মুখোমুখি শীলা
বিশ্বাস
সম্পাদক: সকলের আগে ত্রৈমাসিক
রংরুটের পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। রংরুটের এই বিশেষ সংখ্যায় আপনাকে স্বাগতম। প্রথমেই
যে বিষয়টি জানতে চাইবো সেটি হলো, কবিতাই বা কেন? অর্থাৎ কবিতা ছাড়া আরও তো অনেক বিষয়
রয়েছে সাহিত্যের। সেখানে কবিতা নিয়ে আপনার আগ্রহের উৎস কি? এবং মোটামুটি ভাবে জীবনের
কোন পর্যায় থেকে এই আগ্রহের সূত্রপাত। এবং এই বিষয়ে বিশেষ কারুর প্রভাব যদি থেকে থাকে
আপনার জীবনে।
শীলা
বিশ্বাস: প্রথমেই
জানাই আপনাকে অন্তরিক ধন্যবাদ, ত্রৈমাসিক রং রুটের বিশেষ
‘সাক্ষাৎকার’ সংখ্যায় আমার মতো একজন সামান্য শব্দ শ্রমিককে আপনি নির্বাচিতের
তালিকায় রেখেছেন এবং নিজের কথা ও মতামত সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ করে
দিলেন। আমি এটাকে সাক্ষাৎকার বলছি না কারণ সাক্ষাৎকার দেওয়ার মতো এতোটা যোগ্যতা
আমার হয়নি বরং কথোপকথন বা আলোচনা বলা যেতে পারে।
হ্যাঁ
মূলত কবিতা লিখি। গদ্য খুব কম লেখা হয়। কবিতাই কেন প্রশ্নের উত্তর আমার ঠিক জনা
নেই। তবে আমি নিজের সঙ্গে অনবরত নিজে কথা বলতে থাকি। সেই কথাগুলিই বোধ হয় অবয়ব
পেতে চায়। কবিতা লেখা আসলে এক ধরণের মুক্তি আমার কাছে। কবিতা একটা আশ্রয়।
ভালো লাগা। যা আমি অন্য কোথাও পাইনা। সম্পূর্ণ সময়ের লেখক নই তবে মাথার মধ্যে চিন্তা সব সময় কিছু না কিছু চলতে
থাকে। একটানা বসে অনেকক্ষণ লেখার সময় আমার নেই। তাই দীর্ঘ লেখাগুলি বেশিরভাগ
অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আবার যখন সেই লেখাতে ফিরতে চাই লেখাটা হারিয়ে যায়। এই জন্যই
বোধ হয় গদ্য কম লেখা হয়।
জীবনের
কোন পর্যায় থেকে বা প্রভাব বলতে গেলে একটু বিশদে বলতে হয়। স্কুল ম্যাগাজিন
মালঞ্চতে একটা ছড়া প্রকাশিত হয়েছিল। তখন ক্লাস এইট, সুরেন্দ্রনাথ
বালিকা বিদ্যালয়, বাকসারা হাওড়া। ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখে সে কী আনন্দ।
শুরুটা ছিল এইরকম ' ঘড়ি বলে টিক টিক /মা বলেন পড়া করো ঠিক ঠিক.....' মাধ্যমিক
পর্যন্ত হাওড়ায় ছিলাম। তারপর ১৯৮৯- এ কলকাতায়
চলে আসি। বাবা ছিলেন সরকারি কর্মী। সাঁত্রাগাছি সরকারি আবাসনে অনেকটা এলাকা
জুড়ে ছিল আমাদের আবাসনটি। সুন্দর
সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ছিল। কৃষ্টি নামে একটি সাংস্কৃতিক সংস্থায় কবিতা আবৃত্তি, নাটক
করতাম। তবে ছোটো থেকেই দেখতাম বাবাকে (শ্রী নেপাল
চন্দ্র চৌধুরী ) সঞ্চয়িতা হাতে নিয়ে জোড়ে জোড়ে কবিতা পড়তেন। ‘মরণ রে তুহু মম শ্যাম
সমান’ তখন অর্থ বুঝিনি। শ্রাবণ মাসে সুর করে মনসা পুঁথি পড়তেন।
অবচেতন মনে গেঁথে যেত। আর আমাদের বাড়িতে খুব রেডিও বাজতো। গান বিশেষ করে রবীন্দ্র
সঙ্গীত। রবীন্দ্র সঙ্গীত ছোটো থেকেই আমাকে উদাস-বিভোর করে। কবিতার প্রতি আকর্ষণের
শুরু বা আমার লেখা পঙক্তি যদি কবিতা হয়ে থাকে তাহলে তার উৎসমুখ বোধ হয় রবি ঠাকুরের
গানের প্রতি আমার প্রেম। তবে কোনোদিন আমি লিখবো বা আমার
কবিতার বই প্রকাশিত হবে এরকম স্বপ্ন দেখিনি। তারপর পড়াশুনা, কর্ম
জীবন, সংসার
জীবন এগুলিকে খুব প্রাধান্য দিয়েছিলাম। আমার পুত্র সন্তান সপ্তর্ষির বাংলা বিষয়ের
জন্য কোনোদিন গৃহশিক্ষক রাখতে হয়নি, আই
সি এস সি বোর্ডের পাঠ্য যা ছিল আমি পড়ে শোনাতাম,আমার
কোলে মাথা রেখে সে শুনত। ছোটদের সাহিত্যের বই কিনে এনেও শোনাতাম। একটা ঐশ্বরিক
ব্যাপার ছিল এর মধ্যে।এই ইনভল্ভমেন্টটাই আমাকে ঠেলে দিল নিজের কথা লেখার দিকে।
কিন্তু যেহেতু লেখক হওয়ার পরিকল্পনা ছিল না তাই সেরকম ভাবে নয়, পাড়ায়
একটি দেওয়াল পত্রিকায় নিজের একটি কবিতা
দিয়েছিলাম। শূন্য দশকের শেষের দিকে আমার মায়ের আকস্মিক
মৃত্যু আমার মধ্যে একটা শূন্যতার সৃষ্টি করে।
সেখান থেকে মাকে নিয়ে কিছু লেখা লিখলাম। এদিক
ওদিক পড়ে থাকতো লেখাগুলি। আমার শাশুড়ি মা মাঝে মাঝে ছেঁড়া পাতা কুড়িয়ে রাখতেন।
তিনি আমার লেখালিখিতে উৎসাহ দেন। আমার ‘জঠর কন্যা’ কবিতাটি শুনে কেঁদেই ফেলেছিলেন।
এরকম ভাবেই অল্পবিস্তর লেখালিখি চলছিল।
আমার কাকা শ্রী শিবব্রত দেওয়ানজি (বাবার পিসতুতো ভাই ) কবি ও মধ্যবলয়
পত্রিকার সম্পাদক। একদিন আমার লেখার পাণ্ডুলিপি তৈরী করে আমার কাকার কাছে পাঠিয়ে
দিলাম। ওঁর কাছে সবুজ সঙ্কেত পেয়ে বই প্রকাশের কাজে এগিয়ে গেলাম।
সম্পাদক: এবারে আসি আপনার নিজের
লেখার বিষয়ে, কোন বিশেষ লেখকের প্রভাব সম্বন্ধে আপনি কি সচেতন? যেমন, অনেকেই আমরা আমাদের
খুব প্রিয় লেখকের দ্বারা মনের অজান্তেই প্রভাবিত হয়ে পড়তে পারি। আবার অত্যন্ত সচেতন
ভাবে প্রিয়তম লেখকের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার প্রয়াসও করতে পারি। আপনার নিজের
লেখালেখির ক্ষেত্রে বিষয়টি ঠিক কি রকম?
শীলা
বিশ্বাস: কবিতা
পড়তে পড়তে আমার নিজের কবিতা লেখার ইচ্ছা হয়। সেই স্পার্কটার জন্য অপেক্ষা করি।
খুব বেশি আমি লিখতে পারি না। পর পর অনেক লেখা আসে না। প্রথম দিকে বিখ্যাত (মিডিয়া)
কবিদের লেখা খুব পড়তাম। তবে প্রভাবিত হতে চাই নি বলে একজন কবির লেখা বা একটি বই টানা পড়তাম না। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে
বিভিন্ন কবির লেখা পড়তাম। লিটিল ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে বিভিন্ন কবি, আড়ালে
থাকে কবিদের খুঁজে পাই। তবে সব রকম লেখা পড়ি। কী লিখব না সেটা বোঝার জন্যেও সব রকম
লেখা পড়তে হয়। কবিতার যেহেতু কোনো সংজ্ঞা নেই। তাই সবার লেখাই পড়ি। আর এখন যেহেতু
ওয়েবজিন সম্পাদনা করি এখন তো পড়তেই হয়। সময়ের
সঙ্গে পছন্দ পাল্টেছে। লিখতে গেলে পড়তে হবে এবং সচেতন ভাবে প্রভাব থেকে
বেরিয়ে আসতে হয়। নিজস্ব স্বর বা উচ্চারণ
না থাকলে সে কবি নয়।
সম্পাদক: কবিত লেখার বিষয়ে, আপনি
কি আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশেই বিশ্বাসী, নাকি মহাকবি টি এস এলিয়টের সেই বিখ্যাত
উক্তির মতো আপনিও বিশ্বাস করেন, “Poetry is not a turning loose of emotion,
but an escape from emotion; it is not the expression of personality, but an
escape from personality. But, of course, only those who have personality and
emotions know what it means to want to escape from these things.” এলিয়ট কথিত এই যে ব্যক্তিগত আবেগ ও আপন ব্যক্তিত্বের
বদ্ধ আবহাওয়া থেকে মুক্তির আনন্দই কবিতা, আপনার কবিজীবনের পর্বে এরকম অভিজ্ঞতা ঘটেছে
কি কখনো?
শীলা
বিশ্বাস: ব্যক্তিগত
আবেগ দিয়ে কবিতা লেখা যায় না। কবিতা
লিখতে পারলে সেই আনন্দ ব্যক্তিত্বের বদ্ধ আবহাওয়া থেকে মুক্তি দেয় একথা ঠিক।
পর্যবেক্ষণ, অনুভব দিয়ে কবিতা নির্মিত হয়।
কিছু পঙক্তি অবচেতন থেকে এসে যায়, কিছু চয়ন করে নেওয়া শব্দ দিয়ে অবয়ব
নির্মিত হয়। কাউকে বলতে না পারা এলোমেলো কিছু কথা যা মনের
মধ্যে কিলবিল করে, বাইরে আসার চেষ্টা করে কিন্তু বেরোবার নির্ঘণ্ট সে নিজেই
ঠিক করে,
কারোর শাসন সে সহ্য করে না অর্থাৎ স্বায়ত্ব শাসনে বিশ্বাসী
শব্দ অথবা পঙক্তি অথবা চিত্রকল্প, বহুমাত্রিক অর্থ সম্পন্ন, কুয়াশাময়
কিংবা আপাত সরল কিন্তু গভীরবোধ সম্পন্ন বা দর্শন থেকে জন্ম নেওয়া কিছু অনুভূতির
নাম আমার কাছে কবিতা। কবিতার জন্মের সময় কবিকে যেন কোন অদৃশ্য শক্তি ভর করে, চলে
নিজেকে ভাঙা গড়ার খেলা। শব্দগুলো কোথা থেকে যেন ঝরে পড়ে। তা ধরে না রাখলে ফিরে
পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
অন্তহীন গন্তব্যহীন একলা পথে হেঁটে চলা বা নিজের সঙ্গে কথা বলাই তো কবিতা।
ক্রমাগত বুকে দহন, রক্তক্ষরন আর নিজেকে খননের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যায় কবি।
অপরিপূর্ণ উপসংহারহীন ভাবনাই তো কবিতা যার সৃষ্টি কবিকে অনাবিল মুক্তির আনন্দ দিতে
পারে। সাময়িক আনন্দ কিছু সময় পরে মিলিয়ে
যায়। অতৃপ্তি এসে গ্রাস করে যা তাকে পরবর্তী রচনার
দিকে ঠেলে দেয়। আমি খুব সাধারণ মানুষ। আর সব
মানুষের মতো কবিরও চাওয়া পাওয়া থাকে। কিন্তু
যখন সে লেখে তখন অন্য সত্ত্বা অন্য মানুষ বা আলাদা ব্যক্তিত্ব।
আমি নিজের মধ্যে আলাদা ব্যক্তিত্ব খুঁজে পাই।
সম্পাদক: এলিয়টের প্রসঙ্গই যখন
উঠল, উনি কিন্তু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, “Honest criticism and sensitive
appreciation is directed not upon the poet but upon the poetry.” আপনার কবিতা লেখালেখির জীবনপর্বের অভিজ্ঞতায় আপনিও
কি এলিয়টের সাথে একমত। কবি নয়, কবিতাই হোক আলোচনা সমালোচনার বিষয়বস্তু। যদিও আমাদের
সাহিত্য সমাজে কবিতা ছেড়ে কবিকেই সমালোচনার বিষয় করে তোলার ঐতিহ্য অনেক সুপ্রাচীন।
একজন সংবেদনশীল কবি হিসাবে আপনার প্রতিক্রিয়া।
শীলা
বিশ্বাস: একটি
কবিতা বা রচনা যখন পড়ি তখন লেখাটি শেষ কথা বলে। কবিতাই আলোচনার বিষয় বস্তু।
কবিকে জানতে হবে তবে গঠনমূলক দৃষ্টি ভঙ্গি দিয়ে। তার ব্যক্তিগত জীবন বা কেচ্ছা বা
অপরাধ ইত্যাদির দ্বারা সমালোচনা করে তার লিখন শৈলীকে অস্বীকার করা যায় না। আর কবি
কোনো মহাপুরুষ নন। দোষে গুনে রক্তে মাংসের
মানুষ। যিনি কবিতার আলোচক তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা যে সে কবিকে তার কবিতায় কিভাবে
ব্যাখ্যা করবেন। তিনি তার লেখার উপরেই ফোকাস করে লিখতে পারেন আবার চাইলে তার
ব্যক্তিসত্ত্বাকেও আলোচনায় আনতে পারেন। গবেষকের কাজ একটু আলাদা।
সম্পাদক: আমাদের সমাজসংসারে নারীর অবস্থান আপনাকে কতটা ও কিভাবে
বিচলিত করে?
আপনার নিজের সাহিত্যচর্চার ভিতরে এর কোন প্রচ্ছন্ন প্রভাব বিদ্যমান কি?
শীলা
বিশ্বাস: ‘A woman must have money and a room of her own if she is to write fiction’
– Virginia Woolf. আসলে
পুরুষ নারীকে হয় দাসীরূপে নয়তো নিজের স্বার্থে বা ভয়ে দেবীরূপে স্তব করতে চেয়েছে।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজে লৈঙ্গিক রজনীতি আছেই যেখানে সতীত্ব নারীর মুকুট আর লাম্পট্য
পুরুষের গৌরব। সব শ্রেনীর পুরুষ শোষিত নয় কিন্তু সব শ্রেনীর
নারীই শোষিত ও বঞ্চিত। নারীবাদী রা নারী পুরুষের সাম্য ও
সমানাধিকার দাবি করে। কিন্তু আজকাল নারীবাদী একটি
অশ্লীল শব্দ যার অর্থ পুরুষ বিদ্বেষী। সিমোন
দ্য বোভেয়ার “দ্বিতীয় লিঙ্গ’’ লিখেছেন ১৯৪৯ সালে।
হুমায়ন আজাদের “নারী’ র কথা মনে পড়ছে। যে বইটি
১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয়,১৯৯৫ সালে
সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল এবং ২০০০ সালে
উচ্চ বিচারালয়ে নিষিদ্ধ করণ ঘোষনাটিকে
অবৈধ ঘোষণা করা হয়। তসলিমা
নাসরিনের কথাও মনে পড়ছে তাকে লেখার জন্য
নির্বাসনে যেতে হয়। আমাদের
সমাজ সংসারে এখনো নারী মানে যোনী আর স্তন।
চারিদিকের এত ধর্ষণের ঘটনা, আসিড
আট্যাক এগুলো বিচলিত করে। এখনো একজন মেয়ে আর ছেলে সন্তানকে অনেক পরিবারেই
সমান চোখে দেখা হয় না। বাঙালির ক্ষেত্রে রাম মোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা বিদ্যাসাগর না থাকলে আমরা আজকে যে
জায়গায় আছি সেই জায়গায়ও হয়তো পৌঁছাতাম না।
আমার
পারিবারিক দিক থেকে সাহিত্য চর্চাকে কিভাবে দেখা হয় সেকথায় আসি। আমার লেখলিখির
জগতে আসা একটু পরের দিকে, আমার
সন্তান তখন হাই স্কুলে। খুব ছোটো থাকাকালীন নিজের জন্য
সময় দিতে পারতাম না। তাছাড়া আপনি জানেন আমাকে ১০ টা ৬
টা ডিউটি করতে হয় সরকারি অফিসে। আমি যে
সময়টা তে শুরু করেছি পারিবারিক দিক থেকে বাঁধা হয়নি।
তা সত্বেও বলি কোন কিছু খামতি হলে কবিতা কথাটি এমন ভাবে উচ্চারিত হবে মনে হবে
আলমারির উপরে ধূলো ঝারাকে প্রাওরিটি দিলে হয়তো বেশি খুশি হতেন সকলে।
খুব মজার ছলে যখন জীবন সঙ্গী বলে ওঠেন আমি
লেখলিখি করি সেটা জানলে তিনি আমাকে বিবাহ করতেন না।
একাকী লেখার ঘরে বসে এই কথাটি যখন ভাবি তখন নেহাত মজার বলে মনে হয় না।
তবুও বলব যেটুকু পারি সংসার থেকে সময়টুকু বাঁচিয়ে করি।
তাই পরিবার সঙ্গে না থাকলে মেয়েদের পক্ষে লেখলিখি করা অসম্ভব। আবার যখন এই সাহিত্য চর্চাটি শুধু মাত্র
একটি ‘ভালো নেশা’ বলে দেগে দেওয়া হয়, মেধা বা মননের
উল্লেখটুকু থাকে না তখন মনে হয় একজন পুরুষ লেখকের তুলনায় একজন নারী লেখকের
লড়াইটা অনেক বেশি।
সম্পাদক: আপনার কবিতায় সমাজ ভাবনার
একটি প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে। বস্তুত সমাজসচেতনতার আলো একজন কবির সাহিত্যচর্চার অন্যতম
আয়ুধ। কবিতার ভিতর দিয়ে আপনি আমাদের সামাজিক অবস্থানের এই যে একটা চলমান ধারাভাষ্য
দেওয়ার প্রয়াসী, এটি কি বিশেষ কোন মতবাদ সঞ্জাত? না’কি আপনার সংবেদনশীল কবি মননেরই
একস্টেনশন। এখানে প্রাসঙ্গিক ভাবে আরও একটি প্রশ্ন উঁকি দেয়, কবি মননের সাথে বিশেষ
বিশেষ মতবাদের, তা রাজনৈতিক হোক বা আধ্যাত্মিকই হোক, কোন আপাত বিরোধ থাকা কি সম্ভব?
আপনার নিজস্ব অভিমত।
শীলা
বিশ্বাস: কবিতায়
কোনো ইজম-এর কথা সরাসরি বলা হলে কবিতার ধর্ম থেকে সরে আসে সেই লেখা।
এটা আমার বিশ্বাস। আমি কবিতায় যা লিখি তা সমাজ থেকে উঠে আসে।
বাস্তবও পরাবাস্তবতা কোথাও মিলে যায়। সুকান্ত, সুভাষ,
পাবলো নেরুদা এদের লেখায় আমারা সরাসরি মতবাদও পাই এবং
লেখাগুলি যে কবিতা নয় এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না।
কবিতার ধারা প্রকৃতি যেহেতু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়।
প্রচ্ছন্ন ভাবে মতবাদ থাকাই শ্রেয়। প্রকট
হলে তা কবিতা বলে মনে হয়না। স্লোগান ধর্মী লেখা শিল্পের কাছা কাছি পৌঁছায় না।
সামাজিক দিক থেকে যদি ভাবি সাধারণ মানুষের সাথে রিলেট করতে চাই, একজন
রিক্সা চালক আমার লেখটি পড়বে এবং আমি একটি মেসেজ দিতে চাইছি। তাহলে সেই ভাষাটি একটি সরলরৈখিক বা এক মাত্রিক লেখা হবে।
কবিতা তো একটা শিল্প।
শিল্প নতুন কিছু চায়। সেই
জায়গায় খামতি থাকে বলে আমি নিজে সরাসরি প্রতিবাদ কবিতায় আনতে চাই না।
আধ্যাত্মবাদ,
পুরান, তন্ত্র সবই আসতে পারে।
কবিতায় কোনো কিছু অচ্ছ্যুত নয় কিন্তু কবিতায় তার চলনে বিঘ্ন ঘটাবে না বা বাদে
পরিণত হবে না।
সম্পাদক: আমাদের বর্তমান সমাজ
ব্যবস্থায়, সাহিত্যের অবস্থান কতটা জোরালো বলে আপানার মনে হয়।? আজকের সাহিত্য এই সময়ের
জীবন ও জীবন সংগ্রামে সংবেদী আলো দিতে পারছে কি আদৌ? না’কি এযুগের মানুষকে সেই আলোর
খোঁজে ক্রমাগত ফিরে তাকাতে হচ্ছে শাশ্বত সাহিত্যের অভিমুখেই?
শীলা
বিশ্বাস: না
এই সময়ের সাহিত্য বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার জোরালো প্রতিবাদ হিসাবে উঠে আসছে না।
সময়ের একটা চাহিদা থাকে। বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাস যদি দেখি,বা
বিশ্বযুদ্ধ,স্বাধীনতা আন্দোলন, বিপ্লব
এগুলি এক এক সময়ে শিল্প ও সাহিত্যে তার প্রতিফলন ঘটিয়েছে।
এখন ডিজিটাল যুগ। পরিবর্তন আসছে ভিন্ন রূপে। এখন মানে ২০২০ সাল
অর্থাৎ করোনা কালের মধ্যে রয়েছি তার জন্য কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করছি।
যেমন ইবুক বা অডিও বুক ইত্যাদির কথা শোনা
যাচ্ছে বেশি করে, ওয়েব ম্যাগাজিনের কথা বেশি করে শোনা যাচ্ছে।
কয়কজন সাহিত্যিকের নাম মনে পড়ছে মহাশ্বেতা দেবী, নলিনী
বেরা প্রমুখ গ্রাম জীবন বা আদিবাসি জীবন নিয়ে কাজ করেছেন সেখানে জীবন সংগ্রামের যে
সংবেদী আলোর কথা বলছেন তা আছে।
সম্পাদক: কবিতায় অনেকেই দিন বদলের
স্বপ্ন দেখেন। এবং দেখান। বিশ্ব কবিতার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে সেটি অনুভব করা যায়।
এই সময়ের একজন কবি হিসাবে এই দিন বদলের স্বপ্ন দেখা ও দেখানোর বিষয়টি কিভাবে ধরা দেয়
আপনার অন্তরে?
শীলা
বিশ্বাস: বিশ্ব
কবিতার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে বিপ্লব, আন্দোলনে
কবিদের ভূমিকা ছিল। তবে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কবিতা লিখে দিন বদল করা যায় বলে আমি
বিশ্বাস করি না। আমি যা বলতে চাইছি তা
পাঠকের মনের যদি কিছু পরিবর্তন করতে পারে চিন্তা ধারার পরিবর্তন ঘটায় বা
প্রবৃত্তির পরিবর্তন ঘটায় তাহলে পরোক্ষ ভাবে বদলের কাজ করে বইকি।
সম্পাদক: আপনার নিজের লেখার বিষয়ে
কখনো কি মনে হয়েছে, একটি গণ্ডীর ভিতরেই আটকিয়ে যাচ্ছে আপনার যাবতীয় লেখালেখি। সাধারণত
আমাদের অধিকাংশই কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে আত্মনির্মিত নিজস্ব গন্ডীর ভিতরেই আটকিয়ে
যাই। অনেকেই হয়তো খেয়াল করি না। আবার অনেকেই হয়তো সচেতন ভাবে সেই গণ্ডীর ভিতর থেকে
নিজেকে মুক্ত করতে প্রয়াসী হন। আপনার লেখালেখি ও আপনার ব্যক্তিগত উপলব্ধি থেকে এই বিষয়ে
বিস্তারিত আলোকপাত যদি করেন।
শীলা
বিশ্বাস: একটা
গণ্ডীর মধ্যে যখন লেখা আটকে যাচ্ছে মনে হয় তখন অনেক বই পড়ার চেষ্টা করি তাতে
ভাবনার অনেক দিক খুলে যায়। আমার যে
চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে পর পর পড়লে বোঝা যাবে কবিতা সম্পর্কে আমার ধারনা খুব
দ্রুত বদলেছে। অনেক কবিকে দেখেছি যে তিনি যে ধারায় লিখে
আলোচিত হয়েছেন বা খ্যাতি অর্জন করেছেন সেই ধারা থেকে বেরোতে চান না।
আমার ব্যক্তিগতভাবে নিজের সঙ্গেই চ্যালেঞ্জ থাকে নতুন রকম লিখতে হবে।
আমার যে নতুন বইটি প্রকাশিত হবে তা পূর্বের বইটিকে ভাবনায় এবং কবিতার নির্মাণগত
বৈশিষ্টকে ছাপিয়ে যেতে হবে তবেই আমার নতুন বই প্রকাশের স্বার্থকতা।
সম্পাদক: সবশেষে এসে জানতে চাইবো আপনার ব্যক্তিগত সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি সমসাময়িক কার কার কবিতাচর্চা
আপনাকে বিশেষ ভাবে উদ্বুদ্ধ করে, যেখান থেকে বাঙলা কাব্যসাহিত্যের অদূর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে
আপনি প্রবল ভাবে আশাবাদী ভুমিতে অবস্থান করতে পারেন।
শীলা
বিশ্বাস: এই
লিস্টে এতজন কবির নাম নিতে হবে যে কোথা থেকে শুরু করবো বুঝতে পারছি না।
তবে সময়ের সঙ্গে কবি ও কবিতার পছন্দ বদলে যায়। সব রকম না পড়লে ভালো মন্দ বুঝবো কি
করে? কবিতায় ঠিক ভালো মন্দ হয় না।
পছন্দ অপছন্দ হয়। যে লেখা আমাকে ভাবায় সেই লেখাই আমার পছন্দ।
আসলে আগ্রজ কবিদের লেখা পড়েই আমি শিখি। আমার
ভাবনার পরিধিকে ব্যপ্ত করে, সম্পৃক্ত করে।
তবে আমি পাঠক হিসাবে নতুনদের লেখাও পড়ি।
আমার এবং সইকথা ওয়েবজিন সম্পাদনা করতে গিয়ে আমাকে প্রচুর পড়তে হয়।
এক্সপেরিমেন্টাল লেখার কথা যদি বলেন তরুণ কবি অভিজিৎ দাসকর্মকার ও রাহুল গাঙ্গুলির
কথা বলব। বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি
প্রচুর আশাবাদী। এত মানুষ কবিতাকে আঁকড়ে বেঁচে রয়েছে।
এত কাজ হচ্ছে। অনেক তরুণ লিখছেন।
ভীষণভাবে আশাবাদী।
শীলা বিশ্বাসঃ জন্ম
১৯৭২ সালে, সাঁতরাগাছি, হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারি দায়িত্বশীল পদে কর্মরত (আয়কর বিভাগ, কলকাতা)। বর্তমান ঠিকানা ১০১, অজয়নগর,
দমদম,
কলকাতা- ৭০০০৭৪।
শূন্য দশকে লেখালিখির শুরু হলেও প্রথম বই প্রকাশ প্রথম দশকে। লেখার
বিষয় মূলত কবিতা, অন্যান্য প্রচেষ্টা গল্প, প্রবন্ধ,
শ্রুতি নাটক। নিয়মিত লেখালেখি বানিজ্যিক ও অবানিজ্যিক সাময়িক পত্র পত্রিকা এছাড়াও বিভিন্ন
ই-ম্যাগাজিনে। সম্পাদিত পত্রিকা ‘ এবং সইকথা’ ই- ম্যাগাজিন, (ত্রৈমাসিক )। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থঃ ১। হেমিংটনের জন্য - (পরিবেশক নীলাঞ্জনা
প্রকাশনী) প্রকাশ রথযাত্রা ২০১৪, ২। অন্তর্গত স্বর - (ক্রান্তিক প্রকাশনা) প্রকাশ
বইমেলা ২০১৫, ৩। নেবুলা মেঘের মান্দাসে- (কলিকাতা লেটারপ্রেস ) প্রকাশ বইমেলা ২০১৮,
৪। নির্বাচিত শূন্য
(সুতরাং প্রকাশনা) প্রকাশ বইমেলা ২০২০।
কপিরাইট রংরুট
কর্তৃক সংরক্ষিত
তোমার চিন্তা ভাবনাগুলো পড়লাম! লেখালেখিতে অনেক পরে এসেও তুমি কবিতার ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে এসেছো, এজন্যে তোমাকে অবশ্যই অভিনন্দন! তোমার লেখার জীবনে এক অন্যতম প্রেরণা ও মাইলস্টোন - শিবব্রত দেওয়ানজী - সদ্যপ্রয়াত মানুষটার কথা এখন খুব মনে পড়ছে!
উত্তরমুছুনধন্যবাদ দাদা । সদ্য প্রয়াত শিব্রবত দেওয়ানজী কাকু যেমন আমার প্রেরণা তেমনি শুরুর দিন থেকে আপনিও আমার লেখালিখি বিষয়ে উৎসাহ দিয়ে আসছেন। আপনাকেও শ্রদ্ধা জানাই দাদা। সত্যিই কাকুর কথা খুব মনে পড়ছে।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ দাদা । সদ্য প্রয়াত শিব্রবত দেওয়ানজী কাকু যেমন আমার প্রেরণা তেমনি শুরুর দিন থেকে আপনিও আমার লেখালিখি বিষয়ে উৎসাহ দিয়ে আসছেন। আপনাকেও শ্রদ্ধা জানাই দাদা। সত্যিই কাকুর কথা খুব মনে পড়ছে।
উত্তরমুছুন