করোনার আগমন
পরীক্ষামূলকভাবে কিছু প্রচলিত ওষুধ নিয়ে এই অসম
যুদ্ধটি স্থায়ী অস্থায়ী হাসপাতালের
হাজার হাজার ডাক্তার, নার্স আর স্বাস্থ্যকর্মীরা লড়ছেন। পুলিশ দিনরাত পাহাড়া দিয়েছেন তখন। এখনও
দিচ্ছেন। ডাক্তাররা ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে
পড়েছেন করোনা রুগীদের রক্ষার ব্রোত নিয়ে।
আর আমরা মাস্ক পড়ে সরাদিনে স্যানেটাইজারে দম্ভ ধুইছি অগুন্তিবার। কি অবিশ্বাস্য দ্রুততায় পদানত করে
ফেলল ক্ষুদ্র থেকেও ক্ষুদ্র এই ভাইরাস। মুখ খিস্তি দেবারও ভাষা নাই। পৃথিবীতে হঠাৎ করে তার জন্ম হয়েছে অথচ মানুষ কতশত বছর
থেকে পৃথিবীর বাসিন্দা! জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে, অর্থে, বিত্তে, সম্পদে বলীয়ান হয়েও
করোনার সামনে অসহায়!? এই
ভাইরাস যদি মানুষের মতো চিন্তা-ভাবনা করতে পারত, তাহলে সে অবশ্যই অট্টহাসি দিয়ে
বলত, ‘পৃথিবীর মানুষ, তোমারা কী নিয়ে করো
অহংকার?
সময় হয়েছে
মাটিতে মেশার। এখন, এতদিনে আমাদের মধ্যে বিশ্বমানবতা জেগেছে। মাঝে মাঝে ভাবি, মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ-মাটির গায়ে লালন, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ এমন আরও। তবুও আমাদের নৈতিক অবক্ষয় যে চরম
পর্যায়ে পৌঁছে গেছিল, সেই
জন্য হয়তো সুশাসন প্রয়োজন ছিল! কিন্তু এ ভাবে ? করোনা যখন প্রবল বিক্রমে অন্য
অন্য দেশে মহামারী চালাচ্ছিল তখনই আমাদের
দেশ সময় মতন তাকে রুখতে গণপরিবহণ বন্ধ করে দিয়েছে। তারপরেও সন্তর্পণে ঢুকে পড়েছে সে আমাদের দেশেও। আমরা
ঘরবন্ধি যুদ্ধার্থী হয়ে শুধুমাত্র নানা
জাতের শিল্পী সেজে করোনাকে ভুলতে সৃজন আন্দলনে মেতে উঠেছি। মানে আমরা দৌড়াচ্ছি কালজয়ী সেলিব্রিটি হওয়ার পথে। করোনাও বারবার রূপচেঞ্জ করে দেখছে আমাদের । মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে করোনার
থেকেও বিপজ্জনক , এবং ভয়াবহ
দূষণাক্রান্ত এই সেলিব্রিটিপনা। বন্ধিদশানে আমার যেটা খুব জরুরি বলে মনে
হচ্ছে আর
হাগ-ডে,
ভ্যালেন্টাইন
-ডে নয়।
বরঞ্চ ১৫ অক্টোবর বিশ্ব হাতধোয়া
দিবস মানে ২০০৮ - এ প্রথম যে চালু হয়েছিল
বলে জেনেছি। কিন্তু কেউ সেভাবে গুরুত্ব দেইনি। ২০২০ থেকে আর ভুল করবো না কেউ । যাই
হোক করোনা কিন্তু আরো প্রমাণ করে দিল বাইরের পরিবেশকে মানুষেরাই
দূষিত করি। ইন্টারনেট আমাদের
দেখিয়েছে যখন থেকে আমরা ভারতের মানুষেরা
দিন রাত গৃহকোণে রয়েছি । তখন থেকেই রাস্তা ঘাট, নদী, পাহাড়ের দূষণের মাত্রা কমে গিয়েছে হু হু করে। দেশের বড়
শহরগুলিতেও তাই। পরিষ্কার বাতাস, আকাশ। দেখা গিয়েছে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে হরিণ, ময়ূর, কচ্ছপ এবং নানান সব পশু পাখিরা। ওরা মুখে কিছু না বলে চাল চলন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, এই পৃথিবীতে চলার মতোন তাদেরও
সমান অধিকার ছিল কিন্তু মানুষের জন্য পারে নি। আমরা ওদের দেখে লজ্জিত না
হলেও,
আনন্দিতও
হয়েছি। আমাদের দেখা পাল্টে দিয়েছে পশুরা।
আমরা যে মানুষরতন হয়েছি। তাই ওদের ধরতে, মারতে, বাঁধতে কেউ যাইনি । শিং, পালক, ছাল কিছুর প্রতিই আমাদের
মানুষদের আর লোভ নেই। লোভ কমে গেছে টাকা, যৌনতা, বা ক্ষমতার। অথচ আমরা
মানুষেরা দিনকয়েক আগেই কেমন ছিলাম!? চারিদিকে মদোন্নতি, ধর্ষণ, প্রকৃতিকেও ধর্ষণ করার প্রবণতা থেকে আধুনিকতার নামে নগ্নতা আর মানুষে মানুষে বিভেদ চরম সীমায় পৌঁছে গেছিল।
অর্থাৎ চোখের খিদায় একদিন বিবেক চিবিয়ে খেয়েছি। শুধু কি তাই! নিরন্তর ভুল
করে গেছি, কখনো
নিজের সাথে,
কখনো
পরিবারের সাথে,
কখনো
পরিবেশের সাথে। সে'গুলো
শোধরানোর সময় এছেছে । পৃথিবী হয়তোবা নতুন করে গুছিয়ে নিতে চাইছে নিজেকে। তাই সে
কঠোর হাতে শিক্ষা দিচ্ছে। আমারাও পাঁকে পড়ে এখন
প্রকৃতির কথা বলছি, নিজের বাঁচা আর
অন্যকে বাঁচানোর কথা বলছি। মৈত্রীর কথা বলছি। বাড়িতেও সবাই সবার সাথে মিলেমিশে থাকছি। স্বেচ্ছাচার ভুলে যেতে চাইছি।
মনকে হিংসা নির্মাণের আর সুযোগ দিতে চাইছি না। দেশের নাম উচ্চারণ করে গর্ববোধ
করছি। আহা ভারতবর্ষ। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য সাধনের যেই মন্ত্র, তার উৎপত্তিস্থলও এই
ভারতবর্ষ। যে মন্ত্রের বিস্তার উত্তরের হিমালয় থেকে শুরু করে আজ সমগ্র বিশ্বে। এই
মন্ত্রের সাধকগণ যুগে যুগে ভারতভূমিতে অবতীর্ণ হয়ে আমাদের মৈত্রীর শিক্ষা দিয়েছেন, সাম্যের শিক্ষা দিয়েছেন, মানবিকতার শিক্ষা
দিয়েছেন। তা আমরা মুখে মুখে বলেছি। কাজে করিনাই। কিন্তু এখন করছি
কায়মনোবাক্যে নিজেদের সংশোধন। মনে প্রাণে বাঁচার জন্য কতো কিছু যে বর্জন করেছি আমরা। মনে পড়ে ধর্মযুদ্ধের সারি
সারি মৃত্যুর সংখ্যা। ভয় হয় এটাও কি মানুষকে মানুষ হয়ে ওঠার
ধর্ম যুদ্ধ?
প্রশ্ন
জাগে পশুরা আমাদের বন্ধি জীবন নিয়ে কি ভাবছে? অাসলে ওদের তো জানার কথা নয় পরিকল্পনা ছাড়াই অামরা যে পরিস্হিতির চাপে পড়ে
গুণসমৃদ্ধ হয়েছি। প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি
যত্নবান হলে যে একটা সবুজ, সতেজ মডেল হয়ে
উঠতে পারতো দেশ, সেটা আমাদের ধারণা ছিল, কিন্তু ইচ্ছে হয়নি এতোটা ত্যাগ করা সত্যি সম্ভব ছিলনা বলে। অবশ্য উৎসব
করে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করেছি ,নানান জন, নানান জায়গায়, নানান ভাবে। যদিও ফেসবুক সাক্ষী থাকলেও পরিবেশের বুকে
হাহাকার ছিলই। বিশ্বের ইতিহাসে এই
প্রথমবার কোনও শত্রু যুদ্ধের ময়দানে এসে এমন স্নিগ্ধ পরিবেশ দিল। আমরাও পরিবেশের এই অনন্য রূপ
দেখিনি কখনও আগে। দেখিনি প্রকৃতির
এমন নিঃশ্বাস নেওয়া। আমাদের এই ঐক্যবোধ
জাগ্রত থাকুক। নদীরা থাকুক স্বচ্ছ সলিলা। প্রকৃতি প্রকৃতির নিজের সঙ্গ উপভোগ করুক। ধূলাহীন সবুজের সমারোহ
পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ুক। পাখিদের
দলবাধা গল্প না হয় আমরা আর কিছুদিন ঘর
থেকে শুনি। এখন প্রকৃতি চনমনে সাহসী। সাহসী জন্তু জানোয়ার। অার আমরা শুধু মনখারাপের জানলার পাশ দিয়ে দেখছি একদল রোদ্দুর
পরস্পরকে রং মাখাচ্ছে। চাঁদ আগের তুলনায় আরও বেশি
সুন্দরী হয়েছে। অমাবস্যার অন্ধকারটা যেন সেদিন বলছিল, আমি খুব তাড়াতাড়ি চলে
যাবো। ভারতবর্ষ যেন সবার উদ্দেশ্যে বলছে, তীর্থে আসবে যদি - ধীরে, অতি ধীরে পা ফেলে এস ।
এই আশার আলো নিয়েই সব কিছু দেখতে চাইছিলাম
অন্যরকম,
অন্য
নিয়মের মধ্যে দিয়ে সময় চাইছিলাম বেশ। সবাই বাড়িতে বসে অনুধাবন করছিলাম আমাদের
অবস্থান। কোনও অবস্থাতেই আমাদের ধৈর্য, আমাদের প্রার্থনা, আমাদের শুদ্ধতা
থেকে যেন বিচ্যুত না হই এই মনোভাব নিয়ে ।
আমরা উপলব্ধি করছিলাম যে পৃথিবী বলছে
" প্রস্তুত হও নিজেকে বদলে নিতে "। তা না হলে সমাপ্তি। সত্যি আমরাও বদলে গেছি অনেক । বুঝেছি এই পৃথিবীটা সুন্দর, এই দেশটা আরও সুন্দর, আমাদের লোভহীন জীবনটা তার থেকেও বেশি সুন্দর। কিন্তু একটা সময়
মানুষের মনে করোনা-দুর্যোগ ভয়াবহভাবে হতাশার-আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল না তা নয়
। তার থেকে আমরা অনেকটা বেড়িয়ে এসেছি। আমরা মানুষ জাতি সহজে সব ভুলে যাই। তাই বদলে
যেতে আমাদের সময় লাগেনা। তবে প্রশ্ন ছিল
যে আজ লোকজন বাড়িতে তাই দূষণ নেই। কাল সব
চালু হলেই আবার মানুষের সেই অভ্যাস ফিরে
আসবে না তো?
ফিরে আসবে
না তো কাম ক্রোধ হিংসা? রেপ হত্যা রোড অ্যাক্সিডেন্ট ! বেঁচে থাকার সংগ্রাম আরো
তীব্র হবে না তো। যা ভাল দেখছি তার বেশিরভাগই কি সাময়িক ! সত্যি সেই ভাবনাটা যে
ভুল নয় তার প্রমাণও ইতিমধ্যে পেয়েও গেছি। যাই হোক আমরা বিশ্বাস করেছি যে করোনা
থাকবে,
এর ভেতরেই
আমাদের মানিয়ে চলতে হবে। তবে করোনা ঝড় কালে যেসব সংকট তৈরি হয়েছে, মানে করোনার থাবায়
আমাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি, শিল্প-বাণিজ্যের
প্রতিটি ক্ষেত্রই যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা
বলার অপেক্ষা রাখেনা। তার মধ্যেও সবচেয়ে
বড় সংকট হল
কর্মহীন এক বিশাল জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে। তার মধ্যে পরিযায়ী শ্রমীক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, হকার, রিকশাওয়ালা, ক্ষেতমজুর, পরিবহন শ্রমিক, মালিক, কুলি, দিনমজুর থেকে শুরু করে
বাসার কাজের মানুষ, এমনকি
পেশাদার ভিক্ষুকরা পর্যন্ত। এক অজানা আতঙ্কে আড়ষ্ট হয়ে পড়েছে পুরো শ্রমের
আঙিনা!পরিশেষে বলব এই দুর্যোগ মোকাবেলায় চাই জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা।
সরকারের পাশে থেকে বেসরকারি খাতের মানুষকেও ভূমিকা রাখতে হবে উল্লিখিত
স্বেচ্ছাব্রতীদের মতো। এরা যেন অর্থনীতিতে পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে লড়তে
স্বচ্ছ ও সৎ সহযোগিতা পায়। তাদের
জীবন ও জীবিকা যেন ঠকের হাতে না পড়ে। সে সরকারের হোক বা বেসরকারিদের কছেই হোক। কর্মসংস্থানের এই ভেঙে পড়া ঝুঁকি কাটিয়ে
আবার যথাযথরূপে পুনঃস্থাপন না করতে পারলে সমাজের সার্বিক স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা দুঃসাধ্য
হয়ে পড়বে। বতর্মান উদ্বেগের বিষয় হলো অনেক
ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে সমন্বয়হীন কর্মকাণ্ডের চিত্র। এর মাঝে আবার সংবাদমাধ্যমেই
উঠে আসছে নানারকম অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র যা মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করছে। কোনো
কোনো ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল অনেকেরই
ব্যর্থতা- দেখা যাচ্ছে। এর ওপর নানারকম
অর্থহীন কথাও কানে আসে। যেসব শুনে
নিরুদ্বিগ্ন থাকা যায়না! করোনা নানামুখী ক্ষতির পাশাপাশি আমাদের শিক্ষা খাতে যে
ক্ষতি করেছে বা আরও করবে তা থেকে উত্তরণ আমাদের সহজ হবে না। শিক্ষা সংশ্নিষ্ট সবাই
তো বটেই অভিভাবকদের পর্যন্ত নানা রকম শঙ্কাগ্রস্ত হবে বলে আমার ধারণা।
করোনা-দুর্যোগের শিক্ষার্থীদের এই ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার অনাকাঙ্ক্ষিত।শুনতে
খারাপ লাগলেও বাস্তবায়নে এর যে বিরূপ প্রভাব পড়বে । সেই ভার আমাদের সমাজ বইতে পারবে তো??
কপিরাইট লক্ষ্মী নন্দী কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন