বাইরে থেকেই শুনতে পেলেন ইউনিয়ন-অফিসে হাসির আওয়াজ। একা রামে রক্ষা নেই, তাহে সুগ্রীব দোসর। ও মেয়েদুটোও আছে মনে হচ্ছে। ডেসপ্যাচের ললিতা, আর পারচেজের মানসী। আড়ালে সবাই ওদের ‘টিকটিকি’ বলে। সর্বক্ষণ ইউনিয়ন-অফিসে পড়ে আছে। সব স্টাফের হাঁড়ির খবর ওদের জানা। কার স্বামী কোন অফিসে কোন পদে চাকরি করে, কার বৌ অসুস্থ, কার ছেলেমেয়ে নিয়ে অশান্তি, এমনকি টিফিনে কে কি খাবার আনে। সর্বদা হিহি করে হেসেই চলেছে। পারতপক্ষে ওদের এড়িয়ে চলেন বিপিনবাবু। এখনও গুটিয়ে গেলেন। শামুকের মতো খোলের মধ্যে ঢুকে পড়তে ইচ্ছে হল। কিন্তু উপায় নেই। কি একটা হাসির কথায় হাসছিলেন নেতা, বিপিনবাবুকে
ঢুকতে দেখে হাসিটা গিলে নিলেন। ‘কি ব্যাপার দাসসাহেব? আজকাল ডেকে না পাঠালে
ইউনিয়ন-অফিসে পা দেন না। ব্যাপার কি?’ নিয়ম করে স-পারিষদ সভা
হয় রোজ,
সভাসদরা হাজিরা দেয় এখানে, জানেন
বিপিনবাবু। কি বলবেন বুঝতে না পেরে চেয়ে রইলেন। ‘দাসসাহেব’ ডাক শুনে বুকের মধ্যে কাঁপুনি।~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মিছিল
আইভি চট্টোপাধ্যায়
সকালে অফিসে এসে এক কাপ চা খেয়েছিলেন। মন্টু চায়ের এঁটো কাপ তুলে নিয়ে গেছে, কিন্তু
টেবিলে গোল একটা ছাপ থেকে গেছে। সেই গোল দাগ ঘিরে পিঁপড়েদের একটা বৃত্ত তৈরি হয়েছে। বৃত্তটা ক্রমে ক্রমে জমাট বেঁধে ফেলছে। টেবিলের নিচের অদৃশ্য কোনো জায়গা থেকে দলে দলে পিঁপড়ে সারি বেঁধে উঠে আসছে।
একের পেছনে এক। লাইন ধরে ধরে। কে ওদের এ নিয়ম শিখিয়ে দিয়েছে কে জানে। পিঁপড়েদের মিছিলের দিকে একভাবে তাকিয়ে বসেছিলেন বিপিনবাবু।
বিপিনবিহারী দাস। অফিসের বড়সাহেব ডাকেন, ‘দাসসাহেব’, সহকর্মীরা ডাকেন ‘দাসদা’। সম্প্রতি আর একটা নতুন নাম পাওয়া হয়েছে। ডেসপ্যাচ সেকশন থেকে বদলি হয়ে আসা নতুন মেয়েটা খিলখিল করে হেসে বলেছিল, ‘আপনিই তো বি বি দাস! বিবি কা দাস!’ পুরোনোরা মুখ টিপে
হেসেছিলেন। অল্পবয়সী ছেলেগুলো হৈহৈ করে উঠেছিল, ‘দারুণ দিয়েছেন মৌমিতাদি।‘
সেকশন–ইনচার্জ সুপ্রতীকবাবু বলে উঠেছিলেন, ‘সব বিবাহিত পুরুষই বিবি
কা দাস রে ভাই। ওঁকে টানাটানি করে কি হবে? কাজ করুন,
কাজ করুন।‘
হাসির হল্লা বয়েছিল অনেকক্ষণ, ‘যাই বলুন, মৌমিতাদি এসে সেকশনের হাওয়াটাই বদলে দিয়েছেন।‘
হাওয়াবদল তো বটেই।
আধঘন্টা দেরিতে অফিসে ঢুকে খানিকক্ষণ সিটে বসে জিরিয়ে নেবেন তিনি। রাস্তার ধকল তো কম নয়। তারপর একটা ধূপ জ্বালবেন। মহীন এসে দাঁড়াবে। ব্যাগ থেকে প্রসাদের ঠোঙা বার করে দেবেন। মহীন অফিসের কাজ বন্ধ করে টেবিলে টেবিলে গিয়ে নকুলদানা বাতাসা বিতরণ করবে। বিশেষ বিশেষ দিনে সন্দেশ কালাকাঁদ
নারকেলনাড়ু। সকালে পুজো করে, বরকে
অফিস পাঠিয়ে,
ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে অফিস আসতে কত খাটুনি, সে গল্প হবে তারপর। পাখাটা নিজের দিকে পুরো ঘুরিয়ে নিয়ে হাওয়া খাবেন। আর বলবেন,
‘এবার সেন্ট্রাল এয়ারকন্ডিশনিং নিয়ে ভালো করে লড়তেই হবে। অফিসে এসি না থাকলে পোষায়!’
হাওয়ার সঙ্গে ধূপের গন্ধ ছড়িয়ে পড়বে সেকশন জুড়ে। সেই গন্ধে আমোদিত হয়ে কেউ আর দিদিকে কাজের কথা মনে করিয়ে দিতে পারবে না।
এমন আবেশেও বিপিনবাবু ঘাড় গুঁজে একমনে কাজ করে চলেন। খিলখিলিয়ে হাসেন মৌমিতাদি, ‘কি বিবিদা? মুখ গোমড়া কেন? বৌদির রান্নাঘরের কাজ শেষ করে আসেন নি?’
সোমেনের টিপ্পনী, ‘সেই ভয়েই তো ব্যাজারমুখে কাজ করছে, বাড়ি গিয়ে ঝাড় হবে সেই ভাবনায়।‘
সারা শরীরে তরঙ্গ তুলে দিদি হাসবেন।
অধীর এসে দাঁড়াবে, ‘দাদা ডাকছেন।‘ ব্যস হয়ে গেল। তিনি উঠে ইউনিয়ন অফিসের দিকে এগিয়ে যাবেন। দিদির টেবিল থেকে ফাইল তুলে অসীমের টেবিলে
পৌঁছে দেবে মহীন। অসীম চাপাগলায় বলবে, ‘এবার একঘন্টা ওদিকে কাটিয়ে আসবেন উনি। আমি খেটে মরি।‘
সুপ্রতীকবাবু বলবেন, ‘আপনি বরং এনপিএ ফাইলটা নিন। রিটার্ন ফাইল দাসবাবুকে দিন। ওটা একঘন্টার মধ্যে করে দিতে হবে। দুদিন ধরে পেন্ডিং। বড়সাহেব এসেই তলব করবেন।‘
অসীম গজগজ করবে, ‘সেই তো। আমি আর বিপিন খেটে মরি। আর তিনি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ান। কিছু বলতে পারেন না কেন?’
সোমেন ললিত হৈ হৈ করে উঠবে, ‘একদম পেছনে ফুট কাটবেন না
অসীমদা। সাহস থাকলে যা বলার সামনে বলবেন। মৌমিতাদি আমার আপনার জন্যেই কাজ করছেন। কত জরুরি মিটিং আজ শুভদীপদার ঘরে, জানেন?’
দেবু চোয়াল শক্ত করবে,‘আমরা এখানে আছি,ভুলে যাবেন না। সংগঠনের জন্যে জান কবুল।‘
দীপক গলা তুলবে তখন, ‘সংগঠন? হাসিও
না দেবু। তোমাদের জন্যে কর্মসংস্কৃতি বলে আর কিছু
রইল না। অথচ ইলেকশনের আগে কত বড় বড় কথা। হ্যান করেঙ্গে, ত্যান
করেঙ্গে।‘
টেবিল চাপড়ে তর্ক শুরু হয়ে যাবে। সামনে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জনতা মাঝে মাঝে স্বর মেলাবেন, মাঝে মাঝে অধৈর্য হয়ে স্বর তুলবেন।
সুপ্রতীক জানা টেলিফোন তুলে কথা বলতে থাকবেন। কার সঙ্গে এত কথা কে জানে। তবে তর্কাতর্কি না থামা পর্যন্ত কান থেকে টেলিফোন নামবে না।
এই নিত্যকার ছবি।
আজও সেরকম চলছিল। দেবু সোমেন সকাল থেকে মৌমিতার টেবিলে বসে গুলতানি করছিল। শিগগিরই এরিয়ার পাবার কথা। কার কিরকম মাইনে বাড়বে, কে কিরকম এরিয়ার পাবে, সব হিসেব হচ্ছিল। দেবু বৌ-মেয়ে নিয়ে কাশ্মীর বেড়াতে যাবে। সোমেন ল্যাপটপ কিনবে। ললিতের সব টাকা বৌই নিয়ে নেবে। হাসি আড্ডায় সব কানে আসছিল।
অধীর এসে দাঁড়ালো, ‘শুভদীপদা ডাকছেন।‘
আড্ডা ভেঙে গেল। আঁচল তুলে নিয়ে লীলায়িত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ‘যান মৌমিতাদি, আমাদের ওভারটাইমের টাকার কথাটা বলতে ভুলবেন
না।‘
‘আপনাকে না,
দাদাসদাদাকে ডাকছেন’, অধীর
বলে উঠল।
‘আমাকে!’
বিস্ময়ে মুখটা হাঁ হয়ে গেল বিপিনবাবুর। এই ডাক টাক এলেই ঘাবড়ে যান তিনি।
‘ঠিক শুনেছ অধীর? আমাকে ডাকছেন না?’ মৌমিতাদির
পাতলা ভ্রুযুগল কম বিস্মিত নয়।
‘দূর! কান শুনতে ধান শোনে।আপনাকেই ডাকছেন শুভদীপদা।একবার ঘুরেই আসুন মৌমিতাদি।‘ দেবু বলল।
‘হ্যাঁ,
দেখি কি হল’, দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেলেন তিনি। চায়ের পরের মৌতাতের টানে বাইরে বেরিয়ে গেল
কেউ কেউ। এখন আর সেকশনের মধ্যে টান নেই।
এই মুহুর্তে ইউনিয়ন-অফিসে যাওয়া ঠিক হবে কিনা বুঝতে না পেরে বসেই রইলেন
বিপিনবাবু।
‘যান দাসদা। ভটচাজসাহেব ডাকছেন’, দীপক
জোরগলায় বলে উঠল, ‘দেরি করলে আপনার গর্দান চলে যেতে পারে।‘ খুকখুক করে কাশল অরূপ।
এই আর এক মুশকিল। এরা অন্য ইউনিয়নের লোক। আড়ালে হম্বিতম্বি করে। একজন নির্বিবাদী শ্রোতা পেলেই হল। সামনাসামনি কিছু বলার সাহস নেই।
এমনিতে নেতাদের গালিগালাজ করলে শুনতে ভালোই লাগে। কিন্তু তা বলে এমন সোজাসুজি ! কথাটা শুনতেই পাননি, এমন
ভান করে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন বিপিনবাবু। আড়চোখে একবার চারদিকে তাকিয়ে নিলেন। অসীম আর প্রভাসদা এদিকেই চেয়ে আছে। চশমার ফাঁক দিয়ে তাকালেন সুপ্রতীকবাবুও, ‘ঘুরে
আসুন। আমি দেখছি এদিকটা।‘
পেনশনের লাইফ-সার্টিফিকেট জমা দেবার মাস। বিপিনবাবুর টেবিলের সামনে লম্বা লাইন। বেঁচে থাকার প্রমাণ দেবার জন্যে দীর্ঘ মিছিল। বয়সের ভারে ন্যুব্জ, বার্ধক্যজনিত অসুখে জীর্ণ
মানুষের মিছিল। দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে কেউ কেউ মাটিতেই বসে
পড়েছেন।
বিপিনবাবুকে উঠে দাঁড়াতে দেখে কেউ কাতর চোখে তাকালেন, কেউ
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। রাগও করলেন কেউ কেউ। রাগ হবারই কথা। পেনশন তোলার জন্যে কৃপাপ্রার্থী হয়ে থাকা। সেটুকুও সময়ে হবে না? কাজের সময়ে ইউনিয়নের কাজে ছুটতে
হবে?
মাথা নিচু করে সরে এলেন বিপিনবাবু।
***
বাইরে থেকেই শুনতে পেলেন ইউনিয়ন-অফিসে হাসির আওয়াজ। একা রামে রক্ষা নেই, তাহে সুগ্রীব দোসর। ও মেয়েদুটোও
আছে মনে হচ্ছে। ডেসপ্যাচের ললিতা, আর
পারচেজের মানসী। আড়ালে সবাই ওদের ‘টিকটিকি’ বলে। সর্বক্ষণ ইউনিয়ন-অফিসে পড়ে আছে। সব স্টাফের হাঁড়ির খবর ওদের জানা। কার স্বামী কোন অফিসে কোন পদে চাকরি করে, কার বৌ অসুস্থ, কার ছেলেমেয়ে নিয়ে অশান্তি, এমনকি টিফিনে কে কি খাবার আনে। সর্বদা হিহি করে হেসেই চলেছে। পারতপক্ষে ওদের এড়িয়ে চলেন বিপিনবাবু। এখনও গুটিয়ে গেলেন। শামুকের মতো খোলের মধ্যে ঢুকে পড়তে ইচ্ছে হল। কিন্তু উপায় নেই।
কি একটা হাসির কথায় হাসছিলেন নেতা, বিপিনবাবুকে ঢুকতে দেখে
হাসিটা গিলে নিলেন। ‘কি ব্যাপার দাসসাহেব? আজকাল ডেকে না পাঠালে ইউনিয়ন-অফিসে পা দেন না। ব্যাপার কি?’
নিয়ম করে স-পারিষদ সভা হয় রোজ, সভাসদরা হাজিরা দেয় এখানে, জানেন বিপিনবাবু। কি বলবেন বুঝতে না পেরে চেয়ে রইলেন। ‘দাসসাহেব’
ডাক শুনে বুকের মধ্যে কাঁপুনি।
‘কি হল?
ডেকে পাঠালেও আসেন না কেন?’
চেষ্টা করে মুখে হাসি ফোটালেন বিপিনবাবু, ‘তা কেন? অধীর বলতেই তো উঠে এলাম।‘
‘এসে ধন্য করেছেন। কাল বিকেলে আপনাকে মিছিলে দেখলাম না কেন? ত্রিবেদীর
ফেয়ারওয়েলের দিনও ছিলেন না আপনি। ইউনিয়নের কাজকর্মে যে আপনার দেখাই পাওয়া যাচ্ছে না। ত্রিবেদীর ফেয়ারওয়েলে এই মেয়েরা সবাই রাত দশটা পর্যন্ত ছিল। আপনি থাকলেন না। কেন?’
সেসব হুল্লোড়ের ছবি দীপক দেখিয়েছে। আবির নিয়ে মাখামাখি, কে কাকে জড়িয়ে ধরে আবির মাখাচ্ছে
তার ঠিক নেই।
‘বেলেল্লাপনার চূড়ান্ত’, পারচেজের সরকার বলেছিল, ‘ভাগ্যিস আপনি ছিলেন না দাসদা। না পারছি বেরিয়ে যেতে, না পারছি বসে থাকতে। আপনি বেঁচে গেছেন।‘
সেসব তো আর বলা যায় না। মিনমিন করে বললেন, ‘আসলে সেদিন একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি
চলে যেতে হয়েছিল। গিন্নীর শরীর ভালো ছিল না, ডাক্তারের কাছে যাবার ছিল।‘
‘গিন্নী’
শুনেই পেছন থেকে হাসির বন্যা।
চাপাহাসিটা একটু ভরাট হল নেতার ঠোঁট জুড়ে, ‘একদম
অজুহাত দেবেন না। একদম না। সবসময় আপনার একটা না একটা বাহানা থাকে। সেনদার ফেয়ারওয়েলের চাঁদা তোলার সময় সুব্রতকে কি বলেছিলেন? কেন টাকা দিতে টালবাহানা করেছিলেন?’
টেবিলে সপাটে চাপড় পড়ল। কেঁপে উঠলেন বিপিনবাবু। গতিক সুবিধের নয়। খুব রেগে আছেন নেতা।
বারোশ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়েছিল। সে টাকায় বিদায়ী নেতাকে একখানা গাড়ি উপহার দেওয়া হয়েছিল। মাসের শেষ,
একটু টালবাহানা করেছিল অনেকেই। এতদিন পর সেসব কথা কেন? একটু একটু বুঝতে পারছেন অবশ্য। এই মেজাজ অন্য কোনো ঘটনার ভনিতা। প্রথমেই দাবড়ানি দিয়ে প্রতিপক্ষের স্নায়ু
স্ববশে আনার বৃটিশযুগের কায়দা। ভেতরে ভেতরে ঘামতে লাগলেন বিপিনবাবু।
‘কি যে মাথা গরম করেন শুভদীপদা?’ ললিতা এসে চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়েছে।
নেতার অত কাছে ললিতাকে দেখেই বোধহয় মৌমিতা তাড়াতাড়ি পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল, ‘বাদ দিন শুভদীপদা, বিবিদাকে কেন ডেকেছেন সেটা বলুন বরং।‘
‘দেখেছেন?
এই হল আজকালকার মেয়ে। মাত্র চারবছর হল জয়েন করেছে, এসেই ইউনিয়নের কাজে কেমন
ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ললিতাকে দেখুন, কিভাবে
সংগঠন তৈরি করতে হয় ওকে দেখে শিখুন। অফিসে সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, বাড়ির খবর রাখে। আপনার মতো একলষেঁড়ে নয়। মানসীর মা হাসপাতালে, তবু কালকে মিছিলে হেঁটেছে, বক্তৃতা করেছে। অফিস এসে ঘাড় গুঁজে কাজ করে বাড়ি চলে গেলেই
হবে?
ইউনিয়নের অ্যাক্টিভিটিতে থাকতে হবে না? মাইনে যখন বাড়বে, আপনার বাড়বে না? বুড়ো
হয়ে রিটায়ার করতে চললেন, এখনো ধরে এনে কাজের কথা বলে
দিতে হবে?’
হট্টগোল শুনে দরজা দিয়ে উঁকি মারছে কয়েকজন। হাত নেড়ে সবাইকে ডেকে নিলেন নেতা। অনেক লোকজন না থাকলে প্রতাপ দেখিয়ে লাভ কি?
গলাটাও চড়ল,
‘শুনুন দাসদা, এই শেষবারের মতো বলছি। এরপর থেকে প্রতি মিছিলে আপনার হাজিরা চাই। মৌমিতা আপনাকে খবর দেবে। খবর পাইনি বলার সুযোগ পাবেন না। এরপর থেকে যে মিছিলে আসবে না, তাকে একদিনের মাইনে ফাইন দিতে হবে। এই ঠিক হয়েছে।‘
এ নিয়ম কে ঠিক করল, তা অবশ্য ভেঙে বলার প্রয়োজন মনে
করেন না তিনি।
অধৈর্য ললিতা পেপারওয়েটটা হাতে তুলে নিল। ভয় পেলেন বিপিনবাবু। ছুঁড়ে মারবে নাকি ! যা মারকুটে হয়ে আছে সবাই !
***
কালকের মিছিলে না যাবার কারণ আরেক মিছিল।
দুপুরবেলা ফোন এসেছিল। হাপুস কাঁদছে টুনটুনি,‘বাবা, আমাকে
সায়েন্স দেয় নি। বলছে কমার্স নিয়ে পড়তে হবে।‘
অনেক আশা নিয়ে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করেছিলেন মেয়েকে। গিন্নী রাজি ছিলেন না। অনেক খরচ,
সামান্য কেরানীর মেয়ের অমন শৌখিনতা মানায় না। গিন্নীর অমতে জীবনে এই একটা কাজ করেছিলেন
বিপিনবাবু। ইংরেজি স্কুলগুলো প্রফেশনাল চাকরির জগতের
জন্যে তৈরি করে দেয়। খুব আশা,
মেয়ে তাঁর থেকে একধাপ ওপরে কেরিয়ার শুরু করবে। তাঁর চাকরিজীবনের রোজকার অসম্মান, অপমান মেয়ের জীবনে দেখতে চান না তিনি।
দশ ক্লাসের পরীক্ষা পাশ করেছে টুনটুনি। কেউ বলে দেয় নি, স্কুলে ইলেভেন-টুয়েলভ ক্লাসের জন্যে আবার
তদবির করতে হয়। টুনটুনির মতো কয়েকজন, যারা স্কুলের বিশেষ কয়েকজন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট টিউশন পড়ে নি, তাদের সায়েন্স গ্রুপে জায়গা হয় নি। মেয়েটা তাঁর মতোই বোকা হয়েছে। টিউশনিচক্রের মিছিলে শামিল হতে পারে নি।
‘তুমি একবার স্কুলে আসবে বাবা? মিতালি রুবন প্রিয়াঙ্কা সবার
বাবারা এসেছেন। সবাই মিলে প্রিন্সিপালের কাছে যাচ্ছেন।‘
অভিভাবকদের একটা অ্যাসোশিয়েশন আছে। তাঁরা রীতিমতো বকাঝকা করলেন, ‘আপনাকে তো কোনো মিছিলেই পাই না। গতবারের অত ইম্পর্ট্যান্ট মিছিলটাতে এলেন
না আপনি। এখন বুঝছেন তো, কেন
অ্যাসোশিয়েশনের সঙ্গে থাকতে হয়।‘
ও মিছিলে ইচ্ছে করেই হাঁটেন নি বিপিনবাবু। পরীক্ষার হলে টোকাটুকি করার জন্যে চারজন ছাত্রকে সাসপেন্ড করেছিল স্কুল। সে নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা তো বটেই, অভিভাবক অ্যাসোশিয়েশনও তান্ডব চালিয়েছিল স্কুলে। টিভি নিউজেও দেখিয়েছিল খবরটা। স্কুল তবু নরম হয় নি। প্রতিবাদে মিছিল শহর পরিক্রমা করেছিল। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ডেপুটেশন জমা দিয়েছিল সবাই মিলে।
বিপিনবাবুর বিবেক সায় দেয় নি। টোকাটুকির মতো অপরাধে শাস্তি হবে না? তাঁদের
ছাত্রাবস্থায় ‘ডিসিপ্লিন’
একটা পবিত্র শব্দ ছিল।
কিছু বললেন না অবশ্য। মাথা নিচু করে অপরাধীভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আজকের মিছিলে শামিল হতেই হবে। নইলে টুনটুনির সায়েন্স পড়া হবে না। কত স্বপ্ন মেয়ের। ফিজিক্স নিয়ে পড়বে, গবেষণা করবে। দশ-ক্লাসের পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে ছিয়াশি
পার্সেন্ট পেয়ে পাশ করেছে, প্রাইভেটে না পড়েও।
হাসির আওয়াজে ঘোর কাটল।
‘দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখছেন নাকি?’ নেতার মুখে চওড়া হাসি।
‘না না,
বিবিদা গিন্নীর কথা ভাবছেন’, মৌমিতা
জোরেই হেসে উঠল।
‘কাজের কথা হোক। যে কারণে আপনাকে ডেকেছি। আপনার নামে একটা ইন্সেনটিভ এসেছে। একজন কমরেড হিসেবে আমরা গর্বিত। আমাদের মধ্যে থেকে একজন এ ইন্সেনটিভ
পেয়েছেন। যতই চালাকি করুক ম্যানেজমেন্ট, দিতে ওদের হবেই। কতদিন ধরে এ নিয়ে ডেমনস্ট্রেশন দিচ্ছি, ওয়ার্ক
টু রুল চালাচ্ছি, আপনারা সবাই জানেন।‘
ভেতর থেকে চমক। অ্যাওয়ার্ড, অ্যাপ্রিসিয়েশন, ইন্সেনটিভ,
এসব তো ইউনিয়নের কাছের লোকরাই পায়। এবার বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল কি করে? আনমনেই
মাথা উঁচু করে চাইলেন। সে দৃষ্টির তরঙ্গে নেতার কপালে ভাঁজ। মাথাউঁচু লোকজন নেতা পছন্দ করেন না।
গলা চড়ল,
‘ম্যানেজমেন্টের চালাকি। ইউনিয়নকে বাদ দিয়ে এবার নাম পাঠানো হয়েছে। ওই সুপ্রতীক মাইতি আপনার নাম সুপারিশ করেছে। ওকে ছাড়ব না, ইতিমধ্যেই কথা বলে নিয়েছি, ওকে বদলি করিয়ে দেব। এ শর্মা কম ঘাটের জল খায় নি।‘
মনে মনে সুপ্রতীকবাবুর কাছে কৃতজ্ঞ হলেন বিপিনবাবু। মৌমিতা বলল, ‘তবে যে সুপ্রতীকদা বললেন, উনি কিছু জানেন না?’
‘আমাকেও তাই বলেছে। কম্পিউটারের যুগ, হেড অফিস নাকি কম্পিউটার ঘেঁটে এবার
পারফরমেন্স রিপোর্ট তৈরি করেছে। সত্যি হতেও পারে। তবে সুপ্রতীক মাইতিকে একবার কড়কে দিতে হবে। আজকাল ইউনিয়নের কাজকর্ম নিয়ে নানা কথা বলে। গত বছরে পারফরমেন্স অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। অনেকদিন ধরে রাগ আছে ওর ওপর। এই সুযোগ।‘
নির্বাক মুখগুলোর ওপর ঘুরে এল চোখ।
মুষ্টিবদ্ধ হাত ওপরে উঠে এল, ‘কম্পিউটার সব তথ্য দিয়েছে। সারাবছর কে কি কাজ করেছে, সে কাজে কোম্পানির কি লাভ হয়েছে সব তথ্য। এইজন্যেই কম্পিউটারের বিরোধিতা করেছিলাম আমরা সেই কতদিন আগে। তখনি জানতাম আমরা, এইসব হতে যাচ্ছে। এ কিছুই না কমরেড। এইভাবে শ্রমিক ইউনিয়নকে দুর্বল করে দেবার সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা ইতিহাসে
বারবার হয়েছে।‘
দম নেবার জন্যে থামলেন একপলক।
পরক্ষণে উঠে দাঁড়ালেন, ‘এ অন্যায় করতে দেব না আমরা। সারা বছর সবাই কাজ করবে, আর ম্যানেজমেন্ট নিজের ইচ্ছেমতো লোক বেছে নিয়ে অ্যাওয়ার্ড দেবে? ইন্সেনটিভ দেবে? এইসব ম্যানেজমেন্টের দালাল লোকগুলোকে
আমাদেরই চরাতে হয়। ম্যানেজমেন্ট অপাত্রে যাতে টাকা না দান করে, তা দেখার জন্যে আমরা শতচক্ষু মেলে জেগে আছি।‘
‘চরানো’
শুনে নিজেকে চতুষ্পদ প্রাণী ভাবতে শুরু করেছিলেন বিপিনবাবু, ‘অপাত্র’
শুনে থমকে গেলেন। অফিসে এসে সততার সঙ্গে নিজের কাজটুকু করে যাওয়া। এই তো করেছেন। সুপ্রতীক মাইতির চোখে যদি পড়েও থাকে, কাজটুকুই পড়েছে।
কি করে যে ম্যানেজমেন্টের দালাল হয়ে উঠলেন কে জানে। কি কুক্ষণে যে কম্পিউটার তাঁর নামটাই সুপারিশ করল!
***
‘বাক্যিহারা হয়ে গেলেন যে’, ধমকে উঠল জয়ন্ত, নেতার প্রিয় পারিষদ। ‘শুভদীপদা কি বলছেন, কানে ঢুকছে?’
‘আহ জয়ন্ত।অমন করে বোলো না। দাসদা আমাদের পুরোনো কমরেড, উনি বুঝতে পারছেন। আমরা যে ম্যানেজমেন্টের চক্রান্তের সঙ্গে
লড়াই করছি,
তা সকলের ভালোর জন্যে।‘
‘শুনুন দাসবাবু’, গোস্বামী বলে উঠল। নেতার আরেক প্রিয় পারিষদ। ‘ও টাকা থেকে ইউনিয়ন এক পয়সাও নেবে না। কিন্তু আপনারই সহকর্মীরা, যারা আপনার ডিপার্টমেন্টেই
সারাবছর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করছে, এই মৌমিতা সোমেন দেবু, তাদের সঙ্গে টাকা ভাগ করে নিতে হবে। আলাদা করে কেউ ইন্সেনটিভ পাবে তা হতে দেব না আমরা।‘
আলাদা করে কেউ ইন্সেনটিভ পাবে, তা হতে দেবে না ইউনিয়ন। অথচ বছর বছর লোন সেকশনের প্রবীর, বিল সেকশনের অনুপম ইন্সেনটিভ পায়। এই মেয়েরা তিনজন কতবার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। সোমেন আর দেবু প্রতিবছর অ্যাপ্রিসিয়েশন লেটার পায়। সে টাকার ভাগ কোনোদিন বিপিনবাবুকে দেবার কথা কারো মনে হয়নি। তিরিশ বছর চাকরিজীবনে এই প্রথম ইন্সেনটিভে
নাম এসেছে বিপিনবাবুর।
আত্মপ্রসাদের হাসি নেতার মুখে, ‘বুঝেছেন তো? ইউনিয়ন সবার, কোম্পানিও সবার। এই যে মৌমিতা, নতুন এসেই কিভাবে দশভুজা দুর্গার মতো কাজ
করছে। সোমেন ললিত দেবু, কিভাবে
দীপকদের দলের সঙ্গে লড়াই করে আমাদের সংগঠনকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আর আপনি?
কোনোদিন মিছিলে হাঁটেন না, কোনোদিন
ইউনিয়নের মিটিং-এ আসেন না, তবু আপনাকে আমরা বছর বছর
ইনক্রিমেন্ট দিয়েছি, ভালো ডিপার্টমেন্টে বদলি করেছি। অ্যাকাউন্টস সেকশনে না থেকে আপনি যদি
ডেসপ্যাচ সেকশনে থাকতেন, তা হলে কি কাজটা এমন হাইলাইট হত? সুপারিশ হত আপনার নাম?’
চাকরিসূত্রে কোনো ইনক্রিমেন্ট পাওনা হয় নি? ইউনিয়নের
দাক্ষিণ্যেই ইনক্রিমেন্ট?
প্রশ্নটা গিলে নিলেন বিপিনবাবু।
‘দুনিয়াটা বেইমানে ভরা। বুড়োহাবড়া,
অরাজনৈতিক, অজ্ঞ, মূর্খ
লোকদের নিয়ে কিভাবে চলতে হয় আমরাই জানি। এই যে দাসদা, আপনি কি জানেন যে এ অফিসে আপনার প্রথম
পোস্টিং করিয়েছিল ইউনিয়ন? এমন মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন, যেন টাকা ভাগ করে নিতে বলে আপনাকে ফাঁসিকাঠে ঝুলতে বলা হয়েছে।‘
রীতিমতো লিখিত পরীক্ষা দিয়ে, ইন্টারভিউ দিয়ে, মেডিকেল টেস্ট করিয়ে চাকরিতে ঢোকা। চাকরিতে জয়েন করার পর প্রথম ছ’মাস নানা ব্রাঞ্চে ঘুরে ঘুরে
ট্রেনিং নিতে হয়েছিল, তারপর ছ’মাস
প্রোবেশন পিরিয়ড। চাকরি পাকা হবার পর ইউনিয়নের সদস্যপদ নিতে
হয়েছিল।
ইউনিয়ন কি আমাকে আগে থেকে চিনত যে আমার পোস্টিং-এর ব্যবস্থা করেছিল? প্রশ্নটা বুকের মধ্যেই ঘুরপাক খেতে লাগল অবশ্য। মুখে এল না।
মোবাইলে ফোন এল। ব্যস্ত নেতা কথা বলতে বলতে হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করলেন। ঘর ফাঁকা হয়ে গেল। চলে যাবেন,
নাকি দাঁড়িয়েই থাকবেন ডিসিশন নিতে পারছিলেন না বিপিনবাবু। গিন্নী ঠিকই বলে। ঠিকঠাক ডিসিশন নিতে পারেন না বলেই যত সমস্যা তাঁর।
ফোন রেখে অমায়িক হাসলেন নেতা, ‘তাহলে ওই কথাই রইল। বড়সাহেব চেক দিলেই সেটা মৌমিতার হাতে তুলে
দেবেন। আপনার ভাগের টাকা সুন্দর খামে করে
বড়সাহেবের হাত দিয়েই আপনাকে দেওয়াব। ছবি তোলা হবে। অফিস ম্যাগাজিনে সে ছবি থাকবে।‘
মৌমিতার দিকে ফিরলেন, ‘এদিকে কোনো ঝামেলা হলে আমাকে
বোলো।‘
কঠিন চোখে তাকালেন তারপর, ‘এসব নিয়ে কারো সঙ্গে আলোচনা
করবেন না। কোনোরকম উল্টোপাল্টা না হয়। তাহলে একটা টাকাও আপনি পাবেন না। আর তারপর অফিসে কি করে কাজ করেন দেখব। এখনো পাঁচবছর চাকরি আছে না আপনার? মেয়েও তো কলেজ যাবে দু’ বছরের মধ্যে। নাকি?’
গোস্বামী পিঠে হাত রাখল, ‘দাদার কথায় ঘাবড়ে গেলেন না তো? আপনার প্রোমোশনের ব্যাপারটা ঝুলে আছে না? দাদা
কিন্তু আপনার জন্যে বড়সাহেবকে বলেছেন ক’দিন আগেই। সবার দিকে দাদার নজর আছে।‘
দু’
বছরের বেশি হল, প্রোমোশনের ব্যাপারটা
আটকে আছে। এতদিন পর নেতার অভয়বাণী শুনেও তেমন আহ্লাদ
হল না।
***
ফিরে এসে নিঃশব্দে কাজ করেছেন বিপিনবাবু। পেনশনের লাইনের শেষ ভদ্রলোক বিদায় নেবার পর থেকে চুপ করে বসে পিঁপড়েদের মিছিল
দেখছেন।
আজ টিফিন খেতেও ইচ্ছে হয় নি। গ্যাস্ট্রিকের ব্যামো, ডাক্তার বারবার বলে দিয়েছেন
খাবার সময় ঠিক রাখার কথা। ইচ্ছে হয় নি। মাথাটা দপদপ করছে। মুখে গলায় ঘাড়ে জল দিয়েও লাভ হল না। এখুনি একবার স্নান করতে পারলে হত।
দীপক এসে বসল, ‘কিছুতেই ফাঁক পাচ্ছি না আপনার কাছে আসার। এবার বলুন, কি হল
ওখানে?’
এদিক ওদিক থেকে ক’জন মুখ ফেরালো। আরো গুটিয়ে গেল মনটা।
‘কি হবে বলে?
সবই তো জানো।‘
‘ওহ দাসদা। জানি আমি। তবু পুরোটা খুলে বলুন। আপনাকে নাকি ঘরে ডেকে খুব চমকেছে! ওই মেয়ে তিনটেও ছিল, না?
একটা কাজ করে না, সর্বক্ষণ খুকিগিরি করে বেড়াচ্ছে। আপনাকে নাকি খুব অপমান করেছে !’
‘বাদ দাও দীপক। চাকরি করতে এসে অত অপমান গায়ে মাখলে চলে না।‘
‘এই করে করেই ওদের বাড়িয়েছেন আপনারা। এই আপনাদের ম্যাদামারা চরিত্রের জন্যেই ওদের রমরমা। লাস্ট ইলেকশনের আগে আপনাকে পইপই করে বুঝিয়েছিলাম। তবু আপনি ওদের ভোট দিয়ে এসেছিলেন। আর ওই ঢলানি মেয়েটা। সন্ধের পরও ইউনিয়ন অফিসে বসে থাকে। সবাই কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলে?’
এই সেরেছে। দীপক অল্পকথায় ছাড়বে না মনে হচ্ছে। এতদিনে ক্ষমতা দেখানোর এমন সুযোগ পেয়েছে। রিটার্ন ফাইলটা টেনে নিলেন বিপিনবাবু।
ঠেলে সরিয়ে দিল দীপক, ‘রাখুন। আর কাজ দেখাতে হবে না। শুনুন,
আজ বিকেলে আমাদের একটা মিছিল আছে। অফিসের ব্যাপার না। মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে রাস্তায় নামছি আমরা। আপনি চলুন। রাজারামদা আসবেন। ওঁর সঙ্গে আমাদের বড়সাহেবের কেমন খাতির, তা তো
জানেন। এক কথায় হিল্লে হয়ে যাবে। নিজের পাওনা টাকা শুধু শুধু ছাড়বেন কেন?’
লোন সেকশনের কাজলও উঠে এসেছে, ‘আমাদের সেকশনের বিপ্লবকে
রাজারামদা প্রোটেকশন দিয়েছেন, ওরা কিছুই করতে পারে নি। রাজারামদা সাত্ত্বিক লোক, টাকাপয়সা কিছুই চাইবেন না। একদিন আপনি খুশি হয়ে খাইয়ে দেবেন আমাদের। সেও আপনার মর্জি। আমাদের এখানে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আমাদের একটাই চাওয়া, এই কোরাপশন, এই অন্যায় বন্ধ হোক।‘
রাজারামকে চেনেন বৈকি। শনি মঙ্গলবার বোসপাড়ার কালিমন্দিরে গেলেই তাঁকে পাওয়া যায়। বিপিনবাবুর শ্বশুরবাড়ির সবাই ওখানের ভক্ত
শিষ্য। গিন্নী অনেকবার দীক্ষা নেবার কথা বলেছে। ধর্মব্যবসায়ীদের মিছিলে শামিল হতে মন সায়
দেয়নি। মাঝে মাঝেই গিন্নী রাগ করে, ‘ছাপোষা গেরস্ত মানুষের ঠাকুর দেবতায় ভক্তি থাকে না, এই
প্রথম দেখলাম।‘
মুখচোরা বিপিনবাবুর বলতে ইচ্ছে হয়, ‘আগে একটা মানুষ পাই যাকে
ভক্তিশ্রদ্ধা করা যাবে। তারপর ঠাকুর দেবতাকে নিয়ে ভাবা যাবে।‘
এখন আফসোস হচ্ছিল। গিন্নীর কথা শুনলে রাজারামের মিছিলে এমনিই হাঁটা হয়ে যেত।
***
আর একটু হলেই নৈহাটি লোকালটা ছেড়ে যেত। নিত্যযাত্রীদের মিছিল ঠেলে তুলে দিল ভিড়ের কামরায়।
আহ। স্বস্তি। নইলে সেই সাতটা কুড়ির লোকাল ধরার জন্যে বসে থাকতে হত। দরজার মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন বিপিনবাবু। হু হু হাওয়ায় মনটা ঠান্ডা হয়ে এল।
অপমানটা সত্যিই গায়ে লাগছিল না আর। এসব তো নতুন নয়। কত বছর ধরে চলছে। আজকাল স্নায়ুগুলো কেমন অবশ হয়ে থাকে। এই ভালো। মান অপমান বোধটা চলে গেলেই সবচেয়ে ভালো হয়। ভয় ভয় ভাবটাও টের পাচ্ছেন না তেমন আর।
বড়সাহেবকেই সব খুলে বলবেন এবার। নেতা যা বললেন তা যদি ঠিক হয়, ম্যানেজমেন্টের কাছেই নিশ্চিত
আশ্রয় পাবেন। কাজের কদর তাঁরাই করছেন যখন। ম্যানেজমেন্টের জানা উচিত, কর্মীদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার হয়। কি করে টপ ম্যানেজমেন্টের সব ডিসিশন নিচের লেভেলে এসে কিছু লোকের জন্যে অসফল
হয়,
কিভাবে দুর্নীতিপরায়ণ কিছু লোক ম্যানেজমেন্ট-পলিসি নিজ
স্বার্থরক্ষায় ব্যবহার করে, সব বলবেন।
বলে ফেলতে পারলেই আর ভাবনা নেই।
সকালে অফিসে গিয়ে শুনলেন, বড়সাহেব ডেকে পাঠিয়েছেন। ভালোই হল। মুখস্থ কথাগুলো মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে দরজায় দাঁড়ালেন।
‘আসুন দাসসাহেব’, দরাজ আহবান।
ভেতরে পা দিয়েই স্থির। সপারিষদ নেতা বসে আছেন।
‘কনগ্র্যাচুলেশনস। এবছর স্পেশাল অ্যাওয়ার্ড আর ইন্সেনটিভের জন্যে আপনার নাম এসেছে। বিশেষ কিছু কারণে আমি আপনাকে এখনি তা দিতে
পারছি না। পুনর্বিবেচনার জন্যে আরো কিছু এফিসিয়েন্ট
এমপ্লয়ীর নাম সুপারিশ করা হচ্ছে।‘ বেরিয়ে আসছিলেন, বড়সাহেব ফিরে ডাকলেন আবার। ‘শুনুন, এ নিয়ে
আপনার কোনো বক্তব্য থাকলে শুভদীপবাবুকে জানাবেন। এমন নেতা আছেন আপনাদের, ভাবনা কি? আপনি লিখিতভাবে কোনো ক্লেইম যাতে না করেন তাই এ কথা জানিয়ে দিলাম। আমাকে সবাইকে নিয়েই চলতে হবে, না?
ম্যানেজমেন্ট তো বলেই খালাস। ও,
আর একটা কথা। আমাদের স্পেশাল সেল খোলা হয়েছে, এমপ্লয়ীদের সাজেশান
শোনার জন্যে। সেখানে আপনি নিজের কথা বলতে পারেন। ঠিক আছে?’
আবার এক মিছিলে শামিল হতে হবে? নিজের প্রাপ্যটুকু আদায়ের জন্যে? পুনর্বিবেচনার জন্যে নাম পাঠানো হবার পেছনের কারণ কি? বিপিনবাবুদের
নাম বাদ দেওয়া?
কার কাছে নিজের কথা বলবেন? এ
অফিসে ম্যানেজমেন্ট ওই বড়সাহেব। নেতাদের সঙ্গে আপোষ করে চলার জন্যে নিজেকে বিক্রী করে ফেলেছেন। পণ্যমনস্ক সমাজে টিকে থাকার জন্যে অবশ্য
সেটাই সহজ কাজ।
সততার মিছিলে হাঁটা কি সত্যি বন্ধ হয়ে গেছে?
***
কেন যে কোনো মিছিলেই শামিল হতে পারলেন না ! একজন অপদার্থ ম্যাদামারা ভুলভাল
লোক বলেই কি! আজকালের যা ধরণ। সমাজের মাথা বড় বড় লোকজনও মিছিলে শামিল হাওয়াটা প্রধান কাজ মনে করছে। কেমন একটা জেদ এল মনে। আর ভয় পাবেন না। তিরিশ বছরের চাকরিজীবনে এই প্রথম স্বীকৃতি। অপমানগুলো যেমন সত্যি, এই সম্মানটাও ততখানিই সত্যি। শুভদীপ যেমন আছে, সুপ্রতীক
মাইতিও তো আছেন। শুভদীপকে মান্য করতে গিয়ে সুপ্রতীকবাবুকে
অপমান করা যায় না। নিজের প্রাপ্যের ইন্সেনটিভ কাউকে নিতে
দেবেন না এবার। লড়াইটা একাই লড়বেন। মিছিল ছাড়াই। হয়ত সে লড়াইতে এসে জড়ো হবে আরো অনেক মানুষ। তাঁরই মতো মানুষজন, প্রাপ্য
অধিকারটুকু থেকে বঞ্চিত হয় যারা। নতুন একটা মিছিল হবে তখন।
রাতে খাবার পাট সাঙ্গ হলে বাসন্তীদেবী এসে দেখলেন, ঘুমিয়ে
পড়েছেন বিপিনবাবু। মুখটা হাঁ হয়ে আছে। হাত দুটো বুকের কাছে জড়ো। চোখ কুঁচকে আছে, কপালে গভীর দাগ। ভয়ের স্বপ্ন দেখছে নাকি ! ডাকতে গিয়েও থেমে গেলেন। আহা ঘুমোক। এই ঘুমের সময়টুকুই যা স্বস্তি।
সত্যিই স্বপ্ন দেখছিলেন বিপিনবাবু। চারদিক দিয়ে অনেকগুলো মিছিল এগিয়ে আসছে। পিছু হটতে হটতে যেখানে এসে দাঁড়ালেন, সেখানে
বিরাট একটা দেওয়াল। নিরেট। পালাবার পথ নেই। মিছিলগুলো এগিয়েই আসছে। এখুনি গিলে ফেলবে যেন। ভয়ে দেওয়ালে মিশে যাচ্ছিলেন। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। চোখ বন্ধ হয়ে এল।
কতক্ষণ এমন ছিলেন কে জানে, হঠাৎ হালকা হয়ে গেল শরীরটা। চোখ খুলে গেল নিজে থেকেই। দেখলেন শরীরটা বেড়ে যাচ্ছে। আর পিছু হটার জায়গা নেই বলেই বুঝি লম্বায়
বেড়ে যাচ্ছে। লম্বা দুই পায়ে শিকড় জড়িয়ে আছে, নড়তে পারছে না। লম্বা দুই হাত ডানার মতো বাতাসে সাঁতার
কাটতে লাগল। মিল্টন বলেছিলেন, ‘ইফ অপারচুনিটি ডাজন’ট নক, বিল্ড আ ডোর।‘ নিজেকেই নতুন দরজা তৈরি করে
নিতে হবে। জীবনের এই নিয়ম। নিজের মতো করে লড়াই, নিজের সঙ্গে লড়াই। দেয়ালে পিঠ না ঠেকে গেলে সে লড়াই শুরু হয়
না। ক্রমে ক্রমে বিশাল শরীর আকাশ ছুঁয়ে ফেলল। হাঁ করে সেই আকাশে শ্বাস নিতে লাগলেন
বিপিনবাবু।
আহ!
.................................
আইভি
চট্টোপাধ্যায়