মুখোমুখি ভাস্কর পাল
সম্পাদক রংরুট: সকলের আগে ত্রৈমাসিক রংরুটের পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক
ধন্যবাদ। রংরুটের এই বিশেষ সংখ্যায় আপনাকে স্বাগতম। আপনার লেখালেখির পরিধি
মূলত কাব্যসাহিত্য কেন্দ্রিক। কবিতার প্রতি এই বিশেষ আগ্রহের সূত্রপাত ঠিক কিভাবে?
ভাস্কর পাল: আমি আন্তরিক ভাবে কৃতজ্ঞ রংরুট
একটি ভিন্ন স্বাদের ত্রৈমাসিক এর সাথে যুক্ত প্রতিটি মানুষের কাছে আমার ভাবনা আমার
চেতনা চিন্তন সকল মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য। এটা ঠিক
লেখালেখি শুরু করার পর থেকে আমার চিন্তা ভাবনা
কেন্দ্রীভূত ছিল মূলত কাব্য সাহিত্য কেন্দ্রিক।ইদানিং ভাবনার পরিসরকে একটু
বৃদ্ধি করে গবেষণা মূলক প্রবন্ধ নিয়ে কাজ করছি। লেখালেখির
প্রতি আগ্রহ আমার স্কুল জীবন থেকেই। আমি বিজ্ঞানের স্নাতক অথচ শব্দ ও শব্দ শৃঙ্খল
নিয়ে নির্মাণ বিনির্মাণের দুর্নিবার আকর্ষণ আমাকে টেনে এনেছে লেখায়। আমার মনে
হয়েছে শব্দই পারে সঠিক ভাবে সঙ্গবদ্ধ হয়ে তীব্র প্রতিবাদ মুখর হতে। বর্তমান সময়ে
যখন শিরদাঁড়া ক্রম বিলুপ্ত হতে চলেছে সেই সময় কবিতার হাত ধরেই শক্ত হোক শিরদাঁড়া, মানুষ
হয়ে উঠুক মানুষ। শব্দ অবয়ব গঠন করতে গিয়ে অনুভব করেছি অন্তর জুড়ে থাকা
প্রেমের অনুভবকে লুকিয়ে রাখার কোনও উপায় নেই। শব্দই পারে দেহ মন এর সঙ্গে প্রেমের
অনুভূতির মিশেল একাত্মিভুত করতে এক্ষেত্রে
ভালোবাসা যেন মৃতসঞ্জীবনী, চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে পারে।
সম্পাদক রংরুট: আমরা জানি
কবিতা প্রকাশের বিষয়ে আপনি খুবই যত্নশীল একজন মানুষ। নিজের সৃজনশীলতার বিষয়ে অত্যন্ত
বেশি রকমের নিষ্ঠাবান না হলে এই যত্নশীলতা অর্জিত হয় না। এই বিষয়ে আমরা জীবনানন্দ দাশের
কথা স্মরণ করতে পারি। প্রতিটি কবিতার পিছনে আপনার যে পরিশ্রম যে অধ্যাবসায় ও যত্নশীলতা
বর্তমান, তার অনুপ্রেরণার উৎস কি?
ভাস্কর পাল: সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হল কবিতা।
পৃথিবীর সব দেশে সব ভাষাতেই কবিতা লেখা হয়। এক কথায় কবিতার কোনো সংজ্ঞা দেওয়া যায়
না বা কয়েকটি বাক্যে কবিতার সব বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করা যায়না। সাধারণ
ভাবে কবিতা হল কবির উপলব্ধিজাত এক বিশেষ শিল্পভাবনা এক ধরনের সৃষ্টি যা কবির মনে
বা জগতে ভাবের মধ্যে ছিল,বস্তু হিসেবে ছিল না, কবি
তাকেই রচনা প্রতিভার গুণে কবিতা হিসেবে নতুন রূপ দেন। কবিতা হল কবির
সৌন্দর্য্যভাবনার বহিঃপ্রকাশ বা কবির বাস্তবতাবোধের উন্মোচন ঘটায়। পাশাপাশি কবিতা
হল কবি মনে স্থিত ভাব ও ভা্লোবাসার জাগরণ। কবিতা এক ধরনের সদর্থক জীবনভাবনা – যা
মানুষকে সতত প্রেরণা দেয় মানুষকে ভালবাসতে শেখায়, প্রতিবাদী
হতে সাহায্য করে, মানুষকে নির্মল আনন্দ দান করে।কবিতা কবির শিক্ষা, সংস্কৃতি, চেতনার
পরিচয় প্রদান করে। কবিতা বা লেখা মূলত শব্দ ও উপলব্ধির অন্বেষণ। একজন লেখক বা কবির
জন্য এই পথচলাটা দীর্ঘ এবং অসমাপ্ত। অনেক কবিতা আমি লিখেছি কিন্তু আজ অবধি একটা
সত্যিকারের লেখা,লিখতে পারলাম না।তাই ভেতরের অতৃপ্তি নিয়েই চলেছি। একটি ভালো
কবিতা লেখার প্রবল আকুতি। এই অতৃপ্তি না থাকলে হয়তো আমি পথের মাঝখানে থেমে যেতাম।
কবিতা নিয়ে আমার একান্ত উপলব্ধি হলো, কবিকে কবিতার পথ থেকে সরানো যায় না। অনুপ্রেরনা এই শব্দটিতে আমার প্রবল আপত্তি।আমার পিতামহ
লেখালেখি করতেন। সেই সময়ে উনার বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল।হয়তো লেখার
সেই বীজ আছে। আবার মনে হয় সমকালের চোখ দিয়ে দেখে কিছু প্রতিবাদ,সামাজিক
অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, অব্যক্ত ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যম
হিসাবে আমায় প্রতি মুহূর্তে শক্তি সঞ্চারিত করে চলেছে।
সম্পাদক রংরুট: এই প্রসঙ্গে জানতে চাইবো কবিতার
কাঠামোগত দিকের বিষয়ে একজন কবির, নৈর্ব্যক্তিক ও শৈল্পিক ধ্যানধারণা থাকা প্রয়োজন বলে
মনে করেন কি আপনি? কবির ব্যক্তিগত আবেগকে সাহিত্যের নান্দনিকতায় বিকশিত করতে যা খুবই
মূল্যবান? না’কি কবিতা মূলত আবেগের বহিঃপ্রকাশ মাত্র? অনেকেই যেমনটা দাবি করেন আজকাল।
ভাস্কর পাল: কাব্য সাহিত্য সাধনার একজন অত্যন্ত তুচ্ছ সাধক
হিসেবে আমার অনুভব থেকে বলতে পারি: কাব্য -কবিতা, সংগীত
এগুলি মানবমনের অতিচেতন জগতের চিন্তন এর বহিঃপ্রকাশ। এগুলো শিল্প-সংস্কৃতিও বটে।
দেশ-কাল-পাত্রে ভাষায় যাই হোক না কেন এসবই ব্যক্তি উৎস। সেগুলি যখন মানুষ প্রাণী
বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে লেখা হয়ে পড়ে তখন সেগুলো নৈর্ব্যক্তিক
হয়। পাঠক সমাজ এগুলি পড়ে, উদ্বেল হয়,প্রেরণা
পায়। সৃষ্টির জগতে কেউ কারো সাথে তুলনার নয়। আলোচ্য ব্যক্তিত্বদের ক্ষেত্রে এই
কথাগুলি প্রযোজ্য। হাজার হাজার বছর ধরে পথ হাঁটছে কাব্য-কবিতা লিপি, এদের
পথ কেবলি অগ্রগমনের। ব্যক্তি, কে, কোন কবি
সাহিত্যিকের কোন মন্তব্য বা উক্তি কখনো কখনো কাল প্রবাহের পাতায় পড়ে থাকে কখনো
কখনো সামনে চলে আসে। এসব আলোচনার কোনো শেষ নেই, সিদ্ধান্ত
টানবার কোন জায়গা নেই। তবু কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর "কবিতার কী ও
কেন"অনেক কিছু বুঝতে আমাদের সাহায্য করবে।
সম্পাদক রংরুট: আপনার কবিসত্তার ভরকেন্দ্র শাশ্বত মানবিক সংবেদনশীলতায় না’কি নির্মোহ দার্শনিক
বিশ্ববীক্ষায়? কবিগুরু বলতেন, তিনি দার্শনিক নন। তিনি কবি। দর্শন ও সাহিত্যের ভিতর
একটি দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ের পালা চলতে থাকে। অন্তত রবীন্দ্রকাব্যের বিবর্তনের দিকে লক্ষ্য
রাখলে বিষয়টি দেখা যায়। এই বিষয়ে আপনার ব্যক্তিগত অভিমত। জানতে চাইছি বিস্তারিত আলোকপাতে।
ভাস্কর পাল: এটা খুবই সত্য যে, দর্শন
ছাড়া সাহিত্য নেই। দর্শনের মূল কথাটা
হচ্ছে জীবন ও জগতের ব্যাখ্যা। সে-ব্যাখ্যা অন্যত্রও পাওয়া যায়, কিন্তু
দর্শনের ব্যাখ্যাটা আসে যুক্তির পারম্পর্যের ভেতর দিয়ে। এখানেই তার আত্মীয়তা
বিজ্ঞানের সঙ্গে। কিন্তু বিজ্ঞান যে-পরিমাণে নৈর্ব্যক্তিক, দর্শন
কিন্তু সেই পরিমাণে নৈর্ব্যক্তিক নয়। দর্শনের চরিত্রটা সর্বদাই মানবিক।তাই
বলা যায় কবিতাই প্রথমে এসেছে,পরে দর্শন। কবিতা কিন্তু দর্শনকে খুঁজেছে। যদিও দুয়ের
মধ্যে ব্যবধান অনেক। কবিতার তথা সাহিত্যের উপজীব্য
হচ্ছে বিশেষ,
দর্শনের উপজীব্য নির্বিশেষ। তাদের অবলম্বন ভিন্ন ভিন্ন; সাহিত্য
বিশ্বাস করে সংশ্লেষণে, দর্শনের আগ্রহ বিশ্লেষণে। তবু
সাহিত্যের জন্য দর্শনানুসন্ধান অপরিহার্য। সাহিত্য ছাড়া দর্শন তাও চলতে পারে, কিন্তু
দর্শন না-থাকলে সাহিত্য একেবারেই অচল। সাহিত্যের লক্ষ্য থাকে কালজয়ী হওয়া, এবং
কালজয়ী হতে হলে তার দরকার দার্শনিক গভীরতা। দর্শনের ‘সুখানুসন্ধান’ হিসেবে নয়, দর্শনের
‘সুখানুভূতি’ হিসাবে। আমরা সাহিত্য চায় এবং সাহিত্য চায় দর্শন। তাই দর্শন ও
সাহিত্য পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক।
রবীন্দ্রনাথের সমগ্র কাব্যসাহিত্যের ভেতর প্রবেশ করলে দেখতে পাবো সৌন্দর্যের
ভেতর দিয়ে সত্যের ও প্রেমের সাধনাই তাঁর মর্মকথা। এটাই দর্শন বেদান্তের সেই মূল
মন্ত্র ‘একং সদ্বিপ্রা বহুদা বদন্তি’ যা এই তত্ত্বের মর্মবাণী। অর্থাৎ পৃথিবীর সব
বস্তুই একই বস্তুর বিকাশমাত্র। তাইতো তিনি অনুভূতিতে জীবনসমুদ্ররূপ রূপনারাণের
কূলে জেগে উঠে অনুভব করেছেন, এ জগৎ স্বপ্ন নয়, পরম
বাস্তব। এই পরম বাস্তবের আয়নায় দেখেছেন নিজ রক্তের অক্ষরে আপনার বাস্তব রূপ।
রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এই আধ্যাত্মিক চেতনার সাথে যুক্ত হয়েছিল আধুনিক ইউরোপের
গতিবাদ। বিশ্বের কোনো কিছুই স্থির হয়ে নেই। সমস্তই বিপুল পরিবর্তন, পরিবর্ধনের
ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে অবিশ্রান্ত। এই যে অনির্বাণ ছুটে চলা, অনন্ত
জীবনপ্রবাহ এটাই হলো বিশ্বসৃষ্টির মূল তত্ত্ব। বেদ উপনিষদের গতিবাদ সহস্র সহস্র
বছর পূর্বে এই অমোঘ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
রবীন্দ্র কাব্যেও তেমনি সীমার মধ্যে অসীমের, অসীমের
মধ্যে সীমার,
বিশেষের মধ্যে নির্বিশেষের, নির্বিশেষের
মধ্যে বিশেষের,
রূপের মধ্যে অরূপের আবার একই সাথে অরূপের মধ্যে রূপকে
চরমভাবে উপলব্ধির সাধনা উপভোগ্য হয়ে উঠেছে বিচিত্র অনুভূতিতে। অনির্বচনীয় সেই
ভাবনারাশি মাধুর্যরসে রবীন্দ্রনাথ বারবারই প্রকাশ করেছেন কবিসুলভ কাব্যিক বার্তায়-
‘ধূপ
আপনারে মিলাইতে চাহে গন্ধে
গন্ধ সে চাহে ধূপেরে রহিতে জুড়ে
সুর আপনারে ধরা দিতে চাহে ছন্দে
ছন্দ ফিরিয়া ছুটে যেতে চায় সুরে।
ভাব পেতে চায় রূপের মাঝারে অঙ্গ
রূপ পেতে চায় ভাবের মাঝারে ছাড়া
অসীম সে চাহে সীমার নিবিড় সঙ্গ
সীমা হতে চায় অসীমের মাঝে হারা’।
বেদ উপনিষদের রচয়িতারাও বলেছিলেন- ‘চরৈ বেতি, চরৈ বেতি।
এগিয়ে চলো,
এগিয়ে চলো, থেমে পড়ো না’। রবীন্দ্রনাথ এই
চলায়মানতাকে বলেছেন- চলার সম্পদ। বলেছেন- ‘চলিয়া তোমার পদে মুক্তি পাই চলার
সম্পদে’। কবি রবীন্দ্রনাথ সীমা থেকে অসীমে পৌঁছেও সীমাহীন হয়ে থাকতে চাননি।এর
কারণ রবীন্দ্রনাথ দার্শনিক, কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা তিনি
জীবনরসের কবি। অসীম-সসীমের মিলনকে কবি অনুভব করেছেন প্রেমে ভালোবাসায়, রূপে
রসে, গন্ধস্পর্শে, বিষাদে
বেদনায়,
সুখ-দুঃখে। ভারতবর্ষের পুরনো ভাবরাশিকেই রবীন্দ্রনাথ নতুন
রূপে, মাধুর্যের
শ্রেষ্ঠত্বে উপস্থাপনা করেছেন তাঁর কাব্যে। কবি শুধুমাত্র দার্শনিক হলে তাঁর এই
দ্বৈতসত্তার প্রয়োজন ছিল না। রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন ভারতের আধ্যাত্মিক ভাবরাশিতেই
অভিস্নান করেছেন, তবুও সত্য ও প্রেমের সাধনায় মনোজগতের বিচিত্রতার পথ ধরে যে
অভূতপূর্ব উপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছে কবির কবিতা ঘিরে, তা তাঁর
কবিপ্রতিভার স্নিগ্ধতায়, মাধুর্যে, বিরাটত্বে,গভীরতায়, ব্যাপকতায়, অভিনবত্বে
বিশেষ থেকে নির্বিশেষের হয়ে বিশ্বের দরবারে,বিশ্বসাহিত্যের
ক্ষেত্রে চির প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে মহাসম্পদ হয়ে।
সম্পাদক রংরুট: সাহিত্যসাধনা বা কাব্যচর্চার
প্রসঙ্গে কবি জীবনানন্দ পরিচ্ছন্ন
কালজ্ঞান ও সুস্পষ্ট ইতিহাসচেতনার উপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। সাহিত্য সাধনার ক্ষেত্রে
একজন কবির জন্য এই পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান ও ইতিহাসচেতনা কতটা জরুরী বিষয় বলে মনে করেন
আপনি? আপনার নিজের কবিতায় এই বিষয়গুলি কতটা প্রাসঙ্গিক ও কিভাবে দেখা দেয়?
ভাস্কর পাল: প্রশ্নটা যেহেতু কবি জীবনানন্দ দাস কে স্পর্শ
করেই তাই তাঁর কথা দিয়েই বলি, তিনি
বলেছিলেন “একজন কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার, কবিতার
অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাস চেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান”।
ঠিক একই রকম ভাবে বর্তমান ও বিগতের মধ্যে সংযোগ সাধনের চেষ্টা রবীন্দ্রনাথ
করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা কাব্যে যিনি কালজ্ঞান ও সুস্পষ্ট ইতিহাসচেতনার
উপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন জীবনানন্দ দাশ। তাঁর নাম স্মরণ করলে
আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে অরুণিমা স্যানালের মুখ’, ‘সিংহল
সমুদ্র,
‘বিম্বিসার অশোকের ধূসর নগরী’, ‘নাটোরের
বনলতা সেন’,
‘শ্রাবস্তীর কারুকার্য’, ‘মিশরে
বিদিশায় ধূসর প্রাসাদ’, ‘মিশরের মানুষী’ ‘গ্রীক, হিন্দু, ফিনিশীয়
নিয়মের রূঢ় আয়োজন’, ‘ধর্মাশোকের ছেলে মহেন্দ্র’, কিংবা
‘কলকাতা একদিন তিলোত্তমা’। কাব্যসৃষ্টির পক্ষে ইতিহাস মনস্কতা যে জরুরী সেটা গভীর
ভাবে বিশ্বাস করতেন জীবনানন্দ দাশ আর তার
পরিচয় পাওয়া যায় বাংলা কাব্য নিয়ে লেখা দু’টো নিবন্ধে ¬‘উত্তরৈবিক
বাংলা কাব্য’,
এবং ‘রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতা’। ইতিহাস চেতনা বলতে
স্বয়ং জীবনানন্দ তাঁর সচেতন জিজ্ঞাসায় কিংবা অনুপ্রাণিত কাব্যসৃষ্টির মধ্য
দিয়ে এঁকেছিলেন। তিনি সময়ের মাপকাঠিতে যে
ইতিহাসকে প্রত্যক্ষ করিয়েছিলেন।
বৃটিশ ইতিহাসবিদ কলিংউড -বলেছেন, “ইতিহাস হলো ঐতিহাসিকের মননে অতীত
ঘটনার পুনর্সংঘটন।” আবার
এলিয়টের কাছে ইতিহাসচেতনারই অপর নাম ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য একই সাথে সমকাল(Temporal) ও
কালাতীতের(Timeless)
বোধ। যেটাকে এলিয়ট নিজে নতুন শব্দ তৈরি করে বলেছেন “ Contemporaneity”. ইতিহাস
চেতনা মানে এই বোধ যে, অতীত শুধু অতীতে থাকেনা,থাকে
বর্তমানের মজ্জাতেও(not only pastness of the past but of its presence)।
অতীত পরিবর্তন হয় বর্তমান দ্বারা,আর
বর্তমানও পুষ্টি খোঁজে অতীতে। জীবনানন্দ দাশও ‘কবিতার অস্থিতে ইতিহাস চেতনা আর
মজ্জায় পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান’এর কথা বলেছেন।
ইতিহাস চেতনা সম্পর্কে এলিয়ট এক জায়গায় বলেছেন, Òa perception not
only of the pastness of the past, but of its presence. This historical sense
which is a sense of the timeless as well as the temporal and of the timeless
and of the temporal together, is what makes a writer traditional” (Eliot -
Traditional and the individual talent; points of view P-25)
জীবনানন্দ নিজে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “মহা বিশ্বলোকের ইশারা থেকে উৎসারিত
সময় চেতনা আমার কাব্যে একটি সঙ্গতি সাধক অপরিহার্য সত্যের মতো; কবিতা
লিখবার পথে কিছুদূর অগ্রসর হয়েই এ আমি বুঝেছি, গ্রহণ
করেছি।” (কবিতার কথা - জীবনানন্দ দাশ)
রবীন্দ্রনাথ যেমন উপনিষদ ও কালিদাসের যুগকে নতুন করে আবিষ্কার করেছিলেন, জীবনানন্দ
দাশও তেমনি প্রাচীন বাংলা, প্রাচীন ভারত ও প্রাচীন বিশ্বকে
অনুভব করার চেষ্টা করেছেন ইতিহাস মনস্কতার মধ্য দিয়ে। তিনি ইতিহাস চেতনাকে
বিশেষভাবে গ্রহণ করেছেন বর্তমান পৃথিবীর আত্মিক শূন্যতায় রুদ্ধশ্বাস হয়ে।
জীবনানন্দের ইতিহাস চেতনা পাশ্চাত্য মনন প্রভাবজাত নয়, প্রাচ্য
জীবনদর্শনেরই ফসল। প্রাচ্যের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সতীর্থ করে বাংলার রূপকথা, ব্রাত্যকথা, যাত্রা, পালা-পাঁচালী
থেকে রসদ নিয়ে বাংলাদেশের নদ-নদী, নিবিড় প্রকৃতি থেকে চিত্রকল্প কুড়িয়ে তিনি পা বাড়িয়েছিলেন
ইতিহাস পাঠে,
ইতিহাসের মাঠেঘাটে। এলিয়টের
উক্তিতে যে timeless
এবং temporal কথার উল্লেখ দেখি ‘বনলতা সেন’
কবিতায় তার প্রকাশ একেবারেই স্পষ্ট। ‘নাটোরের বনলতা সেন’ কথাগুলো উচ্চারণের সাথে
সাথেই যেন আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রেমিকার মুখ। যার সামনে ক্লান্ত বিধ্বস্ত
¬ দু’-দণ্ড শান্তির জন্যে অপেক্ষমান
তাঁর প্রেমিক পুরুষ। যাকে কোন ভূগোল বিস্তৃত দেশ কিংবা কোন বিম্বিসার নগরী তিল
পরিমাণ শান্তি দিতে পারেনি। অনেকটা ইয়েটসের মতো। ইয়েটস যেমন প্রেমিকার আলিঙ্গনের
মধ্যেই যুগ,
যুগান্তরের কথা স্মরণ করেছিলেন তেমনি জীবনানন্দ প্রেমের ও
সৌন্দর্যের প্রকৃত স্বরূপ খুঁজেছেন ভূগোল ও ইতিহাসের বৃহত্তর পটভূমিতে।
ভারতবর্ষের ইতিহাসের মধ্যে অশোকের যুগ তাঁকে উদ্দীপনা জুগিয়েছিল বেশি। কেননা
সে যুগ ছিলো প্রেমের উদ্দীপনার যুগ। এ যুগে ধর্ম, সংঘ, শক্তির
চেয়েও ‘মানুষ চায় আরো আলো : মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়’। ধর্মাশোক, মহেন্দ্র
ও সঙঘমিত্রার ব্যক্তিগত প্রেমের শক্তি তিনি দেখতে পেয়েছেন এ অশোকের যুগে।ইতিহাসের
মধ্য দিয়ে প্রকৃতি, চেতনা, মানুষ, সমাজ, সভ্যতা
বা যে সত্য তিনি আবিষ্কার করেছেন সেই পুরনো সত্যই আমাদের কাছে নতুন সত্য হয়ে ওঠে।
আর তখনি বুঝতে পারা যায় শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে ব্যক্তি চেতনার মূল্য বেশি কেন।
সৃষ্টিশীল নান্দনিক কবিতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মৌলিক সত্তার অন্তর থেকে উঠে আসে, আর
তাই সে কবিতা অসম্ভব কঠিন কিছু হওয়ার কথা নয়। এ প্রসঙ্গে আমি টি এস এলিয়টের মতামত
তুলে এই প্রশ্নটির উত্তর শেষ করব। তিনি
বলেছেন—‘Poetry…excellent words in
excellent arrangement and excellent metre. That is what is called the technique
of verse…a poem in some sense, has its own life; the feeling,
or emotions or vision, resulting from the poem is something different from the
feeling, or emotions or vision in the mind of poet’।
সম্পাদক রংরুট: মহাকবি টি এস এলিয়টের ভাষায়, “No poet, no artist of
any art, has his complete meaning alone. His significance, his appreciation is
the appreciation of his relation to the dead poets and artists. You cannot value him alone; you must set him
for contrast and comparison among the dead.” আপনিও কি
এলিয়টের মতো এই মতে বিশ্বাসী? আপনার নিজের কাব্য সাধনায় কতটা সত্য এই দর্শন? অর্থাৎ
আপনার কবিতার পাঠককেও কি আপনার কবিতা অনুধাবনে এই পথেই অগ্রসর হতে পরামর্শ দেবেন আপনি?
না’কি আপনার অবস্থান কিছুটা ভিন্নমাত্রায়।
ভাস্কর পাল: এর আগের প্রশ্নের উত্তরে আমি এলিয়টের উক্তিতে
যে timeless
এবং temporal কথার উল্লেখ করেছিলাম। ইতিহাস
একইভাবে উঠে এসেছে তাঁর কবিতায় তার প্রবহমান সময়চেতনার ঐতিহ্যে। তিনি বললেন :
Time
present and time past
Are both
present in time future,
And time
future contained in time past
এর কারণও ব্যাখ্যা করেছেন উইন্ডহ্যাম লুইস। তিনি বলেছেন- কবির অভিজ্ঞতা is deeper than
civilisation and he only uses the phenomenon of civilisation in expressing it
আর কবি জীবননানন্দ বললেন “কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার, কবিতার
অস্থি-র ভিতর থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান” এই কথাটা আমি খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই যে আমি
সাহিত্য বিভাগের ছাত্র নই যার জন্য ‘ঐতিহ্য’ বা ট্র্যাডিশানাল সাহিত্য শিক্ষা আমার
নেই। কবিতাকে ভালোবেসে বা শব্দ প্রতিস্থাপনের অদম্য আগ্রহের জন্য এবং সম কালের
প্রবাহে সাহিত্যকে জানার আগ্রহে আমার পথ চলা।
টি এস এলিয়ট এর এই ভাবনার সাথে আমি একেবারে একশো ভাগ সহমত। এই কারণে যে কোনো
মানুষ ঐতিহ্যচ্যুত হতে পারে না। জেনে বা নাজেনে সে তাঁর যে পরম্পরা, প্রাচীন
ঐতিহ্য তার অংশীদার। মানুষ যে পৃথিবীতে বাস করেন, তিনি যে পরিবেশে থাকেন, তাঁর
পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য সে জেনে বা না জেনেই বহন করে আসছে।
এখানে ঐতিহ্য বলতে কবিতার ইতিহাস বলা। কবিতার
ইতিহাস বলতে তোমার যে অগ্ৰজ ছিল, রবীন্দ্রনাথ
বা আরো প্রাচীনকালে ধরলে সেখানে বেদ, উপনিষদ, সংস্কৃত
সাহিত্য আছে চর্যাপদ আছে এই আবহমান ঐতিহ্য তুমি বহন করে নিয়ে আসছো তোমার চিন্তা
চেতনায়। তুমি যদি মুর্খ হও, তাহলে হবে না। তোমার এই ঐতিহ্য
সচেতনতা থাকতে হবে তোমার জীবনের অংশ হিসেবে।আর এটিই টি এস এলিয়টের কথা।
একজন কবির সাথে তার পূর্বসুরী কবির ভাব ও ভাষার কি সম্পর্ক হবে সেটা বোঝাতে টি
এস এলিয়ট ‘ঐতিহ্য’ বা ট্র্যাডিশান পদটি ব্যবহার করেছিলেন।তিনি একে ‘হিসটোরিকাল
সেন্স’ও বলেছিলেন। এলিয়টীয় ভাবনায়, সৃষ্টিশীলতা কোন ভুঁইফোঁড় বিষয় নয়;অতীত
কবির সঙ্গে সৃজনশীল গ্রহন-বর্জনের মধ্যেই মৌলিকত্বের মানে নিহিত। আমি
বিশ্বাস করি অতীত ও বর্তমানের সম্পর্ক একমুখী নয়, অতীত
বর্তমানকে যেমন পরিবর্তন করতে পারে ঠিক তেমনি অতীত বর্তমানকে অবহিত করে।
এটা তো ভীষণ রকম ঠিক যে একটা কবিতা জন্ম দিতে পারে আরো আরো কবিতার। একটা কবিতা বের করে আনতে পারে কবি হতে ইচ্ছুক কারো
ভেতরের কবিতাকে।
বাংলায় কাব্যের ঐতিহ্যকে শুধু বাংলা কবিতায় আর এই অঞ্চলেই সীমায়িত করে রাখাকে
আমি সমীচীন মনে করিনা। আজকের কবিকে যেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে হবে রবীন্দ্রনাথ,জীবনানন্দের
সাথে, ঠিক
তেমনি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে হবে বিশ্বকবিতার সাথে এবং না-লেখা আগামীর কবিতার
সাথেও।
সম্পাদক রংরুট: ইংল্যাণ্ডজাত
মার্কিন কবি ডবল্যু এইচ অডেন গভীর ভাবে বিশ্বাস করতেন, একজন কবি সবিকিছুর আগে সেই ব্যক্তি
যিনি তাঁর ভাষার প্রেমে পড়ে গিয়েছেন। আমাদের এত ভালোবাসার এত দুর্দশা পীড়িত তবুও সংগ্রামী
বাংলা ভাষার একজন কবি হিসাবে এই বিষয়ে আপনার অবস্থান সম্বন্ধে যদি আলোকপাত করেন স্পষ্ট
ভাবে। কবিতা কি সত্যই এমন নিবিড় ভাবে বিশেষ কোন ভাষা নির্ভর হতে পারে? না’কি অডেনের
এই মতকে আমরা কবিতার নিজস্ব ভাষা বলে ধরে নেবো। যেমন চিত্রশিল্পের ভাষা, চলচিত্রের
ভাষা ইত্যাদি।
ভাস্কর পাল: আমি এটা বিশ্বাস করি না যে কবিতা নিবিড় ভাবে
বিশেষ কোন ভাষা নির্ভর হতে পারে।কবিতার
সম্পর্ক প্রথমত শ্রবণেন্দ্রিয়ের সঙ্গে। কবি কাব্যরচনা করেন কানের কথা মাথায় রেখে।
অডেনের বলেছেন – ‘যে কবিতাকে আয়ত্তে আনার পর পড়ার চেয়ে শুনতে ভালো শোনায় না সেটি
আদপে উৎকৃষ্ট কবিতা নয়।’ অন্যভাবে বললে, একটি ভালো কবিতা যতখানি
দৃষ্টিনন্দন তার চেয়েও বেশি শ্রুতিমধুর। আমরা যেমন ছন্দহীন বিশ্বজগতের কথা চিন্তাও
করতে পারি না। আমাদের এই পৃথিবী, মহাবিশ্ব, ভৌত ও জৈব
জগত এবং কোয়ান্টাম বিশ্বসহ যে কোনো জাগতিক ও মহাজাগতিক বস্তু, বিষয়
বা ঘটনাকে বিশ্লেষণ করলে আমরা একধরণের যৌক্তিক ছন্দকে খুঁজে পাব। ছন্দ ছাড়া কোনো
বিষয় আমাদের জীবন ও প্রকৃতিতে নাই।মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সময়ে মায়ের হৃৎপিণ্ডের
‘লাবডুব’ শব্দ শুনতে শুনতে আমরা পৃথিবীতে আসি। তারপর ছেলেবেলায় শুনতে হয় ‘হাট্টি
মাটিম টিম,
তারা মাঠে পাড়ে ডিম’, ইত্যাদি।
আমরা ছন্দপূর্ণ সামাজিক ভাষা বলতে বলতে কাব্যের জগতে প্রবেশ করি এবং এর ফলে একজন
কবি বা পাঠকের অবচেতন মনে ছন্দের সঞ্চার হয়।মানুষ
মনস্তাত্ত্বিক কারণে ছন্দকে পছন্দ করে।
কাব্যের মধ্যে ছন্দের সাঙ্গীতিক যে ব্যাপারটি রয়েছে সেটি উপলব্ধির জন্য ‘কান’
তৈরি হয় কবিদের। এ কারণেই আমাদের অভিধানে কবিতার শ্রুতিবোধকতাকে বোঝানোর জন্য
এতগুলো শব্দ আছে। শ্রুতিবোধকতা বলতে কবিতার শাব্দিক মাত্রাকে বোঝায়। শব্দ কেবল
অর্থই নয়,
প্রদান করে ধ্বনিও। কবিতা পড়তে গিয়ে আমাদের হতে হয় আন্তরিক।
কবির খণ্ড খণ্ড অনুভব-অনুভূতি, যা হয়ত
তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা ছিল, সেটি তখন সঞ্চারিত হতে পারে, হয়ত
প্রান পায় পাঠকের জীবনে। কবির বিচ্ছেদ, ব্যথা, পাঠকেরও
ব্যথা হয়ে যায়। কবির হৃদয় ভাঙলে, পাঠকেরও হৃদয় যেন কোথাও ভেঙে
পড়ে। কবি যদি কবিতায় কোনো ‘তুমি’কে নিয়ে
দু’লাইন লেখেন,
পাঠকও তখন তার নিজস্ব ‘তুমি’কে খুঁজে বেড়ায়। কবি যদি কবিতায়
বলে, ‘ভালো
লাগছে’,
পাঠকেরও যেন অজানা কোনো ভালোলাগায় মন ভরে ওঠে।
জীবন মুক্তির পথ সহজ করে কোনো কোনো কবিতা পাঠককে বাঁচিয়েও তুলতে পারে। পথ যদি
বন্ধুর আর দীর্ঘ হয়, তা থেকে পরিত্রাণের পথও দীর্ঘই হয়। কবিতা এই দীর্ঘ পথের
সাথী হতে পারে। পথের দূরত্ব যতোই বাড়ুক, পাঠকের মনের আকাশের জমে থাকা মেঘ
কেটে যেতে পারে কবিতার কারণেই। যাদের জীবন থেকে আনন্দ হারিয়ে যায়, কবিতাই
পারে তাকে আবার প্রগাঢ় আনন্দে ভাসিয়ে দিতে। মুক্ত মানুষ নিঃসঙ্গও। মুক্ত মানুষ
নিজেকে তৈরি করে মুক্তপ্রাণ হিসেবে, এই করতে করতে একসময় কেউ কেউ
নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। কবিতা তাকে জড়িয়ে রাখে, সঙ্গ দেয়। এসব, কবিতাই
পারে। অন্যদিকে,
কবিতার ব্যাকরণকে হয়ত পাঠক তার অনুধাবনের সঙ্গে সব-সময়
সমার্থক করতে পারে না, কিন্তু ঐ যে বললাম, কবিতার
ভাব পাঠককে বিহ্বল করে তুলতে পারে। কবিতার শক্তি এখানেই।ভাষা এখানে একটা মাধ্যমের
কাজ করে অনুঘটকের মত।
আমরা কবিতা পড়ি, যতটা শিল্প উপভোগে, সম্ভবত
এরচেয়ে বেশিই নিজের প্রয়োজনে। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার এই জীবনকে সহনীয় করতে
কবিতার কাছে আমাদের হাত পাততে হয়। শুধু তো প্রেম নয়, জীবনে
নানা অনুষঙ্গ রয়েছে। যখন কোনো পরিস্থিতি, কোনো ঘটনা, আমাদের
স্বস্তি দিতে চায় না, শান্তি দেয় না, তখন কবিতা হয়ে পড়ে অমোঘ আশ্রয়।
কখনো কখনো কবিতার বইতে মুখ লুকিয়ে আমরা কান্না লুকোই। উদাসীনতা চাপা দিই। হাহাকার
পোড়াতে চাই। হয়ত এ-কারণেই, জীবনকে আবার সামনের দিকে টেনে নিয়ে
যাওয়া যায়। পা বাড়ানো যায় জীবনের নতুন গন্তব্যের দিকে।
সম্পাদক রংরুট: ভাষার প্রসঙ্গই
যখন উঠলো, তখন বিশেষ করে জানতে ইচ্ছা করছে আমাদের এই বাংলাভাষা আপনার ব্যক্তিগত জীবনসত্যের
সাথে ঠিক কিভাবে জড়িয়ে আছে? না, শুধু মাত্র কবিতা লেখা বা সাহিত্যসাধানার একটি মাধ্যম
হিসাবে নয়। একজন অনুভুতিশীল সচেতন বাঙালি হিসাবে।
ভাস্কর পাল: সাতটি রঙ দিয়ে যেমন বিশ্ব আঁকা
যায়, মুছে
ফেলা যায়,
ঠিক তেমন ভাবে অসংখ্য শব্দের উচ্চারণে প্রতীকী শব্দ ও
নৈঃশব্দ্য তৈরি করা যায়।ভাষার উদ্ভাবনের ধারাই যোগাযোগ কোনো একটি নব-মাত্রার
সংযোজন ঘটেছে,
কারণ ভাষাই একমাত্র উপায়, যার
দ্বারা মনের ভাব অন্যের নিকট সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করা সম্ভবপর হয়।প্রাচীনকালে
চোঙ্গা,
ঢোল, কবিগান, পথ নাটক, ঘন্টা, জীবজন্তুর
ডাক, ফরমান, কবুতরের
ডাক-এসব মাধ্যমের সহায়তায় যোগাযোগ সম্পন্ন করার চেষ্টা চলত, কিন্তু
ভাষাই একমাত্র মাধ্যম যা যোগাযোগকে সফল করতে পারে।
ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এর স্বর ও ব্যঞ্জন
ধ্বনি আছে তার সম্মেলনে সুকোমল আর কার্য উপযোগী ভাষা প্রকাশ সম্ভব। উচ্চারণ স্থান
ও রীতি অনুসারে বাংলার ধ্বনি সমূহ সংস্থান করতে পারে পৃথিবীর অধিকাংশ ভাষার ধ্বনি
মালাকে। এর শব্দ ভান্ডার বহু উৎস থেকে গ্রহণের মাধ্যমে
হয়েছে ঋদ্ধ।
মাতৃভাষা মানুষের সহজাত বিকাশের ভাষা। এ ভাষা শুদ্ধ করে
বলতে পরিশ্রম করতে হয় না। এই ভাষা একান্ত উপলব্ধির অনুভূতির ভাষা। প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে মাতৃভাষায় জ্ঞান
অপরিহার্য। জ্ঞানের মৌলিক দক্ষতা ও কুশলতা অর্জিত হয় মাতৃ ভাষায়। সাংস্কৃতিক
উত্তরাধিকার ও বংশগত ঐতিহ্যকে ধারণ ও বহন
করে মাতৃভাষা।আমার আড্ডা মারার ভাষা, ভালোবাসার
ভাষা বাংলা ভাষা। আমি গর্বিত আমার ভাষা বাংলা বলে। আমি গর্ব অনুভব করি ভাষা
আন্দোলনের জন্য কষ্ট পাই ভাষা শহীদ দের জন্য। আমি নিজেকে ধন্য মনে করি কারণ আমি
ভাষা শহীদদের স্মৃতি বিজড়িত বাংলাদেশের স্মৃতি সৌধে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করতে পেরেছি।
সম্পাদক রংরুট: সাহিত্য দর্শন
বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিবর্তনের পথে আমরা যে অনেক দূর এগিয়ে এসেছি, সে
কথা হয়তো বলাই যায়। কিন্তু সমাজ সংসার বিবর্তনের পথে বিগত দুই হাজার
বছরের হিসাবটুকুই যদি ধরি খৃষ্টাব্দের সূত্রে- তাহলে সত্যই
কতটুকু এগোলো মানুষের সমাজ সংসার সভ্যতা? আপনার মূল্যায়ন।
ভাস্কর পাল: যদি খৃষ্টাব্দের সুত্রে আঁকতে যাই এই অগ্রগতি তাহলে মানব সমাজের
অগ্রগতি এত টুকুও ঘটে নি।বিগত দুই হাজার বছরের হিসাবটুকুই
যদি ধরি সেই ধর্ম, কুসংস্কার, হিংসা, জিঘাংসা
এখনও চলছে দ্বিধাহীন ভাবে কিছু আভ্যন্তরীণ ভাবে কিছু রাষ্ট্র যন্ত্রের মদতে।
বিশ্বব্যাপী প্রেম, ভালোবাসা ও সমাজ চেতনাবোধের অসংখ্য নজির থাকলেও বস্তুত
মানুষ সুখী নয়। মানুষের ভেতরে ভালোবাসাহীন এক অতৃপ্ত হাহাকার সর্বদা বিরাজমান, চারদিকে
সামাজিক অবক্ষয়ের ছড়াছড়ি। এর কারণ হিসেবে বলা যায় আমাদের ভেতরে মানবিক ও
বিজ্ঞানভিত্তিক সেক্যুলার শিক্ষার অভাব রয়েছে। আজ ভোগবাদ
সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে।মানুষের আত্মসর্বস্য এমন স্বরূপ এর আগে পৃথিবী প্রত্যক্ষ
করেনি কখনো,
ভোগবাদের এই পৃথিবী মানুষকে মনে করে পণ্যের উপভোক্তা। সমাজ
ব্যাবস্থা আজ এই সংস্কৃতিটি আত্মস্থ করাতে
সক্ষম হয়েছে যে, পণ্য কিনলেই জীবন সার্থক। পণ্যের
উপভোক্তা নয়,
‘মানুষ’ পরিচয়টা বড় করে তুলতে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা থেকে
পৃথিবীকে ফেরানো দরকার।আজকের বিশ্বব্যাপী COVID -19 ভাইরাসের
আক্রমণ পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যের ভয়ংকর রূপটি সামনে এনে দিয়েছে।
এজন্য এই দশকের সমাজে সমাজতন্ত্রের স্বরূপ
চাই। আমি মনে করি সেটাই ভোগবাদে লাগাম টানতে পারে, এতেই
রক্ষা পাবে মানবিক মূল্যবোধ, সেই সঙ্গে প্রাণ প্রকৃতি ও পরিবেশ।
কারণ জীবনকে উদযাপন করতে ভোগবাদ অনিবার্য নয়। জীবন ভোগের নয় আনন্দের, সুখবোধ
ও স্বস্তির। এর জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আয়োজন চাই। আর তা গড়ে তোলার জন্য চাই
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। আর সেই রাষ্ট্র নির্মানের দায় অনুভব করি। আমরা যদি
সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মানবিক মূল্যবোধগুলি চর্চার পাশাপাশি তা আত্মস্থ করতে
পারতাম তাহলে মানুষরাই হতো সবচেয়ে সুখী। গড়ে
উঠতো মানবিক সমাজ, সভ্যতা ও
ইতিহাস।
সম্পাদক রংরুট: সবশেষে
এসে জানতে চাইবো আপনার ব্যক্তিগত সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি সমসাময়িক
কার কার কবিতাচর্চা আপনাকে বিশেষ ভাবে উদ্বুদ্ধ করে, যেখান থেকে বাঙলা কাব্যসাহিত্যের
অদূর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আপনি প্রবল ভাবে আশাবাদী ভুমিতে অবস্থান করতে পারেন।
ভাস্কর পাল: সমসাময়িক কালে কবিতা চর্চা নিয়ে আলোচনা করতে
গেলে পর্যায়ক্রমে চলে আসবে অনেক অনেক নাম,তারাপদ
রায়, প্রেমেন্দ্র
মিত্র,
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, পল্লীকবি
জসীমউদ্দীন,শক্তি
চট্টোপাধ্যায়,শঙ্খ
ঘোষ অনেকেই………; বর্তমান
সময়ে লেখালেখির সাথে প্রতিষ্ঠিত লেখক কবি জয় গোস্বামী, সুবোধ সরকার, শুভ
দাসগুপ্ত ,আমার বন্ধুদের মধ্যে মানিক পণ্ডিত, শ্যামাশ্রী
রায়কর্মকার, জয়তি দাস, সূর্য
মণ্ডল। প্রতিষ্ঠিতরা ভিন্নমাত্রিক তাঁদের শিরদাঁড়ায় কর্পোরেট ভরসা।
বরং বন্ধুদের লেখায় পাই ভোরের আকাশের আঘ্রান।তবে
বাঙলা কাব্য সাহিত্যের ভবিষ্যৎ ভাবনা নিয়ে বলতে গেলে যে দুইজন আমায় প্রভাবিত করেন
তাদের একজন কবি বিষ্ণু দে। তাঁর
লেখায় আছে স্পর্ধা। বিষ্ণু দের মধ্যেই প্রথম রাবীন্দ্রিক কাব্যবলয়
অতিক্রমণের প্রয়াস লক্ষ করা যায়। মার্কসীয়
তত্ত্বকে জীবনাবেগ ও শিল্প সম্মত করে উপস্হাপনার ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য অপরিসীম।
বিষ্ণু দে একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, শিল্পানুরাগী
এবং চিত্র সমালোচক। আধুনিক বাঙ্গালি কবিদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও চিন্তাশীল
ব্যক্তিত্ব বিষ্ণু দে তাঁর কাব্য রচনার মূল গঠনে যেমন ইউরোপীয় আধুনিক কবিদের চিহ্ন
রেখেছেন,
তেমনই কবি টি এস এলিয়টের রচনাশৈলী এবং ভাবনা দ্বারাও তিনি
প্রভাবিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করা যে সম্ভব নয়, তা
বিষ্ণু দে বুঝেছিলেন। মার্কসীয় দর্শনেই
তিনি বিকল্প পথ খুঁজে নিলেন, এখানেই একাত্ম হয়ে যায় সৃজন ও
সংগ্রাম। বিষ্ণু দে’র কবিতায় দেখা যায় রাবীন্দ্রিক ঐতিহ্য এবং মার্কসীয় চেতনার
আশ্চর্য মেলবন্ধন।বিষ্ণু দে’র কবিতায় রয়েছে এমন মননরস যা পাঠককে বাধ্য করে জগৎ ও
জীবন সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে। সেই ভাবনা শুধু মস্তিস্কের অবসর বিলাস নয়, তাতে
পরিশ্রম লাগে,
মেধা লাগে, অধ্যাবসায় লাগে।
আমার ভাবনার ভালবাসায় দ্বিতীয় জন হলেন কবি বুদ্ধদেব বসু।
বাংলা ভাষার উপর যে আত্মবিশ্বাসী দখল সঠিক উপযুক্ত শব্দ নির্বাচন এবং প্রান
স্পন্দিত সংবেদনশীলতা একটি সাধারন কে অসাধারন হৃদয়গ্রাহী করে দিতে পারে সেই দক্ষতা
ও অপূর্ব ক্ষমতা যার ছিল তিনিই কবি বুদ্ধদেব বসু। শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর কবিতায়
লিখেছেন,
‘তোমার নিকটে এসে বৃক্ষের ভরসা পেত কবি, ছায়া
পেত, সচ্ছলতা
পেত সুন্দর।‘। আর শামসুর রহমান ‘বুদ্ধদেব বসুর প্রতি‘ কবিতায় লেখেন:-
‘শব্দেই
আমরা বাঁচি এবং শব্দের মৃগয়ায়
আপনি শিখিয়েছেন পরিশ্রমী হতে অবিরাম।
…আপনার
ঋণ
যেন জন্মদাগ, কিছুতেই মুছবে না কোনোদিন”
বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ কাব্য, তার
কাব্যে মাতাল করে দেওয়ার ঐশ্বরিক শক্তি রাখে! শার্ল বোদলেয়ার এর কথা ভাষান্তরিত
করে তিনি লেখেন ‘সুরা, কবিতা, পুণ্য- যার দ্বারাই হোক, মাতাল
হও!’
ভাস্কর পাল পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলায় আমার
জন্ম। রামকৃষ্ণ
মিশন বিবেকানন্দ বিদ্যামন্দির থেকে বিদ্যালয় শিক্ষা, মালদা টাউন হাই স্কুল থেকে উচ্চ
মাধ্যমিক এবং এখান থেকেই লেখালেখির পথ শুরু। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় এর অন্তর্গত
মালদা কলেজ থেকে স্নাতক। পরবর্তী কালে আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে উচ্চশিক্ষা। কলেজ জীবন থেকেই লেখার প্রতি আগ্রহ
সেই সময় লিটিল ম্যাজাগিন প্রকাশনা করা। একসময় জেলা স্তরে
সাংবাদিকতা এবং জেলা ও রাজ্য স্তরে
বিভিন্ন ম্যাগাজিন এর নিয়মিত লেখালেখিও করতেন। অন্যমনে নামের একটি পত্রিকা
সম্পাদনা এবং প্রতিবিম্ব একটি সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপ এর সাথে লেখালেখি নিয়ে যুক্ত।
আন্তর্জাতিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত রোটারী ইন্টারন্যাশনাল ক্লাবের 3240 জেলার রোটারী ক্লাব অফ মালদার 2018-19 সালের প্রেসিডেন্ট হিসাবে
বিভিন্ন সেবা মূলক কাজ, পোলিও দূরীকরণ আর বয়স্কদের শিক্ষা প্রদান কর্মকাণ্ডের সাথে
জড়িয়ে আছেন।
কপিরাইট রংরুট
কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন