বাঙালির সমাজ ও জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব * ইন্দ্রাণী সরকার



বাঙালির সমাজ ও জীবনে
রবীন্দ্রনাথের প্রভাব

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ও বাঙালির অহংকার, বিশ্বসাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। অসাধারণ সব সাহিত্যকর্ম দিয়ে তিনি বিস্তৃত করেছেন বাংলা সাহিত্যের পরিসর। কালজয়ী এই কবি জীবন ও জগৎকে দেখেছেন অত্যন্ত গভীরভাবে, যা তাঁর কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ ও ভ্রমণ কাহিনী, সংগীত ও চিত্রকলায় উৎসারিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। সাহিত্য, সংগীত ও শিল্প চর্চার মাধ্যমের প্রতিটি শাখায় তাঁর অনন্য ও অনায়াস বিচরণ সত্যিই বিস্ময়কর। বিশ্বকবির সমস্ত সৃষ্টির মূলে নিহিত মানবতাবাদ তাঁকে বিশিষ্টতা দান করেছে। শান্তি ও মানবতার কবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যের সাধক।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যের অক্ষয় সম্পদ। তাঁর আগে ছোটগল্প লেখা হলেও, যথার্থ ছোটগল্প বলতে যা বুঝায়, তার স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছোটগল্পের সংগঠন-শৈলী, অন্তিম ব্যঞ্জনা, ভাষারীতি- যে কোনো দৃষ্টিকোণেই উত্তরকালীন লেখকদের উপর রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সমুদ্রপ্রতিম। এ কালে বাংলা ছোটগল্পে নিম্নবর্গের জীবন চিত্রায়নের যে প্রবণতা ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায়, তার প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি আমরা পেয়েছি রবীন্দ্র ছোটগল্পে। এ প্রসঙ্গে ‘শাস্তি’, ‘একটি মুসলমানী গল্প’, ‘মাস্টারমশাই’ এসব রচনার কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। আজ থেকে একশ পঁচিশ বছর আগে দুখিরাম-ছিদাম-রাধা-চন্দরাকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘শাস্তি’ নামের যে গল্প লিখেছেন, তা এখনো বাঙালি গল্পকারদের কাছে রীতিমতো ঈর্ষার বিষয়। এ যুগের ছোটগল্পে নারী ব্যক্তিত্বের উন্মোচনের যে প্রয়াস লক্ষ করা যায়, সেখানেও দেখি রবীন্দ্রনাথের অতুল প্রভাব। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় তাঁর ‘হৈমন্তী’, ‘বোষ্টমী’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘পয়লা নম্বর’, ‘ল্যাবরেটরি’ প্রভৃতি গল্পের কথা। এ সব গল্পে শিল্পিতা পেয়েছে প্রথা ও সমষ্টির সঙ্গে ব্যক্তির সংঘর্ষ এবং সকল সনাতন মূল্যবোধের বিরুদ্ধে ব্যক্তির বিদ্রোহ। ‘রবিবার’ কিংবা ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পের বিজ্ঞানচেতনার কথাও এখানে উল্লেখ করা যায়। নারীকে প্রাকৃতিক লৈঙ্গিক পরিচয়ের মধ্যে বৃত্তাবদ্ধ না রেখে, তাকে সামাজিক লৈঙ্গিক দৃষ্টিকোণে পর্যবেক্ষণের সূত্রপাত ঘটে রবীন্দ্রনাথের হাতে। রবীন্দ্র-ছোটগল্পের এসব বৈশিষ্ট্যই উত্তরকালীন বাংলা ছোটগল্পে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়।

রবীন্দ্রনাথের প্রভাব যে কতো ব্যাপক, তা বোঝা যায় তখন, যখন দেখি রবীন্দ্রনাথের বাক্যবন্ধ ধার করেই বুদ্ধদেবকে নির্মাণ করতে হয় তাঁর বিবেচনা। বস্তুত, রবীন্দ্রোত্তর কালে এমন কোন বাংলাভাষী লেখক আছেন, যিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রবীন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত হননি? এই প্রভাব কখনো পড়েছে সাহিত্যের ভাব-পরিমণ্ডল সৃজনক্ষেত্রে, কখনো সংগঠন নির্মাণে, কখনো বা আঙ্গিক নির্মিতিতে। লেখার অপেক্ষা রাখে না যে, কোনো কোনো সাহিত্যিক রবীন্দ্র প্রভাব থেকে কখনো মুক্তি পাননি, আবার কেউ বা নির্মাণ করে নিয়েছেন নিজস্ব ভুবন।

বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে বাঙালি কবির কাছে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ছিলো উপদ্রবের মতো। কিন্তু প্রলোভন দুর্দম হলেও রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ তাঁদের পক্ষে ছিলো দুঃসাধ্য। ফলে তাঁর প্রবল দীপ্তির জোয়ারে অনেকেই হারিয়ে গেছেন, অনেকেই নির্মাণ করতে পারেননি নিজস্ব কোনো দ্বীপভূমি। প্রায় সকলেই এদিক-সেদিক ঘুরে-ফিরে শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের কবিতা-উপনিবেশেই আশ্রয় নিয়েছেন, রাবীন্দ্রিক কবিতাকাশেই তাঁরা ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁদের সাধনার শ্রেষ্ঠ তারামালা। রবীন্দ্র-বলয়বন্দি এই কবিদের মধ্যে আছেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, কালিদাস রায়, গোবিন্দ্রচন্দ্র দাস, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, মোহিতলাল মজুমদার, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখ। বলতে দ্বিধা নেই, কিছু স্বাতন্ত্র্য থাকলেও এঁরা মূলত রবিশস্যেই লালিত-পালিত বর্ধিত।

রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার কিংবা অতিক্রমের স্পর্ধিত কোনো প্রয়াস এঁদের ছিলো না, উনিশ শতকী রবীন্দ্র-রোমান্টিকতাই তাঁরা চর্চা করলেন বিশ শতকের প্রথমার্ধেও- ‘বলাকা’ উত্তর রবীন্দ্র-কবিতা আত্তীকরণেও তাঁরা হলেন ব্যর্থ। দেশকালের দ্বন্দ্ব ও সংক্ষোভ, সভ্যতার সঙ্কট তাঁদের বিচলিত করেনি, তাই রাবীন্দ্রিক স্বদেশপ্রেম ও প্রকৃতিলোকে এঁরা নিশ্চিন্তে কালাতিপাত করে নির্মাণ করেছেন কবিতার পর কবিতা। বস্তুত, তাঁদের এই পরিণাম ছিলো ইতিহাস-নির্ধারিত। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় বুদ্ধদেব বসুর নিম্নোক্ত ভাষ্য:

বাঙালি কবির পক্ষে, বিশ শতকের প্রথম দুই দশক বড়ো সংকটের সময় গেছে। এই অধ্যায়ের কবিরা- যতীন্দ্রমোহন, করুণানিধান এবং আরো অনেকে, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যাঁদের কুলপ্রদীপ, যাঁরা রবীন্দ্রনাথের মধ্যবয়সে উদ্গত হয়ে নজরুল ইসলামের উত্থানের পরে ক্ষয়িত হলেন- তাঁদের রচনা যে এমন সমতলরকম সদৃশ, এমন আশুক্লান্ত, পাণ্ডুর, মৃদুল, কবিতে-কবিতে ভেদচিহ্ন যে এত স্পষ্ট, একমাত্র সত্যেন্দ্র দত্ত ছাড়া কাউকেই যে আলাদা করে চেনা যায় না- আর সত্যেন্দ্র দত্তও যে শেষ পর্যন্ত শুধু ‘ছন্দোরাজ’ই হয়ে থাকলেন- এর কারণ, আমি বলতে চাই, শুধুই ব্যক্তিগত নয়, বহুলাংশে ঐতিহাসিক।’

রবীন্দ্রনাথ জন্ম-রোমান্টিক কবি বলে বুদ্ধদেব বসু তাঁর কবি রবীন্দ্রনাথ বইয়ে দাবি করেছেন। রোমান্টিকদের যে যে বৈশিষ্ট্য থাকে, তার সবই রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল অত্যন্ত প্রকট। তীব্র কল্পনাপ্রবণতা, সুদূরের প্রতি আকর্ষণ, সূক্ষ্ম সৌন্দর্যবোধ, প্রকৃতির প্রতি বাঁধভাঙা আকর্ষণ রবীন্দ্র প্রতিভার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। এসব বৈশিষ্ট্য রবীন্দ্রনাথের প্রেমানুভূতিকে দারুণভাবে শাসন করেছে। ফলে প্রেমানুভূতির জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে নারীর প্রত্যক্ষ শারীরিক উপস্থিতির প্রয়োজন হয়নি। বরং নারীর শারীরিক উপস্থিতিকে তিনি প্রেমের অন্তরায় বলে মনে করতেন। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, কাঙ্ক্ষিত নারী যখন কল্পনা থেকে বাস্তবের মধ্যে চলে আসে, কল্পনার অসীম থেকে সংসারের সীমার মধ্যে চলে আসে, তখন প্রেম আর থাকে না। কারণ ‘অনন্ত আকাশের ফাঁক না পেলে বাঁশি বাজে না’। এ কারণে একসময় যে নারী ছিল সংসার-সীমার বাইরে কল্পনার মায়াঞ্জন মাখা, সে যখন সংসারের মধ্যে এসেছে তখন ওই নারী আবিষ্কার করেছে যে তাদের মধ্যে আগের সেই প্রেমের তীব্রতা নেই।   

ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য শিক্ষার হাত ধরে বাংলায় যে ‘আধুনিকতা’ প্রবেশ করে, তা ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির চিন্তাজগতে একটা ঘোরতর আলোড়ন তোলে। প্রেম-ভালোবাসার অনুভূতি যেহেতু জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, তাই স্বাভাবিক নিয়মেই এখানেও ইউরোপ-আগত প্রেমের ধারণা একটা বড়সড় ধাক্কা দেয়। বন্যার পানির মতো প্রেমের উচ্ছ্বাস আছড়ে পড়ে শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তের মনের দোরগোড়ায়। এই নতুন প্রেমের উচ্ছ্বাস কতটা প্রবল ছিল, তা নীরদচন্দ্র চৌধুরী তাঁর আত্মঘাতী বাঙালি বইয়ে সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাঙালি জীবনে ইউরোপ হইতে আনা “রোমান্টিক” প্রেম সেই যুগেই বাংলাদেশে বিলাত হইতে আনা নতুন গোলাপের মত ফুটিতে লাগিল।’ বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন এই নতুন গোলাপের প্রথম বাগানি। নীরদের ভাষায়, ‘বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালি জীবনে নূতন “রোমান্টিক” প্রেমের প্রবর্তক।’

এখন রবীন্দ্রনাথের প্রেমের ধারণার স্বাদ-গন্ধ দ্রুত চেখে নেওয়া যাক, যা শিক্ষিত ‘আধুনিক’ বাঙালি সমাজ শুধু সমকালে নয়, প্রায় সোয়া শতাব্দী ধরে ব্যবহার করছে নিজের প্রেমানুভূতিকে প্রকাশ করার জন্য।

রবীন্দ্রনাথের প্রেমচেতনার যে পরিচয় পাওয়া গেল, তা মূলত ইউরোপীয় রেনেসাঁসের চেতনায়¯স্নাত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই প্রেমের ধারণা এবং প্রকাশরীতি প্রায় সোয়া শতাব্দীব্যাপী শিক্ষিত বাঙালির প্রেমাবেগ প্রকাশের প্রধান উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং হচ্ছে। ভবিষ্যতেও রবীন্দ্রনাথ এই শ্রেণির প্রেমের অনুভূতি প্রকাশের বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হবেন—এমন ধারণা অমূলক নয়। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রেম সম্পর্কিত আবেগ আর ধারণার পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তমানতার সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথের পরে জীবনানন্দ দাশ এবং রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগের অপরাপর কবিদের ব্যবহারও কম হয়নি। কিন্তু এককভাবে রবীন্দ্রনাথের মধ্যেই বোধ করি বাঙালি তার প্রেমানুভূতির সবচেয়ে বেশি মিল খুঁজে পায়।

যত দিন পর্যন্ত না শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রেম সম্পর্কিত নিজস্ব নতুন ধারণা দাঁড় করাতে পারবে, প্রেমের নিজস্ব ভাষা দাঁড় করাতে না পারবে, তত দিন বাঙালির রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। কারণ রবীন্দ্রনাথের মতো প্রেমিক পুরুষ বোধ করি বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় নেই। তাঁর মতো সবল, সুস্থ, স্বতঃস্ফূর্ত, সূক্ষ্ম প্রেমের প্রকাশ আর কোনো কবির মধ্যে দেখা যায় না। তাঁর প্রেমভাবের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, এর সঙ্গে কবি গভীরভাবে লিপ্ত থাকেন; সপ্রাণতার সঙ্গে লিপ্ত থাকেন; নারীভাবে লিপ্ত থাকেন। এ কারণে রবীন্দ্রনাথের মানবপ্রেম, ঈশ্বরপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম, নারীপ্রেম সমান আবেগ আর আন্তরিকতায় রূপায়িত। রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিপ্রেমের যেকোনো কবিতাকে বা ঈশ্বরপ্রেমের যেকোনো কবিতাকে শিক্ষিত বাঙালি প্রেমিক তার প্রেমিকার উদ্দেশে নিবেদন করতে পারে এবং যুগে যুগে করেছেও তাই। এভাবে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ভুলভাবে কিন্তু অব্যর্থ উদ্দেশ্যে যুগ যুগ ধরে শিক্ষিত বাঙালি প্রেমিক হৃদয়ের অব্যক্ত কথাকে ব্যক্ত করে চলেছে।

রবীন্দ্রনাথ ‘দাতা’ হিসেবে উদার, দানে তার অতটুকু কৃপণতা নেই। সারাজীবন এতবেশি লিখেছেন, সব মানুষের ভেতর দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছেন যে, ভালোর বিপরীত যেমন মন্দ, কমের বিপরীত যেমন বেশি, আস্তিকের বিপরীত যেমন নাস্তিক উভয়পক্ষই চাইলেই তার কাছ থেকে গ্রহণ করতে পারছেন। একজন প্রগতিশীল যেমন তার কাছ থেকে নিজস্ব চিন্তার সঙ্গে মিলিয়ে গ্রহন করছেন, তেমনি একজন রক্ষনশীলও দান পাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথের বড় সফলতা বা বড় দূর্বলতা তিনি কাউকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেন না।

সমগ্র সাহিত্যকর্মের ভিত্তিতে রবীন্দ্রনাথ একজন নন, প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা। প্রথমত, তিনি পৃথিবীকে দিয়েছেন; দ্বিতীয়ত, ভারতবর্ষকে দিয়েছেন; তৃতীয়ত, বাঙালীকে দিয়েছেন। এভাবেই তিনি সার্বজনীন। এক একটা বছর যাচ্ছে, বয়স বাড়ছে রবীন্দ্রনাথের; আর প্রতিটি জন্মদিনেই নিজের সাহিত্যকর্মের জটিল দার্শনিক, সামাজিক, নৈতিক ও নীতিশাস্ত্রীয় সমস্যাদির ব্যাপারে নবদিগন্তের সূচনা স্মারক উপহার পাচ্ছেন তিনি। আমাদের রবীন্দ্রনাথকে আমরাই ভাঙছি-গড়ছি, প্রতিনিয়ত যুগের সঙ্গে মিলিয়ে নবায়ন করছি। কারণ, এই ভাঙা-গড়ায় নদী টিকে রয়লেখক টিকে রয়; এমনকি আমাদের এবং রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কও।

পল্লী উন্নয়নে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-ভাবনা কতটা সুগভীর ছিল, পরিষ্কার বোঝাপড়া ছিল তা নিচের উদ্বৃতিটি দেখলেই ধারণা করা সম্ভব। খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় অনেকখানি শোনাচ্ছি, ‘তোমরা যে পারো এবং যেখানে আরো এক-একটি গ্রামের ভার গ্রহণ করিয়া সেখানে গিয়া আশ্রয় লও। গ্রামগুলিকে ব্যবস্থাবদ্ধ করো। শিক্ষা দাও, কৃষিশিল্প ও গ্রামের ব্যবহার সামগ্রী সম্বন্ধে নূতন চেষ্টা প্রবর্তিত করো, গ্রামবাসীদের বাসস্থান যাহাতে পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যকর ও সুন্দর হয় তাহাদের মধ্যে সেই উৎসাহ সঞ্চার করো। এ কর্মে খ্যাতির আশা করিয়ো না। এমনকি, গ্রামবাসীদের নিকট হইতে কৃতজ্ঞতার পরিবর্তে বাধা ও অবিশ্বাস স্বীকার করিতে হইবে। ইহাতে কোনো উত্তেজনা নাই, কোনো বিরোধ নাই, কোনো ঘোষণা নাই, কেবল ধৈর্য এবং প্রেম, নিভৃতে তপস্বা- মনের মধ্যে কেবল এই একটিমাত্র পণ, দেশের মধ্যে সকলের চেয়ে যাহারা দুখী তাহাদের দুঃখের ভাগ লইয়া সেই দুঃখের মূলগত প্রতিকার সাধন করিতে সমস্ত সমর্পণ করিব। “

রবীন্দ্রনাথের এইসব কথাবার্তা আজকের এনজিওগুলোর গ্রাম উন্নয়ন কিংবা শোষণের ‘গাইডবুক’। রবীন্দ্রনাথ বোঝাতে চেয়েছেন, বাঙালির চেতনা জাতীয় কলেবরের সর্বত্র গিয়ে না পৌছানোর কারনে, বাঙালির সব চেষ্টা এক জায়গায় পুষ্ট ও অন্য জায়গায় ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। জনসমাজের সঙ্গে শিক্ষিত সমাজের বিচ্ছেদকে জাতির ঐক্যবোধের ভাঙনের জন্য তিনি দায়ী করছেন। হিতসাধন মণ্ডলীর প্রথম সভাধিবেশনের বক্তৃতায়  তিনি বলছেন, ‘আমাদের অন্তরের রাজাকে আমরা শ্রদ্ধা করি না বলেই তিনি রাজত্ব করতে পারছেন না। ফলে আমাদের আত্মশক্তি ও আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছে।’

বর্তমান নাগরিক জীবনের ফ্ল্যাট সংস্কৃতির প্রবণতাগুলো রবীন্দ্রনাথ তখনি ধরতে পেরেছিলেন। তাই মানব সম্পর্ক উন্নয়নে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘আমরা পাশের লোককেও আত্মীয় বলে অনুভব করি না, পরিবার পরিজনের মধ্যেই প্রধানত আমাদের আনন্দ ও সহযোগিতা, সেই পরিধির বাইরে আমাদের চেতনা অস্পষ্ট। এজন্যই আমাদের দেশে দুঃখ, মৃত্যু, অজ্ঞান, দারিদ্র্য।’

রবীন্দ্রনাথ অন্তত পরিবারে যে সম্পর্কের চর্চা দেখতে পেয়েছিলেন, আজ তো তাও নেই, নাগরিক সম্পর্কগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। হিতসাধন মণ্ডলীর সভায় রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় বর্তমান বাংলা সাহিত্যের আমদানীতে তত্ত্বের ক্ষতির দিক নিয়ে বলে রেখেছেন। তিনি বলছেন, ‘যৌবনের আরম্ভে যখন বিশ্ব সম্বন্ধে আমাদের অভিজ্ঞতা অল্প অথচ আমাদের শক্তি উদ্যত, তখন আমরা নানা বৃথা অনুকরণ করি, নানা বাড়াবাড়িতে প্রবৃত্ত হই। তখন আমরা পথও চিনিনে, ক্ষেত্রও চিনিনে, অথচ ছুটে চলবার তেজ সামলাতে পারিনে।’

আবার একাডেমিক শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি চিহ্নিত করে তিনি মত প্রকাশ করেছেন,‘আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা বিষয় শিক্ষা। আমরা নোট নিয়েছি, মুখস্ত করেছি, পাস করেছি, বসন্তের দক্ষিণ হাওয়ার মতো আমাদের শিক্ষা মনুষ্যত্বের কুঞ্জে কুঞ্জে নতুন পাতা ধরিয়া ফুল ফুটিয়ে তুলছে না। অর্থাৎ এ শিক্ষায় আত্মপ্রকাশের আনন্দময় উপায় উপকরণ নেই।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেছিলেন আজ থেকে একশ সাতান্ন বছর পূর্বে। তাঁর জীবনের অর্ধেকটা কেটেছে উনিশ শতকে, বাকি অর্ধেক বিশ শতকে। এখন আমাদের মাথার উপর দিয়ে বইছে একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের হাওয়া। পৃথিবীজুড়ে কত পরিবর্তনই না ঘটেছে বিগত দেড়শ বছরে। তবু রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে থেকে গেছেন, হয়ে উঠেছেন নির্ভর এক আশ্রয়, অফুরান এক আশ্বাস। আজকে আমরা কেন্দ্র-প্রান্তের কথা বলি, কামনা করি প্রান্তের অভ্যুত্থান-শর্তবর্ষ পূর্বে শিলাইদহ-সাজাদপুর-পতিসর জীবনে সে কাজটাই করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। আমরা আন্তর্জাতিক চেতনার কথা বলি, বিসর্জন দিতে চাই জাতিক চেতনা। রবীন্দ্রনাথ শিখিয়েছেন, জাতিক না হলে আন্তর্জাতিক হওয়া যায় না। লন্ডন থেকে ফিরে এসে রবীন্দ্রনাথ শিকড় সঞ্চার করেছেন শিলাইদহ-সাজাদপুর-পতিসর-শ্রীনিকেতনের মৃত্তিকায়- একালে আমরা প্রান্তের শিকড় উন্মূলিত করে বাসা বাঁধতে চাই কেন্দ্রে। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে একাশে আমরা বৃদ্ধি করে চলেছি কংক্রিট-সভ্যতা, অথচ সোয়াশো’ বছর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ নাটক।

সাহিত্যের নানা আঙ্গিক বা ফর্ম ভেঙে একালে যে ভাবনা উচ্চারিত হয়, রবীন্দ্রনাথের রচনায় শত বর্ষ পূর্বে আমরা পাই সেই কর্মহীনতার ধারণা। তাঁর নাটকে আছে সঙ্গীত ও নৃত্যের খেলা। তাঁর ছোটগল্পে, কবিতায় আছে নাটকের ব্যঞ্জনা। রবীন্দ্রনাথের অনেক ছোটগল্পই তো নাটকের এক একটা অসমাপ্ত টেক্সট। তাঁর উত্তরপর্বের কবিতাতে আছে চিত্রশিল্পীর তুলির টান, আছে ছোটগাল্পিকের প্রতিভার স্পর্শ।

শান্তিনিকেতনে থাকাকালেই অল্প কয়েক বছরের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যাকে হারান। তাঁর পিতৃবিয়োগও ঘটে ১৯০৫ সালে।

এসবের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে পড়েছিলেন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক লর্ড কার্জন যখন দেখলেন বাঙালিরা স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, তখন তারা ওই আন্দোলন রুখতে সিদ্ধান্ত নিলেন বাংলাকে দুভাগে ভাগ করে দিতে। এর প্রতিবাদে যে রাজনৈতিক আন্দোলন দানা বেঁধেছিল, তার পুরোভাগে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ব্রিটিশ সরকারের ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বাংলার নেতারা ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের ডাক দিলেন। রবীন্দ্রনাথ তখন শাসকগোষ্ঠির বিরুদ্ধে কলম ধরে যে গানগুলো লিখেছিলেন, তা তখন এক অভিনব উন্মাদনা তৈরি করেছিল।

তবে স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বেশিদিন প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকেননি। রাজনৈতিক নেতারা উত্তেজনাপূর্ণ আন্দোলন-সর্বস্ব, গঠননীতি-বর্জিত যে পথ বেছে নিয়েছিলেন তা তিনি সমর্থন করেননি। কিন্তু তাঁর কিছু কিছু জীবনীকার লিখেছেন রাজনৈতিক আন্দোলনে তাঁর সায় না থাকলেও, যেহেতু তাঁর মন জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ ছিল এবং তিনি ছিলেন খুবই সংবেদনশীল, তাই বিদেশি শাসকরা বড় রকম অন্যায় করছে দেখলে তিনি চুপ করে থাকতে পারতেন না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন প্রথম অ-ইউরোপীয় যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯১৩ সালে। তাঁর কাব্যগ্রন্থ 'গীতাঞ্জলি'র ইংরেজি অনুবাদের জন্য সুইডিশ অ্যাকাডেমি তাঁকে নোবেল পুরস্কার দিয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ছিল তার ভাবগভীরতায়। তাঁর সাহিত্যে বিশ্বপ্রেম ও মানবপ্রেমের পাশাপাশি প্রকৃতিপ্রেম, রোমান্টিক সৌন্দর্যচেতনা আর প্রগতিবোধ প্রকাশ পেয়েছে। কথা সাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্বন্ধেও তাঁর মতামত তুলে ধরেছিলেন।

সমাজকল্যাণ, গ্রাম উন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র মানুষের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার পক্ষে তিনি সোচ্চার ছিলেন। শান্তিনিকেতনের কাছে সুরুল গ্রামে আমেরিকান কৃষি অর্থনীতিবিদ লেনার্ড এলমহার্স্ট এবং শান্তিনিকেতনের শিক্ষক ও ছাত্রদের সহযোগিতায় তিনি গড়ে তুলেছিলেন শ্রীনিকেতন নামে পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্র।

একালে আমরা বৃক্ষরোপণের কথা বলি, পরিবেশের কথা বলি অথচ শতবর্ষ পূর্বে রবীন্দ্রনাথ উড়িয়েছেন মরু-বিজয়ের কেতন। পরিবেশ রক্ষার জন্য আমরা একালে যে বৃক্ষরোপণের কথা বলি, সেই ‘বৃক্ষরোপণ’ শব্দটাও রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি। শিক্ষাকে রবীন্দ্রনাথ বিবেচনা করেছেন মানব-উন্নয়নের প্রযুক্তি হিসেবে, আমরা আজ শিক্ষাকে বানিয়েছি পণ্য। যে ক্ষুদ্র ঋণের কথা আজ পৃথিবীজুড়ে উচ্চারিত, তার প্রাথমিক ধারণা তো রবীন্দ্রনাথের কাছেই আমরা পাই। কৃষিব্যাংক প্রতিষ্ঠা, জলসেচ ভাবনা, পল্লি-উন্নয়ন কার্যক্রম-  কতভাবেই তো রবীন্দ্রনাথ নিয়ত আমাদের প্রভাবিত করে চলেছেন, প্রভাবিত ও প্রাণিত হতে আমাদের আহ্বান জানাচ্ছেন। আমাদের চিত্তলোকে দুঃখ সৃজন আর শুশ্রুষা প্রদানে রবীন্দ্রনাথের গান তো অবিরাম কাজ করে চলেছে। তাঁর সমান উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড, তাঁর দর্শন, তাঁর ভাবনা, তাঁর চিঠিপত্র- কোন দিকটা বাদ দিয়ে চলে আমাদের একদিন? কোনো বাঙালি কি রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে কাটাতে পারেন পূর্ণ একটা দিন? এমন কোন বাঙালি লেখক আছেন, যিনি রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার অতিক্রম করে, কিংবা তাঁর প্রভাব বলয়ের বাইরে থেকে সাহিত্যচর্চা করেন? নামের মধ্যেই আছে ওই প্রভাবের সূত্র। সূর্যকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় নক্ষত্রপুঞ্জ, বাংলা সাহিত্যের উত্তরকালীন লেখকেরাও রবীন্দ্রনাথ নামক সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেই হয়ে উঠেছেন এক একজন নবীন নক্ষত্র।

এপ্রিল ৪, ২০২০

কপিরাইট ইন্দ্রাণী সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন