রবীন্দ্রনাথের
নামের ব্র্যান্ড –
বনাম
রবীন্দ্রনাথ
আলোচিতব্য
প্রবন্ধে শিরোনাম নিয়ে ঋদ্ধ পাঠকমহলকে
একটা সত্য কথা বলার তাগিদ অনুভব করছি। আসলে প্রথমে আমি শিরোনাম লিখেছিলাম - রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমরা উৎসব করি
শিখিনাই কিছু তাঁর। কিন্তু যেহেতু ২৫বৈশাখ সম্মুখে তাই চোখের সামনে নানান ঘটনার
পুনরাবৃত্তি ভেসে উঠছিল। তার থেকেই বর্তমান লেখার শিরোনাম হয়ে দাঁড়াল এই। তবে
শুনেছি যে এও সত্যি, বিজ্ঞাপন জগতে রবীন্দ্রনাথের অবদানও নাকি যথেষ্ট ছিল। অনেক
প্রোডাক্টের এককালের ভাষায় তিনি ' ব্রান্ড অ্যাম্বাসাডড়' ছিলেন। তবে এ বিষয়ে শুনেছি
অর্থকরী পাওনার সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক ছিল না। বিশেষত দেশীয় জিনিসের বিজ্ঞাপন
জগতের লোকদের নিরাশ করে তিনি ফিরিয়ে দিতেন না। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমরা উৎসব করি
শিখিনাই কিছু তাঁর!
সত্যি আমরা রবীন্দ্রনাথকে
কতটুকু শিখতে পেরেছি? হয়তবা তাঁর কণাটুকুও নয়। কিন্তু এ কথা তো ঠিক যে রবীন্দ্রনাথ নামটা উচ্চারণ করলেই অপার্থিব এক
মনোহারিতা জেগে ওঠে আমাদের ভাবে অনুভবে।
আমাদের মানস চোখে ভেসে ওঠে সৌম্যদর্শন ঋষিসুলভ চেহারার দিপ্তজ্জ্বল এক সাধক। যেই
সাধক বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী। যাঁকে
আমরা বাংলা সাহিত্যের আধুনিক ঈশ্বর বলেও জানি । এই জনপ্রিয় মনীষী, বাঙালির সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও
বৌদ্ধিক বিকাশে এক আলাদা ঔজ্জ্বল্য এনে দিয়েছেন, কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, প্রাবন্ধিক, বাগ্মী, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সমাজবিদ , শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ এবং মনন বোধেরও কারিগর হয়ে। তিনি চলে গেছেন তাও প্রায় ৮০ বছর
হতে চলল। তাঁকে মনোযোগ দিয়ে
অনুভব করলে দেখা যাবে আজও তিনি
কতোটা গুরুত্বপূর্ণ, তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে আছেন
আমাদের জন্যে। কিন্তু বর্তমানের প্রজন্ম তাঁর আদর্শকে কি অনুসরন করতে পারছে? সবিনয়ে বলছি আমরাও
কি পারছি?
না
পারছিনা। আমাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের আসনটি গভীর ভালবাসা ও শ্রদ্বা দিয়ে ঘেরা
থাকলেও তাঁর জীবন ও কাজকে পর্যবেক্ষণ করে, তাঁর কর্ম আর
সাহিত্যের মূল্যায়ন করতে গেলে যে সচেনতা থাকা প্রয়োজন আমাদের তা নেই। এই বাংলার
সীমানা অতিক্রম করে সময়কালেই তিনি পৌঁছেছিলেন পৃথিবীর কেন্দ্রে। তা যে কেবল ওই
নোবেল পুরস্কারের মাহাত্ম্য, তা নয়। তিনি যে
সমকালের চেয়ে কতটা অগ্রগামী ছিলেন, তা আমরা আজও প্রতি পদে- পদে অনুভব করি। যদিও তাঁর সমকালে কালোমেঘের দল তাঁকে কম আচ্ছন্ন করেনি। এমনকি
বুর্জোয়া বলেও অপমান করেছে । সেটা কম বেশি সবার জানা। তিনি কখনও তাদের প্রত্যাঘাত
করেননি। শান্ত প্রজ্ঞায় সহনীয় করেছেন সেইসব অাক্রমণ। আর বারবার ফিরে গিয়েছেন
নতুনতর রচনার কাছে, নতুনতম সামাজিক উদ্যোগের আশ্রয়ে। আজ আমরা যখন তাঁর সেই বিপুল
সৃষ্টিপ্রবাহের কথা ভাবি, মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ যেন কোনও ব্যক্তি -মানুষ নন, ঠিক ঈশ্বর যেমন। ।
এই মহামানব দৃশ্যায়িত হয়েছেন নিজে চেতনা, বোধ ও মননকে মানুষের মধ্যে
বিলিয়ে দিতে। তবুও আমরা এবং আমাদের দেশ তাকে তাঁকে অনুসরণ করে এগোতে পাছিনা কেন? বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের মন্ত্রকে রবীন্দ্রনাথের
মতো গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে গ্রহণ করে
আমরা এগোতে পেরেছি কি? পারিনাই, যদি পারতাম তবে দেশের মধ্যেই
জাতীয়তাবাদীর জিগির তুলে বিভাজন সৃষ্টি
করতে চাইতামনা। এখানেই তাঁকে অনুসরণের ব্যর্থতা আমাদের। সমগ্র জীবনের
সাহিত্যকর্মে রবীন্দ্রনাথ অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর ধর্মে জ্ঞান প্রেম ও কর্মে মিলিত হয়েছে, উপনিষদের সত্যসাধনা, বৌদ্ধধর্মের মৈত্রী-করুণা এবং
বৈষ্ণব ও খ্রিস্টধর্মের প্রেমভক্তি। যিশু খ্রিস্ট, গৌতম বুদ্ধ ও হজরত মহম্মদকে
নিয়ে লিখেছেন প্রবন্ধ। আমরা তো দেখছি। শান্তিনিকেতনকেও তিনি নিজের শিক্ষাচিন্তার
আদর্শে গড়ার চেষ্টা করেছিলেন কি ভাবে, সেটাও কম বেশি সবার জানা। প্রচলিত শিক্ষা
ব্যবস্থাকে তিনি ঠিক তখন মেনে নিতে পারেননি। তাই সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে নিজস্ব
শিক্ষাদর্শন ও চিন্তার মাধ্যমে আশ্রম পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনের কথা
ভেবেছিলেন এবং সেই অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রম প্রসারের লক্ষ্যে শান্তিনিকেতন ও
বিশ্বভারতী গড়ে তুলেছিলেন। তিনি যখন
দেখলেন শান্তিনিকেতনে প্রবাসিরাও বিদ্যার্জনের জন্য এসেছে তখন তিনি ভেবে খুশি হলেন
যে, শান্তিনিকেতন
বাঙালিত্বের ক্ষুদ্র গণ্ডী ভেঙে বাইরের ছাত্রদের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। একে
তিনি ভারতীয়দের শিক্ষাকেন্দ্র করে তুলতে চেয়েছেন যেখানে শিশুকাল থেকে ছাত্ররা
একসাথে থেকে একটি জাতীয় আদর্শ চর্চা করতে পারবে, যেখানে শিক্ষাচর্চা হবে সমস্ত
রকমের সাম্প্রদায়িকতামুক্ত। সেখানে মানুষের শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে ব্যক্তিত্বের
পূর্ণ বিকাশ। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কবি বলেছেন, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য
উচ্চ যেথা শির/ জ্ঞান যেথা মুক্ত সেথা গৃহের প্রাচীর’। এখানে মুক্তজ্ঞানের আদর্শে
মানুষকে তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন। অস্কার বিজয়ী চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়, নোবেলজয়ী
অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং
মহাশ্বেতা দেবীর মতো ব্যক্তিত্ব এই বিশ্বভারতীতেই পড়াশোনা করেছেন। শান্তিনিকেতনকে
কখনও তিনি তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা বা কর্মকাণ্ডের সাথে জড়াননি। তিনি শান্তিনিকেতনকে
এইসব থেকে রক্ষা করেছেন। এই বিষয়ে যা জানা যায় তা হল স্বদেশী যুগের জাতীয় শিক্ষা পরিষদ
আন্দোলনপর্বে কি হোমরুল লীগ যূগের জাতীয়
বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনে, এমনকি, গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের তীব্র উত্তেজনার মধ্যে- তিনি
শান্তিনিকেতনকে বাহিরের উত্তাপ থেকে রক্ষা করেছিলেন। একটি রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের
মানবিক,
বৌদ্ধিক
ও মনুষ্যত্বের উদ্বোধন ঘটাতে
রবীন্দ্রনাথের আধুনিক শিক্ষাভাবনার আদর্শ অনুসরণের বিকল্প নেই। রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের সম্পূর্ণ জীবনই শিক্ষা গ্রহণের
জন্য উপযুক্ত। তিনি যা কিছুই লিখেছেন তার
সমস্ত কিছুই মানবতার কল্যাণে। এক একটি ধর্ম নারীকে শুধুমাত্র ভোগ্যবস্তুরূপে
চিহ্ণিত করেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর
সাধনা দ্বারা লেখনির দ্বারা নারীকে গড়ে তুলেছেন অর্জিত ভালবাসার ধন। উনিশ শতকে
নারী স্বাধীনতা বা অধিকার যখন এক কথায়
অকল্পনীয়, তখন কবি নারীকে তুলে এনেছেন তাঁর রচনার কেন্দ্রীয় চরিত্রে। নারীকে
উপস্থাপন করেছেন স্বাধীনচেতা ও সাহসী হিসেবে, যা আজও একই রকম ভাবে প্রাসঙ্গিক। বর্তমানে যে বিষয়টি পরিবেশবিদ তথা
সমগ্র মানবজাতির অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়, তা হল বৃক্ষচ্ছেদন ও পরিবেশের
উপর তার প্রভাব। রবীন্দ্রনাথ বহু আগেই এটি উপলব্ধি করেছিলেন এবং সেই প্রকৃতিবাদী
দর্শনচিন্তার প্রতিফলনও রেখে গিয়েছেন কাব্যে, গানে, সাহিত্যে।
সামনেই
১৪২৭’র ২৫ বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথের
জন্মদিন। এই মহাপুরুষের জন্মদিনে আমরা প্রতিবছর যেমন পূজা প্রার্থনা উৎসব আদি করে থাকি সেটা এ-বছর
পৃথিবীর এই ভীষণ দুর্দিনে বাঙালি জাতিকে
হাজার উৎসবের বেগ দিলেও সম্ভব নয়। সম্বব নয়
আসন্ন সর্বনাশের প্রত্যক্ষ ঘনঘটাকে উপেক্ষা করা। কারণ আমরা স্মরণ কালে এরকম
আর কোনও দিন পৃথিবীকে দেখিনি। পৃথিবীর সমস্ত
মানুষ আমরা আজ একই সমস্যায় আক্রান্ত। একই আতঙ্কে বিপর্যস্ত। একই অনিশ্চয়তায়
বিষন্ন। সবাই স্বনির্বাসনে রয়েছি। হাতের উপর হাত রাখা নিষিদ্ধ । সুতরাং আমরা
বাঙালিরা যতই আমদী প্রবণ হই না কেন। আজ আর কোনো উৎসব আমাদের সাজবে না। সম্ভব নয়
কবিপক্ষে সেই নাচ গান, গলা কাঁপিয়ে আবৃত্তি আর
অসম্ভব ভাষণের বিনোদনের উচ্ছ্বাস। দক্ষিণপন্থী বা বামপন্থী - কারা রবীন্দ্রনাথকে
বেশি চান,
সেই
নিয়েও চলবে না মাতামাতি প্রদর্শনী। যাইহোক এবার সেই ভাবে নাই বা হলো বাহ্যিক
আড়ম্বর অনুষ্ঠান। তবে সত্যিকারের রবীন্দ্রসেবাইত বা রবীন্দ্র পূজারী যারা অন্তরের
ভক্তিতে তাঁকে স্মরণ ও বরণে শ্রদ্ধা
নিবেদন করলেও যে মন কিছুক্ষণের জন্য
মালিন্যমুক্ত হয়ে আনন্দ পাবে এটা নিশ্চিত। তাই এবার মননের পুজায় তাঁর মহান আত্মার সঙ্গে যোগ স্থাপন করার চেষ্টা
করবো আমরা। এই ঘোর অন্ধকারেও আমরা যেন
একটু আলো দেখতে পাই। তাঁর আত্মাকে দর্শন
আর বাণীকে সাধনায় সফল করতে এবং কর্মকে পথ নির্দেশ করতে যদিও উৎসবের খুব প্রয়োজন
হয়তো থাকেও না। কিন্তু আমরা যে উৎসবপিয়াসী। উৎসব আর স্মরণ এর পার্থক্য ঠিক কি সেটা
বোঝার চেষ্টাও করিনা। আমারা রবীন্দ্র স্মরণকে প্রতিবছর উৎসবের মধ্য দিয়ে পালন করি।
উৎসবে বিনোদনের প্রাপ্তি ঘটে ঠিকই কিন্তু বিনোদন আর স্মরণ যে এক নয় সেটা আমরা বুঝেও বুঝিনা। বিনোদন মানুষকে
ফাঁপা করে তোলে,
পলকা
করে তোলে। ইন্দ্রিয়ানুভূতি দেয় । আর স্মরণ - স্বাতন্ত্রকে লোপ করে দিয়ে
ইন্দ্রিয়ানুভূতির জগৎ পার করে সচেতনতায় নিয়ে যায় । উৎসবের বিনোদন বিচ্ছিন্নতায়
অনেক সময় অনেক জায়গায় হিংসাও লালিত হয়। স্মরণে হিংসার স্থান থাকেনা। স্মরণে শুধু
বোধের আনন্দ আর আনন্দের মিলন থাকে। যেখানে শুধু মনোযোগ, মনোযোগে
চিন্তা - চর্চা, স্মৃতিরোমন্থনে অনেক উপলব্ধিই মুকুলিত হয়। অর্থাৎ আমার মনে হয় মনোযোগই রবীন্দ্র পুজার সবচেয়ে বড়
পুজা উপচার।রবীন্দ্রনাথের মতোন করে অল্পজনই বলে গেছেন। জীবনসম্ভোগ ও জীবনচারণের
সংবেদন,
সজাগতার
অসীম গুরুত্বের কথা হাতের কাছে, কোলের কাছে যা আছে তার দিকে তাকিয়ে দেখবার সংবেদন
সজাগতার কথা তাঁর বীক্ষণে বারেবারে প্রকাশ পেয়েছে। মনোযোগী হলেই সেই বিষয়ের প্রতি
সজাগতা আসে। আর সজাগ হতে পরলে তখনই সম্ভব ঐতিহ্যের মোহ, উচ্ছ্বাসের মাদকতার ঘেরাটোপ
সরিয়ে দিয়ে সত্যের অভাবনীয় সৌন্দর্যকে
গ্রহণ করে মনকে নির্মল করতে পারা। শুধু
রবীন্দ্রনাথ বিষয়টি ঘিরেই নয়, যে কোনও সৎ বিষয়ের প্রতি সম্পূর্ণ মনোযোগ স্থাপন করতে
পারলে প্রতিটি মানুষের জন্য প্রতিটি মুহূর্ত প্রত্যাশা করা যায়। রবীন্দ্রনাথের
সত্তর বৎসরের জন্মদিনে দেশ জুড়ে যে উৎসব হয়েছিল, যে উৎসবের আয়োজক ছিলেন বিজ্ঞানী
জগদীশ বসু,
কথাসাহিত্যিক
শরৎ চট্টোপাধ্যায়, সেই আলোড়নের পরেও তিনি উত্তেজনাপূর্ণ ও বিনোদনপূর্ণ এই বিপুল আয়োজনে
জন্মদিন পালনের চেয়ে একাকী ব্যক্তির নিভৃত উপলব্ধিকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে
করেছিলেন। বিনোদনে ভেসে যাওয়ার লঘুতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সেঁজুতি কাব্যগ্রন্থে
স্মরণ ব্যাপারে তাঁর খোলাখুলি পরামর্শ রেখে গেছেন।
" কখনো স্মরিতে যদি হয়
মন,
ডেকো না
ডেকো না সভা - এসো এ ছায়ায়
যেথা এই
চৈত্রের শালবন। "
সত্যি রবীন্দ্রনাথের কবিতা এবং শিল্পকর্মের বুদ্ধি, হৃদয়, সংবেদন, শিক্ষা নৈপুণ্য দূরদর্শীতার যে চমৎকার মিশ্রণ আমাদের দেশে এমন
বাঙালি জন্মেছেন যার অস্তিত্ব আমাদের
গৌরব। সমগ্র বাঙালি জাতির কাব্যচেতনা যেন তাঁর মধ্যেই চরম উৎকর্ষ লাভ করেছে। আমরা
দেখেছি তাঁর ননান কাব্যে বিশ্ব, অনন্ত, অসীম, ভূমা এই জগতের
ব্রহ্মবাদ ও প্রকৃতিবাদ কিভাবে গভীর অতলস্পর্শী প্রণিধানযোগ্য হয়ে উঠেছেন।অতএব রবীন্দ্রনাথকে
জানতে পারলে আমাদের জাতিগত প্রতিভার গূঢ়তম প্রবৃত্তি ও তাঁর সীমা আমরা স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারব।
আমাদের মনোজীবনের ভবিষ্যৎ বিকাশধারায় সেই জ্ঞান অনেক পরিমাণে সাহায্য করবে। হ্যাঁ
কারো কারো মনে হতে পারে যে রবীন্দ্রনাথ তো সেই কালের বিশিষ্ট কবি, এবং তাঁর সেই
অসাধারণ কবি- প্রতিভা আমাদের জাতির ও সাহিত্যের এক মহাগৌরব হলেও রবীন্দ্র যুগ এখন
নেই। সেই সময়ের উচ্চ আদর্শবাদ ও অতি সূক্ষ কাব্যকলার অপূৃর্ব সৌন্দর্য আমাদের
বাস্তব জীবনের সঙ্গী নয়। তাছাড়া প্রত্যেক যুগেরই একটা নিজস্ব রুচি আছে। আর আমরা তো
তাঁকে ভুলে যাইনি এবং তাঁর মহার্গতাকেও সম্মান করি। তাঁকে নিয়ে গর্ববোধ করি । আমি
মনে করি এ সব কিছু কথায় যুক্তি থাকলেও, সেই চিন্তা ধারণার থেকে তাঁর জন্মদিন, মৃত্যুদিন পালন করা কিন্তু
আমাদের বড় ভুল হবে। আসলে যে রবীন্দ্রনাথ
বিড়াট চেতনার এক আদর্শ। যুগের পর যুগ অতীত হবে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ চিরদিন
আমাদের চেতনায় জাগ্রত হয়ে থাকবেন।
রবীন্দ্রনাথ অামাদের বিষন্নতাকে বিশ্লেষণ করে অানন্দ এনে দিতে পারেন। কিন্তু
যেখানে শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, মানে শুধু রবীন্দ্রনাথের নামটা থাকে
সেখানে থাকে, উচ্চ আদর্শে
প্রবৃত্ত করার অজুহাতে আমোদ - প্রমোদ, সখ, হুজুগে, শ্রদ্ধাহীন
অনুষ্ঠান। মানে যে কোনও একটা উপলক্ষ্য
পেলে যা হয় আরকি, কিছু বাহাদুরের বাহাদুরির প্রচার। কোথাও আবার উচ্চশিক্ষিত সমাজের
প্রতিনিধি,
কবি
সাহিত্য সমিতিরা বাংলাসাহিত্যের নামে একটা আত্মপ্রচারের বড় প্লাটফর্ম করে তোলেন
রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনকে। যাই হোক
রবীন্দ্রনাথের নামের ব্যান্ড বনাম রবীন্দ্রনাথ এটাই বোঝাতে চাইছিলাম। তাই বলছি যদি কোথাও কোথাও সত্যি মনোযোগিতায় রবীন্দ্রনাথ থাকেন, সেখানে থাকে অানন্দ। যে আনন্দ
মস্তিককে সাজিয়ে দিতে পারে প্রেম
আর জ্ঞান দিয়ে। এই প্রেম আর জ্ঞান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন। “আনন্দকে ভাগ
করলে দুটি জিনিস পাওয়া যায় একটি হচ্ছে
জ্ঞান এবং অপরটি হচ্ছে প্রেম”। এটা ভারতীয় উপনিষদেরও নৈতিক ভাবনা। উপনিষদের
আদর্শের সমার্থক বাণী এবং আচরণ আমরা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে নানা ভাবে পাই।
মনুসংহিতায় পঞ্চযজ্ঞের কথা আছে ব্রম্ভযজ্ঞ, পিতৃযজ্ঞ, দৈবযঞ্জ, ভূতযজ্ঞ, ও নৃযঞ্জ। ভূতযজ্ঞ জীবজন্তুকে
খাদ্যদান ও নৃযজ্ঞ অতিথিসেবা এর থেকেই
বোঝা যায় জীবনযাত্রায় 'বসুধৈব কুটুম্বকম্ 'বা "সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেতে আমরা পরের তরে" এই বোধ তখনই আসবে যখন ক্ষুদ্র আমি ' বৃহৎ অামিতে পরিণত
হবে। " আত্মানং বিদ্ধি' নিজেকে জান। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-
"আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবেনা।"
এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।
আসলে
আমরা প্রায় প্রত্যেকেই মনে করি, আমরা কেবল গ্রহণ করব, কেবল ভোগ করব, আমার ধন মান হোক।
রবীন্দ্র নাথ আরও বলেছেন " দুঃখ যদি না পাবে তো দুখঃ তোমার ঘুচবে কবে? " বৃহদারণ্যকোপনিষদে
আছে " অসতো মা সদ্গময় তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যোর্মাহমৃতংগময় " রবীন্দ্রনাথের মতে, এই গময়' কথার অর্থ পার হয়ে যাওয়া ; এড়িয়ে যাওয়া নয়।
যেটা আমরা রবীন্দ্রনাথের জীবনে ছবির মত দেখেছি। আসলে রবীন্দ্রনাথের সাথে উপনিষদ
এমন ভাবে জড়িয়ে আছে তাঁর চলায় বলায় আমরা বারবার দেখতে পাই। যেমন "অন্তর মম
বিকশিত করো " এখানেও সেই " মা গৃধঃ ' অর্থাৎ লোভ কোরো না। এই লোভেন
থেকেই তো যত হানাহানি, কাড়াকাড়ি, বিচ্ছেদ। যাই হোক রবীন্দ্রনাথ আর উপনিষদ দুই- আমাদের জীবনের আলোর পথ। এই অতুল
ঐশ্বর্যের অধিকারী রবীন্দ্রনাথের জীবনযাত্রা কেমন ছিল? হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতিতে ' লিপিবদ্ধ তাঁর অতি
সহজ সরল আড়ম্বরহীন দিনপঞ্জী থেকে জানতে পারি - তাঁর দৈনন্দিন রুটিন ছিল ভোর থেকে
রাত নটা পর্যন্ত নিয়মে বাঁধা। সেখানে পড়া, কুস্তি, গান, উপনিষদ্ পাঠ, কবিতা লেখা, অন্যান্য ভাষা
শিক্ষা সবই ছিল। আমরা এই যুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা উপকরণে জীবনকে আরো মসৃণ করেও এই জীবনযাত্রার কল্পনাতেও
আনতে পারি না। যদিও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নতুন করে কচকচানি এই লেখার উদ্দেশ্য নয়, বরং এই লেখার প্রধান
কারণ হচ্ছে আমাদের অতি কাছের, এই আপনজনকে এবং তাঁর কীর্তিকে আমাদের প্রজন্ম ঠিক কতোটা অনুসরণ করছে, কতোটা শিখছে তাঁকে ।
কতোটা অালোকিত হচ্ছে জ্ঞানজগতের এই উজ্জ্বল নক্ষতের আলোতে
আগমীরা ? বাইশে শ্রাবণ আর পঁচিশে বৈশাখে স্কুল-কলেজ, পাড়ায়-ক্লাবে
সারাদিন নাচ,
গান, নাটকে কবিচর্চার
মাধ্যমে পালিত হয়। কিন্তু বছরের অন্যদিনগুলি কি তারা রবীন্দ্রভাবনার
কাছাকাছি থাকে?
আমরাই
বা রবীন্দ্রনাথের গান শুনছি, কবিতা পড়ছি, প্রবন্ধ পড়ছি। কিন্তু কতটা আত্মস্থ করছি? কতটাই-বা বাস্তবায়িত
করার চেষ্টা করছি তাঁর উদ্দেশ্য কে? আমি একটু আগেও বলেছি
যে,
রবীন্দ্রনাথ
শুধু একটি নাম নয়, এক বিরাট মহৎ চেতনা, । আমরা সেই চেতনা বা ভাবনাকে কতটা সততার সঙ্গে বহন করছি? আজকের তরুণ প্রজন্ম
যতটা সামাজিক মাধ্যমে সাবলীল বোধ করে, ততটা বইয়ের পাতা ওল্টাতে করে না। ওল্টালে বুঝতে
পারত, মৃত্যুর এত বছর পরেও
"রবীন্দ্রনাথ" এই নামটাই বা কেন এত ছড়িয়ে পড়েছে? আর তাঁর নাম নিয়েও বা কেন মেতে
উঠছে মানুষ?
অার এই
জন্যই দরকার তাঁর জীবন সাধনার ধারাটিকে অনুসরণ করবার দিকে মন দেওয়া" কবিগুরুর
মহাপ্রস্থানের পর আরও কতকাল কাটল। তাঁকে আমরা উৎসবের মধ্যদিয়ে পূজা-বন্দনা করে
চলেছি নানাভাবে কিন্তু তাঁর কর্ম-সাধনার পথে চলতে শিখছি না। আজ গ্রামজীবন, দেশীয়
শিল্প-সংস্কৃতি ও উত্তরাধিকার হারাতে বসেছি আমরা কিছুমাত্র লজ্জাবোধ না করে। তিনি
গ্রাম ও শহরজীবনের বিচ্ছেদ ভাবনায় কাতর হয়ে, দেশীয় শিল্প-সংস্কৃতি বাঁচানোর
তাগিদে শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন গড়েছিলেন। শ্রীনিকেতনের নামও আজ কারও মুখে
উচ্চারিত হয় না। বিশ্বভারতীর পতন-সংবাদ এখন দৈনিক সংবাদপত্রে প্রায়ই দেখা যায়। অথচ
শ্রীনিকেতনের কাজের মূল উদ্দেশ্য ছিল কৃষির উন্নতি, পল্লী উন্নয়ন সমিতি, রোগ নিবারণ, সমবায় প্রথা, চিকিৎসার সুব্যবস্থা, স্বাস্থ্য বিষয়ে
গ্রামবাসীকে সচেতন করে তোলাসহ গ্রামবাসীর উন্নয়নে আরও অনেক কাজ করা। রবীন্দ্রনাথ
চেয়েছিলেন পল্লী পুনর্গঠন পরিকল্পনায় গ্রন্থাগার-পরিষেবা চালু করতে। আর তাই
শ্রীনিকেতনে ছিল একটি গ্রন্থাগার। সেখানে থাকত গ্রামীণ মানুষের উন্নতিতে সহায়ক
নানা ধরনের বই। যেমন কৃষি ও পশুপালন, হস্ত ও কুটির শিল্প। যদিও আজও আছে। তাঁর
সারাজীবনের লড়াইকে আমরা চিনি নি, জানি নি। কেবল তাঁর বাণী উদ্ধৃত করেই সব কাজ সারা করতে
পাকাপোক্ত হয়েছি বহুকাল ধরে। এখনও চলছে যার ধারা অবিরাম গতিতে। এই আত্মবিস্মৃতি
ক্ষমার অযোগ্য তবুও আমরা বাঙালিরা 'ভূরি পরিমাণ বাক্য রচনা'তেই কাল কাটিয়ে চলেছি 'তিল পরিমাণ
আত্মত্যাগে'
না
করে। অথচ রবীন্দ্র-পূজারীরা ভালভাবেই জানেন যে, 'তাঁর লেখা এবং দৈনন্দিন জীবনটার
মধ্যে কোনো ঐকান্তিক ভেদ ছিল না। তিনি যে
আদর্শ ও চারিত্রিক বলিষ্ঠতার প্রতিফলন
রেখে গিয়েছেন তাঁর সুবিশাল সৃষ্টিতে। সেগুলো সবারই পড়া বা চর্চা করা খুব
প্রয়োজন। আজকের অস্থির সমাজের কাছে সেই সৃষ্টি অতি অল্পসময়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য
ডিজিটাল মাধ্যমে এই বিষয়ে অবশ্যই অনেক কাজ হয়েছে। ইন্টারনেটের সহায়তায়
এখন চাইলেই যে কোনও রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা যায়। ই-বুকে রবীন্দ্ররচনাবলি সংযোজিত
হয়েছে। এখন আর কাগজ নয়, রবীন্দ্রনাথ তরুণ প্রজন্মের পছন্দের ডিজিটাল ফর্মেই।
কিন্তু তবু সংশয় থেকেই যাচ্ছে যে নবীন প্রজন্মকে ঠিক কতোটা নাড়া দিচ্ছে রবীন্দ্র
আদর্শ!
আজকের
দিনে তারুণ্যের যে সংকট উপস্থিত হয়েছে এই অবস্থায় রবীন্দ্রনাথের
শিক্ষাচিন্তার আলোকে নতুন করে চিন্তা করলে
কোনো পথনির্দেশের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে শুধু লেখনির
মধ্যদিয়ে আমাদের নির্মল আনন্দ ও বিশ্বজ্ঞান প্রদান করেছেন তা তো নয়। সাথে সাথে সমাজ সংষ্কার করেছেন হাতে কলমে লেগে
থেকে। এক্ষেত্রে সমাজ সংষ্কার করতে প্রথমেই শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিককরণের দিকেই
তাঁর সর্বোচ্চ দৃষ্টি ছিল। আধুনিক বিশ্বে বাঙালি মাথা উঁচু করে যেন দাঁড়াতে পারে, সেজন্য তিনি কাজ
করেছেন আজীবন। শিক্ষার প্রভাবে সমাজ যেমন আধুনিক ধ্যানধারণা লাভ করে, তেমনি আধুনিক
বিশ্বের চলমান শিক্ষাক্রম ও নবতর ধারণা একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গতি সঞ্চার
করে। আমরা এই ক্ষেত্রে কিছুটা লক্ষ করেছি যে আধুনিকতার প্রভাবে আমাদের সামাজিক
প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে আধুনিক ভাবধারা কিছুটা বদলেছে।
বাংলার
আকাশে সূর্যের মতোই যিনি জ্বলজ্বলে মূর্তিতে দীপ্যমান থেকে জীবনযাপন করে গেছেন সেই
'রবি' নামধারী মানুষটির কত
না-জানা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কত জ্ঞানের উচ্চ চিন্তা আগামী জেনে নিতে পারে
তাঁর লেখা থেকে! রবীন্দ্রনাথ যে জীবন সম্পর্কে উদার দৃষ্টিভঙ্গী
অর্জনের কথা বলেছেন অর্থাৎ পরিস্কার করে
বুঝিয়েছেন "যতটুকু অত্যাবশ্যক কেবল
তাহারই মধ্যে কারারুদ্ধ হইয়া থাকা মানবজীবনের ধর্ম নহে"।
সব
মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিরস্থায়ী সৃষ্টিসম্ভার বর্তমান প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া
আর সে সবের গ্রহণযোগ্যতাকে নিশ্চিত করা ছাড়া এই সময়কে সুস্থ করার বিকল্প পথ নেই।
রবীন্দ্রনাথকে জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং তাঁর দেখানো পথে জাতির ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা
তৈরি করতে হবে। উৎসবে, আনন্দে বা মহাসঙ্কটে
রবীন্দ্রনাথই অনুপ্রেরণা, আশ্রয়। তাঁকে ধারণ করতে পারলে নবীন প্রজন্ম সমৃদ্ধি লাভ
করবে। আর তবেই আমরা জন্মদিন ও মৃত্যুবার্ষিকীর গণ্ডি ছাড়িয়ে দৈনন্দিন জীবনে
রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে নিতে পারব।
যাইহোক
রবীন্দ্রনাথ আমাদের সবার গুরুদেব। যদিও গুরুদেব তো অনেক রকম হয় দীক্ষা গুরু, শিক্ষা গুরু, সঙ্গীতগুরু কুলোগুরু, তপস্যাগুরু, আরো অনেক। যাঁরা
একেক জনের একেক জন আলাদা আলাদা কিন্তু কবিগুরু এক জনই। যিনি সবার গুরু। তিনি
চৈতন্যদেব,
রামকৃষ্ণ
বা বিবেকানন্দের মতো ধর্মবিপ্লবী ছিলেন না। ছিলেন আসলে তথাকথিত ধর্মাশ্রয়ের
বাইরেই। তবু,
এই
ধর্মপ্লাবিত দেশে, এই হানাহানির পৃথিবীতে আজও তিনি
সহায়ক, অনিবার্য, শাশ্বত ।
কপিরাইট লক্ষ্মী নন্দী কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন