করোনাকালের বহুমাত্রিক সঙ্কট
কেমন আছো তুমি, আমি কেমন আছি? ভালো আছি কি? এইসব কথা এখন আর কাউকে
জিজ্ঞাসা করা যাচ্ছে না, আমাকেও কেউ জিজ্ঞাসা করবে না।আসলে এই করোনাকালে আমরা
কেউ ভালো নেই। তবুও জানতে চাই, বলতে চাই রুদ্রমহম্মদ শাহেদুল্লার সেই জনপ্রিয় গানটির
কলির ভাষায় ‘ভালো আছি। ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’। আমরা যেন ঠিকানাহীন, আকাশই আমাদের ঠিকানা।করোনাকালে আমরা তীব্র
অস্তিত্বের সঙ্কটে আক্রান্ত।চেনা মানুষগুলো অচেনা হয়ে
যাচ্ছে,
একদা
প্রিয় বন্ধুকেও বিশ্বাস করছি না।রাস্তায় পড়ে থাকছে মৃতদেহ, পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছি।অর্থনৈতিক কিংবা
সামাজিক সঙ্কট এই গ্রহ অনেক দেখেছে, মানুষ সে সবের মোকাবিলা করেছে।কিন্তু করোনা কালে মানব
সভ্যতার যে সঙ্কট মানুষকে এমন অসহায় করেছিল কিংবা তার অস্তিত্বের সঙ্কট এমন তীব্র
হয়েছিল কি না জানি না।ইতিমধ্যেই বিশ্বে মৃত্যুর সংখ্যা ১২ লক্ষ ছুঁয়েছে। সাম্প্রতিক অতীতে
বার্ড ফ্লু,
ইনফ্লুয়েঞ্জায়
কয়েক লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। প্রতি বছর মারণরোগ ক্যান্সারে
বিশ্বে ১২ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়, এইডস’এ ৮ লক্ষ।আমরা ‘মারী নিয়ে ঘর করি’। তবুও শুধু মৃত্যুর
সংখ্যা দিয়ে এই অতিমারীর ব্যাপকতা বোঝা যাবে না।মানব সভততার এমন
বহুমাত্রিক সঙ্কট এই গ্রহ আগে কোনদিন প্রত্যক্ষ করেনি।এই অতিমারী আমাদের
জীবনযাপনকে,
আমাদের
চেনা পৃথিবীকে ক্রমাগত বদলে দিচ্ছে।এই রোগ শুধুমাত্র মানুষের দেহেই
সীমাবদ্ধ না থেকেসাআজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে সৃষ্টি করেছে
সুদূরপ্রসারী সঙ্কট।অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের অধোগতির ফলে সংগঠিত ও অসংগঠিত উভয়
ক্ষেত্রই ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত
অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক ও গ্রামীণ প্রান্তিক মানুষ যাদের কোন সামাজিক সুরক্ষা
রাষ্ট্র দেয় না।
অর্থনৈতিক সঙ্কটা একটা দিক।করোনাকালে তা সুতীব্র হয়েছে, কিন্তু আমাদের মানসিক সঙ্কট যে চেহারা ও তীব্রতায় আমাদের ঘিরেছে তা থেকে কবে বেরিয়ে আসবো বা আদৌ বেরিয়ে আসতে পারবো কি না তার উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে। কোভিড ১৯ ভাইরাস শুধুমাত্র এক অভূতপূর্ব অতিমারী সৃষ্টি করা রোগ হিসাবেই থেমে থাকছে না, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কঙ্কালসার চেহারাটাও উন্মোচিত করে দিয়েছে।এবং এই সঙ্কটের সবটাই আমাদের রাষ্ট্রীয় বন্দোবস্তের তৈরি করা।করোনাকালে বিশ্ব জুড়ে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের যে অবনতি হয়েছে,হয়ে চলেছে সেটিই বোধকরি সবচেয়ে চিন্তাজনক।সংক্রমণের আতঙ্ক, চিকিৎসা নিয়ে অনিশ্চয়তা, মৃত্যুভয়, আসন্ন অর্থনৈতিক সংকট, কর্মহীনতা, পরিবর্তিত সামাজিক আচরণের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং রোগ নিয়ে নেতিবাচক সামাজিক বৈষম্য ও কুসংস্কারের কারণে বাড়ছে মানসিক চাপ। আমরা চোখের সামনে, সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে দেখছি অন্তঃসত্তা বধু তার বোন হাসপাতালে কাজ করে বলে নিজের বাড়িতে ঢুকতে পারছেন না। চিকিৎসককে পাড়াছাড়া হতে হচ্ছে, মরনাপন্ন করোনা রোগী এম্বুলেন্সে তোলার অপেক্ষায় কয়েক ঘন্টা হাসপাতাল চত্তরে পড়ে থেকে মারা গেল, আক্রান্ত রোগী একাধিক হাসপাতালে ঘুরেও ভর্তি হতে না পেরে মারা গেলেন এসব আমরা দেখছি অহরহ।চিকিৎসার এই হাহাকারের মধ্যে অন্য অসুখে আক্রান্ত মানুষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাবেন কিনা এই চিন্তা আমাসের সঙ্গী হয়েছে। কোভিড পরবর্তী বিশ্বে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের আরো অবনতি হবে বলেই গবেষকরা বলছেন।
কোভিড-পরবর্তী বিশ্বেও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা আগের চেয়ে বাড়বে বলে গবেষকেরা ধারণা করছেন। পারষ্পরিক অবিশ্বাস, সহনশীতার অভাব, কুসংস্কার, মানসিক অস্থিরতা, অবসাদ, বিষন্নতা, কর্মহীনতার আতঙ্ক এখন ঘরবন্দী আমাদের নিত্যসঙ্গী।করোনা পরবর্তী পৃথিবী কি এরকমই থাকবে! সমাজতাত্বিকরা বলছেন করোনা পরবর্তী বিশ্বে আমাদের যাপনের, পারস্পরিক সম্পর্কের ধাঁচাটাই পালটে যাবে।এটাই নাকি নতুন স্বাভাবিকতা বা ‘নিউ নর্মাল’ বলে সান্তনা খোঁজার প্রয়াস পাচ্ছি। যে নিউ নর্মালে মানুষের প্রশ্ন থাকবে না, জিজ্ঞাসা থাকবে না, প্রতিবাদ থাকবে না,আমাদের যাপন হবে সামাজিক সম্পর্কহীন! না এমন হতে পারে না।অমৃতের পুত্র মানুষ ঠিক এই সর্বব্যাপি সঙ্কটকে অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে আসবে বিজয় পতাকা উড়িয়ে। করোনাকালের বহুমাত্রিক সঙ্কট শুধু মানসিক সঙ্কটই নয় করোনাজজিত মানব সভ্যতার তাবৎ সঙ্কটেরই অনুঘটক হচ্ছে অর্থনৈতিক সঙ্কট। করোনা প্রাদুর্ভাবের পর ভারতের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে লক্ষলক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়েছে, হয়ে চলেছে।লকডাউনের বিধি নিষেধের ফলে অসংগঠিত খেটে খাওয়া মানুষ কর্মহীন হয়েছে।
ইদানিং আমরা একরকম পরিযায়ী প্রাণীর কথা শুনছি, অন্তত আগে তাদের কথা তেমনভাবে আলোচনায় আসেনি, এলেও আমাদের মধ্যবিত্ত মনে কোন আগ্রহের যায়গা তৈরি হয়নি। তারা পরিযায়ী শ্রমিক। পেটের টানে, রুজির তাগিদে দূর দূরান্তে, এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে পাড়ি দেয়। আমরা জানতামই না, জানার চেষ্টাই বা কজন করি? একটা একটা করে ইট গেঁথে যে লোকগুলো সুবৃহৎ অট্টালিকা নির্মাণ করছে। বাঁশের মই বেয়ে যারা সেই বহুতলের সুদৃশ্য রঙ করছে, পলেস্তারা করছে, অলঙ্কারের ব্যবসাতে লক্ষ লক্ষ টাকার সোনার অলঙ্কারের পালিশ করছে, বহুজাতিক খাবারের বিপণি থেকে আমাকে যে সময়মত খাবারের যোগান দিচ্ছে তারা কারা? কোথায় তাদের সাকিন? লকডাউনের পরে দেশের মানুষ সচকিত হল এই সংবাদে, দেশের রাজধানী দিল্লি থেকে হাজার হাজার মানুষ – নারী,পুরুষ হাঁটছেন, শিশুপুত্রকে কাঁধে চাপিয়ে হাঁটছেন। ট্রলি ব্যাগে ঘুমন্ত শিশু সন্তানকে চাপিয়ে টেনে নিয়ে চলেছে, স্ত্রীকে কাঁধে চাপিয়ে হেঁটে চলেছে এমন ছবি আমরা দেখেছি। রুজি বন্ধ, অনিশ্চিত জীবন, তারা বাড়ি ফিরতে চাইছে। তাই পাঁচশো বা তার বেশি কত মাইল দূরে তাদের ঘর সে হিসাব তাদের জানা নেই, তারা হেঁটেই ঘরে ফিরবে। ক্ষুধায়, তেষ্টায় অশক্ত শরীরে অনেকে পথেই মারা গেলেন। যেমন দিল্লির এক হোটেলের ডেলিভারি বয় রনধীর। এই হাটা, জীবনের জন্য, নিজ পরিবার ও প্রতিবেশীদের পাশে থাকার, পাশে পাওয়ার জন্য হাঁটা। এটা অন্ধকারের একটা দিক। আর একদিকে রয়েছে স্থায়ী ঠিকানাহীন ছোট বিক্রেতারা, যারা ফুটপাথে জামা-কাপড়, রোজকারের প্রয়োজনীয় জিনিস কিংবা খেলনার পসরা সাজিয়ে কিছু উপার্জন করেন। যারা মেলা, সমাবেশে বেলুন, টুকটাক জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসেন, যারা ট্রেনে হকারি করেন, থিয়েটারের সে নির্মাণ বা আলোর কাজ করেন, তারাই এই লকডাউনের করুণতম শিকার। বড় দোকানদার, ব্যবসায়ীরা এই চোট সামলে নেবেন স্বাভাবিক অবস্থা ফিরলে। কিন্তু ফুটপাথের দোকানদার, হকারদের কোমর যেভাবে ভেঙে দিল এই লকডাউন, স্বাভাবিক অবস্থা ফিরলে তারা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবেন কি না কে জানে!
একটা হিসাব জানাচ্ছে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ঘরে ফিরতে আকুল শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৬.৬ লক্ষ আর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সংখ্যাটা পৌছালো ১৪ লক্ষে। সুপ্রিম কোর্টে ১২ই এপ্রিল সরকারের হলফনামায় স্বীকার করা হয়েছিল যে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য যথেষ্ঠ আশ্রয়শিবির করা যায় নি। তাহলে তারা ঘরে ফেরার জন্য হাটবেন না কেন? অমানবিক লকডাউনের ৪৭দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর সরকার তাদের জন্য ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফিরছেনও তারা অনেকে। সারা দেশকে তালাবন্দী করার আগে পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরে যাওয়ার জন্য দুএকদিন সময় তো দেওয়া যেত। মার্চ মাসেই যখন দিল্লি থেকে হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক হাঁটা শুরু করলো, আমাদের নাড়িয়ে দিল তখনও সরকার কিছু বন্দোবস্ত করতে পারতো। কিন্তু করেনি। বিশ্বাস করার কারণ আছে যে কর্পোরেট লবি, রিয়েল এস্টেট আর হোটেল লবির চাপ ছিল পরিযায়ীদের ফিরে যাওয়া আটকাতে। একটা প্রচার সুচতুরভাবে হয়েছে যে পরিযায়ী শ্রমিকরা নিজ গ্রামে ফিরলে সংক্রমণ অনেকগুন বেড়ে যাবে। তাদের মনে রাখা দরকার যে দেশে প্রথম সংক্রমণ ছড়ায় জামাই আদর করে বিমানে বিদেশ থেকে অভিবাসীদের ফিরিয়ে আনার পর থেকেই।
ঘরে ফিরতে চাওয়া মানুষদের মৃত্যুমিছিলের সামান্যই মাত্র আমরা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হতে দেখছি। শুরু হয়েছিল মার্চের শেষ সপ্তাহে দিল্লির সেই ডেলিভারি বয় রনধীর সিংকে দিয়ে, যে হেঁটে বিহারে তার গ্রামে ফিরতে চেয়েছিল, পারেনি। তেলেঙ্গানার লঙ্কাক্ষেতের ১২ বছরের কিশোরী শ্রমিক জামলো মাকদেমও পারেনি, বাকি ছিল আরো একঘন্টার পথ। জামলো মাকদেম – ছত্তিশগড়ের ১২বছরের কিশোরী ঘর ছেড়ে ছেড়েতেলেঙ্গানার লঙ্কা ক্ষেতে দৈনিক দুশোটাকার মজুরীতে কাজ পেয়েছিল। ২৩শে মার্চ লক্ষলক্ষ মানুষের সঙ্গে সেও জানতে পারলো লকডাউন হয়েছে তার আর কাজ নেই।অনাহার থেকে বাঁচতে ঘরে ফিরতে চাইল। কোন রকম যানবাহন নেই, তাই হাটা শুরু করলো অভুক্ত তৃষ্ণার্ত ছোট্ট শরীর কটুকুই বা নিতে পারে? নিজ গ্রাম থেকে মাত্র একঘন্টার পথের আগেই জামলোর জীবন থেমে গিয়েছিল। বাঙ্গালুরু থেকে ৩০০ কিলোমিটার পথ হেটে রাইচুরে ফিরতে চেয়েছিল ২৯ বছরের গঙ্গাম্মা। অভুক্ত গঙ্গাম্মা বেল্লারি পর্যন্ত আসতে পেরেছিল। ঔরঙ্গাবাদে ১৬জন শ্রমিকের মৃত্যুর পরের দিন মধ্যপ্রদেশে ট্রাক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হল ৫জন পরিযায়ীর। অপরিকল্পিত অমানবিক লকডাউন আরো কত রকমভাবেই না অসহায় মানুষের জীবন কেড়ে নিল, এই নিষ্ঠুরতার কোন সীমা নেই। তামিলনাড়ুর একটি বাস স্ট্যান্ডের পাশে এক অশিতিপর বৃদ্ধা পথচলতি, বাসযাত্রীদের দেওয়া খাবারে দিন গুজরান করতেন। বাস নেই, যাত্রীও নেই। বৃদ্ধা মারা গেলেন অনাহারে। তিনিও তো লকডাউনেরই বলি। তেলেঙ্গানার এক প্রচতেকে ছটি হাসপাতাল ফিরিয়ে দেয়। কোভিড নেগেটিভ জানার পর এক হাসপাতাল তাকে ভর্তি নেয়। বিলম্বের জন্য জটিলতার কারণে মৃত্যু হয় সদ্যজাতর। পরে মৃত্যু হয় মেয়েটিরও। এই রকম অসংখ্য মর্মান্তিক মৃত্যুর নিয়ে এসেছে অপরিকল্পিত লকডাউন।
তিন গবেষক সম্প্রতি লকডাউন জনিত কারণে মৃত্যুর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন, তা থেকে আমরা জানতে পারছি যে গত ৯ই মে পর্যন্ত লকডাউন জনিত মৃত্যুর সংখ্যা ৩৮৩। তাঁদের প্রতিবেদন অনুযায়ী মৃত্যুর কারণ অনাহার ও আর্থিক বিপর্যয় – ৪৭, হাটা ও দীর্ঘ লাইনে দাড়ানোর ফলে পরিশ্রান্ত হয়ে – ২৬, নিজ রাজ্যে ফেরার পথে ট্রেন ও সড়ক দুর্ঘটনায় – ৭৪, পুলিশি অত্যাচারে – ১২, চিকিৎসা ও সহায়তা না পাওয়া বয়স্ক ও অসুস্থরা – ৪০, সংক্রমণের ভয় ও একাকীত্বের অবসাদে আত্মহত্যা ৮৩। কিন্তু দিল্লির সেই ডেলিভারি বয় রনধীর সিং তার বিহারের গ্রামে ফিরতে পারেনি। ফিরতে চেয়েছিল পায়ে হেঁটে। অভুক্ত পেটে কতটা হাঁটা যায়, জানতো না। রাস্তাতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল। অনেকেই পড়েছিল, কেউবা জাতীয় সড়কের ট্রাকের তলায়! সেই বারো বছরের কিশোরীটি – মাকডেম, যে কিছু পয়সার আশায় মধ্যপ্রদেশের বীজাপুর থেকে তেলেঙ্গানায় কাঁচা লঙ্কা তোলার কাজ করতে গিয়েছিল তারও শেষরক্ষা হয়নি। অভুক্ত শরীর আর একঘন্টার রাস্তা টানতে পারল না। বাড়ির অনতি দূরে এসেই তার বারোবছরের জীবন থেমে গেল।
এরা পরিযায়ী শ্রমিক। এরা আমাদের তাবৎ অগ্রগতির সচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে অবহেলিত অংশীদার। এদের কোন ঠিকানা থাকেনা। যারা তাদের শ্রম নিংড়ে নেয় তারাও জানে না তাদের ঠিকানা, রাষ্ট্রও জানে না। তারা শুধুই পরিযায়ী শ্রমিক এই পরিচয়ে বাঁচে। বাঁচে কি? লকডাউনের অমানবিক বাস্তবটা উলঙ্গ হয়ে গেছে কয়েক লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের নিজ ঘরে, পরিবারের কাছে ফেরার আকুল আর্তি। কোচবিহার থেকে ফুলিয়ার তেরো জন তাঁত শ্রমিক হাঁটাপথে রওনা দিয়েছিলেন। ৫০০ কিলোমিতার হেঁটে শিলিগুড়ি পৌছে তারা প্রবল আশাবাদী এতোদূর যখন এসেছেন ফুলিয়ার নিজগ্রামে নিশ্চিত পৌছাবেন। শিলিগুড়ি থেকে হাঁটাপথে রওনা দিয়েছে বাগনানের কয়েকজন নির্মাণ শ্রমিক। তারা কি বাগনান পৌঁছেছে! ফুলিয়ার তাঁত শ্রমিক কিংবা বাগনানের নির্মাণ শ্রমিক নিজ ঘরে ফেরার জন্য জীবন বাজি রেখে হাঁটছেন। কিন্তু সেই সুযোগটা পায়নি লুধিয়ানার কম্বল কারখানার শ্রমিকটি। বাড়িতে মায়ের কাছে টাকা পাঠাতে না পারার গ্লানি তাকে ঠেলে দিয়েছে আত্ম নিধনের পথে। সে বেঁচে গেছে আত্মহত্যা করে। দুর্গাপুরের সুমঙ্গল কারখানার অভুক্ত শ্রমিক সঞ্জয় সিং আত্মহত্যার সুযোগও পায়নি। তার আগেই মৃত্যুদূত হয়ে ক্ষুধা হাজির হয়েছিল সঞ্জয়ের কাছে। ভুখা পেটে সঞ্জয় মরেছে। সঞ্জয়রা নাকি কারখানা মালিকের নিজস্ব শ্রমিক। রাষ্ট্র এদের দায় নেয় না। মারণ করোনায় আক্রান্ত হয়ে যতজন মারা গেছেন বোধয় তার চেয়েও বেশি মৃত্যু হয়ে চলেছে ক্ষুধায়। রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের অর্থনীতিবিদরা এইসব মৃত্যুর বেশ জুতসই সংজ্ঞা দিয়েছেন – ‘কো-ল্যাটারাল ড্যামেজ’ বা আনুষঙ্গিক ক্ষয়-ক্ষতি। রাষ্ট্র এমন বলছে!
এটা প্রথম দু মাসের হিসাব, তারপর কাজ হারানোর
যন্দ্রণা,
রোজগার
হারানোর হতাশা ক্রমেই তীব্র হয়েছে আর তা থেকে মুক্তি পেতে আত্মনিধনের পথ বেছে
নিয়েছেন বহু মানুষ।মেদিনিপুরের ৩৩ বছরের স্নতোকত্তর যুবক শোভন গিরি উড়িষ্যাতে একটি
লজিষ্টিক সলিউশন কোম্পানীতে চাকরী করতেন। মার্চ মাসের লকডাউনে কাজ
হারিয়ে গ্রামে ফিরে এলেন। ফিরে এসে কোন কাজের সংস্থান করতে না পারায় হতাশার
অন্ধকারে তলিয়ে গিয়ে অবশেষে আত্মনিধনের পথটাই বেছে নিল শোভন।এটা শুধু একটা
ঘটনামাত্র নয় বহু, আমরা
আর কটা সংবাদ পাই! সংবাদ মাধ্যম এসব সংবাদ প্রকাশ করে সামান্যই। রাষ্ট্রের কর্নধারদের
কাছে নাকি কোন তথ্য নেই যে লকডাউনের কারণে কত শিল্প কারখানা বন্ধ হয়েছে, কত শ্রমিক কাজ
হারিয়েছেন। কিন্তু তথ্য আছে কোন শিল্পপতির প্রতি ঘন্টায় তাঁর সম্পদের বৃদ্ধি
হচ্ছে ৯০ কোটি টাকার।নানা সমীক্ষায় অতিমারী ও লকডাউনজনিত অর্থনৈতিক সঙ্কটের
ভয়াবহ ছবি আমাদের সামনে আসছে।লকডাউনের বিগত ছয়মাসে দেশের
আভ্যন্তরীন উৎপাদন সঙ্কুচিত হয়েছে ২৩.৯ শতাংশ,শিল্পক্ষেত্রে সঙ্কোচন ৩৮ শতাংশ,ময়ানুফ্যাকচারিং শিল্পে
৩৯.৩ শতাংশ,
পরিষেবা
ক্ষেত্রে ২২.৬ শতাংশ, নির্মাণশিল্পে
৫০ শতাংশ। এই ভয়াবহ আভ্যন্তরীন সঙ্কোচনের অনিবার্য প্রভাব পড়েছে মানুষের কাজ ও
আয়ের ক্ষেত্রে। দেশ জুড়ে কারখানা, ছোট উদ্যোগ, নির্মাণ উদ্যোগ, পর্যটন বেশিরভাগই বন্ধ হয়েছে
লকডাউনের ধাক্কায়। প্রাথমিক ধাক্কা কাটার পর যেগুলি চালু হয়েছে সেখানে অনেক কম শ্রমিক
নিয়ে চালু হয়েছে আর সেই সঙ্গে হয়েছে বেতন সঙ্কোচন, শ্রমিক কর্মচারীরা নিরুপায় হয়ে
আগের চেয়ে কম বেতনে কাজ করতে রাজি হয়ে যাচ্ছেন।সেন্টার ফর মনিটরিং
ইন্ডিয়ান ইকনমি বা সি এম আই ইর হিসাব - লকডাউনের চার মাসে ৬০ লক্ষ মানুষ কাজ
হারিয়েছেন।এদের আর একটা হিসাব – লকডাউনের ঠিক আগে দেশে বেকারত্বের হার ছিল –
জানুয়ারি ২০২০-
৭.২২%
ফেরুয়ারি
– ৭.৭৬%
মার্চ -
৮.৭৫%
লকডাউন ঘোষনা হবার পর বেকারত্বের হার হল –
এপ্রিল -
২৩.৫২%
মে
- ২১.৭৩%
কাজ হারানোর এই ছবি শুধু দেশীয় ক্ষেত্রেই নয়, বিদেশে যারা কাজ করতে যান তারাও কাজ হারিয়েছেন বিপুল সংখ্যায়। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদন জানাচ্ছে ২০১৯এর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর বিদেশে কাজ করতে গিয়েছিলেন ২,৫৯,১৬৮ জন ভারতীয়, এ বছর এই একই সময়ে করোনা আবহে বিদেশে কাজের সুযোগ পাওয়া মানুষের সংখ্যা নেমে এসেছে ৮৪,৫৮৫ তে।
কোভিড ১৯ অতিমারী জনিত সর্বগ্রাসি সঙ্কট মানব
সভ্যতার আগামী পৃথিবীটা কেমন হবে তা ভেবে আ্রামরা আতঙ্কিত হচ্ছি। ৮ই সেপ্টেম্বর আমরা
পেরিয়ে এলাম ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস’।অতমারী ঘোষণার সময় থেকে বিশ্বে প্রায় ১১০
কোটি পড়ুয়া বিদ্যালয়ের বাইরে রয়েছে বিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে।এ দেশেপ্রায় ৩২.৭ কোটি
যার মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষায় প্রায় ১৪ কোটি শিশু-কিশোর-কিশোরী
বিদ্যালয় শিক্ষায় অংশ নিতে পারছে না বিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে।ইউনেস্কোর পূর্বাভাষ, এই বিপুল সংখ্যক পড়ুয়ার
মধ্যে ৩৩ শতাংশ আগামী দিনে বিদ্যালয়ছুট হবে। তাদের পূর্বাভাষ অনুযায়ী
আমাদের দেশেপ্রায় ২.৫ কোটি পড়ুয়া বিদ্যালয়ছুট হবে। অর্থাৎ এই অতিমারী
ডেকে আনবে নিরক্ষরতার অন্ধকার আগামী প্রজন্মের কাছে। এইসব তথ্য অতিমারী
জনিত সঙ্কটের একটা বাস্তব খন্ড চিত্র।
এই সঙ্কট আগামী পৃথিবীটাকে কতখানি পালটে দেবে তা আমরা এখনো জানি না।ঠিক একশো বছর আগে স্প্যানিশ ফ্লুতে বিশ্বে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষের। এছাড়াও যুদ্ধ, অনাহারে, অন্যান্য ব্যাধিতে মারা যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। কিন্তু শুধু মৃত্যুর সংখ্যা দিয়ে ইতিহাস করোনাকালকে মনে রাখবে না, মনে রাখবে করোনা-উত্তর বদলে যাওয়া পৃথিবীর নিরিখে। এই অতিমারী হয়তো কিছু শিক্ষাও দিয়ে গেল।সব দেশেরই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কঙ্কালসার চেহারাটা উন্মোচিত করে সেটা বদলানোর প্রয়োজনীয়তা চোখে আঙুল দিয়ে রাষ্ট্রকে সচকিত করল। আমার মনে হয়, আর একটা বিষয় শেখালো যে করোনা ধনি-নির্ধন, সবল-দুর্বল, শিক্ষিত-অশিক্ষিত বাছ-বিচার করে না। সুতরাং একা একা বাঁচা নয় সকলে মিলেই বাঁচতে হবে। করোনা-সন্ত্রাস একদিন থেমে যাবে, বিশ্ব করোনামুক্ত হবে। কেননা মানব সভ্যতার এই সঙ্কট স্থায়ী হতে পারে না। মানবতার এমন পরাভব হতে পারে না। আশি বছরের জন্মদিনের ভাষণ ‘সভ্যতার সঙ্কট’এ রবীন্দ্রনাথ আশা প্রকাশ করেছিলেন “আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর-একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান মনে করি”। আমাদেরও এই বিশ্বাস রাখতেই হবে।
কপিরাইট শ্রী ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
কর্তৃত সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন