বঙ্গ রাখাল : মজিদ মাহমুদের কবিতায় আধ্যাত্মিক প্রভাব




মজিদ মাহমুদের কবিতায় আধ্যাত্মিক প্রভাব

বাংলা কবিতার সূত্রপাত বৈদিকতান্ত্রিকতার বিশ্বাস মিশ্রিত আলো-আঁধারের গূঢ়্যরহস্যময় কবিতাকে আশ্রয় করে, যা আমাদের আকাঙক্ষাময় জীবনবোধনিষ্ঠ অনুভূতি; এ অনুভূতি থেকেই জন্ম নেয় কবিতা। কবি যখন কবিতা রচনা করেন তখন তাঁর সামনে এসে উপস্থিত হয় প্রাচীন, বর্তমান, অতীত। এ সময়পর্বে জ্ঞানচক্ষুর সন্মুখে মেলে ধরে ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভূগোল, নৃতত্ত্ব, অর্থনীতি, ধর্মনীতি, সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্যের সার্বিক জ্ঞান; যার সাথে কবি মিশ্রণ ঘটান তাঁর কল্পনা শক্তির রূপ, রস আর রঙ। এ রূপ রস আর রঙের মিশেলে ভূমিষ্ট হয় কবিতা। কিন্তু এ কবিতা কি সব সময়ই একই ধারায় প্রবাহিত হয়েছে? না, তা হয়নি। ক্ষণে ক্ষণে পাল্টে গেছে কবিতার ভাষা, শব্দের ব্যবহার। চর্যাপদের কবিতায়-


কাআ তরুবর পাঞ্চবি ডাল।
চঞ্চল চীএ পাইঠা কাল।।
দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমান
লুই ভণই গুরু পুছিঅ জাণ।।

শরীর বৃক্ষ, পঞ্চ ইন্দ্রিয় তার পাঁচখানা ডাল। চঞ্চল চিত্তে কাল প্রবিষ্ঠ হলো। দৃঢ় মহাসুখে পরিমান কর। আবার-‘রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাই’। অর্থাৎ গাছের তেঁতুল কুমিরে খাচ্ছে। আবার বৈষ্ণব কবিতায় দেখা যায় জীবাত্মা পরমাত্মার আড়ালে মানুষের অনুভূতি নিষ্পেষিত হয়েছে। মঙ্গলকাব্যও এর থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। চণ্ডী বা মনসামঙ্গল কাব্যে পূজা প্রাপ্তির আশায় অ-দেবোচিত ব্যবহারে মানবিক ব্যবহার করলেও এ মানবিকতার ওপরে স্থান করে নিয়েছে অলৌকিক ঘটনা, যা আমাদের জীবন অনুভূতির বিপরীতে অবস্থান নেয়। পৃথিবীর সমস্ত বিখ্যাত কাব্যই ধর্ম অনুভতিকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে। মধ্যযুগীয় ধর্ম অনুভূতির ব্যাপক কাব্য বিশ্বাস তাই একটা অনির্ণিত বাসনায় পর্যবসিত হয়েছে। সেই জন্য হয়তো বাংলা সাহিত্যে মহাকাব্য সৃষ্টির মহৎ চেষ্টা জাগরিত হয়নি। কাশীরাম দাস কিংবা কৃত্তিবাস ওঝা সে বিষয়ে আকাঙ্ক্ষিত ছিল কিনা সেটা এখন গবেষণার বিষয়। কারণ এখনো আমরা ভাবি বাংলার ঘরে ঘরে বাল্মীকির সীতা অধিষ্ঠিত না হলেও কৃত্তিবাসের কল্পিত সীতা কলাবধুর মতো অবনত হয়ে আছে বাংলা কাব্যের বঙ্গলীবৃক্ষের বুকের ভেতর থেকে। সেজন্য অনুভব করা যায় যে, বাংলা কাব্যক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুভতির একটা প্রতিষ্ঠা আছে জীবন জাগরণের মূলে। বস্তুত মধ্যযুগটাই ছিল ধর্মের জীবন। জীবনের ধর্ম মানবে নেমে আসতে আলাওল, ভারতচন্দ্র পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। আলাওল, ভারতচন্দ্রে ধর্ম নেই এমন নয়, তবে সেটা ছিল একটা পাতলা আবারণমাত্র, সেটা রবীন্দ্রনাথেও হয়তো-বা থাকতে পারে। ধর্মের আচরণ মানবসভ্যতায় মধ্যযুগে প্রথমেই সাহিত্যে আকীর্ণ হয়েছে ধর্মগ্রন্থসমূহে। এটা সত্য যে, বিশাল বাইবেলও এককালে রচিত হয়নি বা কেউ লেখেননি। প্রথম থেকে শেষ অবধি বিবিধ বিধি, রাজনামা, উপদেশ, বংশবানী, গানসমূহ নানা যুগের নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রচিত। বিষয়সমূহের প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে এ কথা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, বিভিন্ন সময়ের একটি জীবনধারা এতে উৎকীর্ণ করা আছে। জেকব-কন্যা দিনার কাহিনি কিংবা রথের কাহিনির একটা নীতিগত পার্থক্য রয়েছে। সে কালের সমাজের বিভিন্ন ক্রম খুবই সীমিত গতিতে অগ্রসর হয়েছে, কিন্তু কেবল সাহিত্যই তাকে ভাষাতে অন্তর্ভুক্ত করে চিহ্নিত করে রেখেছে। কালের ধর্ম এই-কিছু যায় না ফেলা। ধর্মগ্রন্থ বলে কথা। নইলে বেদ আবেস্তা রামায়ণ মহাভারত যে কোনো বিষয়ধর্মী প্রকাশকে ভাষার মহিমা ও সাহিত্য থেকে বিচ্যুত করা যায় না। এমনকি পবিত্র আর-কোরানের গভীর উপলব্ধির মূলে সাহিত্যক অনুষঙ্গ ন্যুন নয়। ধর্মগ্রন্থ ছাড়া ধর্মীয় অনুভূতির মাহত্ম্যপূর্ণ ও ‘মানবরচিত’ উৎকর্ষ বেদনারসমিজ সৌন্দর্য উপলব্ধির বাকমূর্তি ও শব্দ সংগীতগুলোর মধ্যে দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’, মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ ও ‘প্যারাডাইস রিগেইন’, জালালউদ্দিন রুমীর ‘মসনবি’, চণ্ডীদাসের পদাবলী, ইকবালের ‘অসারের খুদী’ ও ‘শিকওয়া’ ইত্যাদি মানব সমাজে ধর্মীয় ও সাহিত্য রসাস্বদনের জন্য প্রতিশ্রুত কাব্য। এসব কাব্য মানবরচিত বলা হলো এ কারণে যে অনেক ধর্মীয়গ্রন্থ দৈব, অপৌরুষের কিংবা আদিষ্ট হয়ে রচিত বলে দাবি করা হয়েছে। মাইকেলেঞ্জেলের শিল্পকর্মও এই অনুভূতি ,ভক্ত বলা চলে। কারণ তিনি মনে করতেন দৈব ইচ্ছা তাঁর হাতের তুলি পরিচালিত এবং সেজন্য তাঁর হাত দ্বারা সৃষ্ট কোনো রেখা তিনি বিনষ্ট করেননি।


কবি মজিদ মাহমুদ (জন্ম : ১৯৬৬) আশির দশকের একজন আলোচিত কবি। এ দশকের কবিরা যখন ইশতেহার ঘোষণা করে কবিতার পথকে শাণিত করেছে, কবিতার অনুষঙ্গ হিসেবে হাজির করেছে বিন্দুবাদী কবিতা, বিকল্প কবিতা ও প্রতিকী কবিতা। সে সময় কবি মজিদ মাহমুদ এই স্রোতের বিপরীতে হেঁটেছেন। রচনা করতে চেয়েছেন একান্ত নিজস্ব কবিতা, দেশজ অনুষঙ্গ নির্ভর; যাকে আমরা বলতে পারি বিশ্বমিথের সঙ্গে দেশজ মিথের অন্তর্বয়ন। এ দশকের নবীন কবিরা যেখানে সমাজ চিন্তা, নন্দন চিন্তুা নিয়ে তাদেন কবিতার ডালি সাজাতে বসেছেন সেখানে মজিদ মাহমুদের কবিতা বিজ্ঞান, দর্শন আর আধ্যাত্মিক ধাচের হয়ে পাল্টে দিচ্ছে কবিতার ফর্ম। মজিদ বিজ্ঞানকে আশ্রয় করে আধ্যাত্মিক চিন্তা চেতনার বিশ্বাসে সৃজন করেছেন কবিতা, যে কবিতা তাঁর নিজের মৌলচর্চার আত্মিক স্মৃতিতাড়িত হয়ে ধরা দিচ্ছে তাঁর করতলে। যেখানে কবিরা বদলে দিতে চায় সমাজ, গঠন করতে চায় নতুন রাষ্ট্র, বিশ্বসাহিত্য থেকে শব্দ কুঁড়িয়ে রচনা করতে চায় কবিতা; সেখানে মজিদ মাহমুদ একান্তই নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে আশ্রয় করে রচনা করেন কবিতার শরীর কাঠামো। তাঁর কবিতা পড়লে মনে হয় সাদামাটা কবিতা, কিন্তু এতে অন্তর্নিহিত রয়েছে দর্শন আর বিজ্ঞান। কবিতার পরতে পরতে আধ্যাত্মিক চিন্তা-চেতনা আর মিথের সুনিপুণ ব্যবহার।

এই যাত্রা একদিন শেষ এবং নিঃশ্বেষ হয়ে
তোমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাবে
তুমি একমাত্র সন্তানের জননীর মতো
হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়বে আমার অপুষ্ট তনুর উপর
আমি বলবো, মাগো তোমার বাবা কে
তুমি বলবে, ‘তুই
আমি তোর জননেন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে গড়াতে গড়াতে
বেরিয়ে এসে তোকেই করেছি ধারণ
(বল উপাখ্যান)

বাংলা সাহিত্যের কেন্দ্রীয় ধারাই মূলত আধ্যাত্মিকতা। নশ্বর এ দেহে অবিনশ্বর সত্তার বসত। বাইরে না খুঁজে আপন দেহমাঝে খোঁজ করলেই তাকে পাওয়া যায়১। ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, ভারতের চিন্তাজগতে আধ্যাত্মবাদের প্রভাব সর্বজনবিদিত২। কবি মজিদ মাহমুদের কবিতায় ঘুরে ফিরে এসেছে আধ্যাত্মিকতা যা আমাদের অন্বিষ্ট জীবনানুভতিরই ধারণাকে জাগ্রত করে। এ কবির কবিতায় ইসলামী ঐতিহ্যমণ্ডিত শব্দের ব্যবহার আমরা লক্ষ্য করতে পারি। কিন্তু তিনি অনেক ধর্ম পদ্ধতি ও দর্শনকে নতুন করে সংযোজন করেছেন। একে যদি খুটিয়ে দেখা হয় তাহলে তাকে বেদাতি বা নতুনত্ত্ব সৃষ্টির দায়ে অপরাধী বলা যায়। এতো বিদ্রোহী সুর যার কবিতায় কেন তাঁকে একদল কবি-সাহিত্যিক প্রতিক্রিয়াশীল বলার চেষ্ট করেন তা আমার বোধে আসে না। নজরুলকে একসময় কাফের ও নাস্তিক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, শেষে ইসলামের কবিও বলা হয়; এসব তৃতীয় শ্রেণির সাহিত্য সমালোচনা বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত। কাজী নজরুল হলো মানুষের কবি মানবতার কবি। মজিদ মাহমুদও তেমনি মানুষের কবি, তাঁর সৃষ্টিশীলতার মাঝেই আমরা পাই মানবতার স্পন্দন। মাহফুজামঙ্গল কাব্যের ‘এবাদত’ নামক কবিতায় কবি বলেন-

মাহফুজা তোমার শরীর আমার তছবির দানা
আমি নেড়েচেড়ে দেখি আর আমার এবাদত হয়ে যায়
তুমি ছাড়া আর কোনো প্রর্থনায়
আমার শরীর এমন একাগ্রতায় হয় না নত
তোমার আগুনে আমি নিঃশেষ হই
যাতে তুমি হও সুখী

মাহফুজা কবির একমাত্র এবাদতের মাধ্যম, যার কাছে গেলে কবির এবাদত হয়ে যায়। এ প্রেম শুধুমাত্র বৈষ্ণব সাধনা, সুফি সাধনা বা তন্ত্র সাধনায় সন্ধান মেলে। এসব সাধনা ঐতিহ্যবাহী প্রাচ্য সাধনার যোগ্য উত্তরসুরী হয়ে উঠেছে কবি মজিদ মাহমুদ। বৌদ্ধদের শ্রমণ কৃচ্ছতা আর তান্ত্রিকদের আচার সংক্রামিত এবং ইরানিদের সেমীয় বিরুদ্ধচারীতা থেকে সুফীবাদের উদ্ভব এ কথা সত্য এবং সুফীদের সত্যনিষ্ঠা ও পরিচ্ছন্নতা অভ্যাস থেকে ধারণা করা হয়েছে যে ফারসি সাফা বা পরিষ্কার অভিনিবেশ থেকে সুফীবাদের উদ্ভব বিশেষভাবে তাৎপর্যময়৩। জামি কাব্য ও দর্শন সূত্রে প্রথম সুফী শব্দের ব্যাবহার করেন৪। সুফীদের মূল সাধনা খোদার সঙ্গে প্রেমবন্ধন স্থাপন করার মধ্য দিয়ে খোদার অস্তিত্বের অনুপ্রবিষ্ট হওয়ার সাধনাকে বোঝায়। এ সাধনার ফলে পবিত্র আত্মার অনুসন্ধান করা। এ জন্যই এ সাধনার সংক্ষিপ্ত নাম ‘হামাওস্য’, অর্থাৎ যা কিছু তিনি সব কিছুই আমি। আমিই তিনি। কবি ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ঈশ্বররূপী মাহফুজাকে খুঁজেছেন প্রতিটি বিষয়ের মধ্যে। কারণ তিনি, ঈশ্বর আর মাহফুজা এখন একাকার হয়ে গেছে, এখন আর কবি এই তিনজনকে আলাদা করে দেখতে পান না। তাই তো সব আজ মাহফুজাময়। আমরা জনি সুফীদের চরম সাধনা ও জ্ঞান অন্বেষণ করা বা সত্যানুসন্ধানী হওয়া আর এর পরবর্তী ধাপ ফানা বা বাকা চিত্তে সত্য উপলব্ধির সাধনা করা। এই ফানা বা বাকাতে সুফীরা দারবিশত্ত্ব লাভ করেন। সত্যের জন্য সর্বত্র ত্যাগ করেন। মনসুর হাল্লাজ সত্যকে পরিত্যাগ করতে পারেননি। তাই সত্যের জন্য জীবন দিলেন। তিনি এ সত্যের অনুসন্ধানী ছিলেন বলেই বলতে পেরেছিলেন ‘আনাল হক’-আমিই ঈশ্বর। ‘আমি’ নামের এই সত্যটি উচ্চরিত হলো। এ যুগের আধ্যাত্মিক কবি মজিদ মাহমুদ সেই একই আমিত্বের কথা একটু অন্যভাবে রূপকের আশ্রয়ে বলেন। এ সময়ে এসেও তিনি হাল্লাজের মতো সত্যনুসন্ধানী, বিদ্রোহী-আমিই সব। এই জোরাল উচ্চরণ কবি মজিদের কবিতায়-

আমার রক্ত এখন মনসুর হাল্লাজের মতো ধ্বনি তোলে মাহফুজা
আমার ক্রুশবিদ্ধ শরীর এখন ধ্বনি তোলে মাহফুজা
আমার চিতাভস্ম ধ্বনি তোলে মাহফুজা
সমুদ্রের ঢেউ আর বাতাসের ধ্বনি
আমার শ্রবণেন্দ্রিয় একটা শব্দই ভরে রাখে সারাক্ষণ
মাহফুজা মাহফুজা মাহফুজা মাহফুজা...
(মাহফুজা)

কথিত আছে মনসুর হাল্লাজের গর্দান তলোয়ারের আঘাতে কাটা হলেও তাঁর নিঃসৃত রক্ত থেকে আনাল হক অথবা আমিই ঈশ্বর শব্দ ধ্বনিত হচ্ছিল; মতান্তরে আমিই সত্য। মজিদ মাহমুদ ‘আনাল হকে’র মতো বাণী উচ্চরণ করেছেন, যা কবিকে মনসুরের মতো বিদ্রোহী করে তোলে। এ সাধনা যেন প্রেম সাধনা। এ প্রেম কার সাথে? সেই পরম পুরুষের সাথে যা কবির একমাত্র লক্ষ্য। তিনি পরম পুরুষ বা পরমাত্মার সঙ্গে মিশে একাকার হতে চান। যে কারণে তিনি সরল ভঙ্গিমায় উচ্চরণ করলেন সবকিছু আজ মাহফুজাময়। এ প্রেমে কোনো কামনা থাকে না, কামকে অতিক্রম করে পৌঁছতে হয় প্রেমের সাগরে। প্রাচীন বস্তুবাদী চার্বাক দর্শনে দেহনিরেপক্ষ চৈতন্যময় আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না। যুক্তিবাদী এ দর্শনে চৈতন্যকে দেহধর্ম হিসেবেই গণ্য করা হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মে ঈশ্বর ও নিত্য আত্মার অস্তিত্ব নেই। সুতারং এতে ঈশ্বর বা পরমাত্মার প্রেমের কথা থাকতে পারে না। তবে এতে প্রেম বলতে নির্বান বা মহা সুখ লাভের কথা বলা হয়েছে৫। সুফী মতবাদে আল্লাহ সম্পর্কে বলা হয়েছে তিনিই একমাত্র সত্য এবং অনন্ত ও প্রেমময়। এই ঐশ্বরিক প্রেমে আবিষ্ট হওয়া মানুষের একামত্র কাম্য। ঈশ্বরের সঙ্গে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বা মিলনের বন্ধন স্থাপনই সুফীদের একামত্র উদ্দেশ্য। ঈশ্বর আনন্দময় সেজন্যই ঈশ্বর প্রকৃত স্বরূপ। তাই ঈশ্বরকে পেতে হলে তাঁর সঙ্গে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে নতুবা সফলতা সম্ভব নয়। প্রেম ব্যতিত তাকে পাওয়া যায় না। সুফীদের কাছে এ প্রেম মনিমুক্তার চেয়েও মুল্যবান-

মাহফুজা কবির আত্মার যন্ত্রণা বা ক্রন্দন, যা কবির প্রেমের উৎস মূল হয়ে পূজনীয় আদিমতা থেকে আধুনিকতা প্রক্রিয়ায় তৃপ্ত এক ঐশ্বরিক নারী; যে কবির সর্বসত্তায় বাস করেন। এ যেন কবির পৃথিবী আজ মাহফুজাময়। চারদিকে মাহফুজা মাহফুজা মাহফুজা।
তোমার নাম জানার আগেই কে আমাকে
স্তন্যদানে সজীব করেছিল
কে আমাকে শিখিয়েছিল তোমার নামের
আদ্যক্ষর
আজ আমি বুঝতে পারি মাহফুজা তুমিই দিয়েছিলে
এই প্রস্তুতিকাল
তোমার মহীমা বোঝার অপার ক্ষমতা
তুমি জাগিয়ে দাও আমাদের ভেতরের মেয়েমানুষ
(আদ্যক্ষর)

মাহফুজা’র আদ্যক্ষর মা যে আমাদের বুকের দুধ পান করিয়ে সজীব করে তোলেন। কবি সত্যানুসন্ধানী পুরুষ সত্যকে সে সন্ধান বয়ে চলেছেন। কবি যে মায়ের স্তনপানে সজীব হয়েছিলেন, মাহফুজার পূর্ব প্রস্তুতির ফল। আর সুফীতত্তে¡র ভাষায় জানা যায় দেহের মধ্যে ৭২,০০০ নাড়ি আছে। এ নারীদের মধ্যে আবার তিনটি নাড়ি প্রধান। এর মধ্যে একটা দিয়ে বীর্য আসা-যাওয়া করে, এই বীর্যই তো সুফীতত্তে¡র সর্বশক্তি। কবি সম্রাট লালন এ মানুষস্বরূপ উচ্চরণ করতে চেয়েছেন আদিরসের মধ্যে। জন্মলগ্নে শুক্রকীটরূপী সেই মানুষ এসেছিল ডিম্বাণুরূপিনী আর মানুষকে ধরে। ডিম্বকোষে যে মূণ্যাকার থাকে, ঐ ডিম্বাণুকে ধরতে পারলেই অধর মানুষের সাধন সিদ্ধ হয় এবং তাতেই জন্ম-মৃত্যু-বার্ধক্য থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব৬। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর ঋতু ও ঋতুস্রাবকে গুরুত্ত্ব দেয়, কেননা এই কালে নারীর সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়াগত হিসাবের ব্যাপারটির সূচনা ঘটে। রজঃস্রাবের পরবর্তী তিনদিন নারী-পুরুষের দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন নিষিদ্ধ এবং এই সময়ে নারীকে অপবিত্র ভাবা হয়। তিনদিন পর শুরু হয় নারীর সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়া৭। কবি মজিদ মাহমুদ তাঁর কবিতায় উল্লেখ করলেন-

ঋতুবতী তুমি যখন আমাকে জন্ম দিয়েছিলে
শূন্যতার তারল্যের ভেতর
(মাছের পোনা)
স্ত্রীকে ধরা হয় ফসলী মাঠ। এ মাঠকে সঠিক সময় আবাদ না করলে পতিত থাকে। আবাদ দিলে ফসলরূপী সন্তান উৎপাদন হয়। এ সন্তান ধারণের মাধ্যমেই একজন নারী পরিপূর্ণ নারী হিসেবে সমাজে স্বীকৃতি পায়, পরিণত হয় বীজ ধারণ ও ফসল উৎপাদনের স্বরূপরূপে।

১. রক্তাক্ত দেহ টেনে নিয়ে গেলে ফসলের মাঠে
তুমিই তো প্রথম তুলে দিলে পাখি
তারপর একমুঠো বীজ
(একমুঠো বীজ)

২. আমি তো দেখি তোমার সবুজ স্তন-আগুনের ক্ষোত

ইতালীয় কবি আলিগিরি দান্তে পরিব্যপ্তভাবে তাঁর কাব্যচিন্তার মূল প্রেরণায় একজন নারীকে মূর্ত রেখেছিলেন। আলিগিরি পরবর্তী ইতালীয় কবিতা মূলত তাঁকে কেন্দ্র করেই সৌন্দর্যের উৎসমুখে প্রকাশিত হয়েছিল। আর সে নারীর নাম বিয়াত্রিসে। আরবী কবিতায় যেমনটি লায়লা, অথ্যাৎ রাত্রি। এই রাত্রি রৌদ্র দগ্ধ জীবনকে স্নিগ্ধ সুখ আনন্দ প্রেম প্রদান করেছে, তাই লায়লা অর্থ প্রেমিকা। বাংলা কবিতায় যাকে ধরা হয় রাধা৮। কবি মজিদ মাহমুদের কবিতার প্রেরণায় একজন নারী মাহফুজা; বাংলা সহিত্যে যে রাধা। কবি এ প্রেমিকাকে সর্বময় ডেকেছেন। কিন্তু কবি মজিদ মাহমুদ তাঁর কবি চিত্তকে কোনো নারীর কাছে এর আগে এতোটা বশীভূত করে দেউলে করে দিতে পারেন নি।

ঈশ্বরকে ডাক দিলে মাহফুজা সামনে এসে দাঁড়ায়
আমি প্রার্থনার জন্য যতবার হাত তুলি সন্ধ্যা বা সকালে
সেই নারী এসে আমার হৃদয়মন তোলপাড় করে যায়
তখন আমার রুকু
আমার সেজদা
জায়নামাজ চেনে না
সাষ্টাঙ্গে আভমি লুণ্ঠিত হই
এ মাটিতে উদ্গম আমার শরীর
(কুরশিনামা)

কবির সামনে মাহফুজা নিজেই ঈশ্বর হিসাবে সামনে এসে দাঁড়ায়, কবি তাঁর আত্মার সাথে মাহফুজার আত্মার সংযোগ ঘটনার জন্য যেন ব্যাকুল। সে মিশে যেতে চায় মাহফুজার আত্মার সাথে। মিল্টনের বর্ণিত জর্দান নদীর তীরবর্তী তরুরাজি প্যারাডাইস মানব মনের সৌন্দর্যের শিল্পরূপ এবং তারই বাকমূর্তস্বরূপ। কিন্তু প্যারাডাইসে নারীর প্রেম এসে করলো সবকিছু কলুষিত। তখন দেখা গেল গডের প্রতি ভালোবাসার চেয়ে নারীর প্রতি ভালোবাসাই কাব্যের প্রধান কারণ। আদম নির্বাসিত হলো পৃথিবীতে-কবি মজিদেরও সেই পাপে ধরেছে, একজন নারীর প্রেমই তাকে মাতাল বানিয়েছে; যে কারণে কবি একজন ঈশ্বরকেও তাচ্ছিল্য করতে ছাড়েন না।

৩.

কবি মজিদ মাহমুদের কবিতায় রয়েছে প্রচুর মিথ, দর্শন, বিজ্ঞান, অধিবিদ্যার ব্যবহার; যা কবিকে একজন গূহ্যরহস্যময় চর্যাপদের তান্ত্রিক সাধন পুরুষদের মতো করে আলো-আঁধারী ভাষা সৃষ্টিতে গভীরভাবে সাহয্য করে। এ আধ্যাত্মিক রহস্যময়তাই কবি মজিদ মাহমুদকে পরিচিত করে তুলেছে অন্যসব কবিদের থেকে আলাদা। তিনি সুফীদের জীবনবোধ ও মানসিকতায় অনুভব করেছেন তাঁর সাধনা, যা তাকে এ মাটিতে জন্মে মানুষের সামাজিক জীবনের চাহিদা মেটাতে সাহয্য করে। কবির কাব্যের অনুসন্ধান মেলে ভাবের। এ ভাব সাগরে যে একবার ডুব দিয়েছে সে ভাবের ঘাটে নিত্য আসা-যাওয়া করে। কবি মজিদ মাহমুদও সেই ভাবের ঘাটে ঘুরে ঘুরে সঞ্চয় করেছেন প্রেম। যে প্রেম তাঁর তৃষ্ণার্ত মনের তৃষ্ণা মেটায়। হাফিজ যেমন সাকির গালের একটি তিলের জন্য সমখন্দ ও বুখারা বিলিয়ে দিতে দ্বিধা করেন না-

আগার আস তুর্কএ সিরাজী বদস্ত আরদ দিলএ মারা
বাখলে হিন্দওয়াশ বখশাম সমরকন্দ ওয়া বুখারারা

হেলেনের রূপের জন্য ট্রয় গেছে, লঙ্কা গেছে সীতার জন্য, দ্রোপদীর জন্য পাঁচ ভাইকে দ্রৌপদীয় শাড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে। তেমনি কবি মজিদ মাহমুদের আর এবাদত করা লাগে না, মাহফুজার শরীর তাঁর তসবির দানা। এ দানা নেড়েচেড়ে দেখলেই তার এবাদত হয়ে যায়। এই ঐশ্বিবোধ বা মরমি চিন্তার মূল সুর প্রেম, যার পুরোপুরি সন্ধান পাওয়া যায় মজিদ মাহমুদের কবিতায়। এ যেন শাশ্বত সত্যকেই বারংবার আবিস্কার করা। কবির এ প্রেম ব্যাকুলতা যেন বাউলদের আর্তি-পরমাত্মার সাথে আমার মিলন কবে হবে। কিংবা রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-আমার মিলন লাগি তুমি আসছ কবে থেকে। শ্রী চিন্ময়ও প্রশ্ন করেন, হে প্রভু, কোথায় তোমার সত্যের প্রকাশ? কোথায় তুমি, হে সত্য হে প্রিয়? মজিদ মাহমুদ তেমনই বলেন-

মাহফুজা আমার জীবন আমার জবান তুমি
করেছ খরিদ, অতএব তোমার গোলাম আমি

কবি প্রেমের উৎসে তার আয়ুকে বৃদ্ধি করেছেন শতেক গুণে। এ চেতনা তার ইন্দ্রিয় শক্তিকে বাড়িয়ে দেয়। কবি তাঁর আধ্যাত্মিক চেতনায় ভাব প্রকাশ করেছেন বিরল ভাব বৈশিষ্টে সহজ যুক্তিতে যা দেশজ অনুসঙ্গের সমর্থ পংক্তিতে। কবির কবিতার অন্তর্নিহিত বানি আমাদের কাছে যেন এক মহৎ প্রাপ্তি আমাদের কাছে গুপ্ত চেতনা বোধকে শাণিত করতে হলে বার বার ফিরে যেতে হবে কবি মজিদ মাহমুদের কবিতার কাছে, যার তাৎপর্য সুদূর প্রসারী।

সূত্র :
১. খোন্দকার সিরাজুল হক-মরমী কবি পাঞ্জু শাহ জীবন ও কাব্য, বাংলা একাডেমি পুর্ণমুদ্রণ ২০০৪
২. ঐ
৩. শামসুল আলম সাঈদ-কাব্য বিশ্বাসে কবি ও কবিতা, ইউপিএল প্রকাশনি, প্রকাশ : ১৯৯৫
৪. ঐ
৫. আবুল হাসান চৌধুরী-বাংলাদেশের লোক সঙ্গীতে প্রেমচেতনা, বাংলা একাডেমি, ফেব্রুয়ারি ২০০১
৬. ঐ
৭. সিরাজ সালেকীন : উপনিষদের নারী (উলুখাগড়া, জুলাই-সেপ্টেম্বও ২০১৬)
৮. শামসুল আলম সাঈদ-পূর্বোক্ত

কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন