পুরাণ সাহিত্যে ঋষি কন্যা বেদবতী
তিনি সীতা আবার তিনিই দ্রৌপদী
রূপকের
শৃঙ্গারে,
প্রতীকের
ইশারায় দুটো নারী চরিত্র লেখার ইচ্ছে নিয়েই আজ কলম ধরলাম। অবশ্য আমার অনুভব বলে, লেখা শুরু করাটা
লেখকের ইচ্ছে,
তারপর
কলম বা লেখা নিজ গতিতে চলে। আমি যেটা বলতে চাইছি যে এই লেখায় সীতা আর দ্রৌপদীকে
নিয়ে কোনও বাদানুবাদে যাবনা। সে সব তো
করবেন বা করেছেন পণ্ডিতেরা। তবে কখনো কখনো মনে হয় পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত সবই তো রচনা করেছেন
পুরুষ কবি। তাই কি তাঁরা ইচ্ছে মতো সীতাকে পাতালে পাঠিয়েছেন? কুন্তীর মুখ দিয়ে
দ্রৌপদীকে পঞ্চপাণ্ডবের উপভোগ্যা করে তুলেছেন? আবার এই নারীদেরকে সামনে রেখেই
রাবণ বধ থেকে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সূচনা করেছেন? সেই জন্যেই কি আজও ঘরে ঘরে ঝগড়া
লাগলে প্রথমেই আঙুল তোলা হয় মেয়েদের দিকে? যদিও এ প্রশ্নটা অনেকেরই। তাই
আবার বলছি এটা আমার লেখার বিষয় নয়। আমার
লেখার গতিমুখ রেখেছি উপমার প্রতীকী ভাবনায় সীতা ও দ্রৌপদী। পাঠক মহলের প্রতি পরম
শ্রদ্ধা রেখে এই ইচ্ছেটা বারবার বলার কারণ
হল পুরাণ সাহিত্যের সব কাহিনিতেই রয়েছে ধর্ম এবং রাষ্ট্রশাসনের মধ্য দিয়ে
সমাজজীবনে নৈতিকতা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা। রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় নিয়মকানুন
এবং সে-সবের বিধিনিষেধ। মানে পারলৌকিকতা আর আধ্যাত্মিকতাকে বাদ দিয়ে ইহজাগতিক সমাজ নিয়ে যদি বলি, তাহলে দেখা যাবে, রাষ্ট্র ও ধর্ম উভয়েরই মূল
উদ্দেশ্য,
সমাজ
নিয়ন্ত্রণ করা।
পুরাণের
মূলকথা হলো,
ভালোর
সঙ্গে মন্দের,
ধর্মের
সঙ্গে অধর্মের চিরন্তন দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ, এবং পরিশেষে অবধারিতভাবেই মন্দের বা দুষ্টের দমন
আর শিষ্টের,
অর্থাৎ
ন্যায়ের জয়। দেবতার সঙ্গে অসুরের, মানুষের সঙ্গে দানবের চিরকালীন বিরোধ একটা প্রধান বিষয়
দেখা যায় পুরাণে। অামি যে নারী চরিত্র দুটি নিয়ে লিখতে এসেছি সেগুলি রামায়ণ
মহাভারত যা পুরাণ সাহিত্যেরই অন্তর্গত দুটো চরিত্র। এই মহাকাব্যদ্বয়ের ঐতিহাসিক
গুরুত্ত্ব যেমন অাছে তেমনি সামাজিক ইতিহাস লিখতে গেলে রামায়ণ-মহাভারত অপরিহার্য।
যুদ্ধ থেকে দৈনন্দিন আহার্য, দর্শন ও ধর্মচিন্তা থেকে রাষ্ট্রতত্ত্ব এই সবের আকর এই
গ্রন্থদুটি,
প্রাচীন
ভারতের ভৌগলিক ধারণা পেতেও অনেকাংশে সহায়ক। মহাভারতে আছে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ও
চন্দ্রবংশীয় রাজাদের। রামায়ণে আছে শ্রী রাম চন্দ্রের কথা,যা সূর্যবংশীয়। এই
দুই গ্রন্থে,
দুই
বংশের,
দুই
যুগে অর্থাৎ ত্রেতা আর দ্বাপরের হাজার
হাজার চরিত্রের মধ্যে যথাক্রমে ভগবান
বিষ্ণুর দুই অবতার রাম ও কৃষ্ণের কাহিনী পরিবেশিত হয়েছে। সেই সঙ্গে রাজনীতি, ধর্ম্মনীতি, সংসার নীতি, লোকযাত্রাবিধান. বাণিজ্য-কৃষিকার্য্য
ও শিল্পশাস্ত্র সংক্রান্ত নানান দিকের বর্ণনা রয়েছে। সব মিলিয়ে স্নেহ-মমতা, শৌর্য-বীর্যে, মহত্বে. ক্ষমা-হিংস্রতা, করুণা-নিষ্ঠুরতা, নিষ্কাম কর্ম-ভোগের
আকাঙ্ক্ষা নিয়ে হয়েছে অনন্তে আবর্তিত। পিছন ফিরে তাকানোর কেউ নেই। আছে সামনে এগিয়ে
যাওয়ার আহ্বান। সবাই পরাভূত হয় অবশেষে সময়ের কাছে। তবুও ধর্মের সূক্ষ তত্ত্ব গুলিয়ে যায় মাঝে মাঝে. তখন প্রশ্ন জাগে যে
ধর্মের নাম কি লোভ? কেউ রাজত্বের নামে। কেউ প্রেমের নামে। কেউ যৌনতার নামে। কেউ স্নেহের
নামে, শ্রদ্ধার নামে। কেউ
মহত্বের নামে। কেউ অমৃতের নামে। কেউ দেবত্ব মানে ঈশ্বরত্বের নামে। লোভ ছাড়া আর কি
আছে এই জগতে?
আসলে
পুরাণ সাহিত্যের সীতা আর দ্রৌপদী এই দুই নারীকে পড়তে পড়তে আমার এমনটাই মনে হয়েছে।
তাঁরা দুজনেই লোভের স্বিকার. ইহ জন্মে তো বটেই পূর্ব জন্মেরও। তাই মূল লেখা লেখার আগে
এই দুই সাহিত্য গ্রন্থের পরম্পরা অনুযাযী দুই নায়িকার ভবিতব্য সম্পর্কে একটু
আলোচনা করা দরকার মনে করছি। কারণ আমি বিশ্বাস করি এই ইতিহাস আর কাব্যগ্রন্থর কাহিনীগুলিই
আমাদের প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। রামায়ণ, মহাভারত এই দুই
গ্রন্থ আমাদের বাংলা ভাষা, সাহিত্য,সংস্কৃতি এবং শিল্পকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। রামায়ণের থেকেও
মহাভারতের চরিত্রগুলোর বিন্যাস, বিভিন্নতা বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ। আমাদের সমাজের মত সেখানে
যেমন আছে নায়ক,
তেমনি
আছে খলনায়ক। সৎ,
অসৎ, মূর্খ, জ্ঞানী, সুন্দর, কুৎসিত সব ধরনেরই
চরিত্র স্থান পেয়েছে সেখানে, কিন্তু রামায়ণের কাব্যকার প্রাধান্য দিয়েছেন কেবলই
আদর্শবান চরিত্রগুলোকে। সৃষ্টি করেছেন আদর্শ মানুষকে, আদর্শ নারীকে, আদর্শ ভ্রাতাকে অথবা
আদর্শ খলনায়ককে। রামায়ণ মুখ্যত একনায়কের কাহিনী, নায়ক রামচন্দ্রের আদর্শের
উপস্থাপনা ও মাহাত্ম্যকীর্তন স্থান পেয়েছে সেখানে। দুই নারীর চরিত্রেও সাদৃশ্য ও
বৈসাদৃশ্য দুইই পাওয়া যায়। সাদৃশ্যগুলো - দ্রৌপদী রাজা দ্রুপদের এবং জানকী রাজা
জনকের কেউই ঔরসজাত নন, কিন্তু এই দুই অযোনিসম্ভবা কন্যা
উভয়েই রাজনন্দিনী। এই দুজনেই বিবাহের জন্য স্বয়ম্বরা হয়ে, দুই মহাকাব্যের সবচেয়ে
বীরত্বপূর্ণ রাজপুরুষকে স্বামীরূপে লাভ করেছিলেন। মহাভারতের যুগে অর্জুন ও
রামায়ণের যুগে রাম অপেক্ষা বড় ধনুর্ধর আর কেউ ছিলেন না। বিয়ের পরে স্বামীসহ
দ্রৌপদীর হয়েছিল তের বছর বনবাস ও অজ্ঞাতবাস, আর সীতার চৌদ্দবছর বনবাস। যার
ফলে উভয়ের জীবন হযেছিল ঝঞ্ঝাটময়, বিপদগ্রস্ত ও অশান্তিপূর্ণ। আক্ষরিক অর্থে তাঁদের দুজনের
বনবাস হলেও কারণ গুলো ছিল একটু ভিন্ন। দ্যুতক্রীড়াসক্ত স্বামীরা রাজ্যপাট হারিয়ে
দ্রৌপদীকে বাধ্য করেছিলেন বনবাসিনী হতে। অন্যথায় সীতার বনবাস ছিল তাঁর আদর্শ
স্বামীর সত্য রক্ষায়। দ্রৌপদী বনবাসে থাকাকালীন আগের মতই তাঁর পাঁচ স্বামীর প্রতি
যথোচিত কর্তব্যপরায়ণ ও নিষ্ঠাবান ছিলেন। তাঁর সপত্নীগণ সেই সময় তাঁদের নিজ নিজ
পিত্রালয়ে ছিলেন। আর সীতার বনবাসে? আসছি সেই বিষয়ে একটু
পরে। আরো একটা মিল আছে দৌপদী ও সীতার। যে মিল
ভুলের মিল। সেই জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই ভুলের মাসুলও দিতে হয়েছিল
তাঁদের দুজকেই। সীতার ভুল হল মায়াবী সোনার হরিণের হাতছানিকে প্রশ্রয় দেওয়া এবং
রাবণের বোন সূর্পণখাকে দেখে ব্যঙ্গ করা। ফলে তিনি হলেন রাবণের দ্বারা অপহৃতা যা
পুরো রামায়ণের গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। অন্যদিকে দ্রৌপদীর ভুল হল, ময় দানব নির্মিত, স্ফটিক খচিত
ইন্দ্রপ্রস্থে দুর্যোধনের প্রথম পদার্পণেই পা পিছলে যাওয়া দেখে হেসে ফেলা। পরবর্তী
কালে এর চেয়ে অনেক বেশি অপমান তাঁকে ফিরে পেতে হয়েছিল। আমি এই লেখার নাম বিষয়
রেখেছি.
যে সীতা
আর দ্রৌপদীর কথা পুরাণ বলে দৌপদীর পূর্বজন্ম হল সীতা। আবার সীতা ছিলেন পূর্বজন্মে
এক ঋষিকন্যা বেদবতী। তাঁর পিতা মহর্ষি শ্রুতধ্বজ. মতান্তরে কুশধ্বজ। বেদবতী ছিলেন
বিষ্ণুভক্ত। দিনরাত তিনি তাঁর আরাধ্য শ্রী
বিষ্ণুর ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন। আসলে বেদবতী আবার মা লক্ষ্মীর-ই অবতার। দেখতে নাকি
ছিলেন সীতারই মতোই। এদিকে লঙ্কেশ্বর রাবণ, বিষ্ণুর যিনি চিরশত্রু, তাঁর নজর পরে অসামান্যা
লাবণ্যময়ী বেদবতীর উপর। শুধু তাই নয়
লঙ্কেশ্বর বেদবতীকে ধর্ষণও করেন। তার পরেই বেদবতী অগ্নিতে প্রাণবিসর্জন দেন। এই
বেদবতীই,
সীতা।
ত্রেতাযুগে মিথিলার রাজা রাজর্ষি জনকের পালিত কন্যা। যাঁর জন্য রাবণের সর্বনাশ
সূচিত হয়েছিল।
সেই সময়
মিথিলায় অনাবৃষ্টিতে প্রচণ্ড খরা চলছিল। তাই মিথিলার রাজা
ঠিক করলেন মিথিলার শস্যক্ষেতে তিনি সোনার লাঙল চালাবেন। সেই লাঙল চালানোর সময়
পাওয়া গেল এক কন্যা। যাকে পালন
করার দায়িত্ব নিলেন জনক রাজা। মাটিতে হাল চালানোয় যে রেখা হল তাতে তার সন্ধান
পাওয়া গেছিল তাই তার নাম হয় সীতা। এবং ভুমিতে জন্ম বলে ভুমিজা, আর বৈদেহী প্রদেশের
রাজকুমারি বৈদেহী। জনক কন্যা জানকী। বেদবতী প্রাণবিসর্জন দেবার আগে অভিশাপ
দিয়েছিলেন রাবনকে যে, আমিই পরজন্মে তোর মৃত্যুর কারণ হব। এবং তোর ঘরেই জন্ম নেব।”। হয়েও
ছিল রাবনের ঔরসে এবং মন্দাদরির গর্ভেই সীতার জন্ম। এ কথা জানতে পারেন মন্দাদরি।
তাই সীতার জন্ম হতেই নিজের স্বামীকে
বাঁচাতে জনক রাজার রাজ্যে, মানে অনেক দূরে পাঠিয়ে মাটিতে পুতে রাখার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সীতা যে সম্পদের
দেবী লক্ষ্মী। ভূমির রক্ষাকারিনী ভূমিজা। তাই একদিকে যখন সীতা মিথিলাকে সমৃদ্ধ
করছেন তখনই তিলে তিলে ধ্বংস হচ্ছিল স্বর্গপুরী লঙ্কা। ধনদেব কুবেরের ভূমি লঙ্কা।
সেই মুহূর্তে যোগী রাবণ জানতে পারেন যে তার লঙ্কাপুরীকে বাঁচাতে পারেন স্বয়ং সীতা।
তবে তাঁর কারণেই তাঁর মৃত্যু হবে এটাও জানতেন তিনি। তবুও রাবণ খোঁজ চালিয়েছেন
স্বর্গ,
মর্ত্য
পাতালে নিজ কন্যা ভূমিজার। অবশ্য বাল্মীকি
রামায়ণে আছে রাবণের বোনের নাক কেটে দিয়ে, লক্ষ্মণ যে অত্যন্ত অন্যায় কাজ করেছিলেন সেটার
বিরুদ্ধেই প্রতিশোধের জন্যেই রাবণের সীতা হরণ। কিন্তু এটাও হয়তো ঠিক ছিল. নিজের রাজ্যকে এবং সেখানকার
মানুষদের বাঁচাতে সেদিন রাবন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন লক্ষ্মীকে। সীতাকে নাকি
যথার্থ সম্মানও করেছিলেন। তাই সীতা রাবনের মৃত্যুর পর অপর এক বটবৃক্ষকে স্থাপন করেছিলেন যাতে মানুষ
তার ছায়া পায়। কিন্তু যখন অযোধ্যা ফিরে আসেন রাম – লক্ষণ– সীতা। প্রশ্ন ওঠে সীতার
সতীত্ব নিয়ে। যে পুরুষ তাকে সমস্ত যুদ্ধ জয় করে বাড়ি ফিরিয়েছিলেন সেই পুরুষও মেনে
নেন সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন। নিজের সতীত্ব প্রমান করতে অগ্নি মুখর পাতাল গর্ভে প্রবেশ
করেন সীতা। কিন্তু আগুনে বিলীন হওয়া সীতা আবার আগুনের থেকেই জন্মেছিলেন। মানে
পুত্র সন্তানের আশায় এক যজ্ঞ করেছিলেন
রাজা ধ্রুপদ আর সেই যজ্ঞের আগুনে জন্ম নিয়েছিলেন অগ্নিজা ধ্রুপদ কন্যা
দ্রৌপদি। পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের যজ্ঞের
আগুনে তার জন্ম বলে তাই তিনি যাজ্ঞসেনী। আবার পাঞ্চাল রাজ দ্রুপদের কন্যা তাই তাঁর
আরেক নাম পাঞ্চালী। শ্যামাঙ্গী তাই
কৃষ্ণা। পদ্মপলাশাক্ষী, কুঞ্চিত ঘনকালো কেশবতী এবং তাম্রবর্ণ নখ, সুন্দর ভ্রূ ও
স্তনযুক্তা পরম সুন্দর রুপধারিণী
দৌপদী ইনিই মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের ধর্ম
যুদ্ধের কারণ হয়েছিলেন। অর্থাৎ দ্রৌপদী
হলেন মহাভারত মহাকাব্যের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র পঞ্চপাণ্ডবের সহধর্মিনী। যাঁকে এই ভরতবংশের কুলবধু বলে সবাই মহাভারতী
বলেও জানেন। মনে হয় এই মহাভারতী জন্যই পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ পান্ডবদের
কুরুক্ষেত্রে জয়লাভ করিয়ে ছিলেন। তিনিই তো আগাগোড়া মনোবল যুগিয়েছেন শুধু দ্রৌপদীকেই
নয়, প্রণাধিক প্রিয়
অর্জুনসহ বাকি চার পান্ডবকে।
তবে এখানেই একটা প্রশ্ন আসতেই পারে যে বেদবতী হল
লক্ষ্মী অর্থাৎ সত্যযুগে লক্ষ্মী বিষ্ণুর স্ত্রী। ত্রেতাযুগে সীতা রামের স্ত্রী
মানে, রাম বিষ্ণু আর সীতা
লক্ষ্মী। কিন্তু দ্বাপরে দৌপদীর বেলাতে
তিনি কৃষ্ণকে স্বামী রূপে পেলেন না কেন? শুধু পেলেনই না তা নয়, পাঁচজন পুরুষ তাকে বণ্টণ করে
নিলেন। এখানে কৃষ্ণ রইলেন সখা হয়ে। যদিও দৌপদী যতবার বিপদে পড়ে সখাকে ডেকেছেন ততবার সখা কৃষ্ণ তাঁকে রক্ষা
করেছেন। পঞ্চ স্বামীর সয্যা সঙ্গিনী, এবং কষ্ট সঙ্গিনী দৌপদী ও কৃষ্ণর এক কথোপকথনে
দেখেছি যে দৌপদী কৃষ্ণকে একান্তে প্রশ্ন করেছেন হে কৃষ্ণ! আমি কে? আমার জীবনের
উদ্দেশ্য কি?
কি
করিলে আমার জীবন সার্থক হবে? কি করলে আমি পরমশান্তি লাভ করবো সখা? শ্রীকৃষ্ণ মৃদ্যু
হেসে বলেছেন.
তুমি
কে? সেটা তো কেবল তুমিই
জানতে পারো। আর হ্যাঁ, যখন তুমি জেনে যাবে তুমি কে! তখন আমি কে? সেটাও তুমি জানতে পারবে। ভগবান
শ্রীকৃষ্ণ তখন আরো বলেছেন . নিজেকে ব্যক্তি তখনই
জানতে পারে - যখন ব্যক্তি আত্মজ্ঞান লাভ করে। আর সে তখন বুঝতে পারে. আসলে তার জীবনের
উদ্দেশ্য কি! সমস্ত প্রশ্নের উত্তর তখনই প্রাপ্ত হয়, যখন সে আত্মজ্ঞান লাভ করে। তাই
দ্রৌপদী তোমার আত্মজ্ঞান অর্জন করতে হবে। দ্রৌপদী বললেন, আমি আত্মজ্ঞান কিভাবে লাভ করবো? আমাকে সব বুঝিয়ে বলো
সখা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, আত্মজ্ঞান তো ব্যক্তি তখনই লাভ করতে পারে। যখন সে ধর্মকে
হৃদয়ে ধারণ করতে পারে। আর যখন তার হৃদয়ে ধর্ম ধারণ হয়, তখন সে তার স্বরুপ উপলদ্ধি করতে
পারে এবং সব রকম জ্ঞান লাভ করতে পারে। মানে, তার উদ্দেশ্য, তার কর্তব্য, তার কর্ম সমস্ত
কিছুকেই সে জানতে পারে। দ্রৌপদী আবার বললেন, ভগবন আমি ধর্ম কি তা কিভাবে
জানবো?
আর
কিভাবেই তা হৃদয়ে ধারণ করবো? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন. ধর্মকে জানতে হলে, প্রথমে ধর্মের
আধারকে জানতে হবে। এই আধারই ধর্মকে জানতে ও ধারণ করতে সাহায্য করবে। ধর্মের আধার
হলো পাঁচটি।
জ্ঞান =
জ্ঞানই মানুষকে সত্য দর্শন করায়।
প্রেম =
মানুষের হৃদয়কে শান্ত করে।
ন্যায় =
মানুষের কর্তব্য ও কর্মকে জানিয়ে দেয়।
সমর্পণ =
যা মানুষের ভক্তি ও শ্রদ্ধাবান করে তোলে। ধৈর্য = যা মানুষকে সমস্ত কার্যের শক্তি
প্রদান করে। এই সমস্ত গুলোই ধর্মের আধার। আর যখন মানুষ এই আধারকে আয়াত্ত্ব করে
নেয়। তখন সে ধর্মকে জানতে এবং হৃদয়ে সহজেই ধারণ করতে পারে।জগতের সমস্ত জ্ঞান এই
আধারের মধ্যেই নিহিত আছে। কিন্ত সবাই তা বুঝতে পারেনা। হে দ্রৌপদী, তোমাকে আগে এই
আধারকে অর্জন করতে হবে। যদি তুমি এই আধারগুলোকে আয়াত্ব করে নাও, তবে তুমি তোমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।
শুধু তাই নয় তুমি স্বয়ং আমাকেও জানতে পারবে। খুবই ভালোলাগার
এই আধ্যাত্ম আলোচনা।
আমরা
দেখেছি দ্রৌপদী নিজের ইচ্ছায় পাঁচ স্বামীকে বিয়ে না করলেও পরিস্থিতির কারণে সেটা
যখন ঘটে গেল,
তিনি
প্রাণপণে চেষ্টা করেছেন সংসারে শান্তি বজায় রাখার জন্যে। কারো প্রতি অবিচার না
করে পঞ্চস্বামীকে তুষ্ট করার এক অনন্য গুরুভার গ্রহণ করেছিলেন দ্রৌপদী। মেনে
নিয়েছিলেন পঞ্চস্বামীকে এবং পঞ্চস্বামীর
অন্য স্ত্রীদের। পুরুষের প্রচুর স্ত্রী এটা পুরুষের অহংকার। কিন্তু একজন
স্ত্রীর পাঁচ- পাঁচজন স্বামী! এ-হেন কাজ তখন আর্যাবর্তে মহাপাপ। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ
তাঁকে বললেন এ কাজ জগত সংসারে পাপ হতে পারে, কিন্তু তুমি শুদ্ধ মনে এ কাজ গ্রহণ করেছ তাই তুমি
সতী হবে। অর্থাৎ সেদিন রামায়ণ যে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি সে প্রশ্নের উত্তর
রচিত হয়েছিল মহাভারতের মহারণে। সেখানে
পঞ্চস্বামী এক নারীর সম্মান রক্ষ্যার্থে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে যুদ্ধে
নেমেছিলেন। অর্থাৎ অামরা দেখলাম যে
রাম যে সম্মান সীতাকে দিতে পারেন
নি, সে সম্মান
পঞ্চপান্ডব দৌপদীকে দিয়েছিলেন। দুই গ্রন্থের কাহিনীকে তুলনা করলে সমালোচনার
দৃষ্টিতে দেখা যেতেই পারে যে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তে ধর্মরক্ষার লড়াইয়ে বহু
প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন ত্রেতা আর দ্বাপরের দুই অথচ এক অগ্নিকন্যা দ্রৌপদী। দৌপদী
বিবাহ যোগ্যা হতেই. দ্রুপদের ইচ্ছা ছিল
তৃতীয় পাণ্ডব ধনুর্বীর অর্জুনের সঙ্গে দৌপদীর বিয়ে দেবেন। কিন্তু সেই ইচ্ছা প্রকাশ
না করে তিনি একটি ধনু তৈরী করালেন যেটা অসাধারণ
ধনুর্বীর না হলে কেউ তাতে গুণ পরাতে পারবেন না। তারপর ভূমি থেকে অনেক
উঁচুতে এমন ভাবে একটি লক্ষ্য স্থাপন করলেন যাকে বিদ্ধ করতে একটি ক্ষুদ্র ছিদ্রের
মধ্য দিয়ে বাণ চালনা করতে হবে। এইবার দৌপদীর স্বয়ংবর সভার আয়োজন করে তিনি ঘোষণা
করলেন,
যে ঐ
ধনুর্বাণ ব্যবহার করে লক্ষ্যভেদ করতে পারবেন, তাঁকেই দৌপদী বরমাল্য দেবেন। দ্রুপদ আশা করেছিলেন যে অর্জুন
ব্যতীত কেউই এই কার্যে সক্ষম হবেন না। সমবেত রাজারা একে একে উঠে ধনুতে গুণ পরাতে
গিয়ে ব্যর্থ হলেন। তখন কর্ণ উঠে এসে সহজেই
ধনুতে গুণ পরিয়ে শরসন্ধান করলেন। তাই দেখে দ্রৌপদী বলে উঠলেন যে, তিনি সূত জাতীয়কে
বরণ করবেন না। অপমানিত কর্ণ একটু কষ্টের হাসি হেসে ধনুর্বাণ ত্যাগ করলেন।
আরও কয়েকজন রাজার নিষ্ফল চেষ্টার পর সম্মুখে এলেন ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন। আসলে
পঞ্চপাণ্ডবরা তখন মাতা কুন্তিকে নিয়ে বারণাবত থেকে পালিয়ে এসে ব্রাহ্মণের বেশ ধরে
আত্মগোপন করে ছিলেন। সেই ব্রাহ্মণবেশি অর্জুন উঠে এসে মহাদেব ও কৃষ্ণকে স্মরণ করে
বাণযোজনা করে লক্ষ্যভেদ করলেন আর দৌপদীও স্মিতমুখে সেই ব্রাহ্মণবেশী বীরের গলায়
বরমাল্য পরিয়ে দিলেন। ভীম ও অর্জুন দৌপদীকে নিয়ে এসে মাতা কুন্তিকে বললেন যে,তাঁরা ভিক্ষা
এনেছেন। কুন্তি ঘরের ভেতরে। কি আনা হয়েছে না দেখে বললেন, সকলে একসঙ্গে মিলে ভোগ কর।
অর্জুন মাতৃবাক্য লঙঘণ করতে রাজি হলেন না। তখন পাণ্ডবরা স্থির করলেন কৃষ্ণা সবারই
পত্নী হবেন। যাই হোক দৌপদী পঞ্চপাণ্ডবের
পত্নী হলেন। কিন্তু পঞ্চপাণ্ডবের মত বীররা তাঁর স্বামী হলেও দৌপদীকে
সারা জীবন বহু অপমান সহ্য করতে হয়েছে। পণদ্যূতে হেরে যুধিষ্ঠির ভ্রাতা সহ
তাঁর
স্বাধীনতা হারিয়েছেন। ফলে দুরাত্মা দুর্যোধন দ্রৌপদীর চুল মুঠিতে ধরে সভায় টেনে নিয়ে এসে দাসী বলে সম্বোধন করেছেন।
এবং বেশ্যাও বলেছেন তাঁর বস্ত্র পর্যন্ত হরণ করার চেষ্টা করেছেন। ধর্মপরায়ণ পতিদের
কাছে কোনও সাহায্য না পেয়ে দ্রৌপদী
কৃষ্ণের শরণাপন্ন হয়েছেন। যোগবলে সুদূরে থাকা সত্বেও কৃষ্ণ তাঁকে চরম
লজ্জার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। পণদ্যুতে দ্বিতীয়বার পরাজিত হয়ে পাণ্ডবরা যখন বনবাস
করছেন,
তখন
কৃষ্ণ ওদের দেখতে এসেছিলেন। দ্রৌপদী তখন সভাগৃহে তাঁর চরম লাঞ্ছনার কথা শুনিয়ে
কৃষ্ণকে অনেক অনুযোগ করে বলেছেন যে, চারটি কারণে কৃষ্ণ যেন ওকে নিত্য রক্ষা করেন। প্রথমত, কৃষ্ণের সঙ্গে ওর সম্বন্ধ
তিনি কৃষ্ণের ভ্রাতৃবধূ, তিন পাণ্ডবভ্রাতা কৃষ্ণের পিসীমাতার পুত্রবধূ। দ্বিতীয়ত, ওর পবিত্রতা কারণ
উনি যজ্ঞবেদী সম্ভূতা। তৃতীয়ত, ওর সখ্যতা। তিনি কৃষ্ণের অনুগতা সখী। এবং চতুর্থত
কৃষ্ণের শক্তিমত্বা। পঞ্চপাণ্ডব মহাবীর হওয়া সত্বেও রক্ষক হিসেবে কৃষ্ণকে তাঁর
দরকার হয়েছে। সাধারণত বিপদে আপদে ভীমই ছিলেন। দ্রৌপদীর ভরসা। ভীমও দ্রৌপদীকে রক্ষা
করতে সবসময়েই তৎপরতা দেখিয়েছেন। কৌরব সভায় দ্রৌপদীর অপমান প্রত্যক্ষ করে ভয়ানক
প্রতিজ্ঞা,
দ্রৌপদী-হরণ
প্রচেষ্টার জন্য, জয়দ্রথকে অমানুষিক প্রহার, দ্রৌপদীর ওপর বলপ্রয়োগের জন্য পাপিষ্ঠ কীচককে বধ, কীচকের স্বজন কর্তৃক
কীচকের সঙ্গে দ্রৌপদীকে দাহ করার অপচেষ্টা নষ্ট করা, ইত্যাদি ব্যাপারে ভীমকেই সচেষ্ট
দেখা যায়। দ্রৌপদী তাঁর তেজস্বিতার জন্য
সুপরিচিত ছিলেন। অজ্ঞাতবাস শেষ হবার পর কৌরবদের সঙ্গে শান্তি-স্থাপনের আগ্রহে যখন
যুধিষ্ঠির,
অর্জুন, এমন কি ভীমসেন
পর্যন্ত আগ্রহ প্রকাশ করছেন, তখন দ্রৌপদী কৃষ্ণকে বলছেন যে, রাজ্যার্ধ না দিলে কখনোই সন্ধির প্রস্তাব যেন না করা হয়।
সবাই কি ওর লাঞ্ছনার কথা ভুলে গেছেন? তারপর নিজের খোলা চুল কৃষ্ণের সামনে তুলে ধরে
বলেছেন যে,
কৃষ্ণ
যেন মনে রাখেন - দুঃশাসন এই চুলগুচ্ছ স্পর্শ করেছে! তারপর ভীমার্জুনকে উদ্দেশ্য করেই কৃষ্ণকে বলেছেন যে, ভীমার্জুন যদি যুদ্ধ
করতে না চান,
তাহলে
ওর বৃদ্ধ পিতা ওর ভ্রাতাদের এবং ওর পাঁচ
পুত্র ও অভিমন্যুকে সাথে নিয়ে যুদ্ধ
করবেন। দ্রৌপদীর এই তেজোস্বিতা পাণ্ডবদের,বিশেষ অরে ভীমকে যেরকম উদ্দীপ্ত
করেছে,
কৌরবদের
সেই রকম ভীতি উৎপাদন করেছে। মহাযুদ্ধের শেষে গভীর রাত্রে অশ্বত্থমা পাণ্ডবশিবিরে
ঢুকে দ্রৌপদীর ভ্রাতা ও পুত্রদের হত্যা করেছেন যেনে দ্রৌপদী শোকে দুঃখে বিহবল
হয়েছেন। বলেছেন অশ্বত্থমা নিহত না হলে অনাহারে প্রাণত্যাগ করবেন। যুধিষ্ঠির যখন
ওকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছেন, তখন তিনি ভীমকে বলেছেন অশ্বত্থমাকে বধ করে ওর মস্তকের
সহজাত মণি এনে যুধিষ্ঠিরকে দিতে। ভীম তখন অশ্বত্থমার খোঁজে গেছেন। যুধিষ্ঠির যখন
যুদ্ধজয় করেও বিষাদগ্রস্থ হয়ে বনবাসের কথা ভাবছেন, তখন দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে স্মরণ
করিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁর এই চিন্তা ক্ষত্রিয়জনোচিত নয়। পুত্রদের হারিয়েও দ্রৌপদী বাঁচতে চাইছেন, তাহলে যুধিষ্ঠিরের
এই অবস্থা কেন। ধর্মপথে যুধিষ্ঠির পৃথিবী শাসন করুন। মহাপ্রস্থানের পথে মহাশৈল
মেরুর কাছে এসে দৌপদীই প্রথমে পতিত হলেন।
ভীমের
প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেছেন যে, অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদীর পক্ষপাত ছিল। সেই দোষেই
এমনটা ঘটল। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে মহাভারতের শেষে পঞ্চপান্ডবসহ দ্রৌপদীর
মহাপ্রস্থান হয়েছিল। যা মহাভারতের আলোকে দ্রৌপদী চরিত্র শ্রেষ্ঠ নারী হিসেবে
চিত্রিত করা হয়েছে। সমগ্র বিশ্বে
দৌপদী অাজও তুলনাহীনা। সৌভাগ্যশালিনী।
এদিকে
রামচন্দ্র লাভ করেছিলেন কোমল- নিষ্ঠাবান রূপবতী জনক নন্দিনীকে। চারিত্রিক দৃঢ়তা
দিয়ে রাম নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন আদর্শ পুত্র বা ভ্রাতা হিসেবে, আদর্শ স্বামীরূপে
নয়। যার জন্য সন্তানসম্ভবা সীতা হয়েছিলেন আশ্রমবাসিনী। পরে দুঃখে, শোকে, লজ্জায় অপমানিত হয়ে
পুনর্বার প্রবেশ করেছিলেন ভূগর্ভে। সীতার পিতা জনক রাজা না কি মহত ছিলেন একথা আমরা
সকলেই জানি। তাই এমন প্রশ্ন আসাও অযুক্তিক নয় এটা কেমন মহত্ব? রামায়ণে রাজকন্যা
সীতার খোঁজ নিতে এবং তাঁকে বিপদের সময় সাহায্য করতে বা তাঁকে উদ্ধার করতে তাঁর
পিতা বা পিতৃকুলের কেউই এগিয়ে আসেননি কেন সেদিন? অন্যদিকে মহাভারতের কুরুক্ষেত্র
যুদ্ধে দ্রৌপদীর ভ্রাতা ধৃষ্টদ্যুম্ন পঞ্চপান্ডবের পক্ষে প্রধান সেনাপতির ভূমিকা
নিয়েছিলেন। ঠিক যেমন এখনকার কালে আদরের একমাত্র বিবাহিত বোনের বিপদে আপদে
ভগ্নীপতির পাশে এসে দাঁড়ান তাঁর ভ্রাতা। অামরা অারো পেয়েছি মহাভারতে, অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীন দাদা ধৃষ্টদ্যুম্ন যখন
দ্রৌপদীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন. তখন দৌপদী
নিদারুণ অভিযোগের সুরে বলেছিলেন, "আমার কি স্বামী, ভ্রাতা, পিতা কেউ নেই? থাকলে আজ রাজসভায়
বিবস্ত্রা হয়ে এমন অপমান সইতে হত না।" কত লাঞ্ছনা ও অপমান সহ্য করেও স্বামী
বা ভ্রাতাকে পরিত্যাগ করিনি আমি। তবে আমারা দেখেছি তাঁর দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে
সেই শ্রীকৃষ্ণ। এর পরেও এই প্রশ্ন আসা তো।স্বাভাবিক যে সয়ং রামচন্দ্র যাঁর স্বামী তবুও অভাগিনী
অবাঞ্ছিতা কেন ছিলেন সীতা? রামচন্দ্র নিজ পরিচয়ে রূপবতী সীতাকে লাভ করে সীতার
রাজমর্যাদা শুধু যে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তা নয়। সীতাপতি রামের একটাই স্ত্রী। আবার
সীতাও কেবল-ই রামের সম্পত্তি। আর দ্রৌপদী বহুবল্লভা। এবং তাঁর স্বামীরাও বহুপত্নীক। এখানে যুধিষ্টিরের বলা অসাধারণ একটা কথা মনে পরছে
"ধর্ম অতি সূক্ষ্ম বিষয়; সুতরাং, আমরা এর গতি বুঝতে পারি না; তাই প্রাচীনেরা যে পথে গিয়েছেন, আমরাও সেই পথের
অনুসরণ করে চলি। আসলেই তো ধর্মের সূক্ষ্মতম ব্যপার গুলো অনেক সময় বোঝা কঠিন হয়ে
যায়। আমরা শুধু নিয়মের নিয়ম পালন করেই যাই।" সম্পূর্ণ
মহাভারতে কেবল কর্ণ, দুর্যোধন ও দুঃশাসন ভিন্ন আর কোনো ব্যক্তি দ্রৌপদীকে পঞ্চস্বামী নিয়ে
কোনও কটু কথা বলেননি। বরং, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, পিতামহ ভীষ্ম, আচার্য দ্রোণ ও তৎকালীন
সকল মুনি-ঋষি অত্যন্ত আদরের সাথে দ্রৌপদীকে গ্রহণ করেছিলেন। পঞ্চপান্ডবের সম্পত্তি
দৌপদী পেয়েছিলেন সামাজিক মর্যাদা। দৌপদীই
পান্ডবভ্রাতাদের মধ্যে একতা, সংহতি ও
ভ্রাতৃত্ববোধ জীবনের শেষ পর্যন্ত এক সুতোয়
গেঁথে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর জন্যই পান্ডবরা বুঝতে পেরেছিলেন যে একতাই
বল।দ্রৌপদী সম্ভবত পুরাণের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ও বিতর্কিত নায়িকা পঞ্চপাণ্ডবের
যিনি সহধর্মিনী। যাঁর জন্য কৃষ্ণের পাঞ্চজন্যের বজ্রনিনাদে অনুরণিত হয়েছে
ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার বাণী। সেই অনুরণনে অবিচলিত হাল ধরে ছিলেন ভরতবংশের কুলবধু
দ্রৌপদী। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে গেছেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ
শেষে যুধিষ্ঠির যখন হস্তিনাপুরের রাজা হন তিনি পুনরায় রাণী হন।
পুরুষের সমাজে দৌপদীকে বারবার অপমানে দলিত হতে হলেও তিনি আপন তেজে ও ব্যক্তিত্বে
স্বমহিমায় মহাভারত মহাকাব্যে তিনি এক উজ্জ্বল অগ্নিকন্যা। শ্রীকৃষ্ণের
কৃপাধন্যা দ্রৌপদী ধৈর্য্য, সহ্য, মনোবলে তাঁর শ্বশ্রূমাতা কুন্তীর মত পঞ্চকন্যার অন্যতমা হয়ে উঠেছেন।
কিন্তু তেজস্বিনী নারীকে অনন্য বলে
বিশ্লেষিত করলেও আদর্শ বলতে সমাজের বুকে আর মুখে বাঁধে। সেই দিক দিয়ে সীতা আদর্শ
হতে পেরেছেন সমাজের কাছে। কারণ সীতা জনম
দুখিনী। অত্যন্ত দুর্বল প্রকৃতির, নির্বিরোধী, সর্বংসহা, নির্জীব এক নারী। জিনি নিজেকে
নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেন না, পারেন না কোনো প্রতিবাদ করতে। নিজের বা অন্য কোনো নারীর
প্রতি অন্যায়,
দুর্ব্যবহার
অথবা কটূক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সে অসমর্থ। তাই সীতা চরিত্র ভারত উপমহাদেশের
এক আদর্শ নারীর উদাহরণ, সেই আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত। সীতার মতোন নারীকেই মুখ
বুজে সকল অত্যাচার সহ্য করার ভূমিকায় দেখেই অভ্যস্ত থাকতে ভালো বাসে সমাজ। সীতার
সঙ্গে একাত্ম বোধ করেননা এমন বাঙালি পাওয়া যাবে না। কিন্তু আমি একজন নারীবাদী হলেও
আমার মনে হয়েছে অগ্নিপরীক্ষার ব্যবস্থা শ্রীরামচন্দ্রের চরম বিচক্ষণতার পরিচয়।
বাল্যকাল থেকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে তাঁর মেলামেশা ছিল। তিনি বিশ্বামিত্রের ন্যায়
ঋষি থেকে নিষাদরাজ গুহক পর্যন্ত সকলের সুহৃদ ছিলেন। সমাজের মানসিকতা তিনি খুব
ভালভাবে জানতেন। সমষ্টিগত ভাবে সমাজ চিরকাল ব্যক্তির দোষ খুঁজে বেড়ায়। সমাজ তার
মূল্যবোধগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সব সময় খুঁতখুঁতে নজরে সমস্ত ঘটনার বিশ্লেষণ
করতে থাকে। যাতে ব্যক্তি সমাজের দোষদৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে সমস্ত কাজে সাবধানতা
অবলম্বন করে। আবহমান কাল থেকে সমাজের অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই হল পরনিন্দা।
রাবণের কারাগার থেকে উদ্ধৃত সীতার চরিত্র নিয়ে সমাজে কথা উঠবেই এটা তিনি জানতেন।
অগ্নির থেকেও পবিত্র সীতা প্রজাগণের এই আচরণে অতীব দুঃখ পাবেন এটাও শ্রীরামচন্দ্র
জানতেন। সেজন্য সমাজের প্রমুখ ব্যক্তিদের সামনে রামচন্দ্র অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমে
সীতার চরিত্রের প্রমাণপত্র নেওয়ালেন, যাতে সমাজে এই বিষয়ে কথা না ওঠে। সীতা
শ্রীরামচন্দ্রের যোগ্য সহধর্মিণী–তেজস্বিতার প্রতিমূর্তি। অযোধ্যার সকলের আপত্তিকে
যুক্তিজাল ও দৃঢ় সঙ্কল্পের বলে নস্যাৎ করে তিনি রামচন্দ্রের সঙ্গে বনবাসে
গিয়েছেন। তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তার বলেই বন্দিনী অবস্থাতেও রাবণ দীর্ঘ এক বছরের
সময়কালের মধ্যে তাকে স্পর্শ করেনি। হনুমান তাকে চুপিচুপি নিয়ে আসতে চেয়েছে। তিনি
আসেন নি। তিনি জানেন যে, লঙ্কা থেকে পালানো নয়–প্রয়োজনে রাবণের রাক্ষস মানসিকতার
সংহার করতে হবে। তিনি হনুমানকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন যাতে সে বানর সেনা সহিত
রামচন্দ্রকে নিয়ে ফিরে আসে। রাবণকে ধ্বংস
করার কাজে রামচন্দ্রের প্রধানতমা সহায়িকা হয়েছেন তিনি। তিনি সাধারণ মানবী নন।
তিনি রাজা রামচন্দ্রের পত্নী মহারানি সীতা। রামরাজ্যের সম্রাজ্ঞী তিনি। সীতা যখন গর্ভবতী প্রাণপ্রিয়া ভার্যার পতি তাই
তিনি প্রজার আক্ষেপের কথা যখন জানলেন সীতাকে তা, না জানিয়ে চুপিসাড়ে নিরাপদ
আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিলেন–তপোবনে। সেখানে তপস্যার প্রভাবে সিংহ আর হরিণ একসঙ্গে খেলা
করে। লৌকিক কলুষ সেখানে প্রবেশ করে না। সেখানে সকলে নির্ভয়। সেখানেই তাঁর হবু
পুত্র শিক্ষালাভ করবে।রামচন্দ্রের এই কাজ নিয়ে অন্যরা যে মনোভাবই পোষণ করুন না কেন, সীতা যে এর ঔচিত্য
নিয়ে সন্দেহ করবেন না সেটা প্রায় তিন দশকের দাম্পত্যের পরে রামচন্দ্র জানেন। সীতার
সঙ্গে রামচন্দ্রের সম্পর্ক পবিত্র, হার্দিক এবং অলৌকিক। সেখানে অপবিত্রতা, সন্দেহ, কামগন্ধের লেশ নেই–আক্ষরিক
অর্থেই স্বর্গীয় সৌরভে আমোদিত নিশ্ছল, নিঃস্বার্থ প্রেম সেই দাম্পত্যের ভিত্তি। রাজা
রামচন্দ্র ও প্রেমিক পতি রামচন্দ্র একটি সন্তুলিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি সীতাকে
কিছু না জানিয়ে তপোবনে পাঠিয়েছেন। সিদ্ধান্তের কথা সীতাদেবীকে জানাতে হলে প্রজার
আক্ষেপের কথাও জানাতে হয়–যার পরিণাম অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ। এই ঝুঁকি এড়াতে
পরবর্তীতে শ্রীরামচন্দ্র আর কখনও সীতাকে অযোধ্যায় আনতে চাননি। এবং ফিরিয়ে আনতেও
চাননি। চাননি কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করাতেও। কিন্তু, বিধির অলঙ্ঘ্য
বিধানে সীতা এসেছেন। অতি স্বাভাবিক ভাবেই তার ফল ভাল হয়নি। রামচন্দ্রের আশঙ্কা
সত্য করে সীতা পাতালে প্রবিষ্টা হয়েছেন–অগ্নিপরীক্ষার থেকেও কঠিনতর সিদ্ধান্ত
নিয়েছেন। উত্তর বঙ্গের এক রাজবংশী সম্প্রদায়ের
যাত্রাপালায় সীতার অপমানের কাহিনীকে কেন্দ্র করে যাত্রার ডায়লগ অাছে "
ভাত কাপড় দেওয়ার মুরোদ নেই, ঘরের বাইরে লক্ষ্মী মেয়েটাকে বের করে দিলা গো!"
যিনি পিতৃসত্য পালনের জন্য চৌদ্দ বছর বনবাসে কাটিয়েছেন, নিজের জীবন বাজি রেখে রাবণের
বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, ধর্ম ও নারীর সম্ভ্রম রক্ষার জন্য রামরাজ্যের প্রবর্তন
করেছেন সেই পুরুষোত্তম রামচন্দ্রকে নারীবিদ্বেষী ও নীচ চরিত্রের বলে প্রতিপন্ন না
করে প্রতিকী দৃষ্টিতে দেখা যেতেই পারে। যেমন দ্রৌপদীর অবস্থা দেখে প্রতিভা বসু
মন্তব্য করেছেন,
'দ্রৌপদী
‘যেন খেলার বল। একের কাছ থেকে যাচ্ছে অপরের কাছে।
তাহলে তো
দ্রৌপদীকে আরো অনেক সম্মানে ভূষিতা করলেও অন্তত তাঁকে আর সৌভাগ্যশালী বলা যায়না? সেভাবে যদি লক্ষ্য করা যায় দেখা যাবে দ্রৌপদীর
প্রতি পঞ্চপাণ্ডবের অবহেলা।সত্যিইতো
পাণ্ডবরা কেউই দ্রৌপদীর মন বোঝার চেষ্টা করেননি। একমাত্র কৃষ্ণই বুঝেছিলেন
ঠিকঠাক দ্রৌপদীকে। কারণ দ্রৌপদী ছাড়াও যে দেখা যায় প্রত্যকেই আরো কয়েকটি করে
বিয়ে করেছেন এবং কি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিও। স্বয়ংবর সভায় অর্জুন জলে প্রতিফলিত
ছায়া দেখে তার অব্যর্থ তীর ধনুক দিয়ে ঝুলন্ত মাছের চক্ষু ভেদ করে প্রতিযোগিতায়
জয়ী হয়ে দ্রৌপদীকে বিবাহ করতে সমর্থ হন। তারপর পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গেই দ্রৌপদীর
বিয়ে হয়। এক্ষেত্রেও প্রশ্ন উঠতে পারে কেন
দ্রৌপদীর মত এক তেজস্বিনী নারী অন্যের চাপিয়ে দেওয়া পঞ্চপান্ডবের স্ত্রী হতে
অস্বীকৃতি জানালেন না বা বিরোধিতা করলেন না? এটার ব্যাখ্যা কি এই, সে-সময়ে নারীর
মতামতের কোনো মূল্য ছিল না? বা কেউ তা গ্রাহ্য করতো না? নাকি আত্মপ্রত্যয়ের আদর্শগত বিভিন্ন দিক তুলে
ধরতেই হয়েছিল এমোন সব চরিত্র নির্মাণ।
এই
গ্রন্থদুটিতে দুই নারীর ধৈর্য্য, সহ্য, মনোবল এবং সাহসের প্রতিকী হল আমাদের আত্মার সন্মান। আর
তাঁদের লাঞ্ছনা লজ্জাহীন কিছু পুরুষের
প্রতি ঘৃণা। একটু ভেবে দেখলে দেখা যায় যে, অগ্নিপরীক্ষার ব্যবস্থা
শ্রীরামচন্দ্রের চরম বিচক্ষণতার পরিচয়। বাল্যকাল থেকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে তাঁর
মেলামেশা ছিল। তিনি বিশ্বামিত্রের ন্যায় ঋষি থেকে নিষাদরাজ গুহক পর্যন্ত সকলের
সুহৃদ ছিলেন। সমাজের মানসিকতা তিনি খুব ভালভাবে জানতেন। সমষ্টিগত ভাবে সমাজ চিরকাল
ব্যক্তির দোষ খুঁজে বেড়ায়। সম্ভবতঃ, সমাজ তার মূল্যবোধগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য
সবসময় খুঁতখুঁতে নজরে সমস্ত ঘটনার বিশ্লেষণ করতে থাকে। যাতে ব্যক্তি সমাজের
দোষদৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে সমস্ত কাজে সাবধানতা অবলম্বন করে। আবহমান কাল থেকে
সমাজের অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই হল পরনিন্দা। রাবণের কারাগার থেকে উদ্ধৃত
সীতার চরিত্র নিয়ে সমাজে কথা উঠবেই এটা তিনি জানতেন। অগ্নির থেকেও পবিত্র সীতা
প্রজাদের এই আচরণে খুব দুঃখ পাবেন এটাও শ্রীরামচন্দ্র জানতেন। সেজন্য সমাজের
প্রমুখ ব্যক্তিদের সামনে রামচন্দ্র অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমে সীতার চরিত্রের
প্রমাণপত্র নেওয়ালেন, যাতে সমাজে এই বিষয়ে কথা না ওঠে। সীতা শ্রীরামচন্দ্রের যোগ্য
সহধর্মিণী– অতুলনীয়া এক প্রতিমূর্তি। অযোধ্যার সকলের আপত্তিকে যুক্তিজাল ও দৃঢ়
সঙ্কল্পের বলে নস্যাৎ করে তিনি রামচন্দ্রের সঙ্গে বনবাসে গিয়েছেন। তাঁর চরিত্রের
দৃঢ়তার বলেই বন্দিনী অবস্থাতেও রাবণ দীর্ঘ এক বছরের সময়কালের মধ্যে তাকে স্পর্শ
করেনি। হনুমান তাকে চুপিচুপি নিয়ে আসতে চেয়েছে। তিনি আসেন নি। তিনি জানেন যে, লঙ্কা থেকে পালানো
নয়–প্রয়োজনে রাবণের রাক্ষস মানসিকতার সংহার করতে হবে। তিনি হনুমানকে ফেরত পাঠিয়ে
দিয়েছেন যাতে সে বানর সেনা সহিত রামচন্দ্রকে নিয়ে সমগ্র ফিরে আসে। রাবণকে ধ্বংস
করার কাজে রামচন্দ্রের প্রধানতমা সহায়িকা হয়েছেন তিনি। তিনি সাধারণ মানবী নন।
তিনি রাজা রামচন্দ্রের পত্নী মহারানি সীতা। রামরাজ্যের একমাত্র সম্রাজ্ঞী তিনি।
রাম যখন জানলেন যে তাঁর প্রাণপ্রিয়া ভার্যা গর্ভবতী। তিনি তখন সীতাকে প্রজার
আক্ষেপের কথা না জানিয়ে চুপিসাড়ে নিরাপদ
আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিলেন–তপোবনে। সেখানে তপস্যার প্রভাবে সিংহ আর হরিণ একসঙ্গে খেলা
করে। লৌকিক কলুষ সেখানে প্রবেশ করে না। সেখানে সকলে নির্ভয়। সেখানেই তাঁর হবু
পুত্র শিক্ষালাভ করবে।রামচন্দ্রের এই কাজ নিয়ে অন্যরা যে মনোভাবই পোষণ করুন না কেন, সীতা যে এর ঔচিত্য
নিয়ে সন্দেহ করবেন না সেটা প্রায় তিন দশকের দাম্পত্যের পরে রামচন্দ্র জানতেন।
সীতার সঙ্গে রামচন্দ্রের সম্পর্ক পবিত্র, হার্দিক এবং অলৌকিক। তিনি সীতাকে কিছু না জানিয়ে
তপোবনে পাঠিয়েছেন। সিদ্ধান্তের কথা সীতাদেবীকে জানাতে হলে প্রজার আক্ষেপের কথাও
জানাতে হয়–যার পরিণাম অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ। এই ঝুঁকি এড়াতে পরবর্তীতে
শ্রীরামচন্দ্র আর কখনও সীতাকে অযোধ্যায় আনতে চাননি। পত্নীকে ছাড়া যজ্ঞ অসম্ভব
জেনে নতুন করে বিয়েও তো করেননি সীতাপ্রেমিক। রাম দীক্ষিত এক পত্নীব্রতে। আসলে চিরবিরহিণী
সীতাকে কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করাতে চাননি রাম। কিন্তু, বিধির অলঙ্ঘ্য
বিধানে সীতা এসেছেন। অতি স্বাভাবিক ভাবেই তার ফল ভাল হয়নি। রামচন্দ্রের আশঙ্কা
সত্যি করে সীতা পাতালে প্রবিষ্টা হয়েছেন–অগ্নিপরীক্ষার থেকেও কঠিনতর সিদ্ধান্ত
নিয়েছেন। যিনি পিতৃসত্য পালনের জন্য চৌদ্দ বছর বনবাসে কাটিয়েছেন, নিজের জীবন বাজি
রেখে রাবণদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। রামরাজ্যের প্রবর্তন করেছেন। সেই
মর্যাদাপূর্ণ পুরুষোত্তম রামচন্দ্রকে নারী বিদ্বেষী ও নীচ চরিত্রের বলে প্রতিপন্ন
না করে বরঞ্চ সমগ্র বিশ্বের
তুলনাহীনা সীতা ও বীরাঙ্গনা দ্রৌপদী যাঁরা মহামুনি বাল্মীকি এবং কৃৃৃৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস রচিত
দুই
ইতিহাস এবং কাব্যগ্রন্থের প্রাতঃস্মরণীয়া
দুই নারী পরমাপ্রকৃতির প্রতীকী সেই
বিশ্লেষণের দিকে লেখাকে এগিয়ে নিয়ে যাব। দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী তবুও তিনি সতী দেবী
রূপে পূজিতা। ব্রহ্মের ধর্ম সৎ, চিৎ ও আনন্দ এটা ভারতীয় আস্তিক দর্শন। সত্ শব্দের অর্থ
চিরস্থায়ী। সত্ - এর স্ত্রী লিঙ্গ হল সতী। নরদেহ পঞ্চতত্ত্বের সমন্বয় - ক্ষিতি, অপ্. তেজ, মরুত্ ও ব্যোম। এই
পঞ্চতত্ত্ব হল পঞ্চপাণ্ডব। ব্যোম তত্ত্ব হলেন যুধিষ্ঠির, তাই তিনি সর্গারোহণ করেন। মরুত্
- ভীম,
তেজ-
অর্জুন,
অপ্ -
নকুল এবং ক্ষিতি - সহদেব। কুলকুণ্ডলিনী শক্তি হলেন দ্রৌপদী। এই কুলকুণ্ডলিনী
শক্তিতে প্রাণবন্ত হয়ে পঞ্চপাণ্ডব পঞ্চভূত, চিত্ত স্বরূপ
কুরুক্ষেত্রে মানে চেতন-মন যুদ্ধ করছেন। কাম রিপু- দুর্যোধন, দ্রণ -জেদ, ভীষ্ম -সংশয়, আকাঙ্ক্ষা -কর্ণ, ধৃতরাষ্ট্র -অন্ধ মন, অচেতন মন। সংযম-
সঞ্জয়,
লোভ
-দুঃশাসন,
ক্রোধ-
জয়দ্রত, শকুনি - হিংসা, মোহ - অশ্বত্থামা, কুন্তী- মায়া, বিদুর - ভক্তি, আত্মা- অর্জুন এবং
পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ (সারথী)। ' দ ' - স্থিতি, ' র ' - সূর্য বা প্রকাশ, ' ঔ ' - চন্দ্র, ' প ' -লয়, ' দ '- স্থিতি এবং ' ঈ ' = বিষ্ণু। সূর্যের তেজ প্রভা এবং
চন্দ্রের কমনীয় জ্যোতি যার দ্বারা স্হিত এবং যার মধ্যে লয় পায় সেই বিষ্ণুতে স্থিতি
হল দ্রৌপদীর অর্থাৎ তিনিই হলেন পরম বৈষ্ণবী শক্তি, তিনিই কুলকুণ্ডলিনী শক্তি. তাই দ্রৌপদী সতী
রুপে মান্যতা পেয়েছেন।
সীতা
প্রতীকী --মা সীতা ছিলেন সেই যুগের এক অগ্রগণ্য কৃষি বিজ্ঞানী”।
‘জনক’ মানে পিতা।
জনগণের পিতা,
গোষ্ঠীনেতা
বা সমাজের মাথা। তাঁর বীর্য পড়ল জমিতে, তার পরে লাঙল থেকে উঠে এলেন সীতা। যেন মাটির সাথে
মানুষের প্রথম রমণ হোল। সেই প্রয়াসকে আরও উন্নত করতে, আরও নিরাপদ ও সফল করতে বিশেষ
সম্ভাবনা ও দক্ষতা নিয়ে নতুন প্রজন্মের আবির্ভাব হোল, যার মধ্যে পথিকৃত মা সীতা। কৃষি
তার আগে পর্যন্ত অসংঘটিত, অপরিকল্পিত ও কিছুটা বিশৃঙ্খল। ভ্রাম্যমান জীবনের
অনিশ্চয়তা কাটিয়ে মানুষ তখন সবে স্থায়ী বসতি স্থাপন করার চেষ্টা করছে, জমি ও নদীর সাথে এক
অন্য স্তরের সম্পর্ক গড়ে উঠছে। তার ভিত তৈরি হয়েছে কিছুকাল আগেই যখন পরশুরামকে
দেখেছি কুঠার হাতে গাছ কাটছেন। অর্থাৎ জঙ্গল পরিষ্কার করে ভূমি ফাঁকা করা হচ্ছে।
সেই ভূমি ভেদ করে সীতার উঠে আসা এক যুগ সন্ধিক্ষণের রূপক।
বনবাস
কালে শ্রীরামচন্দ্র, সীতা ও লক্ষ্মণ আর্যাবর্তের বহু অঞ্চলে গেছেন। বেশিটাই অরণ্য। কোথাও
খানিক পাহাড়ি। কোথাও শুকনো কোথাও সিক্ত। যেখানে তাঁরা গেছেন সেখানেই নতুন
বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। গ্রাম নগর এবং বিশেষ করে অরণ্যের আদিবাসীদের সাথে। যেখানে
যেমন জমির চরিত্র ও জল-হাওয়ার বৈশিষ্ট, সেই অনুযায়ী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
কৃষি থেকেই বিস্তার হয় কৃষ্টি। গোটা দেশকে এক সাংস্কৃতিক পরিচয়ের আলিঙ্গনে নিয়ে
এলেন শ্রীরামচন্দ্র। পশ্চিম ভারত প্রায় মরুভূমি হয়ে গিয়েছিল বহু কাল। রামের পা
পড়ল, পশ্চিম প্রদেশ আবার
সবুজ হয়ে উঠল।
অহল্যার
পাষাণমুক্তি হোল। অামরা দেখেছি অপহরণ করার পর রাবণ সীতার কাছে কী
চেয়েছিলেন?
হনুমান
সেই বিশাল দ্বীপ থেকে ফিরে এসে রাম’কে বলেছিলেন, ‘সোনার লঙ্কা’। অর্থাৎ চোখ
ধাঁধানো নগর ও শিল্প সভ্যতা কিন্তু সবুজ নেই। খাদ্যে স্বনির্ভর নয়। কৃষিতে অজ্ঞান।
তাই সীতাকে প্রাসাদে বন্দী না করে অশোক বনে রাখা হোল। যাতে ভয় দেখিয়ে তাঁর কাছ
থেকে কৃষি বিজ্ঞানের নিত্যনতুন বিদ্যা রপ্ত করা যায়। কিন্তু অধার্মিক রাবণের এই
গা-জোয়ারি দাবি সীতা মানলেন না। শ্রদ্ধা ও বিনয় না থাকলে কোন উন্নত জ্ঞান অর্জন
করার যোগ্যতা বা অধিকার জন্মায় না। বিভীষণের সেই মানবিক গুণগুলি ছিল। তাই আমরা
অনুমান করতে পারি যে তিনি সিংহাসনে বসার পর শ্রীরামচন্দ্র কোন কার্পণ্য করেননি।
আমি নিজে চোখে দেখে এলাম শ্রীলংকাকে ঐ ছোট্টো একটা দেশ যা সাগর দ্বীপ ওই দেশের সকল
মানুষের মধ্যে সীতাম্মা এক জাগ্রত ইষ্টরূপ। শ্রীলংকাবাসীদের বড় আদরের দেবী তিনি।
শুধু মাত্র দ্রোপদী, সীতাই নয় পৌরাণিক অনেক নারী
চরিত্রেই প্রতীকী সংকেতের মাহাত্ম্য অাছে। যেমন - রাধা, দুর্গা পার্বতী, উমা, সতী, কালী এদের সবার অন্তর্নিহিত
দর্শন সর্বজনীন,
চিরন্তন।
কপিরাইট
লক্ষ্মী নন্দী কর্তৃক সংরক্ষিত
উৎসঃ
১/মহাভারত - রাজশেখরবসু
২/শ্রীমদ্ বাল্মীকীয় রামায়ণ
৩/ সংক্ষিপ্ত মহাভারত ( গীতাপ্রেশ)
৪/ অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত, এম. ফিল, ইতিহাস।
৫/ উদ্বোধন পত্রিকা ( স্বামী সারদানন্দ)
৬/ মহাভারত - রামায়ণ উইকিপিডিয়া
৭/সনাতন কথামৃত /
৮/ স্বামী পরমানন্দ মহারাজ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন