মুখোমুখি শ্যামলী
বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্পাদক রংরুট: সকলের আগে ত্রৈমাসিক রংরুটের পক্ষ
থেকে আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। রংরুটের এই বিশেষ সংখ্যায় আপনাকে স্বাগতম। আপনার লেখালেখির সূত্রপাত
সম্বন্ধে যদি আলোকপাত করেন। সময়ের পরিধিতে এবং পরিবেশের প্রেক্ষাপটে। জীবনের
বিভিন্ন পর্বে কোন কোন বিশেষ ব্যক্তিত্ব আপনার জীবনদর্শনের গড়ে ওঠায় বিশেষ ভূমিকা
রেখেছেন?
শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়: আমার ছোটবেলা থেকে কলেজবেলা
পর্যন্ত কাটে বাবার কর্মক্ষেত্র বাঁকুড়ায়। বিষ্ণুপুর ঘরানায় খুব ছোটবেলা থেকেই
গানে ছিলুম ,বাবার
সঙ্গে বাকি দাদাদিদিরা সবাই গান, বাজনা, নাটক, আবৃত্তি
নানা দিকে ছিলেন। বাড়ি থেকে হাতে লেখা একটি পত্রিকা বার করা হোত, ‘শঙ্খ’।
নিজেদের লেখা গল্প প্রবন্ধ কবিতা আর জলরঙে আঁকা ছবি দিয়ে ভরা। প্রতিবছর ১৫ই আগস্ট
ছাদে পতাকা উত্তোলনের পরই ফিঁতে কেটে শাঁখ বাজিয়ে তার মোড়ক উন্মোচন করা হোত। শেষের
কটি পাতা খালি রাখা হত প্রতিবেশি পাঠকদের মতামতের জন্য। তখন আমি খুব ছোট, লিখি
না। ফাঁক পেলে সেই ম্যাগাজিনটি নিয়ে বিমুগ্ধ বিস্ময়ে পাতায় পাতায় তাকিয়ে থাকতুম,যেখানে
গল্প-কবিতা-প্রবণ্ধ-জলরঙে আঁকা ছবি ভরা।
এভাবেই কবে যেন কবিতা-গল্প-উপন্যাস পড়ার
বয়সে উঠে এসেছিলুম।সঙ্গে ছিল রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের গান।অগ্রজ সাহিত্যিকদের পড়ার
অভ্যেস স্কুলবেলা থেকে। লেখা শুরু মধ্যতিরিশের শেষ থেকে। জীবনদর্শন গড়েওঠায়
প্রাথমিকভাবে আমার পরিবার, পরবর্তীতে বিশেষ ভাবে স্মরণীয় কিছু
অধ্যাপক।আর সঙ্গে আদ্যন্ত রবীন্দ্রনাথ – না বোঝার বয়স থেকে আজ পর্যন্ত, আর
দশজন বাঙালিদের মতই। আর এক সাহেবের কথা
না বললেই নয়,
তিনি সুইজারল্যান্ডের শ্রী এরিখ ভন দানিকেন। আজও ৮০ পার করে
তিনি আছেন। জীবনকে দেখার দৃষ্টিটুকু তিনি
তিনি আমার আমূল বদলে দিয়েছিলেন, আমার স্কুলবেলা থেকে। প্রাগিতিহাসের
দিকে তাকাতে তিনিই শিখিয়েছিলেন। আমার রোমে রোমে তিনি – অথচ আমি তাঁকে সামনা সামনি
দেখিনি কোনওদিন।
সম্পাদক রংরুট: বাংলা কাব্যসাহিত্যে
রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব এবং আপনার জীবন ও
সাহিত্যসাধনার যাত্রাপথে বিশ্বকবির ভূমিকা ঠিক কি রকম?
শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রেম, প্রকৃতি, ঔপনিষদিক
ভাবনা আর বিশ্বমানবতা – এই চারটি তারেই তিনি তাঁর বীণাকে বেঁধেছিলেন, যেগুলি
আজও আমাদের মাঝে প্রবলভাবে বহমান। তবে তাঁর বিশ্বমানবতার ভাবনাটি আজ খুব বেশি
গুরুত্বপূর্ণ,
এই সময়ের প্রেক্ষিতে। আর আমার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা? নিজের
ভাষ্যেই বলি -কিছুতেই যেন নিজযুদ্ধের কথা কিছু বলা হয়না/ নাছোড় সে এক রবির কলস বলে
‘আশকারা দেব না’/ যেই আমি ভেবে তুলেছি কলম চোখের বালাই রবি/পলক ছাপিয়ে বলেন-‘কোনটা
তোর নিজস্ব ছবি?’/অগত্যা
যুদ্ধ এবং বিরতি নিয়ে ঠুক ঠুক হাঁটছি/রবির আলোয় নিজ ক্ষয়-ক্ষতি মুলতুবি করে
রাখছি।/শব্দহরিণ ছক ভাঙে, তবু রবি বিনে আশ মেটে না/’সর্বং
খলু ইদং ব্রহ্ম’ কাঁখ ধরে আছে ছাড়ে না।/ রবিরশ্মির নাছোড় কলস তুলসীর ডালে বেঁধেছি,/টুপ
টুপ করে পড়ে ‘শান্তম্’! শিরের সরায় ধরেছি
সম্পাদক রংরুট: রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘মানুষের
উপর বিশ্বাস হারানো পাপ’; একজন সাহিত্যিকের প্রত্যয়ে মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখাটা
কতটা জরুরী বলে আপনার মনে হয়? আর বিশ্বাসভঙ্গেরর দহন তার প্রতিভাকে কি ভাবে সমৃদ্ধ করে
তুলতে পারে?
বা আদৌ
পারে কি?
শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়: কথাটি সর্বকালে সার্বজনীন ভাবে
সত্যি হওয়া জরুরী । একজন সাহিত্যিকের জন্যে তো বটেই। আমিও বিশ্বাস রাখতে চাই। তবে
প্রত্যয়ে আঘাত এলে অনেকে নিজেকে আড়ালে সরিয়ে নেন, অনেকে
বিষপান করতে করতেই নিজেকে সমৃদ্ধ করেন। শেষেরটিই সমীচীন। নইলে তো বিশ্বাস
ভঙ্গকারীদেরই জয় হবে!
সম্পাদক রংরুট: রবীন্দ্রনাথের যুগের পর আমরা বহুদূর এগিয়ে এসেছি! জীবন ও
সাহিত্যের ভিতর ও বাইরে ঘটে গিয়েছে বিপুল পরিবর্ত্তন! আজকের দিনে সাহিত্যে আধুনিকতা বিস্তর পরীক্ষা নিরীক্ষার
মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে কোথাও কি একটা আবর্তের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে বলে মনে করেন
আপনি? নাকি বাংলাসাহিত্য
আরও বেগবান হয়ে আধুনিকাতার পরিসরটিরই আরও বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে বলে মনে হয় আপনার?
শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়: শেষের
কবিতার অমিত’র ‘পরিহাস-বিজল্পিতম্’ কথাগুলি মনে পড়ে যাচ্ছে -আধুনিক কবিতা হবে ‘কড়া
লাইনের,
তীরের ফলার মতো...ফুলের মতো নয়…কোণ-ওয়ালা গথিক গির্জের ছাঁদে, মন্দিরের
মণ্ডপের ছাঁদে নয়।… মন কেড়ে নিতে হবে, যেমন করে
রাবণ সীতাকে কেড়ে নিয়ে গেছল।’ আসলে সময় এবং মর্জি – এই দুটি সাহিত্যের মোড় ঘোরাবার
ক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবী – এ কথা মেনে নিতে হবে। বাকিটা সারভাইভাল অফ দ্য
ফিটেস্ট।তরুণরা বুঝে নিক।
সম্পাদক রংরুট: সামাজিক দায়বদ্ধতার নিরিখে, একজন সাহিত্যেকের সমাজসচেতনতা কতটা জরুরী বলে মনে হয় আপনার? এবং এই সমাজসচেতনতার
প্রসঙ্গে সাহিত্যিকের দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক মতাদর্শ কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়: এক্ষেত্রে একজন সাহিত্যিকের
দায়বদ্ধতার ভাগ বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সাধারণ মানুষদের কাছে তাঁরাই
আইকন হয়ে থাকেন।তাই কোন কোন কোন কবি বা সাহিত্যিক মিছিলে হাঁটলেন, সেটি
চর্চার বা অনুপ্রেরণার বিষয় হয়ে পড়ে। দেশপ্রম একটি অভিন্ন ভাবনা, কিন্তু
রাজনৈতিক মতাদর্শ অভিন্ন হয় না, সেক্ষেত্রে সংকটও তৈরি হয়। এও এক
আশ্চর্য সমাপতন – মানুষ কবিদের নিয়েই বেশি ব্যতিব্যাস্ত থাকেন!কারণ তাঁরাই সময়কে
বদলে দেয়ার প্রত্যক্ষ ক্ষমতা রাখেন। বিষয়টি কবিদের জন্য যতটা গৌরবের, ততটাই
দায়িত্বেরও বটে।
সম্পাদক রংরুট: সাহিত্যসাধনা বা কাব্যচর্চার প্রসঙ্গে কবি জীবনানন্দ পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান ও সুস্পষ্ট
ইতিহাসচেতনার উপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন।
তাই এই সমাজসচেতনতার ভিত্তি সুদৃঢ় ইতিহাসবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে কতটা
জরুরী বলে মনে করেন আপনি, এবং কেন?
শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়: অবশ্যই জরুরী বলে মনে করি। নইলে
সেই সাহিত্য তার নিজের সমাজ সংস্কৃতিকে কী ভাবে তুলে ধরবে? জীবন তো
জলপরী নয়,
যে হঠাৎ উঠৈ এল কল্পনায়! এখানে আরও একটি বিষয় যোগ করতে চাই।
শুধু ইতিহাস নয়,
পৃথিবীর প্রাগিতিহাসের দিকেও তাকাতে হবে, নির্মোহ
দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে জানতে হবে, জানাতে হবে। প্রাগিতিহাসকে অলীক
রূপকথা হিসেবে না দেখে প্রকৃত কাটাছেঁড়া করা হয় না। যাঁরা করেন, তাঁরা
পরিহাসের শিকার হন বা জেলে বন্দী হন। কীসের ভয় রাষ্ট্রনেতাদের? এ
ব্যাপারে খোলা মন থাকলে সাহিত্যে আরও নানা বাঁক আসতে পারত।
সম্পাদক রংরুট: স্বদেশপ্রেম, নিজের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর
প্রতি দায়বদ্ধতা- নিজের চারপাশের প্রবাহমান সময়ের সাথে আত্মসংলগ্নতা এগুলি একজন সাহিত্যিককে
কি আন্তর্জাতিকতার প্রেক্ষিতে সীমাবদ্ধ
করে তোলে বলে মনে করেন আপনি?
শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়: এই অস্থির সময়ের প্রেক্ষিতে একটি
জরুরী প্রশ্ন।
না, আমি তা মনে করিনা। বিন্দু বিন্দু
জল দিয়েই মহাসমুদ্রের সৃষ্টি। তাই খণ্ডকে গ্রহণ না করতে পারলে অখণ্ডে যাব কী করে? আবার
অখণ্ডর বোধ না থাকলে খণ্ডকে ভালবাসব কী করে? আত্মসংলগ্নতা
বা আন্তর্জাতিকতা – বিষয়গুলোয় রাজনীতির উইপোকারা ঢুকে গিয়ে ধর্ম ,দেশপ্রম, মানবতা
ইত্যাদি বোধগুলিকে গুলিয়ে দেয়।
সম্পাদক রংরুট: আধুনিক জীবনেরর গতি সর্বস্বতা ও ভোগবাদী সংস্কৃতি সাহিত্যকে
কি ক্রমেই কোণঠাসা করে দিয়ে ভবিষ্যতের জন্যে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলবে বলে মনে করেন
আপনি? গত এক দশকে, গোটা বিশ্বে
ইনটারনেট বিপ্লবে আপনি বাংলাসাহিত্যের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কতটা আশাবাদী?
শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়: তা কেন? এই জীবনের
গতিসর্বস্বতা বা ভোগবাদ – এও তো এই সময়ের এক সত্য দলিল, যা
পরবর্তী প্রজন্মের সাহিত্যে হয়তো সুফল দেবে!কে বলতে পারে ভবিষ্যতের কথা? কোণঠাসা
যদি হয়েও যায়,
সেটাই তাদের জন্য
হয়তো সাবধানবাণী হবে! পৃথিবীর মানুষ বড্ড দৌড়োচ্ছিল ।মানুষের এই অতি দৌড়কে থামালো
যেমন করোনা! আমি আশা ছাড়ি না। তাই ইনটারনেট বিপ্লবেও আমি আশবাদী। ভালই লাগে। লেখালেখির পরিসর ক্রমশই বিস্তৃত হচ্ছে। কত ভাল
ভাল আপডেট পাচ্ছি। সাহিত্যের অন্দরমহলের শিল্পকলার নদিটিকে বাঁকে বাঁকে বইয়ে
দিচ্ছে এই নেটিজেন-সাহিত্য। সময় ছাঁকনিতে ছেঁকে নিয়ে যা রাখার রাখবে, যা
ফেলার ফেলবে,
ভাবনা কিছুই নেই । তবে এত এত গ্রুপ-ক্রিয়েশন লেখকদের মধ্যে কোনও দূরত্ব তৈরি করছে না তো? কি
জানি,হয়ত
আমার এ বোধ একান্ত ব্যক্তিগত! তবে ভবিষ্যতে বই প্রকাশ বা কিনে পড়ার তাগিদ কমবে মনে
হয়। সবই তো নেটে আছে।বই প্রকাশও ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট বা ইউটিউবে হবে হয়তো।
লেখালেখির মোড বদলাবে, কিন্তু সৃজন আরও স্পেস পাবে বলে মনে করি। এই যেমন আপনারা
শীর্ষচূড়ায় না থাকা সাহিত্যিকদেরও সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, আরকাইভ
তৈরি করছেন,
এও একটি ভারি সদর্থক পদক্ষেপ ইনটারনেট বিপ্লবে। গোটা
বিশ্বের লেখক ও পাঠককুল সহজেই ঘরে বসেই নিজেদেরকে যুক্ত করতে পারছেন। বসুধৈব কুটুম্বকম্।বিষয়টি
আশা ও আনন্দের।
সম্পাদক রংরুট: আমাদের সমাজসংসারে নারীর
অবস্থান আপনাকে কতটা ও কিভাবে বিচলিত করে? আপনার ব্যক্তিজীবনের দৈনন্দিন
ছন্দে এর প্রতিফলনের সরূপ সম্বন্ধে একটু বিস্তৃত ভাবেই জানতে চাইছি।
শ্যামলী
বন্দ্যোপাধ্যায়: ভীষনভাবে
বিচলিত করে,
বিশেষ করে ধর্ষণের ঘটনাগুলি। তিন তালাক আইন করে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্তে আমি
ভীষন খুশি।আবার নগরকেন্দ্রিক নারীরা চাকরী করতে যাওয়ায় সংসারে নানা সংকটও আসে। তখন
ঘর-বার সামলাতে সামলাতেও প্রতিপক্ষদের শিকার হতে হয়।এও সত্যি, হয়তো
বাইরে না বেরোলে সংসারে স্থিতাবস্থা থাকেনা।নানা আমারও সাহিত্যচর্চাও ব্যাহত হয়
বৈকি। দেখুন,
এই ইনটারভিউটি ডিটিপি করতে আমার কয়েকদিন লেগে গেল। ।একজন
পুরুষ সাহিত্যিকের হয়তো মাত্র একদিন লাগবে। কারণ তিনি একনাগাড়ে সময়টা দিতে পারবেন।
আমি পারছি না। এটি সত্য। আমি কবিতা লিখতে বসলে
ভাতের ফ্যান পড়ে, সবজি পোড়ে, বলতে পারিনি, এখন
লিখছি,
আমাকে কেউ ডিসটার্ব করবেনা। এসব নিয়ে একটা কবিতাও লিখেছিলুম ‘ইসক্রা’ পত্রিকায়। এদের সঙ্গে নিয়েই
থাকি লেখার টেবিলে। টোট্যাল ট্র্যাংকুইলিটির অভাব আছেই, সাজা
ঠিকমত না তৈরি হলে যেমন দই জমেনা, লেখালেখিটাও ওই দই জমার মত
ব্যাপার।তবে এ টুকু বাদ দিলে আমার ব্যক্তিজীবনে মেয়ে হিসেবে কোনও বিভাজিত জীবন
যাপন করতে হয়নি।তিন ভাই তিন বোন আমরা, ডিসক্রিমিনেশনের কোনও সংকেতই ছিলনা
বাবা-মায়ের তরফ থেকে। তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত মুক্তমনা, শ্বশুরবাড়িও
তাই। বিয়ের বেশ কিছুদিন পর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে আমি যখন অধ্যাপনা ছেড়ে ছিলুম, সবচেয়ে
দু:খ পেয়েছিলেন আমার শাশুড়ি-মা। আজ ভাবি, জীবনে একটি নয়, দুটি
ভুল-অ্যাকাডেমিক সিদ্ধান্ত আমি নিজেই নিয়েছিলুম, যার ছায়া
পড়েছে গোটা জীবনে। এর জন্য দায়ী শুধু আমি, আর কেউ
নয়।
সম্পাদক রংরুট: তথাকথিত একাডেমিক
নারীবাদের চর্চা আমাদের তৃতীয়বিশ্বের
এই আর্থসামাজিক পরিসরে কতটা ফলদায়ী ও আশাব্যঞ্জক বল মনে করেন?
শ্যামলী
বন্দ্যোপাধ্যায়: তথাকথিত
একাডেমিক নারীবাদের চর্চার বেশিরভাগটাই পাশ্চাত্য থেকে ধার করা। আমাদের তৃতীয়
বিশ্বের জীবনযাপনের সঙ্গে খাপ খায় না। তাই এগুলি বে-বুনিয়াদ সিদ্ধ হয় বেশিরভাগ
ক্ষেত্রে। আমার নিজের দেশে দেখি, নারীরা পুরুষদের সঙ্গে সমান তালে
মাঠে চাষের কাজ করে। গ্রামেগঞ্জে মহিলাদের রকমারী স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে।
তারা স্বামীর উপায়ে বসে খায় না। বরং স্বামীরাই তাদের উপার্জিত টাকা ছিনিয়ে নিয়ে
মদ্যপান করে। মেয়েরা মদের ঠেক গুলি দৃপ্তপদে ভেঙে দিয়ে আসে। এগুলি তাদের জীবনের
স্বত:স্ফুর্ত মুক্তি। বিভিন্ন এনজিওগুলির ব্যাবহারিক ভূমিকা অনেক বেশি ফলদায়ী হয়।
একাডেমিক নারীবাদের চর্চা তাদের ব্যক্তিগত জীবনে আদৌ কোনও প্রভাব ফেলে কিনা, ভাবার
বিষয়। যারা শিকড়ের সঙ্গে আছে, সেখানে সমস্যা কই? সমস্যা
নাগরিক জীবনে,
পারসেন্টেজে যেটা ধর্তব্যে আসে না। ভারতবর্ষের বেশিরভাগটাই
কিন্তু গ্রাম,
সেটি ভুললে চলবে না। সেখানে নারী-পুরুষ একসঙ্গেই শ্রমের
মাঠে নামে। নগরজীবনেও দেখুন, পরিচারিকারা শুধু আমাদের জীবনটিকেই
ধরে রাখেনা,
ধরে রাখে নিজের পরিবারকেও। কোবিদ-১৯ সে কথা হাড়ে হাড়ে
বুঝিয়ে দিয়ে গেল।
সম্পাদক রংরুট: আর ঠিক এই প্রসঙ্গেই জানতে
ইচ্ছে করছে,
বিশেষত
একজন লেখিকার দৃষ্টিকোণ থেকে; আমাদের
পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ সভ্যতায় একজন লেখিকার ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার
মনে হয়?
আপনার
নিজের লেখালেখির সূত্র ধরেই যদি বলেন!
শ্যামলী
বন্দ্যোপাধ্যায়: লেখিকার
ভূমিকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।। তার হৃদয়ের টানাপোড়েন, পাওয়া না
পাওয়া,
ব্যথা-যণ্ত্রণার কথা তেমনটি করে আর কেই বা লিখেছেন
রবীন্দ্রনাথ আর শরৎবাবু ছাড়া? এ প্রসঙ্গে মৈত্রেয়ী দেবীর ‘ন
হন্যতে’ বইটি নারীকথার একটি মাইলস্টোন বলে আমি মনে করি ।অবশ্যই মালয়ালী বিশিষ্ট
এবং বিতর্কিত কবি কমলা দাসের নাম করব। উৎপলকুমার বসুর অনুবাদ করা (সাহিত্য
একাডেমী) নির্বাচিত কবিতা সমগ্র পড়ে আমি চমকে উঠেছিলুম! এভাবেও নিজেকে প্রকাশ্যে
আনা যায়!! সমসাময়িকে তসলিমা নাসরিন। আমি কবিতায় যখন যতটা পারি, ধরে
রাখি বৈকি।তবে আমার লেখায় বেশি প্রতিফলিত হয় সমগ্র সমাজ, যেখানে
নারীকথা স্বাভাবিক ধর্মেই উঠে আসে। আমার কাব্যগ্রন্থগুলিতে তার প্রভাব নিশ্চয়ই
লক্ষ্য করে থাকবেন, যাঁরা পড়েছেন।
সম্পাদক রংরুট: ভবিষ্যত প্রজন্মের সাহিত্যের
কাছে আপনার প্রত্যশা ও দাবী কি?
শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়: সাহিত্য আপডেট হতে থাকুক, সে
তো বহিরঙ্গের ব্যাপার। কিন্তু শুধুই নিজের কথা নয়, সামাজিক
দায়িত্ব থেকে তা যেন কখনোই বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে। তাহলে সাহিত্যে স্থবিরতা আসবে। আঞ্চলিক
ভাষার কবিতাগুলি এখন উঠে আসছে, ভাল লাগে। এটি অব্যাহত থাকুক।
অনুবাদ-কবিতায় বিশ্বসাহিত্যের দিকেই ঝোঁকটি বেশি। মাতৃভাষায় লেখা ভারতীয় কবি ও
সাহিত্যিকদের লেখাগুলির পারস্পরিক অনুবাদ আরও বেশি করে হোক, মানুষ
সেগুলি পড়ুন,
বর্তমান উলঝে যাওয়া রাষ্ট্রীয় সংহতি বজায় রাখার প্রেক্ষিতকে
সামনে রেখে বললুম।
শ্যামলী
বন্দ্যোপাধ্যায়: ছাত্রীজীবনে পড়াশোনার সঙ্গে ছিল গান, ছবি আঁকা আর পছন্দের বই পড়া। পড়তে পড়তেই লেখালেখির ইচ্ছে, নিজেকে প্রকাশের একরকম তাড়না। নব্বইের দশকের শেষ
পর্যায়, স্বামীর পোস্টিংএর সুবাদে বাংলাদেশে থাকা কালীন ভারতীয় হাইকমিশন থেকে প্রকাশিত ‘ভারত
বিচিত্রা’য় সম্পাদক বেলাল চৌধুরীর সম্পাদনায় ছেপে বেরোয় তাঁর প্রথম কবিতা। প্রবাস থেকে ফিরে দিল্লিতে আরও বেশ কয়েক বছর কাটে। লেখা কবিতা
জমে থাকত। কলকাতায় আসা এবং সপরিবার প্রকৃত
থিতু হতে হতে আরও বেশ কয়েকবছর পার হয়ে যায়। এখানকার নানা লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে
সেই পরিসরে যুক্ত হওয়া শুরু হয়। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অন্তরিন’ প্রকাশিত হয় ২০১২ তে
বইমেলায়। একটি ছড়ার বইও প্রকাশিত সেই বছরই। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘এই ঘ্রাণ এই
অভিমান’ প্রকাশিত হয় ২০১৮ বইমেলায়। আরও দুইখানি বই প্রকাশের অপেক্ষায়।
কপিরাইট রংরুট
কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন