মুখোমুখি শ্যামলী রক্ষিত
সম্পাদক
রংরুট:
সকলের আগে ত্রৈমাসিক রংরুটের পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। রংরুটের এই বিশেষ
সংখ্যায় আপনাকে স্বাগতম। আপনার লেখালেখির সূত্রপাত সম্বন্ধে যদি আলোকপাত করেন।
সময়ের পরিধিতে এবং পরিবেশের প্রেক্ষাপটে। জীবনের বিভিন্ন পর্বে কোন কোন বিশেষ
ব্যক্তিত্ব আপনার জীবনদর্শনের গড়ে ওঠায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন?
শ্যামলী
রক্ষিত: নমস্কার।
প্রথমেই আমি অশেষ কৃতজ্ঞতা ও আন্তরিক শুভ
কামনা জানাই রংরুটের সম্পাদক ও সকল সদস্যের প্রতি। আমার লেখা লিখির
সূত্রপাতটা একেবারই নিজের বোকামো থেকে। ছেলে বেলা
থেকেই তীব্র সংগ্রাম করতে হয়েছে আমাকে,তাই পড়াশোনা করতে
সময়ই পেতাম না। রোজ স্কুলে যেতে পারতাম না। পড়ার বই খুলতাম নমাসে ছ মাসে।পরীক্ষার দিন
গুলোতে।বাইরের বই পড়া তো দুঃস্বপ্ন। তাই সব মিলিয়ে চূড়ান্ত বোকা ছিলাম।ক্লাস সেভেন এ পড়ি
তখন। পম্পা নামে একটা সিনেমা দেখেছিলাম। একটি আমারই সম বয়সি মেয়ের করুন জীবন কাহিনী। সেই সিনেমায় ওই
মেয়েটি একটি গান গেয়েছিল। বাণী জয়রামের কণ্ঠে গান। (সেই গান কেন আমি পারি
না শোনাতে। ) সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরে এলাম। খুব মনটা
খারাপ। পম্পা বলে ওই মেয়েটি তখন বুকের মধ্যে বসে আছে। ওর কষ্টে হুহু করছে
মন।সেদিন সন্ধ্যে বেলায় পড়তে বসে অংক খাতা নিয়ে মনে হলো ওই পম্পা যদি নিজে নিজে গান বেঁধে গাইতে পারে,তাহলে আমি কেন কছু
লিখতে পারব না। অংক খাতায় অংক না করে লিখে ফেললাম দশ বারো লাইনের একটি কবিতা, কুঁড়ি। সেই কবিতা
আমার এখন আর কিচ্ছু মনে নেই। একটি গোলাপ ফুলের কুঁড়িকে
নিয়ে আমার প্রথম কবিতা লেখা। কুঁড়ির ফুল হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা সেখানে বলবার কথা
ছিল।
আমার
জীবনের মূল দর্শন গড়ে তুলতে সব চেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে আমার মায়ের আর আমার
কাকার।কিন্তু তার চেয়ে
বেশি গুরুত্ব পূর্ণ ছিল আমার শৈশবে অপরিসীম দারিদ্র।পাঁচ বছর বয়সে বাবা
মারা যান। সতেরো বছরের
দাদা আর ছত্রিশ বছরের মা। কপর্দক শূন্য, জমি জমা বলতে এক বিঘে মত ধান
জমি এই নিয়ে লড়াই।আমার দর্শনের ভিত
তৈরি হতে থাকে ওখান থেকে । প্রতি নিয়ত প্রবল দারিদ্রের
সঙ্গে লড়াই করেও কী করে নির্লোভ থাকা যায়, সেটা মায়ের কাছ থেকে শিখেছি।আর আমার কাকা ছিলেন
আমার এই সর্ব কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার মানসিক শক্তি সঞ্চয়ের পথপ্রদর্শক। একদম শৈশবে মা এবং কাকা আমার জীবন
দর্শনের মূল দিক রচনা করতে সাহায্য করেছে । আমার মায়ের মধ্যে
ছেলে এবং মেয়ের তফাৎ করার মানসিকতা ছিল
না।কোনদিন মাকে বলতে শুনি নি তুমি মেয়ে এটা করতে নেই। কিংবা ছেলেদের জন্য আলাদা কোনো ভালোবাসা
মর্যাদা দেবার প্রবণতা মায়ের কোনো দিন দেখি নি। আর শৈশবে কাকার সঙ্গে অনেক কাজ
করতাম।খুব ছোট বেলা থেকেই এটা মেয়েদের কাজ, এটা ছেলেদের কাজ এসব
জানি নি। আর এই দুটো মানুষের প্রভাবে আমার মধ্যে নারী বা পুরুষ এই বোধ তীব্র হয় নি। আমি মানুষ এমনটাই
ভেবে অভ্যস্থ। তাই আমি মাঠে কিসেনের সঙ্গেও যেমন আলু কুড়িয়েছি, আমার ছোড়দার লেদের
কারখানাতেও কাজ করেছি।ছেলেদের সঙ্গে সমস্ত রকমের খেলা খেলেছি। পরবরতীকালে আমার
শ্রদ্ধেয় দিদিমণি অধ্যাপিকা ড. সুমিতা
চক্রবর্তীর জীবন দর্শন আমাকে ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করেছে।আমি নিয়মিত আমার
চিন্তা ভাবনার পরিশুদ্ধি ঘটানোর জন্য ওনার সঙ্গে মত বিনিময় করি।বর্তমান সময়ে
একজন স্বনাম ধন্য কথাকার, কবি শ্রদ্ধেয়
তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ও আমার লেখালিখির ক্ষেত্রে একটি বিশেষ দর্শন লাভ করতে প্রভাবিত
করেছেন। জীবনে যা কিছু দেখবে, শুনবে সব কিছুর মধ্যে গল্প আছে।তোমাকে শুধু গল্পটা
নির্মাণ করতে হবে।কাহিনী খুঁজতে হবে না।কাহিনী তোমার
চারিপাশে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তুমি শুধু চয়ন করবে, আর নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে
নির্মাণ করবে। এই দর্শন আমাকে ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করেছে।
সম্পাদক
রংরুট: বাংলা কাব্যসাহিত্যে
রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব এবং আপনার জীবন ও
সাহিত্যসাধনার যাত্রাপথে বিশ্বকবির ভূমিকা ঠিক কি রকম?
শ্যামলী
রক্ষিত:
দেখুন
বাংলা সাহিত্য রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কিন্তু
মেরুদন্ড হীন বলেই আমার অভিমত। না তিনি নোবেল জয়ী বলেই কথাটা বলছি না। এমন
দার্শনিক,
সমাজতাত্ত্বিক, মানবতাবাদি, প্রগতিশীল সাহিত্যিক
বাংলা সাহিত্যে কেউ আসেন নি।কাজেই রবীন্দ্রনাথকে উপলব্ধি
করতে না শিখলে বাংলা সাহিত্য চর্চাই বৃথা হবে। জীবন কি, জীবন কেমন, এবং জীবন কি হওয়া
উচিত তা যেমন রবীন্দ্রনাথের কাছে জানতে পার, তেমনি বাংলাসাহিত্যের ঐতিহ্য কি? বাংলা সাহিত্যের রূপ
কি, বিশ্ব সাহিত্যের
আঙিনায় তার স্থান কি? এবং বাংলা সাহিত্যের গতি কি হওয়া উচিত।,রবীন্দ্র নাথের কাছ থেকেই
আমাদের বর্তমান প্রজন্মের লেখকদের এটা শিখতে হয় প্রতিটা মুহূর্ত।
আমি
রবীন্দ্রনাথ কে নিজের করে পেয়েছি একটু বড়
বয়সে। ক্লাস নাইন যখন পড়ি তখন আমার স্কুল লাইব্রেরিতে দেব বলে একটি কবিতা
লিখি বিদায়। মাসিমা অবসর নিয়েছেন চাকরি থেকে। আমাদের খুব প্রিয়
দিদিমণি ছিলেন। তাকে নিয়ে কবিতা লিখলাম বিদায়। স্কুলের বড়ো দিদিমণি বাংলার
টিচার। সেই কবিতা পড়ে আমাকে, স্টাফ রুম ডেকে পাঠালেন, তার পর খুব বকলেন। আমি নাকি ঐ
কবিতা রবীন্দ্রনাথের কোন কবিতার নকল করেছি। উনি যত বকেন আমি কেবল একটি
কথাই উত্তর দিই আমি তো কিছু জানি না।আমি রবীন্দ্র রচনাবলী তখনও
দেখিই নি চোখে। দরিদ্র পরিবার, গ্রাম দরিদ্র, স্কুলে লাইব্রেরি নেই, আমার রবীন্দ্র নাথ তখনও পাঠ্য
পুস্তক ভিত্তিক। উনি তো কিছুতেই বিশ্বাস করলেন না। বেধরপ বকুনি
খেয়ে বেরিয়ে এলাম। বকুনি খেয়েও যেন
বুকের ভেতরটা অহংকারে ফুলে উঠল।কেননা কবিতাটা যে আমি নিজেই
লিখেছি এই সত্য টা তো আমার কাছে খাঁটি। আমার মনে হল কবিতাটা তার মানে কিছু একটা হয়ছে। যা পড়ে কোথাও রবি
ঠাকুরের কথা মনে পড়েছে দিদিমণি।এই
জিনিসটা আমাকে দুটো জিনিস ফিরিয়ে দিল।এক আমি তার মানে লিখতে পাচ্ছি। আমাকে লিখতেই হবে।দুই রবীন্দ্র
রচনাবলী পাঠ করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করার পর,আমার প্রিয় বন্ধু
প্রীতিকণার বাড়ি থেকে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। রবীন্দ্রনাথ পড়ে যেটা আমাকে খুব
বেশি প্রভাবিত করে, তা হল মানুষকে জন্মাবার পর থেকে,প্রতি নিয়ত মানুষ হতে হয় মনুষত্য অর্জন করে। ক্ষুদ্রত্ব
থেকে বৃহতের দিকে যেতে হয়। ছোট আমি থেকে বড়ো আমিকে আবিষ্কার করতে হয় আমৃত্যু। এটাই আমি জীবনে
বিশ্বাস করি,
মেনে
চলি। আর কি সাহিত্য জীবন, কি ব্যক্তি জীবন কিংবা ছাত্রদের কাছেও মানে শিক্ষকতা
জীবনেও আমি রবীন্দ্র নাথের এই বিশেষ দর্শন মেনে চলার চেষ্টা করি।
সম্পাদক
রংরুট: রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘মানুষের
উপর বিশ্বাস হারানো পাপ’; একজন সাহিত্যিকের প্রত্যয়ে মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখাটা
কতটা জরুরী বলে আপনার মনে হয়? আর বিশ্বাসভঙ্গের দহন তার প্রতিভাকে কি ভাবে সমৃদ্ধ করে
তুলতে পারে?
বা আদৌ
পারে কি?
শ্যামলী
রক্ষিত: দেখুন যে কোনো সাহিত্যই আসলে সমাজের আয়না। আর সমাজ মানেই তো মানুষের
সমাজ অথবা মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত সমাজ। এ্যারিস্টটল তার পোয়েটিকস গ্রন্থে সেই
খ্রিস্টের জন্মেরও কত বছর আগে বলে গেছেন ট্র্যাজেডির মূল উপাদান পাঁচটির মধ্যে
মুখ্য উপাদানটি আবার চরিত্র। সেই চরিত্র কিন্তু মানুষ।
মানুষকে যদি না বুঝি তো মানব চরিত্র সৃষ্টি সম্ভব নয়। মানুষকে বুঝতে গেলে
মানুষকে বিশ্বাস করতে হবে, ভালোবাসতে হবে। তা যদি না হয় তাহলে কখনো শাশ্বত সৃষ্টি
সম্ভব নয়। তাই মানুষের প্রতি সংবেদনশীল হওয়াটা জরুরি। হ্যাঁ
বিশ্বাস হারানো যেমন পাপ তেমনি বিশ্বাস ভঙ্গের দহন স্রষ্টার কাছে খুব যন্ত্রণার। আবার আমরা জানি,our sweets song are those
that tell of the saddest Thought. বিশ্বাস ভঙ্গের দহন জ্বালা থেকেই কিন্তু বিশ্বের
যাবতীয় চিরকালীন সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে।
বিশ্বাস ভঙ্গের দহন জ্বালা একজন লেখককে সমৃদ্ধ করতে ভীষণ ভাবে সহায়তা করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। আবার কখনো কখনো এই দহন
জ্বালায় দগ্ধ হয়ে যন্ত্রণায় ক্ষত বিক্ষত
হয়ে পাগল হয়ে গেছেন, আত্ম হত্যা করেছেন
এমন টাও ঘটেছে।
সম্পাদক
রংরুট:
রবীন্দ্রনাথের
যুগের পর আমরা বহুদূর এগিয়ে এসেছি! জীবন ও সাহিত্যের ভিতর ও বাইরে ঘটে গিয়েছে
বিপুল পরিবর্তন! আজকের দিনে সাহিত্যে
আধুনিকতা বিস্তর পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে কোথাও কি একটা আবর্তের
মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে বলে মনে করেন আপনি? নাকি বাংলাসাহিত্য আরও বেগবান হয়ে আধুনিকাতার
পরিসরটিরই আরও বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে বলে মনে হয় আপনার?
শ্যামলী
রক্ষিত:
আসলে
সময়ের সঙ্গে সমাজ ও সভ্যতার ক্রম পরিবর্তমানতা স্বাভাবিক ধর্ম। সাহিত্যও বিভিন্ন
সময়ে বিভিন্ন ভাবে তার স্বরূপ পরিবর্তন করে থাকে।রবীন্দ্রনাথের
নিজেরই ছোটবেলার কথা যখন তিনি জীবনস্মৃতি গ্রন্থে
লিখেছেন তখন তাঁর আটষট্টি বছর বযস। তার আট বছরের
স্মৃতির কলকাতার কথা বলেছেন যখন,তখন তিনি নিজেই
বলেছেন,
সেকালের
কলকাতার অনেকটা পরিবর্তন ঘটে গেছে র। বীন্দ্রনাথের মৃত্যুর আশি বছর পরেও সমাজ এবং
সভ্যতা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। সেই কারণেই
সাহিত্যও নানানভাবে তার রূপ পরিবর্তন করেছে। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকাকালীন
সময়ে রবীন্দ্র অনুসারী বৃত্ত এবং রবীন্দ্রবিরোধী বৃত্ত তখনই গড়ে উঠেছে। বাংলা সাহিত্য ধাপে
ধাপে বিশেষ করে কথাসাহিত্য সম্পূর্ণ ভাবে নিজেকে বিকশিত করার প্রচেষ্টায় অবিরত
কার্যকরী থেকেছে। কবিতার ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি সেই ভাঙা গড়ার খেলা আরও
তীব্রভাবে ঘটেছে। আসলে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর ভারতবর্ষের স্বাধীনতা
এবং দেশভাগ এই দুটো মূল বিষয় স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে বাংলা সাহিত্যের পরিবর্তমান
রূপ আমরা পেয়েছি। সেই সময়কার উপন্যাসে কবিতায় গল্পের রূপ ও রীতির নানান
পরিবর্তন ঘটেছে।সত্তরের দশকে নকশাল মুভমেন্ট বাংলা সাহিত্যকে আবার অন্য
মাত্রা দান করেছিল।তারপর বাংলা কথাসাহিত্য কি কাব্যসাহিত্য উভয় ক্ষেত্রেই কোথায় যেন একটা
প্রবহমানতার শৈথিল্য দেখা গেছে।নানাভাবে বিষয় এবং গঠনের ধারা
পরিবর্তন হতে হতে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে দীর্ঘদিন ধরে আর কোনো
ক্লাসিক্যাল সাহিত্য সৃষ্টি হতে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। গতিহীনতার জটিল আবর্তের
মধ্যে বাংলা সাহিত্য এখন কিছুটা হলেও আবদ্ধ হয়ে গেছে আমার মনে হয়।। সত্তর আশির
দশকের পর,বাংলা সাহিত্যের গতি
আর সেই ভাবে বেগবান নেই। প্রান্তিক মানুষ নিয়ে কাজ হচ্ছে অনেক। কিন্তু সে সব
নাগরিক অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ পাঠ্যপুস্তক নির্ভর কাহিনী সেই অর্থে সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে
তুলতে পারিনি। এসবের কারণ বোধহয় বাংলা তথা ভারতবর্ষের আর্থসামাজিক পরিকাঠামোর
বিপুল পরিবর্তমান পরিস্থিতি। বলা যেতে পারে
স্রষ্টার জীবনের চরম ক্রাইসিস থেকে সাহিত্যের সোনার ফসল উৎপাদিত হয়ে থাকে। অর্থনৈতিকভাবে
সমৃদ্ধ দেশ মানুষের আর্থিক সংকট কিছুটা দূরীভূত হল, সাহিত্য মানুষের পেশা হয়ে
উঠেছে অনেক আগেই।বাজারি সাহিত্যের দুনিয়ায়, সাহিত্যিক কে সম্পাদকের চাহিদা
অনুযায়ী সাহিত্য সৃষ্টি করতে হয়।
সম্পাদক
আবার পাঠক রুচির উপর নির্ভরশীল।বাজারি সাহিত্যের চাহিদা অনুযায়ী সম্পাদক সাহিত্যের যোগান দেয়ার
চেষ্টা করেন। এর উল্টোটাও হয়ে থাকে। আশির দশকের পর থেকে আস্তে আস্তে সমাজের সমস্ত
কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে বাজার। মানুষের রুচি অনুযায়ী বাজার নয়,বাজারের মর্জি
অনুযায়ী মানুষ নিজেকে তৈরি করে নিল। মানুষের সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রক হল বাজার। তার ফলেই বাংলা
সাহিত্য তথা বিশ্ব সাহিত্যেকে আমরা এখন একটা বিপর্যস্ত পরিস্থিতির সম্মুখীন
হতে দেখছি। সাহিত্য ব্যবসায়ীর তিনটি মূল স্তম্ভ।লেখক সম্পাদক পাঠক।এই তিন সংযোগ সূত্র
এখন একটা সুতোর মধ্যে দোদুল্যমান। আজকের
সোশ্যাল মিডিয়ার চূড়ান্ত একটা সময় এসে আমরা সাহিত্যকে একটা শুধু সাহিত্য বলবোনা
সমস্ত রকম সৃজনশীলতাকে একটা থমকে যাওয়া পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে
পাচ্ছি। তার মধ্যেই ঘটে গেল গোটা বিশ্বব্যাপী এই করোনা মহামারী। এরপর শুধু বাংলা
সাহিত্য নয়;
সমগ্র
বিশ্ব সাহিত্য একেবারে আমূল পরিবর্তন হবে বলেই আমার মনে হয়।
সম্পাদক
রংরুট: সামাজিক দায়বদ্ধতার নিরিখে, একজন
সাহিত্যেকের সমাজসচেতনতা কতটা জরুরী বলে
মনে হয় আপনার?
এবং এই
সমাজসচেতনতার প্রসঙ্গে সাহিত্যিকের দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক মতাদর্শ কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
শ্যামলী
রক্ষিত:
একজন
দায়িত্ব সচেতন নাগরিকের সমাজ এবং রাষ্ট্র সম্পর্কে সচেতন থাকা খুবই জরুরী। একজন সাহিত্যিক
তিনি সমাজের পথপ্রদর্শক বলা হয়ে থাকে, সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করে থাকেন তিনি,তারা
সভ্যতাকে গতিবান করে। সৃজনশীল মানুষের সমাজ সচেতনতা অবশ্যই প্রয়োজন। না হলে
কোনো সৃষ্টিই সম্ভব নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সমাজ সচেতন হলেই কি
সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করে থাকেন? এ ব্যাপারে একটি কথা মনে পড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ
তাঁর 'সাহিত্যের উদ্দেশ্য ' প্রবন্ধে বলেছেন
সাহিত্যের কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারেনা আনন্দ-বিনোদনই মূল কথা। কিন্তু একথা তিনি
প্রবন্ধে বললেও তার প্রত্যেকটা সৃষ্টিতে, সে কবিতা,নাটক বা গান, উপন্যাস, গল্প যা কিছু তিনি
রচনা করেছেন,
প্রত্যেকটির
মধ্যে একটি করে মেসেজ তিনি পৌঁছে দেবার চেষ্টা করেছেন সমাজের মানুষকে। যা মানুষের
ব্যক্তি চরিত্র এবং রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর
উৎকর্ষ সাধনের সহায়ক হয়ে উঠতে পারে। বর্তমান
পরিস্থিতিতে,
সৃজনশীলতার
সঙ্গে সংযুক্ত মানুষ সামাজিক দিক থেকে অনেকটাই উদাসীন। আসলে সমাজ সচেতনতা বলুন, সামাজিক দায়বদ্ধতা
বলুন সবকিছুই গড়ে ওঠে মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে। মানুষকে ভালোবাসলে
সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা অন্তর থেকেই তিনি উপলব্ধি করবেন। আর মানুষকে ভালবাসতে হলে
মানুষের সঙ্গে সমস্ত রকমের বিভেদ ভুলে, বন্ধুত্বপূর্ণ সহানুভূতিশীল সম্পর্ক প্রয়োজন।
অর্থাৎ মানুষের সঙ্গে মিশতে হয় মানুষকে চিনতে হয়। এই জানা চেনার
মাধ্যমেই তার সঙ্গে একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়। সেই আত্মিক
সম্পর্কের বন্ধন এর জায়গা থেকেই ভালোবাসা আসে। আর সেই ভালোবাসাই
তাকে নিয়ে যায় সামাজিক দায়বদ্ধতার দিকে। এটা কাউকে চাপিয়ে দেয়া
যায়না। তার জীবনে চলার পথ যদি সেই অভ্যাসে এসে জারিতে থাকে
তবে সম্ভব। তখন এই ভালোবাসা
স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার সৃষ্টিতে উৎসারিত হয়। সমাজ সচেতনতার সঙ্গে শুধু দেশপ্রেম ও
রাজনৈতিক মতাদর্শগত দর্শন কার্যকরী থাকেনা। দেশপ্রেম মানুষকে অর্জন করতে হয়।
মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকেই কিন্তু সমাজের প্রতি দেশের প্রতি ভালোবাসা জাগ্রত
হয়।মানুষকে না ভালোবাসলে কখনো কোন দেশকে ভালোবাসা যায় না।
আর রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা যদি বলেন সেক্ষেত্রে আমি মনে করি রাজনৈতিক মতাদর্শ
সাহিত্যে চিরকালই একটি অপরিহার্য উপাদান। বর্তমান সভ্যতায় সমাজের
মুখ্য চালিকা শক্তি র ভূমিকায় আছে
রাজনীতি।তাই রাজনীতি অসচেতনতা সাহিত্যিকএর পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব
নয়।কিন্তু স্রষ্টাকে তার নিজের প্রতি সৃষ্টির প্রতি থাকতে
হবে নির্মমভাবে নিরপেক্ষ। নাহলে
তাঁর সৃষ্টি হয়ে উঠবে রাজনৈতিক ইশতেহার। যা কখনোই কাম্য নয়
বলেই আমার মনে হয়।
সম্পাদক
রংরুট: সাহিত্যসাধনা বা কাব্যচর্চার
প্রসঙ্গে কবি জীবনানন্দ পরিচ্ছন্ন
কালজ্ঞান ও সুস্পষ্ট ইতিহাসচেতনার উপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। তাই এই সমাজসচেতনতার ভিত্তি সুদৃঢ় ইতিহাসবোধের
উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে কতটা জরুরী বলে মনে করেন আপনি, এবং কেন?
শ্যামলী
রক্ষিত:
সমাজ
সচেতনতায় ভিত্তি সুদৃঢ় ইতিহাসের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া টা যে কোন স্রষ্টার পক্ষে
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।কেননা যে কোন সৃষ্টি তার স্বীকৃতি
খোঁজে। স্বীকৃতি দেবে তার সমকাল। সমকালের সমৃদ্ধ পরিশীলিত
পাঠকের মেধা ও মননের উপর ভিত্তি করে একজন স্রষ্টা তার যথার্থ স্বীকৃতি লাভ করে
থাকেন। তাই যে কোন সাহিত্যিক তিনি তার যুগে কালে যা কিছু সৃষ্টি করবেন তাঁর
সমকালীন সমাজ চেতনা প্রখর থাকতেই হবে। এবং সেই কাল চেতনা তখনই যথার্থ হতে পারে, যখন তা ইতিহাস বোধের
উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি যে ভাষায়
সাহিত্য সৃষ্টি করুন না কেন, সেই ভাষা সংস্কৃতির স্তম্ভ ফলকগুলি অর্থাৎ ইতিহাসের
বন্ধুর পথ তাকে সুস্পষ্টভাবে জানতে হবে। আজকের সময় দাঁড়িয়ে আগামী
সময় কে ছুঁতে চাওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা, একজন শাশ্বত স্রষ্টার তা শুধু সমকালকে জেনে-বুঝে
উপলব্ধি করে সম্ভব নয়। তখন ই চিরকালীন
সাহিত্য সৃষ্টি হতে পারে, যখন কোনো স্রষ্টা তার ঐতিহ্যের প্রতি এবং সুতীক্ষ্ণ
অনুভূতি লাভ করেন। অর্থাৎ যেকোনো
চিরকালীন সাহিত্যসৃষ্টির ক্ষেত্রে, বর্তমান সময়কে ইতিহাসের
চরণচিহ্ন অনুসরণ করে আগামী দিনের পথ নির্দেশ করতে পারেন। এইজন্যেই শাশ্বত
স্রষ্টাকে হতে হয় ত্রিকালদর্শী।
সম্পাদক
রংরুট:
স্বদেশপ্রেম, নিজের দেশের
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর প্রতি দায়বদ্ধতা- নিজের চারপাশের প্রবাহমান সময়ের সাথে
আত্মসংলগ্নতা এগুলি একজন সাহিত্যিককে কি আন্তর্জাতিকতার প্রেক্ষিতে সীমাবদ্ধ করে তোলে বলে মনে করেন আপনি?
শ্যামলী
রক্ষিত: না না আমি তা কখনই মনে করি না।আমি মনে করি নিজেদের
সংস্কৃতি সমাজ ইতিহাস সমস্ত কিছুকে
সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করতে শিখলে উপলব্ধি করতে পারলে, তবেই আন্তর্জাতিক
মানের সাহিত্য সৃষ্টি করা যায়। একজন মানবতাবাদী মানুষ যদি
যথার্থ অর্থে মানুষকে উপলব্ধি করতে পারে,তাহলে তার সৃষ্টি কখনো কোনো সীমাবদ্ধতাকে বরণ করে নেয়
না। সমস্ত সীমাবদ্ধতা ছিন্ন করে দেশকালের গন্ডিতে, থেকেও শাশ্বত কালের
কথা বলে।সেই স্রষ্টার কলম মানুষকে ভালোবেসে মানুষের মঙ্গলের জন্য
মানুষের সংকট উত্তীর্ণ হবার পথনির্দেশক বাণী। কখনো কোনো দেশ কালের সীমাবদ্ধতার গন্ডিতে আবদ্ধ
থাকতে পারেনা। সমস্ত গণ্ডি সেখানে মনুষ্যত্বের আঙিনায় বিশ্বদরবার তৈরি করে।সেই দরবার কোনো
নির্দিষ্ট ভূখন্ড নয়, কোনো নির্দিষ্ট সময় খন্ড নয় কোনো নির্দিষ্ট ভাষা-সংস্কৃতির
বেড়াজাল নয়।
সম্পাদক
রংরুট: আধুনিক জীবনেরর গতি সর্বস্বতা ও ভোগবাদী
সংস্কৃতি সাহিত্যকে কি ক্রমেই কোণঠাসা করে দিয়ে ভবিষ্যতের জন্যে অপ্রাসঙ্গিক করে
তুলবে বলে মনে করেন আপনি? গত এক দশকে, গোটা বিশ্বে ইনটারনেট বিপ্লবে আপনি
বাংলাসাহিত্যের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কতটা আশাবাদী?
শ্যামলী
রক্ষিত: এ প্রসঙ্গে আমার যেটা মনে হয়
আগে আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে সাহিত্য কিন্তু বিনোদন মাধ্যম। সেক্ষেত্রে বর্তমান
সভ্যতায় বিনোদনের হাজার মাধ্যম আছে। সাহিত্যকে সেই জায়গায়
দাঁড়িয়ে প্রতিযোগিতা করতে হবে। এটা তো স্বাভাবিক।কালের পরিবরতনে
বিনোদনের অনেক মাধ্যম ই অপ্রাসঙ্গিক এবং মূল্যহীন হয়ে গেছে। কিন্তু সাহিত্য কখনোই তা হবে না। তুলনার বিচারে তা
হয়ত পরিসংখ্যানে র দিক থেকে কমতে পারে। কিন্তু সিরিয়াস চিন্তা প্রবণ
মানুষের কাছে গ্রন্থ পাঠের মূল্য কমবে না কোনো দিন। কেননা আমাদের মনে
রাখতে হবে সাহিত্য ভাষা নির্ভর। প্রতিটি ভাষা শিক্ষার জন্য
বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত নির্দিষ্ট
কোর্স আছে।তাই নিয়ে কত মানুষ গবেষণা রত। কাজেই সাহিত্য পাঠ ও লেখা
কোনো দিন কমবে না। গোটা
বিশ্ব জুড়ে ইন্টার নেট যে ভাবে সর্বগ্রাসী আগ্রাসন বিস্তার করেছে তাতে পৃথিবীর
সমস্ত আঞ্চলিক ভাষা গুলির অস্তিত্ব সংকট দেখা দিয়েছে একথা মেনে নিতেই হয়। কিন্তু বাংলা ভাষা
সংস্কৃতি পৃথিবীর অন্যতম ভাষা গুলির মধ্যে একটি একথা অস্বীকার করার উপায়
নেই।বাংলা সাহিত্যের যে ব্যাপক বিস্তৃতি তা যেমন একদিন আসে নি তেমনি বর্তমান
পরিস্থিতিতেও বাংলা সাহিত্য বিশ্বে
নিতান্ত অবহেলার বিষয় নয়।কাজেই বাংলা সাহিত্য দিনে দিনে
ঠিক নিজের শক্তিতে সমহিমায় বিকশিত হবে এই প্রত্যাশা।
সম্পাদক
রংরুট: আমাদের সমাজসংসারে নারীর
অবস্থান আপনাকে কতটা ও কিভাবে বিচলিত করে? আপনার ব্যক্তিজীবনের দৈনন্দিন
ছন্দে এর প্রতিফলনের সরূপ সম্বন্ধে একটু বিস্তৃত ভাবেই জানতে চাইছি।
শ্যামলী
রক্ষিত: এই ব্যাপারে আমার একটু ভিন্ন
রকমের মতামত আছে।আমি কখনো নিজেকে নারী
বলে প্রতিষ্ঠা করতে বা দাবি করতে অভ্যস্ত নই। আমি সেইভাবে কখনো ভাবি নি। আসলে আমার ভাবার
প্রয়োজন হয়নি। কেন জানিনা আমি আগেই বলেছি, আমি নিজেকে মানুষ বলে পরিচিত
করতেই বেশি পছন্দ করি, তাই আমি ঠিক নারীবাদী পুরুষবাদী এই ব্যপারটা মাথার মধ্যে রাখি না
কখনও।ব্যক্তিগত জীবনে কাজে কর্মে কোন কিছুতেই আমি সেই অভ্যাসে
থাকি না। আমি গল্প-উপন্যাসে
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রান্তিক মানুষ নিয়ে লিখে থাকি। এই নারী বা পুরুষ
ব্যাপারটা আমার মনে হয় মধ্যবিত্ত ঘরানার চিন্তাভাবনা প্রসূত। আমি বর্ধমানের যে
গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছি সেখানে আদিবাসী কোরা
বর্গক্ষত্রিয় সুঁড়ি এরকম বিভিন্ন
গোত্রের নিম্নবর্গীয় মানুষের বসবাস। তাদের ক্ষেত্রে আমি দেখেছি
নারী-পুরুষের মধ্যে ব্যবধান খুব কম। আদিবাসী জীবনে পুরুষদের থেকে নারীদের ভূমিকা বেশি। পুরুষরা তার
উপার্জিত পয়সার প্রায় সবটাই মদ খেয়ে উড়িয়ে দেয়। নিম্নবিত্ত যে কোন
পরিবারের ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি, পুরুষদের চেয়ে সংসারে নারীদের ভূমিকা বেশি। বলা যেতে
পারে নারী চালিত সংসার। ছেলে-মেয়ে মানুষ করা,সংসারের ভালো-মন্দ ভাবনা চিন্তা
করা, সবটাই নারীদের বুদ্ধিমত্তা শারীরিক সক্ষমতা
ইত্যাদি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং
পুরুষদের থেকে (বিশেষ করে
আদিবাসীদের ক্ষেত্রে ) রোজগারও বেশি করে। তারা প্রতিদিন কাজ করে। তাদের কোনো ছুটি
নেই।কিন্তু পুরুষরা ইচ্ছা হলে কাজে গেল, না হলে মদ গিলে উল্টে পড়ে রইল। বর্ষার সময়ে, যখন চাষের মূল সময়,সে সময় মেয়েরা দুটো
কিষেনের কাজ একাই করে।কিন্তু পুরুষরা অত
বেশি কাজ করতে পারে না। বাজার দোকান করা সবই মেয়েরাই করে।
আর গ্রামে উচ্চবিত্ত মানেই সম্ভ্রান্ত পরিবার।সে
ক্ষেত্রে দেখেছি নারী-পুরুষের ব্যবধান তীব্র ছিল পু। রুষ শাসিত পরিবারে, শুধু পুরুষশাসিত বলা
চলবে না,পরিবারের প্রধান
যিনি সে নারী হোক বা পুরুষ। তার নির্দেশেই সকল কে। পুরুষদের ক্ষেত্রে
তারা ততটা রক্ষণশীলতা দেখাতেন না।কিন্তু মেয়েদের মেনে চলতে হত
নারী চালিত পুরুষ তান্ত্রিক শাসনে। আমরা আশাপূর্ণা দেবীর সুবর্ণলতা উপন্যাসে যার জ্বলন্ত চিত্র দেখতে পেয়েছি। কিন্তু
মধ্যবিত্ত সমাজে আবার এই দুটোর সংমিশ্রণ দেখতে পাই। কোথাও পুরুষকে ডমিনেট করে নারী। নারীত্বের প্রতিফলন
তেমনি দেখা গেছে। রমাপদ চৌধুরীর, 'বীজ', উপন্যাসে খুব ভালো
ভাবে তা দেখান হয়েছে। অনেক গল্পে উপন্যাসে, বাস্তব জীবনে আমরা দেখেছি
একান্নবর্তী পরিবার গুলোতে, বাড়িতে পিসিমা কিংবা ঠাকুমার কিংবা শাশুড়ি মায়ের
কথায় সংসার চলে। সে ক্ষেত্রে ছেলে মেয়ে বাচ্চা বুড়ো সবাই সেই নারীর
অধীনে পরিচালিত হয়।আবার কোথাও কোথাও পুরুষের অধীনে চলতে হয় সমস্ত
সংসার কে। এমনটাই দেখা গেছে।সে ক্ষেত্রে সবসময় যে
অর্থনৈতিক স্বাধীনতাই তার কেন্দ্রবিন্দু, তা কিন্তু নয়। সংসারে শ্রম দিয়ে
বুদ্ধি দিয়ে মেধা দিয়ে কোন নারী বা পুরুষ এমন যোগ্যতা অর্জন করেছে।সেটাও লক্ষ করা গেছে।কিন্তু বিষয় হচ্ছে উনবিংশ শতাব্দীর সময়কাল পর্যন্ত, কিংবা বিংশ শতাব্দীর
প্রথম যুগ পর্যন্ত বলা যেতে পারে কোন পক্ষেরই শোষণ বঞ্চনা নিয়ে কারো কোনো অভিযোগ
কারো প্রতি ছিলনা। প্রত্যেকে নিজের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি জনিত দুঃখ বেদনা কে নিজের
মতো করে হজম করে নিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে নারী প্রগতি
বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থাৎ সমস্ত কাজে নারী এবং পুরুষের সমান দক্ষতায়
পরিচালনা করার ক্ষমতা অর্জিত হল যখন, তখন থেকেই কিন্তু শোষক শোষিতের বিভাগটা সুস্পষ্ট
হয়ে গিয়েছিল। শিক্ষার সাধারণীকরণ ঘটার পরে যত বেশি নারী শিক্ষিত হয়েছে তখন
থেকেই বুঝেছে যে সে কোথায় শোষিত বঞ্চিত নিপীড়িত। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই জায়গা
গুলো খুব সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত হয়ে গেছে। তাই এখন আর নারী-পুরুষ বলে না,এখন প্রতিটা ক্ষেত্রে
সমাজ সংসার অফিস স্কুল বাজার দোকান সমস্ত জায়গাতে ক্ষমতাবান ও অক্ষমের লড়াই।
ক্ষমতাবান নারী বা পুরুষ অক্ষমকে, শোষণ করে নিজেকে শক্ত করে গড়ে তুলতে চায়,সে নারী হোক বা
পুরুষ। কাজেই এখন আর এক তরফা কোনো সিদ্ধান্তে আসা মুশকিল।
সম্পাদক
রংরুট: তথাকথিত একাডেমিক নারীবাদের চর্চা আমাদের তৃতীয়বিশ্বের এই আর্থসামাজিক পরিসরে কতটা ফলদায়ী ও
আশাব্যঞ্জক বল মনে করেন?
শ্যামলী
রক্ষিত: দেখুন আমাদের দেশের অধিকাংশ
শিক্ষিত নারীই এখনো কেবল মাত্র
ডিগ্রিধারীই থেকে গেছেন। প্রমথ চৌধুরীর 'বই পড়া ' প্রবন্ধে একশ বছর আগে বলেছেন
স্বশিক্ষিত মানুষই সু শিক্ষিত। আমাদের মেয়েরা সেই স্বনির্ভর
শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারে কজন। এম. এ. বি. এড, পি,এইচ .ডি ডিগ্রি আছে
সেই মেয়ে ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছে সঙ্গে
বাবা কিংবা মা কিংবা স্বামী যাবেন তবে তিনি পারবেন। চাকরিতে জয়েন করতে
যাবেন সেই সঙ্গে গার্জেন চাই। আমাদের মত দেশে এই নারীবাদের
চর্চা সেই মাত্রায় যেতে পারে নি, কারণ তারা অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হলেও, যথার্থ অর্থে সে
সাবলম্বী নয়। তার উপার্জিত টাকার হিসেব রাখেন তার স্বামী। তিনি নিজে নিজের ইচ্ছা
মত নিজের উপার্জিত অর্থের খরচা করতে সক্ষম নন এখনও। সংসারের যাবতীয় অর্থনৈতিক
পরিকল্পনা সম্পন্ন করেন পুরুষ, নারী নয়। আর এখনও যারা উচ্চ শিক্ষার আলো পায় নি,তাদের ক্ষেত্রেও সেই
একই কথা বলা যায়। তবে পরিস্থিতি অনেক পাল্টাচ্ছে। নারী প্রগতি চিন্তা
ধারাকে অনেক পুরুষ ও সমর্থন করে। নারী বাদী আন্দোলন নারী র ক্ষমতা,অধিকার ইত্যাদি
বিষয়ে অনেকটাই সচেতনতা দান করেছে। কাজেই এটার প্রয়োজন আছে তো
বটেই। এবং আগামি দিনে তা আরো বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে, সমাজ এবং সভ্যতার অগ্রগতির
কারণেই।
সম্পাদক
রংরুট: আর ঠিক এই প্রসঙ্গেই জানতে ইচ্ছে করছে, বিশেষত একজন লেখিকার
দৃষ্টিকোণ থেকে;
আমাদের
পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ সভ্যতায় একজন লেখিকার ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার
মনে হয়?
আপনার
নিজের লেখালেখির সূত্র ধরেই যদি বলেন!
শ্যমলী
রক্ষিত:
পুরুষ
তান্ত্রিক সমাজ বলেই শুধু নয়, সমাজের সামগ্রিক চালচিত্র শুধু মাত্র এক পক্ষের দ্বারা
চিত্রিত করা সম্ভব নয়। তার প্রধান কারণ দেখার দৃষ্টিভঙ্গি। অর্থাৎ জীবন দর্শন। নারী পুরুষের জীবন
দর্শন কখনো এক রকম হতে পারে না। তার কারণ
প্রাকৃতিক কারণে ই উভয়ের মনের গঠন আলাদা। কাজেই সমাজের সম্পূর্ণ ছবি পেতে গেলে দু পক্ষ্কেই চাই। তার সঙ্গে নারীর
সুদীর্ঘ সংগ্রামের পথ অতিক্রম করে কি ভাবে আজকের সমাজ এবং সভ্যতায় পুরুষের সঙ্গে
সমান মর্যাদায় সমান দক্ষতায় স্বস্থান অর্জন করেছে।এবং আজকের সময়ে
দাঁড়িয়ে তার বঞ্চনা,তার
ক্ষত বিক্ষত হওয়া এসব এক জন নারীর কলমে যতটা সাবলীল এবং সহজ ভঙ্গিমায় চিত্রিত
হবে,তা কিন্তু পুরুষের
কলমের দ্বারা সম্ভব নয়। নিজের লেখা লিখিত
সূত্র ধরে বলতে বললেন যখন বলি, আমি আগেই বলেছি আমি প্রান্তিক মানুষের রুজি রুটির
সংগ্রামের ইতিকথাই লিখে থাকি বেশি।সেখানে বেশি ভাগ লেখায় বিশেষ
করে আমার ছোট গল্পে কেন্দ্রীয় চরিত্র নারী সমস্যা। কিন্তু শুধু
ব্যক্তি নারীর নয়। সেই সম্প্রদায়ের।যেমন
একটি গল্প আছে মেছুনি। গ্রামের দিকে বাগদি দুলে বিশেষ করে দুলে সম্প্রদায়ের ঘরের
বউরা বাঁশের পাতলা বাঁকারি
গোল করে রিং বানিয়ে তার সঙ্গে জাল
বেঁধে ছোট ছোট গোল হাতজাল বানিয়ে সারা বছর লোকের পুকুরে দুপুর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত এ গ্রাম সে গ্রাম করে চিংড়ি মাছ ধরে বিক্রি করে
বাড়ি ফিরত। সেটা করতে
গিয়ে অনেক সময় পুকুর মালিকের কাছে তার
নারীত্ব বিকিয়ে দিতে বাধ্য হত।
হতদরিদ্র
সংসারে ছেলে মেয়ের মুখে দুটো অন্ন তুলে দেবে বলে।এই সমস্যার কথা একজন পুরুষের
পক্ষে লেখা খুব কষ্টকর।এরকম আরো অনেক গল্প আছে আমার, মুড়ি ভাজুনি কে
নিয়ে,
বাড়িতে কাজ করা মহিলাকে কিভাবে তার সংসার বাঁচানোর
জন্যে বাবা থেকে তিন ছেলেরে ভোগ্য হয়ে থাকতে হয়েছিল এবং একদিন তার স্বামী ফিরে
এসেছিল যখন তখন সে প্রজাপতির মত উড়তে উড়তে চলে গেছে তার ছবি আছে 'এবং প্রজাপ্রতি ' গল্পে। কাজেই
সমাজ এবং সভ্যতার অগ্রগতিতে এক জন লেখিকার
গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা আছে বলেই আমার
মনে হয়।
সম্পাদক
রংরুট: ভবিষ্যত প্রজন্মের সাহিত্যিক
দের কাছে আপনার প্রত্যশা ও দাবী কি?
শ্যামলী
রক্ষিত:
আমি
নিজেই এখনও নবীশ।আমার পরবর্তী প্রজন্মের সাহিত্যিকদের কাছে একটাই দাবি
মানুষ কে চিনুন,
সমাজকে
দেখুন,
সংবেদন
শীল হোন তা না হলে আর যাই হোক কথাসািত্যিক হতে চেষ্টা করা বৃথা।মানুষের চরিত্র এবং
সংলাপ কথা সত্যের মূল দুটি উপাদান। তা চলমান পরিবর্তন শীল জীবন্ত। তাই নিজের দেশ গ্রাম, অঞ্চল পরিবার সমাজকে
জানতে হবে,
বুঝতে
হবে তার মত করে উপলব্ধি করতে হবে,তবেই
জীবন্ত রক্ত মাংসের চরিত্র সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।
শ্যামলী রক্ষিত পেশায় শিক্ষিকা। খুব ছোট বেলা থেকে লেখালিখি শুরু। এযাবৎ একটি কাব্যগ্রন্থ,দশটি উপন্যাস,তিনটি ছোট গল্প
সংকলন এর স্রষ্টা। কবিতা লিখলেও গদ্যকার হিসেবেই পরিচিত।প্রথম উপন্যাস 'ক্ষতমুখ' লিখে ২০০৬ সালে
কলকাতা বইমেলায়, ওয়েস্ট
বেঙ্গল পাবলিশার্স অ্যান্ড গিল্ড থেকে, সাহিত্য সম্মান পুরস্কার লাভ।সারা বাংলা ছোট গল্প
প্রতিযোগিতায় গল্প পুরস্কৃত হয়।বর্ধমান
জাগরণী পত্রিকা থেকে সোমা গুইন স্মৃতি পুরস্কার লাভ ২০১০ এ গল্পের জন্য।
কপিরাইট রংরুট
কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন