মুখোমুখি সুস্মেলী দত্ত



মুখোমুখি সুস্মেলী দত্ত


সম্পাদক রংরুট: সকলের আগে ত্রৈমাসিক রংরুটের পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। রংরুটের এই বিশেষ সংখ্যায় আপনাকে স্বাগতম। প্রথমেই যে বিষয়টি জানতে চাইবো সেটি হলো, সাহিত্যই বা কেন? অর্থাৎ সাহিত্য ছাড়া আরও তো অনেক বিষয় রয়েছে। সেখানে সাহিত্য নিয়ে আপনার আগ্রহের উৎস কি? এবং মোটামুটি ভাবে জীবনের কোন পর্যায় থেকে সাহিত্য বিষয়ে এই আগ্রহের সূত্রপাত। এবং এই বিষয়ে বিশেষ কারুর প্রভাব যদি থেকে থাকে আপনার জীবনে।

সুস্মেলী দত্ত: ছোটবেলা থেকেই আমি খুব অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলাম।  যেহেতু খুব রক্ষণশীল পরিবারে বড় হয়েছি, সেহেতু বাইরের জগতের নানান সস্তা চটক আমাকে কোনদিন স্পর্শ করেনি। প্রকারান্তরে বলা যায়, আমিই হয়ত সেসব থেকে দূরত্ব বাঁচিয়ে নিজের মনে যাকে বলে, অন্তর্লীন হয়ে থাকার চেষ্টা করতাম। বোধহয় সেই কারনেই ফাইন আর্টস বা ক্রিয়েটিভ আর্টসের সাহিত্য শাখাটি আমার বড় পছন্দের ছিল। মনে পড়ে, ছোটবেলা থেকেই বেশ ছিলাম ভাবুক প্রকৃতির। পরিবার বন্ধুবান্ধব–আত্মীয়স্বজনকে সময় দিয়ে যতটা নিজের জন্য বাঁচত বই পড়তাম গোগ্রাসে। না সে ছোট বড় যে কোন বিষয় ভিত্তিক গ্রন্থ বা ম্যাগাজিনই হোক না কেন। কেন জানিনা মনে হত, আমার সব প্রশ্নের উত্তর বুঝি এই বইয়ের মধ্যেই আছে।  এই বই–ই একমাত্র অবলম্বন, যার মাধ্যমে আমি আমার দুঃখ–শোক যন্ত্রণাগুলোকে জয় করতে পারি, এই কথন চর্চার নিয়মিত অভ্যাসে খুঁজে পাই নিজের অস্তিত্ব।  আর যখন মনের মধ্যে না বলা কথা আর ভাবনাগুলো জট পাকাত তখন একমাত্র লেখাতেই আমি আমার স্বস্তিটি খুঁজে পেতাম। তাই ছোট থেকেই লেখালেখির আগ্রহ। বিশেষ কোন মানুষ বা ঘটনা আমাকে লেখাতে প্রভাবিত করেছিল এমন নয় – আসলে তখন বুঝতাম না এখন বুঝি আমি এর মাধ্যমেই হয়ত  নিজের আমিটাকেই নিরন্তর নিজের মধ্যে খোঁজার চেষ্টা করতাম তাই লেখক জীবনের উৎসবিন্দু বলতে এটাই বলা যেতে পারে।



সম্পাদক রংরুট: এবারে আসি প্রথম লেখার বিষয়ে। লেখালেখির ভিতরে যে অপার আনন্দ, সেই আনন্দের প্রথম অভিজ্ঞতা কেমন ছিল আপনার? একটু বিস্তারিত ভাবে বলেন যদি।

সুস্মেলী দত্ত: আমি আগেই বলেছি, লেখার মধ্যে আমি আমার শান্তি খুঁজে পেতাম।  তবে কখনও ভাবতাম না যে,  আমার সৃষ্টি কারোর পছন্দ হলেও বা হতে পারে।  তবু মন মানে নি একদিন, কী জানি কী ভেবে, আনন্দবাজার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে ‘সাহিত্যরূপা’ নামক একটা লিটল ম্যাগ–এ কপাল ঠুকে একটা ছোট কবিতা পাঠিয়েই দিলাম। কিছুদিন পরে সম্পাদকের চিঠি পেলাম, কবিতাটি মনোনীত হয়েছে। কিছুদিন পর সেটি প্রকাশিত হলে, কী পরিমান যে আনন্দিত হয়েছিলাম তা কহতব্য নয়।  সত্যি এখন এত ছোটবড় পত্রপত্রিকায় লেখাপত্র প্রকাশিত হয়, ছাপার অক্ষরে নিজের সৃষ্টিটাকে দেখতে তখন বেশ লাগে, তবে প্রথম কবিতা ছাপার অক্ষরে দেখার স্মৃতিটুকু আজও ভুলতে পারিনি, আর ভুলব না কোনদিনও। প্রসঙ্গত মনে পড়ে গেল দেশ পত্রিকায় আমার লেখা একটি কবিতা যেদিন প্রথম প্রকাশ পেল সেদিন আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন ছিল।


সম্পাদক রংরুট: ব্যক্তিগত জীবনে আপনার বড়ো হয়ে ওঠা, লেখাপড়ার সাথে সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা কখনো কি কোন সমস্যার সৃষ্টি করেছিল? বিশেষ করে পেশাগত জীবনে প্রবেশের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার পর্যায়ে?

সুস্মেলী দত্ত: না, সেভাবে সমস্যার ঠিক সৃষ্টি করেছে বলব না তবে একটু বলতে পারি স্কুল কলেজের পাঠ্যবই ফেলে যেহেতু প্রচুর গ্রন্থরস পান করতাম, যেহেতু পরীক্ষায় ভাল নম্বর পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই হ্রাস পেত।  অবশ্য, এতে আমার বিন্দুমাত্র আফসোস ছিল না কারণ আমি মনে করতাম পড়াশুনায় ভাল বা মেধাবী হওয়াটা আমার জন্যে cup  of tea নয়, বরং সাহিত্যরসে দিবারাত্র নিমজ্জিত থাকলে আর যাই হোক, আমার দিক থেকে  আমি অন্ততঃ তৃপ্ত থাকবো, আর থাকতামও। এই ভাবনাগুলো থেকেই ছোটখাটো সমস্যাগুলোকে আর সমস্যা বলেই আর মনে হতো না, এখনোও নয়। পেশার কথা বললে, অন্ততঃ আমার ক্ষেত্রে সাহিত্য আগে নেশা তারপর পেশা।  যে কারণে, অন্য কোনো সতীনকে আমার সুখী পরিবারে ঠাঁই দিতে আমি নারাজ। তাইতে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না। তাই সাহিত্যই আমার কাছে একমাত্র বেঁচে থাকার ও টিকে থাকার অবলম্বন।  


সম্পাদক রংরুট: সাহিত্যের প্রতি আপনার এই ভালোবাসার প্রথম দিকে কোন ধরণের সাহিত্যের প্রতি আপনার অধিকতর আগ্রহ ছিল? অর্থাৎ গল্প কবিতা উপন্যাস। নাটক প্রবন্ধ ইত্যাদি। এবং এই প্রথম পর্যায়ে কোন কোন লেখকের লেখা আপনাকে বেশি করে টানতো?

সুস্মেলী দত্ত: বরাবর আমি গল্পের বই পড়তে ভালবাসি।  সেদিনের দিনগুলোও তার ব্যতিক্রম ছিল না, কার লেখা গল্প, কোথায় বেরিয়েছে না দেখে, যা সামনে পেতাম তাই পড়ে ফেলতাম অবলীলায়। অনেক পরে কবিতা, নাটক এগুলি আমাকে আগ্রহান্বিত করে তুলল।  যা ভাবা তাই কাজ।  আস্তে আস্তে এখন সাহিত্যের প্রতিটি শাখা আমাকে গ্রাস করে ফেলেছে। আর আমি প্রায় ডুবু ডুবু ডিঙির মতো ভাসতে ভাসতে সমুদ্রের অগাধ জলে কোথায় যেন ভেসে চলেছি একনাগাড়ে। প্রথম পর্যায়ে যা পেতাম তাই পড়তাম গোগ্রাসে।  সত্যি, মনেও নেই কার কার লেখা সে সময়ে পড়েছি নাকি পড়িনি। তবে যতদূর মনে পড়ছে, নবনীতা দেবসেন, সঞ্জীব চট্টেপাধ্যায়, শিবরাম চক্রবর্তী,সত্যজিৎ রায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়, লীলা মজুমদার, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, আশাপূর্ণা দেবীর লেখা আমাকে বেশ টানতো।  একটু বড় হতে শংকর, বিমল মিত্র, বিমল কর, সমরেশ বসু,সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় – আরও অনেকের লেখা খুব টানতো। 


সম্পাদক রংরুট: আপনার নিজের লেখার বিষয়ে, কোন বিশেষ লেখকের প্রভাব সম্বন্ধে আপনি কি সচেতন? যেমন, অনেকেই আমরা আমাদের খুব প্রিয় লেখকের দ্বারা মনের অজান্তেই প্রভাবিত হয়ে পড়তে পারি। আবার অত্যন্ত সচেতন ভাবে প্রিয়তম লেখকের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার প্রয়াসও করতে পারি। আপনার নিজের  লেখালেখির ক্ষেত্রে বিষয়টি ঠিক কি রকম?

সুস্মেলী দত্ত: জানিনা, আমার লেখালেখির ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি বিশেষের প্রভাব পড়েছে কিনা – তবে এটুকু অনুভব করতে পারি রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থেকে বোধহয় এখনও মুক্ত হতে পারিনি। তবে মনে আছে জীবনের কোন একটা সময় জীবনানন্দে বুঁদ ছিলাম বেশ কিছুদিন। তারপর কখনও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কখনও জয় গোস্বামী, কখনও নির্মলেন্দু গুণ, শামসুর রহমান, আল মাহমুদ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার সুবোধ সরকার, মল্লিকা সেনগুপ্ত, কৃষ্ণা বসু, ভাস্কর চক্রবর্তী, তুষার চৌধুরী, বীথি চট্টোপাধ্যায়, নমিতা চৌধুরী, শ্যামল কান্তি দাশ, সুব্রত রুদ্র, শংকর চক্রবর্তী সময়ে সময়ে আমাকে প্রভাবিত করেছে। এই সময়ে কিছু কিছু লেখা লিখে মনে হয়েছিল এইসব প্রিয় কবিদের অনুকরণ বা অনুসরণ হয়ে যাচ্ছে না তো?  তখনই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি।  আবার নতুনভাবে ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে। হয়ত কিছুটা সচেতনভাবেই, তবে আমি মনে করি ভাগ্যিস তৎক্ষণিক ভাবনায় প্রভাবিত হয়ে যায়নি, নিজেকে স্বতন্ত্র রাখার বোধটা ঈশ্বর দিয়েছিলেন, তাই বোধহয় নিজেকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নেবার কাজটা সৎভাবে করতে পেরেছিলাম। আমি মনে করি, প্রত্যেক কবি বা লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির ওপর আস্থা রেখে নিজস্ব ভাষায় কথা বলা উচিত, না হলে সৃষ্টিটাই বৃথা। এবং অবশ্যই তা সাহিত্য জগতের পক্ষেও সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়।

গদ্যের ক্ষেত্রে স্বপ্নময় চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু পালিত, প্রচেত গুপ্ত, বাণী বসু, সুচিত্রা ভট্টাচার্য নবনীতা দেবসেন – সময়ে সময়ে আমার ভাবজগতে উঁকি মারলেও – খুব কষ্ট করেই হোক, আমি এঁদের প্রভাব থেকে বেরিয়ে হয়ত আসতে সচেষ্ট হয়েছি।  তবে এক্ষেত্রেও ‘হয়ত’ কথাটা বলব, 'পাঠক' আর 'সময়' তার বিচার করবেন।

আমার লেখার বিষয় ঠিক সেভাবে কোন বিশেষ নয়।  যা মনে আসে, কলমের ডগায় যে শব্দগুলো ছটফট করে তাকেই মাপমতো কাগজে বসিয়ে দিই।  বিচার ভবিষ্যতের ওপর, সময়ের ওপর।  শুধু এটুকুই মনের সান্ত্বনা যে, এটি আমার একটি সৎ প্রয়াস, যার মাধ্যমে নিজে ভালো থাকতে পারি।  শব্দ ও ভাবনার সহবাসে যে সৃষ্টিটি গর্ভিনীর অন্তঃস্থলে বেরনোর জন্য প্রসববেদনায় ছটফট করে, তা সুষ্ঠুভাবে প্রসব করানোর দায় কিন্তু আমারই, আমি, আমিই এর একমাত্র সৃষ্টি ও পালন কত্রী। সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার উপরই বর্তায়  তবে বিষয় নির্বাচন বুঝি কোন অজানা শক্তির দ্বারা প্রভাবিত। কথায় বলে, কবিতার প্রথম লাইন আসে স্বর্গ থেকে। এটা আমি মনে প্রাণে খুব বিশ্বাস করি, তাই এক্ষেত্রে ঈশ্বর বা আমি যেই হই না কেন, তার ওপরেই এই গুরুভার ন্যস্ত করা থাকে। তবে পারিপার্শ্বিক ঘটে চলা অন্যায় আর ক্রমবর্ধমান জটিলতা আমাকে ইদানীং হয়ত কিছুটা কল্পনার জগত থেকে মাটিতে নামিয়ে এনেছে।  অনেক নতুন কিছু বিষয় ও ভাবনা মনের মধ্যে ঢেউ তুলছে – ইতিমধ্যেই তাই কিছু লেখা এ প্রসঙ্গে লিখেও ফেলেছি – ভবিষ্যতেও লিখব এই আশা রাখি। 


সম্পাদক রংরুট: লেখালেখির সাথে নিরন্তর বই পড়ার একটা গভীর সংযোগ রয়েছে। বর্তমানের গতিময় জীবনে হয়তো সবসময় সেই সম্পর্ক অটুট রাখা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তবুও এই সময়ে দাঁড়িয়ে আপনি কোন ধরণের বই পড়তে বেশি আগ্রহী। এবং কোন কোন লেখক আপনাকে এই সময়ে বেশি করে কাছে টানেন তাঁদের লেখার গুণে।

সুস্মেলী দত্ত: আমি প্রবন্ধের বই কিনি ও পড়ি।  আজকাল খুব পৌরাণিক প্রবন্ধ নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ির লেখা আমাকে টানে।  এছাড়া নবনীতা দেবসেনের কিছু প্রবন্ধের বই, নাম না জানা লিটল ম্যাগের কোন ছাপোষা প্রাবন্ধিকের বই বা লিটল ম্যাগের কোন প্রবন্ধ, আর সময় সময় সুকুমারী ভট্টাচার্য পড়ে ফেলি অনায়াসে। লীনা চাকীর বাউলদের জীবনী নিয়ে গবেষণামূলক লেখা থেকে শুরু করে শ্রী চৈতন্যদেবের জন্ম মৃত্যু রহস্য, সিদ্ধার্থ বসুর সে যুগের ক্রীতদাস প্রথা, চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পুরোনো কলকাতা নিয়ে লেখা, চিত্রা দেব কিছুই বাদ যায়না। সব গবেষণাধর্মী লেখাগুলোই আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধগুলো এখনও সময় পেলে বারবার পড়ি – পুরোনো হয় না। প্রতিবারই মনে হয় প্রথম পড়লাম আজ। আজকাল গল্পের বই বা কবিতার বইয়ের থেকে প্রবন্ধ বেশি টানলেও কবিতার টানে ডুব দিই শম্খ ঘোষ, নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী, প্রবুদ্ধসুন্দরে আর গল্পের মধ্যে সুনীল, শীর্ষেন্দু, বুদ্ধদেব সহ প্রচেত গুপ্ত, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, তিলোত্তমা মজুমদার দেবেশ রায়, আবুল বাশার, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তো আছেনই।


সম্পাদক রংরুট: আপনার নিজের লেখা কয়টি ও কি কি বই প্রকাশিত হয়েছে যদি বলেন। এবং বইগুলির বিষয়বস্তু ও সেই সম্বন্ধে আপনার ভালোলাগা তৃপ্তির দিকগুলিকে আমাদের পাঠকের সামনে একটি যদি বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেণ।

সুস্মেলী দত্ত: এ পর্যন্ত আমার লেখা এগারটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে।  এবং একটি শ্রুতিনাটকের গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন পরিবেশ, ও বিভিন্ন আঙ্গিকে লেখা কবিতা গ্রন্থগুলি যে যার স্বতন্ত্রতা বজায় রেখেছে।  প্রথম দিকের, গ্রন্থগুলি পড়লে এখন আফশোস হয়, মনে হয় ইসস কী যে লিখেছি – আবার, গতকালের লেখাও পরের দিন কিরকম যেন পানসে বলে মনে হয়। এখন মনে হয় এই সৃষ্টির বুঝি কোন শেষ নেই – এ এক নেশার মতো।  লিখেই চলেছি লিখেই চলেছি। এখনও পর্যন্ত শেষ দুটো কাব্যগ্রন্থ সিগনেট থেকে বেরিয়েছে ‘রোমিওচরিত’ ও ‘মৃত জোনাকির টিপ’দুটো বইয়ের সব কবিতাগুলি ছন্দে লেখা। নানারকম এক্সপেরিমেন্ট আছে এখানে। ভাষা, ভাব ও শব্দের পরীক্ষা নিরীক্ষাও আছে; এখানে আর আছে নতুন ভাষা গড়ার চ্যালেঞ্জ।  আমার মনে হয়, সবাই যেভাবে লিখছে আমি লিখব না – নতুন আঙ্গিকে কিছু করে দেখাবো। তাই ক্রমান্বয়ে পড়া, চর্চা ও আলোচনার মাধ্যমে নিজেকে ভাঙা গড়ার কাজে মেতেছি।  এতেই আমার তৃপ্তি।

নাটকের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা। ‘শ্রবণ সখীর কথা’২০১৯–এ বেরিয়েছে।  এরপরে আরও নাটক লিখে চলেছি, লিখেই চলেছি নিরন্তর সাধনা, সত্যি।

এর কোন শেষ নেই।  আমি মনে করি, লেখক কখনও তৃপ্ত হন না। এমনকি পাঠকও।  এ এক জার্নি বৈ তো নয়। যেদিন লেখক তৃপ্ত হবেন, সেদিন সাহিত্য জগত থমকে যাবে। পাঠকেরও দাবী থাকতে হবে সৃষ্টিকর্তার কাছে, তবেই না সৃষ্টির রকমফের ঘটবে। আমিও সেই অভিযাত্রীদের দলেই নাম লিখিয়েছি। জানিনা, গন্তব্য কোথায় – কতটুকুই বা পথ – কিন্তু যাচ্ছি। গতিই ধর্ম – গতিই জীবনের রসদ – সৃষ্টিশীলতার ভরকেন্দ্র।


সম্পাদক রংরুট: বর্তমান সময়ে একটি বই প্রকাশ করতে গিয়ে একজন লেখককে সাধারণত কি কি ধরণের সমস্যায় পড়তে হয়। আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এই বিষয়ে যদি আলোকপাত করেন।

সুস্মেলী দত্ত: প্রথম প্রথম নিজের খরচায় বই বের করতাম। প্রকাশকরা অসম্ভব দামে গোটাকতক বই দিয়ে আমাদের মুখ বন্ধ রাখতেন। তারপর নিজের বই নিজে কিনে বিশিষ্ট জনকে উপহার দেওয়া তো আছেই। এমনও হয়েছে যে আমার উপহার দেওয়া বই আমিই কিনে নিয়েছি সস্তায় পুরোনো বইয়ের দোকানে থেকে। প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষরে বই যাকে দিয়েছি তার নামটা লেখা। বুকটা রিনরিন করে উঠেছিল যন্ত্রণায়; লেখকের ওপর বেশ রাগ হয়েছিল, এখন বুঝি এটাই আমার হয়ত প্রাপ্য ছিল।  নিজেই নিজের গালে অবধারিত চপেটাঘাত।  তারপর থেকে বিনিময় মূল্য ছাড়া কাউকে বই দেবার কথা চিন্তা করি না। আর এখন প্রকাশকরা যেহেতু নিজের খরচে আমার বই বের করেন, যেহেতু দাম দিয়ে কিনে অন্যকে বিলিয়ে দেবার তো কোন প্রশ্নই নেই, উল্টে পাঠককুল যখন নিজে বই কিনে আমার কাছে যেচে সই করিয়ে নেবার আবদার করে তখন আমি আত্মতৃপ্তি অনুভব করি।

তখনকার চিত্র আর এখনকার চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা।  কিন্তু এর মাঝখানের দিনগুলো যে কী পরিমান অসহনীয় ও অপমানের ছিল তা ভাষায় বোঝানো কঠিন।  ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার খোলসগুলো আপাততঃ উন্মোচন না করাই ভালো – তবে নতুন কবি লেখকদের বলি, যা করবেন সবটাই ধীরে ও সন্তর্পনে – ভেবেচিন্তে করুন।  সৎ ও নিষ্ঠা সহকারে কাজ করলে তার ফল মিলবেই।  কোন তাড়াহুড়োয় না যাওয়াই শ্রেয়।


সম্পাদক রংরুট: আপনার নিজের লেখার বিষয়ে কখনো কি মনে হয়েছে, একটি গণ্ডীর ভিতরেই আটকিয়ে যাচ্ছে আপনার যাবতীয় লেখালেখি। সাধারণত আমাদের অধিকাংশই কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে আত্মনির্মিত নিজস্ব গন্ডীর ভিতরেই আটকিয়ে যাই। অনেকেই হয়তো খেয়াল করি না। আবার অনেকেই হয়তো সচেতন ভাবে সেই গণ্ডীর ভিতর থেকে নিজেকে মুক্ত করতে প্রয়াসী হন। আপনার লেখালেখি ও আপনার ব্যক্তিগত উপলব্ধি থেকে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত যদি করেন।

সুস্মেলী দত্ত: জানিনা, কোন গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ছি কিনা, এটা মনে হয় সময়ই বিচার করবে। তবে আমি বারবার নিজেকে ভাঙবার ও গড়বার প্রয়াসী, তাই এক্ষেত্রে বিস্তারিতভাবে হয়ত আমার কিছু বলার নেই।


সম্পাদক রংরুট: সবশেষে জানতে চাইবো, বর্তমান সমাজ সভ্যতায় দাঁড়িয়ে আজকের বাংলা সাহিত্যের বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন। এবং বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আপনি কতটা আশাবাদী ও কেন?

সুস্মেলী দত্ত: বাংলা সাহিত্যের উত্তরণ হচ্ছে না, অবনতি হচ্ছে, এ সম্পর্কে কোন মন্তব্য করা আমার মতো অর্বাচীনের শোভা পায় না। তবু নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সাহিত্যের বাঁক কিন্তু বদলাচ্ছে ধীরে নয় বেশ সচেতনভাবে, অতি দ্রুত।  কবিতার ক্ষেত্রে একটা উদাহরণ দিয়ে বলি, রবীন্দ্র পরবর্তী বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দ থেকে শুরু করে সুনীল শঙ্খ শক্তি সুভাষ ছাড়িয়ে কালচক্রের রথ এখন মন্দাক্রান্তা – বিনায়ক – শ্রীজাত – অংশুমান, ন’য়ের দশকের অন্যতম শক্তিশালী কবি অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে জুবিন, সৌরভ এরপর জানিনা কোথায় গিয়ে থামবে। অবশ্য না থামাটাই শ্রেয় –আমরাও তাকিয়ে আছি নতুন সূর্যের দিকে – নতুন বিশ্বের দিকে, নতুন সৃষ্টির দিকে। প্রতিনিয়ত ভাঙা গড়ার মধ্যে দিয়েই তো জীবন, জীবিকা, বেঁচে থাকা।

সম্প্রতি কবিতা গল্প উপন্যাসে একটা ঝড় এসেছে।  আসুক।  উড়িয়ে পুড়িয়ে দিক যত আবর্জনা। নতুন শব্দ আসুক, নতুনত্ব ছন্দের, ভাবের এক্সপেরিমেন্ট আরও আরও হোক।  গদ্যের ক্ষেত্রেও আসুক রেনেসাঁ।  আমি আশাবাদী।  উজ্জ্বল আলোর রেখা আমাকে দিক নির্দেশ করছে।  পুরোনো ও নতুনের চিরাচরিত দ্বন্দ্বকে ঝেড়ে ফেলে গড়ে উঠুক এক অনায়াস ভারসাম্য।  নিক্তিতে ওজন করলে এখন তো দেখছি অতীত আর বর্তমানের তুলনায় আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম যেন একটু ভারী বৈ হালকা নয়। এটাই আশার কারণ।


সুস্মেলী দত্ত মূলত নয়ের দশকের কবি জন্ম ১৯৬৯ সাল।  এপর্যন্ত প্রকাশিত মোট এগারটি কাব্যগ্রন্থ।  ওর সর্বপ্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নের রং নীল' প্রমা থেকে বেরিয়েছে। এপর্যন্ত সর্বশেষ প্রকাশিত কবিতার বইয়ের নাম 'মৃত জোনাকির টিপ'। প্রকাশক সিগনেট। কবিতা ছাড়াও ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, নাটক বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। একটিমাত্র শ্রুতি নাটকের গ্রন্থ 'শ্রবণসখীর কথা' ২০১৯ বইমেলায় কলাভৃৎ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে নাটক 'হনন' সম্প্রচারিত হয়েছে। 'আমাদের উচ্চারণ' 'শ্রাবণ কথারা' এই নামে দুটি নাটকের দলও আছে। 'মালিনী', 'নীল দিগন্ত' 'হৃৎপিণ্ড' তিনটি কাগজে ইনি সহ সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। ২০০৬ সালে 'অবগাহনের শেষে' কাব্যগ্রন্থের জন্য 'উৎসব' সম্মান, ২০১১–এ মেদিনীপুর থেকে কবি নিত্যানন্দ পুরস্কার, ২০১৭–এ স্রোতস্বিনী সম্মান, বিভূতিভূষণ  স্মৃতি পুরস্কার, ২০১৮–এ  সিগনেট থেকে প্রকাশিত 'রোমিওচরিত' কাব্যগ্রন্থের জন্য মেদিনীপুর থেকে নিবেদিতা স্মারক সম্মান, ডলি মিদ্যা স্মৃতি পুরস্কার, এবং সম্প্রতি বাংলা কবিতা একাদেমির তরফ থেকে 'কবিতা সিংহ পুরস্কারে' সম্মানিত।


কপিরাইট রংরুট কর্তৃক সংরক্ষিত


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন