রূপময় ভট্টাচার্য ~ করোনাকাল এবং বিপন্ন সভ্যতা

 

করোনাকাল এবং বিপন্ন সভ্যতা

 


ঘুণাক্ষরেও কি কেউ ভাবতে পেরেছিলো ২০২০র মত একটা ভয়ানক বছর দেখতে হবে। সর্বত্র তো একটা নতুন নামই চালু হয়ে গেলো " বিশ বিষ"। অর্থাৎ গরলময় এই বছর এবং এই বিষময়তার নেপথ্যে এক ভয়াবহ ছোঁয়াচে মারণ ভাইরাস।“নভেল করোনা ভাইরাস” বা কোভিড -১৯। আসুন, প্রথমেই একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক এই ভাইরাস কুলোদ্ভব ভদ্রলোক (?)এর নাম ধাম আতাপাতা সাকিন দাগ খতিয়ান।


ভাইরাস শব্দটার সাথে বিজ্ঞানীদের পরিচয় ১০০ বছরের কিছু বেশী সময়। ১৮৯৬ সালে তামাক গাছে প্রথম সন্ধান পাওয়া যায়  ভাইরাসের - আবিষ্কর্তা মার্টিনস বেইজেরিনক যার নামকরণ করেন টোব্যাকো মোজেক ভাইরাস।  ভাইরাস আসলে জড় আর জীবের মধ্যবর্তী এক অতিক্ষুদ্র বস্তু, যা সচরাচর অণুবীক্ষণ যন্ত্রেই দেখা যায়। মজার কথা হলো, আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়ানোর সময় এই ভাইরাস থাকে জড় অবস্থায়, তখন তাকে বলে ভিরিয়ন। তখন সে পরম বৈষ্ণব। তার ক্ষতি করার বিন্দুমাত্র ক্ষমতা নেই তখন। সে তখন কপালে তিলক কেটে দিব্যি ঘুরে বেড়ায় আর ঠাকুরের নাম করে। কিন্তুযেই না সে মনের মত একটা জীবদেহ পেলো, সে উদ্ভিদ প্রাণী যাই হোক না কেন, অমনি সেই ভিরিয়ন পুষ্টি পেয়ে হয়ে উঠলো ভাইরাস। তবে সব ভাইরাসই যে ক্ষতিকারক এমনটা কিন্তু নয়। মানুষের দেহে বসবাসকারী ব্যাকটেরি়য় ফাজ যেমন। ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলোর সাথে লড়াই করে দেহকে সুস্থ রাখে। এখানে বলে রাখা ভালো, ভাইরাস দেখতে ছোটো খাটো হলেও তাকে নিয়ে বিজ্ঞানের একটা আলাদা শাখাই আছে, যাকে বলে ভাইরোলোজি।


এ তো গেলো ভাইরাস সম্পর্কে  কিছু সাধারণ তথ্য।যা স্কুল পাঠ্য বইয়ের দৌলতে  আপনি আমি সবাই কমবেশি জানি। এবার সমগ্র বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক সৃষ্টিকারী  কোভিড-১৯ ভাইরাস সম্পর্কে দুচার কথায় আসি ।  মানবদেহে  করোনা ভাইরাসের টের বিজ্ঞানীরা প্রথম পান ১৯৬৫ সাল নাগাদ। উপসর্গ ছিল জ্বর সর্দি কাশি।  করোনা গোত্রের ভাইরাসগুলো আকৃতিতে গোলাকার ,কাঁটাযুক্ত। সূর্যের বহির্বলয় অর্থাৎ করোনা অঞ্চলের সাথে  সাযুজ্য খুঁজে পেয়ে বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসের নাম রাখেন করোনা ভাইরাস। এই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত সব ভাইরাসই যে মহা ক্ষতিকর এবং মারণ ক্ষমতা সম্পন্ন এমন টা নয়, উল্টে অধিকাংশই জ্বর সর্দি কাশি ইত্যাদি খুচরো অপরাধে হাত পাকিয়েছে বলাই ভালো।  বিজ্ঞানীরা যে একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক পর্যন্ত এই ভাইরাস গোত্রকে মোটেই পাত্তা দিতেন না - তার আঁচ মিলেছে  ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস সাউথ ওয়েস্টার্ন মেডিকেল সেন্টারের পেডিয়াট্রিশিয়ান জেফরি কান এর বক্তব্যে , যিনি রেসপিরেটরি সিনড্রোম নিয়ে গবেষণা করছিলেন দীর্ঘদিন, ২০০৩ সালে SARS Severe Acute Respiratory Syndrome) আউট ব্রেকের কিছুদিন পরে করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত একটি আলোচনায় তিনি বলেছিলেন " আমার মনে হয়, এত বছর এই ভাইরাসের প্রতিষেধক ( বা ভ্যাকসিন) আবিষ্কারের বিশেষ চেষ্টা এই জন্যেই করা হয়নি,কারণ সবাইই একে ( করোনাকে) সামান্য উৎপাত ছাড়া আর কিছুই ভাবেন নি। " প্রসঙ্গত, ২০০২ সালে দক্ষিণ চীন থেকে ক্রমশ আরো ২৮ টি দেশে SARS ছড়িয়ে পড়ে, ৮০০০ এর বেশী মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন, ৭৭৪ জন মারা যান। এরপর ২০১২ সালে এই SARS এরই এক তুতো ভাইয়ের খোঁজ মেলে মধ্যপ্রাচ্যে। স্থান মাহাত্ম্য মাথায় রেখে নাম দেওয়া হয় MERS ( Middle East Respirstory Syndrome)! এবার আক্রান্ত হন ২৫০০ এর বেশী মানুষ, কিন্তু মারা যান ৮৫৮ জন। অর্থাৎ এটির মারণ ক্ষমতা ছিল SARS এর সামান্য বেশী।


কিভাবে ছড়ালো এইবারের এই SARS-COV  2 ভাইরাস? বিজ্ঞানী মহলের ধারণা, বাদুড় জাতীয় প্রাণী থেকেই ছড়ায় এই ভাইরাস। যদিও দক্ষিণ চীনের উহান শহরের সেই বহুল চর্চিত পশুবাজারে করোনা ভাইরাসের আউট ব্রেকের সময় কোনো বাদুড় বিক্রির কথা জানা যায়নি। উহানের এই পশুবাজার বেআইনি ভাবে জীবিত সাপ, বাদুড়, প্যাঙ্গলিন এবং অন্যান্য নিষিদ্ধ প্রাণী বিক্রির জন্য কুখ্যাত। তবে এই বাজারে সেই সময় লম্বা শক্ত আঁশযুক্ত প্যাঙ্গলিন বিক্রির কথা জানা যায়। হয়তবা সেখান থেকেই মানবদেহে প্রথম ছড়ায় এই ভাইরাস।ক্রমশ এক মানুষ থেকে অন্য মানুষ হয়ে অতিদ্রুত ,প্রায় গুণোত্তর প্রগতিতে ( geometric progression) সংক্রমণ ছড়াতে থাকে। কোভিড ১৯ এর প্রথম সংক্রমণের খবরটি আসে দক্ষিণ চীন থেকে,২০১৯ সালের ডিসেম্বরে।সেই কারণেই এই ভাইরাসের এই সংস্করণটির নাম কোভিড-১৯। ভারতে কোভিডে প্রথম সংক্রমণের ঘটনা ঘটে, জানুয়ারির ৩০ তারিখ, কেরালায়। এইবার আসা যাক, আমাদের মূল আলোচনায়। বৈজ্ঞানিক আর তাত্ত্বিক কচকচি একদমই আমার আলোচনার বিষয় নয়। আলোচনার বিষয় এই ১১ মাসের মধ্যেই গোটা বিশ্বে এই ভাইরাসের প্যান্ডেমিক রূপ ধারণ করা এবং সভ্যতা এবং সাধারণ মানুষের উপর এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব।


এই নভেল করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ যেহেতু মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয় অতি দ্রুত। এক দেড় মিটারের সংস্পর্শে থাকলেই যেখানে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশী, বলাই বাহুল্য সেখানে দূরত্ব বিধি মেনে চলা ছাড়া উপায় নেই। বিভিন্ন দেশেই এই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের চেন ভাঙার জন্য  জনসাধারণের ঘরে থাকার জন্য নিভৃতবাস বা স্বেচ্ছা কারাবাসে থাকতে বলা হচ্ছে। এই নির্দেশিকা প্রথম আসে WHO ( World Health organisation) থেকে এবং তাঁদের এই পরামর্শ মেনে চলে বিভিন্ন দেশে আংশিক ভাবে সংক্রমণ রোধ ও করা গেছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয় ভারতের মতো প্রবল  জনঘনত্ব ,বিপুল জনসংখ্যার প্রগতিশীল দেশে। যেখানে জনসংখ্যার সিংহভাগ  মানুষ  অসংগঠিত ক্ষেত্রে দৈনিক রোজগারের ভিত্তিতে বেঁচে আছেন।  সরকারের নির্দেশ অনুসারে সোশ্যাল ডিস্টান্সিং বা সামাজিক দূরত্ববিধি বাধ্য  হয়ে এরা মানার চেষ্টা করছেন বটে ,কিন্তু এদের রোজগার গেছে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে। এদের মধ্যে কেউ কেউ বিকল্প জীবিকা খুঁজে নিতে পারলেও অধিকাংশই দিশাহীন ,তাদের রোজগারের উপায় নিয়ে।  এই শ্রেণীর মধ্যে ট্রেনবাসের হকার যেমন আছেন,তেমনই লক্ষ লক্ষ শ্রমিক আছেন যারা এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে সামান্য অর্থের বিনিময়ে কাজ করে বেড়ান, এই লকডাউনে  যাদের পরিযায়ী শ্রমিক বলা হচ্ছে, যাদের ভয়াবহ দুর্ভোগের কথা আমরা সবাই কমবেশি সংবাদপত্র এবং টিভি নিউজ দেখে ওয়াকিফহাল।  দেশব্যাপী লক ডাউনের শুরুর দিকে তারা আটকে পড়েছেন ভিনরাজ্যে, তাদের বাড়ি ফেরা নিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। তাদের ঠিকাদাররা হাত তুলে নেওয়ার ফলে সরকারের দিকে তাকানো ছাড়া উপায় বিশেষ ছিলনা । কেউ কেউ হাঁটতে হাঁটতে প্রাণ হারিয়েছেন  ট্রেন লাইনে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে, কেউ বা মারা গেছেন হাইওয়েতে, গাড়ির সংঘর্ষে । এদের জীবনের মূল্য কোনোদিনই দেশ নির্ধারণ করেনি, আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এরা আমাদের দেশে শুধু একটা সংখ্যা হয়েই থেকে গেছে।


শুধু কি পরিযায়ী শ্রমিক! প্রাইভেট সেক্টরে কর্মরত কত লক্ষ মানুষ কাজ খুইয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কত ছোট ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা হারিয়ে সর্বস্বান্ত তার হিসেব নেই । যারা দেশের ছাত্রছাত্রী,তাদের কেরিয়ার বিশ বাও জলে। তাদের পরীক্ষা, তাদের ভবিষ্যৎ পুরোটাই অজানা । ভারতবর্ষে বেকার সমস্যা তো কোনোদিনই নতুন নয়। এই ভয়াবহ মহামারী তাতে বাড়তি ইন্ধন দিল, বলাই বাহুল্য। আর যেটি উপেক্ষার নয়, সেটি হলো দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কঙ্কালসার চিত্র। এই মহামারী বুঝিয়ে দিল ন্যূনতম চিকিৎসা পরিষেবা টুকুও অপ্রতুল এই দেশে। এত বেকারত্ব সত্ত্বেও দেশে ডাক্তার নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব। যেদিকে আশু নজর দেওয়া সরকারের প্রয়োজন। যেভাবে স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে শাসক ও শোষণ সমার্থক হয়েছে, বঞ্চনা আর বঞ্চিতের দিনলিপি ক্রমে ক্লান্ত হয়ে হারিয়েছে প্রতিবাদের ভাষা , করোনা এসে সেই ছবিটাই যেন সমাজের পর্দা সরিয়ে উন্মুক্ত করে দিল আরো বেশি। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে বিভিন্ন সরকারি ফান্ড নিয়েও। প্রচুর শিল্পপতি, অভিনেতা, সাধারণ মানুষ তাদের সাধ্যমতো দান করার পরেও তা কতটা কাজে এসেছে মানুষের, তার কোনো হিসাব নেই।  মানুষ ক্রমে ক্রমে ডুবে গেছে হতাশার চরম অন্ধকারে। 


করোনা ভাইরাসের দৌলতে উদ্ভূত এই দ্বিধাময় সময়কাল কেই সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটিজেনরা এবং সংবাদপত্র মিলে অভিহিত করেছেন " করোনাকাল" হিসেবে। যা মানব সভ্যতার ইতিহাসের পাতায় এক সন্ধিক্ষণ। সভ্যতা যে প্রবল সংকটের মুখে তা বলাই বাহুল্য। গৃহবন্দী অবস্থায় দেশের বহু মানুষ চরম ডিপ্রেশনের শিকার।  কর্মহীন মানুষ, রোজগারের কোনো পথ দেখতে না পেয়ে ডিপ্রেশনে। শিশুটি কতদিন সবুজ মাঠে বন্ধুদের সাথে খেলতে না পেরে হাঁপিয়ে উঠেছে। ট্রেন চলছে না বলে হাজার হাজার মানুষ বাড়িতেই বসে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের জীবন জীবিকা সব এককথায় স্তব্ধ হয়ে আছে।


এই প্রবল সংকটময় অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শিল্পীরাও। নাটক, সিনেমা ,যাত্রা, গান , লেখক সবারই প্রবল দুর্দশা। এবং এই ভয়াবহ ক্রান্তিকালে মানুষের মন শিল্পসাহিত্য চর্চার থেকে বহু বহু দূরে তা বলাই বাহুল্য। কলকাতার ফুটপাথে এক গায়িকার সাবান বিস্কুট পাউরুটি  বিক্রির ছবি অনেকেরই নজর এড়ায়নি। বহু অভিনেতা অভিনেত্রী যারা আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল নন তাদের দুর্দশা ও কহতব্য নয়। ফলে সমাজের নখদন্ত সমৃদ্ধ কঙ্কালসার ছবিটা এই ভাইরাসের বদান্যতায় প্রকট মান।


এই অবস্থায় বিভিন্ন দেশে নেতা মন্ত্রীদের ভূমিকাও অস্বীকার করার নয়। আমেরিকার মতো দেশের রাষ্ট্রপতি যখন সর্বত্র মাস্ক না পরে স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করেন এবং অচিরেই করোনা আক্রান্ত হন। তখন তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। আবার নিউজিল্যান্ড সহ বিভিন্ন ছোটো ছোটো দেশগুলি আপন চেষ্টায় সামাজিক স্বাস্থ্যবিধি বজায় রেখে করোনা দূরীকরণে সাফল্য লাভ করেছে।  ভারতেও কেরালা,দিল্লী সহ বেশ কটি রাজ্যে কঠোর নিয়ম বিধি, এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরলস পরিশ্রমে সুস্থতার হার উল্লেখ্য।


পশ্চিমবঙ্গও যে করোনা রোধে খুব পিছিয়ে তা বলা যায়না। বিশেষ করে খুব সামান্য পরিকাঠামো সম্বল করে দিনের পর দিন ডাক্তারদের পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা প্রশংসার যোগ্য। যদিও এর মধ্যেই বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালগুলো  এই করোনা কে হাতিয়ার করে তাদের ব্যবসা ভালোই ফেঁদে বসেছে। বহু সাধারণ মানুষ যাদের হয়ত সরকারি হাসপাতালের থেকে সামান্য বেশী খরচে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর  সাধ্য ছিল, তাদের বাড়ির শেষ মূলধন টুকুও  লক্ষ লক্ষ টাকার বিল করে নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। প্রাণের কাছে অর্থ তুচ্ছ এই কথা মাথায় রেখে বহু পরিবার টাকা এবং তাদের পরিজন উভয়েই হারিয়েছেন। প্রচুর অভিযোগের পর সরকার আস্তে আস্তে উদ্যোগী হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালের এই অত্যাচারের উপর। নজরদারি বাড়ছে। এটাই আশা ব্যঞ্জক। তবে এখনও রাজ্যের বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য আরো পরিকল্পনা প্রয়োজন। রাজ্যের প্রায় প্রতিটা গ্রামে তৈরী হওয়া সুস্বাস্থ্য কেন্দ্র ( হেলথ ওয়েলনেস সেন্টার) গুলিকে করোনার প্রাথমিক চিকিৎসা করার কাজে লাগানো যেতে পারে।  ইতিমধ্যেই এইসব কেন্দ্রগুলোতে কোভিড টেস্টের নমুনা সংগ্রহের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার কাজ চলছে। যত দ্রুত যত বেশী সংখ্যক মানুষকে এর আওতায় আনা যায়, ততই ভালো। এই প্রবন্ধটি লেখার সময় পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে দৈনিক প্রায় তেতাল্লিশ হাজার নমুনা সংগ্রহ হচ্ছে এবং এখনও অব্দি প্রায় তেত্রিশ লাখ নমুনা সংগ্রহ হয়েছে।


তবে অবশ্যই সমালোচনার মুখে পড়তে পারে লক ডাউনের কঠোরতা নিয়ে সরকারি শিথিল মনোভাব। জুন জুলাই থেকেই কন্টেনমেন্ট এলাকা নিয়ে  দ্বিধাগ্রস্থতা এবং সাধারণ মানুষের নিয়ম অমান্য করার প্রবণতাকে প্রশ্রয় দেওয়া। মানুষ শাস্তির মুখে পড়ছেনা দেখে যথেচ্ছ ভাবে অকারণে আড্ডা দিতে চা খেতে মাস্ক ছাড়াই রাস্তায় বেরিয়েছে, যাদের প্রতি কড়া দমন নীতি প্রয়োগ করার দরকার ছিলো সামাজিক স্বার্থেই। জরুরী সার্ভিসের আওতায় যারা নেই, তাদের জীবিকা এবং জীবন নির্বাহ করার দিকেও হয়ত আরো অনেকটা যত্নশীল হওয়া যেত।বারংবার লক ডাউন ঘোষণা এবং তার তারিখ বারংবার বদলানোর মধ্যেই অস্পষ্ট পরিকল্পনার ছাপ পাওয়া যায়। এতদসত্ত্বেও বলা যায় এই করোনা কালের মধ্যে আমাদের রাজ্যবাসী আমফান ঝড়ের মতো প্রবল সাইক্লোনের মুখোমুখি হয়েছে, যা  প্রতিবেশী রাজ্য উড়িশ্যা বাদে অন্য রাজ্যগুলিকে সৌভাগ্যবশত  সইতে হয়নি। ফলে এত ঝড় ঝাপটা সামলেও সুস্থতার অভিমুখে যাত্রা করার চেষ্টায় সরকার এবং সাধারণ মানুষের উভয়েরই লড়াই সাধুবাদ যোগ্য।


বিভিন্ন দেশে বিজ্ঞানীরা যদিও ঘুমিয়ে নেই। এই প্রবল তমসাচ্ছন্ন অবস্থায় তারা দিনরাত এক করে লড়ে যাচ্ছেন ভাইরাসটির প্রতিষেধক আবিষ্কার করার চেষ্টায়। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পর্যায়ে ট্রায়াল চলছে। ব্রিটেন, রাশিয়া, ভারত, ইতালি সব দেশই অঙ্গীকারবদ্ধ।


প্রসঙ্গত, হায়দ্রাবাদের সংস্থা ভারত বায়োটেক তাদের  " কো ভ্যাক্সিন " নামক ভ্যাকসিনটির পরীক্ষার তৃতীয় ধাপে আছে। সংস্থার তরফ থেকে দিল্লী, উত্তর প্রদেশ, বিহার, পাঞ্জাব, অসম  মহারাষ্ট্র সহ আরো নানা রাজ্যের মুখ্যসচিব দের চিঠি দিয়ে মোট  কুড়ি হাজার জন স্বেচ্ছা সেবী মানুষের উপর এই পরীক্ষা হবে। সব ঠিক থাকলে আগামী বছরের গোড়ার দিকে এই ভ্যাক্সিন সাধারণ মানুষের জন্য তৈরী হয়ে যাবে বলেই সংস্থার দাবী। সংস্থাটি ইতিমধ্যেই ড্রাগ কন্ট্রোল জেনারেল অব ইন্ডিয়া এবং ইন্ডিয়ান  কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চের কাছে এই মর্মে অনুমতি নিয়েছে বলে জানানো হয়েছে।


ভারত বায়ুটেকের কো ভ্যাক্সিন ছাড়াও পুনের সেরাম ইনস্টিটিউট অক্সফোর্ডের সাথে যৌথ উদ্যোগে "অক্সফোর্ড - এস্ট্রো জেনেকা কোভিশিল্ড " ভ্যাক্সিনের জোরদার পরীক্ষা চালাচ্ছে ভারতের সতেরোটি জায়গায়। প্রায় ১৬০০ জনের উপর পরীক্ষা করার পরেও এখনো অব্দি ভ্যাকসিনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে কয়েকজনের দেহে সামান্য জ্বর ছাড়া অন্য কোনো অসুবিধে সেভাবে পরিলক্ষিত হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল,ইংল্যান্ড ,ভারত সহ বেশ কিছু দেশে প্রায় ৩০০০০ মানুষের উপর পরীক্ষা এই একই ফলাফল দিয়েছে ।এখনও অব্দি যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। সেরাম ইনস্টিটিউট  ভারত সহ অন্যান্য গরীব দেশগুলিতে নিম্ন মূল্যে এই প্রতিষেধক  পৌঁছে দেওয়ার   প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।


পাশাপাশি গত ২৯ শে সেপ্টেম্বর টুইটারে সেরাম ইনস্টিটিউটের কর্ণধার আদর পুনাওয়ালা একটি টুইটে জানিয়েছেন , ভারত সরকার ৮০০০০ কোটি টাকা আগামী এক বছরে এই ভ্যাকসিনের খাতে বরাদ্দ করলেই সমস্ত দেশবাসীকে বিনামূল্যে এই  ভ্যাক্সিন পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। এই ঘোষণার পরেই অর্থনীতি বিদ থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে একরকম চাঞ্চল্য সৃষ্টি  হয়েছে । কারণ সাধারণ মানুষ হয়ত এই লাখ কোটি টাকার হিসেবের সাথে অভ্যস্ত নয়, কিন্তু একটি  কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থবরাদ্দের হিসেবে এই পরিমাণ অর্থটি তেমন কিছু নয় বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা। মোদী সরকার  চলতি অর্থবর্ষেই ১০০০০০ কোটি টাকা NREGA প্রকল্পে বরাদ্দ করেছে, অর্থাৎ সারা দেশবাসীর ভ্যাক্সিনের পিছনে এর চেয়েও কম বরাদ্দ করে পরিষেবা দেওয়া সম্ভব। বিশেষ করে দেশের জাতীয় স্বাস্থ্য নিরাপত্তার প্রশ্নটি যেখানে জড়িয়ে আছে ওতপ্রোত।  তবে সরকার রাজি হবে কিনা এই পরিমাণ অর্থব্যয়ে , নাকি এড়িয়ে যাবে কৌশলে , তা আগামী সময়ই বলবে।


তবে ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার বেশ দুরুহ একটা পদ্ধতি।  কাজেই ফলপ্রসূ একটি ভ্যাক্সিন আবিষ্কার বেশ কঠিন একটি কাজ। তার চেয়েও বড় প্রশ্নটি অন্যত্র, বিশেষজ্ঞ মহলের একাংশের আশঙ্কা যে ভ্যাক্সিন যদি বা আবিষ্কার হয়ে যায়, তা মুষ্টিমেয় বিত্তশালী দেশগুলির কুক্ষিগত হয়ে থাকবেনা তো? ভারতের মতো ১৩০ কোটির দেশের প্রতিটা মানুষের কাছে ভ্যাক্সিন পৌঁছতে ঠিক কত বছর লাগবে তা ও লাখ টাকার প্রশ্ন ! ২০২০-২০২১ তাই এই দেশের মানুষের কাছে এক কঠিনতম পরীক্ষার বছর। ইতিহাস সাক্ষী  ।এর থেকেও কম উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থায় মানুষ এর থেকেও ভয়াবহ ঝড়ঝাপটা কাটিয়ে উঠেছে। স্প্যানিশ ফ্লু, কলেরা, ম্যালেরিয়া ইত্যাদির দাপটে কোটি কোটি মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। কত দুর্ভিক্ষ, কত সাইক্লোন, কত মহাযুদ্ধ সামলেছে তারা। কত জনপদ নিমেষে ধূলিসাৎ হয়েছে। কত নাম না জানা গ্রাম  গিলে নিয়েছে অরণ্য। কত মানুষের স্বপ্ন গেছে ভেঙ্গে। কিন্তু তবু মানুষ হাল ছাড়েনি। বিজ্ঞান হাল ছাড়েনি। ওষুধ আবিষ্কার হয়েছে। প্রতিষেধক এসেছে। নিজেদেরই ভুলে নষ্ট হয়ে যাওয়া পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় মানুষ আজ অঙ্গীকারবদ্ধ। নতুন যে প্রজন্ম , তারা নিশ্চই করোনা কালের প্রেক্ষিতে নিজেদের জীবনকে বারংবার ভেবে দেখবে। নিজেদের চাওয়া পাওয়া, কষ্ট, ডিপ্রেশনের সামনে যখন আজকের এই ক্রাইসিস পেরোনোর দিনগুলো তারা রাখবে, নিশ্চই তারা উদ্বুদ্ধ হবে।  শারীরিক ইমিউনিটির পাশে মানসিক ইমিউনিটি বেড়ে যাবে কয়েকগুণ।  তারা নিশ্চই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের জীবন দেবতাকে বারংবার বলবে -


" বিপদে  মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা

বিপদে আমি না যেন করি ভয়। "

 

তথ্য ঋণ :

১. google

২. Wikipedia

৩. worldometer

৪. covid19india.org

৫.The Print

৬.The Economic Times

৭.The Hindu

৮.The scientist.com

৯.webmd.com

১০.livemint.com

১১.এবং প্রবন্ধের শেষের কবিতাংশ ঋণ : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 


কপিরাইট রূপময় ভট্টাচার্য কর্তৃক সংরক্ষিত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন