জীবন জুড়ে রবীন্দ্রনাথ * আবদুস সালাম



জীবন জুড়ে
রবীন্দ্রনাথ
                                                                   
একবিংশ শতাব্দীতে চলছে বিশ্বায়নের বিশ্বগ্রাসী আর্তনাদ । ধর্মীয় মৌলবাদীর বিষাক্ত নিশ্বাস । রক্তাত্ত অন্ধকার আমাদের গিলে নিতে চাইছে প্রতিনিয়ত । ধর্ষিত হচ্ছে মানবিকতা । অশুভ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আসকারা পেয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ধর্মীয় মৌলবাদ । একদিকে ক্ষমতা অন্যদিকে তথা কথিত ধর্মগুরুদের ধর্মীয় দাপট । মানুষ আজ দিশেহারা ।

পার্থিব্য সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের ডানায় ভর দিয়ে মানুষ এখন পাল্লা দিতে ব্যস্ত । অর্থৈ সমুদ্রের লোনা জল থেকে উদ্ধারের নিমিত্তে আমৃত্যু ছুটে চলা । প্রতিযোগীতার দূরন্ত ঢেউ এর দাপটে ক্রমশঃ আমরা হয়ে পড়ছি বিচ্ছিন্ন । জীবন মুখী উৎকট আবহাওয়া বয়ে চলেছে আমাদের সমাজ জীবনে । উৎকট আবহাওয়া সাবেকি মূল্যবোধের ধ্যান ধা   রনা মুখ থুবড়ে পড়েছে । ভালোমন্দের ঘাত প্রতিঘাতে মানবিকতার কোন ঠাঁয় নেই । বিশ্বায়নের বিশ্বগ্রাসী দানবীয় এাস আর মৌলবাদীর বিষাক্ত রক্তে ভেসে যাচ্ছে আমাদের মানবতা । মানবিকতার পতাকা উড়ে যাচ্ছে মৌলবাদী ঝড়ে । মাথা তুলে দাঁড়াতে গেলেই দুমড়ে মুচড়ে অস্তিও্বহীন করে দিচ্ছে অশুভ চক্রান্তের কালো তপ্ত নিশ্বাস । দেশে দেশে ভুলুন্ঠিত হয়ে চলেছে মানবিক মূল্যবোধ । ক্ষমতার লোভে চাতুরতায় অন্ধ হয়ে সাম্প্রদায়ীকতাকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে।

মানুষ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় জেনে গেছে বর্তমান সমাজ ব্যবস্হা কখনই স্বেচ্ছায় সুখ শান্তির চাবিকাঠি সাধারন মানুষের হাতে তুলে দিবেনা । সব কিছুই নিজের ক্ষমতার জোরে অর্জন করতে হবে ।প্রয়োজন যেহেতু আমরা সেই হেতু তা আদায় করার দায় ও আমর । জীবন মুখী প্রতিযোগীতায় কঠিন ও অনৈতিক সোপানগুলি পরপর টপকাতে হয় । এখানে পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন কেউ কারো নয় । সহজাত সমবেদনার কোন স্হান এখানে নাই । মনুষ্যত্ব ও মূল্যবোধ কে যে ধাক্কা মেরে পার করে দিতে পারবে সে ততই আধুনিক । দেশ বিদেশের ইতিহাস অন্বেষণ করলে আমরা দেখতে পাই নিম্ন বর্গের আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্হিতি কিভাবে দলিত মথিত ও পদদলিত হয়ে চলেছে উচ্চবর্ণের লোকে দের দ্বারা । নিম্নবর্গের জাতিয়তা বোধ, ধর্ম চেতনা, দৈব শক্তি, আদিম বিশ্বাস, এগুলো সবই অলৌকিক এিয়া কল্পানা দ্বারা চালিত । তথা কথিত সম্ভ্রান্ত মানুষেরা নিম্নবর্গের লোকেদের অযথা হয়রানি করতে দ্বিধা করেনা । নিম্নবর্গের লোকেদের অবজ্ঞা করা, গুরুবাদ, আধ্যাত্মিকতা, তন্ত্রমতে বিশ্বাস, সীমাহীন সংস্কারের বোঝা মথায় নিয়ে তাদের জীবনাতিপাত করতে হয় – Dr M.N Srinivas বলেন If and  when cast disappears from India “ Hinduism will also disappear from India.
       
১৯৯২ এর ডিসেম্বর এর পর থেকে ভারতের রাজনীতিতে বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয় । ১৯৯৩ সালে জঙ্গী পতাকাবাহী রাষ্ট্রিয় স্বয়ং সেবক সংঘের নেতা গিরি লাল জৈন “নকল সেকুলারিজম” প্রবন্ধে বলেছেন আমি বিশ্বাস করি এই মেরুকরণ এবং নানা অছিলায় বাধিয়ে তোলা হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, পরিবর্তন আনার সংগ্রামের একটি অঙ্গ । এটা এই সংগ্রামের সৃষ্টি” । সামাজিক প্রভেদ সৃষ্টি করার জন্য উস্কানি মূলক বিবৃতি সাধারন মানুষ কে ভ্রান্তির জালে আবদ্ধ করে চলেছে প্রতি নিয়ত । চারিদিকে যখন ভেদাভেদের রাজনীতির আস্ফালন এই সময় শান্তির পরশ যে অতীব প্রয়োজন তা কবিগুরু উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন । আজ দেড়শত বৎসর পেরিয়েও কবিগুরুর দার্শনিক চিন্তা ধারা প্রাসঙ্গিক বলে আমাদের মনের মনিকোঠায় আজও তিনি বিদ্যমান । তাঁর দেশাত্মবোধক চিন্তাধারা আজও আমাদের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ । তিনি চেয়েছিলেন “চিও যেথা ভয় শূন্য উচ্চ যেথা শির” । তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে কোন দিন ভারতবর্ষ অশান্ত হয়ে উঠতে পারে । চিও যদি ভয় শূন্য না হয় তবে স্বাধীন চিন্তাধারা কোন দিনই বিকশিত হতে পারবেনা । আজ বিভেদ কামী একটা দল ছড়াচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিষ । গুরুদেব সবসময় বলে গেছেন আন্তর্জাতিক ভাতৃও্ববোধের কথা আমরা আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে তার প্রকাশ দেখি । সারা ভারতবর্ষকে তিনি একসূএে বাঁধতে চেয়েছিলেন । “ জনগন মন অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্য বিধাতা” । আর এক ছএে বলেছেন “পাজ্ঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মারাঠা / দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ” । আমার সোনার বাংলা আমি তোমাকে ভালোবাসি।

তিনি সাম্প্রদায়িকতার নিশ্বাসে শান্তির বানী যে বাতুলতা মাএ তা বুঝে লিখেছেন “নাগিনীরা ফেলিতেছে নিশ্বাস / শান্তির লালিত বানী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস” । তিনি তার লেখায় সার্বজনীনতার কথা তুলে ধরেছেন বারবার । আজ ভরতের এই অশান্ত পরিবেশে তার গান, কবিতা, ছোটগল্প প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে বাঙালী জীবন ধারায় । দেড়শো বছরের ও বেশীর ভাগ সময় তিনি প্রাসঙ্গিক ।

লোকো সঙ্গীতের অঙ্গ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ আমাদের মনের মনি কৌঠাই ঠাঁই করে নিয়েছেন । আমাদের চলমান জীবন যেখানে শুরু আর যেখানে শেষ সবখানেই উপস্হিত হয়ে আমাদের চলার পথে যুগিয়েছেন নিত্য নতুন দিশা ।
             
নিত্য তোমার যে ফুল ফোঁটে ফুলবনে”

প্রথমিক স্কুলে সহজপাঠ আমাদের পড়তেই হয় । এখানে যে সকল কবিতার কিছু কিছু লাইন Reference Point হিসাবে আমরা মেনে চলি এবং তা আজও প্রাসঙ্গিক ।
 আমরা মাথা নত করে দাও হে তোমার”............

রবীন্দ্রনাথ শুধুই রবীন্দ্রনাথ নন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠান । কবিগুরুর ভারততীর্থ কবিতা পড়লে আমাদের চোখ খুলে যায় । তিনি যে একটি প্রতিষ্ঠান তা আমরা অস্বীকার করতে পারিনা । এই কবিতায় সমগ্র ভারত কে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরতে পারি । তাই অশান্ত ভারত বর্ষে তিনি আজ আমাদের মনে প্রলেপ দিতে পারেন । আজ ও তিনি প্রাসঙ্গিক ।

আমরা যদি রবীন্দ্র চর্চায় ফিরে যায় তবে আমাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবেই । নিষ্ঠুর সামরিক শাসন ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে তিনি গর্জে উঠেছেন বারংবার । বিপ্লবীদের পাশে চিন্তনে ও সিদ্ধান্ত গ্রহনে কর্মসম্পাদনায় সঠিক নির্দেশনা দিয়েছেন বারংবার । কবিগুরুর সিদ্ধান্ত এবং উপদেশ অশান্ত ভারত বর্ষে আজ ও তা প্রসঙ্গিক । ধর্মীয় মৌলবাদের বাড় বাড়ন্ত চলছে আজ ।
ভগবান তব দূত পাঠায়েছে বারে বারে” ।।
               
হিন্দু মুসলমান কে নিয়ে যে বিভ্রান্ত মূলক ইতিহাস রচনা করেছেন কিছু বিজ্ঞ কুলাঙ্গার তার খেসারত আমরা গুনে চলেছি স্বাধীনতার ৭৩ বৎসর ধরে । দুই ধর্মের সহবস্হান কে বিষিয়ে দিয়ে পবিএ ভারত ভূমি টুকরো টুকরো হয়ে গেছে । এর নীরব দহন আমরা মাথা পেতে সহ্য করে চলেছি । অশান্ত সময়ে তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন  “ জনগন মন অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্য বিধাতা”

আমরা যদি হত ভাগা হই তবে হিন্দু মুসলিম যৌথ সংস্কৃতিকে গুঁড়িয়ে দিতে চায় তো আলাদা কথা । কিন্তু যদি আমরা আমাদের দেশকে শান্তি পূর্ণ সহবস্হসনে দেখার চিন্তা করি তবে আমরা রবীন্দ্র আদর্শে দীক্ষা নিতে পারি । তাই রবীন্দ্রনাথ এই অশান্ত আবহাওয়াই সুষ্ঠ ভাবে বেঁচে থাকার যে প্রেরণা আমাদের যুগিয়ে চলেছেন দেড়শত বৎসর তা এই একবিংশ শতাব্দীর আজও তিনি প্রসঙ্গিক । আমাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক । আমরা যেন বেশী বেশী করে রবীন্দ্র আলোচনায় মগ্ন হই । তিনি উদাও কন্ঠে বলে গেছেন “ এই ভারতের মহা মানবের সাগর তীরে “ । তাঁর জীবদ্দশায় শান্তিনিকেতনে দেওয়া একটি ভাষনে তিনি বলেন “ জাতীয়তাকে আমরা পরম পদার্থ বলে পূজা করিনে এইটেই হচ্ছে আমাদের জাতীয়তা “ । মিশ্র সংস্কৃতির দেশ ভারত । আন্তজাতিক প্রেক্ষাপটে ভারতের অবস্হান অতে উচ্চে । এখানে পরিবার, গোষ্ঠি, ধর্ম, জাতি কোনটায় তাকে ক্ষুদ্রতার মাঝে বেঁধে রাখতে পারেনি । তিনি বার বার ক্ষুদ্রতার অর্গল ভেঙে বৃহওর বিশ্বের কাছে ভারতের অবস্হান তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন । তিনি ব্যাক্তিগত জীবনের দুঃখ-যন্ত্রনা শোক দেশ ও জাতির ব্যর্থতা-কে যেমন তীব্র কটাক্ষ করেছেন তেমনি আবার বৃহত্তর স্বার্থে বিশ্বমানবের জন্য প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন ।
               নারী মুক্তি ও স্বাধিকার ঘোষনা করলেন সবলা কবিতায়
               নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেহ নাহি দিবে অধিকার                 
                 হে বিধাতা “
১৯০৫ সালে ১৬ ই অক্টোবর বঙ্গ ভঙ্গ হলে শুরু হলো ব্রিটিশ পন্য বর্জন বাঙালি হিন্দু মুসলিম যে ভাই ভাই ভাব স্পষ্ট করতে রাখী বন্ধন উৎসব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন-
          বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান
                    তুমি কি এমনি শক্তিমান-
            যুবকেরা গাইলো-
                 যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে
                        তবে একলা চল রে ।। “
সেদিন ও অগ্নি মন্দে দীক্ষিত জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিও ভাবনাহীন-
             স্বার্থক জনম আমার
                  জন্মেছি এই দেশে-  
ভারতের কতকগুলি বিশেষ সংস্কার ও লোকাচারের মধ্যে স্বজাত্যের অভিমানকে সীমাবদ্ধ ও অতুগ্র করে তোলার পশ্চাতে তিনি ন্যাশনাল শিক্ষা করতে রাজী নন ।

                   লোকসাহিত্যের প্রতি আনুগত্য কবিকে চিরকাল মনে রাখবে । বিশ্বব্যাপি লোকসংস্কৃতির যে বিকাশ চলেছে তাকে তরান্বিত করার ক্ষেএে কবিগুরুর অবদান অনস্বীকার্য । তিনি যদি লোকসংস্কৃতি নিয়ে প্রবন্ধ লিখে নেটিজনদের উপহার না দিতেন তবে লোকসঙ্গিত উন্নাসিকতায় পৃথক হয়ে থাকতো । তিনি বলতেন শুধুই আন্দোলন, অসহযোগীতা করে কিছুই হবেনা দেশের অন্তকরণকে সকল দিক থেকে পূর্ণ উদ্যমে কাজে লাগাতে হবে ।।

    অচ্ছ্যুৎদের সরিয়ে ফেললে দেশ যে আগাবেনা তা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই লিখলেন “দুর্ভাগা-দেশ”
          হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান
                অপমান হতে হবে তাদের সমান” ।
আবার বলছেন-
          যারে তুমি নিচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে
           পশ্চাতে রেখেছ যাবে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে” ।
হোক ভারত জয় কবিতায় লিখলেন –
             এসো এসো ভাতৃগর্ণ ! সরল অন্তরে
                  সরল প্রীতির ভরে
                 সবে মিলি পরস্পরে
               আলিঙ্গন করি আজ বহুদিন পরে” ।

ক্ষণজন্মা এই বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব ছিলেন সবধর্মের, সবসম্রদায়ের । তাঁর দূবদৃষ্টি সব সময় অগ্রসর হয়েছে বিশ্বায়নের পথে । তাঁকে আন্তর্জাতিক ভৌগলিক সীঁমারেখার বাঁধা যায় না । তিনি সার্বজনীন । ভারতবর্ষের আজ চরমতম দূর্দিনে সাম্প্রদায়িক সম্পৃতি রক্ষায় তাঁর রচিত গান, প্রবন্ধ, কবিতা, আমাদের চলার পথে পাথেয় হয়ে থাকবে চিরকাল ।

কপিরাইট আবদুস সালাম কর্তৃক সংরক্ষিত



1 টি মন্তব্য: