মুখোমুখি সুলেখা
সরকার
সম্পাদক রংরুট: সকলের আগে ত্রৈমাসিক রংরুটের পক্ষ থেকে আপনাকে
আন্তরিক ধন্যবাদ।
রংরুটের এই বিশেষ সংখ্যায় আপনাকে স্বাগতম। প্রথমেই যে বিষয়টি
জানতে চাইবো সেটি হলো, কবিতাই বা কেন? অর্থাৎ কবিতা ছাড়া আরও তো অনেক
বিষয় রয়েছে
সাহিত্যের। সেখানে কবিতা নিয়ে আপনার আগ্রহের উৎস কি? এবং
মোটামুটি ভাবে জীবনের কোন পর্যায় থেকে এই আগ্রহের সূত্রপাত। এবং এই বিষয়ে বিশেষ
কারুর প্রভাব যদি থেকে থাকে আপনার জীবনে।
সুলেখা
সরকার: আমি প্রথমেই রংরুট এবং তার পাঠকদের সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা
জানাই। কবিতায় কেন ? এটা ঠিক আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় কারণ আমি কবিতার পাশাপাশি একজন
প্রাবন্ধিকও বটে। তবে এটা ঠিক যে কবিতার প্রতি আমার আগ্রহটা অনেকটাই বেশি। কবিতা
লেখার প্রথম শুরুটা আমার কাছে স্বপ্নের মতো। তখন ক্লাস সিক্স। 'নর্থ বেঙ্গল আর্ট এন্ড ক্রাফট ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন'এর পক্ষে শিলিগুড়ি কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে চিত্রশিল্পীদের নিয়ে ছবি আঁকার
ওয়ার্কশপ চলছে। উপস্থিত ছিলেন
চিত্রশিল্পী বিজন চৌধুরী, প্রকাশ
কর্মকার, সমীর
আইচ, আশিস
কাবাসি, দেবাশীষ
কাবাসি, দিপালী
ভট্টাচার্য এবং অন্যান্য চিত্রশিল্পীরা।
কলকাতার 'নান্দীকার' নাট্যগোষ্ঠীর পক্ষে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত এবং অন্যান্য সদস্যরা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বিখ্যাত
কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত। তিনদিন ধরে ওয়ার্কসপ চলছিল সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৫ টা
পর্যন্ত। প্রথম
দিন সকলের
ক্যানভাসের সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছিলাম আর কৌতুহলী জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল আমার।
দ্বিতীয়
দিন আমি ঢুকতেই শ্রদ্ধেয় প্রকাশ কর্মকার আমায় চিৎকার করে ডেকে বললেন, কাল সারাদিন যুবকদের পাশে পাশে
ছিলে। আজ এইখানে চুপ করে বসবে। আমার ছবি দেখবে। আমি টেবিলের সামনে
এগিয়ে গেলাম। টেবিল ঘিরে যতগুলো চেয়ার ছিল
সবকটি চেয়ারেই গুণীজনেরা বসেছিলেন। আমি বড় বড় চোখ করে প্রকাশ জেঠুর দিকে তাকালাম।
ঠিক সেই সময়ে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা রোগা-পাতলা একজন মানুষ বললেন, এদিকে
আয়। আমার কোলে বস। আমি গিয়ে তার
কোলে বসলাম। প্রকাশ জেঠু বললেন, চেনো ওকে ? ঘাড় নাড়লাম ... না। উনি অমিতাভ দাশগুপ্ত। আমরা রং দিয়ে ছবি আঁকি, উনি শব্দ দিয়ে ছবি আঁকেন। অমিতাভ দাশগুপ্ত
হাসলেন। বুক পকেট থেকে পেন বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, লেখ দেখি। আমি
লিখলাম, ' মন যখন ক্যানভাসে মানুষ খুঁজতে গেল / এক বড় কবি /
এক বুড়ো কবি / শব্দের স্বপ্ন দেখাল '। কবি অমিতাভ দাশগুপ্তের উৎসাহে সেই ছিল আমার প্রথম
কবিতা লেখা। আজকে ভাবলে অবাক এবং আশ্চর্য হই। এছাড়াও আমি
খুব ছোট বয়স থেকেই মা'কে কবিতা লিখতে
দেখেছি। আমার
দাদা মশাইও কবিতা ও গান লিখতেন।
সম্পাদক রংরুট: এবারে আসি আপনার নিজের লেখার বিষয়ে, কোন
বিশেষ লেখকের
প্রভাব সম্বন্ধে আপনি কি সচেতন? যেমন, অনেকেই
আমরা আমাদের খুব প্রিয় লেখকের দ্বারা মনের অজান্তেই প্রভাবিত হয়ে পড়তে
পারি। আবার অত্যন্ত সচেতন ভাবে প্রিয়তম লেখকের প্রভাব থেকে
নিজেকে মুক্ত রাখার প্রয়াসও করতে পারি। আপনার নিজের
লেখালেখির ক্ষেত্রে বিষয়টি ঠিক কি রকম?
সুলেখা
সরকার: একেবারেই অন্যরকম। আসলে আমি শুধু কবি নই, প্রাবন্ধিকও।
তাই এই কথা আমার ক্ষেত্রে ঠিক প্রযোজ্য নয় তবে এটা ঠিক কবিতার প্রতি আগ্রহটা
বরাবরই বেশি। কোনো নির্দিষ্ট কবির কবিতা সেভাবে আমি পড়ি না। তবে সিলেবাসের কবিতাগুলো
পড়তে হয়েছে। তাছাড়া আমি মনে করি না, কবিতা
লিখতে গেলে প্রচুর কবিতা পড়তে হবে। কখনো রান্না করতে, প্রবন্ধ
লিখতে, আড্ডা দিতে অথবা মঞ্চে বসে আছি তারমধ্যেই কবিতা এসে যায়।
তারজন্য কোনো আয়োজনের প্রয়োজন পড়ে না। উৎসব, শ্মশান, শূন্যতা, ঘরোয়া
মেজাজ যেখানে যখন খুশি কবিতা আসে যায়। কোনো
কবি নন বরং ঘটনার প্রভাব ও তার ছায়া দেখা গেছে আমার কবিতায়। মানে
বলা যায় যে, কোন কবির কবিতা দ্বারা প্রভাবিত হই নি ঠিক কিন্তু সামাজিক ঘটনাবলী, নিজের কল্পনা, দৃশ্য, প্রকৃতি
দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি বারবার এবং সেখান থেকে উপাদান নিয়েই তার সাথে নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও
সঞ্চয়ে মিলেমিশে জন্ম নিয়েছে কবিতা।
সম্পাদক রংরুট: কবিত লেখার বিষয়ে, আপনি
কি আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশেই বিশ্বাসী, নাকি
মহাকবি টি এস এলিয়টের সেই বিখ্যাত উক্তির মতো আপনিও বিশ্বাস করেন, “Poetry is not
a turning loose of emotion, but an escape from emotion; it is not the
expression of personality, but an escape from personality. But, of course, only
those who have personality and emotions know what it means to want to escape
from these things.” এলিয়ট
কথিত এই যে
ব্যক্তিগত আবেগ ও আপন ব্যক্তিত্বের বদ্ধ আবহাওয়া থেকে
মুক্তির আনন্দই কবিতা, আপনার কবিজীবনের পর্বে এরকম অভিজ্ঞতা
ঘটেছে কি কখনো?
সুলেখা
সরকার: মহাকবি
টি এস এলিয়েটের বিখ্যাত উক্তি। পোয়েট্রি ডিফাইন করতে গিয়ে তিনি এই কথা বলেছেন।
রোমান্টিক পোয়েটস এর ট্রার্মসে
পোয়েট্রি মানে এসকেপ ফর্ম রিয়ালিটি।
রিয়ালিটির মধ্যে কি থাকে... ইমোশন
যা আমাদের ক্ষয় করে। এক্সপেক্টেশন যা আমাদের হার্ট
করে। পার্সোনালিটি যার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হই। আসলে রেগুলার লিভিং, সোশ্যাল
নর্মস, রুলস এন্ড কন্ডিশনস অফ সোসাইটি আমাদের
সাফোকেট করে দেয়। আমরা নিজেদের আইসোলেট করতে শুরু করি এবং সবকিছু থেকে দূরে সরে
যেতে থাকি। রিডার্সরা ভাবে কবি কবিতায় ইমোশন নিয়ে খেলছে
আসলেই পালাচ্ছি, এসকেপ করছি। আমার ক্ষেত্রে সেটা বারবার এসেছে।
কবিতায় নিজেকে মুক্ত করে যেমন আনন্দ পেয়েছি তেমনি আয়ু বেড়েছে।
সম্পাদক রংরুট: এলিয়টের প্রসঙ্গই যখন উঠল, উনি
কিন্তু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, “Honest criticism and sensitive
appreciation is directed not upon the poet but upon the poetry.” আপনার কবিতা
লেখালেখির জীবনপর্বের অভিজ্ঞতায় আপনিও কি এলিয়টের সাথে একমত। কবি নয়, কবিতাই হোক
আলোচনা সমালোচনার বিষয়বস্তু। যদিও আমাদের সাহিত্য সমাজে কবিতা ছেড়ে কবিকেই
সমালোচনার
বিষয় করে তোলার ঐতিহ্য অনেক সুপ্রাচীন। একজন সংবেদনশীল কবি
হিসাবে আপনার প্রতিক্রিয়া।
সুলেখা
সরকার: ক্রিটিক যদি
ক্রিটিসাইজ করে, বিশেষ করে সেটা লিঙ্গুইস্টিক হোক, ইমোশন হোক, থিম, প্লট , প্যাটার্ন
যাই হোক না কেন, আমি মনে করি অনেস্ট ক্রিটিসিজম
কবিতার একটি পার্ট। এটা কখনোই পোয়েট এর জন্য নয়। আমাদের
পার্সোনাল লাইফ, পার্সোনাল ইমোশন বা পার্সোনাল
এক্সপেরিয়েন্সকে হার্ট করা ক্রিটিসিজম এর উদ্দেশ্য
নয়। এটা শুধু এবং শুধুমাত্র আমাদের পোয়েট্রির সাথেই
যেন রিভলভ করে। এপ্রিসিয়েশন বা ক্রিটিসিজম
যাই হোক না কেন উভয় ক্ষেত্রেই it's only directed towards the poetry and nor
towards the poet.
সম্পাদক
রংরুট: আমাদের সমাজসংসারে নারীর
অবস্থান আপনাকে
কতটা ও কিভাবে বিচলিত করে? আপনার নিজের সাহিত্যচর্চার ভিতরে
এর কোন প্রচ্ছন্ন প্রভাব বিদ্যমান কি?
সুলেখা
সরকার: সঠিক
ও উপযুক্ত প্রশ্ন। সময়ের হিসেবে সামাজিকভাবে সিন্ধু সভ্যতার নারীদের স্থান
উঁচুতে ছিল। পরবর্তীকালে অর্থাৎ বৈদিক যুগে নারীদের অবস্থানগত অধঃপতন সম্পর্কে
আমরা সকলেই অবগত। একদিকে তাসলিমা, মালালা অন্যদিকে নারীর ক্রমবর্ধমান
সংগ্রাম এবং অর্জনকে লক্ষ্য করে রাষ্ট্রসঙ্ঘের "নারী দশক" ঘোষণা, এই
বিপরীতপন্থী আচরণ আমাকে ভাবিয়ে তোলে। নারীরা সব দিক থেকেই আক্রান্ত। সাধারণ যে কোনো
ইস্যু ধর্মগত, জাতিগত
তারপর রাজনৈতিক হয়ে ওঠে। অথচ পরিবার, সমাজ, রাজনীতির কূটকৌশলের বিরুদ্ধে
নারীরা যে লড়াই চালায় সে ক্ষেত্রে নারীদের আড়ালে ক্ষতিগ্রস্থ করা বা জনসমক্ষে
কূটবুদ্ধির প্রয়োগে মাটিতে মিলিয়ে দেবার প্রয়াস সব সময়। চেয়ারে বসলেই যেমন
মানুষের আত্মীয় হওয়া যায় না শুধুমাত্র ক্ষমতা অর্জন করে নিজ এবং নিজস্ব গোষ্ঠীর
পোষণ ছাড়া সেখানে শিবিরহীন একটি
মেয়ে ঠিক কতটা আক্রান্ত হয় তার হিসেব সমাজ জানে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। আমি বিচলিত নই কোনদিন।
দৃষ্টি সোজা রেখে বুদ্ধির প্রয়োগ ঘটানো জরুরী। লক্ষ্য সম্মুখে।
সেখানে পৌঁছতে পরিশ্রম ও সাধনার সাথে সাথে সমাজ থেকে যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু কেড়ে
নেব এবং তা সততা ও সাহসিকতার সাথে।
সম্পাদক রংরুট: আপনার কবিতায় সমাজ ভাবনার একটি
প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে। বস্তুত সমাজসচেতনতার আলো একজন কবির সাহিত্যচর্চার অন্যতম
আয়ুধ। কবিতার ভিতর দিয়ে আপনি আমাদের সামাজিক অবস্থানের এই যে
একটা চলমান ধারাভাষ্য দেওয়ার প্রয়াসী, এটি কি বিশেষ কোন মতবাদ
সঞ্জাত?
না’কি আপনার সংবেদনশীল কবি মননেরই একস্টেনশন। এখানে
প্রাসঙ্গিক ভাবে
আরও একটি প্রশ্ন উঁকি দেয়, কবি মননের
সাথে বিশেষ বিশেষ মতবাদের, তা রাজনৈতিক হোক বা আধ্যাত্মিকই
হোক, কোন
আপাত বিরোধ থাকা কি সম্ভব? আপনার নিজস্ব অভিমত।
সুলেখা
সরকার: প্রথমত আমি কোন
নির্দিষ্ট মতবাদের পক্ষে নই। এক্ষেত্রে জীবন সম্পর্কিত বাস্তব অভিজ্ঞতাকে মান্যতা দিই এবং
সেটাই আমার কবিতার ভাব ও সারবস্তু।
মূলত সকলেই কম বেশি সংবেদনশীল। তবে কবি মনের সাথে রাজনৈতিক অথবা
আধ্যাত্মিক মতবাদের বিরোধ সবসময় হতে পারে আবার নাও হতে পারে সেটা
স্বার্থকেন্দ্রিক।
তবে এটা খুবই সত্য আমরা কেউই রাজনীতি বা আধ্যাত্বিকতার
বাইরে নই। বর্তমান সময়ে যেকোন পর্যায়ে স্বার্থসিদ্ধি যেমন
মানুষের লক্ষ্য আবার স্বার্থত্যাগের মাধ্যমে আনন্দের অনুসন্ধানও মানুষের
ধর্ম।
সম্পাদক রংরুট: আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায়, সাহিত্যের
অবস্থান কতটা
জোরালো বলে আপানার মনে হয়।? আজকের সাহিত্য এই সময়ের জীবন ও
জীবন সংগ্রামে সংবেদী আলো দিতে পারছে কি আদৌ? না’কি
এযুগের মানুষকে সেই আলোর খোঁজে ক্রমাগত ফিরে তাকাতে হচ্ছে শাশ্বত
সাহিত্যের অভিমুখেই?
সুলেখা
সরকার: সমকালীন
সমাজ ব্যবস্থায় বাংলা সাহিত্য কতটা জোরালো এবং তার অবস্থান নির্ভর করে ভবিষ্যৎ
সমাজ ও সাহিত্য চিন্তার ওপর। ভবিষ্যৎ, বর্তমান
সাহিত্যকে কিভাবে কতটা গ্রহণ করবে সেটাই টিকে থাকার মুখ্য বিষয়। এই মুহূর্তে কেউ
গবেষণায়,
কেউ অনুবাদে, কেউ রচনায় ব্যস্ত। এইযে
সাহিত্যসৃষ্টি এবং পাঠক সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতাই নির্ধারণ করবে এই মুহুর্তের বাংলা
সাহিত্যের অবস্থান এবং আয়ু। তাই এই
বিষয়ে ঢিল ছোড়া সঠিক নয়। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলব, একদম
পারছে। সেদিনও
মানুষের দুঃখ যন্ত্রণা ছিল। আজও আছে।
আজও মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদ খোঁজে। শক্তি
খোঁজে। যারা বই পড়ে, সাহিত্যের
সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত তারা জানে সাহিত্যের মর্মকথা।
আলোর
সন্ধানে মানুষকে বারবার শাশ্বত সাহিত্যের দিকে ফিরে তাকাতে হচ্ছে এ কথায় আমি
বিশ্বাসী নই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধারা এসেছে।
যুগ থেকে আরেকটি যুগ এসেছে। তার ভেতর অনবরত পরিবর্তন চলছে এবং যেটা চলতেই থাকবে।
সেটা কেউ বুঝে উঠতে পারেন, কেউ পারেন
না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় সবকিছু স্থির কিন্তু সাহিত্য হল সূর্যের মতো।
সে স্থির নয়। অনবরত তার উপাদানের যেমন স্থান বিনিময় হচ্ছে তেমনি সময়ের হিসেবে
তার মধ্যে ঘটে চলেছে একাধিক পরিবর্তন। প্রাচীন
ও মধ্যযুগের সাহিত্যে আমরা পেয়েছি চর্যাপদ, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, অনুবাদ
সাহিত্য, ইসলামী সাহিত্য, শাক্তপদাবলী, রামায়ণ এবং মহাভারত সেইরকমই আধুনিক সাহিত্যে আমরা পেয়েছি
প্রবন্ধ, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, কল্পবিজ্ঞান।
যেখানে মানবতাবাদ ও মানুষের মনস্তত্ত্বকে বেশি মাত্রায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বা
হয়। একটা সময় পর্যন্ত মানুষের বিনোদনের সেইরকম কোনো মাধ্যম না থাকায় মানুষ বই
পড়তো কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তিগত কারণে প্রায় সবকিছুই সহজলভ্য।
বিনোদনের বিভিন্নতায় মানুষ তার চাহিদা মিটিয়ে নেয়। ফলে বই পড়ার তাগিদ অনেকটা
কমে গেছে । কনটেম্পোরারি লেখার প্রতি পাঠকের ঝোঁক বেশি।
আমি যখন স্কুল বা পরে কলেজে পড়ি তখনও পাশাপাশি অনেকের মধ্যেই বই পড়ার নেশা দেখেছি।
উপন্যাস, বড় গল্প কিন্তু এখন কম্পিটিশনের
যুগ। মানুষের সময় কম।
কিছু মানুষ মাইকেল মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শামসুর রহমান আবার কেউ জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, নির্মলেন্দু
গুণ, অমিও চক্রবর্তী ও সুধীন্দ্রনাথ
দত্ত কে পড়েন। কেউ আবার শঙ্খ ঘোষ, জয়
গোস্বামী, সুবোধ সরকার এদের লেখা পড়তে
ভালোবাসেন। সেটা যার যার নিজস্ব পছন্দ। আসলে মানুষের সন্ধান সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত।
সম্পাদক রংরুট: কবিতায় অনেকেই দিন বদলের স্বপ্ন
দেখেন। এবং দেখান।
বিশ্ব কবিতার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে সেটি অনুভব করা যায়।
এই সময়ের একজন কবি হিসাবে এই দিন বদলের স্বপ্ন দেখা ও
দেখানোর বিষয়টি কিভাবে ধরা দেয় আপনার অন্তরে?
সুলেখা
সরকার: শিল্পী
মাত্রই সংবেদনশীল বিশেষত যারা লেখার সাথে যুক্ত তারা অতিমাত্রায়।
আমাদের প্রাথমিক চাহিদা থেকে শুরু করে ক্রমাগত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত প্রয়োজনীয় ইচ্ছেগুলোর
পাশাপাশি জনগণ ও জনগণের জীবনযাপনের ন্যূনতম উপকরণের যোগান দেওয়া সেই দেশের
সরকারের সাংবিধানিক কর্তব্য। প্রতিটি
দেশেই মূল দুটি বিষয় সরকার ও জনগণ। এই দুটি
বিষয়কে কেন্দ্র করেই যাবতীয় ধর্ম, জাতি, সমাজ, রাজনীতি ও
সংস্কৃতিগত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আন্দোলন গড়ে ওঠে। এবার এই আন্দোলন তখনই সমাজের
বিভিন্ন স্তরে বসে থাকা মানুষ বা সরকারকে প্রভাবিত করে যখন এর কারণটা
বৈজ্ঞানিকভাবে যুক্তিসঙ্গত ও জীবনকেন্দ্রিক হয়। তখনই আন্দোলনের সাথে শিক্ষিত সমাজ যুক্ত হয়।
কবি কলম ধরে। আমি সবসময়ই শিক্ষার প্রতি বিশ্বাসী কারণ একমাত্র বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে
যুক্তিনির্ভর শিক্ষাই পারে যুগ বদলাতে, দিন বদলাতে।
সম্পাদক রংরুট: আপনার নিজের লেখার বিষয়ে কখনো কি
মনে হয়েছে,
একটি গণ্ডীর ভিতরেই আটকিয়ে যাচ্ছে আপনার
যাবতীয় লেখালেখি। সাধারণত আমাদের অধিকাংশই কিন্তু একটা
পর্যায়ে এসে আত্মনির্মিত নিজস্ব গন্ডীর ভিতরেই আটকিয়ে যাই। অনেকেই হয়তো খেয়াল করি না।
আবার অনেকেই হয়তো সচেতন ভাবে সেই গণ্ডীর ভিতর থেকে নিজেকে মুক্ত করতে প্রয়াসী হন। আপনার
লেখালেখি ও আপনার ব্যক্তিগত উপলব্ধি থেকে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত যদি করেন।
সুলেখা
সরকার: নতুন
নতুন শৈলী বা আঙ্গিক নিয়ে কাজ করার প্রবণতা খুব কম মানুষের থাকে তবে যারা এ
বিষয়ে সচেতন তারা সহজেই নির্দিষ্ট সীমারেখার বাইরে বেরিয়ে যেমন কাজ করে তেমনি
শব্দ, বাক্য ও তার ভাব নিয়ে বিভিন্ন
ধরনের গবেষণামূলক চিন্তাভাবনাও করে। স্বভাবতই আমি এই দৃষ্টিভঙ্গিতেই বিশ্বাসী।
সম্পাদক
রংরুট: সবশেষে এসে জানতে চাইবো
আপনার ব্যক্তিগত সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি সমসাময়িক কার কার কবিতাচর্চা আপনাকে
বিশেষ ভাবে উদ্বুদ্ধ করে, যেখান
থেকে বাঙলা কাব্যসাহিত্যের অদূর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আপনি প্রবল ভাবে আশাবাদী ভুমিতে
অবস্থান করতে পারেন।
সুলেখা
সরকার: অবশ্যই
নির্মলেন্দু গুণ, জয় গোস্বামী, সুবোধ-সরকার, অংশুমান কর পাশাপাশি প্রান্তিক
এলাকা থেকে উঠে আসা অসংখ্য তরুণ কবি।
সুলেখা সরকার: কবি প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক। জন্ম শিলিগুড়ি
শহরে। বাবা শ্রী
সুরেশ সরকার। মা শ্রীমতী রেবা সরকার। একক কাব্যগ্রন্থঃ ১)
'যে কথার অন্তর্বাস নেই'। ২) কবিতায় শুয়ে কাঁদি। যৌথ কাব্যগ্রন্থঃ ১) সময়ের সাথে কবিতার কাছে ২) কবিতা ক্যাফে। ৩) মগ্ন পদাবলী ৪) কাঁটাতারের এপার ওপার।
কপিরাইট রংরুট
কর্তৃক সংরক্ষিত
রংরুট ও কবি সুলেখা সরকার কে ধন্যবাদ, অত্যন্ত মূল্যবান, প্রাণবন্ত এই সাক্ষাৎকার পর্বটির জন্য এবং এযাবৎকালে আমার পড়া অন্যতম সেরা ও এই সংখ্যার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এই সাক্ষাৎকার পর্বটি।
উত্তরমুছুন