সমাজ
হিতাকাঙ্ক্ষী
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর
আজ যখন
এই লেখা লিখছি, তখন প্রায় সমগ্র পৃথিবী আতঙ্কে
কাঁপছে। অদৃশ্য শত্রু ‘করোনা’ মারণভাইরাস একে একে স্পর্শ করছে পৃথিবীর সমস্ত
দেশকে। মানুষের বিজ্ঞানের অহংকার চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। মানুষ মানুষের স্পর্শ
থেকে বাঁচবার জন্য বসে আছে একা ঘরে। একা বসে হয়তো এ এক আত্মবিশ্লেষণের সময়। এখনো
বাঙালির জীবনের ধ্রুবতারা রবীন্দ্রনাথ পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারেন সভ্যতার এই চরম
সংকটের সময়ে। পৃথিবীর স্থান কত অকিঞ্চিৎকর এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে, তার লেখার মধ্যে পাই
সে ইঙ্গিত। ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ নাটকের সন্ন্যাসী উচ্চারণ করেন...
‘কিরণকুন্তলজাল এলায়ে
চৌদিকে
রুদ্র
তালে নৃত্য করে এ মহাপ্রকৃতি।
আলোক
আঁধার ছায়া,
জীবন
মরণ,
রাত্রি
দিন, আশা ভয়, উত্থান পতন,
এ
কেবল তালে তালে পদক্ষেপ তার।
শত
গ্রহ, শত তারা, শত কোটি প্রাণী
প্রতি
পদক্ষেপে তার জন্মিছে মরিছে।‘
মানুষ
অপরাধ করেছে। প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিচ্ছে, যা অবশ্যম্ভাবী। সভ্যতার
অহংকারে মানুষ শুধু যে প্রকৃতিকে দাবিয়ে রাখে, তাইই নয়। মানুষকেও দমন করে।
বেড়ে চলে ক্রমশ তার অপরাধ। মানুষের প্রতি মানুষের অসহিষ্ণুতা তৈরি করে সভ্যতার নানা
সংকট। রবীন্দ্রনাথ মানুষকে বার বার সতর্ক করেছেন ভারতবর্ষের সমাজের এই বিপদের
ব্যাপারে। অথচ তার কোনো শিক্ষা আমরা গ্রহণ করিনি। উল্টে এরকমও দেখা যাচ্ছে যে তার
উদ্ধৃতি বিকৃতভাবে উচ্চারণ করে মানুষ আপন অপরাধের পক্ষে ঢাল তৈরি করছে। অদ্ভুতভাবে
কিছু চোরাস্রোত প্রবেশ করছে আমাদের সমাজজীবনে, যেখান থেকে এরকম মত উঠে আসছে যে
রবীন্দ্রনাথ সেই অর্থে সাম্প্রদায়িক না হলেও একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাসের
ব্যাপারে বেশ জাজমেন্টাল ছিলেন। এই কালিমালেপন যে মৃত্যুর এত বছর পরেও তাকে সহ্য
করতে হবে,
সে কথা
কে জানত?
না, এই মুহূর্তে আর
মানুষটি হৃদয়ের অন্তঃস্থলে কিরকম ভাব পুষে রেখেছিলেন, সে কথা জানা সম্ভব নয়। তবে
তার বিভিন্ন লেখাপত্র থেকে জানা সম্ভব যে
ঠিক কী ধরণের চিন্তা সমাজে ছড়িয়ে পড়া উচিত বলে তিনি ভেবেছিলেন। সমাজের মঙ্গলকামনায়
তার মতো একজন শিক্ষাবিদের ধারণা ঠিক কী ছিল, এই বিষয়ে আজ উচ্চকিত কণ্ঠে
বলবার সময় এসেছে।
শুধু
ভারতে নয়,
সারা
বিশ্বে,
বিভিন্ন
দেশে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে নানা বিভেদকামী শক্তি। তার ভাষাতেই বলি, ‘বাহিরের দিকে দরজা
যতই খুলিতেছে,
প্রাচীর
যতই ভাঙিতেছে,
মানুষের
জাতিগুলির স্বাতন্ত্র্যবোধ ততই যেন আরো প্রবল হইয়া উঠিতেছে। এক সময় মনে হইত
মিলিবার উপায় ছিল না বলিয়াই মানুষেরা পৃথক হইয়া আছে কিন্তু এখন মিলিবার বাধা সকল
যথাসম্ভব দূর হইয়াও দেখা যাইতেছে পার্থক্য দূর হইতেছে না।' তিনি সত্যদ্রষ্টা ছিলেন। সমাজকে
সতর্ক করেছেন তার বার্তার মধ্য দিয়ে বারবার। ভেদবুদ্ধি ছড়িয়েছেন বলে কোনও অর্বাচীন
কোথাও বলবে না। তবুও যদি কেউ আজ বলে, ধরে নিতে হবে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে
ক্ষুদ্রস্বার্থবুদ্ধি তাকে দিয়ে আজ বলিয়ে নিচ্ছে এই কথা।
সবার আগে
কবি নিজেকে চিনে নেওয়ার চেষ্টায় রত ছিলেন। যিনি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে জানেন, বোঝেন যে তার ধর্ম
কীভাবে তার অস্তিত্বকে ধারণ করে আছে, তিনি কি অন্যধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু থাকতে পারেন? যার নিজস্ব
ব্রহ্মাণ্ডের ভরকেন্দ্র টলটলায়মান, তিনিই ক্ষিপ্ত হয়ে বিভেদকামিতাকে আমন্ত্রণ জানাবেন।
সুখের কথা এবং শান্তির কথা, রবীন্দ্রনাথের সেরকম কোনও অবকাশ আসেনি।
না, রবীন্দ্রনাথ হিন্দু
ছিলেন না। তিনি ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী ছিলেন। কিন্তু হিন্দুধর্ম যে ক্ষুদ্র
স্বার্থান্বেষী মানুষের ধর্ম নয়, সে বিষয়ে তার থেকে ভালো বিশ্লেষণ আর কেউ কোথাও করেছেন
বলে চোখে পড়ে নি। বলেছেন, যা জীবনধর্মী, তা গতিশীল। এর স্থিতির দিকে যেমন সংজ্ঞা আর
অস্তিত্ব আছে,
গতির
দিকেও পাল্লা হাল্কা নয়। এখন যেকোনো একদিক
থেকে একে বিচার করাই একচোখোমি। তিনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। আমরা
অন্ধ, মূক, বধির হয়ে আছি। কবি
বলছেন,
‘যেসকল
আচার আমাদের শাস্ত্রে এবং প্রথায় অহিন্দু বলিয়া গণ্য ছিল আজ কত হিন্দু তাহা
প্রকাশ্যেই লঙ্ঘন করিয়া চলিয়াছে; কত লোককে আমরা জানি যাঁহারা সভায় বক্তৃতা দিবার ও কাগজে
প্রবন্ধ লিখিবার বেলায় আচারের স্খলন লেশমাত্র সহ্য করিতে পারেন না অথচ যাঁহাদের
পানাহারের তালিকা দেখিলে মনু ও পরাশর নিশ্চয়ই উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিবেন এবং রঘুনন্দন
আনন্দিত হইবেন না। সমস্ত বাঁধাবাঁধির মধ্যেও হিন্দুসমাজ একপ্রকার অর্ধচেতন ভাবে
অনুভব করিতে পারে যে, বাহিরের এইসমস্ত পরিবর্তন হাজার হইলেও তবু বাহিরের — যথার্থ
হিন্দুত্বের সীমা এইটুকুর মধ্যে কখনোই বদ্ধ নহে।’
তিনি
সম্যকরূপে ভারতবর্ষ এবং তার অন্তর্নিহিত ‘হিন্দুত্ব’কে চিনে নেওয়ার একটা চেষ্টা
চালিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি জানতেন, ব্রিটিশ আমলেও এই সমস্যা নতুন কিছু ছিল না। তার কথায়
‘স্বদেশ ও স্বজাতি-রক্ষার জন্য হিন্দু এক হইতে পারে না, গোষ্ঠ এবং গোজাতি-রক্ষার জন্য
চাই কি তাহারা এক হইতেও পারে। স্বাধীনতা স্বদেশ আত্মসন্মান মনুষ্যত্ব প্রভৃতি অনেক
শ্রেষ্ঠতর পদার্থের অপেক্ষা গোরুকে রক্ষা করা যে আমাদের পরমতর কর্তব্য, এ কথা হিন্দু ভূপতি
হইতে কৃষক পর্যন্ত সকলেই সহজে বুঝিবে।’ তিনি বুঝেছিলেন হিন্দুধর্মের বিপদের
খানাখন্দ। বড় দুঃখের কথা, আমরা আজ স্বাধীনতার এত বছর পরেও বেরিয়ে আসতে পারি নি, চলতে পারি নি ভেদবুদ্ধির
উর্ধে উঠে তার নির্দেশিত পথে।
না, তিনি সত্যিই
‘হিন্দুত্ব’ কে শুধুমাত্র একটা ধর্ম বলে দেগে দেননি। বলেছেন, ‘হিন্দু ভারতবর্ষের
ইতিহাসের একটি জাতিগত পরিণাম।’
উদাহরণস্বরূপ বলি, মাঘমাসে শ্রীপঞ্চমী তিথিতে যখন বাগদেবী বন্দিতা হন, পূজার আয়োজনে
গ্রামের কোনও ইস্কুলে যে মেয়েটি ফলমূল কেটে নৈবেদ্য সাজায়, ফুল দিয়ে পূজার অর্ঘ সাজায়, কারো যেন প্রশ্ন করার সাহস না হয় তার
জাতধর্মগোত্র নিয়ে। এরকম ভারতবর্ষের ছবিই কবি দেখেছিলেন। তবে এই স্বপ্নের ছবি
খণ্ডিত,
সর্বব্যাপী
নয়। এখনো এই দেশে এরকম জায়গায় অভাব নেই, যেখানে গ্রামে দলিতদের জন্য আলাদা কূপ এবং দিনের
বেলা নিচুজাতের ছায়া মাড়ানো পাপ। সরকারী হিসেবে তাদের সংরক্ষণের আওতায় রাখা হলেও
বর্তমান বিশ্বের জীবনযাত্রায় অর্থই প্রধান চালিকাশক্তি। ফলে অনগ্রসর জাতি কোথাও
কোথাও আরও অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে।
পৃথিবীতে
অনেক দেশেই অর্থনৈতিক মেরুকরণ এখন এক চরম আকার ধারণ করতে চলেছে। থাবা বসানো মারণ
ভাইরাসের কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেও সারা বিশ্বেই অর্থনৈতিক মন্দার ফলে মুখ
থুবড়ে পড়তে চলেছে সমাজের বড় অংশের মানুষ।
মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সম্পূর্ণ বিলোপ আসন্ন। এই বিশাল বিভেদের পাশাপাশি যোগ হয়েছে ধর্মভিত্তিক
মেরুকরণ,
যা
বিভিন্ন স্বার্থাণ্বেষী গোষ্ঠীর নিজেদের অস্তিত্ব জিইয়ে রাখার কৌশল। আমরা ভুলে গিয়েছি শতাধিক বর্ষ আগে বঙ্গভঙ্গ
বিরোধী আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ পথে নেমে জাত-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের
হাতে রাখি পরিয়েছিলেন। সে কাজ হয়তো বা কারো কাছে মনে হয়েছিল অতিরিক্ত নাটকীয় গিমিক, কিন্তু তার সেই
উচ্চারণ,
‘বঙ্গদেশটি
ভাঙলে হিন্দু,
মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান- সকল
মানুষের বঙ্গদেশই ভাঙবে। কেবল হিন্দুর বঙ্গদেশ ভাঙবে না।' সেই কথা কেউ অস্বীকার করতে
পারেনি। না,
বাংলা
ভাগ আটকানো যায়নি। যদিও কবি নিজের জীবদ্দশায় দেখে যান নি এই ভাঙন।
ভাঙন
দেখে না গেলেও তিনি জানতেন বিপদ কোথায়। বলেছিলেন, ‘শনি তো ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ
করিতে পারে না;
অতএব
শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই সাবধান হইতে হইবে।' হিন্দু-মুসলমানের মাঝের প্রভেদ সেই ব্রিটিশ আমল
থেকে ইংরেজ শাসকরা নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে। দুঃখের বিষয় এখন স্বজাতির
দ্বারা শাসিত হয়েও, ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হবার সত্তর বছর পরেও সম্পূর্ণরূপে বেরিয়ে
আসতে পারিনি এই বিভেদ থেকে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বারে বারে মাথাচাড়া দিয়েছে
অসন্তোষ। নিজেরাই আহ্বান করে নিয়ে এসেছি ‘শনি’।
ভেদ মোছা
যায়না। প্রকৃতির নিয়মে, সমাজের নিয়মে, কালের নিয়মে ভেদ অতি স্বাভাবিক বস্তু। সকল রকম
বৈচিত্র ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির বলেই তা সুন্দর বলে মনে হয় আমাদের চোখে। ভেদ
নিন্দনীয় নয়,
নিন্দনীয়
হল ভেদবুদ্ধি। নিন্দনীয় হল তজ্জনিত বঞ্চনা, অন্যায়, অবিচার, যা যুগ যুগ ধরে আমাদের দেশে চলে
আসছে। আবার নতুন করে মনে করবার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে যে কবি বলে গিয়েছিলেন যিনি
বর্ণভেদের অতীত,
তিনি
শুভবুদ্ধি দ্বারা আমাদের সংযুক্ত রাখুন। কবি এই ভেদবুদ্ধিকে ভূত তাড়ানোর মত তাড়িয়ে
দেবার কথাও বলেছিলেন। সমাধানের পথ হিসেবে বলে গেছেন বলপ্রয়োগ বা কণ্ঠপ্রয়োগ নয়, অর্থাৎ দাদাগিরি বা
গলাবাজি করে এখন আর এই ‘ভেদবুদ্ধি’ র ভূত ভাগানো সম্ভব নয়। কবি বলেছেন,
‘কথায় তো শোধ হয় না
দেনা, গায়ের জোরে জোড় মেলে
না—
গোলেমালে
ফল কি ফলে জোড়াতাড়ার ছাঁদে ॥...’
হ্যাঁ, এই জোড় মেলাতে, ভেদবুদ্ধি তাড়াতে
শুভবুদ্ধি প্রয়োজন, হিতবুদ্ধি প্রয়োজন। কর্মের দ্বারা, বিশ্বাসের দ্বারা, পারস্পরিক শ্রদ্ধার
দ্বারা হয়তো বা সম্ভব। স্বপ্ন দেখেছিলেন কবি, আমাদেরও দেখিয়েছিলেন।
‘এসো হে আর্য, এসো অনার্য,
হিন্দু
মুসলমান।
এসো
এসো আজ তুমি ইংরাজ,
এসো
এসো খৃস্টান।
এসো
ব্রাহ্মণ,
শুচি
করি মন
ধরো
হাত সবাকার,
এসো
হে পতিত করো অপনীত
সব
অপমানভার।
মার
অভিষেকে এসো এসো ত্বরা
মঙ্গলঘট
হয় নি যে ভরা,
সবারে-পরশে-পবিত্র-করা
তীর্থনীরে।
আজি
ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে।’
মনে
প্রশ্ন জাগে,
তাহলে
কি রবীন্দ্রনাথ একাই ধর্মের মতই ধারণ করে রাখতে পারেন আমাদের? উত্তরে আকাশ বাতাস
বিদীর্ণ করে প্রচণ্ড শব্দে ‘হ্যাঁ’ বলতে সাধ জাগে। আমরা যারা দিশেহারা এই মুহূর্তে, তাদের জন্য অবশ্যই
তিনি এক বিরাট অবলম্বন হয়ে উঠতে পারেন রবীন্দ্রনাথ।
স্বপ্নস্বরূপের
সঙ্গ খুঁজে ফিরেছিলেন কবি। এই খোঁজই ছিল তার জীবনচর্যা। জীবনের যাত্রাপথের বাঁকে
বাঁকে রেখে গিয়েছেন অজস্র মণিমুক্তা এবং
তিনি নিজেই হয়ে উঠেছেন আমাদের জীবনের স্বপ্নস্বরূপ। আসলে আমরা ঈশ্বরের উপস্থিতি টের পেলেও তাকে বুঝবার শক্তি
জুটিয়ে উঠতে পারিনা। তার ক্ষেত্রেই এমনটিই হতে চলেছে। ঈশ্বরকে গজদন্তের সিংহাসনে
বসিয়ে রেখে তার জন্মতিথি পালনের আচার অনুষ্ঠানটুকু যান্ত্রিকভাবে করে চলেছি আমরা
এবং তার শিক্ষার মূল ভাবনা বিস্মৃত হয়েছি।
তিনি বলে
গিয়েছিলেন,
‘জগতে
স্বার্থপর হইবার যো নাই। পরার্থপরতাই এ জগতের ধর্ম। এই নিমিত্তই মানুষের
সর্বোৎকৃষ্ট ধর্ম পরের জন্য আত্মোৎসর্গ করা। জগতের ধর্ম আমাদিগকে আগে হইতেই পরের
জন্য উৎসৃষ্ট করিয়া রাখিয়াছে, সে বিষয়ে আমরা জগতের জড়াদপি জড়ের সমতুল্য। কিন্তু আমরা
যখন স্বেচ্ছায় সচেতনে সেই মহাধর্মের অনুগমন করি তখনই আমাদের মহত্ত্ব, তখনই আমরা জড়ের
অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। কেবল তাহাই নয়, তখনই আমরা মহৎ সুখ লাভ করি।’
তিনি জগতসংসারের
নিয়মকে আরোপ করতে চেয়েছিলেন মানুষের ধর্মাচরণের মধ্যে। এই পরার্থপরতা তার কাছে
বিভিন্ন মনুষ্যসৃষ্ট আচার- আচরণবহুল ধর্মের চেয়েও অনেক মহৎ বলে প্রতিভাত হয়েছিল।
মানুষের সমস্ত অসুখ যে লুকিয়ে আছে স্বার্থপরতার ভেতরে, সে কথা বারে বারে বলে গিয়েছিলেন
তিনি। এমনকি কঠোর আধ্যাত্মিক নিয়মপালনও যে স্বার্থপরতার নামান্তর মাত্র, একথা বলতে তিনি
দ্বিধাবোধ করেননি।
তিনি
বলেছিলেন,
‘সকল
স্বার্থপরতায় চূড়ান্ত এই আধ্যাত্মিক স্বার্থপরতা। কারণ, সংসারের মধ্যে এমন একটি অপূর্ব্ব কৌশল আছে যে, স্বার্থসাধন করিতে গেলেও পদে
পদে স্বার্থত্যাগ করিতে হয়। সংসারে পরের দিকে একেবারে না তাকাইলে নিজের কার্য্যের
ব্যাঘাত ঘটে। নৌকা যেমন গুণ দিয়া টানে তেমনি সংসারের স্বার্থবন্ধন আমাদিগকে ইচ্ছায়
অনিচ্ছায় সর্ব্বদাই প্রতিকূল স্রোত বাহিয়া নিজের দিক হইতে পরের দিকে আকর্ষণ করিতে
থাকে। আমাদের স্বার্থ ক্রমশই আমাদের সন্তানের স্বার্থ, পরিবারের স্বার্থ, প্রতিবেশীর স্বার্থ, স্বদেশের স্বার্থ
এবং সর্ব্বজনের স্বার্থে অবশ্যম্ভাবীরূপে ব্যাপ্ত হইতে থাকে।
কিন্তু
যাঁহারা সংসারের দুঃখ শোক দারিদ্র্য হইতে পরিত্রাণ পাইবার প্রলোভনে আধ্যাত্মিক
বিলাসিতায় নিমগ্ন হন তাঁহাদের স্বার্থপরতা সর্ব্বপ্রকার আঘাত হইতে সুরক্ষিত হইয়া
সুদৃঢ় হইয়া উঠে।’ হ্যাঁ, আধ্যাত্মিক ধর্মপালনকে ‘বিলাসিতা’ বলে অভিহিত করতে
দ্বিধাবোধ করেননি তিনি এবং সেই কারণে জগতসংসারের সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে
থাকাকেও সমর্থন করেননি।
জগতের
ধর্ম বলতে অনেকক্ষেত্রেই প্রশ্ন ওঠে যে এর ভিত্তি কি নিষ্ঠুরতা নয়? প্রাণের ধারা
প্রবাহিত থাকার অন্যতম শর্ত কি অন্যের প্রাণহরণ নয়? এখানে কবি মনে করিয়ে দেন যে
আমরা খণ্ডচিত্র দেখছি। সমগ্র জগতের সাম্যাবস্থাকে দেখছিনা। তিনি বলে ওঠেন, ‘নিষ্ঠুরতাই যদি
জগতের মূলগত নিয়ম হইত, হিংসাই যদি জগতের আশ্রয়স্থল হইত, তবে জগৎ এক মুহূর্ত বাঁচিত না।
উপর হইতে যাহা দেখি তাহা ধর্ম নহে। উপর হইতে আমরা ত চতুর্দিকে পরিবর্তন দেখিতেছি, কিন্তু জগতের মূল
ধর্ম কি অপরিবর্তনীয়তা নহে? আমরা চারি দিকেই ত অনৈক্য দেখিতেছি, কিন্তু তাহার মূলে
কি ঐক্য বিরাজ করিতেছে না?’
এই
ভাবধারা তো কোনও রূপক নয়। জগতছাড়া অনাসৃষ্টি কোনও অবাস্তব স্বপ্ন নয়। তবুও সেই
ভাবনা আজো মানুষের কাছে অধরা হয়ে থেকে যাচ্ছে। স্বপ্নস্বরূপ সেই ভাবনার বাস্তবায়ন
কি মানুষ কোনওকালে করতে পারবেনা?
ত্রিশের
দশকের শেষভাগে চীন-জাপান যুদ্ধের সময় এক অদ্ভুত ঘটনায় কবি বিচলিত হয়েছিলেন। ঘটনাটি
হল, এক জাপানী সৈন্য
যুদ্ধের সাফল্য কামনা করে বুদ্ধমন্দিরে পূজা দিতে গিয়েছিল। হ্যাঁ, সঙ্গতভাবেই তার কাছে
অদ্ভুত এবং নিন্দনীয় বলে মনে হয়েছিল হিংসাকে আবাহনের জন্য এই অহিংসার দূতের
অর্চনা। কবি লিখেছিলেন...
‘হত-আহতের গনি সংখ্যা
তালে
তালে মন্দ্রিত হবে জয়ডঙ্কা।
নারীর
শিশুর যত কাটা-ছেঁড়া অঙ্গ
জাগাবে
অট্টহাসে পৈশাচী রঙ্গ,
মিথ্যায়
কলুষিবে জনতার বিশ্বাস,
বিষবাষ্পের
বাণে রোধি দিবে নিশ্বাস —
মুষ্টি
উঁচায়ে তাই চলে
বুদ্ধেরে
নিতে নিজ দলে ।
তূরী
ভেরি বেজে ওঠে রোষে গরোগরো,
ধরাতল
কেঁপে ওঠে ত্রাসে থরোথরো।’ ...
আসলে
আমরা সর্বদা আমাদের নিজস্ব বিশ্বাস, ভাবনা, অভিব্যক্তি সবকিছুর প্রতিফলন দেখতে চাই এবং প্রকারান্তরে
সমর্থন আদায় করে নিতে চাই আমাদের প্রিয় মানুষ এবং আরাধ্য দেবতার থেকে। মাঝেমধ্যেই
বুঝে উঠতে চাইনা যে, সে কাজে হয়তো সেই মানুষটির বিশেষ সায় নেই, আগ্রহও নেই। সমর্থন দূরে থাক, আপত্তিও থাকতে পারে।
তবুও যেন আমরা নিজের দল ভারি করতে চাই ওজনদার মানুষকে দলে টেনে নিয়ে।
এখন এই
মুহূর্তে হয়তো সেটাই ঘটে চলেছে রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও। সবাই নিজের নিজের ভাবনা
প্রকাশ করবার জন্য তারই লেখাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। বিপদ সেখানেই। কখনো বা
সম্পূর্ণ প্রসঙ্গের অবতারণা ছাড়াই খণ্ড খণ্ড ভাবে তাকে ব্যবহার করা হচ্ছে আশ্রয়
হিসেবে নয়,
ঢাল
হিসেবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তিনি বেঁচে থাকতে, প্রাণ থাকতে কোনওদিন চরমপন্থী
মৌলবাদকে সমর্থন করতেন না। পরাধীন ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আন্দোলনের চরমপন্থী
হিংসাশ্রয়ী ভাবনার ধারাটির বিশেষ বিরোধিতা
তিনি বার বার করেছেন। সে লড়াই বিদেশী শাসনের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করবার লড়াই ছিল, তা সত্ত্বেও তিনি
সর্বান্তকরণে সমর্থন করেননি। আজ দেখি ক্ষুদ্রস্বার্থে দেশেরই মানুষ নিজেদের মধ্যে
কখনো রাজনৈতিক অথবা সাম্প্রদায়িক লড়াইয়ে মত্ত, বাধে না এতটুকু একে অপরের প্রাণ
নিতে; যে মুখের কথায় তারা
হিংসায় ইন্ধন দেয়, সেই একই মুখে তারা
রবীন্দ্রনাথের বাণী আউড়ে ফেরে। জানতে ইচ্ছে হয়, একালে জন্মালে রবীন্দ্রনাথের
দশা কী হত!
অবশ্য
তার জীবদ্দশাতেও যে আপামর বাঙ্গালী তাঁকে চিনতে পেরেছিল এমন নয়। প্রতিপক্ষ প্রবল
ইংরেজ হলেও যেকোনো রকম হিংসার এবং যুদ্ধের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে ছিল তার
অবস্থান। বারবার মানুষ তাঁকে ভুল বুঝেছিল
সেকালেও। কিন্তু তিনি দমে না গিয়ে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন যে
স্বাধীনতা কিংবা স্বরাজ বিষয়ে আমজনতার ভাবনার মধ্যে গলদ ঠিক কোন জায়গায়। তিনি
বলেছিলেন,
‘আমরা
যখন বলি স্বাধীনতা চাই, তখন কী চাই সেটা ভেবে দেখা চাই। মানুষ যেখানে সম্পূর্ণ একলা সেইখানে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন। সেখানে তার কারো সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ
নেই, কারো কাছে কোনো
দায়িত্ব নেই,
কারো
প্রতি কোনো নির্ভর নেই, সেখানে তার স্বাতন্ত্র্যে লেশমাত্র হস্তক্ষেপ করবার কোনো
মানুষই নেই। কিন্তু মানুষ এ স্বাধীনতা কেবল যে চায় না, তা নয়, পেলে বিষম দুঃখ বোধ করে।’ তিনি
সঠিক জায়গায় ঘা দিয়েছিলেন, এই “কী চাই” সেই ব্যাপারটা তলিয়ে ভাববার কথা বলে। কারণ, স্বাধীনতা বলতে আমরা
ঠিক কি বুঝি,
সেটা
সত্যিই বড় ঘোলাটে, বড় ধোঁয়াশার জায়গা। দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা শুধুই একটি ভূখণ্ডকে
বিদেশী শাসনের হাত থেকে মুক্ত করলে যে আসা সম্ভব নয়, সেকথা তার মত করে ক’জন বুঝেছিল? হয়তো সে সময়
ভারতবর্ষ এক জটিল সন্ধিক্ষণের মধ্য দিয়ে চলছিল বলেই তিনি এই ব্যাপার নিয়ে তলিয়ে
ভেবেছিলেন। তবে অনেক ক্ষেত্রেই নামীদামী রাজনৈতিক নেতাদের সাথে মতপার্থক্য ঘটেছিল
তার। ‘বিদেশী বর্জন’ এর উন্মাদনায় গা ভাসিয়ে দেননি বলে কম সমালোচনা সইতে হয়নি। সে
সব কথায় কান না দিয়েই তিনি লিখেছিলেন, ‘আজকাল আমরা এই একটা বুলি ধরেছি, ঘরে যখন আগুন লেগেছে
তখন শিক্ষা দীক্ষা সব ফেলে রেখে সর্বাগ্রে আগুন নেবাতে কোমর বেঁধে দাঁড়ানো চাই; অতএব সকলকেই চরকায়
সুতো কাটতে হবে। আগুন লাগলে আগুন নেবানো চাই এ কথাটা আমার মতো মানুষের কাছেও
দুর্বোধ্য নয়। এর মধ্যে দুরূহ ব্যাপার হচ্ছে কোন্টা আগুন সেইটে স্থির করা, তারপরে স্থির করতে হবে
কোন্টা জল।’
বিভিন্ন
সঙ্কটের সময় এভাবেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়ে হয়ত তিনি বলতে চেয়েছিলেন ‘আগুন’
কে, অর্থাৎ বিপদটাকে
ঠিকঠাক চিনে নেবার কথা। তবে বিপদ চিনে নিয়ে সেখানে জল ঢালাও ভারি বিপদের কাজ। যাকে
জল বলে ভাবছি,
কে
জানে, জলভাণ্ড বদলে সেখানে
কেউ ঘৃতভাণ্ড রেখে দিয়েছে কিনা।
সেসময়
আপামর ভারতবাসী একচক্ষু হরিণের মত শুধুই স্বরাজের কথা ভেবেছিল। স্বরাজের সাথে
ঘনিয়ে আসা অন্যান্য বিপদ অর্থাৎ আনুষঙ্গিক আধিব্যাধি নিয়ে একেবারেই ভাবিত ছিল না।
কারণ, তারা সম্ভবত বুঝে
উঠতে পারেনি যে ভারতবর্ষ প্রস্তুত ছিল না স্বরাজের জন্য। রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, সতর্ক করেছিলেন এবং
সমালোচিত হয়েছিলেন, কারণ বাকিদের মত ছিল যে তিনি সময়ের দাবী অর্থাৎ ‘প্রায়োরিটি’ বুঝতে
পারছেন না। আসল ব্যাপারটা হল, তিনি কোনও সমস্যাকে খণ্ডচিত্রের মত দেখেননি। সত্যদ্রষ্টা
দার্শনিকের মত সমস্যার সমগ্র স্বরূপ বুঝবার চেষ্টা করেছিলেন। হয়তো সেই কারণেই
চরমপন্থী এবং নরমপন্থী সবরকম আন্দোলনের বাইরে দাঁড়িয়ে তাদের সমস্যাগুলি দূর থেকে
দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। দূরে ছিলেন, তাই গোটা চিত্রটি দেখতে পেয়েছিলেন। কাছাকাছি থাকলে হয়তো
বা অন্ধ হয়ে যেতেন। শ্লোগানের চিৎকারে শুনতে পেতেন না অন্তরাত্মার মনের কথা। তার
মত করে কেউ বোঝেনি যে যেন তেন প্রকারেণ প্রতিবাদ করাই মোক্ষ হতে পারেনা যেকোনো
আন্দোলনের। সমস্যার স্বরূপ বুঝেই তিনি লিখেছিলেন, ‘আগুনের জ্বালানি কাঠটা হচ্ছে
ধর্মে কর্মে অবুদ্ধির অন্ধতা।’
লিখেছিলেন... ‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ
সে জন মারে আর শুধু মরে’ ...
তার মতে, দেশকে সর্বব্যাপী
শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা ছিল সমাধানের পথ। প্রকৃত শিক্ষাই একমাত্র পারে সবরকম
হিংসা,
ধর্মবিদ্বেষ
এবং অন্ধতা দূর করতে। শিক্ষার চটকদারি পাশ্চাত্য অনুকরণ নয়, অল্প কিছু মানুষকে
পাইয়ে দেওয়া শিক্ষা নয়, অন্ধকার ভাসিয়ে দেওয়া আলোর কথা বলে গিয়েছিলেন তিনি।
ভাবতে অবাক লাগে, স্বাধীনতার এত বছর পরেও কি দেশ তাঁকে বুঝতে পারলো না? তাহলে কেন আজো এ
দেশের স্তরে স্তরে এত অন্ধতা? সেই কবে তিনি লিখেছিলেন,
... ‘দেশকে মুক্তি দিতে গেলে দেশকে শিক্ষা দিতে হবে, এ কথাটা হঠাৎ এত
অতিরিক্ত মস্ত বলে ঠেকে যে একে আমাদের সমস্যার সমাধান বলে মেনে নিতে মন রাজি হয়
না। দেশের মুক্তি কাজটা খুব বড়ো অথচ তার উপায়টা খুব ছোটো হবে, এ কথা প্রত্যাশা
করার ভিতরেই একটা গলদ আছে।’ তিনি এই প্রত্যাশার গলদটা হাতে ধরে চিনিয়ে দিতে
চেয়েছিলেন। আমরা কি আদৌ কোনও দিন চিনতে পারবো?
কপিরাইট নন্দিনী সেনগুপ্ত কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন