মৃত্যু ও
ভালবাসার অনন্ত মহাসাগর
সমুদ্র
ক্যানভাসে ঢেউ রঙ
"সে দেখে নিয়েছে
জলের গভীর কত ঐশ্বর্যময়
জেনে
নিয়েছে তরল অন্ধকার কত আকর্ষক
সে এখন
এক মহাসাগর থেকে অন্য মহাসাগরে সাঁতরে বেড়ায়
পথে কত
নতুন প্রবাল ও মাছেদের সঙ্গে দেখা হয়
সে আর
ফিরতে চায় না কোনদিন
ক্লান্ত
হলে জিরিয়ে নেয় ডুবে যাওয়া জাহাজের ডেক-এ
উপরে তখন
সকাল। তল্লাশি আর পুলিশ। মৃত্যুর খবর
সভ্যতা
আজও ভালোবাসার সঙ্গে মৃত্যুকে গুলিয়ে ফেলে।"
আমরা শুধু শব্দবন্ধের ধরে রাখার
অক্ষমতায় সীমিত। সবকিছু কেড়ে নিয়ে আবার ফিরিয়ে দেবার মহানুভবতা সেতো সমুদ্রের
রাজকীয় অধিকার। দূর মহাকাশে গ্রহ-নক্ষত্রের সাথে তার অক্ষয় প্রেম। পেন্ডুলামের
সময়নিষ্ঠ লোকের সাথে তার আজন্ম সখ্যতা। সৃষ্টির আদি থেকে ক্ষেত্র বণ্টনের
পরিসীমায় সে পৃথিবীর ঘোষিত মহারাজা। আপাত সহজ সমীকরণের ভিতরে এক জটিল আবর্তন-চক্র
যেন লোকচক্ষুর আড়ালে এক মহাকালের সংসার। সহস্র স্রোতের ঘূর্ণাবর্ত ঢেউ, পর্বতের মত বীর
আস্ফালন,
চোরাবালির
কপট প্রতিহিংসা,
তটভূমির
বুকের পৌরুষ মত্ততা, গভীর মহীখাতের চৌম্বকীয় আকর্ষণ -- যেন এক ঐশ্বর্যময় স্বরূপ। জীবন
উদযাপনের এই মহান কর্মযজ্ঞে আবক্ষ অবগাহন ছাড়া শিল্পী এক মানুষের কিবা উপলক্ষ
থাকতে পারে! ভালোবাসার সেই বিশাল হুঙ্কারের সামনে তাই উদার আত্মসমর্পণ ছাড়া পীযূষ
কবিরাজের আর কিছু করার ছিলনা। সমুদ্রকে সে পরম আত্মীয়ের মতো বরণ করে নিয়ে, আমাদের জন্য খুলে
দিয়েছে -- সব হারিয়ে নতুন করে খুঁজে পাবার স্মৃতির এই অসীম বিশ্বলোক। মৃত্যু আর
ভালোবাসা কে আমরা যেন গুলিয়ে না ফেলি।
রামধনু
উপসাগর ও বোহেমিয়ান
উপসাগর প্রান্তে এই নির্জন পাতাবাড়ি
ঘাটে ভিজে যাচ্ছি চোখের পাতায় অসীম বিস্ময়। ঢেউ ছুটে এসে অনিরুদ্ধ সোহাগে পা
জড়িয়ে ধরে। দক্ষিণ আমেরিকার বিখ্যাত সেই নদীটির মত এখানে সমুদ্র সেজে উঠেছে
রামধনু রঙে। আত্মমগ্ন ছবিওয়ালা যেন বাতাসের গায়ে ছবি আঁকতে আঁকতে অবহেলায় এবং
অজান্তেই কৌটোর সমুদ্রে ডুবিয়ে ডুবিয়ে এই বর্ণময় উপসাগর রচনা করেছেন। গভীর
মগ্নতায় যে ছবি আঁকা শেষ হলো না, নিতান্ত অবহেলায় উপসাগর জেগে রইল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ
শিল্পকর্ম হয়ে।
পাশেই অদূরে দু'হাটুর মাঝে মাথা
গুঁজে এক বোহেমিয়ান (নুলিয়া সম্ভবত), বসে আছে সমুদ্রের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে। বহু
ব্যবহারে জীর্ণ একটি তেলচিট খাতায় তুলে রাখছে এক দুই তিন....... ঢেউ-এর আনাগোনা।
একবার স্বভাবসিদ্ধ তাকিয়ে আবার ডুবে গেলাম --ভাবনার গভীরে। বালির মধ্যে ফেলে আসা
পায়েহাঁটা অতীতের সব ছাপ ঢেউ এসে মুছে দেয় বারবার। কেন যে মাথার ভেতর থেকে এইভাবে
সব অতীত হারিয়ে যায় না! বহুদূরে কে যেন জলশাঁখে ফুঁ দিয়ে আমার সম্বিত ফিরিয়ে
দিলে। বালির উপরেই টানা জালের ফাঁদ থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে জ্যান্ত সোনালি মাছ আর
কিছু মরা সমুদ্রকিটের ঝাঁক। সফেন ঢেউ আর তটরেখার সীমানা বরাবর যতদূর দেখা যায়, হাটতে হাটতে কখন যেন
সন্ধ্যা নেমে এলো
ফেরার পথে দেখি বোহেমিয়ান লোকটি তখনও
একভাবে। পাশে গিয়ে বসতেই বিড়বিড় করে বলে উঠলো, "তারপর বাতাসের গায়ে
সব আঁকাআঁকি এবং বাঁচাবাঁচি শেষ হলে ছবিওয়ালার হাত ও পায়ের সব আঙ্গুল তুলির মত
লম্বা হয়ে উঠলো। যাবার সময় বলে গেলো 'আসছি', যেন মনের মানুষের সন্ধান পেয়েছে। তারপর ধীর পায়ে নেমে
গেল রামধনু উপসাগরের দেশে। আমি জানতাম সে সাঁতার জানে না তাই আর বাঁচানোর আগ্রহ
দেখাইনি। ডুবেই মরুক! বাইরের পৃথিবী থেকে সমুদ্রের তলদেশে এভাবে পালাবার সুযোগ আর
ক'জন পায় ? লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি
ঢেউ-এর পর ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য একটি সুযোগ আসে। গুনতে ভুল করলে মিস হয়ে
যাবে।"
আমি জানতে চাইলাম, "কলম্বাস কি তবে ভুল ?" জবাবে বললে, "শুধু ভুল নয়, ডাহা মূর্খ
ছিল।" কেন জানতে চাইলে বললে, "জাহাজকে কি সব সময় পাড়েই আসতে হবে ? জলের তলায়
ঐশ্বর্যময়ী পৃথিবী, উন্মত্ত তরল অন্ধকারে হারানোর সুখ কি কেউ জানে ?" আমি বোকার মত
তাকিয়ে রইলাম দেখে রামধনু উপসাগরের পাড়ে সেই বোহেমিয়ান আমাকে পণ্ডিতের মতো আবার
প্রশ্ন করলে,
"আবিষ্কার
না সৃষ্টি,
কে বড়
?"
অ্যান্তসিরাবাতো
বন্দর ও পর্তুগিজ নাবিক
প্রয়াত শিল্পী পীযূষ কবিরাজের
মৃত্যুর প্রায় এক দশক পরে আমি পুরী শহরে এলাম। প্রিয়জনেরা যেখানে চরম শোক ও
ঘৃণায় এই সমুদ্র শহর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে স্মৃতিকাতরতা ভুলতে, আমি ট্রেনে চড়ে
বসলাম একপ্রকার দাঁতে দাঁত চেপে। অপ্রত্যাশিতভাবে সেদিনের সেই বোহেমিয়ান লোকটি
আমাকে এক দ্বন্দ্বমূলক ভাবনার দিগন্ত খুলে দিলে। আমি স্মৃতিভ্রমণে এসেছি সে জানলেই
বা কি করে !প্রায় এক দশক পর দূর্ঘটনাস্থলেই তার সাথে দেখা হওয়াটা এক অদ্ভুত
সমাপতন !
কিন্তু........। উপকূল পথে হাঁটতে
হাঁটতে,
চিল্কায়
ভাসতে-ভাসতে,
কোনার্কের
স্থাপত্য শিল্পকর্ম দেখতে দেখতে হাজারো প্রশ্ন আমাকে সারাক্ষণ ভাবিয়ে তুললে।
পুরীর সমুদ্রে ডুবে যাবার পর এবং মৃত্যুর চুম্বন মেখে ফিরে আসার মধ্যিখানের
সময়টুকুতে সে কোথায় ছিল ? কে মন ভুলিয়ে ডেকে নিয়ে গেছিল মহাসাগরের পথে পথে ? কয়েকদিনের মধ্যে
কিসের টানেই বা ফিরে এলো জলের উপরে ?
অ্যান্তসিরাবাতো বন্দরের অদূরে নাইভ
নদীর মোহনা। নারকেল এবং অন্যান্য উপকূল প্রজাতির ছিমছাম বাদাবন। স্থানীয় পাহাড়ী
কৃষি পদ্ধতি ও জনপদ বিস্তারের দ্বিমুখী চাপে রেইন ফরেস্ট পিছিয়ে গেছে দূরে। ভারত
মহাসাগরের এই দ্বীপটি অন্যথায় মনোরম ও নিরিবিলি। নারকেল পাতার ছাউনি ও বালির উপর
ফুটিফাটা চেয়ার পেতে একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্ট। মৃদু আওয়াজে একটি স্প্যানিশ লোকগান
বাজছে আবহে। পীযূষ লাল গামছাটি মাথা থেকে খুলে কোমরে বেঁধে নেয় টানটান। অনেকক্ষণ
জল না খেয়ে গলা প্রায় শুকনো কাঠ। ভাঙ্গা ইংরেজিতে জল চাইলে মাঝবয়সী এক যুবতী
স্থানীয় মালগাসী ভাষায় জবাব দেয়, পীযূষ তার বিন্দুবিসর্গ বোঝেনা। এর অনেক পরে এক পর্তুগিজ
নাবিক পীযুষকে দেহাতি ভেবে একটি ডাব খেতে অনুরোধ করে এবং আজ উৎসবের দিনে কোন মূল্য
লাগবে না বলে আশ্বস্ত করে। পীযুষের মনে পড়ে আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ে উশুআইয়া
শহরের কথা,
সেখানকার
মানুষের ভালোবাসার কথা। আরো দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে ছোট্ট আঁচিলের মতো
হনোলুলু দ্বীপ ও নীলতিমির স্কন্ধ ভ্রমণের কথা। মহীসোপানের সমতলে ফিরে যাবার আগে
রেস্টুরেন্টের সামনে বালি দিয়ে সে তৈরি করে একটি সুশীল নারীমুখ -- বাঙালি শিল্পীর
ফিরতি উপহার।
প্রবাল
দ্বীপের পাঠশালা
সকালে হোক্কাইডো দ্বীপে সূর্যপ্রণাম
সেরে পীযুষের ফেরার তাড়া ছিল মহীসোপানের সমতলে এবং উদ্দেশ্যটি মহৎ। সকলকে নিমেষে
আপন করে নেবার এক আশ্চর্য ঐশ্বরিক দক্ষতা ছিল তার। এই তালুকার সর্বাধিনায়ক
(প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির সমতুল্য) শিল্পী পীযুষকে পেয়ে আহ্লাদে একেবারে
আটখানা। তালুকা সৌন্দর্যায়নের সব দায়িত্ব তার। মনে পড়ে দুবরাজপুরের অদূরে
পাহাড়েরশ্বরকে সাজিয়ে তোলার সেসব দিনের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা। দায়িত্বভার থেকে কোনদিন
মুখ ফিরিয়ে নিতে শেখেনি সে। মনে পড়ে বাড়ির কথা, আর্থিক অনটনের দিনে বুক চিতিয়ে
লড়াই। এখানে একটি ফুটিফাটা গোছের মালভূমির সন্ধান পায় সে এবং নিমেষে মাথায় খেলে
যায় একটি ছোট্ট আকার স্কুলের পরিকল্পনা। নামও ঠিক করে ফেলে -- প্রবালদ্বীপের
পাঠশালা। এখন স্কুলের কাজ চলছে পুরোদমে। মনে পড়ে দুবরাজপুরে ঠাকুরদালানের
আটচালায় তার নিজ হাতে তৈরি আঁকার স্কুলের কথা। মফস্বল শহরে তার বিরাট সুখ্যাতি
জোটেনি বটে কিন্তু স্বশিক্ষিত শিল্পী পীযুষের মনের সবচেয়ে বড় জোর ছিল ছোটবেলায়
বাবাকে হারানো এবং জীবনযন্ত্রণার নিষ্ঠুর স্মৃতিকথা।
স্কুল শুরু হয়ে গেল। বড় মাছ, অক্টোপাস, অতিকায় কাঁকড়া, জেলিফিশ, তিমি, ভ্যাম্পায়ার স্কুইড
ইত্যাদি প্রজাতির বাবা-মায়েরা তাদের শিশু সন্তান নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে। প্রাথমিক
বাছাই পর্ব শেষে পার্সোনালিটি টেস্ট। চশমা পরা ফিরিঙ্গি মাষ্টারমশাইকে পেয়ে ছোটরা
তো ভীষণ উৎসাহী। ছানাপোনারা রীতিমতো তার চব্বিশ প্রহরের সাগরেদ হয়ে উঠেছে। পাশ
ফিরলেই হ্যাঁ স্যার। চোখ পাকালেই নো স্যার।
পীযূষের জীবনে সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল
ন্যুড আর্ট এবং বডি পেইন্টিং। রাতের পর রাত জেগে বই পত্র তোলপাড় করে এসব পড়াশোনা
করতো। দুবরাজপুরের মত সাবেকপন্থী ছোট শহরে বসে যা কিনা আগামী পঞ্চাশ বছরেও ভাবা
যেত না। কিন্তু এখানে সেসব সাবেকিয়ানার কোন প্রশ্নই নেই। মৎস্যকন্যাদের শরীরের
ওপর তার রংতুলির অবাধ বিচরণ।জলপরীদের শরীরের নিখুঁত উত্থান-পতন উঠে আসছে এক একটা
মাস্টার স্ট্রোকে।
এখানে আসার পর থেকে পীযূষ যেখানেই যায়
হাজার হাজার মাঝারি ছোট ও পুঁচকে মাছের রঙিন ঝাঁক তার পিছু নেয়। কোন প্রবাল
পরিবারের রং ফিকে হয়ে গেছে -- রঙিন মাছের ব্রিগেড নিয়ে সে চলল রঙের প্রলেপ দিতে।
ঢেউ-এর তোড়ে প্রান্তর প্রান্তর প্রবাল কলোনি ভেঙ্গে গেছে -- মই, ছেনি-হাতুড়ি নিয়ে
সে চলল মেরামত করতে। মাছেদের ব্রিগেড কিন্তু ক্লান্তিহীন ! ব্রিগেড মেম্বারদের এই
সব লিটার লিটার তৈলমর্দনের গোপন অভিসন্ধি পীযূষ ভালই বোঝে। তাদের গায়ের রং কোনদিন
ফিকে হয়ে গেলে একটু-আধটু বডি পেইন্টিং করে দিলেই তারা বেজায় খুশি। এখন কয়েকদিন
সে সিন্ধুকর্দ (এক প্রকার সামুদ্রিক কাদা) দিয়ে একটি ওয়াটারপ্রুফ চারুকলা
একাডেমি তৈরি করতে ব্যস্ত। তার চিল্লার পার্টির মেম্বারদের খাওয়া-ঘুম লাটে উঠেছে।
জলের ভেতর থাকতে থাকতে ওয়াটারপ্রুফ কি জিনিস তারা শেখেনি।
সামুরাই
জাহাজের ডেক-এ একটি সন্ধ্যা
বীরভূমের লালমাটির আদর আর সংলাপের
উষ্ণতায় মিশেছিল পীযুষের চারুকলার আঞ্চলিক সীমানা, কিন্তু মননের বিস্তার আরো দূরে।
কখনো দুবরাজপুরের পাহাড়ে নিমগ্ন শিল্পী, হেতমপুরের জঙ্গলে আত্মভোলা সবুজ পথিক, খয়রাশোলে নদীর
আয়নায় মুখ -- না বলা চুপ কথা, রাজনগরের আদিগন্ত খোলা বাতাসে বাউলের গন্ধ, সিউড়ি বটতলায়
চায়ের তর্কে তুফান। পুনরাধুনিক কবিতাশিল্পের মতো সে বদলে নিয়েছিল নিজের শর্তে
বেঁচে থাকার এক আশ্চর্য অভিধান।পীযুষের মননের বান্ধবীরা কি পেয়ে কি হারিয়েছেন --
আলোচনার সে প্রসঙ্গ আরো একটি মহাসাগরের জন্ম দিতে পারে, কিন্তু, আজ এই সামুরাই জাহাজের ডেক-এ
একান্ত আলাপচারিতায় তার মনের মৎস্যকন্যারা যে হীরকখনির সন্ধান পেলো ঈশ্বরের
ষড়যন্ত্র ছাড়া তা বাস্তবিকই অসম্ভব।
প্রাচীনকালে জলপথে ঝড়ের কবলে পড়ে বহু
পণ্য ও যাত্রীবাহী জাহাজ সমাধিস্থ গভীর সমুদ্রের তলদেশে। বছরের পর বছর ধরে সেগুলি
পড়ে থাকে সমুদ্রের তলায় সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায়। সেইসব গুপ্তধন তল্লাশি
অভিযানের গল্প উপন্যাস পীযুষের প্রায় মুখস্থ। একদিন কথা প্রসঙ্গে সামুরাই
যোদ্ধাদের জাহাজের গল্প বলতেই মৎস্যকন্যারা খুবই উৎসাহিত হয়ে পীযুষকে পথ দেখাতে
রাজি হল। গুটিকয়েক মননের মৎস্যকন্যাদের
সাথে নিয়ে প্রবালদ্বীপের সেই পাঠশালা থেকে প্রায় কয়েক হাজার মাইল দূরে
যখন সামুরাই জাহাজের ডেক-এ পৌঁছানো গেল সময় প্রায় সন্ধ্যে। পথশ্রমে প্রায় সবাই
ক্লান্ত কিন্তু তরল অন্ধকারের ভিতর অ্যাডভেঞ্চারের নেশা তার চেয়ে বহুগুণ বেশি !
লেখকের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা না থাকলে শুধু কল্পনার উপর ভিত্তি করে লেখা গল্প উপন্যাস
কিভাবে এমন হুবহু মিলে যেতে পারে বাস্তবের সঙ্গে -- পীযূষ আশ্চর্য ডুবে যায়।
দোতলার পড়ার ঘর থেকে বই গুলো এক ছুটে নামিয়ে এনে হুবহু মিলিয়ে নিতে ইচ্ছে করে।
এরপর বহু সিঁড়িপথ, বারান্দা, ছাতঘর, গোসলখানা পেরিয়ে যখন মূল প্রশস্ত বৈঠকখানায় পৌঁছানো
গেল অন্ধকার চুরমার করে মায়াজালের বিভ্রান্তির মত একে একে সব আলো ঝলসে উঠলো।
দেওয়ালে ঝোলানো একটি বৃহৎ তেলরঙ ছবির দিকে এগিয়ে পীযূষ চমকে তাকায় -- এই সেই
পর্তুগিজ নাবিক,
অ্যান্তসিরাবাতো
বন্দরে যে তাকে চরম তেষ্টার মুহূর্তে ডাবের জল খেতে দিয়েছিল। সেদিন জাহাজের ডেক
থেকে ফিরতে কত রাত হয়েছিল সে হিসাব কেউ রাখেনি।
যাবার
আগে রাঙিয়ে দিয়ে যাও
পীযুষের ডাকনাম 'রাঙা' শুনে মৎস্যকন্যারা
তো হেসে খুন ! "এমন সার্থক নাম কে রেখেছিল তোমার ?" পীযূষ লজ্জায় আরও
রাঙা হয়ে ওঠে। এমন দাপুটে প্রশ্নের মুখে কিঞ্চিত অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে কিন্তু
সামলে নেয়। মূলত লাজুক স্বভাবের পীযূষ ছিল তার ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনে এক মহান
প্রেরণা এবং পথপ্রদর্শকের ভূমিকা স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
হাইকমান্ড থেকে খবরটা আসতেই চারিদিকে
শোকের ছায়া নেমে এলো। তাদের বক্তব্য স্পষ্ট -- "পঞ্চভূতের এই সংসারে পৃথিবী, আকাশ, বাতাস ও আগুনের মতো
জলেরও রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু শর্ত ও নিয়মাবলী। সমুদ্র-জলমন্ডল কিছু কেড়ে নিলে
আবার ফিরিয়েও দেয়। ইচ্ছে বা অনিচ্ছায় তাকে ধরে রাখাটা নিয়ম বিরুদ্ধ। কেউ স্বেচ্ছায়
আসতেই পারে কিন্তু পঞ্চভূতের সাথে আত্মার মিলনের পর তাকে ফিরে যাবার নিয়ম মানতেই
হবে। কোন ব্যক্তি বিশেষের জন্য নিয়ম বদলাতে পারে না। অন্যথায় এটি মহাকাল বিরোধী।
সমুদ্রের শর্ত মেনে পীযুষ অবশেষে ফিরল
অক্ষত অবিকৃত ভালোবাসাজয়ী এক যুবরাজের মত। উত্তাল ঢেউয়ের আড়ালে লুকিয়ে এক
মৎস্যকন্যা শেষ বিদায় জানিয়ে গেল প্রায় তটরেখা পর্যন্ত। শরীরে আটক কয়েকটি
পুচকে মাছ ছটফট করতে করতে ভালোবাসার গায়ে ঢলে পড়লো। পুরী থেকে প্রায় আশি
কিলোমিটার দূরে উপকূল স্রোতের নির্মম কাদাজলের উপর মুখ গুঁজে যেন মেপে নিচ্ছে বিকেলের পড়ন্ত রোদ ! নাকি মৎস্যকন্যার
শরীরের গভীর গোপন আঘ্রাণ ! মহাসাগরের অনন্ত পরিসরে পীযূষের ভালোবাসা বেঁচে রইলো
আমাদের মৃত্যুশোককে পরোয়া না করে।
কপিরাইট ফাল্গুনী দে কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন