মুখোমুখি হাসিদা মুন



মুখোমুখি হাসিদা মুন


সম্পাদক: সকলের আগে ত্রৈমাসিক রংরুটের পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। রংরুটের এই বিশেষ সংখ্যায় আপনাকে স্বাগতম। প্রথমেই যে বিষয়টি জানতে চাইবো সেটি হলো, কবিতাই বা কেন? অর্থাৎ কবিতা ছাড়া আরও তো অনেক বিষয় রয়েছে সাহিত্যের। সেখানে কবিতা নিয়ে আপনার আগ্রহের উৎস কি? এবং মোটামুটি ভাবে জীবনের কোন পর্যায় থেকে এই আগ্রহের সূত্রপাত। এবং এই বিষয়ে বিশেষ কারুর প্রভাব যদি থেকে থাকে আপনার জীবনে।

হাসিদা মুন: রংরুটের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এবং এই মাধ্যমের পাঠক্কুলের প্রতি  আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।  কবিতা লেখার সুত্রপাত  কবিতা’ই করে দিয়েছিল শৈশব থেকেই।  কবিতা ছাড়াও অল্প স্বল্প   আরো কিছু প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস লেখার  চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।   কবিতা হচ্ছে   ছোট্ট পরিসরে বড়  কল্পচিত্রকে  চোখের সামনে মেলে ধরা যায়  সহজেই  এ কারণেই আগ্রহ বাড়ে। তেমন কারো  প্রভাব নেই।



সম্পাদক: এবারে আসি আপনার নিজের লেখার বিষয়ে, কোন বিশেষ লেখকের প্রভাব সম্বন্ধে আপনি কি সচেতন? যেমন, অনেকেই আমরা আমাদের খুব প্রিয় লেখকের দ্বারা মনের অজান্তেই প্রভাবিত হয়ে পড়তে পারি। আবার অত্যন্ত সচেতন ভাবে প্রিয়তম লেখকের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার প্রয়াসও করতে পারি। আপনার নিজের  লেখালেখির ক্ষেত্রে বিষয়টি ঠিক কি রকম?

হাসিদা মুন: আমার লেখা হোক সে তেমন না ভালো, তবুও আমাকেই উপস্থাপন করুক, এটাই আমার নিয়ত। আমার স্বভাব, পছন্দ, বক্তব্য  সেতো আমাকেই  টেনে নিয়ে চলে হাত ধরে, না আর কারো হাত সে ধরবেনা– এমন আমার  ক্ষেত্র  যা দেখে আমারই নেত্র


সম্পাদক: কবিত লেখার বিষয়ে, আপনি কি আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশেই বিশ্বাসী, নাকি মহাকবি টি এস এলিয়টের সেই বিখ্যাত উক্তির মতো আপনিও বিশ্বাস করেন, “Poetry is not a turning loose of emotion, but an escape from emotion; it is not the expression of personality, but an escape from personality. But, of course, only those who have personality and emotions know what it means to want to escape from these things.”  এলিয়ট কথিত এই যে ব্যক্তিগত আবেগ ও আপন ব্যক্তিত্বের বদ্ধ আবহাওয়া থেকে মুক্তির আনন্দই কবিতা, আপনার কবিজীবনের পর্বে এরকম অভিজ্ঞতা ঘটেছে কি কখনো?

হাসিদা মুন: তেমন সাড়া জাগানিয়া আবেগে  কিছু এখনো লিখে উঠতে পারিনি – তবে আমার ভিতরে যা উতলে উঠবে আমার লেখাতেও  তাই ই দেখাবে, বদ্ধ আবহাওয়ার  ধার ধারিনি কোনদিন, তবে হ্যাঁ সমাজ সংসারের ঘেরটোপ আছে, থাকবেও - এসব মেনে নিয়েই নিজ পায়ে, সবার  নিজ গন্তব্যে যাওয়া চাই 


সম্পাদক: এলিয়টের প্রসঙ্গই যখন উঠল, উনি কিন্তু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, “Honest criticism and sensitive appreciation is directed not upon the poet but upon the poetry.”  আপনার কবিতা লেখালেখির জীবনপর্বের অভিজ্ঞতায় আপনিও কি এলিয়টের সাথে একমত। কবি নয়, কবিতাই হোক আলোচনা সমালোচনার বিষয়বস্তু। যদিও আমাদের সাহিত্য সমাজে কবিতা ছেড়ে কবিকেই সমালোচনার বিষয় করে তোলার ঐতিহ্য অনেক সুপ্রাচীন। একজন সংবেদনশীল কবি হিসাবে আপনার প্রতিক্রিয়া।

হাসিদা মুন: কবি নয় – কবিতাই হোক আলোচনার বিষয়বস্তু, আমিও একমত। কবি কল্পচিত্রকে কতটা ফুটিয়ে তুলছেন, কতটা হৃদয়গ্রাহী  সেইটাই বিষয়। হোক সে যুদ্ধক্ষেত্র হোক সে প্রণয় কিংবা  দ্রোহের  বাস্পকথা   ব্যক্তিগত আচরণের প্রেক্ষিতে  খোঁচাখুঁচি  করা উচিত  নয়।  কবি কখোনো ঘর পালায় নি, তাই বলে যদি সেই কাহন মনে  সাড়া জাগায়- পংতি গাঁথে, তাঁকে কি তা ই  ধরে নিতে হবে?  পুরুষ কবি যদি লিখেন প্রসব যন্ত্রণা, তাহলে  তাকে কি  সেইমতো সমালোচনা করা যাবে? আমি মদ খেয়ে মাতাল হইনি – তাহলেও কি হিচকি নিয়ে লেখা নিষেধ? নিশ্চয়ই নয় ... 


সম্পাদক: আমাদের সমাজসংসারে নারীর অবস্থান আপনাকে কতটা ও কিভাবে বিচলিত করে? আপনার নিজের সাহিত্যচর্চার ভিতরে এর কোন প্রচ্ছন্ন প্রভাব বিদ্যমান কি?

হাসিদা মুন: হাসিদা মুন: বিচলিত করে বৈকি? তবে  তেমন প্রথা বা পন্থা আমি মানিনা, কাজেই  লিখে ফেলি  অনেক  কথাই, আরো হয়ত লিখে যাবো মন যদি  চায় ...


সম্পাদক: আপনার কবিতায় সমাজ ভাবনার একটি প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে। বস্তুত সমাজসচেতনতার আলো একজন কবির সাহিত্যচর্চার অন্যতম আয়ুধ। কবিতার ভিতর দিয়ে আপনি আমাদের সামাজিক অবস্থানের এই যে একটা চলমান ধারাভাষ্য দেওয়ার প্রয়াসী, এটি কি বিশেষ কোন মতবাদ সঞ্জাত? না’কি আপনার সংবেদনশীল কবি মননেরই একস্টেনশন। এখানে প্রাসঙ্গিক ভাবে আরও একটি প্রশ্ন উঁকি দেয়, কবি মননের সাথে বিশেষ বিশেষ মতবাদের, তা রাজনৈতিক হোক বা আধ্যাত্মিকই হোক, কোন আপাত বিরোধ থাকা কি সম্ভব? আপনার নিজস্ব অভিমত।

হাসিদা মুন: বিশেষ মতবাদ  অভিজ্ঞতার অর্গল যদিও খুলে দেয়। সেই অর্গল দিয়ে আলো আসে সমাজ, সংসার সেই সাথে প্রজ্ঞার। মানুষের মন প্রকৃতির মতো  বাঁধনহারা ছন্নছাড়া। তবে আধ্যাত্মিক দিক আমায় টানে, বসি ধ্যানে,  হায়ার ফেলফ’ খুঁজি  নিবিড়ে, উন্মনা করে, তবে  মতবাদের  বাঁধার জালে সেকি জড়ায়?  মতবাদের ধারাই হচ্ছে  আরেক মতবাদ খণ্ডানোর  তুমুল  আক্রমণ। ওদিকে আমি নেই, আমি বাংলার তথা প্রথিবীর জল কাদাকে ভালোবাসি। পাখীর ছানা আহত হলেও আমার হৃদয় কাঁদে। গাছের বাঁকল দাবানলে  পুড়লে জ্বলে যায়  যেন  আমার ত্বকও। কবি মন হবে আয়নার মতোন, সব কিছুর প্রতিচ্ছবি হয়ত পড়বে তবে সেই সঞ্চয়  ‘পারার’  আদবে মননে থেকে যাবে পেছনের দিকটায়। কুক্ষিগত ধারণায় ধারিয়ে নিলে   সত্ত্বা একই বলয়ে ঘুরতে থাকবে অনবরত।  মন হতে হবে অনন্ত – সেখানে  কি গ্রীষ্ম কি বসন্ত ......


সম্পাদক: আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায়, সাহিত্যের অবস্থান কতটা জোরালো বলে আপানার মনে হয়।? আজকের সাহিত্য এই সময়ের জীবন ও জীবন সংগ্রামে সংবেদী আলো দিতে পারছে কি আদৌ? না’কি এযুগের মানুষকে সেই আলোর খোঁজে ক্রমাগত ফিরে তাকাতে হচ্ছে শাশ্বত সাহিত্যের অভিমুখেই?

হাসিদা মুন: বর্তমান সমাজ  লাভজনক - পুঁজি ভিত্তিক সমাজ মুখী। এখন গানের সুরের চেয়ে  বিজ্ঞাপনের  জিংগেল মন মাতায় বেশি।  সাহিত্যের  সংগ্রামে যে কেউ লিখছেনা তা নয়, তবে লেখার আগেই ভাবছে, ‘পাব্লিক খাবে তো?‘  জ্ঞনের খোরাক কখনো পূর্ণ হয়না। তেমন কিছু খুঁজে না পেলে মৌলিক সাহিত্য  খুঁজবেই জ্ঞান আহারী।  সাহিত্যের আলোকেই  সভ্যতার আগমন ঘটে, চলা - বলা, কলাও  শিখে নেয় গ্রাম বা মফঃস্বল  হতে আসা  আগন্তক  যখন  শিক্ষিত সমাজে প্রবেশ করে। সেতো সাহিত্যের হাত ধরে, তা থেকে  আচরণ, জীবন ধারণ শিখে নেয়।  মেকি কিছু পেলে সে সাগ্রহে মেনে নেয় কি করে ?আর  শিক্ষণে থাকবে  বিরাট  শতাংশে  ‘ইরর’ ......


সম্পাদক: কবিতায় অনেকেই দিন বদলের স্বপ্ন দেখেন। এবং দেখান। বিশ্ব কবিতার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে সেটি অনুভব করা যায়। এই সময়ের একজন কবি হিসাবে এই দিন বদলের স্বপ্ন দেখা ও দেখানোর বিষয়টি কিভাবে ধরা দেয় আপনার অন্তরে?

হাসিদা মুন: অবশ্যই দিন বদলায়, ৮০ কিংবা একশ বছর আগে গ্রামে গঞ্জে যেখানে সেখানে মানুষ কবর দিয়ে রাখতো। রাতে দিনে  কুকুর - শেয়ালের  আখড়া ছিলো সেসব স্থান।  কবি  জসীমউদ্দীন  যখন  দাদীর প্রেমমাখা উপস্থিতি  বুঝালেন  সফট ইমোশন মিললো  কবরের সাথে, যে তাঁর এটা তিরিশ বছরের আরাধনা। এরপর থেকেই গ্রামে নির্দিস্ট জায়গায় গোরস্থান বানানো হয়েছে অনেক স্থানে। বিদ্রোহী কবির চল্ চল চল্ ‘কবিতা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের  পায়ে  জোর জুগিয়ে  যুদ্ধকে বেগবান করে তুলেছে। তেমন করে মাইকেল মধুসূদন চিনিয়েছেন, নিজ মাতৃভাষা।  আমাদের তেমন চর্চার  দরকার  বিশুদ্ধ অন্তরে  দিকদর্শন  তৈরী করার ...


সম্পাদক: আপনার নিজের লেখার বিষয়ে কখনো কি মনে হয়েছে, একটি গণ্ডীর ভিতরেই আটকিয়ে যাচ্ছে আপনার যাবতীয় লেখালেখি। সাধারণত আমাদের অধিকাংশই কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে আত্মনির্মিত নিজস্ব গন্ডীর ভিতরেই আটকিয়ে যাই। অনেকেই হয়তো খেয়াল করি না। আবার অনেকেই হয়তো সচেতন ভাবে সেই গণ্ডীর ভিতর থেকে নিজেকে মুক্ত করতে প্রয়াসী হন। আপনার লেখালেখি ও আপনার ব্যক্তিগত উপলব্ধি থেকে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত যদি করেন।

হাসিদা মুন: খনকার অনেক কবিই সত্য তুলে ধরতে ভয় পায়  হেনস্থা হবার। যা সত্য তাকে ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে চায়। এখানে কিছুটা গন্ডী  দেখা যায়,  মন খুলে লিখতে গেলে  চাপের মুখে থাকে। তবে যারা এর বিপক্ষে সোচ্চার, তাদের ভাবা উচিত কেউ যদি কোন বিষয়, বক্তব্য তুলে ধরে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সেই বিষয়ে খতিয়ে দেখে শোধরানোর রাস্তা হয়ত  পাওয়া যেতে পারে চট জলদি। এমন লেখা কিন্তু কোন প্রতিষ্ঠানকে, কোন চরিত্রকে হনন করা নয়, বরং উল্লেখ করে চোখের নাগালে ‘কালো দাগ’ দেখিয়ে দেবার মতোই। দুর্ভাগ্য,  প্রশাসন  তা কি বুঝতে পারে? উৎপাত করে উল্টো -  কাঁহাতক নাবালোক ... 


সম্পাদক: সবশেষে এসে জানতে চাইবো আপনার ব্যক্তিগত সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি সমসাময়িক কার কার কবিতাচর্চা আপনাকে বিশেষ ভাবে উদ্বুদ্ধ করে, যেখান থেকে বাঙলা কাব্যসাহিত্যের অদূর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আপনি প্রবল ভাবে আশাবাদী ভুমিতে অবস্থান করতে পারেন।


হাসিদা মুন: সমসাময়িক কিংবা পুরোনো লেখা সবই আমার কাছে  শ্রদ্ধার্হ। লিখে গেছেন যারা মাথায় থাকুন, লিখছেন যারা  সামনে চলুন, সত্য বলুন  সুন্দরের হাতে হাত রেখে  সোচ্চারে বলুন ... এখানে  কারো নাম বলে আর কারো নামকে  শ্রেণীকরণ করতে চাইনে – আমরি  বাংলা ভাষা, মেটেনা মনের  আশা .........

হাসিদা মুন:  ঢাকা- বাংলাদেশ হাসিদা মুন, ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ থানার অধীনে দীঘারপাড়া গ্রাম নিবাসী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জনাব হাবিবুর রহমান ও জোবেদা খাতুনের কন্যা এবং বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জনাব শহিদুল হক টুটু'র স্ত্রী। যশোরে জন্ম হলেও তিনি তাঁর স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি জীবন ঢাকাতেই কাটান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে এম এস সি ডিগ্রী অর্জন করেন। স্কুল জীবন থেকেই তাঁর লেখার হাতেখড়ি। বিভিন্ন দৈনিকের ছোটদের পাতা, স্কুল বার্ষিকী, দেয়াল পত্রিকা এবং বিভিন্ন ম্যাগাজিনে লিখতে লিখতে তিনি কবি হয়ে ওঠেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই পুত্র ও এক কন্যার জননী এবং ঢাকা'য় বসবাসরত। তার প্রকাশিত গ্রন্থসমুহ:-* দুয়ারের আগল ভাঙা*আকাশ ও মৃত্তিকার মাঝখানে* মিহি আঁধারে মেঘের প্রহর* সাবেক স্বপ্নের তোরণ* জোছনায় ঝরে পড়ে ফসলী চাঁদ* পৃষ্ঠা উল্টাও* পান্থ ও মায়াবীর জগত দর্শন*হাসিদা মুনের বাছাই কবিতা * ছড়িয়ে দিলাম ছড়া* ভূতুড়ে সময়* মিথিলা ও প্রাচীন ভূতের গল্প


কপিরাইট রংরুট কর্তৃক সংরক্ষিত


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন