মুখোমুখি বৈজয়ন্ত
রাহা
সম্পাদক
রংরুট: সকলের আগে ত্রৈমাসিক রংরুটের
পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। রংরুটের এই বিশেষ সংখ্যায় আপনাকে স্বাগতম।
আপনার লেখালেখির পরিধি মূলত কাব্যসাহিত্য কেন্দ্রিক। এযাবৎ প্রকাশিত আপনার সব কয়টি
বইই মূলত কবিতাসংকলন। কবিতার
প্রতি এই বিশেষ আগ্রহের সূত্রপাত ঠিক কিভাবে?
বৈজয়ন্ত রাহা: একটু ভ্রম সংশোধন
করি। আমার লেখালেখির পরিধি মূলত কাব্যসাহিত্য কেন্দ্রিক নয়। আমি দীর্ঘকাল
যাবৎ প্রবন্ধ , বিশ্ব সাহিত্যের গল্প অনুবাদ, গল্প ও নাটক লিখে
থাকি কবিতার পাশাপাশি। বহু বছর ধরে বহু পত্রিকায় সেগুলি প্রকাশিত। এযাবৎ কাল
প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে ১০ টি কাব্যগ্রন্থ ও একটি বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদ ও একটি
ছোট গল্প সংকলনের বই। আমি যেখানে থাকি, আজ থেকে ৪৫/৪৬ বছর আগে সেখানে এরকম রাস্তা, ঘরবাড়ি কিছুই ছিল না, এমনকি আজকের সল্টলেক
বা লবণ হ্রদ তখনও তৈরী হয়নি। চারদিকে , জলা আর তার মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা সুড়কি ঢালা পথ।
আর পথের দুধারে কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া গাছ। আমার ঠাকুর্দা প্রখ্যাত নাট্যকার ও
অনুবাদ সাহিত্যিক শ্রী সুধীন্দ্রনাথ রাহা
মর্নিং ওয়াক করতে বেড়োলে, আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন।
আগের রাতে কালবৈশাখী হয়ে
গেছে। আমি ঠাকুর্দার হাত ধরে বেড়িয়ে দেখতে পেলাম, একটি রাধাচূড়া গাছ হেলে পড়ে আছে
একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের গায়ে। মাথার মধ্যে কি যেন হল! বাড়ি ফিরে এসে চারটে লাইন
লিখেছিলাম একটা কাগজে। তখন বয়স কত হবে? বড়জোর ৬। দাদুকে দেখাতে, তিনি বললেন, হুমম, আজ রাতে আমার কাছে
পড়তে বসবি। সেদিন থেকে শুরু হল দাদুর হাত ধরে সাহিত্যের অলিতে গলিতে যাত্রা, বায়রণ, শেলী, কিটস, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, পরে শেক্সপীয়ার, সবার কবিতা উনি আমায়
তর্জমা করে বোঝাতে শুরু করলেন। আর একটু বড় হয়ে বাংলা কাব্য সাহিত্য নিজেই পড়েছি।
খুব স্বতস্ফূর্ত ভাবে আমার কবিতার চরণ চলে আসতো। নির্মাণ করতে হত না মোটেই। আলাদা
করে সময়ও দিতে হতনা। হাঁটতে, চলতে, অন্য কাজ করতে করতে
আপনা আপনিই কবিতার লাইন ধরা দিতে থাকলো। মাত্র এগারো বছর বয়সে একটি স্থানীয়
ম্যাগাজিনে বড়দের সাথে লেখা প্রকাশও হল। যেহেতু খুব স্বতস্ফূর্ত ভাবে কবিতা আসে, তাই প্রথম যৌবনে
কবিতা লেখাই মূল লেখা হয়ে দাঁড়াল।
সম্পাদক
রংরুট: আমরা জানি কবিতা প্রকাশের বিষয়ে আপনি খুবই
যত্নশীল একজন মানুষ। নিজের সৃজনশীলতার বিষয়ে অত্যন্ত বেশি রকমের নিষ্ঠাবান না হলে
এই যত্নশীলতা অর্জিত হয় না। এই বিষয়ে আমরা জীবনানন্দ দাশের কথা স্মরণ করতে পারি।
প্রতিটি কবিতার পিছনে আপনার যে পরিশ্রম যে অধ্যাবসায় ও যত্নশীলতা বর্তমান, তার অনুপ্রেরণার উৎস
কি?
বৈজয়ন্ত রাহা: আমি নিজে ঈশ্বরে
বিশ্বাস করিনা। কিন্তু, আমার ঠাকুর্দা
প্রায়ই বলতেন, বৈজন, সরস্বতী তাঁকেই কৃপা করেন, যে প্রকৃত পূজারী।
কখনও প্রলোভনে পা দিও না, কখনও পুজো থেকে সরে যেওনা, যদি আজীবন তুমি সেবা করতে পারো, জানবে আজীবন তুমি বর
পাবে তাঁর। আর সেবা যে যত্ন করেই করা দরকার সেটা কে না জানে? তবে কবিতার ক্ষেত্রে
যত্নশীলতা অর্থ , তাকে ধরে ধরে নির্মাণ নয়। স্বতস্ফূর্তভাবে তাকে লিখে কিছুদিন ফেলে
রাখা। তারপর তাকে বার করে প্রয়োজনীয় সম্পাদনা করা। নিজের ত্রুটি নিজে সংশোধন
করা।এবং দাদু শিখিয়েছিলেন, একটি জাবদা খাতায় লিখে রাখার পদ্ধতি। মূলত এই ধারণা
মাথার ভিতরে আজও বর্তমান, সেবা যেন সঠিক হয়। সেখান থেকেই এই যত্নশীলতা এসেছে।
সম্পাদক
রংরুট: এই প্রসঙ্গে জানতে চাইবো কবিতার কাঠামোগত দিকের
বিষয়ে একজন কবির, নৈর্ব্যক্তিক ও শৈল্পিক ধ্যানধারণা থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন কি
আপনি? কবির ব্যক্তিগত
আবেগকে সাহিত্যের নান্দনিকতায় বিকশিত করতে যা খুবই মূল্যবান? না’কি কবিতা মূলত
আবেগের বহিঃপ্রকাশ মাত্র? অনেকেই যেমনটা দাবি করেন আজকাল।
বৈজয়ন্ত রাহা: কবিতার মূল
সম্পদ তার রস,
তার
ভিতরের বক্তব্য। তার সৌন্দর্য , কাঠামোর উপরে
অনেকখানি নির্ভরশীল। কিন্তু কাঠামো মূল কথা নয়। কবির প্রকাশভঙ্গী অবশ্যই খানিকটা
নৈর্ব্যক্তিক এবং শৈল্পিক হবে , হওয়া উচিৎ, নতুবা কবিতা ডায়রি হয়ে উঠবে। ডায়রি পড়তে হয়তো
ভালো লাগে কিন্তু আসল বক্তব্যে সকলের একাত্মীকরণ ঘটে না। কবিতা কখনই শুধু মাত্র
ব্যক্তিগত আবেগের বহিপ্রকাশ নয়, কবিতার সর্বজনীনতার কারণেই কবির নিজস্ব আবেগকে শৈল্পিক
সুষমায় মন্ডিত করে উপস্থাপনের দরকার।
সম্পাদক
রংরুট: আপনার কবিসত্তার ভরকেন্দ্র শাশ্বত মানবিক
সংবেদনশীলতায় না’কি নির্মোহ দার্শনিক বিশ্ববীক্ষায়? কবিগুরু বলতেন, তিনি দার্শনিক নন।
তিনি কবি। দর্শন ও সাহিত্যের ভিতর একটি দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ের পালা চলতে থাকে। অন্তত
রবীন্দ্রকাব্যের বিবর্তনের দিকে লক্ষ্য রাখলে বিষয়টি দেখা যায়। এই বিষয়ে আপনার
ব্যক্তিগত অভিমত। জানতে চাইছি বিস্তারিত আলোকপাতে।
বৈজয়ন্ত রাহা: অবশ্যই শাশ্বত মানবিক সংবেদনশীলতায় । আমি মানুষ
আগে, কবি পরে। আমি
মানুষের সুখ দুঃখ, ব্যথা বেদনা, কষ্ট যন্ত্রণার সাথে নিজের ব্যক্তিগত সুখ দুঃখ কষ্ট
যন্ত্রণা কে এক করেই লিখতে ভালোবাসি। কখনও কখনও সেই অনুভূতি থেকেই দার্শনিক ভাবনা
উদ্গত হয়। আমি জোর করে কোনো দর্শন লিখতে বসিনা। মনের একেবারে ভিতরের তন্ত্রীতে
কখনও মূর্ছনা উঠলে তা থেকে কবিতা বেরিয়ে আসে। আমি তাকে আমার সাহিত্যই বলব, হয়তো তার ভিতরে মিশে
থাকে আমার কোনো জীবনের উপলব্ধি। সমালোচক
পাঠক ঘাড় নেড়ে বলতেই পারেন, এ এক আশ্চর্য দর্শন। কিন্তু তা হয়তো পাঠকের মননে এর রূপ।
আমি সাহিত্যই রচনা করতে চাই। পাঠকের মন , পাঠকের চোখ তাকে অনেক সময়ই দর্শন হিসেবে গ্রহণ
করেন। আমার মনে হয়, কবি যখন তার ব্যক্তিগত আবেগকে , তার নিজস্ব জীবন দর্শনের আয়নায়
দেখেন,
সেখান
থেকে তার এক উপলব্ধির জগৎ তৈরী হয়, সেই উপলব্ধি কবিতার ভিতরে মিশে থাকে, তাই কবি যত প্রাজ্ঞ
হয়ে ওঠেন,
জীবন
পথের এক
একনিষ্ঠ পথিক হয়ে ওঠেন, তার কবিতা তত জীবন দর্শনের প্রভা বিলোতে থাকে। কবি
কিন্তু কবিতাই লেখেন। আমিও তাই বলি, আমি কবিতা লেখার চেষ্টা করি, দর্শন তৈরীর নয়।
সম্পাদক
রংরুট: সাহিত্যসাধনা বা কাব্যচর্চার
প্রসঙ্গে কবি জীবনানন্দ পরিচ্ছন্ন
কালজ্ঞান ও সুস্পষ্ট ইতিহাসচেতনার উপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। সাহিত্য সাধনার
ক্ষেত্রে একজন কবির জন্য এই পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান ও ইতিহাসচেতনা কতটা জরুরী বিষয় বলে
মনে করেন আপনি?
আপনার
নিজের কবিতায় এই বিষয়গুলি কতটা প্রাসঙ্গিক ও কিভাবে দেখা দেয়?
বৈজয়ন্ত রাহা: হ্যাঁ কবিতার
কথায় কবি জীবনানন্দ তাই বলেছেন। আমি আরও স্পষ্ট করে বলি , কবির কবিতা অবশ্যই স্বকালদর্পণ
হবে। তার কবিতার ক্যানভাসে, ধরা পড়বে এই সময়ের সমাজ, সমাজের চরিত্র, মানুষের মনন, চেতনা, অসহায়তা, বিপন্নতা, নিঃসঙ্গতা, যাতে বহুবছর পরেও
পঠিত হলে মানুষ এই সময়ের সঠিক চিত্রণ পায়।আর তার সাথে যুক্ত হয় পরিভাষা। ১৯৩০ এর
পরিভাষায় আজ যদি লিখি , কিম্বা রাবীন্দ্রিক ঘরাণায়, তাহলে কিন্তু সেই কবিতা ভালো
হলেও এই সময়ের কবিতা হয়ে উঠবে না।
কালজ্ঞান, এইটেই কিন্তু কালজ্ঞান, কোন সময়ে দাঁড়িয়ে আমি কি লিখছি। আমার আচমকা
বেরিয়ে আসা পংক্তিও কি সেই সময়নির্ভর নয়? হতে বাধ্য। কারণ কবি খুব সংবেদনশীল হন, তার ভিতরে এই সময়, এই সমাজের
অসামঞ্জস্যই তারের টংকার দেয়। হতে পারে তা তার ব্যক্তিগত আবেগ , হতে পারে তা তার
সমষ্টিগত আবেগ। কিন্তু তিনি এই সময়েরই এক প্রতিভূ। আর ইতিহাসজ্ঞান , ইতিহাসজ্ঞান মানে
পাঠ্যপুস্তকের ইতিহাস নয়, আমাদের পরম্পরা, আমাদের বিবর্তন, দেশ কাল সমাজের , এমনকী স্বজনেরও
বিবর্তন,
যার
পিছনে লুকিয়ে থাকে আর্থ সামাজিক কাঠামো পরিবর্তনের অমোঘ ছায়া। তাকে চিনতে হয়, তাকে জানতে হয়, নইলে সুদূরপ্রসারী
সুদূর প্রভাবী কবিতা উঠে আসে না কলমে।
আজ অবধি আমি যা
লিখেছি,
( ৩০০০
এর বেশি কবিতা) তার সবকটিই সেই অর্থে কাল আর ইতিহাসকে ভিতরে রেখেই।
সম্পাদক
রংরুট: মহাকবি টি এস এলিয়টের ভাষায়, “No poet,
no artist of any art, has his complete meaning alone. His significance, his
appreciation is the appreciation of his relation to the dead poets and
artists. You cannot value him alone; you
must set him for contrast and comparison among the dead.” আপনিও কি এলিয়টের মতো এই মতে বিশ্বাসী? আপনার নিজের কাব্য
সাধনায় কতটা সত্য এই দর্শন? অর্থাৎ আপনার কবিতার পাঠককেও কি আপনার কবিতা অনুধাবনে এই
পথেই অগ্রসর হতে পরামর্শ দেবেন আপনি? না’কি আপনার অবস্থান
কিছুটা ভিন্নমাত্রায়।
বৈজয়ন্ত রাহা: আমি এ কথাটা
প্রায়ই উচ্চারন করি, আগে জেনে নিও কি লিখবে না, তারপরে লিখো। নিজেকেও বলি , অপরকেও। যদি জানতে
হয় কি লিখব না,
তাহলে
অগ্রজদের পড়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। অগ্রজদের ভাবনা ধারণ করা ছাড়া অন্য কোনো
উপায় নেই। যা আগের পঞ্চাশ বছরে অনেক কবিই লিখেছেন, তা আবার লিখে কি লাভ? সেতো, কিছু মূর্খ
স্তাবকের সামনে এক মূর্খ উচ্চারন। যে
শ্রোতা কিছুই জানে না, তার সামনে যে কবি কিছুই পড়েনি, তার লেখা উপস্থাপন। একজন কবি
যদি তার পরম্পরা কে না জেনে, বিগতকালের সাহিত্য কে না জেনেবুঝে কলম ধরেন, তিনি ভুঁইফোড় হতে
পারেন,
যুগন্ধর
হবার সুযোগ নেই। যে কোনো শাশ্বত স্রষ্টা আসলে সেতু। বিগত কাল ও আগামীর সন্ধিক্ষণ
কে সে ঘোষণা করে। কবি তো স্রষ্টাই। আজ আমার কবিতা যদি মানুষের প্রশংসার কারণ হয়, তাহলে তা কি বিগত
কালের অযুত কবিকে পড়ার ফলস্বরূপ নয় ? আমি তো বিচ্ছিন্ন নই। তাই আমার কবিতাও বিচ্ছিন্ন
নয়। এই সভ্যতা,
এই
সাহিত্য সংস্কৃতির যে ধারা আদিযুগ থেকে প্রবহমান, আমি কি তার একটি অতীব ক্ষুদ্র
অংশ নই?
তাহলে
আমার সাহিত্য,
সেই
প্রবহমানতার একটি ধারা নয় কি? আমি যা কিছু পরীক্ষা নিরিক্ষা করিনা কেন, তা কি আগের বিপুল
সাহিত্য ইতিহাসের উপরে দাঁড়িয়ে নয়? আমার মতে, আমি আমার পাঠককে অবশ্যই পরামর্শ দেব, আমার আগের
সময়ের কবিদের পড়তে পড়তে আমার কাছে এসে
পৌঁছন,
সহজে
ধরতে পারবেন আমার পরিভাষা, সহজে বুঝবেন আমার কবিতার অন্তর্বর্তী আত্মাটি। চিনতে
পারবেন ভঙ্গীমা বদলের দিক। সহজে পৌঁছতে পারবেন বহুমাত্রিকতার সবকটি স্তরে।
সম্পাদক
রংরুট: ইংল্যাণ্ডজাত মার্কিন কবি ডবল্যু এইচ অডেন গভীর
ভাবে বিশ্বাস করতেন, একজন কবি সবিকিছুর আগে সেই ব্যক্তি যিনি তাঁর ভাষার প্রেমে পড়ে
গিয়েছেন। আমাদের এত ভালোবাসার এত দুর্দশা পীড়িত তবুও সংগ্রামী বাংলা ভাষার একজন
কবি হিসাবে এই বিষয়ে আপনার অবস্থান সম্বন্ধে যদি আলোকপাত করেন স্পষ্ট ভাবে। কবিতা
কি সত্যই এমন নিবিড় ভাবে বিশেষ কোন ভাষা নির্ভর হতে পারে? না’কি অডেনের এই মতকে আমরা
কবিতার নিজস্ব ভাষা বলে ধরে নেবো। যেমন চিত্রশিল্পের ভাষা, চলচিত্রের ভাষা ইত্যাদি।
বৈজয়ন্ত রাহা: কবিতা সর্বদাই সব কাঁটাতার অতিক্রম করে যায়। তা ভাষাভিত্তিক
নয় । মৌসুমী বায়ুর যেমন কোনো বেড়া নেই, আকাশের যেমন কোনো
ভৌগোলিক সীমা নেই, সমুদ্রের জলের যেমন নেই, তেমন ভাবেই কবিতার কোনো ভাষাভিত্তিক সীমা নেই।
মনে করিয়ে দিই,
কবি
জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি । এটি কিন্তু একটি বিখ্যাত বিদেশী কবিতার
ভাবানুবাদ। অথচ দেশ কাল ভাষার বেড়া টপকে তা বাংলার হয়ে উঠেছে। কবি সাধারণ ভাবে
মাতৃভাষায় কবিতা রচনা করেন। কারণ কান্নার ভাষা , স্বপ্নের ভাষা, প্রেমের ভাষা তিনি
মাতৃভাষাতেই প্রকাশ করেন সবচেয়ে ভালো। তিনি যে ভাষাতে তার নিজের বক্তব্য সবচেয়ে
ভালো ভাবে প্রকাশ করতে পারেন, তাতেই প্রকাশ করা তার উচিৎ। আমি যদি বিদেশের মাটিতে বড়
হয়ে উঠতাম,
সেখানকার
ভাষাতে বেশি সুবিধা অনুভব করতাম, তাহলে সেই ভাষাতেই করতাম। আমি জন্মুসূত্রে বাঙ্গালী ও
বাঙলা বলতে বলতেই বড় হয়েছি বলে, আমার আবেগের শৈল্পিক রূপকে প্রকাশ করার জন্য বাংলাকেই
সঠিক মনে করেছি। কবি প্রেমে পড়েন, তার নিজস্ব পরিভাষার, নিজস্ব স্টাইলের বা নিজস্ব
ঘরাণার। লেখার জন্য কোন ভাষাকে তিনি বেছে নিচ্ছেন সেই ভাষার নয়। আর রইল
দুর্দশাগ্রস্ত সংগ্রামী বাংলা ভাষার বিষয়।
সে, কোনো অন্য ভাষা এসে এই ভাষাকে দুর্দশায় ফেলেনি, বাঙ্গালীর মানসিকতা
তার ভাষাকে দুর্দশায় ফেলেছে। বাঙ্গালী যদি নিজের ভাষা নিয়ে নিজেই গর্বিত না হয়, তাহলে সেই ভাষাকে
বাঁচাবে কে?
আমরা
যদি নিজেরাই সন্তানাদিকে বাংলা মিডিয়ামের বদলে ক্রমাগত ইংরাজী মিডিয়ামে পড়াতে
পাঠাই,
তাহলে
বাংলা পড়বে আর কে? সমস্ত বাংলা মিডিয়াম স্কুল আজ ধু ধু করে, ছাত্র পাওয়া যায় না, এর জন্য দায়ী কে? চাকরি পেতে গেলে
ইংরাজী জানা প্রয়োজন, আঞ্চলিক ভাষা জানলে ভালো চাকরি পাওয়া যায় না---এই ধারনা কয়েক
প্রজন্মের ভিতর গেঁড়ে বসল কেন?ভাষা তো আসলে রাজনীতির বলি, সেটা আজ বুঝতে না পারার কোনো
কারণ নেই। এ বিষয়ে একটি ঘটনা বলি। আমি আমার পরিচিত সাহিত্য বৃত্তে গত একবছর একটি
খেলা চালু করেছি। বাড়ির সকলে সকালে ঘুম থেকে উঠে ১০ মিনিট টানা বাংলায় কথা বলবে, একটিও বিদেশী শব্দ
ব্যবহার না করে। চেয়ারকেও কেদারা বলবে, কাপ কে পেয়ালা বলবে। নিদেন পক্ষে ইংরাজী ও হিন্দি
শব্দ বাদ দেবে। না বলতে পারলে , ফাইন দেবে, সেটা একটি
পাত্রে জমা রাখবে। মাসের শেষে সেটা নিয়ে বাড়ির সকলে খেয়ে নেবে। মজার খেলা, কিন্তু এতে চর্চা
হবে বাংলা টা ,
বাংলাতে
কথা বলা। আমরা যা প্রায় বলিই না।
সম্পাদক রংরুট: ভাষার প্রসঙ্গই
যখন উঠলো,
তখন
বিশেষ করে জানতে ইচ্ছা করছে আমাদের এই বাংলাভাষা আপনার ব্যক্তিগত জীবনসত্যের সাথে
ঠিক কিভাবে জড়িয়ে আছে? না, শুধু মাত্র কবিতা লেখা বা সাহিত্যসাধানার একটি মাধ্যম হিসাবে নয়।
একজন অনুভুতিশীল সচেতন বাঙালি হিসাবে।
বৈজয়ন্ত রাহা: এই প্রশ্নের
উত্তর দেবার আগে আমি বলতে চাই, যে পত্রিকা থেকে
আমার এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে তার নামটি নিয়ে কিন্তু আমার ভিতরে একটু খচ খচ
করেছে। রংরূট,
আসলে wrong route নয় কি? কেন অন্য ভাষার শব্দ
নামকরণে ব্যবহার হল? যেহেতু ব্যক্তিজীবনে জোর করেই বাংলা চর্চা করতে হয়, করাতে হয়, এমনকি , অফিসেও, পাঠাগারে নতুন টাকা
বরাদ্দ হলে,
বাংলা
নয়, ইংরাজী ও হিন্দি বই কেনা হয়, তাই নিজস্ব বলয়ে একটা লড়াই
চলতেই থাকে। ত্রিভাষিক চুক্তি কোথাও প্রায় লাগু হয়নি কর্মক্ষেত্রে , বহু দাবী সত্ত্বেও।
আমি চেষ্টা করি বুক্তিগত দরখাস্ত থেকে যা কিছু লেখার , বাংলাতেই লেখার, এর জন্য অনেক ঝড়
ঝাপটাও আমাকে সামলাতে হয়। আগেই বলেছি, আমি আমার ব্যক্তিগত সাহিত্য বলয়ে একটি খেলার জন্ম
দিয়েছি। সেখানে পরের প্রজন্মের আড্ডা কেও শুনতে বলেছি আমার প্রজন্মকে, শুনে লজ্জিত হতে
বলেছি,
আমাদের
ছেলে মেয়েরা কিভাবে হিন্দি আর ইংরাজী মিশিয়ে আড্ডা মারে , একটু বাংলা বলে না। আমার পরের
প্রজন্ম না পড়ে রবীন্দ্রনাথ, না পড়ে বঙ্কিম , না পড়ে শরৎ, না তারাশঙ্কর, না বিভূতিভূষণ, আমি তাদের সাথে
পরিষ্কার বাংলাতে কথা বলি, তারা ইংরাজী বললেও বাংলাতেই বলি। এবং একারণে চক্ষুশূলও
হই। আমি বিশ্বাস করি, ব্যবহৃত কথ্য ভাষা যা হবে, সেই ভাষা বেঁচে থাকবে। সেই ভাষা প্রবহমান হবে, সেই নদীর ভিতর চর পড়বে না। দৈনন্দিন জীবনে বাংলাকে
প্রবহমানতা না দিলে ভাষাকে বাঁচানো মুশকিল হবে।
সম্পাদক
রংরুট: সাহিত্য দর্শন বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিবর্তনের পথে
আমরা যে অনেক দূর এগিয়ে এসেছি, সে কথা হয়তো বলাই যায়। কিন্তু সমাজ সংসার বিবর্তনের পথে
বিগত দুই হাজার বছরের হিসাবটুকুই যদি ধরি খৃষ্টাব্দের সূত্রে- তাহলে সত্যই কতটুকু
এগোলো মানুষের সমাজ সংসার সভ্যতা? আপনার মূল্যায়ন।
বৈজয়ন্ত রাহা: এই
মূল্যায়ন বলতে গেলে সেটি প্রকৃতপক্ষে
বিশাল আকার নেবে। প্রশ্নটি আসলে সমাজ
বিজ্ঞানের অন্তর্গত। দিন কাল এর বদলের সাথে সাথে বদলে যায় আর্থ সামাজিক কাঠামো। আর
এটার চেয়ে বড় সত্যি আর নেই, আর্থ সামাজিক কাঠামো বদলের সাথে সাথে মানুষের
মূল্যবোধের পরিবর্তন হয়। বদলে যায়
যাপনচিত্র। বদলে যায় সামাজিক সম্পর্কগুলির দিক। গত দুইহাজার বছর এক বিশাল
প্রেক্ষাপট। সমাজ চিত্রে যা ছিল বর্ণাশ্রম প্রথা , ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয় , বৈশ্য, শূদ্র, যেখানে পুরোহিত
ব্রাহ্মণ রা সমাজের শীর্ষে বসে ছড়ি
ঘোরাতেন ,
দেশের
অর্থ ও ক্ষমতা বন্টন হত ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের মধ্যে , অত্যাচারিত ক্ষেত্র
থাকত শূদ্ররা,
সে
প্রথা আজো একই ভাবে প্রবাহিত আমাদের আধুনিক সমাজে, হয়তো অন্য মুখোশে। অর্থের সঠিক
বন্টনই আনতে পারে সুষম অবস্থা। দেবদাসী প্রথা আজও বর্তমান অন্যরকম ভাবে, নারীর সম্মান , পুরুষ তান্ত্রিক
কাঠামোয় তখনও যা ছিল , আজকেও অনেকাংশে তাইই। সাহিত্য দর্শন বিজ্ঞান প্রযুক্তি হয়তো যাপন
চিত্র বদলেছে কিন্তু মূলগত মূল্যবোধের খুব পার্থক্য কিছু করেনি। বাংলা তথা ভারতীয়
সমাজ ও সভ্যতা এখনও ভন্ডামি ছেড়ে নির্মোহে যেতে পারে নি। অন্তত আমার তাই মনে হয়।
সম্পাদক
রংরুট: সবশেষে এসে জানতে চাইবো আপনার ব্যক্তিগত সাহিত্য
সাধনার পাশাপাশি সমসাময়িক কার কার কবিতাচর্চা আপনাকে বিশেষ ভাবে উদ্বুদ্ধ করে, যেখান থেকে বাঙলা
কাব্যসাহিত্যের অদূর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আপনি প্রবল ভাবে আশাবাদী ভুমিতে অবস্থান
করতে পারেন।
বৈজয়ন্ত রাহা: বহু বহু নাম
করতে হয়,
বহু
অগ্রজ ও অনুজ কবির। বহু কবির নাম উল্লেখ করতে ভুলে গেলে তাদের চক্ষুশূল হবার ভয়
থাকে। তবু যাদের চোখে পড়ে, তাদের কারোর কারোর নাম বলার চেষ্টা করি। বহু অগ্রজ
গুরুপ্রতিম কবি শ্রী শঙ্খ ঘোষ ধারাবাহিক এখনও লিখছেন, লিখছেন শ্রী কমল দে সিকদার, কবি কৃষ্ণা বসু, অরুণ কুমার
চক্রবর্তী,
মঞ্জুভাষ
মিত্র,
অনন্ত
দাস, রণজিত দাশ, অরূণাচল দত্ত চৌধুরী, মৃনাল বসু চৌধুরী, রত্নেশ্বর হাজরা, অমলেন্দু বিশ্বাস, সৌমিত বসু, রাহুল পুরোকায়স্থ, ও অনুজদের মধ্যে
সুমন ধারা শর্মা, সুমন রায়, রাহুল গুহ, দয়াময় পোদ্দার, রেহান কৌশিক, অজিতেশ নাগ, রাকা দাশগুপ্ত , শৌভিক গাঙ্গুলী, শৌভিক ভট্টাচার্য, নিলয় নন্দী ---অন্তত
অনুজদের কলম আমাকে বেশ আশাবাদী করে তোলে, ভাবতে ভালো লাগে এরকম আরও বহু কলম কবিতাকে তার
বিবর্তনের পথে অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে যাবে।
বৈজয়ন্ত রাহা:
জন্ম মেদিনিপুরের ঝাড়গ্রামে, সুবর্ণরেখা নদীর তীরে। পরে কলকাতায় আসা। বরানগরের ডি
গুপ্ত লেনের ভাড়া বাড়িতে। সময়টা সেই উত্তাল পশ্চিমবঙ্গের সময়, ৭০-৭২ সাল। দাদা
নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায়, সেখান থেকে পালিয়ে আসতে হয় উল্টোডাঙার আবাসনে।
জ্যাঠামশাই ও বাবা বামপন্থী আন্দোলনের সংগে যুক্ত ছিলেন,
তাই প্রায়ই তাদের আত্মগোপন করতে হত। বৃত্তি
পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে পাশ করায় বারো ক্লাস পর্যন্ত পড়ার খরচ লাগে নি,
নিজের চেষ্টায় সরকারি স্কুলে ভর্তি এবং
অবৈতনিক ভাবে বারো ক্লাস অবধি পড়াশুনা সমাপন। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অত্যন্ত ভালো ফল
থাকায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা করার সুযোগ হয়। কিন্তু অকাল পিতৃ বিয়োগের কারণে
মাস্টার্স করার সময়ে সংসার চালানোর জন্য কেন্দ্রিয় সরকারের চাকরিতে যোগদান করেন। আজও সেখানেই আছেন। মাস্টার্স শেষ করেন এপ্পলায়েড জিওলজি
(বি টেক) নিয়ে যাদবপুর থেকেই। ঠাকুর্দা আর বাবার সাহচর্যের কারণে ছোট থেকে সাহিত্য
ও নাট্যমণ্ডলে একটি নিজস্ব বৃত্ত গড়ে ওঠে। ছাত্রজীবনেই প্রথম যৌথ কাব্যগ্রন্থ “সময়ের
অঝোরে” প্রকাশিত হয়। তারপর ধীরে ধীরে আরও ১১ টি গ্রন্থ। এর মধ্যে ৬ টি গ্রন্থই
নানান পুরস্কারে ভূষিত।
কপিরাইট রংরুট
কর্তৃক সংরক্ষিত
অনবদ্য একটি সাক্ষাৎকার।
উত্তরমুছুন