বাঙালি সমাজ বাংলাভাষা
এবং রবীন্দ্রচিন্তা
,,,," হায় ছায়াবৃত,
কালো ঘোমটার নীচে
অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ
উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে ।
এল ওরা লোহার হাতকড়া নিয়ে,
নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে,
সভ্যের বর্বর লোভ
নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।" ,,,,
বাঙালির সমাজজীবনে দৈনন্দিন যে চিত্রমালা
উপনীত হচ্ছে তা একপ্রকার কুচ্ছিত কঙ্কালসার চিত্র যা ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠছে
অনেকেই। পৃথিবীর সৃষ্টিকাল থেকে আদিম সভ্যতার প্রান্ত ছুঁয়ে মানবজীবন যে পথে, যে সামাজিক
ব্যবস্থার সংস্পর্শে বেড়ে উঠেছে এবং সুখের চাইতে সৌন্দর্যের মুকুট আঁকড়ে ধরে
থেকেছে তা কল্পনাতীত। সুখ যা ছিল তার চেয়ে বেশি কিছু ছিল সৌন্দর্য, মনুষ্যসমাজ সুখি থাকত এই সৌন্দর্যকে জড়িয়ে ধরে। খাওয়া দাওয়া ,আরাম বিশ্রাম,ক্ষুধা তৃষ্ণা ছিল সুখের অঙ্গ আর
আনন্দ বিহ্বলতা,উন্মত্ততা আর শারীরিক বিশ্বাস ছিল
সৌন্দর্যের কাঠামোগত প্রক্রিয়া। এখনও
সুখে-দুঃখে বাঙালি যেমন নির্বিকার, তেমনি
কাঙালিপনার বৃত্তে আবর্তিত। যুগে যুগে সামাজিক তপ্তশাসনে, নিয়ম নিগূঢ়ে আবদ্ধ বলেই তার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর অবরুদ্ধ। বিদ্রোহ বা
বিদ্বেষী নয়, বিদ্রোহ অর্থে পরিবর্তন, ভাল থেকে ভালতর, সুখ থেকে উন্নত সুখ, উন্নয়নউন্নয়নশীল সমাজ
কাঠামো গড়ে তোলার সংকল্প। বাস্তবিকক্ষেত্রে, বাঙালি জাতি
আজ সেই অর্থে আত্মকেন্দ্রিক ও আত্মলোভী। সামাজিক মানুষ জীবন যাপনের তাগিদে,
জীবিকা অর্জনের স্বার্থে সামাজিক অবয়বী রূপের পরিবর্তনে ব্রতী হয়,
সমাজকে বুকের রক্ত দিয়ে তিল তিল করে গড়ে তোলে, সুদৃশ্য অট্টালিকা নির্মাণ সম আপনি সংবদ্ধতাকে সুদৃঢ় করে
এসেছে।দারিদ্র্য যেহেতু ছিল জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, নিপীড়ন ছিল উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ, নির্যাতন ছিল
অদৃষ্টবাদী লিখনকল্পনা, যার দ্বারা চালিত হত গোটা জাতি,
সমগ্র পৃথিবী একদিন ।
আবদ্ধ খাঁচার দরজা ভেঙে বেরিয়ে এলো একদিন
মানুষ। সত্যালাপের কারণে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল জিওর্দানো ব্রুনোকে, সেই অমোঘ
সত্যকে স্বীকার করতে আজ কারো হাতপা শীতল হয় না, হৃদয়ের
নীড়ে কম্পন আসে না, সক্রেটিসকেও হেমলক পানে বাধ্য করা
হয়েছিল, কিন্তু আজকে আর ততটা বাধ্য করা যায় কি ? কিন্তু এর পেছনে ষড়যন্ত্রের শিকড় গভীরে চালিয়েছে, পিছু ছাড়েনি সুসভ্য যুগেও, একবিংশ শতকের
পাদস্পর্শে পৌঁছেও। এক দেশ, এক জাতি,এক নীতি এক আদর্শ নিয়ে কেউ কেউ কল্পনা করেন, কেউ
আবার পৃথিবীকে একটা গ্রাম বলে ভাবেন বিশ্বায়ণের লেজ ধরে নদী পেরিয়ে যেতে, অথচ কী দেখছি আমরা গ্রামে গ্রামে আগুন জ্বলছে, মানুষ মুক্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু করছে,চারিদিকে
তীব্র আর্তনাদ শুধু বাঁচার বাঁচতে, তখনও একদল ঘোমটার তলে
ক্রুর হাসি মেখে শোষণ যন্ত্রটাকে দানবীয় আকারে সমাজে নিক্ষেপ করতে দ্বিধাবোধ করছে
না । মানুষরূপী জন্তুর অন্ধকার হাতে শোষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে স্বার্থ, লোভ, ক্ষমতা, দম্ভ ও
উগ্র প্রতিযোগিতা মূলক সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধতাকে জিইয়ে রাখতে ।
১৯৭৪ এর পূর্বে বাঙালি
অখণ্ড জাতি হিসেবে এক আত্মার আত্মীয়তার বন্ধনে ছিল আবদ্ধ । ভারত বিভাজনের হাত ধরে
কৌশলে বাঙালি জাতির হৃদয়কে দু'টুকরো করা হলো কিছু
স্বার্থান্বেষী, ক্ষমতালোভী কিছু অর্বাচীন মানুষের উগ্র
লালসার শিকার হয়ে। ভারত বিভাজনের ভেতর দিয়ে বাঙালির চেতনালোকে আঘাত হানে, শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সমাজে ব্যাপক ভাঙন লক্ষিত হয়।
চিন্তা চেতনার দিক দিয়ে বাঙালি জাতির মেরুদন্ডে চিড় ধরে, সমাজের উন্নতি ও কল্যাণ কল্পে ব্যাঘাত ঘটে। ঘুণধরা সমাজের যে কঠিন অসুখ,নিরাময় ঔষধের প্রয়োগ ঘটিয়ে বাঙালি সমাজকে সুস্থ ও স্বাভাবিক করার
চেষ্টা ছিল সর্বক্ষেত্রে। অন্ধকার সমাজকে আলোকিত করতে আলোর রথ নিয়ে উপনীত হলেন
রবীন্দ্রনাথ। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন,
সেই প্রতিষ্ঠানে নতুন উদ্যোগে শান্তির শ্বেত পতাকা উড্ডীন করতে
সচেষ্ট হন বিশ্বকবি। বাঙালি সমাজ এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা দেখতে পেল পশ্চিমাকাশে।
বাঙালির ভাষা ও সাহিত্য পেল এক নতুন জীবন ও নতুন বার্তা। ১৯১৩ সালে নোবেল
পুরস্কারের হাত ধরে বাংলাভাষা সমাদর পায় বিশ্বসাহিত্যে। পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫২
সালের ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত পথ ধরে বাঙালির ভাষা সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। সেই
রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম থেকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ' হিসেবে ভাষা স্বীকৃতি পায় এবং তার প্রেক্ষিতে বাংলাভাষা সজীব ও জীবন্ত
হয়ে ওঠে । বিশ্বে অন্যতম ভাষা হিসেবে সমাদৃত হয়। চর্যাপদ থেকে আধুনিককালে সৃজিত
সাহিত্য তার মূলেও বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও।
' দুধে ভাতে বাঙালি '
আর 'সহিষ্ণুতার বাঙালি ' মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ইতিহাসের পাতায় দু'দুটি
মহাযুদ্ধ ঘটেছে, মানুষ দেখেছে তাদের আস্ফালন, পারমাণবিক অস্ত্রের হুঙ্কার, তার প্রয়োগে
বিশ্বের মাটি থরথর, কম্পমান। বিভাজিত হয়ে জার্মান জাতি দু'টুকরো
হয়ে যায়, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও
সাম্রাজ্যবাদ উপনিবেশবাদ সত্ত্বা দিয়ে গ্রাস করে একাধিক দেশ। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের
অস্তাচল ঘটে, সোভিয়েত
ইউনিয়নের রমরমা বেড়ে যায়। বহুমাত্রিক পরিবর্তনের ফলে বামপন্থা ও দক্ষিণপন্থা
রাজনীতির বিভেদ স্পষ্টতর হয়, দুইমেরুতে বিশ্ব বিভাজিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে সোভিয়েত
ইউনিয়নের পতনে বামপন্থা ধাক্কা খেলে দক্ষিণপন্থা
থেকে অতি দক্ষিণপন্থা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। রাজনীতি আর অর্থনীতি পরস্পরের
সাথে জড়িত থাকার জন্য সমাজের উন্নতি নির্ভর করে তাদের উপর। এককেন্দ্রিক
সাম্রাজ্যবাদ আবার বিশ্বকে একমেরু করে নিজ করায়ত্তে রাখতে চায়। এর ফলে জন্ম নেয়
জাত্যভিমান, জাতি
বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা, স্বার্থপরতার; বিকেন্দ্রীকরণনীতি
গুটিয়ে গিয়ে এককেন্দ্রিকতার ঝোঁক বৃদ্ধি পায়। বিশ্বায়ণের নামে কতিপয় ব্যক্তি
বিশ্ববাজার দখল করে নেয়। ফলে বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল হয়ে পড়ে, লগ্নি
পুঁজির রমরমা ঘটে,
মানুষ দিশেহারা হয়ে যায়,ভারসাম্য হারায় দুনিয়া।
রবীন্দ্রনাথ
শান্তিনিকেতন এসে গ্রামীণ সমাজজীবনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন। তিনি অনুভব
করেন যে, লক্ষ
লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা অভুক্ত থাকছে।
নিরন্নতা তাদের গ্রাস করে আছে, তাদের বেঁচে থাকার ন্যুনতম অধিকার লুণ্ঠিত হচ্ছে, উগ্র
উপনিবেশকতার করালগ্রাসে এবং জমিদার, জোতদারদের অতি মুনাফার দীর্ঘ
হস্তের হস্তক্ষেপে তারা অর্থহারা, প্রকৃতির পাঠশালায় যে অফুরন্ত শিক্ষাসূচি আর অনন্ত উৎপাদনের
ক্ষেত্র যথেষ্ট থাকা সত্ত্বেও অব্যবহারযোগ্য ও অনুর্বর থেকে গেছে। যদি তাকে সহায়তা
করা যায় তাহলে সবুজে শ্যামলে বিজন ভূমি সোনালি সম্পদে,ফসলে ফুলে
দুলে উঠবে। তিনি পুত্র রথীন্দ্রনাথকে কৃষি বিদ্যা লাভের জন্য বিলেতে পাঠালেন,প্রতিষ্ঠা
করলেন শ্রীনিকেতন,
পল্লী নির্ভর এক নতুন সমাজ সংকল্প। শিক্ষা,সমবায়, সংস্কৃতি
ইত্যাদি বিষয়ের উপর জোর দিলেন, গড়ে তুললেন সমবায় ব্যাঙ্ক। যে ব্যাঙ্ক গ্রামীণ কৃষক সমাজকে
সহজ,সরল
সুদে ঋণদান করবে, প্রকল্প
চালু করলে যাতে গরীব,
প্রান্তিক চাষিদের স্বনির্ভর ও আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে
পারেন । এক সামাজিক বিপ্লব ঘটালেন তিনি । বাঙালি সমাজ ঘুরে দাঁড়াতে শিখল, আর্থিক
দোদুল্যমানতা পরিহার করে মানুষ নিবিষ্ট হতে শিখল, কৃষি কাজ মন দিয়ে করে স্বোপার্জিত
সম্পদে, অর্থের
বিনিময়ে জীবনকে সুখি ও সুসংবদ্ধ করতে উদ্যোগী হলো। বাঙালির আচার, অনুষ্ঠান, কৃষ্টি ও
সংস্কৃতি নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে জাতিকে ঋদ্ধ করে তুলতে শিখল, স্বাবলম্বী হতে লাগল। বাঙালি
হৃতগৌরব ফিরে পেল,
সোনালি জাগরণ ঘটল দারিদ্র্য সংকুল, ক্লিষ্ট
বাঙালির মেরুদন্ডে।
জাতি দাঙ্গা
আজকে নতুন নয়। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের দেশ শাসনের কূট কৌশলে সৃষ্ট হিন্দু মুসলমান
বিভাজননীতি বাঙালির জীবনের এক বড় অভিশাপ। বাঙালি জাতি চিরকালই সহজ, সরল, উদারচেতা, সেই
উদারতার সুযোগে বিষ ঢালার কাজে সক্ষম হয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। ফলে জাতি দাঙ্গা
মাঝেমধ্যে মাথা চাড়া দিত। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে
রাখী বন্ধনে আবদ্ধ করে এক করে রাখতে। তিনি মনে করতেন যে, শুধুমাত্র
হিন্দু সম্প্রদায়ের উন্নতি হলেই দেশ এগিয়ে যেতে পারে না, অপর
স্বল্পাংশ মুসলিম ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়েরও উন্নয়ন ঘটানো প্রয়োজন। এক
সম্প্রদায়ের সাথে অন্য সম্প্রদায়ের যাতে বিরোধ বৃদ্ধি না ঘটে তারজন্যও কবি শেকড়ের
দিকে দৃষ্টিপাত করেছেন। মানুষ মানুষের সেবায় যখন কোনো কাজে আত্মনিয়োগ করেছে, কবি তাতে
গভীর সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ১৯৩৩ সালে সাম্প্রদায়িক বিরোধ প্রসঙ্গে একটি চিঠিতে
তিনি সিরাজগঞ্জের আবুল মনসুর এলাহী বক্সকে লিখেছিলেন, " তোমরা যে
সেবক সংঘের প্রতিষ্ঠা করেছ তার উদ্দেশ্য মহৎ। ঈশ্বর তার সহায় হবেন। মানুষের দুঃখ
দূর করা ঈশ্বরের উপাসনার শ্রেষ্ঠ অঙ্গ। তোমরা সেই শ্রেয় সাধনায় ব্রতী হয়েছে, তার সফলতা
চিরদিন অন্তরে বাহিরে তোমাদের অনুবর্তী হোক এই আমার সর্বান্তকরণের আশীর্বাদ।
বাগদাদ মরুভূমিতে একজন বেদুয়িন দলপতি আমাকে বলেছিলেন যে, যার বাক্যের
দ্বারা, কর্মের
দ্বারা কোনো মানুষ পীড়িত হয় না তিনিই যথার্থ মুসলমান ।" রবীন্দ্রনাথ মুসলমান
সমাজকে বারবার বোঝার,
জানার চেষ্টা করতেন,হতদরিদ্র মুসলমান পরিবারে পৌঁছে
যেতেন।
' ইতিহাসের গতি নিরন্তর।
হরপ্পা আর মহেঞ্জোদড়োর প্রাক্ আর্য সংস্কৃতি, বৈদিক সংস্কৃতি, জৈন
সংস্কৃতি, বৌদ্ধ
সংস্কৃতি, বেদ
বিরোধী লোকাচার, গ্রিক, শক, হুণ, পাঠান, মোগলের
অনুপ্রবেশ, জনজাতিদের
গোষ্ঠীবদ্ধ সংস্কার,
দ্রাবিড়ের সংস্কৃতি, ব্যাপক মুসলমান সংস্কৃতি, বিচিত্র
হিন্দু সংস্কৃতি ইত্যাদি মিলেমিশে একাকার ভারত ভূমিতে।' ভারতীয়
সমাজজীবনে এর প্রভাব পড়ে নিঃসন্দেহে। বিভিন্নতা আর বৈচিত্র্য চিন্তা চেতনার সাথে
জাতি একাকীভূত হয়ে গেছে। ভিন্ন ভিন্ন কালখণ্ডে বহুজাতিক মহামিশ্রণের সূত্রে গড়ে
উঠেছে ভারতীয় স্বরূপ ও সংস্কৃতি। বাংলা ভাষায় ভারতবর্ষকে প্রথম 'জননী ' হিসেবে
সম্বোধন করেন কবি ঈশ্বর গুপ্ত, "জননী ভারতভূমি আর কেন থাক তুমি ধর্মরূপ
ভাষা হীন হয়েছ ,' তাই
ভারত-সংস্কৃতিই হচ্ছে সত্যের ধর্মের আচরণের। উপনিষদ বলছে,'সত্যংবদ,ধর্মংচর, স্বাধ্যায়ন
মা প্রমদঃ'।সত্য
বল, ধর্ম
আচরণ কর,স্বাধ্যায়
থেকে বিরত হয়ো না।'
রবীন্দ্রনাথ 'ব্রাহ্মণ ' কবিতায়
বলেছেন -' অগ্রাহ্য
নহে তুমি তাত !
তুমি দ্বিজোত্তম, তুমি
সত্যকুল জাত।'
'ভারততীর্থ
' কবিতায়
ভারততীর্থ বন্দনা করতে গিয়ে লিখেন যে, মহামানব সাগরতীরে সবকিছু মিলেমিশে
একাকার হয়ে গেছে।
" এসো হে
আর্য, এসো
অনার্য, হিন্দু
মুসলমান
এসো এসো আজ
তুমি ইংরাজ, এসো
এসো খৃষ্টান ।
এসো
ব্রাহ্মণ, শুচি
কর মন, ধরো
হাত সবাকার
এসো হে
পণ্ডিত, হোক
অপনীত সব অপমান ভার।
মার
অভিষেকে, এসো
এসো ত্বরা, মঙ্গলঘট
হয়নি যে ভরা
সবার
পরশে পবিত্র করা তীর্থ নীরে
আজি
ভারতের মহামানবের সাগরতীরে ",,,
বহুধা বিস্তৃত ভারত, বহুমুখী রুচি, সংস্কৃতি
ও ভাষার দেশ। এখানে ঐক্য যেমন সংবদ্ধ, তেমনি বিভেদও আছে অনিবার্যভাবে। এই
অনিবার্যতাকে জাগিয়ে তোলা,
তার থেকে মুনাফা লাভ করার চরিত্র লক্ষিত হয় রাজনৈতিক
দলগুলোর,যা
সামাজিক বিভাজনে ঘৃতাহুতি দিয়ে থাকে। প্রতিটি দেশে বিভিন্ন বহিরাগত জাতির আগমন ও
প্রত্যাগমনের ভেতর দিয়ে দেশে যে মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, তার বন্ধন
সুদৃঢ় ও শক্তিশালী হয়। বাঙালি জাতিও সেই গুণের দ্বারা লালিতপালিত হয়ে সংস্কৃতি
সমন্বয়ের মধ্যদিয়ে শক্তিশালী জাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। কিন্তু আজ যে রাজনীতির
কোলাহল ও ভয়ের পরিবেশ রচিত হয়েছে তা সমাজের ভেতরের বিষয় নয়, বরং বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া
হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ১৯১০ সালে জুলাই, ৪ কাদম্বিনী দেবীকে একটি চিঠিতে
লিখেছেন," আমাদের
দেশে ধর্মই মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রভেদ ঘটিয়েছে। আমরাই ভগবানের নাম করে পরস্পরকে
ঘৃণা করেছি। স্ত্রীলোককে হত্যা করেছি, শিশুকে জলে ফেলেছি, বিধবাকে
নিতান্তই অকারণে তৃষ্ণায় দগ্ধ করেছি, নিরীহ পশুদের বলিদান করেছি এবং সকল
প্রকার বুদ্ধি যুক্তিকে একেবারে লঙ্ঘন করে এসব সকল নিরর্থকতার সৃষ্টি করেছি যাতে
মানুষকে মূঢ় করে ফেলে। "
১৯৮০ সালে 'গণপতি
উৎসব' ও
' শিবাজী
উৎসব' ও
গো-রক্ষা প্রভৃতি আন্দোলনের ফলে ভারতে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক
ও সাম্প্রদায়িক বিরোধ ও সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র ব্রিটিশ
উপনিবেশিক শাসকদের ষড়যন্ত্রমূলক ভূমিকাকে দায়ী করেননি, আমাদের
জাতীয় অনৈক্য ও সম্প্রদায়ভিত্তিক বিরোধ সংঘর্ষে অতীত থেকে রাষ্ট্রতন্ত্রীয় একতার
অভাবকেই দায়ী করেন। প্রাদেশিকতা আমাদের বিচ্ছিন্ন করেছে। " আমরা প্রাদেশিক, আমরা
পল্লীবাসী; বৃহৎ দেশ ও বৃহৎ সমাজের উপযোগী
মতের উদারতা, প্রথার
যুক্তি সংগতি এবং সাধারণ স্বার্থ রক্ষার উদযোগপরতা আমাদের মধ্যে নাই। " এই
ব্যাধির মূল কারণগুলিও চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি বলছেন, " বর্তমান
কালে হিঁদুয়ানির পুনরুত্থানের যে হাওয়া উঠিয়াছে, তাহাতে অনৈক্যের ধুলা সেই
প্রাদেশিক ও ক্ষনিক তুচ্ছতা গুলিই উড়িয়া আসিয়া আমাদিগকে আচ্ছন্ন করিয়াছে।"
সেই লক্ষ্যকে উচ্চে তুলে সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগ শুরু হয়েছে। তাই, ভারতের
সংবিধান সংশোধন করা হচ্ছে,
সি এ এ আনা হয়েছে, যা সংবিধানের ১৪ নং ধারাকে
অগ্রাহ্য করেই; লঙ্ঘিত
হয়েছে সংবিধানের মূল আদর্শ। জাতীয় নাগরিক পুঞ্জিকরণের অজুহাত দিয়ে একশ্রেণির
নাগরিককে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা হচ্ছে ও 'অনুপ্রবেশকারী' তকমা
লাগিয়ে দেওয়ার অপপ্রয়াস চলছে। সেই সঙ্গে জোরালো মতবাদ প্রচার করে তাদের দ্বিতীয়
শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে রাখার অপচেষ্টাও হচ্ছে। সংবিধানে যে গণতন্ত্রের কথা উল্লেখ
করা আছে, সমাজতান্ত্রিক
চিন্তা চেতনার স্থান রয়েছে সেখানে গণতন্ত্রই বিপন্ন। সুবিধাবাদী আর সুবিধাবিহীন
বিভক্তিকরণের ভেতর দিয়ে গণতন্ত্রের অসামঞ্জস্য ও সংগতিহীন প্রথাকেই প্রকাশ হতে
দেখা যাচ্ছে,যা
কাঙ্খিত নয়। গণতন্ত্র শক্তিশালী না হলে, সুস্পষ্টভাবে জনস্বার্থে ব্যবহার
করা না হলে দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়, তা ক্রমশ স্পষ্ট,,,, দেশভাগের মধ্যদিয়ে যে অনুচিত কাজ হয়েছে, আজকে তার
খেসারত বাঙালি জাতিকে বহন করতে হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন এক অখণ্ড বাংলা, অখণ্ড
ভারত; 'রাখী
বন্ধন ' সূচনা
করে বিশেষ করে দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে মিলন সেতু গড়ে তোলার প্রচেষ্টা
করেছেন। বাংলাকে, বাঙালি
জাতি ও সমাজকে একটি সুতোয় বেঁধে রাখতে চেয়েছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দও কষ্ট পেয়েছেন, ব্যথিত
হয়েছেন, ও
বলেছেন," যে
দেশে কোটি কোটি মানুষ মহুয়ার ফুল খেয়ে বেঁচে থাকে, আর দশ বিশ লাখ সাধু ও ক্রোড় দশেক
ব্রাহ্মণ ঐ গরীরদের রক্ত চুষে খায় অথচ তাদের উন্নতির কোন চেষ্টা করে না, সে কি দেশ, না নরক ? সে কি
ধর্ম না পৈচাশ নৃত্য।"
" হেথায়
দাঁড়িয়ে দুবাহু বাড়িয়ে
নমি
দেবতারে -'
বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের ক্ষমতাকে রবীন্দ্রনাথ
মানবিক সহজ প্রবণতা বলে বিশ্বাস করেন। ' পরকে আপনি করিতে প্রতিভার প্রয়োজন '। সেই
সুবুদ্ধি শাসকের কাছে কাম্য প্রতিটি নাগরিকের।
কপিরাইট নাসির ওয়াদেন কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন