌমী চৌধুরী: বেসরকারি ব্যাঙ্কে চাকুরিরতা এবং সময়াবকাশে লেখালেখি ও ঘোরাঘুরি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন