মুখোমুখি পৃথা রায় চৌধুরী



মুখোমুখি পৃথা রায় চৌধুরী


সম্পাদক: সকলের আগে ত্রৈমাসিক রংরুটের পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। রংরুটের এই বিশেষ সংখ্যায় আপনাকে স্বাগতম। প্রথমেই যে বিষয়টি জানতে চাইবো সেটি হলো, সাহিত্যই বা কেন? অর্থাৎ সাহিত্য ছাড়া আরও তো অনেক বিষয় রয়েছে। সেখানে সাহিত্য নিয়ে আপনার আগ্রহের উৎস কি? এবং মোটামুটি ভাবে জীবনের কোন পর্যায় থেকে সাহিত্য বিষয়ে এই আগ্রহের সূত্রপাত। এবং এই বিষয়ে বিশেষ কারুর প্রভাব যদি থেকে থাকে আপনার জীবনে।

পৃথা রায় চৌধুরী: ত্রৈমাসিক রংরুটকে অসংখ্য ধন্যবাদ ও অজস্র শুভ কামনা জানাই আমন্ত্রণের জন্য। সাহিত্যজগতে নিজস্ব স্বাক্ষর থাকবে রংরুটের, এ বেশ বোঝা যায়, রংরুটের প্রতিটা সংখ্যা থেকেই। সাহিত্য নিয়ে আগ্রহের উৎস? এ কিন্তু ভারি কঠিন প্রশ্ন। এই প্রসঙ্গে একটা ছোট ঘটনার কথা বলি। আপাতদৃষ্টিতে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও হতে পারে, কিন্তু বলেই ফেলি। আমি বিয়ের পরে কিছুকাল দিল্লিতে থেকেছি। তো সেখানকার বাঙালিদের মধ্যে বেশ ভালোবাসা ছিল। আমার স্বামীর সাথে একই অফিসে একজন কাজ চাকরি করতেন। সেই দাদা বিবাহিত ছিলেন, তাঁর স্ত্রীকে যদিও বিন্দুমাত্র রান্নাবান্না কিছুই করতে হতো না। অথচ পরিপাটী করে বাঙালি ঘরের খাওয়াদাওয়া, আমাদের বা আরও বন্ধুবান্ধবদের নেমন্তন্ন করে খাওয়ানো, এসব করতেন উনি। নিজে গুছিয়ে বাজার করতেন, এমনকি কোন রান্নায় ঠিক কোন মশলাটা না হলেই নয়, অমুক পোলাওয়ে অমুক রকম চাল লাগে সেসব দেখে শুনে কিনে গুছিয়ে রান্না করতেন। 


একবার জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলাম, দাদা এসব করার এনার্জি পান কোত্থেকে? এই সারাদিন অফিস, তারপর এসব করতে ক্লান্তি আসে না? ওঁর উত্তর আমার আজও মনে আছে—“আমার রান্না করতে দারুউউউণ লাগে! ঠিক মনের মতো করে রোজকার রান্না, যে কোনও স্পেশাল রান্না, সব কিছু করতে আমার দারুণ লাগে। বেশ ভেতরে একটা আনন্দ উথলে ওঠে”। আর কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হয়নি। এই যে আনন্দ হতো ওঁর, এটাই কি আগ্রহের উৎস নয়? এই সাহিত্য আমাকে আনন্দ দেয়, স্রেফ আনন্দ। সাহিত্য আলোচনা অবশ্যই গুরুগম্ভীর বিষয়, কিন্তু তাও সঠিক ভাবে করতে জানলে আনন্দেরই হয়ে ওঠে আমার কাছে।

সাহিত্য বিষয়ে আগ্রহের সূত্রপাত তো সেই কোন ছোটবেলা থেকে, যখন ধরুন মা বা দিদু (মায়ের মা) ঠাকুমার ঝুলি পড়ে শোনাত, বা মা মুখে মুখে রবি ঠাকুরের “তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে...” বা “মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে...” মুখস্থ করিয়ে দিতো, বা বাবা আর মা দুজনেই ছোটছোট পত্রিকা, যেমন ‘চাঁদমামা’, ‘শুকতারা’, ‘আনন্দমেলা’ এসব কিনে দিতো সারা মাস-বছর জুড়ে। আমি ধানবাদে মানুষ। আগে বিহারের অন্তর্গত ছিল, এখন ঝাড়খণ্ডের অন্তর্গত। মা ছিল সেখানকার কলেজের বাংলার অধ্যাপিকা। এইসব নানা কিছু মিলিয়ে মিশিয়েই বোধহয় সাহিত্যটা ঢুকে পড়েছিলো ভেতরে। আর হ্যাঁ, সাহিত্য কিন্তু শুধু বাংলা নয়, পুরোদস্তুর ইংরেজি আর হিন্দি ভাষাতেও আমার ভেতরে ঢুকে পড়েছিলো। ধানবাদিয়া ছিলাম, পড়তাম ইংরেজি মাধ্যম কনভেন্টে। হিন্দি আর ইংরেজিটাই শুধু ভেতরে থাকার সম্ভাবনা প্রবল ছিল, কিন্তু মা আর বাবার প্রচুর পরিমাণে কিনে দেওয়া ইংরেজি বইয়ের সাথে সব বাংলা বইগুলো গোগ্রাসে গিলতে গিলতে বাংলা একেবারে গ্যাঁট হয়ে ভেতরে বসে পড়লো।

সাহিত্য বিষয়ে বিশেষ কারুর প্রভাব সেই সময় তো অবশ্যই রয়েছে। বাবা, মা, আমাদের স্কুলের বাংলা শিক্ষিকা শ্রীমতী মায়া মুখার্জি মিস্‌ (আমরা শিক্ষিকাদের মিস্‌ বলতাম), আমাদের একজন ইংরেজির শিক্ষিকা শ্রীমতী অচলা সচদেব মিস্‌ এবং আমার বাবার বন্ধুস্থানীয় শ্রী সুধাংশু মুখার্জি, যিনি পেশাগত দিক থেকে উকিল ছিলেন, এবং ইংরেজি সাহিত্যকে বোধকরি গুলে খেয়েছিলেন। বেশ মনে আছে, আমার আই.সি.এস.ই.-র পরে তাঁর সংগ্রহে থাকা ‘The Complete Works of William Shakespeare’ নিয়ে গেছিলাম বাড়ি, ঠিক এক সপ্তাহের ভেতর পড়ে শেষ করেছিলাম। হয়তো সবটা তখন বুঝিনি, কিন্তু পুরোটা পড়েছিলাম।  


সম্পাদক: এবারে আসি প্রথম লেখার বিষয়ে। লেখালেখির ভিতরে যে অপার আনন্দ, সেই আনন্দের প্রথম অভিজ্ঞতা কেমন ছিল আপনার? একটু বিস্তারিত ভাবে বলেন যদি।

পৃথা রায় চৌধুরী: পৃথা রায় চৌধুরী: প্রথম লেখা যে কী ছিলো, তা মনে পড়ে না আর। নিশ্চয় বাকি সবার মতোই ছোটবেলায় ক্লাসে বসে বা হোমওয়ার্কে লেখা কোনও রচনা হবে। তবে প্রথম আমার লেখা নিয়ে আমি ক্লাস ফাইভে বা সিক্সে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। আমার একটা গল্প ‘শুকতারা’য় কোনও একটা সংখ্যায় কোনও একজনের স্মৃতিতে সাহিত্য পুরস্কারে প্রথম বা দ্বিতীয় না হলেও, কিছু ভালো লাগা গল্পের মধ্যে বিবেচিত হয়েছিলো। পত্রিকায় সেই জন্য আমার নামও ছাপা হয়েছিলো। নিজের নাম সেই প্রথম ছাপার অক্ষরে দেখার সে কী আনন্দের ছিল, সে আজও ভুলতে পারিনি।


সম্পাদক: ব্যক্তিগত জীবনে আপনার বড়ো হয়ে ওঠা, লেখাপড়ার সাথে সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা কখনো কি কোন সমস্যার সৃষ্টি করেছিল? বিশেষ করে পেশাগত জীবনে প্রবেশের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার পর্যায়ে?

পৃথা রায় চৌধুরী: আমি বিজ্ঞানের ছাত্রী, আর তাই সাহিত্যের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী অর্জন করে ওঠা হয়নি আমার, সাহিত্যের গভীরে গিয়ে পড়াশোনা, তাও আমার হয়ে ওঠেনি, কিন্তু বই পড়েছি প্রচুর... বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, যা পেয়েছি, পড়েছি। মদ খেয়ে যেমন মাতাল হয়, আমি বইয়ের নেশায় বুঁদ থাকতাম। জানেন তো, পড়ার বইয়ের ভেতর গল্পের বই লুকিয়ে পড়তে গিয়ে কতো বার যে ধরা পড়েছি বাবা-মার হাতে, আর তারপর বেশ করে উত্তমমধ্যম খেয়েছি মায়ের কাছে, তা ভাবলে আজও খুব হাসি পায়। বাবা-মা বই পড়তে উৎসাহ দিতো, নিজেরা বই কিনে দিতো, লাইব্রেরি থেকে আনতে দিতো, কিন্তু লেখাপড়ার সময় সেটা করলে বাকি সবার মা-বাবার মতোই সাংঘাতিক রেগে যেতো। খুব ইচ্ছে ছিল ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ার, কিন্তু বাবা-মার ইচ্ছেয় তা আর হয়নি। নাই বা হলো, বই পড়তে পারলেই হল। তাই এখন আর সে বিষয়ে আফসোস নেই কোনও।

আমি কিন্তু পড়াশোনায় মারাত্মক ফাঁকিবাজ ছিলাম। সবাই বলতো, আমার নাকি খুব “শার্প ব্রেন”। তা সেই শার্প ব্রেনের জন্যই হোক আর যাই হোক, উতরেও যেতাম সব কিছুতে ঠিকঠাক ভাবে। হ্যাঁ, ঠিকঠাক ভাবেই... ফার্স্ট সেকেন্ড হতাম না, কিন্তু ছজনের মধ্যে থাকতাম আর কি। পেশাগত জীবনে (যার আয়ু খুবই স্বল্প), সাহিত্যচর্চার সেভাবে কোনও সময় বা সুযোগ পাইনি। এই ধরুন বছর তিনেক। কিন্তু তারপর চাকরি ছেড়ে দেবার পরে, সংসার সামলেও বই বা নিদেন খবরের কাগজের ক্রোড়পত্র, সব খুব খুঁটিয়ে পড়তাম। শব্দজব্দ বা শব্দসন্ধান গুলো রোজ পুরোপুরি সমাধান করা আমার নেশা ছিল। কতো যে নতুন শব্দ শিখতে পারতাম সেসব থেকে!


সম্পাদক: সাহিত্যের প্রতি আপনার এই ভালোবাসার প্রথম দিকে কোন ধরণের সাহিত্যের প্রতি আপনার অধিকতর আগ্রহ ছিল? অর্থাৎ গল্প কবিতা উপন্যাস। নাটক প্রবন্ধ ইত্যাদি। এবং এই প্রথম পর্যায়ে কোন কোন লেখকের লেখা আপনাকে বেশি করে টানতো?

পৃথা রায় চৌধুরী: আমার সাহিত্যে আগ্রহের প্রথম দিকে কেবল গল্প, উপন্যাস আর নাটকের প্রতি আগ্রহ ছিল। প্রবন্ধ দেখলেই উলটো দিকে দৌড় লাগাতাম। কবিতা তো সেইভাবে আলাদা করে সুকুমার রায়, রবি ঠাকুর, কাজী নজরুল, মাইকেল, এঁদের ছাড়া আর কিছু পড়িনি তখন। ইংরেজিতে শেলি, বায়রন, কীট্‌স, ব্রাউনিং, ইত্যাদিদের ছাড়া, মানে পাঠ্যবইয়ে যাদের লেখা থাকতো, তাদের কবিতা ভালো লাগলে, তাদেরই বই কিনে বা লাইব্রেরি থেকে নিয়ে পড়তাম। গল্প, উপন্যাসের লেখকদের সবার লেখাই টানত মনে হয়। কারণ, আমি খেতে বসেও বই থেকে চখ সরাতাম না, সে যার লেখাই হোক না কেন। লোকে ভাবে আমি বানিয়ে বলছি, কিন্তু এটাই সত্যি যে শরৎচন্দ্র ঠিক যতটা ভালোবেসে পড়েছি, বঙ্কিমচন্দ্রও ঠিক ততোটাই ভালোবেসে পড়েছি, আবার মধুসূদন রচনাবলীও নেশাগ্রস্ত করে তুলেছে আমাকে। আর তা সেই সময়েই। আমাদের সময়ে ইংরেজি লেখক ক্যারোলিন কীন, এনিড ব্লাইটন পড়তো সবাই... আমিও পড়তাম, অথচ পাশাপাশি আমি শেক্সপিয়ার পড়েছি, রাস্কিন বন্ড পড়েছি, কোনান ডয়েল, আগাথা ক্রিস্টি, রবার্ট লুইস স্টিভেনসন, মার্ক টোয়েন পড়েছি। এত যে নাম বললাম, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের নাম বলতেই ভুলে গেছিলাম। ওঁর লেখা যে কী পরিমাণ টানত, তা ভুলেই বা যাই কীভাবে! নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, লীলা মজুমদার, আশাপূর্ণা দেবী, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সত্যজিৎ রায়, আর কতো নাম বলি বলুন তো? বলতে বলতে থামাই যাবে না বোধহয়।


সম্পাদক: আপনার নিজের লেখার বিষয়ে, কোন বিশেষ লেখকের প্রভাব সম্বন্ধে আপনি কি সচেতন? যেমন, অনেকেই আমরা আমাদের খুব প্রিয় লেখকের দ্বারা মনের অজান্তেই প্রভাবিত হয়ে পড়তে পারি। আবার অত্যন্ত সচেতন ভাবে প্রিয়তম লেখকের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার প্রয়াসও করতে পারি। আপনার নিজের  লেখালেখির ক্ষেত্রে বিষয়টি ঠিক কি রকম?

পৃথা রায় চৌধুরী: জ্ঞানত আমার লেখার মধ্যে আমার পঠিত কোনও লেখকের প্রভাব পড়ুক বা না পড়ুক, এই ব্যাপারটা আমার কখনও মাথাতে আসেনি। সত্যি বলতে কী, আমি যে এভাবে লেখালিখির মধ্যে, বা বলা যেতে পারে সাহিত্যজগতের মধ্যে নিজের কলম বাগিয়ে ঢুকে পড়বো, এটাই তো কোনোদিন ভাবিনি। এমনি এমনি কোনও খাতার পেছনের পাতায় বা হিসেব লেখা কোনও কাগজের পেছনে এটা সেটা মাথায় আসলে লিখে ফেলতাম, কিন্তু সেসব নিয়ে সাহিত্যের আঙ্গিনায় যে আমিও নিজের কলমকে কখন বসিয়ে ফেলেছি, নিজেও জানি না। আর আমার লেখালিখিতে কারুর প্রভাব না থাকাই স্বাভাবিক, কারণ আমার মাথায় হঠাৎ কোনও ভাবনা এলে, ঠিক আমার মতো স্বাধীন ভাবে আমার কলমকে চলতে দিই। তখন আমার মাথায় আমার প্রিয় কোনও লেখকের কথাই থাকে না। সেই সময় থাকি শুধু আমি আর আমার চিন্তা মাখা কলম। 


সম্পাদক: লেখালেখির সাথে নিরন্তর বই পড়ার একটা গভীর সংযোগ রয়েছে। বর্তমানের গতিময় জীবনে হয়তো সবসময় সেই সম্পর্ক অটুট রাখা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তবুও এই সময়ে দাঁড়িয়ে আপনি কোন ধরণের বই পড়তে বেশি আগ্রহী। এবং কোন কোন লেখক আপনাকে এই সময়ে বেশি করে কাছে টানেন তাঁদের লেখার গুণে।

পৃথা রায় চৌধুরী: লেখালেখির সাথে নিরন্তর বই পড়ার একটা গভীর সংযোগ রয়েছে, তা আমার মতে একেবারে সঠিক। তবে হ্যাঁ, ঠিক যেমন প্রচুর বই পড়লেই ভালো লেখক হওয়া যায় না, তেমনই সব লেখক/ কবিরাই যে বিরাট পড়ুয়া, তাও কিন্তু নয়। খেয়াল করে দেখলে আবার এটাও মাথায় আসে, এই যে আমরা নানা লোকগীতি শুনি, নানা ছড়া শুনি, তাদের রচয়িতারা কি প্রচুর বই পড়তেন? প্রচুর বই পড়া ছাড়াই কতশত গান লিখে গেছেন কবীর, সুরদাস, লালন, রামপ্রসাদ, তাই না? চিরন্তন ভাবে চলে আসা আমাদের ঐতিহ্যের শেকড়ে বসে থাকা বহু গানের কথা বা নানা সুরারোপিত লোকগাথা, এসব কিন্তু প্রচুর বই পড়ার ফসল নয়। মনের ভাব দিয়ে গান কবিতা অবশ্যই লেখা যায়, কিন্তু গল্প-উপন্যাস-নাটক, এসব লিখতে হলে বই পড়ার একটা অভ্যেস অবশ্যই থাকতে হবে। এখনকার নিরিখে আমি মনে করি, প্রচুর বই পড়া উচিৎ, কিন্তু নিজের লেখায় তার থেকে আহরিত জ্ঞানটুকুই ব্যবহার্য, পঠিত বইগুলোর মতো লিখতে চেষ্টা না করাই উচিৎ। অর্থাৎ, বই থেকে জ্ঞানার্জন করে নিজস্বতায় পরিপূর্ণ লেখা হওয়া উচিৎ। 


সম্পাদক: আপনার নিজের লেখা কয়টি ও কি কি বই প্রকাশিত হয়েছে যদি বলেন। এবং বইগুলির বিষয়বস্তু ও সেই সম্বন্ধে আপনার ভালোলাগা তৃপ্তির দিকগুলিকে আমাদের পাঠকের সামনে একটি যদি বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেণ।

পৃথা রায় চৌধুরী: আমার এযাবৎ সাতটি একক কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে— ‘মন্দ মেয়ের সেল্‌ফি’, ‘জন্মান্তরে সিসিফাস’, ‘শব্দ এক পুরুষপাখি’, ‘ঘড়ির তেরো নম্বর কাঁটা’, ‘চতুর্থ প্রহরে নক্ষত্রের ছায়া’, ‘মায়াকীয়া’, আর ‘মুরাল তন্ত্র’। এছাড়া দুটো কাব্য সংকলন রয়েছে, দুজন এবং ছয়জন কবির। কবিতার বইগুলোর আলাদাভাবে বিষয়বস্তু এককথায় কী বলি বলুন তো? এই বইগুলোয় কবিতায় ধরা আছে প্রেম, ঈশ্বরভাবনা, আমাদের যাপন নিয়ে কিছু ভাবনা, আবার কোথাও কবিতায় আছে মিস্টিক ছবি। আমার ভালোলাগা নিয়ে বলতে গেলে এটাই বলবো, আমার বই ঠিক কতটা সুখপাঠ্য, বা তৃপ্তিদায়ক, তা বলতে পারবেন কেবল পাঠক। নিজে কতটা তৃপ্ত বলতে গেলে হয়তো নিজের সন্তানের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট মা-বাবার মতো শোনাবে, তাই না?


সম্পাদক: বর্তমান সময়ে একটি বই প্রকাশ করতে গিয়ে একজন লেখককে সাধারণত কি কি ধরণের সমস্যায় পড়তে হয়। আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এই বিষয়ে যদি আলোকপাত করেন।

পৃথা রায় চৌধুরী: বর্তমান সময়ে বই প্রকাশ করতে গেলে নতুন যারা লিখতে এসেছে, তাদের বহু সমস্যায় পড়তে হয়। আমিও পড়েছি, মারাত্মকভাবে পড়েছি। এখন ধীরে ধীরে নিজে অনেক কিছু বুঝতে শিখেছি। প্রথমত নতুন লেখক লেখিকাদের বই বিনা পয়সায় ছাপতে চান না কোনও প্রকাশক। তারা তাদের ব্যবসায়িক দিক থেকে ঠিক করেন। একজন কারুর ওপর তারা কোন ভরসায় বিনিয়োগ করবেন? তারা তাদের বিনিয়োগের পরে লাভ হবে কিনা, তা তো দেখবেন অবশ্যই। সুতরাং বাজারে চলতি লেখক ছাড়া তারা বিনিপয়সায় নতুনদের জন্য কিচ্ছুটি করবেন না, এটাই স্বাভাবিক। আবার কেউ কেউ আছেন, যারা বিনি পয়সায় বই ছাপিয়ে দেন, কিন্তু বিক্রির লভ্যাংশ সম্পূর্ণ নিজের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেন। আবার কিছু অসাধু প্রকাশক রয়েছে যারা বই ছাপিয়ে দেবার বাবদ আনকোরা লেখকদের থেকে টাকা নিয়ে প্রাপ্য বই ছাপিয়ে দেয় না, ছাপিয়ে দিলেও সে বই বিক্রি করার দায়িত্ব চাপিয়ে দেয় লেখকেরই কাঁধে। নিজে থেকে সে সব প্রকাশক কিছু বই বিক্রি করলেও, লেখককে বিক্রি হয়নির দোহাই দিয়ে এক কানাকড়িও রয়্যালটি দেয় না। মানে ব্যাপার খুবই ভজঘট আর কী! আবার সেখানেই কিছু প্রকাশক আছেন, যারা বিনিপয়সায় সৎ ভাবে নতুন পুরনো না বেছে এগিয়ে আসেন শুধু লেখার মান বুঝে বই ছাপাতে। এমন প্রচুর লেখক রয়েছে, তারা হঠাৎ করে ‘বই রয়েছে, আমি লেখক’ হয়ে ওঠে। তারা কোনও পত্রপত্রিকায় নিজেদের লেখা না পাঠিয়েই পয়সাকড়ি দিয়ে দিব্য বইটই ছাপিয়ে ফেলে। নিজেকে মহান বলি না, কিন্তু এটা বলি, এদের একবার অন্তত ভেবে দেখা উচিৎ, তাদের লেখাগুলো বই দূর অস্ত, আদৌ ছাপার যোগ্য তো? প্রত্যেকের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি, ইদানিং বই বের করার এত ব্যস্ততা সবার মধ্যে, একেক সময় নিজের মনে হয় এ যেন এক না থামতে যাওয়া অহেতুক ইঁদুর দৌড়। প্রথমে পয়সা দিয়েই বই করেছি, ইদানিং আর করি না। অপেক্ষা করি, কেউ আমার লেখার গুণে বই প্রকাশে ইচ্ছুক হলে, তবেই এগোই। নতুনদের সুযোগ দেওয়া উচিৎ, কিন্তু তাদের বই সরাসরি করার আগে, তাকেও ঘষেমেজে নেবার প্রয়োজন হয় বইকি। আর প্রতিষ্ঠিত প্রকাশকেরা নতুনদের ওপর সামান্য হলেও দৃষ্টিপাত করুন, এটাই চাইবো। তাদের হাত ধরে উঠে আসুক সাহিত্যের নতুন দিশারীরা শুধু সাহিত্যকে ভালোবেসে। 


সম্পাদক: আপনার নিজের লেখার বিষয়ে কখনো কি মনে হয়েছে, একটি গণ্ডীর ভিতরেই আটকিয়ে যাচ্ছে আপনার যাবতীয় লেখালেখি। সাধারণত আমাদের অধিকাংশই কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে আত্মনির্মিত নিজস্ব গন্ডীর ভিতরেই আটকিয়ে যাই। অনেকেই হয়তো খেয়াল করি না। আবার অনেকেই হয়তো সচেতন ভাবে সেই গণ্ডীর ভিতর থেকে নিজেকে মুক্ত করতে প্রয়াসী হন। আপনার লেখালেখি ও আপনার ব্যক্তিগত উপলব্ধি থেকে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত যদি করেন।

পৃথা রায় চৌধুরী: আমি মূলত কবিতা লিখি। ২০১২-২০১৩য় যে সব কবিতা লিখেছি, এখন পড়লে বুঝি, তা কোথাও একটা পরিধির মধ্যে ঘোরাফেরা করতো। গুণী গুরুজনেরা, প্রতিষ্ঠিত কবি ও লেখকেরা স্নেহে বুঝিয়ে দিয়েছেন নিজেকে ভাঙ্গার কথা। প্রথম দিকে তা করতে গিয়ে কিছুটা এলোমেলো লাগতো, কিন্তু সেসব কাটিয়ে এখন যখন লিখি, তখন বাঁধভাঙা বন্যার মতো বেরিয়ে আসে কোনও চেনা গত বা পরিধি না মেনে। এমনও হয়, ভেবেছি একরকম, কিন্তু লেখার সময় মন বলেছে, ওটা গতানুগতিক, অন্য কিছু হোক!


সম্পাদক: সবশেষে জানতে চাইবো, বর্তমান সমাজ সভ্যতায় দাঁড়িয়ে আজকের বাংলা সাহিত্যের বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন। এবং বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আপনি কতটা আশাবাদী ও কেন?

পৃথা রায় চৌধুরী: লেখিকার থেকে বেশি আমি একজন পড়ুয়া আসলে। খুব পড়তে ভালোবাসি। সংসারের নানা কাজ করতে করতে মনে হয়, ইস্‌, কতো সময় চলে যাচ্ছে, পড়তে পারছি না! একেকবার এটাও মনে হয়, শুধু বই পড়ার জন্য একটা গোটা জীবন কেন পাওয়া যায় না? বড্ড আজগুবি সব ভাবনা, এটা বুঝি। আসি প্রশ্নের উত্তরে— বাংলা সাহিত্য আজ যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানে দাঁড়িয়ে এটা বোঝা যায়, সাহিত্যের আসরে স্বর্ণ সিংহাসন তার আরক্ষিতই রয়েছে, কিন্তু মানুষ আজও তাদের দ্বিচারিতা থেকে বেরিয়ে আসতে দ্বিধাবোধ করে। কথ্য  ভাষায় দৈনন্দিনের কথা লিখে সাহিত্য রচনা করতে কোথাও একটা তার জড়তা আছে আজও। তাই তারা আজও শ্লীল বা অশ্লীল নিয়ে চাপানউতোরে জড়ায়। ভালো সমসাময়িক প্রাসঙ্গিক সাহিত্যকর্মকে অশ্লীল দাগিয়ে দিয়ে লেখকের ওপর ছাপ্পা মেরে বলে “আরে, ও তো পানু লেখে!” বা “ওর তো সারা লেখা জুড়ে খিস্তি খেউড়!” একবার ভাবুন, সমাজের চিত্র তুলে ধরছি হয়তো কোনও গল্পে, আদ্যন্ত অশিক্ষিত, অমার্জিত, জেলখাটা আসামীর কথা হয়তো লিখছি, তার মুখের ভাষা আর পাশের পাড়ায় থাকা অধ্যাপক মশাইয়ের মুখের ভাষা কি এক হবে? আবার বাংলা সাহিত্যে এক অদ্ভুত বৈষম্য রয়েছে লেখক আর লেখিকাদের ব্যাপারে। ঐ যে খিস্তিখেউড় বা গালিগালাজ বা কথ্য স্ল্যাং নিজেদের লেখায় ব্যবহার করলে পুরুষ লেখকরা শুধু পার পেয়ে যান, তা নয়, উলটে তাদের ধন্য ধন্যও করা হয়। অথচ একই কাজ লেখিকারা করলে তাদের গায়ে কুৎসিত সমস্ত বিশেষণের তকমা এঁটে দেওয়া হয়, এমনকি তাদের চারিত্রিক দোষের ঝাঁপি খুলে বসে অনেকেই। অর্থাৎ, লেখিকারা শুধু নাকে কাঁদবে, ফুল-লতা-চাঁদ লিখবে, জীবনের হুতাশ লিখবে, এই অনুমোদন করবে বাংলা সাহিত্য?! এখন অবশ্য সেসব শেকল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসছে অনেকে, বেরিয়ে এসেছি আমিও। এত যে কথা বললাম, এককথায় শেষ করি, আমার মাতৃভাষার জয়জয়কার হবে আরও, ভবিষ্যতে বাংলা সাহিত্য প্রভূত উন্নতির পথে এগিয়ে চলেছে। সাহিত্যজগতকে ব্র্যান্ডনেম লেখকদের পাশাপাশি সুযোগ দিতে হবে বাকি সুলেখকদেরও। নাহলে সাহিত্য শুধু ব্র্যান্ডেড অবধি সীমিত থেকে যাবে, অনাদরে হারিয়ে যাবে সাহিত্যের অজস্র মণিমাণিক্য।  


পৃথা রায় চৌধুরী: জন্মস্থান ভারতবর্ষের ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ শহরে। সাহিত্য চর্চা শুরু, ছোটবেলা স্কুলে থাকতেই। প্রাণীবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ও পরিবেশ বিজ্ঞানে ডক্টরেট। এপার ওপার বাংলার বিভিন্ন প্রিন্ট পত্রিকা ও অনলাইন ওয়েবম্যাগ ও ব্লগে নিয়মিত কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ লেখালিখি করি ২০১২ সাল থেকেই। নিজের একক কাব্যগ্রন্থ সাতটি... "মন্দ মেয়ের সেলফি", "জন্মান্তরে সিসিফাস", "শব্দ এক পুরুষপাখি", "চতুর্থ প্রহরে নক্ষত্রের ছায়া", "ঘড়ির তেরো নম্বর কাঁটা", "মায়াকীয়া" ও “মুরাল তন্ত্র”। এ ছাড়া এপার ওপার বাংলার বিভিন্ন কবিতা সংকলনে স্থান পেয়েছে আমার কবিতা। কিছু কাব্য সঙ্কলনের সম্পাদনা করেছি ও ক্ষেপচুরিয়াস নামক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর মধ্যে, "আমি অনন্যা" পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর মধ্যেও আছি এবং 'শহর' পত্রিকার সহ সম্পাদকের দায়িত্বেও আছি। ২০১৬ সালে “শব্দের মিছিল” সাহিত্য গোষ্ঠীর তরফ থেকে “আত্মার স্পন্দন” ১৪২৩ সম্মানপ্রাপ্ত হয়েছি।


কপিরাইট রংরুট কর্তৃক সংরক্ষিত


৬টি মন্তব্য:

  1. বুবলি তোর সম্পূর্ণ নিবেদন-বর্ণন-বিবৃতি গোগ্ৰাসে গিললাম আমি। ছোটবেলা থেকেই তোর সাহিত্য চেতনাবোধ এতোটা সাহসী ছিল কোনো দিন বুঝতেই পারিনি। দিদু বেঁচে থাকলে হয়তো আজকে তোর মায়ের মতো অতোটা না হলেও বেশ কিছু টা মূল্যায়ন করতে পারতো তোর। আমি সত্যিই সাহিত্য কিছুই বুঝিনা সোনা তবুও আমি আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আশীর্বাদ করছি তুই যেন একদিন সামনের সারিতে নিশ্চয়ই দাঁড়াতে পারিস।

    উত্তরমুছুন
  2. আর সেদিন আমরা পৃথা রায়চৌধুরী-র মা-মাসী বলে অভিহিত হবো। সেই ছোট্ট বুবলি আজ এতোটা খ্যাতি অর্জন করেছে, আমরা বুঝতেই পারিনি/চাইনি হয়তোবা। তুই অনেক অনেক বড়ো হ' এই সাহিত্য পরিমণ্ডলে। এখন তুই চারাগাছ, তবে একদিন নিশ্চয়ই বটবৃক্ষ হ'বি । ঈশ্বর মঙ্গল করুন তোর।

    উত্তরমুছুন
  3. BAh! OshAdhAron professional interview. BAnglA-y type korte pArinA, but I would echo the sentiments of the previous commenters.

    উত্তরমুছুন
  4. বিবিল্, বক্তব্যের ঋজুতা, সহজ সরলভাবে প্রকাশের বিশেষ ভঙ্গী আর সোজাসাপটা বলার রীতির প্রশংসা করি
    । সাহিত্যপ্রেম সবার ঘটেনা/ তবে যাদের ক্ষেত্রে ঘটে, তারা আশীর্বাদধন্য। ক্রমউত্তরণ হোক তোর কালিকলমে।পাঠকেরআনন্দেই হোক তোর লেখার মূল্যায়ণ।আমি আনন্দিত/ যুগপৎ খানিক বিস্মিতও বৈকি!

    উত্তরমুছুন