পৃথিবীর সংকট ও বিশ্বমানবতা বোধে রবীন্দ্র ভাবনা * কাকলি ভট্টাচার্য



পৃথিবীর সংকট ও বিশ্বমানবতা বোধে রবীন্দ্র ভাবনা

একবার একটি দেশাত্মবোধক নাটকের  মহড়া দিচ্ছি -- সে সময় মনে হোল রবীন্দ্রনাথের একটি গান হলে বেশ হতো-- আমার সেই সময়কার এক প্রিয় বন্ধু ও নাট্যকর্মী বলল " নিশিদিন ভরসা রাখিস হবেই হবে - ওরে মন হবেই হবে" গানটির কথা। সবাই মিলে একসঙ্গে গাইলাম গানটি -- এতটাই মনে দাগ কেটেছিল বার বার সেই বন্ধুকে বিরক্ত করতাম সেই গান টি শোনানোর জন্য। আসলে তখন বুঝিনি গানটি ভরসার /উদ্দীপনার / জোট বেঁধে এগিয়ে চলার গান। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় কার্ত্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত এই গানটি বঙ্গচ্ছেদ  আন্দোলন দিয়ে দেশময় যে উত্তেজনা তারই পরিপ্রেক্ষিতে রচিত হয়েছিল ।

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটি অভিযোগ প্রায়ই শোনা যেত। " রবীন্দ্রনাথ যতটা আন্তর্জাতিক ততটা স্বাদেশিক নন," তাঁর কারন সম্ভবত এই যে, সমগ্র রচনা কর্মে, কবিতায় ও গানে স্বাদেশিক হিসেবে বিশেষ চিহ্নিত হতে পারে এমন সৃষ্টির সংখ্যা তাঁর খুব বেশি নয়।  এই জন্য তাঁর দীর্ঘ জীবনের স্বল্প একটি পর্যায়েই তাঁর এই স্বাদেশিক আচরন  অথবা  " এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে ',  "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে", অথবা বাংলার মাটি বাংলার জল' ইত্যাদি সংগীত এর সৃষ্টি লক্ষ্য করা যায়।  তবু বলব স্বাদেশিকতার বোধ  রবীন্দ্রনাথের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় ছিল, প্রকৃত অর্থেই ছিল। তাঁর স্বাদেশিকতায় স্বদেশপ্রীতি আছে, স্বাজাত্য বোধের অপদার্থ অহংকার নেই।হিন্দু মুসলমানের সম্প্রীতির সঠিক উৎস তিনিই আবিস্কার করতে পারেন গভীর আন্তরিকতায়। হিন্দু বিস্ববিদ্যালয় স্থাপনের গুরুত্ব বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতে পারেন যাবতীয় সংস্কার ঝেড়ে ফেলে। তুলনা দিতে গেলে রবীন্দ্রনাথের গোরা  উপন্যাস কেই স্মরন করতে হবে। যেখানে উপন্যাসের নায়ক উগ্র স্বাজাত্য বোধ থেকে শেষপর্যন্ত উপনীত হয়েছিল পরিনত বিশ্ব বোধে।

 সাল ১৯৩৭। জাপানের চিন আক্রমন দিয়ে শুরু।তারপর থেকে মহড়া আর মহড়া। প্রস্তুতি আর প্রস্তুতি। "মানবসমাজে এই কাঁটার বেড়া দেওয়া অনাতিথ্যের অনাত্মীয়তা যে ক্রমশ প্রবর্ধমান  অসভ্যতার প্রমান রূপে কুশ্রী হয়ে উঠল, অসংকোচে মানুষ সেকথা ভুলে যাচ্ছে" -রবীন্দ্রনাথ পৌষ উৎসবের ভাষণে এসব কথা বললেন। জাপানি আক্রমনের উপলক্ষ্যে যেমন বুদ্ধদেব কে পূজা করার নামে নির্লজ্জ কুশ্রীতার প্রদর্শন ঘটেছিল,বিশ্বযুদ্ধেও তেমনি নরহুত্যার ব্যাপক আয়োজনে দেবতার আশীর্বাদ ভিক্ষা চলছে। এই কাপট্য ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধেই লেখা হোল অসাধারণ একটি সংগীত। শ্লেষ বিজরিত, বেদনাসংব্রিত আমন গান এক দুর্লভ প্রাপ্তি।

"একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে
রাজার দোহাই দিয়ে
এ যুগে তারাই জন্ম নিয়েছে আজি,
মন্দিরে তারা এসেছে ভক্ত সাজি-- ঘাতক সৈন্যে ডাকি
মারো মারো ওঠে হাঁকি ।
গর্জনে মিশে পুজামন্ত্রের স্বর -
মানবপুত্র তীব্র ব্যাথায় কহেন, হে ঈশ্বর
এ পানপাত্র নিদারুণ বিষে ভরা
দূরে ফেলে দাও, দূরে ফেলে দাও ত্বরা।
(২৫ দিসেম্বর,১৯৩৯)

রবীন্দ্রনাথের বিস্বমানবতার উজ্জ্বল প্রতিভু হয়ে আছে ' পরিশোধ' নাট্য গীতি এবং শ্যামা নৃত্য নাট্যের একটি গান। গানটি রাজনর্তকী শ্যামার সহচরীর কণ্ঠে শোনা যায়। এটি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ গীতি। আবার নাট্য নিরপেক্ষ ভাবে গানটি কবির বিশ্ব মানবতারই দ্যোতক। নিষ্ঠুর অমানবিক শাসন ও শোষণের বিপ্রতীপে বন্ধনমুক্তির আহ্বান দিয়েই গানটির সুচনা। নিঃসহায়ের অশ্রু মুছিয়ে দেবার মানবিক ব্রত পালনে আগুয়ান হবে কে-- এ প্রশ্ন প্রবল হয়ে ধ্বনিত হয়েছে।

"আর্তের ক্রন্দনে হেরো ব্যাথিত বসুন্ধরা
অন্যায়ের আক্রমনে বিষ বানে জর্জরা--
প্রবলের উৎপীড়নে
কে বাঁচাবে দুর্বলেরে ।
অপমানিতেরে কার দয়া বক্ষে লবে ডেকে।"

এই গানে তিনি ধনতান্ত্রিক শোষণ- পীড়ন- দমনের স্বরূপ 'আর্তের ক্রন্দনে' ব্যাথিত বসুন্ধরাকে বিকৃত  দেখিয়েছেন। শুধু গানে নয় ঘরে বাইরে উপন্যাসেও নিখিলেশ বলেছে যে ছোট রাস্তা থেকে বড় রাস্তায় যাওয়ার মাঝখানে আছে ঝড়ো রাস্তা ওই ঝোড়ো রাস্তাটাই তো সভ্যতার সংকট।  'লিপিকা'র" কর্তার ভূত পড়লে একমাত্রিক মানুষ অধ্যুষিত কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রন চালিত আধুনিক পৃথিবীর ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে আপাতত স্বচ্ছলতার খুড়োর কল ঝুলিয়ে মানুষকে ফোঁপরা করে দেওয়া হয়। এ গল্পে আছে --" এখানে দেশসুদ্ধ লোক ভূতগ্রস্ত হয়ে ছখ বুজে চলে। এই জেলখানায় যে ঘানি নিরন্তর ঘোরাতে হয় তার থেকে এক ছটাক তেল বেরোয় না যা হাটে বিকোতে পারে। বেরোবার মধ্যে বেরিয়ে যায় মানুষের তেজ। সে তেজ বেরিয়ে গেলে মানুষ ঠাণ্ডা হয়ে যায়। তাতে করে ভুতের রাজত্বে আর কিছুই না থাক ।। অন্ন হোক বস্ত্র হোক স্বাস্থ্য হোক--- শান্তি থাকে। কত যে শান্তি তাঁর একটা দৃষ্টান্ত এই যে অন্য সব দেশে ভুতের বাড়াবাড়ি হলেই মানুষ অস্থির হয়ে ওঝার  খোঁজ করে এখানে সে চিন্তাই নেই। কেননা ওঝাকেই আগে ভাগে ভুতে পেয়ে বসেছে।

রক্তকরবী নাটকে সংখ্যার দ্বারা  চেনানো হয় সবকিছু। মুক্ত অর্থনীতিতে  সংখ্যা দিয়েই সবকিছু বিচার্য। রক্তকরবী নাটকে বিশু বলেছে " যক্ষ পুরিতে ঢুকে অবধি এতকাল মনে হোতো, জীবন হতে আমার আকাশখানা হারিয়ে ফেলেছি। মনে হত এখাঙ্কার টুকরো মানুষদের সঙ্গে আমারে এক ঢেঁকিতে কুটে একটা পিণ্ড পাকিয়ে তুলেছে।" এখনও বাজার বিপণন সভ্যতা সমস্ত মানুষকে এক ছাঁচে ফেলার প্রচেষ্টায় আছে হয়ত সফল ও হচ্ছে।   বাংলাদেশে যখন তুর্কী আক্রমন ছিল জনজীবনে আকস্মিক এক অভিঘাত। কিন্তু সেই সময় যা কিছু সুফল দেখা দিয়েছিল-- তার মধ্যে ছিল -- হিন্দু মুসলমান ভেদাভেদ ভুলে যাওয়া, ব্রাহ্মণ- এবং শূদ্র অথবা নিচু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ধর্মভাবের একাত্মতা। উদাহরন স্বরূপ -- হিন্দুদের সত্যনারায়ন ও মুসলমানদের পিরবাবা মিলে গিয়ে সত্যপীরের উৎপত্তি, আবার উচ্চবর্ণের মানুষের পূজিত ছিলেন দেবী দুর্গা  । পরবর্তীতে দেবী চণ্ডী যিনি ছিলেন নিম্ন বর্গীয় মানুষদের দেবী তিনি শিব বা মহাদেবের স্ত্রী হিসেবে পূজিত হতে লাগ্লেন এবং মনসা কে শিবের কন্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হোল। এই লোকায়ত কাহিনির উল্লেখ করলাম এই কারনে-- এ সবই ছিল তুর্কী রাজাদের শোষণের বিরুদ্ধে একত্রিত হবার প্রয়াস। এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত ধর্মীয় নানা অশান্তিতে ভারতবর্ষ জ্বলছিল দাউদাউ করে-- কিন্তু পূর্ববর্তী বিশ্বযুদ্ধ গুলির মতই যখন করোনা ভাইরাস তার জাল বিছিয়ে মৃত্যু মিছিলের নৃশংসতা বিস্তার করলো তখন কোথায় জাতিভেদ? কোথায় বা ধর্মভেদ  মানুষ কেবল বেরিয়ে আসতে চাইছে সবকিছুর খোলস ছেড়ে... সেই আদিম যুগের নামহীন, গোত্রহীন এক  নিশ্চিন্ত জীবন চাইছে আজকের আধুনিক মানুষেরা। শুধু বাঁচার আকুলতা তাদের চোখে - মুখে। আসলে যখনি অহংকার প্রবল হয়ে ওঠে যেকোনো ক্ষেত্রে, তখনই প্রবল এক আঘাত নেমে আসে বজ্রের মতো। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে কালে কালে দেশে দেশে আমরা তা লক্ষ্য করেছি। আমাদের তরুন প্রজন্ম বিলাস বৈভবের টানে অসততার পথে এগিয়ে চলেছে দ্রুত। নীতি নয়, সৌন্দর্য নয়, মাধুর্য নয়, উচ্ছ্রিখল বহির্মুখী, জীবন তাদের যৌবন কে ক্ষয় করে দিচ্ছে। হিংস্রতা তাদের নিত্যসঙ্গী, মিথ্যা হল তাদের প্রতিমুহূর্তের আচরন। তাহলে কি অন্ধকারে নিমজ্জনই আমাদের বিশ্বসভ্যতার পরিনাম? না আজও আমরা উঠে আসতে পারি রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে যিনি আমাদের সব বয়সের বন্ধু ও আশ্রয়। তাঁর কাছেই আছে আজকের রুগ্ন পৃথিবীকে সেবা দিয়ে যত্ন দিয়ে বাঁচিয়ে তোলার মন্ত্র। আজ যদি স্মরন করতে পারি রবীন্দ্রনাথের সে কথা----

' দুঃখেরে দেখেছি নিত্য পাপেরে দেখেছি নানা ছলে
অশান্তির ঘূর্ণি দেখি জীবনের স্রোতে পলে পলে।
মৃত্যু করে লুকোচুরি
সমস্ত পৃথিবী জুড়ি
তারপরে দাঁড়াও সম্মুখে
বল অকম্পিত বুকে--
তোরে নাহি ভয়
এই সংসারে প্রতিদিন তোরে করিয়াছি জয়।"

কপিরাইট ডঃ কাকলি ভট্টাচার্য কর্তৃক সংরক্ষিত

তথ্যসুত্র - ১) বিশ্ব যুদ্ধ সম্পর্কে অমিয় চক্রবর্তী কে লেখা খোলা চিঠি, চিঠিপত্র, খন্দ ১১, পৃষ্ঠা - ৩২৮
             ২) সভ্যতার সংকট , জন্মশতবার্ষিকী সংস্করন রবীন্দ্র রচনাবলী, পৃষ্ঠা - ৪১০ 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন