রেশমা লস্কর ~ সাক্ষাৎকার

 

 

রংরুট:  আমাদের সমাজ সংসারে মেয়ে হয়ে জন্মানো সত্যিই কি বিড়ম্বনা বলে মনে হয়েছে কখনো জীবনের কোন পর্বে?

 

রেশমা লস্কর: নারী জন্ম পুরুষ জন্ম এই প্রকৃতির এক স্বাভাবিক নিয়ম, প্রকৃতির সকল প্রাণীর ক্ষেত্রে এর কোনো ব্যতিক্রম নেই, সৃষ্টিকর্তা এমন ভাবেই সকলকে সৃষ্টি করেছেন মানুষ নিজেদের জীবনযাত্রার সুবিধার্থে গড়েছে সংসার  সৃষ্টি করেছে সমাজ এবং ঐই সমাজের নিয়মাবলী ঈশ্বর গর্ভধারণের ক্ষমতাটি দিয়েছেন নারীদের সেই কারণেই হয়তো নারীজাতি বাহুবলে সামান্য দূর্বল পুরুষের তুলনায়, অপর দিকে  পুরুষ জাতি বীজ বপন করতে সক্ষম হলেও গর্ভে ধারণে অক্ষম কিন্তু বাহুবল যেহেতু তাঁদের বেশি তাই তাঁরাই সমাজ ও সংসারের অধিপতি হয়ে বসে আছেন এবং নিজেদের সুবিধার্থে নিয়মনীতি তৈরি করে কখনো সংস্কারের নামে, কখনো ধর্মের নামে আবার কখনো কর্মের দোহাই দিয়ে নারীদের দমিয়ে রেখে অধিপত্য বজায় রাখার কাজটি করে চলেছেন যুগ যুগান্তর ধরে তাই মেয়ে হয়ে জম্মানো প্রকৃতির কাছে স্বাভাবিক নিয়ম হলেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আদর্শে বেড়ে ওঠা চিন্তাধারার কাছে বিরাম্বনা সৃষ্টি করে বহুক্ষেত্রে

তাই তো--- এক মহিলা কবির কলম লেখে

 

"হতাশ চিত্তে সমাজ কেঁদেছে

প্রথম যেদিন কেঁদেছি আমি,

তোমার প্রথম কান্নার স্বর

সমাজের দরে হয়েছে দামি"

 

ঐ সমাজের বিবাহ নামক রীতিতে মেয়েদের পিতৃগৃহ ত্যাগের নিয়মটিই তো সবচেয়ে বড়ো বিরম্বনা, আমিও একজন  মেয়ে তাই এর ব্যতিক্রম ন‌ই।

 

 

রংরুট:   শৈশব কাটিয়ে কৈশরে পৌঁছে ছেলে মেয়েদের চলা ফেরা ওঠা বসার মধ্যে পার্থক্য গুলো প্রাথমিক ভাবে কেমন লাগতো আপনার?

 

রেশমা লস্কর: আমার জন্ম আশির দশকে, খুবই সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে। জ্যাঠতুতো, খুড়তুতো সকল ভাইবোনেরা মিলে প্রচুর ছুটোছুটি খেলাধুলো করে কেটেছে শৈশব তখন মেয়ে বলে আলাদা কিছু মনে হয়নি নিজেকে, কিন্তু দূর্বার গতিতে ছুটে চলা চঞ্চল ঝর্ণা যেমন সমতলে এসে পৌঁছনোর পূর্বে  হঠাৎ করে শান্ত হয়ে যায় তেমনটাই হয় আমার বা আমার মতো কিছু মেয়ের ক্ষেত্রে অথচ  কিশোর ছেলে গুলি তখনও দূরন্ত বাতাসের মতো মাঠে খেলে বেড়ায়, তাদের চলা ফেরায় কোনো বাধা থাকে না, তাদের শারীরিক পরিবর্তন সমাজের কোনো হায়নার নজরের আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দু হয়না যা একজন কিশোরীর চলা ফেরার ক্ষেত্রে সদাই দেখা যায়। তাই তো একটি কিশোরীকে তাঁর পরিবার আগলে রাখার জন্যই বোধহয় নানা রকমের বাধা নিষেধ গুলি আরোপ করতে থাকে, কৈশোরেই তার সদ্য গজানো ছোট্ট ডানার পালক গুলি ধীরেধীরে ছেঁটে ফেলার অভ্যাস আয়ত্ত করতে শেখানো শুরু হয়ে যায়তাই কবিতার ভাষায় বলি -----

 

"এই সংসারে তুমি আর আমি --হেঁটে চলেছি এক‌ই সাথে,

আমার পায়ে নূপুর সেজেছে --তুমি ছুটে চলো খোলা মাঠে।

তুমি সমীরণ দিবা নিশিতে -- চলার নেইকো বারণ,

আমার জীবন মেদিনীর মাঝে -- গন্ডিতে করে বিচরণ।"---

 

স্বাভাবিক ভাবেই কৈশোর বয়সে ছেলে মেয়েদের মধ্যে এই ধরণের পার্থক্য গুলি মানার ইচ্ছা না থাকলেও মেনে নিতে একপ্রকার বাধ্য হয়েছিলাম সেই সময়।

 

 

রংরুট:   আমাদের বাঙালি সমাজে একেবারে সংসারের ভেতরেই ছেলে মেয়েদের মধ্যে ছোট থেকেই একটা বৈষম্য মূলক আচরণের ধারাবাহিকতা চলে আসছে আবহমান কাল ব্যাপী। পরিতাপের কথা, যে মেয়েটি নিজের বাড়িতেই এই বৈষম্যের পরিবেশে বেড়ে ওঠে, সেই কিন্তু গৃহকর্ত্রীরূপে আবার নিজের সংসারেও এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। এই বিষয়টি আপনাকে কতটা ও কিভাবে নাড়া দেয়?

 

রেশমা লস্কর: mশুধু বাঙালি কেনো, আমাদের ভারতবর্ষের সমগ্ৰ সমাজেই বৈষম্যমূলক আচরণের ধারাবাহিকতা অতি যত্নে লালন পালন করে রাখা হয়ে চলেছে বহুকাল ধরেকিছু ক্ষেত্রে আমার মনে হয় পুরুষের সেবা করা, পুরুষের কথা মেনে চলা,  সংসারের পুরুষ সদস্যটির জন্য নিজের অধিকার ত্যাগ করে পুরুষের কাছে নত হয়ে চলাটাকে নারীরা নিজেদের গুণ বলে মনে করেন হাজার অবহেলার মাঝে 'মানিয়ে চলা' গুণে গর্বিত তাঁরা তাই এক সময় যে মেয়েটি বৈষম্যের স্বিকার হয় অন্য কেউ সেই অবস্থায় মানিয়ে নিতে না পারলে তাঁরাই ভুল ত্রুটি ধরে নিজের মহত্ত্ব বজায় রাখতে চান। যুগ যুগ ধরে তাঁরা এটাই দেখেছেন ‌ও শিখেছেন   তবে এখন সময় বদলাচ্ছে নারীরা শিক্ষিত হয়ে নিজে উপার্জন করছে, বৈষম্যের ধারাবাহিকতা ভাঙার জন্য লড়াই করছে সমাজের সাথে আমি আশাবাদী নারী সমাজ একদিন ঠিক এই গতানুগতিক চিন্তাধারাকে বদলে এক বৈষম্য বিহীন সমাজ গড়তে পারবে।

 

 

রংরুট:   পিতৃতন্ত্রের যে ঘেরাটোপে নারীর জীবন, সেইটি আপনাকে ব্যক্তিগত ভাবে কতটা প্রভাবিত করে?

 

রেশমা লস্কর: একজন মানুষ সে নারী হোক বা পুরুষ‌ই হোক তাঁর জীবনে মায়ের আঁচল যেমন আগলে রাখে তেমনি পিতা তার মাথার ছাদের মতো রোদ- ঝড় -বৃষ্টি থেকে তাঁকে রক্ষা করে

একজন নারী সব থেকে বেশি সুরক্ষিত মনে করে তাঁর বাবার কাছে, বাবার মতো কি কেউ ভালোবাসতে পারে?  তাই বোধহয় বাবার কাছেই বেশির ভাগ কন্যার যত আহ্লাদ যত আবদার। কিন্তু একজন পুত্রের মতো একজন কন্যা সন্তানের সেই শীতল ছায়ার তলে থাকার সৌভাগ্য হয়না চিরকাল আমার ব্যাক্তিগত জীবনে বাবা শব্দটি খুব স্পর্শকাতর, পিতৃহারা আমি, আমি বাবার সবথেকে আদরের সন্তান ছিলাম ...... বাবার কথা বা পিতৃতন্ত্র যাই বলেন না কেনো সেখানে আমার বড়ো দাদার ভূমিকাও কম নয়, নিজের সন্তানের মতোই সে আমায় ভালোবাসেন এবং আমায় মানুষ করেছেন। এতো গেল আমার ব্যাক্তিগত জীবনের কথা , বাস্তবিক ক্ষেত্রে পিতৃতন্ত্রের ঘেরাটোপে  চিরকাল থেকে একজন নারীও চায় তাঁর সমস্ত স্বপ্ন পুরণ করে স্বাবলম্বী হয়ে স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকাতে, কিন্তু এই সমাজ আর সমাজের নিয়মাবলী ক জন নারীকে সেই সুযোগ করে দেয়? এই সমাজ তো চিরকাল‌ই শুধুমাত্র নারীদের উপরেই তন্ত্রের ঘেরাটোপ চাপিয়ে দিয়েছে..পিতা, ভ্রাতা,পতি বা পুত্র বিভিন্ন ক্ষণে বিভিন্ন রূপে

 

 

রংরুট:    নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যে খুবই জরুরী সে নিয়ে আজ আর বিতর্কের অবকাশ নেই। কিন্তু দুঃখের সাথে লক্ষ করা যায় অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী নারীও সমাজ সংসারে সঅভিভাবকত্ব অর্জনে বাধা প্রাপ্ত হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। এই বিষয়ে আপনার অভিমত কি?

 

রেশমা লস্কর:

 

'স্বাধীনতা তুমি জনমে পেয়েছো

আমি পেয়েছি দানে,

তাই বারেবারে হেরেছি তোমাতে

কেঁদেছি গো অভিমানে".......

 

আমাদের সমাজে নারীদের অধিকার ও যথাযোগ্য সম্মান প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন প্রতিটা নারীর শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী হয়ে ওঠা এই সমাজে মেয়েদের স্বাধীনতা .দান বলে মনে করা হয়, জন্মগত প্রাপ্তি নয় তাই অর্থনৈতিক দিক থেকে পুরুষের উপর নির্ভরশীল নারীদের পুরুষদের অনুগত হতে বাধ্য করে, নারীর  গৃহকর্মকে শ্রমের আওতায় ফেলা হয়না তাই তার আলাদা করে কোনো মূল্য পায় না অর্থ উপার্জন করতে হলে তাদের চৌকাঠের বাইরে বেরোতেই হয় এবং আমাদের সমাজে একটি গতানুগতিক ধারণা আছে নারী বাড়ির বাইরে বেরালেই খারাপ হয়ে যায়তাঁর চরিত্রের দিকে আঙ্গুল তোলা হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রথমে স্বামী তারপর শ্বশুর বাড়ির লোকজন এমনকি সেই মহিলা যদি স্বামীর গৃহ ত্যাগ করে সন্তানকে বড়ো করে সেই সন্তানটিও একসময় মায়ের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে! একজন নারীর বারবারন্ত এই সমাজ কখনোই মেনে নিতে পারে না। পেশাগত জীবনে সফলতা যেন তার সাংসারিক জীবনের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়.. হয় সংসার নয় পেশা,এই দুটোর মধ্যে যে কোনো একটা বেছে নিতে হয়  এমন অনেক উদাহরণ আছে সংসারে অশান্তির ভয়ে  মেয়েটি ভালো চাকুরী ছেড়ে দিয়েছেন আবার ভারত বর্ষের কয়েকজন বিখ্যাত মহিলা কর্মকেই ধর্ম মনে করে সফলতার শীর্ষে পৌঁছিয়েছেন, কিন্তু সংসার তাদের হয়নি হয়তো পুরুষরা হীন মান্যতায় ভোগেন তাই নারীর স্বাবলম্বীতা অপছন্দ করেন, হয়তো ওরা ভয় পায় এই ভেবে, সুযোগ পেলে লক্ষ্মীমন্ত নারীই মহা শক্তিশালী দুর্গা হয়ে উঠতে পারে, পুরুষের অধিপত্য নষ্ট হতে পারে, তাই নারীকে এগোতে দেওয়া যাবে না, তাই প্রাচীন কাল থেকেই নারীকে অশিক্ষিত করে চার দেওয়ালে বন্দি করে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখাযায় একজন অর্থনৈতিক ভাবে  পরনির্ভরশীল নারী অপর একজন স্বাবলম্বী নারীর দিকে শুধুমাত্র ঈর্ষান্বিত হয়ে বিভিন্ন রকমের অন্তরায় সৃষ্টি করে তবে সময়ের সাথে সাথে এই ধারণার পরিবর্তন হবে নিশ্চয়; আমি আশাবাদী, নারীরা এগোচ্ছে এবং স্ব‌অবিভাবকত্ব অর্জন করবে একদিন

 

 

রংরুট:  কথায় বলে সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। কিন্তু এর পেছনে পুরুষতন্ত্রের কৌশলগত অবস্থানটি সম্বন্ধে সাধারণ ভাবে আমরা কতটা ওয়াকিবহাল?

 

রেশমা লস্কর: সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে-- ---      ---------গুণবান পতি যদি থাকে তার সনে -----   পরবর্তী এই পংক্তিটি সুকৌশলে অপ্রকাশিত রাখা হয়েছে, রমণীর গুণটিকেই বড়ো করে দেখানো হয়েছে কারণ সংসারে দোষ গুণের মানদন্ডে শুধুমাত্র নারীকেউ বিচার করা হয়, পুরুষরা দোষ ত্রুটি বহির্ভূতসংসারের বাঁধনে নারীদের বেঁধে রাখার এ যেনো কৌশলগত প্রচেষ্টা অর্থাৎ রমণী একটি মাত্র‌ই কাজ করতে সক্ষম তা হলো সংসার সামলানো, তাই নারী তুমি তোমার সমস্তটুকু সংসারের সুখের জন্য ব্যয় করো আর  যদি অসফল হ‌ও তার জন্য রমণী তুমিই দায়ী হবে কারণ সংসারে সুখ শান্তি বজায় রাখতে তুমি অক্ষম সংসারের সুখ শান্তি বজায় রাখার দায়িত্বের দায় ভার থেকে পুরুষ মুক্ত তা সে যতো বড়‌ই অযোগ্য অধম হোক না কেনো রমণীর গুণের সাথে সাথে একটা সংসার সুখ শান্তি বজায় রাখতে গুণবান পতির যে সমানে প্রয়োজন আছে সেদিকে  ওয়াকিবহাল হ‌ওয়া প্রয়োজন পুরুষদের‌ও এ বিষয়ে দ্বায়িত্বশীল হতে হবে, উভয়ের সমান প্রচেষ্টায় একটি সংসার সুখের হবে

 

 

রংরুট:    পেশাগত জগতে একজন নারী কতটা স্বাধীন আর কতটা পরিস্থিতির শিকার, সেটা নারীর ব্যক্তিত্বের উপর কতটা নির্ভর করে, আর কর্মজগতের বাস্তব অবকাঠামোর উপর কতটা নির্ভর করে?

 

রেশমা লস্কর: পেশাগত জগতে একজন নারীর স্বাধীনতা সে কোন পেশায় নিযুক্ত তার উপর অনেকটাই নির্ভর করে, কিছু পেশা যা চিরকাল‌ই এই সমাজের চোখে সম্মানীয় যেমন ডাক্তার, শিক্ষক শিক্ষিকা বা কোনো উচ্চ পদস্থ সরকারি অফিসার  সেক্ষেত্রে এই সমাজ তাঁর পেশার কাছে নতিস্বীকার করে সম্মান করতে বাধ্য হয়, সে ক্ষেত্রে আপন যোগ্যতার বলে নারী সম্মান আদায় করে, কিন্তু সে স্থানটিতে পৌছাতে তাকে অনেক বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয় কিন্তু ক জন নারী এই সম্মানীয় পেশা গুলির সুযোগ পান! বেকারত্বের সংখ্যা যখন এতটাই বেশি তখন একজন পুরুষের সাথে সমান প্রতিযোগিতা করে তাকে কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকতে হয়, তার সাথে হায়না রূপি কিছু পুরুষের চোখ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে হয়, অনেক ক্ষেত্রেই চাকুরীর পদন্নতির জন্য মহিলা কর্মীটিকে শারীরিক সম্পর্কের টোপ দেওয়া হয়। কর্ম ক্ষেত্রে নারীদের নানা রকম হেনস্থার স্বিকার হতে হয় আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় নারীদের  কাজে নিলে সুরক্ষার দায় কম্পানির উপর পড়তে পারে সেই দায় এড়ানোর জন্যই অনেক জায়গায় নারীদের কাজে নেওয়া হয়না যে দেশে একজন নারী ডাক্তার রাতে রোগী দেখতে গিয়ে গণ ধর্ষণের স্বীকার হয় সে দেশে উচ্চ নিম্ন সব ধরনের পেশায় নারীরা অসুরক্ষিত অনেকের মতে কর্মরত মহিলার চলা ফেরা পোশাক আশাক পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাই বিভিন্ন রকম হেনস্থার ঘটনা গুলি ঘটে কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটে, যে মেয়েটি সভ্য ভদ্র নম্র হয়ে চলা ফেরা করে তাদের এই সমাজ দূর্বল মনে করে এবং হায়না গুলির স্বিকার তারাই প্রথমে হয় তাই পেশাগত জগতে টিকে থাকতে গেলে শুধু যোগ্য হলেই চলবে না, নিজেদের এমন ভাবে শক্ত করে তৈরি করতে হবে যে, যেকোনো রকম হেনস্থার যোগ্য জবাব দিতে হবে বর্তমান সময়ে কর্মজগতের অবকাঠামোর বিভিন্ন বাধাবিপত্তির সাথে লড়াই করে প্রচুর নারী স্বাধীন ভাবে উপার্জন করতে সক্ষম হচ্ছে, এই প্রজন্মে হয়তো মানুষের মানুষের গতানুগতিক ধারণার সামান্য পরিবর্তনের সুচনা শুরু হয়েছে আগামী দিনে তা আরও বৃদ্ধি পাবে আশারাখি আর এই অবকাঠামোর উন্নয়নের জন্য নারীদের সাথে পুরুষদের‌ও এগিয়ে আসতে হবে, তাঁর স্ত্রী কন্যা বা ভগিনীর কথা চিন্তা করে তাঁর মহিলা সহকর্মীটি যাতে কর্ম ক্ষেত্রে সঠিক পরিবেশ পান সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।



রংরুট:  এই প্রসঙ্গে আমাদের সমাজ বাস্তবতায় লিঙ্গ বৈষম্যের বিষয়টি একজন সমাজ সচেতন মানুষ হিসাবে আপনাকে কতটা বিচলিত করে। সেই বিচলনের রূপ ও বিকাশ সম্বন্ধে যদি আমাদের অবহিত করেন!

 

রেশমা লস্কর: লিঙ্গ বৈষম্য আমাদের সমাজে আজকের বিষয় নয় যুগ যুগান্তর থেকেই এর ধারাবাহিকতা চলে চলেছে নারীদের মনে, পুরুষের মনে সর্বপরি এই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজমান। বাহুবলে  পুরুষের তুলনায় দূর্বলতাই এর একমাত্র কারণ , পুরুষের তুলনায় নারীর শারীরিক গঠনগত পার্থক্য গুলিকে এই সমাজে অপরাধের মতো দেখা হত, নারীকে ছুত অচ্ছুতের আওতায় ফেলা হত নারীদের অশিক্ষিত করে, চার দেওয়ালে বন্দি করে বিভিন্ন নিয়মনীতি তৈরি করে পুরুষ নির্ভরশীল এবং পুরুষের দাসত্বে জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য করা হয়েছে  পুরুষের ছত্রতল ব্যাতিত নারীর জীবন মূল্যহীন এমন ভাবেই নারীদের তথা এই সমাজে বুকে বীজ বপন করা হয়েছে, তাই একটি সময়ে বৈধব্যের যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে নারী স্বেচ্ছায় স্বামীর চিতায় মৃত্যু বরণ করতেন এবং সতি হতেন একটি পরিবারে পুত্র সন্তান ও কন্যা সন্তানের পারিবারিক সম্পত্তির উপর আজও সম্পূর্ণ রূপে সমান অধিকারের জন্য নারীদের লড়ে যেতে হচ্ছে, এ সমাজে নারীদের চিরকাল আশ্রয়হীন করে রাখা হয়েছে, একজন পুত্র সন্তান যেমন ভাবে পৈত্রিক নিবাসে  বসবাসের অধিকার পায় একজন কন্যা কি পায়? যে চারটি দেওয়ালে নারীদের আবদ্ধ করে রাখা হয় সেই চার দেওয়ালের অধিকারীনি সে কখোনোই হয়না বাড়িটি কখনো বাবার কখনো স্বামীর বা পুত্র সন্তানের হয়, মেয়েদের নিজের কোনো বাড়িই থাকেনা! শুধুমাত্র আশ্রয়হীনতার ভয়ে কত নারী স্বামীর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার গুলি সহ্য করে চলেছে এই সকল বৈষম্য গুলি দূর করতে গেলে সর্বপ্রথম নারীদের শিক্ষিত হতে হবে এবর স্বনির্ভর হতে হবে শারীরিক ও মানসিক দুই দিক থেকেই শক্তিশালী হয়ে উঠতে, নারীদের সুরক্ষার জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন পুরুষের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে পুরুষের সাহায্য না নিয়ে নিজে কিভাবে বেঁচে বেরিয়ে আসতে পারে সে ভাবে গড়তে হবে কন্যা সন্তানদের নারীর নম্রতাকে যারা নারীর দূর্বলতা ভাবে তাদের এই ধারণাকে বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ভুল প্রমাণিত করতে হবে আইন করে প্রশাসনকে তৎপর হয়ে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, তার সাথে নারী পুরুষ উভয়কেই তাদের মনে পুষে রাখা অদি অনন্ত কালের চিন্তা ধারা গুলি বদলাতে হবে প্রতিটি মা প্রতিটি পিতা তাঁর পুত্র ও কন্যাকে সমাজে নারী পুরুষের অধিকারের মাঝে কোনো ব্যাবধান নেই এই সহবত টুকু শেখাতে হবে এবং তাদের সমান চোখে দেখতে হবে, তবেই ধীরেধীরে এই সমাজ বদলাবে বৈষম্য দূর হবে

 

 

রংরুট:    বর্তমান সমাজে নারী নির্যাতনের বিষয়টি কি রাষ্ট্র ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে বলে মনে হয় আপনার? সামাজিক ভাবে আমাদের ভূমিকাই বা কি হওয়া উচিত এই বিষয়ে?

 

রেশমা লস্কর: না, রাস্ট্র চাইলে অনেক কিছুই পারে রাস্ট্র যদি অনেক  কঠিন আইন প্রনয়ন করে, অপরাধের চরম শাস্তি দান করে এবং আইনের জটিলতায় দীর্ঘকাল ধরে কেসটি ঝুলিয়ে না রেখে তৎক্ষণাৎ সাজা ঘোষণা করে তবেই নির্যাতনের পরিমাণ কমতে পারে বলে আমার মনে হয়কিন্তু আমরা যাঁদের নির্বাচিত করে আমাদের সুরক্ষার জন্য রাস্ট্র চালানোর ক্ষমতা দিয়েছি তাঁরা শুধুমাত্র রাজনৈতিক কার্যকলাপে ব্যস্ত, নারী নির্যাতনের মতো বিষয়ের ব্যাপারে তাঁরা উদাসীন। একজন সাধারণ মানুষ কখনোই নারী নির্যাতনকে সমর্থন করবে না নিশ্চয়, সমাজে নারীনির্যাতনের ঘটনা ঘটলে তার প্রতিবাদ করা উচিত, নিজেদের বাড়ি বা তার আসে পাশে যাতে এমন ঘটনা না ঘটে সেই দিকে স্বজাগ থাকবে হবে,দলমত নির্বিশেষে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচ্চার হতে হবে আর মানুষের মাঝে যে অমানুষ মানুষের মুখোশ পরে লুকিয়ে রয়েছে তাদের খুঁজে বার করে  তাদের মুখোশ টেনে ছিঁড়ে ফেলতে হবে।

 

 

রংরুট: বাড়ির বাইরে মেয়েদের সুরক্ষার বিষয়টি আজও কেন এত অবহেলিত! কি মনে হয় আপনার? দেশের প্রশাসনের শীর্ষপদে মহিলারা নেতৃত্ব দিলেও অবস্থার উন্নতি হয় না কেন? গলদটা রয়ে যাচ্ছে কোথায়?

 

রেশমা লস্কর: যুগ যুগ ধরেই তো সুরক্ষার দোহাই দিয়ে নারীদের বাড়ির ভিতরে বন্ধ করে রাখার  একটি বদ্ধপরিকর ধারণা তৈরি করা হয়েছে এই সমাজে, তবে একজন নারী বাড়ির ভিতরেই যে একশোভাগ সুরক্ষিত এমন কিন্তু নয়, বাড়ির মধ্যেও নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনা চোখে পড়ে যাইহোক নারী সুরক্ষার ব্যাপারটি প্রসাশনের কাছে অবহেলার প্রধান কারণ‌ই হল পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, নির্যাতিত নারীর দুঃখ কষ্ট বুঝে ওঠা তাদের পক্ষে সম্ভব নয় তাইতো একটা নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে নেতারা নেমে পড়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুঠতে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় অর্থের কাছে পুলিশ প্রসাশন বিক্রি হয়ে গিয়ে অপরাধীকেই সমর্থন করে, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নারী সুরক্ষাদান সম্পর্কিত কঠোর আইন তাঁদের কোনো রাজনৈতিক সুবিধাদান করবে না হয়তো তাই তারা উদাসীন। দেশের প্রশাসনিক শীর্ষে মহিলা থাকলেও অবস্থার উন্নতি হয়না কেনো তা অতি দুঃখের বিষয়, আসলে একটা মন্ত্রী মভায় নারীরা এখনো সংখ্যালঘু, নারীদের অধিকার দানের ক্ষেত্রে পুরুষরা অনেকটাই মানসিক ভাবে পিছিয়ে, তাই নারীদের হিতের বিল গুলিকে এড়িয়ে চলা হয় হয়তো তাই একজন নেতা বা নেত্রীর ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়না বোধহয়! আবার অনেক সময় রাজনীতির মোহে অন্ধ হয়ে গিয়ে কিছু মহিলা নেত্রীরাই নির্যাতনকে সমর্থন করে দলের হয়ে বুলি আওরাচ্ছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখাযায় রাজনৈতিক স্বার্থে আঘাত লাগার কারণে শীর্ষস্থানীয় নেত্রী  মুখে কুলুপ আঁটেন গলদটা আসলে গোড়ায়, অশিক্ষা ও আদি অনন্তকাল করে নারীদের দূর্বল ভেবে বিভিন্ন ভাবে অসম্মান করা এবং সমাজ সংসারে নারীদের গুরুত্বহীন মনে করা, এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীদের নিজেদেরকেই দূর্বল মনে করা  এর প্রধান কারণ সকল নারীদের এক্যবদ্ধ হয়ে লাগাতার নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে সরকারকে বাধ্য করতে হবে নারীদের হিতে আইন প্রনয়ন করতে

 

 

রংরুট:    আন্তর্জাতিক নারীদিবস পালন আর সারা বছর নারী নির্যাতনের ধারাবাহিত ব্রেকিং নিউজ, এর মধ্যে সমন্বয় হবে কি করে? মেয়েদের এই বিষয়ে কি কর্তব্য আপনার মতে?

 

রেশমা লস্কর: একদিন ঘটা করে নারী দিবস উদযাপন আর সারাজীবন নির্যাতন অনেকটা নারী মূর্তিকে দেবী বলে পূজা করে বাস্তবের নারী মাংস ভক্ষণের সমতুল্য এক্ষেত্রে নারীদের যা করনীয় তার উত্তর নারী দিবসে লেখা আমার কবিতায় খুঁজে পাওয়া যেতে পারে হয়তো-----

 

এগিয়ে চলো, এগিয়ে  চলো, হে নারী!

এক নয়;  প্রতিদিন  হোক যে, তোমার‌ই

 

খুলে ফেলো বন্ধন, কঙ্কণ চুড়ি 

মায়া ভরা  শৃংখল  পায়ের বেড়ি!

 

মিঠে বোল ত্যাগ করে  হও তুমি কর্কশ,

প্রতিবাদী ঝড়  তুলে  ছিড়ে ফেলো মুখোশ 

 

এসো সবে, হাত ধরি  এক সাথে লড়ি,

শিক্ষার ঢালে ধরি  কলমের তরবারি

........................রেশম.........

 

 

রংরুট: সমাজে নারীর সম্মান প্রতিষ্ঠিত না হলে কোনো দেশ জাতি সমাজ উন্নত হতে পারে না। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?

 

রেশমা লস্কর: একটি দেশ তথা একটি সমাজের উন্নয়ন ঘটাতে গেলে নারী জাতির যথাযোগ্য সম্মান প্রতিষ্ঠা একান্ত প্রয়োজন কারণ একটি সুষ্ঠু সমাজ গঠনে নারী পুরুষ উভয়েরই ভূমিকা সমানভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আদি অনন্তকাল করে যে বৈষম্যমূলক ধারণা মানুষের মনে পত্তন করা হয়েছে কালের বিবর্তনে তা নিশ্চয় বদলাবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বদলেছে পরবর্তীকালে আরও বদলাবে আমি আশাবাদীহয়তো একসাথে সমস্তটা বদলাবে না সমাজে যত শিক্ষার হার বিশেষত নারী শিক্ষার হার বারবে, মানুষের চিন্তাধারা বদলাবে সুযোগ পেলে নারী পুরুষের সমানে সমানে সমস্ত কাজ করতে পারে তা বর্তমান সময়ে প্রমাণিত, তাই একদিন ঠিক আসবে সমাজের প্রতিটি পুরুষ তাঁর শিক্ষিত গর্ভধারিণীর থেকে সুশিক্ষা প্রাপ্ত হয়ে বড়ো হবে এবং নারীদের ভোগ্যপণ্য ভাবা বন্ধ করে যথাযোগ্য সম্মান দিতে শিখবে

 

রেশমা  লস্কর, পিতা মহঃ আরসাদ আলী, মাতা নুর‌আফসান বিবির কনিষ্ঠা কন্যা, জন্ম কলকাতার বেহালা পর্ণশ্রী এলাকায়, পড়াশোনা কোলকাতায় ২০০৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল বিষয় নিয়ে স্নাতক, পরবর্তী সময়ে ভৌগলিক তথ্য প্রযুক্তির উপর ডিপ্লোমা ২০০৫ সালে  বিবাহ হয় 'রোজ' সংবাদ পত্রের প্রকাশক মাসুদ লস্করের সাথে। বর্তমানে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার নরেন্দ্রপুর নিবাসী  ছবি আঁকা ও লেখা ভালোলাগার বিষয়। প্রথম কাব্যগ্রন্থ "কবিতার চাদর মুড়ে" প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে আনন্দ প্রকাশনার তত্ত্বাবধানে কলকাতা ব‌ই মেলায়, দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ "জীর্ণ মনের নকশিকাঁথা " আনন্দ প্রকাশন থেকে কলকাতা ব‌ই মেলায় প্রকাশিত হয় এছাড়া বিভিন্ন সংকলন ও পত্র পত্রিকায় ছোট গল্প ও কবিতা রয়েছে।

 


1 টি মন্তব্য: