শেষের কবিতা
নাকি কবিতা নয়
কোথাও
একটা পড়েছিলাম কেউ একজন বলছেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এত নাচানাচি কেন বুঝিনা বাপু। কি
যে ছাতার মাথা লিখে গেছেন নিজেই জানেন না। 'শেষের কবিতা' নামে একটা লেখা নিয়ে
দারুণ হৈ চৈ তারপর জানা গেল ওটা নাকি একটা নভেল...ভাবুন। আরে বাবা পদ্য কি গদ্য যে
লিখেছে সে নিজেই জানে না। আর লোকে তার ব্যাপারে না জানলে এত গেল গেল রব কেন মশাই? ঠিক তাই, রবীন্দ্রনাথ ৫২ টি
কাব্য গ্রন্থ,
৩৮ টি
নাটক, ১৩ টি উপন্যাস, ৩৬ টি প্রবন্ধ রচনা
করেছিলেন। যা নানা সময় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি মোট ৯৫টি ছোট গল্প এবং ২০০০এর
কাছাকাছি গান রচনা করেছিলেন যেগুলি যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতানে পাওয়া যায়।
রবীন্দ্ররচনাবলীর ৩২ খণ্ডে রবীন্দ্র নাথের যাবতীয় রচনা সংকলিত আছে।
গীতাঞ্জলি
কাব্যগ্রন্থের অনুবাদ করে তিনি নোবেল পুরস্কার পান। সর্বোপরি তিনি ভারতের ও
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা ও সুরকার। এতো এতো লিখেছিলেন বেশ করেছেন। বড়
লোকের ছেলে পেটের দায়ে অফিস কাছারি ছুটতে হয়নি বসে বসে খাতার পাতা ভরিয়েছেন।
ভাগ্যটা বিশেষ ভাবে ভালো ছিল তাই সেই সব গান কবিতা গল্প বিপুলার্থে মানুষ গ্রহণ করেছে। দেশে এবং বিদেশে ব্যাপক হারে তাঁর
গ্রহণ যোগ্যতা। কিছু কিছু মানুষ একটা জাতির উৎসব হয়ে ওঠে, সংস্কৃতির মুখ হয়ে দাঁড়ায় ইনি
তেমনই একজন। হিন্দুদের তেত্রিশ কোটি দেব দেবী ছিলই আরো এক যোগ হলো। সেটা তাঁর
লেখার গুণে নাকি ঠাকুর পদবীর জন্য জানা নেই…এই কথা গুলো জন্য
ক্ষমা কোরো রবিঠাকুর কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এগুলো না বলে পারা গেল না।
রবীন্দ্রনাথ
সম্বন্ধে শিশুরাও যা জানে: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে ১২৬৮
খ্রীস্টাব্দের ২৫শে বৈশাখ জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৩৪৮ খ্রীস্টাব্দের ২২ শে শ্রাবণ
দীর্ঘ রোগভোগের পর দেহত্যাগ করেন। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাতা
সারদাসুন্দরী দেবী। বর্ণাঢ্য জমিদার বংশে জন্ম গ্রহন করেও ছেলেবেলায় বাড়ির
চাকরবাকরদের কাছে মানুষ হন রবীন্দ্রনাথ। প্রথাগত শিক্ষা অর্থাৎ স্কুল কলেজে গিয়ে
পড়া এই ব্যবস্থার সাথে কোনো ভাবেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেননি তাই বাড়িতেই গৃহশিক্ষকের কাছে লেখাপড়া শুরু করেন।
সাহিত্যানুরাগ ছিল ছেলেবেলা থেকেই । আট বছর বয়সে প্রথম কবিতা লেখেন নাম 'অভিলাষ'। তারপর এই যাত্রা
আর থামেনি।
এর চেয়ে ঢের ঢের তথ্য
রবীন্দ্রবিষয়ক যেকোন বইতে পাওয়া যাবে। তবে কেন বলা? বলা এই কারণে যে এত কিছুর পরেও
তাকে নিয়ে মাতামাতি বছরের মাত্র দুটি মাসে দেখা যায়। বৈশাখ আর শ্রাবণ। 'হে, নুতন দেখা দিক বারবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ' ...পঁচিশে বৈশাখ মানেই
এই গানটা। এটি তখন বাঙালির জাতীয় সংগীত হয়ে ওঠে। কিন্তু এই গানেরই পরের লাইনটা ? 'তোমারও প্রকাশ হোক
কুহেলিকা করি উদঘাটন সূর্যের মতোন ' নাঃ এটা নিয়ে বাঙালি ভাবে না, ভাবেনি। তাই নিজেকে, নিজের স্বকীয়তাকে
তুলে ধরার,
প্রকাশ
করার, অন্ধকার চিরে আলোর
উৎসে পৌঁছবার চেষ্টা আমরা করিনি। আমরা রবিছায়ায় থাকতে ভালোবাসি, সুরক্ষিত বোধ করি।
তাই জন্মদিন সে রবিঠাকুরেরই হোক কি নিজেদের শুধু ক্যালেন্ডারের একটা দিন, বছর বছর ফিরে ফিরে
আসে শেষে পড়ে থাকে শুকনো রজনীগন্ধা আর ধূপের ছাই। গীতবিতান তাকে গিয়ে ওঠে । মাস
তিনেক পর আবার ধুলো ঝেড়ে ২২শে শ্রাবনের আগে নামালেই হবে। তখনকার জন্য আবার অন্য
গান। 'আছে দুঃখ আছে মৃত্যু
তবুও শান্তি তবু আনন্দ জাগে..' অথবা আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে/ এ জীবন পূর্ণ করো দহন
দানে'। জীবনের মতোই
মৃত্যুও ওনার চোখে সমান সুন্দর...সমান
সমাদৃত। কিন্তু একটা ফ্যাশন অনেকের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় সেটা হলো মৃত্যুবিলাস। 'তারার পানে চেয়ে
চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে' বাঙালির মন নিজেকে নিয়ে এতটাই আত্মবিশ্বাসী এবং নিজেকে
এতটাই পরিহার্য্য মনে করে যে এই গানের ব্যাখ্যা তাদের কাছে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল এর
মতো। মৃত্যুর পরেও আমায় মনে রেখো সে আমি জীবনে মনে রাখার মতো কিছুই নাই বা করি তবু
মনে রেখো। প্রচ্ছন্ন দাবী.. অনুরোধ নয়। কবি কি এই গানে এটাই বলতে চেয়েছিলেন?
আজকের বঙ্গজীবনে অধিকাংশের
কাছেই রবীন্দ্রনাথ একটা ফ্যাশন, প্যাশন নয়। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। কলকাতার এক নামী
স্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তী খুব আড়ম্বরে প্রতি বছর পালিত হয়। মাসাধিককাল রিহার্সাল
চলে। অনুষ্ঠানের দিন ছাত্ররা সাদা পাজামা পাঞ্জাবি আর ছাত্রীরা সাদা শাড়ি মাথায়
জুঁই ফুলের মালা, শিক্ষক শিক্ষিকাদের সাজ সজ্জাও রুচিশীল মার্জিত। হঠাৎ স্কুল
প্রাঙ্গনে ঢুকে পড়লে মনে হবে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে চলে এসেছি হয়তো। অনুষ্ঠান
খুবই সুন্দর ভাবে এগোতে থাকে। সমাপনও হয় সময় মতো। তারপর ওঠে সেল্ফি ঝড়। বৈশাখে
একটু আধটু ঝড় না উঠলে কিসের বৈশাখ! হাত উঁচু করে গলা তুলে ঘাড় কাত করে নানা
বিভঙ্গে উঠতে থাকে সেল্ফি...ব্যাকড্রপে রবীন্দ্রনাথ…এর পর ফেসবুকে পটাপট
পোস্ট। ক্যাপশন : ফিলিং কুল ইন আর.জে ডায়েরি । অসাধারণ অপূর্ব লিখেও প্রশ্নটা করেই
ফেললাম। আর.জে ডায়েরিটা কি রে ? উত্তর এলো "রবীন্দ্র জয়ন্তী ডায়েরি…"
প্রবাসী বাঙালিদের কাছে
রবীন্দ্রনাথ নিজেদের সাহিত্যমনস্কতা প্রমাণ করার এক এবং একমাত্র হাতিয়ার। সবাই তাই
এমন নয়। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে তারা হয়তো মন থেকে তাদের প্রাণের ঠাকুরের পুজো করেন।
বিভিন্ন সাহিত্যসভা আয়োজন করে রবীন্দ্রনাথকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কিন্তু অধিকাংশের
কাছেই রবীন্দ্রনাথ একটি উৎসব। নাটকে বারবার ঘুরে ফিরে আসে 'চিত্রাঙ্গদা' ও 'শ্যামা'। 'তাসের দেশ' কখনো সখোনো আর 'রক্তকরবী' খুব কম অভিনীত হয়।
কারণ এই দুই নৃত্য গীতি নাট্যের মূল সুর অনেকের কাছে আজও অধরা। বিশু পাগলা অনেকের
প্রিয় চরিত্র। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ভাবে রাজাকে ভালো লেগেছিল। এখানেই
রবীন্দ্রনাথের জয়। মন্দের মধ্যেও ভালো আছে ভালোর মধ্যেও মন্দ। আসল তো দৃষ্টিভঙ্গি
এবং সেটা নিজের হওয়া খুব জরুরি। শুধু রবীন্দ্রনাথ পড়লেই সমাজ দর্শন এবং জীবনদর্শন
অনেকটাই বদলে যায়। চাই শুধু মুক্ত মন…যাই হোক প্রবাসে নাটকের কথায়
ফিরে আসি,
এখানে
কোথাও কোথাও আবার স্ক্রিপ্ট ইংরেজি ফন্টে লেখা। কারণ হিন্দি ইংলিশ জানলেও
"আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না"...ওদের কাছে রবীন্দ্রসংগীত হলো টেগোর
সং। রিহার্সাল চলতে থাকে। অনুষ্ঠানের দিন নাটকের যবনিকা পতনের পরে আমরা সমবেত
হাততালি দিই। হল থেকে বেরোতে বেরোতে বলি সত্যি প্রবাসেও কি সুন্দর করে বাংলা
সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছি আমরা...সাদা চাদরে ঢাকা টেবিলের ওপর রবীন্দ্রনাথের ছবিটি
অবিচল দৃষ্টিতে সব কিছু দেখে…
স্বামী বিবেকানন্দ এবং
রবীন্দ্রনাথ নিজের সময়ের থেকে সম্ভবত একশ বছর এগিয়ে ছিলেন। আত্মপ্রতিষ্ঠার মধ্যে
দিয়ে আদতে বাঙালিকে জগৎ সভায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কুপমণ্ডূক জাতিটিকে স্বপ্ন
দেখতে শিখিয়ে ছিলেন। নিজের কর্ম দেশদেশান্তরে ছড়িয়ে দেবার সাহস জুগিয়েছিল।
রবীন্দ্র পূর্ববর্তী বাংলা সাহিত্য এবং রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা সাহিত্য এই দুই
ভাগে যদি ভাগ করা হয় তাহলে বলা যেতে পারে রবীন্দ্রনাথ একটি সেতু বা পথ যার সাহায্য
ছাড়া বা যাকে অতিক্রম না করে বাংলা সাহিত্য আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে পৌঁছাতে
পারতো না। শুধু বঙ্কিমী ভাষার প্রভাব মুক্তি নয় মন, মনন ও চিন্তনে বাঙালি এবং বাংলা
সাহিত্য আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেটা এক প্রকার অসম্ভব ছিল। রবীন্দ্রবিরোধী অথবা
রবীন্দ্র সমালোচকদের হয়তো স্বীকার করতে কষ্ট হবে কিন্তু যে ভাষায় যে ভঙ্গিতে
রবীন্দ্র সমালোচনা তারা করেছেন সেটা অনেকটাই রবীন্দ্রনাথের দান । তারা হয়তো বলবেন
বঙ্কিমি সাহিত্য যুগযুগান্তর চলতো না। তার সরলীকরণ কেউ না কেউ করতোই। হ্যাঁ, একদমই তাই। তবে
এক্ষেত্রে তার পথিকৃৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর লেখা ছোট গল্পগুলো আমাদের জীবনের
প্রতিচ্ছবি। 'চোখেরবালি' সম্ভবত সেই সময়ের
একমাত্র সাহসী ও প্রাপ্তমনস্ক উপন্যাস। 'গোরা' সমাজ দর্পন, 'ঘরে বাইরে' এক চিরকালীন শিক্ষা। এগুলো
কেবলমাত্র সাহিত্য উপাদান নয়, শিক্ষা ও মূল্যবোধ
তৈরির এক একটা অধ্যায়। 'নষ্টনীর' অথবা 'ঘরে বাইরে'র সারমর্ম যদি কোনো পাঠকের কাছে পরকীয়া হয় সেটা
রবীন্দ্রনাথের পরাজয় নয় পরাজয় পাঠকের যা রুচিহীনতার নামান্তর। চন্দরা, বিমলা, চারুলতা, লাবণ্য, মৃন্ময়ীদের মাধ্যমে
বাংলার বিভিন্ন স্তরের নারীদের প্রতি বার্তা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। শুধু নারী নয়
একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে আয়নায় দেখো। রক্তকরবীর নন্দিনীর বারবার রাজাকে প্রশ্ন
করা বলে দেয় ঠিক বেঠিকের হিসেব নিকেশ করার, রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করার অধিকার
নারীরও আছে। রবীন্দ্রনাথের 'নষ্টনীড়' এ চারুর কাদম্বরীর ছায়া দেখা যায় এই আবর্তেই ঘুরতে থাকে
অধিকাংশ বাঙালি যা কিনা দুর্ভাগ্যের।
রবীন্দ্রনাথ আপামর বাঙালির চোখে
কবি হওয়ার স্বপ্ন এঁকে দিয়ে যান। কম বেশি সবাই স্কুল কলেজে কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখা
শুরু করে। সেদিক থেকে বিচার করলে রবীন্দ্রনাথের কবি স্বত্তাটিই সবচেয়ে প্রবল ভাবে
মানুষের মনের কাছাকাছি। দুঃখ শোকে প্রেমে বিরহে রবিঠাকুর ভরসা। এভাবেই শুরু
রবীন্দ্রচর্চা। তবে এখানে একটা বিষয় ভাবতে হবে মুখ উঁচু করে রাবীন্দ্রিক স্টাইলে
দুকলি গীতবিতান দেখে বা না দেখে গেয়ে ওঠার নাম রবীন্দ্রচর্চা নয়। যেমন সহজ নয়
রবীন্দ্র আলেখ্যে কবিতা লেখা। আপাত দৃষ্টিতে সহজ, অনায়াসে মনে জায়গা করে নেওয়া
কবিতাগুলো পাঠ করা হয়তো সোজা কিন্তু অনুকরণ যে প্রায় অসাধ্য। এক ঝলক দেখেই বোঝা
যায় লেখকের ওপর রবীন্দ্রনাথের প্রভাব। তিরিশের দশক থেকে আজ পর্যন্ত রবিছায়া থেকে
মুক্ত হতে পারেনি শয়ে শয়ে কবি। আবার অনেকের মনে হতে থাকলো এভাবে পরগাছা হয়ে
দীর্ঘদিন টিকে থাকা যাবে না। একেবারেই উল্টো পথে হেঁটে কবি হিসেবে নিজেদের
স্বাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে লেগে পড়লেন অনেকেই।
সরলের বিপরীত যেমন বক্র আর
সহজের বিপরীত কঠিন ঠিক সেটাই পরিলক্ষিত হলো এই প্রয়াসে। পরবর্তীতে ষাটের দশক থেকে
এর চলন প্রবল হলো বাংলা সাহিত্যে। তবে সবটাই খারাপ এমন নয়। বাংলা সাহিত্য পেলে বেশ
কিছু কালজয়ী কবিকে। কিন্তু রবীন্দ্র প্রভাব মুক্ত হতে গিয়ে কোথাও যেন জোর করে
রুক্ষ,
রূর, দুর্বিনীত কোথাও
কোথাও বা অশালীন হয়ে উঠলো বাংলা সাহিত্য। অশালীনতার সংজ্ঞা অবশ্যই ব্যক্তি বিশেষের
কাছে ভিন্ন। বাংলা ভাষা নিজ মাধুর্য হারাতে লাগলো। রাষ্ট্র বা সমাজের প্রতি
ক্ষোভের ভাষা গালাগালে এসে ঠেকলো। প্রেম হয়ে উঠলো উন্মত্ত, আগ্রাসী। স্কুলের পাঠ্য বইতে
পড়া ওঁনার লেখা 'অসন্তোষের
কারণ' প্রবন্ধটির কথা মনে
পড়ে গেল...মনে পড়ে গেল বাঙালির ইংরেজী শিক্ষা নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছিলেন চাইলাম জামা
পাইলাম মোজা । ঠিক সেই ভাবে রবীন্দ্রনাথ বাঙালির ও বাংলা সাহিত্যের যে সার্বিক
মানোন্নয়ন চেয়েছিলেন, শিক্ষা সংস্কৃতি রুচি কালচারে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেল বন্ধনে গড়ে
ওঠা যে প্রগতিশীল সমাজ চেয়েছিলেন, যেখানে সাহিত্য
হবে সমাজদর্পন হবে তা কতটা সফল হয়েছে তাতে সন্দেহ আছে। যে ভাবধারার বশবর্তী
হয়ে তিনি বিশ্বভারতী স্থাপন করেছিলেন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় তার ছায়া কোথাও দেখা
যায়না। পুঁথিগত বিদ্যার চর্বিতচর্বন সমানে চলেছে। শিক্ষাব্যবস্থায় গুরু শিষ্যের
পারস্পরিক সম্মান আদানপ্রদান সবচেয়ে জরুরি। ক্লাসরুমের চার দেওয়ালের পরিবর্তে খোলা
আকাশ এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করে যেখানে পড়াশোনার দায়ভার হয়ে ওঠে না ছাত্রশিক্ষক
উভয়ের কাছে। ছাতিম গাছের নীচে পড়ার সুযোগ সবার হয়তো হবে না। কিন্তু ছাত্র শিক্ষকের
মধ্যেকার সুসম্পর্ক শিক্ষাপদ্ধতিকে গতিময় করে তোলে। সেটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের
লক্ষ্য। কিন্তু সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা ছেড়ে দিয়ে যদি শুধু বিশ্বভারতীর কথা বলা
হয় সেখানকার ছবিটাও কিন্তু বড়োই হতাশার।
নম্বরের
জন্য ছুটতে ছুটতে শিক্ষায় প্রবল ফাঁক থেকে গেছে এবং যাচ্ছে। লেখাপড়া অর্থ হয়ে
দাঁড়ালো বিষয়গুলোকে মুখস্থ করে গলাদ্ধকরণ করা এবং তারপর পরীক্ষার খাতায় উগরে
দেওয়া। মাঝে পুষ্টিকরণ বা আত্মীকরণ পর্বটি উধাও। ফলে যথাযথ শিক্ষায় শিক্ষিত
মানুষের আকাল চারিদিকে। ডিগ্রি দিয়ে শিক্ষা মাপা হলে সেটা দুর্ভাগ্যের।
পাশ্চাত্যের প্রতি আগ্রহ বাঙালির চিরকালীন বিলাসিতা। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এর বাইরে
ছিলেন না। তাতে দোষও খুব কিছু নেই। দোষ তখনই যখন অন্য কোনো সংস্কৃতির চাপে আমাদের
নিজেদের সংস্কৃতির দম বন্ধ হয়ে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হয়। জাতি হিসেবে এটা আমাদের লজ্জা। শিক্ষা, সংস্কৃতি সব
ক্ষেত্রেই অদ্ভুতভাবে বাঙালিয়ানা পরিত্যাগের উদ্ধত প্রচেষ্টা। যে বাঙালি
সর্বসমক্ষে নিজের মাতৃভাষায় কথা বলতে লজ্জা পায় সে কি করে বাংলাকে বাঁচাবে? এদের কাছে
রবীন্দ্রনাথ একটি জীবিকার নাম। আদ্যোপান্ত ইংলিশ হিন্দিতে চোস্ত অভ্যস্ত একদল
সুবিধাবাদী বাঙালির রবীন্দ্রনাথকে ভাঙিয়ে করেকম্মে খাওয়ার নাম রবীন্দ্রচর্চা নয়।
রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর পরিবারকে নিয়ে এ যাবৎ অসংখ্য গবেষণা হয়েছে। কিন্তু তাতে
গবেষকের ডিগ্রির ঝোলা ভারী হওয়া ছাড়া আর কি লাভ হয়েছে? এই সমস্ত গবেষণা সাধারণের মধ্যে
ছড়িয়ে পড়েছে কি?
নতুন
প্রজন্ম আগ্রহী হয়েছে কি সেসব তথ্য জানতে? তবে লাভ কি? এভাবেই ধীরে ধীরে
অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বেন রবীন্দ্রনাথ অদূর ভবিষ্যতে। যেমন আজ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছেন
ওনার সমাজদর্শন। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডে প্রতিবাদে নাইটহুড খেতাব ত্যাগ করেন
রবীন্দ্রনাথ। প্রতিবাদের ভাষা সবার আলাদা। তিনি তাঁর মতো করে অন্যায়ের বিরোধ
করেছিলেন যেটা সেইসময় থেকে আজো বাঙালিকে শিরদাঁড়া সোজা রেখে লড়াই করার শিক্ষা দিয়ে
চলেছে। শুধু নিজের নয় অন্য যে কোনো জাতি ও সম্প্রদায়ের ওপর হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে
রুখে দাঁড়াবার শিক্ষা দেয়। বঙ্গভঙ্গ রুখতে এবং হিন্দু মুসলিমে সম্প্রীতি বজায়
রাখতে রাখীবন্ধন চালু করেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু, আজ আমাদের সমাজে যে ভাবে
সাম্প্রদায়িকতাকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে তা দেখে সত্যিই মনে প্রশ্ন জাগে এ কোন
বাংলা?
খুনোখুনি
, মারামারি,বিদ্বেষের ফলে
সাম্প্রদায়িকসম্প্রীতির আদর্শ সম্পূর্ণ ভূলুণ্ঠিত। কোনো জাতি বা সমাজের কাছে এর
চেয়ে লজ্জার,
ভয়ের
আর কিছু হতে পারে না। মানুষ হিসেবে আমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছি নিজেদের...প্রশ্নটা
থেকেই যায়।
রবীন্দ্রনাথের
দর্শন,
আদর্শ
যেখানে মূল্যহীন সেখানে তাঁর ছবিতে মালা পরিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে অন্তঃসারশূন্য
শ্রদ্ধাজ্ঞাপন প্রহসন। বাঙালি বাড়ির দেওয়ালে একটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদাস ছবি না
থাকলে তুমি বাঙালি নও। যদি সেই ছবিতে পঁচিশে বৈশাখ মালা না ঝোলে তবে তুমি একেবারেই
বাঙালি নও। শুধু গান আর আবৃত্তি করে রবীন্দ্রনাথকে জানা আদৌ সম্ভব!? বিতর্কসভা, পর্যালোচনা, বিশ্লেষন এগুলো ছাড়া
ওনার মতো মানুষকে জানা যায় কি? বিতর্ক বলতে বাঙালি আবার সেই কাদম্বরী দেবীতেই আটকে যায়।
কারণ এর চেয়ে সহজ সরেস আর কিই বা হতে পারে। ইদানিং কালে সমাজ একটু সাহসী হয়েছে।
প্রাণের ঠাকুরকেকে নিয়ে একটু কাটাছেঁড়া করতে উদ্যত। তেমনি এক উদাহরণ মৃণালিনী
দেবীর চিঠি। স্বনামধন্য আবৃত্তিকার যখন বলে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীকে লেখা প্রথম
চিঠিতে সম্ভোধন করেছিলেন "ভাই ছুটি".... খাদে নামিয়ে আনা কান্নার বাষ্পে
অবরুদ্ধ কণ্ঠ যখন মৃণালিনী হতাশা আর অভিমান তুলে ধরেন তখন গলা ধরে আসে আমাদেরও…. বিশেষত মহিলা
পাঠককূলের। বেশ অভিমান হয়। পাঠ শেষে হাততালি পড়ে। কিন্তু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ খুব
বেশি দূর এগোয় না। রবীন্দ্রনাথের মতো একজন অপার সৃষ্টিশীল মানুষ স্ত্রীর আঁচলে বাঁধা থাকবেন এই আশা
কুপমণ্ডূকতার ও মানসিক প্রতিবন্ধকতার নামান্তর।
পরিশেষে
বলা যায় রবীন্দ্রনাথকে বিশেষণ করতে গেলে আমরা মূলত দুটো দিক নিয়ে ভাবি । এক হলো
তার সৃষ্টি দুই হলো তার ব্যক্তিজীবন। তাঁর চরিত্রের মনস্তাত্বিক এবং দার্শনিক
দিকটা নিয়ে নাড়াচাড়া খুব কম হয়। গুরুগম্ভীর গবেষণায় না গিয়ে শুধু মাত্র তাঁর রচনা
পড়া এবং অন্তর থেকে তা অনুধাবন করা গেলেই এক জ্ঞানসমুদ্রের সম্মুখীন হবো আমরা।
আমরা কিছু সংখ্যক মানুষ যারা লিখতে ভালোবাসি, তারা কিন্তু প্রধানত কবিতা/গল্প
লিখি। প্রবন্ধ লিখতে প্রবল অনীহা। ব্যতিক্রম আমিও নই। আজ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখতে
গিয়ে বারবার হোঁচট খেতে হচ্ছে কারণ উপলব্ধির জায়গাটায় ফাঁক থেকে গেছে হয়তো। তথ্য
দিয়ে যা পূরণ করা যায়না। তাঁর ১৫৯তম জন্ম জয়ন্তীতে তাঁকেই ফিরে দেখা যে বড্ডো
প্রয়োজন। বিশেষ ভাবে প্রয়োজন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথকে পৌঁছে
দেওয়া। অনেক পরীক্ষামূলক কাজ ইদানিং কালে হচ্ছে। চেষ্টা, রবীন্দ্রনাথের সাথে আজকের
প্রজন্মের সেতু বন্ধন করা। সাধুবাদ দিতেই হয় সেই সব প্রচেষ্টাকে। আজ যা আছে সবটাই
খারাপ এমন নয়। যারা প্রকৃত রবীন্দ্রচর্চা করেন তাঁরা যদি একটু উদ্যোগী হন পরিস্থিতি
পাল্টাবেই। যেকোনো জ্ঞান বা শিক্ষা যদি কুক্ষিগত করে রাখা হয় তার গোড়ায় পচন ধরে।
বাইরের আলো হাওয়া যে সবার প্রয়োজন।
আজকের প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথকে
বোঝে না,
বুঝতে
চায়না। পপ/রক/ জ্যাস/ব্যান্ড প্রেমী বলে ওদের দূরে ঠেলে না দিয়ে একটু চেষ্টা করা
যাক পুরাতনের হাত নূতনের হাতে দেবার। সে যুগের আধুনিকতম মানুষটি এতটাই এগিয়ে ভাবতে
পেরেছিলেন যে আজও তিনি সমান প্রাসঙ্গিক তাই কাজটা কিন্তু খুব একটা কঠিন নয়।
প্রয়োজন শুধু ইচ্ছাশক্তির। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যদি রবীন্দ্রনাথকে না জানতে
পারে শুধু মাত্র বাংলা ভাষাটার প্রতি অবহেলার কারণে তবে সেটা আমাদের লজ্জা এবং
দায়। ১৪০০ সাল কবিতায় "আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি আমার
কবিতাখানি" বলার মধ্য দিয়ে কবির প্রত্যয়ী এবং সন্ধিহান এই দুই
সত্তাই প্রকাশ পেয়েছে। একশ বছর পরেও ওনার কবিতা পড়া হবে এই প্রত্যয় ওনার ছিল। সাথে
সাথে এই সংশয়ও ছিল যে সেই বসন্তদিনের সকাল, ফুলের
গন্ধ পাখির গান কতটা ছুঁতে পারবে শতবর্ষ পরেও পাঠককুলকে। এখানেই রবীন্দ্রনাথ
ব্যতিক্রমী এবং চিরকালীন প্রাসঙ্গিক। ওনার গানেই ওনাকে শ্রদ্ধার্ঘ্য দিয়ে বলি
'শুধু
তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু, হে
প্রিয়,
মাঝে
মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিও'.....
কপিরাইট শতরূপা চক্রবর্তী কর্তৃক
সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন