বাঙালির মননে
রবীন্দ্র-বোধ
বাঙালি, সমাজ জীবন, রবীন্দ্রনাথ, প্রভাব এই শব্দগুলোকে যদি আলাদা আলাদা করে ভাবি তাহলে এই
বাক্যবন্ধগুলি কেন্দ্র করে অনেক ছবিই ভিড় করে আসে। রোজের চলার জীবনে এই ছবিগুলো
প্রত্যক্ষ করি আর উপলব্ধির স্তরে আন্দোলিত হয় মিশ্র অনুভূতি। তেমন মননশীল বাঙালি সংখ্যায় কমে গেছে
বলে আমরা হাপিত্যেশ করি। জানিনা এমন কথা বলা সমীচীন কি না! অনেকের ধারণা যে বাঙালি
এখন ভীষণভাবে তরল যাকে মাপ মতো, আকার মতো যেকোনও
ধাতুর পাত্রে ধরিয়ে ফেলা যায়। এর সপক্ষে যুক্তিসিদ্ধ উদাহরণ এই মুহূর্তে তুলে ধরার
স্পর্ধা আমার নেই। বাঙালি মানস ঠিক কোন জীবনবোধে আজ চালিত হচ্ছে সেটি মাপার কোনও
যন্ত্র নেই, শুধু মনে হয় কোনও কিছুই বর্জন না করার
প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে নিতে সে আজ তরল যদিও সরল নয়; সরল
নয় কারণ পৃথিবী তথা বাংলা ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে যে বাঙালি
উজ্জীবনের মন্ত্র আহরণ করে ঋদ্ধ হয়েছে আজ তার কতটা জীবনে প্রতিফলিত হচ্ছে তা ভাবার
সময় এসেছে।
সমাজ-মানসিকতা
সম্পর্কিত ধারণার আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে। কম্পিউটারের আবির্ভাব মুদ্রণ আবিষ্কারের
চেয়ে কম বিস্ময়কর নয়, সে যেন জীবনের
সর্বস্তরে এক মহাবিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। বাঙালির অন্তর্লোক এবং বহির্জীবন তা থেকে
বিচ্ছিন্ন ভাবার কোনও কারণ নেই। মুঠো ফোনে বন্দি আবিশ্ব মানবজীবন। প্রথাগত অথবা
একেবারেই ঘরোয়া অনুষ্ঠান কোনও কিছুই চলতি ব্যবস্থার বাইরে নয়, তাই আবেগ, আচার, আনন্দ যা ছিল সমাজজীবনের অন্তর্গত প্রকাশ তা সব এখন একই ছন্দে
বাঁধা- ছবি, সেলফি, লাইক, কমেন্ট, প্রশংসা আর সর্বোপরি
জানান দেওয়া। এই বীভৎস অথচ বিস্ময়কর অভ্যাস থেকে আমি বা আমরা কি বিযুক্ত হতে পারি? সেদিন রবীন্দ্র নাটক ও গানের অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখি গান শুরু
হওয়ার পর যখনই কোনও নামি শিল্পী ঝলমলিয়ে উঠছেন মঞ্চে, জ্বলে উঠেছে অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে মোবাইল। নয় ছবি আর নয়
রেকর্ডিং চলছে সমানতালে। গান, সুর, লয়, তাল থেকে মন তখন দূরে
সংরক্ষণের পথে। সেই সংরক্ষণ আসল অনুষ্ঠানের মতো হল না কিন্তু তবু ওই নিম্নমানের
সংরক্ষণের প্রতিই ঝোঁক আমাদের। এই অবনয়ন আসলে এখনকার সমস্ত জীবনে পরিব্যপ্ত। একটাই
অক্টোপাস আমাদের কবজা করতে উদ্যত।
রবীন্দ্রনাথ
চিরকালই আমাদের বাঙালিদের সিন্দুকের কোহিনুর মণি।আমাদের সঙ্গে তিনি চির বিরাজমান।
কুলীন হয়ে ওঠার আর এক চাবিকাঠি। বিজনে, নির্জনে, লোকারণ্যে, ময়দানে সর্বত্র যে
যেভাবে পারছে নিয়ে আসছে রবীন্দ্রনাথকে। তবে শুধুই গান আর কবিতাটুকুই। বসে আঁকো
প্রতিযোগিতা থেকে রক্তদান শিবির, বড়ো রাস্তার মোড়ের
সিগন্যাল ক্রসিং থেকে বিয়ের বাসরে রবীন্দ্রনাথের গান বাঙালির দোসর, নির্ভরস্থল কিন্তু তাঁর প্রবন্ধ, চিঠি, নাটক, অন্যান্য গদ্য নিয়ে
এমন চর্চা নেই এখনকার বাঙালি সমাজে।
আমাদের
দেশে পর পর এমন সব মানুষ জন্মেছেন যাদের এক একজনকে স্মরণ এবং অনুধাবন করতে পারলে
আমাদের সকল অন্ধকার দূর হয়ে যেত। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই আমরা বেশিরভাগ মানুষই
মূর্তি পুজোর অপরোক্ষ শিকার। আজীবন ভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ছুটকারা পেতে চেয়েছি
আমরা। আমাদের নৈবেদ্য, ফুল, আলপনায়, ধূপ ধুনোয় ঝোঁক বেশি।
আত্মীকরণ, প্রভাবিত হওয়া, মেনে চলার জন্য যে নিবিড়তা প্রয়োজন হয় তা তেমনভাবে নেই আমাদের
জীবনে। তাই খুব সহজেই এ হেন মহামানবদের আমরা হেলায় হারিয়েছি। কাজে, মননে তাঁদের নিয়ে চলিনি সঙ্গে করে, কেবল কথায় আর বিজ্ঞাপনেই তাঁদের বেঁধে রেখেছি।
অথচ
এই ভাবধারার উল্টোদিকে হেঁটেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি আত্মীকরণের ওপর জোর দিয়েছিলেন
চিরটাকাল। বৃহদের মধ্যে ক্ষুদ্রকে, অসাধারণের মাঝে
সাধারণকে এবং অসীমের মাঝে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার সাধনায় ব্রতী ছিলেন। বিশ্বজনীন
সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্যকে
গ্রহণ করার অর্থ তাঁর কাছে ছিল নিজেরটুকুকে বর্জন করা নয়, নিজের জগৎকে প্রসারিত করা। বিশ্বভারতীকে সাধারণের হাতে উৎসর্গ
করার জন্য ১৯২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ একটি সভার আহ্বান করলেন, যেখানে তিনি বিশ্বভারতীর সারসত্যটি সহজ ভাষায় বলেছিলেন, “বিশ্বভারতীর আক্ষরিক অর্থের দ্বারা আমরা বুঝি যে ভারতী এতদিন
অলক্ষিত হয়ে কাজ করছিলেন, আজ তিনি প্রকট হলেন।
কিন্তু এর মধ্যে আর একটি ধ্বনিগত অর্থ আছে- বিশ্ব ভারতের কাছে এসে পৌঁছবে সেই
বিশ্বকে ভারতীয় করে নিয়ে আমাদের রক্তরাগে অনুরঞ্জিত করে, ভারতের মহাপ্রাণে অনুপ্রাণিত করে আবার সেই প্রাণকে বিশ্বের কাছে
উপস্থিত করব। সেই ভাবেই বিশ্বভারতীর নামের সার্থকতা আছে।” শান্তিনিকতনকে তিনি
পৃথিবীর পূর্ণ অধিষ্ঠান রূপে দেখতে চেয়েছিলেন। বিশ্বজাতিক মহামিলনযজ্ঞের আয়োজনে
তিনি কিন্তু গ্রামবাংলার এমন একটি নির্ভেজাল কেন্দ্রকেই বেছেছিলেন যেখানে শিক্ষা, বিদ্যা, প্রকৃতি, আত্মনির্ভরতা, স্বদেশ, বিশ্ব মিলেমিশে যাবে। এখনকার বিশ্বভারতীর সঙ্গে সেই
বিশ্বভারতীর আকাশপাতাল তফাৎ। সে আমাদের পরিতাপের বিষয়। যে কর্মযোগের দ্বারা তিনি
আদিবাসী অধ্যুষিত পশিচমবঙ্গের একটি অখ্যাত জায়গাকে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে তুলে
নিয়ে গিয়েছেন সেই আদর্শ, কর্মযোগ, প্রকৃতির প্রতি আত্মনিবেদন,
উদার
চোখে সবাইকে এক হিসেবে দেখার স্বচ্ছ দৃষ্টি কোথায়? রাজনীতি, সংকীর্ণতা, অস্বচ্ছতা, স্বার্থ, অযোগ্যের বাড় বাড়ন্ত
সবকিছুর মতো এখানেও থাবা বসিয়েছে। পরিত্রাণের জন্য শান্তিনিকেতনে ছুটে ছুটে যাই
যখনি স্থূলতা, কদর্যতা ঘিরে ধরে; তাঁর কর্মকান্ডের, চিন্তাধারার, আবেগের পরশটুকুর ছোঁয়া পেতে। মেলা উৎসবের শান্তিনিকেতন নয়, নিভৃতির শান্তিনিকেতনে।
অধুনা
যন্ত্র বা বিজ্ঞান একদিকে আমাদের গ্লোবাল ভিলেজের নাগরিক করে তুলছে অথচ অন্যদিকে
আমরা বিশ্বজনীন রবীন্দ্রমানসকে অবহেলা করছি। বাঙালি জীবনের এই বৈপরীত্য (Dichotomy) আমাদের বিভ্রান্ত করে। ভাবতে বসি
বিজ্ঞানের আশীর্বাদ এবং এই মাটি-সঞ্জাত ভাবগম্ভীর চিন্তা কেন মিলতে পারছে না? এই দীনতা কি আমাদের মজ্জাগত? অথবা
অক্টোপাসের আঁচড় প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আমাদের নেই? আমাদের
শিকড় সম্পর্কে সচেতন করার পিতৃসুলভ এক মনীষীর প্রয়োজন। নাহলে আমরা বাঙালিরা অনাথ
পল্লবগ্রাহী এক জাতিতে পরিণত হব। হয়েছি এ কথা বলছি না কিন্তু চারদিকে যে ক্ষতচিহ্ন
দেখে আমরা আঁতকে উঠি তা ভয়ঙ্কর রোগের পূর্বাভাস।
বাঙালির
সমাজজীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব আলোচনা করার মুহূর্তে স্মরণ করা দরকার যে বাঙালির মননশীলতা
কোনও একটি বাঁধনে ধরা যায়না। কারণ, সমাজে বাঙালির শিক্ষা, দীক্ষা, বোধ্, বুদ্ধি, চেতনা এবং মননে নানা
স্তর আছে। বাঙালির সমাজজীবনে একটা বৃহৎ অংশের মানুষ দুর্ভাগ্যবশত আজও অন্ত্যজ হয়ে
রয়েছেন। তাদের জীবনে প্রথাগত ধর্মচিন্তা, ধর্মীয় সঙ্গীত, পূজার্চনা ইত্যাদি নানাবিধ পুরাতন ধ্যান ধারণায় আবদ্ধ।
রবীন্দ্রনাথ
ছিলেন আমাদের জীবনে আলোকবর্তিকা। তাঁর ভাষা,
সাহিত্য
বোধ, দর্শন, আন্তর্জাতিকতা
এক অভিনব দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয় এবং তা গ্রহণ করতে ন্যুনতম শিক্ষার প্রয়োজন আছে
বলে মনে করি। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ বাঙালির সমাজজীবনে সর্বাঙ্গীনভাবে আলোড়িত করেছেন
এমন শ্লাঘা আমরা করতে পারি না। তবু আমাদের অবশ্যই মানতে হবে যে বিদ্যালয় থেকে
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ মহীরুহরূপে ছায়ায় আবৃত করেছেন
শিক্ষার্থী মনকে। রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি ব্যতীত আমাদের কোনও আনুষ্ঠানিক কর্মকান্ড
শুরু হয় না, অথচ দুঃখের সঙ্গে দেখি গত পঞ্চাশ বছরে
রবীন্দ্র-প্রভাব ক্ষীয়মান হয়ে চলেছে। এক প্রবল জলতরঙ্গের অভিঘাতে পূর্ণ নদীর বুক
ক্রমে শুকিয়ে যাচ্ছে।
প্রথমেই
বলি রাবীন্দ্রিক বাংলা ভাষার অবনয়ন ঘটছে। অতি আধুনিক বাংলার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে
অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষা এবং ইংরেজি। ভাষার মিলনে দোষের কিছু নেই কিন্তু মাঝে মাঝে
মনে হয় হিন্দি এবং ইংরেজি আধিপত্য বিস্তার করছে যার বিরুদ্ধে আমরা মৃদু প্রতিবাদ
ছাড়া তেমন কিছু সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারছি না। নিটোল বাংলা বলতে আজকের প্রজন্ম
গর্ব বোধ করে না; ফলে,
বাংলা
ভাষা অবধারিতভাবে তার অর্জিত গৌরব ধরে রাখতে পারছে না।
সাহিত্যের
পাঠ শুধুমাত্র কিছু সন্দর্ভে আটক হয়ে পড়েছে। ঘরে ঘরে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, পত্রাবলি এবং আলোচনা নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। তার কারণ
অনেক, কিন্তু বৈদ্যুতিন বিনোদন সম্ভারে
সম্মোহিত তারুণ্য ভুলতে বসেছে শিকড়ের কথা। রবীন্দ্র জন্মদিনের অনুষ্ঠানে অবশ্যই
আমরা তাঁর আলোকোজ্জ্বল ক্ষণিক উপস্থিতি অনুভব করি। অস্বীকার করা যাবে না যে বাঙালি
সমাজজীবনে এই উপস্থিতি নগণ্য। তবুও বলব যে সেই বিশাল সৃজনশীলতার আবেশ আমাদের জীবনে
তেমন স্থায়ী হতে পারছে না।
রবীন্দ্রনাথ
যেমন ভেবেছিলেন তাঁর রচিত গানের ক্ষেত্রে তা সত্যিই বলেই মানা যায়। কারণ এখনও
ইউটিউবে রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপহার খুব কম নয় এবং তাঁর গানের ডিস্কের বিক্রি, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষায় আগ্রহ, তাঁর
গান নিয়ে অনুষ্ঠানের পরিমাণ প্রমাণ করে যে এখনও রবীন্দ্রনাথ বাঙালির প্রিয় সঙ্গীতরচয়িতা।
বাঙালির সুখ, অসুখ, প্রেম, বিরহ, যাপন এবং মরণে
রবীন্দ্রসঙ্গীত অপরিহার্য অঙ্গ। তাই বাঙালির সমাজজীবন এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত অচ্ছেদ্য
বন্ধনে আজও বাঙালিকে প্রাণের আনন্দ, মনের আরাম এবং আত্মার
শান্তি দিতে পারে। যে বাঙালি সন্ধের পর
সস্তা টিভি সিরিয়ালে এঁটে বসে থাকেন তার জীবনেও কোনও না কোনও সময়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত
বিশুদ্ধ ঝরনার জলের মতো আত্মার শুদ্ধিকরণ করে দিয়ে যায়। বাঙালির সমাজ জীবনে এই
বৈপরীত্য বিশেষ মনোযোগ দাবি করে কিন্তু সে আলোচনা ভিন্ন। আমরা মোটামুটি এই
সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীত দিয়ে সমাজজীবনের একটা অদৃশ্য
মিলনবিন্দু রচনা করেছেন। তাঁর সুরে প্লাবিত না হোক বাঙালি জীবন মাঝে মাঝে মন্ত্রের
শক্তি লাভ করে।
বৈদ্যুতিন
সংযোগ ব্যবস্থায় আমাদের চিঠি লেখার অভ্যেস লুপ্ত হয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের
ছিন্ন পত্র ও পত্রাবলির মধ্যে যে অফুরন্ত সম্পদ আছে তা পরবর্তী যুগের সাহিত্যে
আমরা পাব না। স্মৃতিমেদুরতায় কাতর হওয়া অবশ্যই কাম্য নয় কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছে
আমাদের চিঠি লেখার একটা পাঠ অত্যন্ত জরুরি ছিল। প্রেমিক প্রেমিকার পত্রাবলিতে যে
আবেগ সঞ্চারিত হত তার ভাষা রবীন্দ্রনাথের, কিন্তু প্রশ্ন জাগে
যে আজ কি কোনও প্রেমিক তেমন চিঠি লেখার প্রানবন্ত তাগিদ অনুভব করেন? এ ভয়ানক পরিতাপের বিষয় যে বিজ্ঞান ধ্বংস করে দিল মানুষের
আন্তরিক সংযোগের ভাষা। মেসেজ দ্রুত যায় কিন্তু তাতে আবেগের স্ফূরণ নেই, তা ভাষাহীন অফিসের নোটের মতো। রসকষহীন মেসেজে প্রতীক্ষার স্থান
ও সময় উল্লিখিত থাকতে পারে, কিন্তু প্রাণের
স্পর্ষ তেমনটা ধরা পড়ে না। একটি হাতে লেখা চিঠিতে শব্দের জাদু থাকে, আবেগসঞ্জাত অভিব্যক্তি থাকে যা সাহিত্যের আলো বিকিরণ করে। আজ
আমরা অনবরত আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। ভাষা ব্যতীত সেই অন্তঃপ্রকৃতির অমলিন বিকাশ
অন্য মাধ্যমে কি সম্ভব? যে যন্ত্রসভ্যতার
দাপটের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সচেতন করার প্রয়াসী হয়েছিলেন তার বিরুদ্ধে আর
কোনও প্রতিরোধ টিকবে না। কারণ বিজ্ঞানের সাহায্য ব্যতীত আজ আমাদের যাপন অসম্পূর্ণ।
ফলত ছিন্নপত্র ফিরে আসবে না, পত্রবলি ফিরে আসবে না, ফিরে আসবে না প্রেমিক প্রেমিকার অন্তর্লীন আবেগ প্রকাশ করার
বাংলা ভাষা। ভাষা ব্যতীত কি প্রেম হয় না? শব্দের মাধুরী প্রকাশ
করার জন্য যে সময়টুকু লাগে তা আজ কেউ নষ্ট করতে চায় না। কিন্তু একবার যে বাঙালি
ভাষা পেয়েছিল তা হারি্য়ে যাওয়ার যন্ত্রণায় নতুন সাহিত্য বিকশিত হতে পারত। হায়! যে
সম্পদ চলে গেল তা চলেই গেল!
নাটক
কিংবা ছবির মাধ্যমে জীবনবোধের ধারণায় ধাক্কা দেওয়া যায়। সজোরে না হোক করাঘাত করা
যায় মূলে। রবীন্দ্রনাথের নাটক নিয়ে বর্তমান কাল কিছু ভালো কাজ দেখেছে কিন্তু তাঁর
নাটক পরিবেশনায়, পরীক্ষানিরীক্ষায় তেমন আগ্রহ দেখা
যাচ্ছে না। দুঃখ হয় যে, আজকের প্রজন্ম দেখতে
পাবে না অচলায়তন, রক্তকরবী, ডাকঘর, বিসর্জন, মুক্তধারা। সিলেবাসে
বন্দি থেকে যাবে রবীন্দ্রনাটক। কিছু নাটক আজ সত্যিই খুব প্রাসঙ্গিক কেননা শিকল
ছেঁড়ার পথের সন্ধান আছে সেখানে, অর্থহীন হিংসা, বিদ্বেষ, জড়তা, মধ্যযুগীয় বিশ্বাস থেকে মুক্ত জীবনের হদিশ আছে সেসব নাটকে।
নতুন জীবনের ভিত গড়তে রবীন্দ্র-বীক্ষা বাঙালিকে আজও প্রণোদিত করতে পারে। তবে আজকের
নাটক এবং প্রবন্ধেও রবীন্দ্রনাথের প্রচ্ছন্ন প্রভাব আমরা লক্ষ করি। নাটকের বিষয়
এবং কাঠামো কখনওই রাবীন্দ্রিক নয়, কিন্তু পাশ্চাত্য
থিয়েটার অনুসারী হয়েও বাঙলা থিয়েটার রক্তকরবী,
বিসর্জন, অচলয়াতন, মুক্তধারা প্রভৃতির
প্রতিবাদী চরিত্র বজায় রেখেছে।
বাঙালি
সমাজে বর্ণগত বৈষম্য ছিল এবং আছে, একথা অস্বীকার করা
যাবে না।কিন্তু ভেদাভেদের প্রশ্নটি সমস্যা-কন্টকিত হলেও রবীন্দ্রনাথ বলেন যে, এর মধ্যে একটা ‘basis
of unity’ এসেছে
আমাদের সাধুসন্তদের মধ্যমে, এঁরা হলেন নানক, কবীর, চৈতন্য প্রমূখ
মহাত্মা। রবীন্দ্রনাথের মতে মানুষ উচ্চতর প্রবৃত্তি দ্বারা এই বিভেদ অতিক্রম করতে
পারেন। বাঙালি তা খানিক করতে পেরেছে বলেই বর্ণের ভেদ নিয়ে লাঠালাঠি হয় না।বিবাহ
ইত্যাদির ক্ষেত্রে কিছু বিভেদ থাকলেও এই রাজ্যে পুজো অর্চনা, প্রার্থনা, গঙ্গাস্নান, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ইত্যাদি নিয়ে ছুতমার্গ নেই। বাঙালি জীবনে এই
প্রগতি শ্লাঘার বিষয়। বাংলার গ্রামে গ্রামে সর্ববর্ণের সহাবস্থান লক্ষ করা যায় যা
আমাদের পূর্বপুরুষদের অনিবার্য আদর্শবাদের সুফল। এই আদর্শবাদ লাঠি বা বন্দুক
দেখিয়ে হয় না। অন্তস্তলের প্রবাহমান মিলনের স্রোত এখনও হারিয়ে ফেলেনি বাঙালি।
অতি
সম্প্রতি ভারতের জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রবীন্দ্রনাথের
জাতীয়তাবোধ সংকীর্ণ নয়। ‘এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’ ভারতের ঐক্যের মন্ত্র।
বিচিত্রের মধ্যে ভারতের ঐক্য সন্ধান করেছেন কবি। সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে
রবীন্দনাথ বলেন, ‘Nationalism is a great
menace.’ রবীন্দ্রনাথ যেমন ভারতীয় তেমনি বিশেষ
করে বাঙালি কবি আবার ভারতের কবি, আরও একটি বৃহত্তম
(‘এবং আরও খাঁটি অর্থে বিশ্বকবি’- গোপাল হালদার রচিত প্রবন্ধ ‘রবীন্দ্রনাথের
ভারতবর্ষীয়তা’)। ‘নেশন’ শব্দটির মধ্যে পাশ্চাত্য জগতের ভেতর যে সংকীর্ণতার আভাস
ফুটে ওঠে তার বিরোধী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর রাষ্ট্র চিন্তার মধ্যে ছিল মানবতাবাদ
যা অবজ্ঞা করে কোনও জাতি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। ‘গোরা’ উপন্যাসে আমরা
ভারত ইতিহাসের ঐতিহ্যবাহী ধারণায় রূপান্তরের কথা পড়ি। এই মহাকাব্যিক উপন্যাসে
পৃথিবীর জাতিতে জাতিতে মিলনের সাধনার কথা বলা হয়েছে। জন্মসূত্রে গোরা ভারতীয় না
হলেও সে আনন্দময়ীকে নিজের মা বলে গ্রহণ কর এবং রবীন্দ্রনাথ নিমেষেই পাঠকের চোখে
হয়ে ওঠেন ভারতীয় এবং বিশ্বজনীন। বাঙালির সমাজজীবনে এই বোধ যে লুপ্ত হয়েছে তা নয়।
ভারতবর্ষের হিন্দু মুসলমান সমস্যা সম্পর্কে রবীন্দনাথ অবহেলা করেননি। হিন্দু
মুসলমানের যে সংঘর্ষ ছিল তাকে তিনি বলেছেন ‘বাহ্য’ (কালান্তর)। হিন্দু মুসলমান
খ্রিষ্টান প্রভৃতি সম্প্রদায় নির্বিশেষে সব ভারতীয়কে নিয়েই ভারবর্ষের জাতীয়তা, শুধু বিভিন্ন উপসম্প্রদায়ভুক্ত হিন্দুকে নিয়ে যে প্রতিষ্ঠান
গঠিত হয় তাকে কিছুতেই জাতীয় বলা যায় না। রাজনারায়ণ বসু এবং বঙ্কিমচন্দ্র
হিন্দুত্বের বাহক বলে রবীন্দ্রনাথ তাদের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেননি। কিন্তু
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ পূর্বতন হিন্দু জাতীয়তার আদর্শ ছেড়ে অসাম্প্রদায়িক
বাঙালি জাতীয়তা তথা ভারতীয় জাতীয়তার প্রতি আকৃষ্ট হন। হিন্দু মুসলমানের মিলিত
জাতীয়তার আদর্শই ক্রমে প্রবল হয়ে উঠল। ১৩০০ খ্রীষ্টাব্দের ‘সাধনা’ পত্রিকার আশ্বিন
কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘ইংরেজ ও ভারতবাসী’
যেখানে তৎকালীন সাম্প্রদায়িক সমস্যা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেন-‘আজকাল হিন্দু
মুসলমানের বিরোধ যে নিদারুণতর হইয়া উঠিতেছে,
আমরা
আপনাদের মধ্যে তাহা লইয়া... কি গোপনে বলি না যে এই উৎপাতের প্রধান কারণ ইংরাজরা এই
বিরোধ নিবারণের জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করে না...। ... ভারতবর্ষের দুই প্রধান
সম্প্রদায়ের মধ্যে তাহারা প্রেমের অপেক্ষা ঈর্ষা বেশি করিয়া বপন করিয়াছে’(হিন্দু
মুসলমান প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ- প্রবোধচন্দ্র সেন)। বাঙালি অসাম্প্রদায়িক মনোভাব
বর্জন করেনি বলেই এত বছর ধরে হিন্দু মুসলমান সহাবস্থান করেছে। বাঙালি জীবনে আজও
গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে আছে সহনশীলতা এবং অসাম্প্রদায়িক মনোভাব। ইতিহাসের ধারায় এমন
মনোভাব বাংলায় গড়ে উঠেছে কিন্তু অতি সম্প্রতি তাতে সন্দেহের বীজ উপ্ত হয়েছে।
এখানেই বাঙালির অগ্নিপরীক্ষা, সে কি অনুসরণ করবে
হিন্দু জাতীয়তাবাদ? না কি সর্বধর্ম
সমন্বয়ের জাতীয়তাবাদ?
রবীন্দ্রনাথের
শিক্ষা সম্পর্কিত প্রবন্ধগুলির মধ্যে নতুন মানুষ সৃষ্টির অভিলাষ প্রোথিত আছে।
শিক্ষা প্রদানের ও গ্রহণের যে আদর্শ তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন তা সব দেশেই, সব কালেই উদাহরণযোগ্য। পৃথিবীতে তিন জন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ
রবীন্দ্রনাথের আদর্শ গ্রহণ করেও নিজেদের দেশে তা প্রবর্তিত করতে পারেননি।
জার্মানির পল গেহেব এবং স্পেনের হিনের দে কোসিও যথাক্রমে হিটলার এবং ফ্রাঙ্কোর
শাসনকালে রবীন্দ্রবিরোধী মনোভাবের ফলশ্রুতি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষচিন্তা
অনুসরণ করতে পারেননি। পৃথিবীর একমাত্র স্থান শান্তিনিকেতন যেখানে আজও আম্রকুঞ্জে
মুক্ত আকাশের নীচে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে এবং তা দেখে এখনও অনেকেই বিস্মিত ও
অভিভূত হন ও এই আদর্শে ব্রতী হয়ে নিজেদের সন্তানদের পাঠান শান্তিনিকেতনে। কিন্তু
যে প্রশ্ন জাগে তা হল আজ কি বাংলার ঘরে ঘরে সেই ‘সম্পূর্ণ মানুষ’ তৈরি করার আদর্শ
রূপায়িত হয়েছে? আমরা কি পেরেছি এই আদর্শকে পাথেয় করে
তথাকথিত ডিগ্রিধারী কেরিয়ার সর্বস্ব জীবনের লক্ষ্যকে নাকচ করে দিতে? নেতিবাচক উত্তরই দিতে হবে কারণ দুঃখজনক হলেও বাস্তব ব্যবস্থাকে
অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশেষজ্ঞ হওয়ার সাধনায় আজকের ছাত্র ‘তপোবন’-এর শিক্ষা
লাভের রোমাঞ্চকর ভাবনা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। একটি ছাত্র প্রকৃতি পাঠ পেল কি না
অথবা তার জীবনে শিল্প, কলা, সঙ্গীত ইত্যাদি সমানভাবে পরিস্ফুটিত হল কি না বিচার করার সময়
নেই আমাদের হাতে। বেশিরভাগ অভিভাবকরাই সেই চলতি ফর্মূলা অনুসরণ করেন কারণ না হলে
জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে তাদের সন্তান যদি পিছিয়ে পড়ে, এই ভয়ে। তথাপি আমাদের গর্ব যে, শান্তিনিকেতনে
অধ্যয়নের আশায় ভারত বাংলাদেশ ছাড়াও অন্যান্য দেশের মানুষ ক্রমাগত আকৃষ্ট হচ্ছেন।
কোরিয়া, জাপান এবং পশ্চিমের কিছু দেশে ছাত্রদের
মধ্যে ড্রাগ এবং অন্যান্য অপরাধ প্রচন্ড বৃদ্ধি পাওয়ায় সেখানকার সমাজচিন্তকগণ
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। আমরা মনে করি যে সম্পূর্ণ সফল
না হলেও রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তা আমাদের মননে গভীর রেখাপাত করেছে। করেছে বলেই
শিশুদের মধ্যে চিত্রকলা, নৃত্য, আবৃত্তি এবং সঙ্গীতের সাধনা দেখা যাচ্ছে আজও।
আজকের
বাঙালি জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব খন্ড খন্ড করে বিচার করা উচিত হবেনা।
লোকসাহিত্য এবং লোকসঙ্গীত রবীন্দ্রনাথের কত প্রিয় ছিল আমরা জানি এবং আজ বৈদ্যুতিন
ও অন্যান্য মাধ্যমে লোকসঙ্গীতের প্রতি অকৃত্রিম উন্মাদনা দেখে তাঁর কথাই মনে পড়ে।
জেলায় জেলায় বিভিন্ন মেলায় এবং উৎসবে লোকসঙ্গীত বিশেষ প্রাধান্য লাভ করেছে। শান্তিনিকেতনের
শনিবারের হাট যারা দেখেছেন তারাই বাউল গানের অভাবিত উপস্থিত লক্ষ করে থাকবেন।
এছাড়াও আমরা বুঝতে পারি যে দীর্ঘদিন অবহেলিত,
অবজ্ঞাত
থাকার পরে আজ লালন সাঁই, শাহ আবদুল করিম, ভবা পাগলা, নির্মলেন্দু চৌধুরি, আব্বাসউদ্দিন প্রমুখ শিল্পীরা আদরণীয় হয়ে উঠেছেন। তাঁরা আজ
বেঁচে থাকলে গর্বিত হতেন বলাই বাহুল্য। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকসাহিত্য
অনিবার্য, অনিবারণীয় সম্মান লাভ করেছে। ইংরেজ
আমলের ধরাবাঁধা পাঠ্যক্রম অতিক্রম করে দেশজ সম্পদ শিক্ষার অঙ্গনে স্থায়ী আসন লাভ
করেছে। এই বিলম্বিত বোধের পেছনে রবীন্দ্রচর্চার ধারাবাহিকতা নেই এ কথা আমরা
বিশ্বাস করতে পারি না। তাৎক্ষণিক প্রভাবের কথা নয়, বাঙালি
জীবনের প্রবাহমানতার মধ্যে ফল্গু ধারার মতো রবীন্দ্র ভাবনা কাজ করেছে যা আমাদের
বুঝতে বিলম্ব হতেই পারে। বিলম্ব কোনও অসম্ভব ঘটনা নয়। ইতিহাসে দেখা যায় শিল্প
সাহিত্যের সৃজনশীলতার স্পষ্ট প্রতিফলন সমকালে ঘটে না, ঘটে হয়তো অনেক পরে। রবীন্দ্রনাথের লোকসঙ্গীত এবং লোকসাহিত্য
প্রিয়তা হয়তো অধ্যাপকের গবেষণায় কিংবা ক্লাসরুমে দীর্ঘকাল আবদ্ধ ছিল। আজ প্রবল
বেগে সঙ্গীত বাঙালির আত্মানুসন্ধানে ইন্ধন যোগাতে পারে। আত্মবিস্মৃত জাতি বলে
বাঙালিকে নিন্দা করা হয়, কিন্তু আমরা এই
নিন্দা সর্বৈব সত্য বলে মানতে পারি না। আত্ম-আবিষ্কারে বাঙালির আশ্রয় রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথের
ধর্মচিন্তা প্রসঙ্গে যে কথা প্রথমেই মনে আসে তা হল তিনি উপনিষদের মর্মার্থ দ্বারা
অনুপ্রাণিত এক মহাকবি। হিন্দু, ইসলাম, খ্রিষ্ঠান বৌদ্ধ, জৈন, শিখ ইত্যাদি ধর্মের প্রধান দিকগুলি আত্মস্থ করেও তিনি
মূর্তিপুজোকে মেনে নিতে পারেননি। ব্রাহ্ম ধর্মের কোনও গোঁড়ামিও তাঁকে আকৃষ্ট
করেনি। সর্বকালীন সর্বজনীন মানব ছিল তাঁর আরাধ্য। তাঁর ধর্ম মানবধর্ম। যে ব্রহ্মের
উপাসনা তিনি করেছেন তার কাব্যিক প্রকাশ ঘটেছে মানবিক মূল্যের মধ্যে তাতেই তাঁর সহজ
আনন্দ। তিনি আনন্দের কথা বলেছেন যে আনন্দ মানুষকে জাগায়, ভাবায়, উত্তরণ ঘটায়। মানুষের
দীনতা তাঁকে পীড়িত করত। কোনও বিষয়েই খর্বকায় মানুষ কিংবা সংকীর্ণ চিন্তা তাঁর মনে
স্থান পায়নি। তিনি কোনও ধর্মকেই অধর্ম বলেন না কিন্তু সমস্ত ধর্মের সংশ্লেষ
রবীন্দ্রনাথের মানবধর্ম। তাই কবিতায়, উপন্যাসে, গল্পে, গানে তিনি যে
স্বাদেশিকতার কথা বলেন তার মধ্যে কোনওরূপ দীনতা প্রকাশ পায়না। ‘চার অধ্যায়’ এবং
‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে তিনি জাগরণের নামে অন্যায় হিংসা এবং ঘৃণা প্রত্যাখান করেন।
ধর্ম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা বাঙালি গ্রহণ করুক না করুক আজ ভাবার দিন এসেছে
যে, পূজার্চনায় বাহ্যাড়ম্বর প্রধান নাকি
হৃদয়ের দেবতাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানানোই আসল তপস্যা?
অগ্রজদের
মুখে শুনেছি তথাকথিত মেকি রাবীন্দ্রিক কিছু মানুষ ‘এই গোরু সরনা’ ধরণের এক হাস্যকর
ফ্যাশন ধরেছিল, কিন্তু পরবর্তীকালের বাঙালি সেই
দেখানেপনা পরিত্যাগ করেছে। অবশ্য তাতে প্রমাণিত হয়না যে আমরা সত্যিকারের
রাবীন্দ্রিক হওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত আছি। ঠিক এই মুহূর্তে বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং জীবনচর্যায় আপাতভাবে রবীন্দ্র প্রভাব লক্ষ করা যায়
না। কিন্তু এ কথা কি অস্বীকার করা যায় যে একালের কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার রবীন্দ্র
প্রভাব মুক্ত! স্বীকার করুন বা নাই করুন বাংলা সাহিত্য কখনওই রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত
আধুনিকতায় পৌঁছতে পারত না। বুদ্ধদেব বসুর মতে রবীন্দ্রনাথের গদ্য কাব্যিক এবং
রূপকধর্মী, কারণ, কবিতা
‘his dearest concern’। আজকের গদ্য লেখক তা
মানতে নাও পারেন। কিন্তু গদ্য ভাষার সুললিত সুরটি বেঁধে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
কবিতা এই সময়ে ভিন্ন শৈলীর আধারে জীবনের দৈনন্দিনতায় অবগাহন করেছে। আধুনিক কবি
তাতে লজ্জা বোধ করেন না, কারণ জীবনে জীবন যোগ
করার ভাবনাটি তিনি মেনে নিয়েছেন।
প্রতিবাদী
রবীন্দ্রনাথকে আমরা শিরোধার্য করি এবং জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে
নাইট উপাধি পরিত্যাগ এবং পত্রাঘাত আমাদের রক্তে এখনও কিছু সঞ্চিত আছে। অপমানিত, পদদলিত, অন্ত্যজ মানুষের
প্রতি কবির ছিল অকৃত্রিম মমত্ববোধ, যারা ‘পশ্চাতে’ পড়ে
থাকে তাদের জীবনের পরিবর্তন না হলে এদেশের অন্ধকার কাটবে না। রবীন্দ্রনাথের
ভাবাদর্শ অনুসরণ করুক বা নাই করুক ভারতের স্বাধীনতার পরবর্তীকালে বাংলা নাটকে, গানে, কবিতায় মুক্তির
আকাঙ্খা বারবার উচ্চারিত হয়েছে। নারী শক্তির উত্থান আজ বাংলায় এক ভীষণ সত্য। তাই
শিল্প সাহিত্যে নাটকে গানে স্বাধীনভাবে মেয়েরা কাজ করছেন। একই সঙ্গে মহিলারা
গ্রামেগঞ্জে স্বাবলম্বী হওয়ার আন্দোলনে মেতেছে।এতে কি রবীন্দ্রনাথের নারীকে আপন
শক্তিতে বিশ্বাস রাখার বাণী প্রতিধ্বনিত হয় না!
সময়ের প্রেক্ষিতে আমরা পাশ্চাত্য সমাজের মতো অগ্রসর না হলেও নারীর অধিকার
প্রতিষ্ঠার বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের শরিক হতে পেরেছি।
আমাদের
সার্বিক জীবনবোধে এবং জীবনচর্যায় নানাবিধ ঘাত প্রতিঘাতের ফলে রবীন্দ্রনাথের
পরীশীলিত যাপন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে বাঙালি সৃজনশীলতার
শিখর ছুঁতে পারছে না। এই অক্ষমতার জন্যে কোনও বিশেষ একটি কারণ দায়ী নয়। শৃঙ্খলার
অভাব এসেছে সমাজ জীবনে, দারিদ্র এবং
কুসংস্কার থেকে মুক্তি আমরা পাইনি। পাইনি বলেই শিব ও সুন্দরের সাধনা আমরা কিছুটা
পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি। বস্তুর প্রতি অত্যন্ত বাজারি আকাঙ্খা শিল্পবোধ তথা
মননশীলতা হরণ করে। এই সত্য আজ আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।
বাংলা
ভাষা মাধ্যম হলে স্কুল চলে না, ছেলেমেয়েরা বাংলা কথা
বলতে লজ্জা পায়, ফটফট করে ইংরেজি এবং হিন্দির মিশ্র এক
ভাষা আবিষ্কার করেছে। অত্যন্ত প্রয়োজন না হলে মিশ্র ভাষা ব্যবহার করা উচিত নয়।
কিন্তু এই অপসংস্কৃতি বাংলার যৌবনে শিকড় গজিয়েছে। আমরা কি আশা করতে পারি যে তারা বাংলা
পড়বে, রবীন্দ্রনাথকে জানবে? অবশ্য একথা বলা যায়না যে কিশোর কিশোরীরা সাহিত্য পড়ে না, তারা পড়ে হ্যারি পটার। আশঙ্কা হয় শিশুরা বীরপুরুষের টগবগিয়ে
ঘোড়ায় চড়ার অভিযাত্রায় সামিল হবে না। নিজেকে হারিয়ে ফেলার রহস্য আর তাদের জীবনে
স্বপ্ন হয়ে ধরা দেবে না, কিন্তু আশঙ্কা করে
লাভ নেই, চলমান সমাজজীবনে কে কোথায় দাঁড়াবে তার
বিচার করবে মহাকাল। মানুষকে অতিমাত্রায় প্রলুব্ধ করব কেরিয়ার গঠনে, পার্থিব বস্তুর সম্ভার আহরণে আর সস্তা বিনোদনে, অন্যদিকে চাইব পরিশীলিত বাংলা সংস্কৃতির চর্চা- সে তো সোনার
পাথরবাটি! অদ্ভূত শোনালেও আমরা লক্ষ করি বিভিন্ন জেলার বইমেলায় বাংলা বই বেশি
বিক্রি হয়। তাহলে কি মেনে নেব যে গ্রামীণ বাংলায় বস্তুসম্ভারের হাতছানি পৌঁছয়নি? কিংবা পৌঁছচ্ছে, কারণ সেখানে টেলিভিশন
গিয়েছে, তবু মাটির ঘ্রাণের প্রতি তীব্র অনীহা
জন্মায়নি। ফলে তাদের জিজ্ঞাসু মনে বাংলার শিল্প সাহিত্যের সম্পদ এখনও আগ্রহ সৃষ্টি
করে চলেছে। অচিরে তাও পথ হারাতে পারে। এছাড়া প্রতিদিনের জীবনে যা প্রচন্ড পরিতাপের
বিষয় বলে মনে হয় তা হল বাঙালির ভাষায় যে পরিমার্জিত, কথিত
রূপ ছিল, তা উধাও। কদর্্য ভাষা, রাস্তার ভাষা মঞ্চে সমাদৃত হচ্ছে এই রাজ্যে বারবার। রাজনীতির
মঞ্চে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নোংরা কথা বলার প্রতিযোগিতা। নাটক-সিনেমার সংলাপে, গানের কথায়, রোজকার কথাবার্তায়
উঠে আসছে গালাগালি, স্থূল শব্দ প্রয়োগ আর
অসুস্থ রুচি। একাধিকবার সে ভাষার কুৎসিত প্রয়োগ দেখে সন্দেহ হয় হয়তো জনপ্রিয়তা
পাচ্ছে আমার মাতৃভাষার এমন উচ্ছিস্ট রূপ। যদি রবীন্দ্রনাথ হন সুস্থ সংস্কৃতির
সম্মাননীয় প্রতিনিধি তাহলে আজ বাংলা চলতি ভাষার যে রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি তা
জঘণ্য অপসংস্কৃতির নারকীয় শিখরে পৌঁছনোর সুগম পথ।
বাংলার
সংস্কৃতি আজ সংকটের মুখোমুখি। যেহেতু ভারতবর্ষের অঙ্গরাজ্য তাই পশ্চিমবাংলায় ওপার
বাংলার মতো বাংলা নিয়ে গর্ব নেই। ওঁদের মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষা
বাংলা কিন্তু আমাদের অন্তত তিনটি ভাষা না হলে চলে না, ফলে একটি ভাষার সাধনায় কালক্ষেপ না করে আমরা ইন্ডিয়ার আধুনিক
জীবনে একটি স্বচ্ছল জীবনের প্রত্যাশায় অধীর হয়ে থাকি। এই অধৈর্য পার্থিব জীবনের এক
অভিশাপ, কাকেই বা দোষ দেব এই সঙ্কটের জন্য? একদিকে বাড়ি, গাড়ি সুখী পরিবারের
স্বপ্ন আর অন্যদিকে বাঙালি সত্তার আত্মবিসর্জন! এই টানাপোড়েনে বিধ্বস্ত বাংলার
তরুণ, তরুণী মাতৃভাষাকে প্রাপ্য মর্যাদা দিতে
পারছে না।
রবীন্দ্রনাথ
বাংলার সর্বাত্মক চেতনার সংস্কৃত রূপ প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছিলেন আমাদের জীবনে, হয়তো তা পূর্ণতা পেল না। কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না যে
প্রতিটি বাঙালির অন্তর্লোকে আনন্দলোক মঙ্গলালোকের প্রতি গভীর আর্তি আছে। শিশুকাল
থেকে আমাদের দিন শুরু হয় তাঁর রচিত প্রার্থনাসঙ্গীত দিয়ে, সে গানে জীবনালোকের পরম সত্যকে তিনি স্থির করে দেন আমাদের মনে।
সেই পরম সত্যের পথে চলার লক্ষ্য নিয়েই শিশুর অভিযাত্রা শুরু হয়। তারপর! তারপর আমরা
আশায় থাকি যে জীবনপথের জটিল কুটিল আবর্তে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হবে না কবির
আকুলতা। বাঙালির মধ্যে সিঁধ কেটে ঢুকবে না
গোঁড়ামি চুপিসাড়ে আলোর বিপরীতে।
রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থাকবে অমলিন হয়ে। যে বহুমুখী এক ঝর্নাধারা নেমে
প্লাবিত করেছিল আমাদের জীবন সেই ঝর্নার মুখে হাজার পাথর চাপা দিলেও তার গতি
সম্পূর্ণ রুদ্ধ হবে না। সচেতনভাবে রবীন্দ্র ভাবনার বহমানতা সব রকমের খরা কাটিয়ে
বাঙালি তথা সমগ্র মানবজীবনকে রাখবে সিক্ত করে। উর্বর থাকবে আমাদের চেতন, মনন ও সত্তা।
কপিরাইট সমর্পিতা
ঘটক কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন