মুখোমুখি হরিৎ
বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্পাদক রংরুট: সকলের আগে ত্রৈমাসিক রংরুটের পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক
ধন্যবাদ। রংরুটের এই বিশেষ সংখ্যায় আপনাকে স্বাগতম। আপনার
লেখালেখির পরিধি মূলত কাব্যসাহিত্য কেন্দ্রিক। এযাবৎ প্রকাশিত আপনার সব কয়টি
বইই কবিতাসংকলন। কবিতার প্রতি এই বিশেষ আগ্রহের সূত্রপাত ঠিক কিভাবে?
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথমেই
রংরুট-এর প্রতি আমার আন্তরিক ভালোবাসা। হ্যাঁ, ঠিকই
বলেছেন। আমার লেখালেখির পরিধি মূলত কাব্যসাহিত্য কেন্দ্রিক। যদিও মাঝে মাঝেই আমি
কবিতা সংক্রান্ত গদ্য এবং গল্পও লিখে থাকি। কিন্তু কবিতাই আমার পৃথিবী। খুব
ছোটবেলা থেকেই আমি নির্জনতা ভালোবাসি। হৈ হট্টগোল চিৎকার চেঁচামেচি ----- এসব আমার
জন্যে নয়। তবে এরকম ভাবার কোনো কারণ নেই যে, ছোটবেলায়
আমার কোনো বন্ধু ছিল না বা তাদের সঙ্গে আমি কথা বলতে পারতাম না। সবই আর পাঁচটা
মানুষের মতো স্বাভাবিক ছিল। শুধু একটাই তফাৎ , সবাই
ঘন্টার পর ঘন্টা খেলা চালিয়ে যেতে পারত কিন্তু আমি একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর
খেলাধুলা বন্ধুবান্ধব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরতাম। তাছাড়া আরও একটা বিষয় এসময় কাজ
করত। বেশিরভাগ জায়গাতেই আমি কোনো কথা বলতে পারতাম না, মানে
আমাকে কথা বলতে দেওয়া হতো না। আমার সেই না বলতে পারা কথাগুলো যাবে কোথায় !
সেগুলোই একদিন দেখলাম কবিতা হয়ে বেরিয়ে এলো। আর কবিতার প্রতি আগ্রহের সূত্রপাতটাও
অদ্ভুত আমার ক্ষেত্রে। ক্লাস সেভেন এইট থেকেই আমি গাছপালা নদী মাঠ ----- এদের
সঙ্গে থাকতে ভালোবাসতাম। সিলেবাসের কবিতাগুলোর মধ্যে দেখতাম ফুল ফল নদী গাছ নিয়ে
কত কিছু লেখা। বন্ধুদের গল্প কবিতার মধ্যে দিয়ে পড়তে কে না চায়। আমার ক্ষেত্রেও
তাই হল। আনন্দে নাচতে নাচতে কবিতার পৃথিবীতে গিয়ে হাজির হলাম।
সম্পাদক রংরুট: আমরা জানি
কবিতা প্রকাশের বিষয়ে আপনি খুবই যত্নশীল একজন মানুষ। নিজের সৃজনশীলতার বিষয়ে
অত্যন্ত বেশি রকমের নিষ্ঠাবান না হলে এই যত্নশীলতা অর্জিত হয় না। এই বিষয়ে আমরা জীবনানন্দ
দাশের কথা স্মরণ করতে পারি। প্রতিটি কবিতার পিছনে আপনার যে পরিশ্রম যে অধ্যাবসায় ও
যত্নশীলতা বর্তমান, তার অনুপ্রেরণার উৎস কি?
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: কবিতা
আমার কাছে একটা সাধনা। কবিতার পৃথিবীতে যখন আমি ঢুকে পড়ি তখন আর আমি পৃথিবীবাসী
কোনো মানুষ নই। আমি কে, কোথায় আমার বাস ----- এসব কিছুই
আমার মাথায় থাকে না। এটা তো কেউ ইচ্ছা করে করেন না বা বলা ভালো শুধুমাত্র চেষ্টার
সাহায্যে এমন একটা পৃথিবীতে গিয়ে পৌঁছানো যায় না। কবিতার সঙ্গে সহবাস করতে করতে
একদিন দেখবেন সমাজ সংসারের কোনো কোলাহল আপনার কানে এসে আর প্রবেশ করছে না। তখন
আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন, কবিতার গন্ধ আপনার নাকের কাছে। আর
কবিতার প্রতি আমার যে অধ্যবসায় ও যত্নশীলতা তার অনুপ্রেরণার সবচেয়ে বড় উৎস আমার
পিতা। আমার বাবা কবি ছিলেন না কিন্তু তিনি সংস্কৃত ভাষার মানুষ। প্রতিনিয়তই তিনি
অনুবাদের কাজ করতেন। তিনি তাঁর নিজস্ব জিনিসপত্রের প্রতি এতটাই যত্নশীল ছিলেন, এ
ব্যাপারে আমাকে অন্য আর কারও কাছ থেকে শিক্ষা নিতে হয় নি। এছাড়াও আমাকে আরও একজন
নিজের কাজের প্রতি যত্নশীল হতে শিখিয়েছে। সে হল আমার দুপুর। প্রতিদিন নিজেকে এত
যত্ন করে সে সকলের চোখের সামনে তুলে ধরত যে তার দিক থেকে নজর সরাতে পারতাম না।
প্রতিদিন একই কাজ তবুও তার মধ্যে কখনও কোনোদিন বিরক্তি দেখি নি।
সম্পাদক রংরুট: এই প্রসঙ্গে জানতে চাইবো কবিতার
কাঠামোগত দিকের বিষয়ে একজন কবির, নৈর্ব্যক্তিক
ও শৈল্পিক ধ্যানধারণা থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন কি আপনি? কবির
ব্যক্তিগত আবেগকে সাহিত্যের নান্দনিকতায় বিকশিত করতে যা খুবই মূল্যবান? না’কি কবিতা মূলত আবেগের বহিঃপ্রকাশ মাত্র? অনেকেই যেমনটা দাবি করেন আজকাল।
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: অবশ্যই, কবিতার
কাঠামোগত দিকের বিষয়ে একজন কবির নৈর্ব্যক্তিক ও শৈল্পিক ধ্যানধারণা থাকা
প্রয়োজন। পাশাপাশি এটাও ঠিক, কারও যদি এই ধ্যানধারণা তুখোড়
থাকে তাহলে কিন্তু তিনি কবি হয়ে যাবেন না। একজন প্রকৃত কবির এসব গুণ থাকেই। কবিরা
সবকিছু নিয়েই জন্মগ্রহণ করেন। তবে কোনো কোনো কবির ক্ষেত্রে এই ব্যাপারগুলো কমবেশি
থাকতেই পারে। সেক্ষেত্রে পড়াশোনা করে নেওয়াটা খুব জরুরী। কারণ যে রাঁধুনি
রান্নার উপকরণগুলি সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল তার পক্ষেই একমাত্র সঠিক অনুপাতে
সেগুলি মিশিয়ে একটি সুস্বাদু খাদ্য প্রস্তুত করা সম্ভব। শিল্পের ক্ষেত্রে ব্যাকরণ
একটা বিষয় হলেও কক্ষপথের বাইরে দিয়ে ঘুরেও পৃথিবীর অনেক মহান সাহিত্য সৃষ্টি
হয়েছে। তখন আবার সেটাই ব্যাকরণ হয়ে গেছে। কবি ভালোবাসার মানুষ। তাঁর কোনো
সীমান্ত নেই। তিনি সমগ্র পৃথিবীর সম্পদ। আবেগ তাঁর বড় মূলধন। কবিতা মেধার থেকে
অনেক বেশি বেশি পরিমাণে অনুভূতির ফসল। কিন্তু তবুও বলবো শুধু আবেগ দিয়ে কবিতা হয়
না। আপনি যা-ই লিখুন না কেন শেষ পর্যন্ত তাকে কবিতা হয়ে উঠতে হবে।
সম্পাদক রংরুট: আপনার
কবিসত্তার ভরকেন্দ্র শাশ্বত মানবিক সংবেদনশীলতায় না’কি নির্মোহ দার্শনিক বিশ্ববীক্ষায়? কবিগুরু বলতেন, তিনি
দার্শনিক নন। তিনি কবি। দর্শন ও সাহিত্যের ভিতর একটি দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ের পালা
চলতে থাকে। অন্তত রবীন্দ্রকাব্যের বিবর্তনের দিকে লক্ষ্য রাখলে বিষয়টি দেখা যায়।
এই বিষয়ে আপনার ব্যক্তিগত অভিমত। জানতে চাইছি বিস্তারিত আলোকপাতে।
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: হ্যাঁ, আমার
কবিসত্ত্বার ভরকেন্দ্রে আছে শাশ্বত মানবিক সংবেদনশীলতা। খুব শৈশব থেকেই আমি
মানুষকে মানুষ বলেই জেনে এসেছি। মানুষের বিভাজন আমার রক্ত বিশ্বাস করে না। মানুষ, সে
দেশেরই হোক না কেন আক্রান্ত হলে আমার গায়ে লাগে। আমার প্রিয় কবি নবারুণ
ভট্টাচার্যের ভাষায় আমি বলতে পারি, "মানুষের অপমান আমাকে রাগিয়ে
দেয়।" এখানে হয়ত অনেকের সঙ্গে আমার বক্তব্য মিলবে না -------- শুধু নিজের
দেশের মানুষ হলেই বুক কেঁদে উঠবে আর অন্য দেশের মানুষে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই
------- এটা আমি মানতে পারি না। মানুষ কষ্ট পেলেই আমার প্রাণ কাঁদে। এছাড়া আমার
কিছু আদর্শ আছে,
নিজস্ব পথও বলতে পারেন, যে পথ
দিয়ে আমি প্রতি মুহূর্তে চলাফেরা করি। এগুলোই আমার নিজস্ব দর্শন। খুব ছোটবেলা
থেকেই আমার বন্ধুর তালিকায় আছে বটগাছ, গ্রীষ্মের দুপুর, নির্জন
রেলস্টেশন,
নদীর ধার। এরা আমাকে প্রতি মুহূর্তে যেভাবে আগলে রাখে, এদের
সঙ্গ আমাকে যে পরিমাণে আনন্দ দেয়, একমাত্র পিতামাতা ছাড়া তা আর কারও
কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। জ্ঞানত আমি কখনও গাছের থেকে ফুল তুলি নি, কারণ
আমি রক্ত দিয়ে বিশ্বাস করি ফুল যেকোনো প্রাণীর দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো।
তাছাড়া ফুলসমৃদ্ধ গাছ নিজেই পৃথিবীর এক আশ্চর্য সৃষ্টি। তাকে অসুন্দর করার অধিকার
মানুষের নেই। এই শিক্ষা আমাকে কেউ দেয় নি। খুব ছোটবেলা থেকেই ধর্মভীরু মানুষজনদের
নাটক দেখতে দেখতে ঘেন্না ধরে গেছে। ঠিক এইসময়েই চেনা প্রতিদিনের জগৎ ছেড়ে
বেরিয়ে এসে নিজস্ব একটা পৃথিবী নির্মাণের চেষ্টা।
সম্পাদক রংরুট: সাহিত্যসাধনা
বা কাব্যচর্চার
প্রসঙ্গে কবি জীবনানন্দ পরিচ্ছন্ন
কালজ্ঞান ও সুস্পষ্ট ইতিহাসচেতনার উপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। সাহিত্য
সাধনার ক্ষেত্রে একজন কবির জন্য এই পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান ও
ইতিহাসচেতনা কতটা জরুরী বিষয় বলে মনে করেন আপনি? আপনার
নিজের কবিতায়
এই বিষয়গুলি কতটা প্রাসঙ্গিক ও কিভাবে দেখা দেয়?
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: জীবনানন্দের অতীতমুখীতা আসলে সময়কে
ধরারই প্রয়াস। জীবনানন্দের কবিতার ইতিহাস চেতনা রাজ - রাজাদের জীবনের উত্থান পতন
নয়, আবহমান
কালের মহাবিশ্বের সঙ্গে নিজের আত্মীক অভিজ্ঞতাকে মেলানো। এটা অবশ্য অনেক কবির
ক্ষেত্রেই সত্য। সাহিত্য সাধনার ক্ষেত্রে একজন কবির জন্য পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান ও
ইতিহাস চেতনা অবশ্যই জরুরী। একজন কবি কোন সময়ে লিখছেন সেটা তাঁকে জানতে হবে। কারণ
কবিতা সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে। জীবনানন্দের " ১৯৪৬ --- ৪৭ " কবিতা পাঠ
করে আমরা যে সময়কে বুঝতে পারি তা বলাই বাহুল্য। আমার কবিতায় ভীষণ ভাবেই আজকের সময়
উঠে আসে। অবশ্য সরাসরি ইতিহাসের কোনো বিষয় আমার কবিতায় আসে না। তবে ফেলে আসা দিনের
কথা, পিতামহ
প্রপিতামহদের প্রসঙ্গ আমার কবিতায় বারবার উঠে আসে। আমার কবিতায় দেখতে পাওয়া যায়
বটগাছকে। আসলে আমার বেঁচে থাকাটা অনেকটাই অতীতে। ঘুরতে ফিরতে বারবার তাই তাদের কথা
চলে আসে। আসলে ইতিহাস মানেই হর্ষবর্ধন অশোক, এসব নামের
মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। আমার জীবনের ইতিহাসের পাতায় আমার দাদু পিতা মাতা ------
সকলের সম্বন্ধেই পাতার পর পাতা লেখা আছে ------- আমি প্রায় সবসময়ই সেই সব
ইতিহাসের পাতায় হেঁটে চলে বেড়াই।
সম্পাদক রংরুট: মহাকবি টি এস এলিয়টের ভাষায়, “No poet, no artist of any art, has his complete
meaning alone. His significance, his appreciation is the appreciation of his
relation to the dead poets and artists.
You cannot value him alone; you must set him for contrast and comparison
among the dead.” আপনিও কি এলিয়টের মতো এই মতে বিশ্বাসী? আপনার নিজের কাব্য সাধনায় কতটা সত্য এই দর্শন? অর্থাৎ আপনার কবিতার পাঠককেও কি আপনার কবিতা অনুধাবনে এই পথেই অগ্রসর হতে পরামর্শ দেবেন
আপনি? না’কি আপনার অবস্থান কিছুটা ভিন্নমাত্রায়।
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: এলিয়টের বক্তব্যকে আমি সমর্থন করি।
বর্তমানে যখন নতুন কিছু সৃষ্টি হয় তখন তা তো পুরোপুরি নতুন কোনো ধারণা নয়। অতীতের
ভিত্তিভূমির ওপরেই সে দাঁড়িয়ে থাকে। উনি পরিস্কারভাবে বলে দিয়েছেন, " It is a
judgment, a comparison, in which two things are measured by each other." অর্থাৎ
অতীতকে দেখে বর্তমানকে measure করা হবে আবার ঠিক একইভাবে
বর্তমানকে দেখেও অতীতকে measure করা হবে। কিন্তু যখনই দেখা যাবে
বর্তমানের একটা একেবারে নতুন উপাদান অতীতে exist করত না
তখন অতীতের standard
নিজেদেরকে remodify করে, readjust করে
বর্তমানের ওই নতুন উপাদানটাকে জায়গা করে দিচ্ছে। একজন কবি বা শিল্পী কখনও নিজেকে
নতুন বলে দাবি করতে পারেন না। উনি বলেছেন you cannot value
him alone আর তাই বর্তমানে শিল্পের যেকোনো বিভাগের কাজ সবসময় অতীতের
বিখ্যাত কাজগুলোকে সামনে রেখে বিচার করব।অতীতকে দেখে বর্তমানকে আরও ভালো করে বুঝতে
শিখব। কোনটা ভালো কোনটা মন্দ এমন ভাবনাকে এক্ষেত্রে কখনও প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।
" The
difference between the present and the past is that the conscious present is an
awareness of the past in a way and to an extent which the past’s awareness of
itself cannot show " --------- অতীতের work of art কে
সামনে রেখে যদি আমরা বর্তমান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হই তাহলে আমরা অতীতের standard কে
remodify
করতে পারব। অতীত নিজেকে যতটা জানত আমরা বর্তমানে দাঁড়িয়ে
তার থেকে অনেক বেশি কিছু জানতে পারছি, যার ফলে আমরা একটা সুবিধাজনক
অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছি। তাই আমাদের এটা দায়িত্ব যে আমরা যখন কোনো বর্তমানের work of art কে
নতুন বলে দাবি করব এবং অতীতের standard কে remodify করব তখন
যেন আমরা মৃত কোনো সমালোচকের অন্ধ বক্তব্যের দ্বারা প্রভাবিত না হই। একজন শিল্পী
বা কবি এসে নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে নতুন বলে দাবি করতে পারেন না। সবসময় একটার
প্রেক্ষিতে আর একটাকে judge করতে হবে। অতীতের existing order সবসময়
মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকবে না, নিজে সবসময় flexible হবে।
তাছাড়া কোনো কবি যখন তাঁর কাজকে নতুন বলে দাবি করছেন তখনও তাকে অতীতের
প্রেক্ষিতেই বিচার করতে হবে।
সম্পাদক রংরুট: ইংল্যাণ্ডজাত
মার্কিন কবি ডবল্যু এইচ অডেন গভীর ভাবে বিশ্বাস করতেন, একজন
কবি সবিকিছুর আগে সেই ব্যক্তি যিনি তাঁর ভাষার প্রেমে পড়ে গিয়েছেন। আমাদের এত
ভালোবাসার এত দুর্দশা পীড়িত তবুও সংগ্রামী বাংলা ভাষার একজন কবি হিসাবে এই বিষয়ে
আপনার অবস্থান সম্বন্ধে যদি আলোকপাত করেন স্পষ্ট ভাবে। কবিতা কি সত্যই এমন নিবিড়
ভাবে বিশেষ কোন ভাষা নির্ভর হতে পারে? না’কি
অডেনের এই মতকে আমরা কবিতার নিজস্ব ভাষা বলে ধরে নেবো। যেমন চিত্রশিল্পের ভাষা, চলচিত্রের ভাষা ইত্যাদি।
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: অডেনের এই বক্তব্যকে আমি দু'দিক
থেকেই সত্য বলে মানি। কবির এই বক্তব্যের মধ্যে অবশ্যই কবিতার ভাষা নিহিত ছিল বলে
আমি মনে করি। কারণ কবিতার ভাষার মধ্যে এমনই এক জাদু আছে যে একবার যদি কেউ তার
প্রেমে পড়ে তাহলে তার কাছ থেকে হারিয়ে যাবে সমগ্র জগৎ। কবিতাই তখন তার কাছে
একমাত্র সত্য বলে মনে হবে। চব্বিশ ঘণ্টা তাঁর চারপাশ কবিতাময় হয়ে থাকবে। আমৃত্যু
তিনি এই পৃথিবীর মধ্যেই বিরাজ করবেন। এর পাশাপাশি কবি তাঁর নিজের মাতৃভাষার প্রেমে
পড়ার কথাও বলেছেন। কারণ তাঁর কাছে মাতৃভাষার পথটা যদি না থাকতো তাহলে তিনি কোথাও
গিয়ে পৌঁছতে পারতেন না। এই বাংলা ভাষারই এক কবি শামসুর রাহমানের কবিতায় ঠিক এই
ভাবনারই উল্লেখ আছে -------- "আজন্ম আমার সাথী তুমি, / আমাকে
স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে গড়ে পলে পলে, / তাইতো ত্রিলোক আজ সুনন্দ জাহাজ হয়ে
ভেড়ে আমারই বন্দরে।" কিন্তু এটাও সত্যি কবিতা নিবিড়ভাবে কোনো বিশেষ ভাষা
নির্ভর হতে পারে না। তাছাড়া কবি অনেক বেশি উদার। তাঁর কাছে ভাষা প্রেমটাই বড়।
একজন কবির কাছে নিজের মায়ের মতোই অন্য মায়েরাও সমান শ্রদ্ধার।
সম্পাদক রংরুট: ভাষার
প্রসঙ্গই যখন উঠলো, তখন বিশেষ করে জানতে ইচ্ছা করছে
আমাদের এই বাংলাভাষা আপনার ব্যক্তিগত জীবনসত্যের সাথে ঠিক কিভাবে জড়িয়ে আছে? না, শুধু
মাত্র কবিতা লেখা বা সাহিত্যসাধানার একটি মাধ্যম হিসাবে নয়। একজন অনুভুতিশীল সচেতন
বাঙালি হিসাবে।
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: "মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের মতো
" ------ এটা আমার কাছে শুধু কথার কথা নয়। এটা আমি আমার রক্ত দিয়ে বিশ্বাস
করি। আমার মা যদি আমাকে পৃথিবীর আলো না দেখাতেন তাহলে এই পৃথিবী আমার কাছে অধরাই
থেকে যেত। যে দেশের কবিতাই আমি পড়ি না কেন আর সেই দেশের ভাষার নাম যাই হোক না কেন, সেই দেশের কবিতা পড়ার পর তার মানেটা কিন্তু আমি বাংলাতেই
বুঝি অর্থাৎ কবিতাটি আপনা আপনি বাংলা ভাষায় অনুবাদ হয়ে তবেই আমার হৃদয়ে প্রবেশ
করে। আমি যদি কবিতা লেখা বা সাহিত্য সাধনা থেকে দূরে থাকতাম তাহলেও বাংলা ভাষার
প্রতি আমার ভালোবাসা সামান্যমাত্রও কম হতো না। কারণ অন্তরের জ্বালা যন্ত্রণা আনন্দ
বেদনা আমি আমার মাতৃভাষায় প্রকাশ করে যে তৃপ্তি পাই সেই তৃপ্তি আমাকে অন্য কোনো
ভাষা কোনোদিন দিতে পারবে না। তাই মাতৃভাষা আমার আর একটি মা।
সম্পাদক রংরুট: সাহিত্য
দর্শন বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিবর্তনের পথে আমরা যে অনেক দূর এগিয়ে এসেছি, সে
কথা হয়তো বলাই যায়। কিন্তু সমাজ সংসার বিবর্তনের পথে বিগত দুই হাজার বছরের
হিসাবটুকুই যদি ধরি খৃষ্টাব্দের সূত্রে- তাহলে সত্যই কতটুকু এগোলো মানুষের সমাজ
সংসার সভ্যতা?
আপনার মূল্যায়ন।
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: সত্যি কথা বলতে কি আমি এই ব্যাপারে
খুব হতাশ। হ্যাঁ, আমরা অনেক কিছুতেই এগিয়েছি। পত্রপত্রিকার পাতা ওল্টালে সেই
সব উন্নতির ক্রমবর্ধমান রেখা আমাদের সবসময়ই চোখে পড়ে। কিন্তু আমরা মাথায় বাড়ছি।
মেধা দিয়েই তো আজকাল মানুষের বিচার হয়। অনুভূতি তো এখন মিউজিয়ামের ঠাণ্ডা ঘরে
বন্দি। অনেক সভাতেই আমি একথা বারবার বলেছি যে, মেধা অনেক
হয়েছে। আর আমাদের মেধা চাই না। এবার আমরা যেন মনে মানুষ হই। এখনও আমার ভারতবর্ষে
জাতপাত ধর্মের ভয়ঙ্কর বাড়বাড়ন্ত, মন্দিরের দুয়ারে গোরুর হাড় পড়লে
হিন্দু মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা লাগে, কন্যা সন্তান প্রসব করলে মাকে
হত্যা করা হয়,
দেবতার নামে আরও যা যা হয় তাতে আমরা যে মধ্যযুগে আছি এটা
বলতে আমার জিভ একটুও কাঁপবে না।
সম্পাদক রংরুট: সবশেষে
এসে জানতে চাইবো আপনার ব্যক্তিগত সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি সমসাময়িক কার কার
কবিতাচর্চা আপনাকে বিশেষ ভাবে উদ্বুদ্ধ করে, যেখান
থেকে বাঙলা কাব্যসাহিত্যের অদূর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আপনি প্রবল ভাবে আশাবাদী ভুমিতে
অবস্থান করতে পারেন।
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: সবার
আগে একটা কথা বলে দেওয়া ভালো, আমি কোনো গোষ্ঠীতে নেই। আমার কোনো
গুরু নেই। এই পৃথিবীতে কাউকে আমি আমার শত্রু বলে মনে করি না। তবে কেউ যদি আমাকে
তার শত্রু বলে মনে করে সে দায়িত্ব আমার নয়। নদীর ধারে, গাছের
নিচে, নির্জন
রেলস্টেশনে কবিতা বুকে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আমি যে আনন্দ পাই সেই আনন্দ আমাকে
কেউ কোনোদিন দিতে পারবে না। সমস্ত কোলাহলের বাইরে আমার অবস্থান। তাই কবিতা পড়ার
ক্ষেত্রে আমার কোনো বাছবিচার নেই। ভালো লাগা মন্দ লাগা অনেক পরের ব্যাপার, সব
কবিতাই আমি হাতে তুলে নিই। নিজের কবিতা লেখার পাশাপাশি সমসাময়িক অনেক কবির কবিতাই
আমি পড়ি। ব্যক্তিগতভাবে আমি কারও নাম করতে চাই না। তবে বর্তমানে যে ধরনের কবিতা
লেখা হচ্ছে তাতে আমি খুবই আশাবাদী। বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: জন্ম ২
জানুয়ারি ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলী জেলার ধনিয়াখালি গ্রামে।
লেখালিখির শুরু খুব ছোটবেলা থেকেই। পেশায় গৃহশিক্ষক হলেও সাহিত্যই চব্বিশ ঘণ্টার
ধ্যানজ্ঞান। প্রকাশিত গ্রন্থ -- তুমি অনন্তজলধি
(কবিতা) বিমূর্ততার অনন্ত প্রবাহে (কবিতা সংক্রান্ত গদ্য) দু এক পশলা মান্না
(ছড়া) চার ছক্কায় শচিন (ছড়া)
সম্পাদিত পত্রিকা :
ছায়াবৃত্ত কাটুম কুটুম
কপিরাইট রংরুট
কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন