গীতাঞ্জলি ও আমরা * তৈমুর খান



গীতাঞ্জলি
ও আমরা

একশো বছর পরও রবীন্দ্রনাথের 'গীতাঞ্জলি ' (১৯১২) কি আমাদের স্পর্শ করে? এ প্রশ্নের উত্তর সঠিক ভাবে দিতে পারি না। এক বিস্ময় বিমূঢ় যুগের মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতায় যেভাবে প্রতিনিয়ত ক্ষয় হচ্ছি, সেখানে আধ্যাত্মিকতা বোধের জায়গা কোথায়? এত আলোকময় সভ্যতা  . তবু মনে হয় কোথাও আলো নেই।  চারিপাশে সব বিদ্রুপ দাঁড়িয়ে আছে। অর্থ - যশ - খ্যাতি সবই শূন্যে বিলীন হয়ে যাবে। মানুষই থাকবে না, মানবিকতাই বাঁচবে না, সেখানে কাব্য কবিতার আয়ু রচনা!  আধ্যাত্মিক শক্তির জয় ঘোষণা কী করে সম্ভব?  সভ্যতায় মনন হারিয়ে যাচ্ছে। সর্বজনীনতায় সর্বব্যাপী বোধিকেন্দ্রে বিস্তৃত হবার, শিল্পকে উপলব্ধি করার ক্ষেত্র ছোটো হয়ে যাচ্ছে। এক গভীর প্রশান্তির আত্মঅন্বেষণর ভেতর স্থির হবার সময় কি এযুগের মানুষের হাতে আছে?

হয়তো নেই বলেই আত্মাজাগরণের আত্মদীক্ষায় মানুষ আর যেতে চায় না। তার প্রাগম্যাটিজম্ বা রিয়ালিস্টিক ভাবনায় স্থূল পার্থিবতা যতটা স্থান পায়, সূর্য আর আমানির খোঁজে মৃত্যুর চৌকাঠ যতটা রক্তাক্ত হয়, ঈশ্বরের জন্য ততটা হয় না।সে ঈশ্বর যদি জীবনদেবতা হন, আমি বা তুমি সর্বনামে মধ্যম পুরুষ বা প্রথম পুরুষের আড়ালে অবস্থান করেন  তাহলে তো কথাই নেই।যে ঈশ্বরকে চোখের আলোয় চোখের বাহিরে খুঁজতে খুঁজতে আলোক ফুরিয়ে গেলে, অন্তরে দেখার আয়োজন চলে এবং কবি তখন বলে দেন

                                ' আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি
                                  বাহির-পানে চোখ মেলেছি, হৃদয়-পানেই চাইনি ।'

হৃদয়-পানে চেয়েই তিনি হৃদয়েশ্বরকে দেখতে পেলেন। হৃদয়-ই তো কাবা-মন্দির-গির্জা । নজরুল ইসলাম অনেক পরে একথা লিখেছিলেন। কিন্তু আজ 'হৃদয়' শব্দটাই বড়ো হাস্যকর মনে হয়। হৃদয়ের উপস্থিতি কোথাও আছে বলে মনেই হয় না। মনে হয় কয়েক যুগ আগেই তার মৃত্যু ঘটেছে।  এখন যারা হৃদয়ের কথা বলে  হয়তো তারা মিথ্যা বলে নয়তো ভণ্ডামি করে। কড়ি ফেলে তেল মাখার যুগে ঈশ্বর ও বিক্রি হন। হদয়ই যদি না থাকে তো তিনিই বা থাকবেন কী করে? রবীন্দ্রনাথ 'গীতাঞ্জলি' সম্পর্কে নিজেই লিখেছেন —  'এ আমার জীবনের ভিতরের জিনিস, এ আমার সত্যকার আত্মনিবেদনের মধ্যে, আমার জীবনের সমস্ত সুখ-দুঃখ সমস্ত সাধনা বিগলিত হয়ে আপনি আকার ধারণ করেছে।' একথা মানতে হয়, ব্যক্তি জীবনের মিশ্রণ ভিন্ন প্রকৃত কবিতা বা গান রচিত হতে পারে না। এই ব্যক্তিই ক্রমে সার্বিক ও মানবিক হয়ে যায়। তখনই বিশ্বজনীন তাৎপর্য ফুটে ওঠে।চিরকালই ঈশ্বরের সঙ্গে জগতের এবং ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের একটা বিরহের অথবা না পাওয়ার সম্বন্ধ আছে। এই না পাওয়া আছে বলেই রবীন্দ্রনাথের গানে সর্বদা পাওয়ার আকুলতা জেগে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ যে পথের অন্বেষণ করেছেন, সেই পথ হাঁটাতেই আনন্দের সন্ধানও দিয়েছেন। যাঁকে তিনি পেতে চান তিনি ধরা দিয়েও ধরা দেন না । তাই পেয়েও তাঁকে বারবার হারান। এই পাওয়া না পাওয়ার রহস্যের ভেতর দিয়েই তাঁর যাত্রা।তখন পথ-পানেই চেয়ে থাকতে হয় —

                       ' চলে যাওয়ার পথ যেদিকে
                         সেদিক পানে অনিমেষে
                      আজ ফিরে চাই, ফিরে চাই'

সেই প্রেমাস্পদ হয়তো চলে গেছেন কিংবা চোখের আড়ালে রয়েছেন। আবার তিনি ফিরে আসবেন।  তাঁর জন্য কবির অপেক্ষার অনন্ত প্রহর কাটছে। হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠছে।  সময় চলে যাচ্ছে, সাক্ষাৎ তো হবেই, কিন্তু কখন হবে?

                ' বেলা আর নাই বাকি, সময় হয়েছে নাকি
                      দিন শেষে দ্বারে বসে পথ পানে চাই'

এই পথ তো সকলেরই পথ, মরমিয়া সাধকের, বাউলের এক সহজিয়া পথ, যে পথে ভারতীয় জীবনদর্শনের আধ্যাত্মিক নিগড়টি রচিত হয়েছে ।  ভেতর থেকে বাহিরে আবার বাহির থেকে ভেতরে সর্বত্রই এই পথের রেখা। এই পথরেখা সর্বগ্রাসী ঘাসে ঢেকে গেলেও সাধনার সহজিয়া বোধিতে নিজেকে পৌঁছে দিতে পেরেছেন। জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে মানবিক প্রশ্রয়ের অন্তরালে প্রশান্তির চরম এক সার্থকতায় যে নিভৃতি নিয়ে আধ্যাত্মচৈতন্যের বাঁশি কবি শুনতে চেয়েছেন সেখানে যুগাতীত সংকটাতীত ব্যাপ্তিই প্রবর্তিত হয়েছে,  যা থেকে নিজেকে এবং যুগ ও সময়কে এবং চিরকালীন মানবকে রক্ষা করা সম্ভব ।রবীন্দ্রনাথ জানতেন 'আমাদের দেশে ধর্মই মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রভেদ ঘটিয়েছে।  আমরাই ভগবানের নাম করে পরস্পরকে ঘৃণা করেছি, স্ত্রীলোককে হত্যা করেছি। শিশুকে জলে ফেলেছি, বিধবাকে নিতান্তই অকারণে তৃষ্ণায় দগ্ধ করেছি । নিরীহ পশুদের বলিদান করেছি  এবং সকল প্রকার বুদ্ধি যুক্তিকে একেবারে লঙ্ঘন করে এমন সকল নিরর্থকতার সৃষ্টি করেছি যাতে মানুষকে মূঢ় করে ফেলে। '(কাদম্বিনী দত্তকে লেখা চিঠি, ১৩১৭, ২০ আষাঢ়)। এইসব লোকাচার,  সংকীর্ণতা ও সংকট যেমন জীবনস্রোতকে কলঙ্কিত করছিল, তেমনি ব্যক্তি জীবনে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মৃত্যুশোকে মুহ্যমান। নিজের অসুস্থতা, পুত্র শমীর মৃত্যু, দীনেশচন্দ্র সেনের পুত্র অরুণচন্দ্রের মৃত্যু প্রভৃতি একের পর এক মৃত্যুর মুখোমুখি কবিকে বিহ্বল করে দিয়েছিল।  সমসাময়িক রাজনীতি থেকেও কবি অব্যাহতি চেয়েছিলেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন এবং ভণ্ড দেশনেতাদের গোঁয়ার্তুমি তিনি পছন্দ করেননি। শোষিত,  নির্যাতিত মানুষের চোখের জলও তাঁকে বেদনাবিধুর করে ফেলেছিল। সব মিলিয়েই যে অন্তিম আত্মআশ্রয় তিনি খুঁজেছিলেন, সেখানে আধ্যাত্মিক যুক্তিই কবির কাছে কাম্য হয়ে উঠেছিল।  লৌকিক জীবন ও অতিলৌকিক জীবন,  পূজা ও ভালোবাসা, প্রেম ও ঈশ্বর সবই  'তুমি' 'আমি' র সম্পর্কে একাকার হয়ে গিয়েছিল

                            'কথা ছিল এক তরীতে কেবল তুমি আমি
                              যাব অকারণে ভেসে কেবল ভেসে,
                              ত্রিভুবনে জানবে না কেউ আমরা তীর্থগামী
                                কোথায় যেতেছি কোন্ দেশে যে কোন্ দেশে!'

এই অনির্দেশ্য অনিশ্চিত দেশই আধ্যাত্মলোকের ঠিকানা। কবি সুতীব্র বিরহ অনুভব করেছেন। কবির হৃদয় প্রকাশিত হয়েছে অনন্ত আকাশে। পরাণ দিয়ে প্রেমের দীপ জ্বেলেই এই পথে কবি পাড়ি দিয়েছেন। বিভোর হয়ে গেছেন স্ব-নির্মিত ধারণায় ' তুমি' র সম্পর্কে ।পূজা-প্রেম-বিরহ-প্রার্থনা সমর্পণে ভরে দিয়েছেন সংকট ও অন্ধকার, আর পরোক্ষে সেসবই আলোকের উৎস হয়ে উঠেছে। সীমার মাঝে অসীমের এই প্রকাশই ধরতে চেয়েছেন —

                'তোমার আলোয় নাইতো ছায়া,
                     আমার মাঝে পায় সে কায়া,
                    হয় সে আমার অশ্রুজলে সুন্দর বিধুর —
                              আমার মধ্যে তোমার শোভা এমন সুমধুর।'

এভাবেই নিজেকে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। নিজকে নম্র আর নমনীয়, পবিত্র আর পরাঙ্মুখ করে তুলতে আধ্যাত্মিক বোধেরই দরকার হয়। স্পিরিচুয়াল পাওয়ারই জীবনের সবচেয়ে কনফিডেনশিয়াল মোমেন্ট এনে দিতে সক্ষম। কবির কাছে যা অধরা, যা অসম্পূর্ণ, যা নাগালের বাইরে, যাকে কবি পাননি, কোনও দিন পাবেনও না, তার উদ্দেশ্যেই শেষপর্যন্ত আত্মশক্তির মহতী আলোয় আত্মপ্রত্যয়ের দীপ্তি জ্বেলে কবি বলে উঠেছেন —

                                       'জীবনে আজও যাহা রয়েছে পিছে,
                                        জানি হে, জানি তাও হয়নি মিছে।
                                       আমার অনাগত    আমার অনাহত
                                          তোমার বীণা তারে বাজিছে  তারা
                                           জানি হে, জানি তাও হয়নি হারা ।।‘
                       
এই কারণেই রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা গান বিরহের ও পূজার হয়েও এক পূর্ণতার সিদ্ধিতে মানবিক হয়ে উঠেছে ।বৈষ্ণব পদাবলীর মতো তা শুধু বৈকুণ্ঠের নয়, সাধকের নয়, তাত্ত্বিকের নয়, পূজারীর নয়,  সমগ্র মানব জাতির উত্তরণের গান। যেকোনও সংকটে, যেকোনও অন্তরায়ে, যেকোনও বেদনার বেদতীর্থে, যেকেউ-ই তরী ভাসাতে পারেন। প্রাণের উষ্ণতায়, প্রাণের আকাঙ্ক্ষায়, মৃত্যু-শোক-মালিন্য দহনে সমস্ত প্রাণ-মন হংসের মতো মানস যাত্রী হয়ে মহামরণ পারে উড়ে যেতে পারে ।অতিলৌকিক এবং লৌকিক জীবনের সেতু রচনা করে কবি যে দুঃখের সমুদ্র পাড়ি দিতে চেয়েছেন, সেই সমুদ্র তো সমগ্র মানবসভ্যতারই।  ব্যক্তি জীবনের শূন্যতা থেকেই প্রতিমুহূর্তে এই সমুদ্রের তরঙ্গ বিক্ষোভ অনুভূত হতে পারে।  একে কে পারে এড়াতে?    
         
জীবনানন্দ দাশ এক আশ্চর্য বোধের তীব্রতায় চালিত হতে দেখেছেন মানুষকে।  সেখানে আধ্যাত্মিক বোধের সমীহ হয়তো জাগেনি,  মৃত্যুবোধ বা আত্মহত্যা বোধের বিমূঢ়তা এই পার্থিব জগতের ক্লেশ ও ক্লিন্নতা থেকে মুক্তি খুঁজেছে । কিন্তু সেই মুক্তি প্রশান্তির নয়,  লাশকাটা ঘরে থেঁতো ইঁদুরের মতো।এই মৃত্যু কবিকেও একদিন গ্রাস করেছিল।   রবীন্দ্রনাে তাঁর নিঃসঙ্গতাকে মৃত্যুর কাছে নিয়ে যেতে চাননি,   প্রাতিষ্ঠানিক কোনও ঈশ্বরের কাছেও নয়     নিজের অন্তরের ঈশ্বরকেই জাগাতে চেয়েছেন।  দেখতে চেয়েছেন প্রাণভরে ।  বাইরের জীবন বা পার্থিব জীবনে বা লৌকিক জীবনেও এই ঈশ্বরের সাধনা করা যায়।  কবি লিখেছেন —

                              'যতখন তুমি আমায় বসিয়ে রাখ বাহির বাটে
                                ততখন গানের পরে গান গেয়ে মোর প্রহর কাটে।'

অর্থাৎ সব গানই ঈশ্বরের, সব গানই প্রাণের। বাহির-ভেতর, মানুষ ও ঈশ্বর, লৌকিক-অলৌকিক সবই একীভূত হয়ে যায়। মানুষকে ভালোবাসাই ঈশ্বরকে ভালোবাসা, নিজেকে খোঁজাও ঈশ্বরকেই খোঁজা। বাউলতত্ত্ব এবং সহজিয়া সাধনার মূল বিভাব এখানেই তার শেকড় মেলে দিয়েছে।  সব সাধনাই একই পথে এসে মিশে গেছে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর চলার পথে বারবার বিপন্ন হয়েছেন, সংঘাত এসেছে, কিন্তু হৃদয়ের নিভৃতে সৃষ্টির বেদনায় সরে এসেছেন। রাজনীতি, যুগসংকট, কলকোলাহল, আন্দোলন, মিছিল কোনও কিছুই তাঁকে পথভ্রষ্ট করতে পারেনি। অন্তরের দাবি থেকেই ব্যক্তি-ঈশ্বরের ইংগিত উপলব্ধি করেছেন।  তখনই নিমগ্ন আত্মপথের আত্মবোধির অনুভব —

                       '   এইখানেতে দু'টি পথের মোড়ে
                          হিয়া আমার উঠলো কেমন করে
                            জানিনে কোন্ ফুলের গন্ধ ঘোরে
                            সৃষ্টিছাড়া ব্যাকুল বেদনাতে '

এই 'ব্যাকুল বেদনা 'বোধেরই নামান্তর, যে বোধ বিপন্ন করে সেই বোধ সৃষ্টির প্রেরণাও দেয়। রবীন্দ্রনাে এই বোধেই তাড়িত, প্রতিপালিত হয়ে তাঁর সৃষ্টকর্মে প্রবৃত্ত হয়েছেন।মূল্যবোধের যতই অবক্ষয় ঘটুক, সৃষ্টির সিদ্ধিতে তিনি নিরন্তর সুন্দরেরই জয়গান গেয়েছেন।  মাটি ছেড়ে নিসর্গ আকাশের নীলিমায় বিচরণ করেও বিশ্বভরা প্রাণের বিস্ময়ে তিনি পুনরায় মাটিতেই অবতরণ করেছেন। বিদায় নিয়েও তিনি বিদায় নেননি।  কাজ সাঙ্গ করেও সাঙ্গ করেননি। ছুটি ঘোষণা করেও ছুটি নেননি।  ক্ষমা চেয়েও নিজেকে দূরে সরাননি । জন্মান্তর না হলেও জীবনের অপরূপ লীলায় অনন্ত ব্রহ্মেরই স্বরূপে নিজেকে উপলব্ধি করে লিখেছেন

                     ' নূতন প্রেমে ভালোবাসি আবার ধরণীরে।।'

পৃথিবীকে ভালোবাসা যে মানবের মাঝে বাঁচবার ইচ্ছারই প্রতিফলন, তা বলাই বাহুল্য।এই ইচ্ছাই সমূহ গানে, রচনায় প্রকাশিত হয়েছে। সব সৃষ্টিই কবিকে পথ হাঁটার রসদ যুগিয়েছে। জীবনে প্রভাতের সংকেত এনে দিয়েছে।

আমরা কি প্রভাত খুঁজি না? আত্মমুক্তি খুঁজি না? সেই পথের আবিষ্কার করতে চাই না? আমরা তো সবাই 'পান্থ' আর পান্থ-ই তো ' পান্থ জনের সখা'। আমাদের পথ আলাদা, আমাদের সময় আলাদা তবু কোথাও যেন আমরা একই,  সকলেই রবীন্দ্রনাথে সমর্পিত। আমাদের আর শূন্যতার উচ্চারণে স্তব্ধতা এসে যায়।  আমাদের নিমগ্ন যাত্রাপথে আজও ব্যাকুল বাঁশরিয়ার সুর বাজে,  হয়তো সেখানে মানব-মানবীর মুখ, শরীরী ঘ্রাণ,  চুলের গন্ধ, জ্যোৎস্না রাত, ফর্সা পিঠ, কুমারী বুক অপেক্ষা করে থাকে।  এক মায়া-মোহের আবরণে রবীন্দ্রনাথের আকাশ ঢাকা পড়ে যায়।  কামনার প্রবল আশ্লেষে আমরা উষ্ণ হতে থাকি। কিন্তু ম্যাথু আর্নল্ড বলেছিলেন,   সৃষ্টিধর্মী সাহিত্য রচনার পেছনে থাকে ' এ ফ্রেশ স্ট্রীম অফ আইডিয়াজ''  এই আইডিয়াজ অতীত -বর্তমান, স্থান-কালের ঊর্ধ্বে সকল স্রষ্টার কাছেই ধরা দেয়।  যার মধ্যে রয়েছে — ' টু লার্ন এ্যান্ড প্রোপাগেট দ্যা বেস্ট দ্যাট হ্যাজ বিন্ থট্ এ্যান্ড রিস্টিং ইন দ্যা ওয়ার্ড' 

অর্থাৎ জগতের যা কিছু মহৎ সুন্দর ভাবসম্পদ সেসবকে আহরণ করে অকৃপণ দান করাই স্রষ্টার একমাত্র উদ্দেশ্য।  এই উদ্দেশ্য সাধনই যদি সকলের লক্ষ্য হয় তাহলে  ' গীতাঞ্জলি' কেনই বা সর্বযুগে সর্বজনের কাছে ট্রাডিশন হয়ে উঠবে না? ভাষা পাল্টে যাক, ছন্দ পাল্টে যাক, জীবনক্ষেত্রের মরমি সংলাপ পাল্টে যাক, তবু তো এক সাধনার প্রেক্ষাপট হয়ে থাকে।  গান বা কবিতার উৎস যে একই, সুর এবং ছন্দের উচ্চারণে শিহরনের অভিমুখ যে একই গতিতে সাবলীল তা প্রতিটি স্রষ্টা জানেন।  বেঁচে থাকা এবং পরিণতি মৃত্যুতে পৌঁছানোর পথটুকুতে আমরা প্রত্যেকেই   ' ইনভল্ভস অল দোজ হ্যাবিচুয়াল এ্যাকশানস,   হ্যাবিট এ্যান্ড কাস্টমস, ফ্রম দ্যা মোস্ট সিগনিফিকেন্ট রিলিজিয়াস রাইটস টু আওয়ার কনভেনশনাল ওয়ে অফ গ্রিটিং এ স্ট্রেঞ্জার ' —টি এস এলিয়টের একথা মর্মে মর্মে উপলব্ধ হয়।  সুতরাং এই ট্রাডিশনে আমরা আবদ্ধ, যেখানে মানব ধর্মের এক চূড়ান্ত নির্দেশ আছে অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময় মুক্তির স্বাদ আছে ।  এর কি ব্যত্যয় কখনও ঘটতে পারে? সেই প্রজ্ঞা আর উপলব্ধি থেকেই আমরা নির্দেশ পেয়ে যাই জীবনের। জীবনানন্দ দাশ লেখেন —'একটি নক্ষত্র আসে '

                       ' একটি নক্ষত্র আসে, তারপর একা পায়ে চলে
                        ঝাউয়ের কিনারা ঘেঁষে হেমন্তের তারা ভরা রাতে
                        সে আসবে মনে হয়, —আমার দুয়ার অন্ধকারে
                           কখন খুলেছে তার সপ্রতিভ হাতে!'

যুগের ক্লান্তি, মৃত্যু, ক্ষয়, সমাধির ভিড়ে একটি নক্ষত্র এবং  'সে'  প্রেমেরই কাণ্ডারি,  যা রবীন্দ্রনাথের   'মাঝি '   অথবা জীবনদেবতা ।
                শক্তি চট্টোপাধ্যায় 'জ্বলন্ত রুমাল ' কাব্যের  ' এই সিংহাসন, তার পায়ে বাজে '  কবিতায় লিখলেন—
                   ' মুক্তি, মুক্তি করে লোক, সব মুক্তি বন্ধনে জড়িত।
                     শাপের অশ্লেষ যেন বিষে ফেটে চৌচির ভুবন
                     অমৃতের পাত্র ভাঙা, কানাতে শিল্পের কারুকাজ
                      মেখলা সুনীল মিনে, কার কাছে রাজ সিংহাসন!
                      কিন্তু যেতে হবে দূরে, আত্মপরিচিত পথঘাট,
                        না গেলেই বিঘ্ন হবে  প্রিয় যেন প্রোষিতভর্তৃকা।

অসংখ্য বন্ধন তো এখানেও মুক্তির সোপান রচনা করেছে। অমৃতের পাত্র ভাঙা বলেই কানাতে শিল্পের কারুকাজ।   আসলে মৃত্যুতেই সমর্পিত জীবনের আভিসার। প্রিয় প্রোষিতভর্তৃকা, যা রবীন্দ্রনাথেরই  ' বন্ধু'  প্রিয়াতে রূপ ধারণ করেছে।

           শঙ্খ ঘোষ 'শবের উপরে শামিয়ানা' কাব্যের  'জলে ভাসা খড়কুটো: সপ্তম গুচ্ছ' কবিতার  ৫০ নং - এ লিখেছেন —    ' রাতের পেয়ালা শেষ হলে
                       দেবতা ভোরের আলো খান
                       আঙুল এখনও বিজড়িত
                        পুতুলে লাগেনি আজও টান
                          নিঃশেষের কাছে এসে গেলে
                         অপ্রেমিকও প্রেমিক সমান '

রাতের পেয়ালা জীবনেরই রসদ। একদিন ফুরিয়ে গেলে আমাদের ভোরও দেবতার পায়ে সমর্পিত। তখন বাহ্যিক পৃথিবীর মায়া-মোহে প্রাণপ্রতিমার নশ্বর রূপটি পুতুলে রূপান্তরিত। আর সীমানা যখন অসীমে এসে বিলীন হয়, তখন তো আমাদের প্রত্যেককেই প্রেমিক হতে হয় । রবীন্দ্রনাথের মতো বজ্রে বাঁশি বাজাও শুনতে পাই ।  হৃদয় তখন নীরবতার সাধক ।  সেই সাধনাতেই প্রত্যেকেরই উত্তরণ ঘটে।

যুগ বা সময়ের যতই অগ্রগতি ঘটুক,  বোধের গতিময় ফিলিংসগুলি নতুন নতুন ইমেজ বা ভাষাকল্পে আত্মপ্রকাশ করুক না কেন, সৃষ্টির মূলে যে শিব-সুন্দরের প্রকাশ এবং সত্যেরই অন্বেষণ তার ব্যতিক্রম ঘটে না। অস্থিরতার বা অপ্রসন্নতার মালিন্য চিরন্তন হতে পারে না,  এক সময় সার্থকতায়,  পূর্ণতায়, সুন্দরের কাছে স্রষ্টাকে পৌঁছাবার চেষ্টা করতে হয়।  সেই চেষ্টাই রবীন্দ্রনাথ করেছেন। সাম্রাজ্যবাদ,  পরাধীনতার গ্লানি,  অমানবিক শোষণ-অত্যাচার কবিকেও বিচলিত করেছিল।  বিচারের বাণীকে নীরবে নিভৃতে কাঁদতে দেখেছিলেন, তবু একদিন শান্তি ও কল্যাণের অনুপম মাধুর্য বারিধারা বর্ষিত হবে তা জেনেছিলেন।  আত্মআশ্রয়ের ভেতর  ' গীতাঞ্জলি'র পূজা,  বিরহ ও সমর্পণে বিভিন্ন ভাবে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন। আজও আমাদের সেই ঈশ্বরের প্রয়োজন হয়, যাঁকে ধ্রুব সত্যে অনুধাবন করেই আত্মশক্তির জাগরণ ঘটাতে পারি।  আত্মশক্তি না জাগলে আমরাও' হিউম্যান ' হতে পারি না। বৃহত্তর পথে নিজেকে বিস্তৃত করতে পারি না।রবীন্দ্রনাথ সেই ৠষিকল্প জীবনের ধ্যানতন্ময় দীক্ষায় আমাদের প্রশান্তির বিনম্র মাধুর্য দান করে চলেছেন ।তাই একশো বছর পার হলেও' গীতাঞ্জলি 'র প্রাসঙ্গিকতা কোনও অংশেই ক্ষুণ্ণ হয়নি।  ইন্টারনেট, মোবাইল, ফেসবুক যন্ত্রসভ্যতার প্রাচূর্যে এখনও আমাদের হৃদয়কেই হাতড়াতে হয়।  লৌকিক জীবনের বিরহভারকে অতিলৌকিকে আশ্রিত করতে হয় ।সে, তিনি, তার, তুমি, তোমার প্রভৃতি সর্বনামে তাঁরই পূজা করতে হয় । পার্থিব নারীটি বা পুরুষটি প্রেমের স্পর্শেই অপার্থিব হয়ে ওঠেন। 'দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা' এখানেই রবীন্দ্রনাথ সারস্বত জীবনবীণায় সুর ছড়িয়ে দিতে থাকেন। রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করা যায়, কিন্তু বাতিল করা যায় না ।  রবীন্দ্রনাথকে অনুকরণ করা যায় না, কিন্তু স্বয়ংক্রিয়ভাবেই অনুসরণ করা যায়।

কপিরাইট তৈমুর খান কর্তৃক সংরক্ষিত
                              



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন