বাবা ফিরোজ আলীর আলোকদিয়া বাজারে ছোট্ট একটা মুদির দোকান আছে। সেই দোকান থেকে যে আয় হয় সেটা দিয়ে তাদের ছয়জনের সংসার কোনরকম চলে। মেয়েকে খুব শখ করে স্কুলে দিয়েছিল ফিরোজ আলী। কিন্তু ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েই বন্ধ হয়ে গেল। গ্রামের আর কোন মেয়ে স্কুলে যায় না। নানা জনে নানা কথা বলে। মেয়েটা রাজ্যের রূপ
নিয়ে জন্মেছে। ফিরোজ আলীর মাঝে মাঝে মনে হয় আল্লাহতায়ালা
ভুল করে কোন পরীকে তার মত গরীবের ঘরে পাঠিয়েছেন। মেয়ের বয়স দশ না হতেই চারদিক থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। ফিরোজ আলী এত ছোট মেয়েকে বিয়ে দিতে চান না। কিন্তু পাড়ার কিছু বখাটে ছেলের উৎপাতে তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। সন্ধ্যা বেলায় তারা বাড়ির আশে পাশে ঘুরঘুর করে, শিস
বাজায়। মেয়েকে তুলে নেবার জন্য লোক মারফত ভয় দেখায়।~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৃত্যুদণ্ড
ম্যারিনা নাসরীন
সেটা ছিল হলুদাভ হেমন্তের শেষ সময়। সূর্যটার শরীরে
খ্যাপাটে ভাব কমে কেমন
যেন মিষ্টি হয়ে এসেছিল। আসন্ন শীতের আশংকায়
এক-দুইটা পাতাও ঝরতে শুরু করেছে বোধ হয়। রোদের গায়ে পিঠ লাগিয়ে ষোড়শীর মন উদাসী করা বেলা যাকে বলে। এমনই একটা দিনে চারদিকে সোনা রঙ ছড়িয়ে কিশোরী বধূ গ্রামের মেঠো পথ ধরে এগিয়ে
চলেছে তার স্বপ্নের রাজপুত্রের দেশে।
নানা কারুকাজে সজ্জিত কাঠের পালকির দুপাশে সোনালী লেসের চিক লাগানো। তার ফাঁক দিয়ে লাল বেনারসি শাড়ির আঁচলের কিছু অংশ বেরিয়ে আছে। ঘোমটার ফাঁকে সলাজ বধূ তার কিশোর জানালায় অবাক দৃষ্টি মেলে দেয়। ধীরে ধীরে ম্রিয়মান হয়ে যাচ্ছে তার শৈশব, কৈশোর
আর বেড়ে ওঠার ছোট ছোট সময়ের কার্নিশ। চার বেহারা ঘুঙুর পায়ে
তালে তালে কদম ফেলে। তাদের কোমর দুলছে। মুখে অদ্ভুত গুনগুন ঘুম পাড়ানি সুর।
পালকি চলে,
পালকি চলেরে হুন
হুনা রে হুন হুনা .......
পালকি চলে রে... অঙ্গ ঢলে রে .....
সূর্য ঢলে পালকি চলে ...
হুন হুনা,
হুন হুনা, হুন হুনারে হুনহুনা
............
সেই গান,
চিকের ফাঁক গলে বেরিয়ে থাকা লাল বেনারসির একটুখানি আঁচল, ঘুঙুরের রুমঝুম সুর, হেমন্তের মিষ্টি রোদের মিশেল
কিশোরী বধূর হৃদয়ের নকশী কাঁথায় অপরিচিত সব ফুল নকশা এঁকে দিয়ে যাচ্ছিল।
বেহারাদের কোমরের তালে তালে পালকিও দুলছে। বালিকার মাথা ঝিমঝিম করে। তার স্বপ্নালু চোখে
মাদকতাময় ঘোর। ঘোরের মাঝেই সে একসময় আপন বলয় ছেড়ে
অনিশ্চিত লোকালয়ে পা রাখে।
শ্যামনগরের কাজী বাড়ির উঠোনে তখন বধূবরণ করে নেবার তোড়জোড় চলছে। কাজী বাড়ির নামটা শুধু আছে কিন্তু ঠাটবাট সব তলানিতে এসে ঠেকেছে। এ বাড়ির বড় ছেলে জামালের আজ বিয়ে। ত্রিশের কাছাকাছি বয়স
হলেও এতদিন স্বেচ্ছায় আইবুড়ো ছিল। কারণ নিজের গায়ের রঙ
আবলুস কাঠের মত হলেও বউ তার দুধ সাদা দেবী দুর্গা হওয়া চাই। বেশি বয়সের মেয়েরা নাকি স্বামীর অবাধ্য হয় তাই কনের বয়স হতে হবে কুড়ির নিচে। এরকম নানা প্যাকনা শেষে চল্লিশ পঞ্চাশ জন কনে দেখার পর পনের বছরের পরীর মত
দেখতে এক কিশোরীকে তার বেজায় পছন্দ হল।
এদেশে কন্যা দায়গ্রস্ত পিতার অভাব নেই। নানা কারণে কন্যাসন্তান পিতাদের মাথায় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তাই জামালের মত বয়সী পুরষ তাদের অর্ধেক বয়সের মেয়ে বউ হিসেবে অতি সহজে পেয়ে
যায়। তারা পালা করে গরু-ছাগলের মত সমাজ বাজারে
মেয়ে দেখে বেড়ায়। চুল দেখে, নাক-কান
দেখে, বাড়ন্ত শরীর দেখে। তারা হাঁটতে পারে কিনা, কথা বলতে পারে কিনা সেটা
পরীক্ষা করে পাত্রী বাছাই করে। তারপর চলে দরদাম, তবে এ ক্ষেত্রে হিসাব উল্টা। গরু ছাগল টাকা দিয়ে
কিনে নিতে হয়। কিন্তু বউ
টাকা দিয়ে কিনতে হয় না। বরং বউ এর সাথে টাকাও
পাওয়া যায়। মেয়েদের জন্য সংসারে এ বড় অদ্ভুত হিসাব।
ঘরের পাশের দেবদারুর গাছটির ছায়া যখন তার দ্বিগুণ প্রায়, তখন কাজী বাড়ির দেউড়িতে এসে পালকি
থামে। মেয়েরা দৌড়ে গিয়ে চিক খুলতেই নতুন বউ
উঠোনেই ঢলে পড়ল। লাল জরির ওড়নার ফাঁকে স্নিগ্ধ শান্ত
নিস্পাপ একটি বালিকার মুখ। কনে দেখা বিকেলের লালচে
আলো তার মুখে তির্যকভাবে পড়ছে। সে আলোর দ্যুতিতে কাজী
বাড়ির উঠান আলোকিত হয়ে ওঠে। বন্ধ দুটি চোখে এখনো
জলের দাগ স্পষ্ট। হয়ত আসার আগে বাবা বা ভাইয়ের কাঁধে মাথা
রেখে কিশোরী মেয়েটি খুব কেঁদেছিল।
বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে ছিল লতিফা। সারাদিন ছোট দুই ভায়ের সাথে খুনসুটি আর সন্ধ্যায় দাদির পাশে শুয়ে রূপকথার
গল্প শুনতে শুনতে চোখ জুড়ে ঘুম আসত। ঘুমের
মাঝেই রঙিন স্বপ্নের প্রজাপতিরা ডানা মেলে দূর দূর রাজ্যে ঘুরে বেড়ায়। রাজকুমারের ঘোড়ায় চেপে সাত সমুদ্র তেরো নদী পারে হারিয়ে যায় তেপান্তরে। জোনাকির এক রত্তি আলো পূর্ণিমার চাঁদ হয়ে মনের আকাশ অকারণেই আলোকিত করে তোলে।
বাবা ফিরোজ আলীর আলোকদিয়া বাজারে ছোট্ট একটা মুদির দোকান আছে। সেই দোকান থেকে যে আয় হয় সেটা দিয়ে তাদের ছয়জনের সংসার কোনরকম চলে। মেয়েকে খুব শখ করে স্কুলে দিয়েছিল ফিরোজ আলী। কিন্তু ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েই বন্ধ হয়ে গেল। গ্রামের আর কোন মেয়ে স্কুলে যায় না। নানা জনে নানা কথা বলে। মেয়েটা রাজ্যের রূপ
নিয়ে জন্মেছে। ফিরোজ আলীর মাঝে মাঝে মনে হয় আল্লাহতায়ালা
ভুল করে কোন পরীকে তার মত গরীবের ঘরে পাঠিয়েছেন। মেয়ের বয়স দশ না হতেই চারদিক থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। ফিরোজ আলী এত ছোট মেয়েকে বিয়ে দিতে চান না। কিন্তু পাড়ার কিছু বখাটে ছেলের উৎপাতে তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। সন্ধ্যা বেলায় তারা বাড়ির আশে পাশে ঘুরঘুর করে, শিস
বাজায়। মেয়েকে তুলে নেবার জন্য লোক মারফত ভয় দেখায়।
এক রাতে লতিফার বাবা এসে ঘোষণার মত করে বললেন,
শোন লতিফার মা, মাইয়ার বিয়া ঠিক কইরা আইলাম।
কি কন? বলা নেই কওয়া নেই হুট কইরা কই
বিয়া ঠিক করলেন?
আরে সেদিন কইলাম না? বাড়ি
শ্যামনগর। কাঠের ব্যবসা করে। কাজী বংশ,
ভাল পোলা। আইজ ওমর ঘটক কইল, তারা এই শাদীতে রাজী। মাইয়ারে শুধু সাজাইয়া দেওন লাগব আর নগদ বিশ হাজার টেকা।
কিন্তু সে পোলার তো হুনছি মেলা বয়স। আমার মাইয়ার বয়স তো এখনো পনের হয় নাই। এখনই কিসের বিয়া? না না। আপনি এই বিয়া বন্ধ করেন।
তুমি বেশি বুঝ? মাইয়া মানুষ হইয়া জন্মাইছ, তাই থাক। বেশি বুঝতে আইস না। এজন্যই তো দশ হাত কাপড়
না হলে তোমাগো ছতর ঢাকে না। মাইয়া ঘরে রাহনের জিনিস?
হুহ!
আপনি যা বলার বলেন, কিন্তু আমি এ বিয়াতে রাজি না। এত ছোট্ট মাইয়া সংসারের কি বুঝে?
শোন লতিফার মা, জিদ করবা না। চারদিকের পরিবেশ ভাল না। কখন আমার মাইয়ার কে
সর্বনাশ করে ঠিক নাই। আমি কই কি, পোলার বয়স বেশি হইলেও মানুষ ভালা। মুখে দাঁড়ি আছে, আল্লাহ ওয়ালা লোক। জমিজমা, টাকা পয়সাও আমাগো থন কম না। মাইয়া আমাগো ভালাই থাকব।
লতিফার মা চুপ করে থাকে। আসলেই তো দিনকাল ভাল না। কখন কি হয় বলা যায় না।
লতিফার বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় চলছে। দূর দুরান্ত থেকে
আত্মীয় স্বজন হাড়ি ভরে মিষ্টি, পিঠা, নতুন
শাড়ি ইত্যাদি নিয়ে হাজির হল। দাদী সম্পর্কিত
বৃদ্ধারা লতিফার হবু স্বামী কে নিয়ে অশ্লীল সব শ্লোক শোনায়, লতিফার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। বিয়ে সম্পর্কে তার গভীর
কোন ধারণা নেই তবুও অজানা অচেনা এক যুবককে স্বামী হিসেবে কল্পনা করে সে স্বপ্নের
ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। বালিকার সেই স্বপ্নে কি নেই?
একজন রূপবান রাজকুমার, প্রাসাদের
মত ঘর,
খাট পালঙ্ক, দাসদাসী আরও কত কি?
দাদির কাছে শোনা গল্প গুলো সব তার মুখস্থ। সোনার কাঠি রূপার কাঠি। আলাল দুলালের গল্প, এসব রূপকথার রাজকুমারী তো সে নিজেই ছিল।
কিন্তু বালিকার তখনো জানা ছিল না রূপকথার রাজকন্যরা শুধু কল্পনার জালেই আটকে
থাকে। বাস্তবের সাথে তার চরম বৈপরীত্য।
চোখে মুখে পানি ঢালার দীর্ঘক্ষণ পর লতিফা ধীরে ধীরে চোখ খোলে। তার চারদিকে অগণিত মুখ। কিন্তু সেসব মুখের
মধ্যে একটি চেহারাও তার পরিচিত নয়। বুক ঠেলে কান্না আসে, বাবা তাকে এ কোথায় পাঠাল? এর
নামই কি বিয়ে?
অপ্রসন্ন মুখে শাশুড়ি মাজেদা বেগম নববধূকে বরণ করে নিলেন। গলায় একটি সোনার
মাদুলি পরিয়ে দিতে দিতে বললেন, উঠোনে পা দিতে না দিতেই বেহুঁশ
হইয়া পড়লা। আমাগো দেশে এইডা তো অলক্ষুণে, বাকি জীবন হুঁশ থাকব তো বউ?
লতিফা শাশুড়ির মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। অলক্ষুণে কেন সে বুঝতে পারে না। তার মা, চাচী,
খালাকে সে দেখেছে। কিন্তু এমন পাথরসদৃশ ভাবলেশহীন নারীমুখ কোনদিন দেখেনি।
নতুন বউকে ঘিরে অনেক মানুষের ভিড়। বউ দেখে একেক জন একেক
মন্তব্য করছে। কেউ ঘোমটা টেনে খুলে ফেলে, কেউবা চুল বের করে দেখে মাথায় কতটা চুল। তবে সবার চোখে মুগ্ধতা। এত সুন্দর বউ! এক
বৃদ্ধা লতিফার মুখ উঁচু করে নিরীক্ষণ করেন, তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। বৃদ্ধা মুখে মমতার হাত
বুলিয়ে দেন,
আহা আমাগো জামাইলা দেহি পরীর মতন বউ পাইছে।
সাথে সাথে পাশ থেকে কেউ একজন ফোড়ন কাটে,
হ দাদী,
বান্দরের গলায় মুক্তোর মালা! তোমাগো পোলা দৈত্য আর বউ হইল
পরী। আইজকা দৈত্যের কাছে পরী বন্দী হইব। হিহিহি।
যা ভাগ ফাজিল মাইয়া!
তার স্বামীর নাম জামাল সেটা লতিফা শুনেছে। কিন্তু তাকে দৈত্য কেন বলছে সেটা সে বুঝতে পারছে না। জামালকে লতিফা দেখেনি। পাড়ার ভাবীরা যখন
শাহনজর করছিল তখন আয়নার মধ্যে বারবার বরের মুখ দেখতে বলেছিল, কিন্তু সবার সামনে সে লজ্জায় চোখ খুলতে পারেনি।
বালিকার মন খারাপ লাগছে, ভীষণ খারাপ। সে ধুলিমাখা চোখে তাকিয়ে থাকে। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। বাড়ির কথা,
মা বাবার কথা, ছোট্ট ভাই দুটোর কথা মনে
হচ্ছে। এই বাড়ি, এই ঘর, এসব মানুষ কেউ তো তার আপন নয় তাহলে কেন তাকে সব ছেড়ে এখানে আসতে হবে?
গভীর রাত,
বাইরে রূপালী চাঁদের আলোর বন্যা। সারাদিনের ধকলে লতিফার শরীরের সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। কখন ঘুমে ঢলে পড়েছে ঠিক নেই। হঠাৎ লোমশ হাতের চাপে
তার ঘুম ভেঙে গেল। ভয়ে সে চিৎকার দিয়ে উঠতেই কর্কশ কণ্ঠের
চাপা আওয়াজে সে বোবা হয়ে যায়,
আরে ভয় পাইতেছ কেন? আমি
জামাল।
ঘরের আবছা আলোয় বিস্ময়ের সাথে লতিফা দেখল সামনে দ্বিগুণ বয়সী এক পুরুষ। ঘন চাপ
দাড়িতে ঢাকা থাকায় মুখটা ভীষণ কালো মনে হচ্ছে। যেমন মোটা তেমন লম্বা। কোথায় তার স্বপ্নের
রাজপুত্র?
দশাসই লোকটা লতিফার পাখির পালকের মত শরীরে হাত বুলিয়ে আদর করে। আতঙ্কে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ও বুঝতে পারছে না লোকটা
তাকে এভাবে আদর করছে কেন? লতিফা
বাধা দেবার চেষ্টা করলে জামাল পিচ্ছিল স্বরে বলে,
এরকম করতেছ কেন? আমি তো তোমার স্বামী, এইসব হয়।
দাদি সম্পর্কিত আত্মিয়দের সেসব অশ্লিল কথা লতিফার মনে পড়ে। ও ভয়ে আরও সংকুচিত
হয়ে যায়। কিন্তু লতিফা যতই নিজের শরীরকে গুটিয়ে নিতে
চাচ্ছে লোকটির বল প্রয়োগ ততই বাড়তে থাকে। একসময় লতিফার গগণবিদারী আর্তনাদে চারপাশ সচকিত হয়ে ওঠে। জামাল নামের লোকটি ওর
ইচ্ছা অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করেই স্বামীর অধিকার আদায় করে নেয়।
ভাঙা স্বপ্নের মতোই লতিফা সারারাত বিছানার এক কোণে পড়ে থাকে। একটু ঝিরঝিরে বাতাসে হালকা শীত শীত ভাব। আম গাছ থেকে টিনের চালে টুপটাপ করে দুই একটা শিশির ফোঁটাও পড়ছে। ওর ছোট্ট শরীর আতংকে আর যন্ত্রণায় বারবার কেঁপে উঠে। পাশেই লোকটি অঘোরে
ঘুমাচ্ছে। তার ভারী শ্বাসের আড়ালে বধূর বুকের
দীর্ঘশ্বাস পথ হারিয়ে ফেলছে।
ভোর না হতেই লতিফা দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। কি মিষ্টি সকাল! এখনো ভোরের আলো ভাল ভাবে ফোটেনি। চারদিকে হালকা কুয়াশার চাদর। উঠানের সামনেই অবারিত
মাঠ। হেমন্তের ধান কাটা শেষ। সোনালী মাঠে ছোট ছোট ঘাস ফুল লুকোচুরি খেলছে। তার মন স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে। আলোকদিয়ার
এরকম কত সকাল সে শিশিরে পা ডুবিয়ে মাঠ পেরিয়ে এসেছে। ও ভুলে যায় গত পরশু আর আজকের মধ্যে আকাশ পাতাল প্রভেদের কথা। ভুলে যায় এখন সে মেয়ে নয় বউ। আর এই সমাজে মেয়ে এবং
বউয়ের মধ্যে অনাক ফারাক। সে ধীরে ধীরে পা বাড়ায়। ছোটছোট ঘাসের ফুল, শিশিরের সাথে মিশে তার পায়ে রংবেরঙের আলপনা আঁকে।
কিছুদূর যাবার পরেই লতিফা পিছন থেকে ডাক শুনতে পেল। কাছে আসতেই ছোট ননদ খুব ব্যস্ত হয়ে বলল,
কুনহানে গেছিলা? মা খুব রাগ করতাছে।
শাশুড়ির মুখ থমথমে। পাশে জামাল। দিনের আলোতে রাগান্বিত চেহারায় তাকে ভয়ংকর লাগছে। এই লোকটা তার স্বামী ভাবতেই লতিফার মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
নতুন বউ হইয়া তুমি কার হুকুমে ঘরের বাইরে পা দিছ?
কথা কউ না ক্যান? এক দিনেই ঠ্যাং এত লম্বা হইয়া
গেছেগা? এইটা কি বাপের বাড়ি পাইছ?
জামালের হুংকারে লতিফা কেঁপে ওঠে। সে পায়ের বুড়ো আঙুল
দিয়ে উঠানের মাটি খোঁড়ে। দাঁত দিয়ে চেপে নিচের
ঠোঁট প্রায় রক্তাক্ত করে ফেলে।
শখ কইরা কচি মাইয়া বিয়া কইরা আনছ। অহন পালপোষ কইরা বড় কর। আমার কি?
এই বলে শাশুড়ি গজগজ করে স্থান ত্যাগ করে।
সেই শুরু,
তারপর দিন যায় মাস যায় ধীরে ধীরে বালিকা বধূ লতিফা তরুণী
বয়সের দিকে পা বাড়ায়। গ্রামের আর দশটি মেয়ের
মত সেও তার ভাগ্যকে মেনে নেয়।
বিয়ের পরদিন থেকে লতিফা স্বামী শাশুড়ির কাঠ গড়ায় আসামি হিসেবে দাঁড়িয়েছিল।
কিন্তু আসামির জেরার কাল যেন শেষ হয় না।
বিয়ের তৃতীয়দিনেই লতিফাকে রান্নাঘরের দায়িত্ব নিতে হল। বিয়ের আগে কোনদিন একটা
ডিম ভেজে খায়নি। আনাড়ি হাতে সে যাই রাঁধে স্বামী শাশুড়ির সেটা পছন্দ হয় না। তরকারিতে আজ লবণ বেশি, তো কাল কম। ভাত কখনো চাল থাকে, কখনো গলে যায়। খাওয়ার সময় জামাল খেঁকিয়ে ওঠে। থু থু করে পাতিল ধরে সব
খাবার উঠানে ছুড়ে ফেলে দেয়।
মাঝে মাঝে লতিফার ধৈর্য থাকে না, প্রতিবাদ করে।
না খাইতে পারলে নিজে রান্না কইরা খান।
জামালের রক্ত চোখে আগুন ধরে যায়। সে পাগলের মত হাতের
কাছে যা পায় তাই দিয়ে বউ পিটায়।
তোর এত বড় সাহস আমার মুখে মুখে কথা কস।
ছেলের মরদাঙ্গিতে মাজেদা বেগম খুশি হয়। ছেলেকে উস্কে দিয়ে বলে,
ওইটুকু মাইরে কাজ হইব না। ভাল মত মাইর দে মাগির
পাট বাড়ছে।
পান থেকে চুন খসলেই মাজেদা বেগমের অশ্লীল ভাষায় চৌদ্দ গুষ্ঠি তুলে গালি আর যখন
তখন চড় থাপ্পড় চলতে থাকে। শাশুড়ির হাতের সাথে
লতিফার মাথার চুল গোছা হয়ে উঠে আসে তবুও সে এসব অত্যাচার মুখ বুজে সয়ে যায়। কারণ সে ছিল দীঘির জলের মত গভীর আর স্থির। বাতাস লাগলে একটু তিরতির করে কেঁপে ওঠে। কিন্তু আন্দোলিত হয় না। ঝর্ণা ধারার মত চঞ্চল
গতি নেই। তার এই শান্ত স্বভাব দেখে শাশুড়ি নাম দিলেন
‘মেনি বিড়াল’।
সেদিনের সেই বালিকা বধূ তরুণী তো হল, কিন্তু তার মন থেকে
প্রথম রাতের সেই বিভীষিকা দূর হল না। সন্ধ্যে নেমে এলেই তার
শরীর বিদ্রোহ করে। বিছানায় সে আড় কাঠের মত পড়ে থাকে। জামাল খুশি হতে পারে না। তার পৌরুষ অপমানিত হয়। সে কুৎসিত সব কথা বলে মনের ঝাল মেটায়,
লতিফার কথা বলার রুচি হয় না। চুপ করে থাকে। তাতে জামালের মেজাজ আরও চড়ে যায়। সে নিজের সম্পদ মনে করে স্ত্রীর শরীর আঁচড়ে কামড়ে মনের হাউস মেটায়। এভাবে একজন লতিফা প্রতি রাতেই নিজের স্বামী দ্বারা ধর্ষিত হয়।
নারীমন,
ধীরে ধীরে তার মনে ক্ষোভ অভিমান জমতে থাকে। বাবা মায়ের উপর বেশি অভিমান হয়। মা মেয়ের বিষণ্ণ চেহারা
দেখে সব বুঝেন,
কিন্তু মেয়ে কিছু স্বীকার করে না। তার শুধু মন উদাস হয়, সারাদিন যন্ত্রের মত কাজ করে
যায় কিন্তু সব খানেই যেন সে অনুপস্থিত। মন আর শরীর আলাদা সত্তা। জাগতিক সব কিছুর প্রতি লতিফা যেন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। একসময় তার মনে হতে থাকে যে এই পৃথিবীর কেউ তার আপন নয়, জীবনের প্রতি প্রচন্ড অনীহা লতিফাকে শীর্ণ আর রোগা করে ফেলে।
একদিন সন্ধ্যাবেলা পাশের বাড়ির ইমতিয়াজ চাচা বাজার থেকে ফিরছিলেন। আবছা আঁধারে এক নারীমূর্তি ওপাড়ার আম
বাগানের দিকে হনহন করে এগিয়ে যাচ্ছে। তার মনে সন্দেহ হল। তিনিও পিছু পিছু গেলেন, বৃদ্ধ মানুষ তাল রাখতে পারছিলেন
না। পৌঁছাতেই দেখলেন নারী মূর্তি গাছের ডালে
ঝুলছে তিনি দৌড়ে ঝুলন্ত পা দুটো ধরে উঁচু করে ধরে বুঝলেন এখনো প্রাণের স্পন্দন আছে।
আরে জামালের বউ তুমি মরতে আইছ কেন? হাত দিয়া ডাল ধর মা। কিন্তু লতিফার হাত উঁচু
করার ক্ষমতা ছিল না। ইমতিয়াজ কতসময় ধরে
রাখবেন? ছেড়ে দিলেই মৃত্যু। তিনি চিৎকার দিলেন,
কে কোথায় আছ তাড়াতাড়ি আস, জামালের বউ গলায় ফাঁস দিছে।
ঘরের সাথে ঘর লাগানো বসতি। লোকের অভাব হল না। যে যাত্রা লতিফা বেঁচে উঠল কিন্তু সে তার চেষ্টা অব্যাহত রাখল। ছয় মাসের মাথায় আবার ঘরের সিলিং এর কাঠের সাথে ফাঁস লাগাল। কিন্তু আল্লাহ বাঁচাতে চাইলে কার সাধ্য আছে মরে! ছোট ননদ শিউলির উছিলায় এবারও
লতিফার মরা হল না।
লতিফার মধ্যে বিষণ্ণতা বাড়তে থাকে। সে হাসতে ভুলে যায়। কারো সাথে তেমন কথা বলে না। একা একা গুনগুন করে
কাঁদে,
হাসে। শাশুড়ি মাজেদা ঘোষণা
দিলেন লতিফার ঘাড়ে জীন লেগেছে। তার নির্দেশে লতিফার
ঘাড় থেকে জীন নামানোর জন্য ফকির ডেকে আনা হল।
সেদিন উঠোনে ফকিরের সামনে লতিফাকে যখন আনা হল তখন সে চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। লম্বা চুলের ইমান ফকিরের হাতে নিম পাতার ডাল। সামনে ধুয়ো, পাতিলের আগুনে সরিষা ফুটছে। পাশে জোড়া বেত। পাড়ার শিশু থেকে বৃদ্ধ
পর্যন্ত গোল হয়ে তামাসা দেখছে। লতিফা ঘোর লাগা
অনির্দিষ্ট দৃষ্টিতে চারদিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে।
ফকির বুনবুন করে অস্পষ্ট সরে মন্ত্র উচ্চারণ করছে আর মাঝে মাঝে হুঙ্কার দিয়ে
উঠছে,
বল তুই কে?
লতিফা হাসে।
হাসচ ক্যান শয়তান? বল তোর নাম কি?
বলেই ইমান ফকির লতিফার মুখে ধূয়া দেয়, নিম পাতার ডাল দিয়ে শরীরে সজোরে আঘাত করে।
লতিফা বিরক্ত হয়ে এবং অদ্ভুত পুরুষালী কণ্ঠে জবাব দেয়,
আমি কুজারাকাহ। কুয়াফা নগরীতে আমার ঘর।
এই কইন্যার ঘাড়ে কতদিন হইল আইছস?
অনেকদিন।
ক্যান আসছস? ওরে আইজকাই ছাইড়া যাইতে হইব।
লতিফাকে আমি পছন্দ করি। ওরে আমি ছাড়তে পারব না।
কি ছাড়বি না? দাঁড়া আল্লাহ রাসূলের নাম লইয়া
তরে কই লই দেখ!
ফকিরের হাতের বেত শপাং শপাং করে লতিফার শরীরে নেমে আসে। কিছুক্ষণ ছটফট করে বেহুঁশ হয়ে লুটিয়ে পড়ে লতিফা। যারা তামাশা দেখতে এসেছিল
তাদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে।
ইমান ফকির তাদের দিকে চেয়ে তেলতেলে হাসে,
ইমানের হাত থেইকা আজ পর্যন্ত কোন শয়তান বাঁচতে পারে নাই। যাইব নাই ও যাইব না ওর বাপে যাইব।
তামাশা দেখতে আসা লোকজন অবশ্য তার সে কেরামতি দেখার অপেক্ষা করে না কারণ
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছিল।
এ রকম অবস্থাতে একদিন লতিফার কোল জুড়ে ফুটফুটে এক ছেলের জন্ম হল। মাজেদা বেগম আঁতুড় ঘরেই নবজাতককে মায়ের কাছ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে। তাকে মায়ের দুধ খেতে না দিয়ে গরুর দুধ খাওয়ায়। ছেলের কানে কানে বলে,
তোর বউয়ের মাথার ঠিক নাই ঘাড়ে জীন লাগছে। তার কাছে পোলা রাখা যাইত না। মাইরা ফালাইব।
লতিফা সন্তানের জন্য হাহাকার করে ওঠে কিন্তু আঁতুড় মানুষ ঘর থেকে বের হওয়া
যাবে না এই দোহায় দিয়ে শাশুড়ি ছোট্ট একটি ঘরে আঁটকে রাখে।
ধীরে ধীরে সেসব দিনেরও অবসান ঘটে। সন্তান একটু একটু বড় হয়
মাকে চিনতে শেখে। লতিফা নতুন জীবন খুঁজে পায়। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বাঁচার চেষ্টা করে। হাসে কাঁদে। শিশু ছেলেটি বাবা মায়ের মধ্যে ভালবাসার একটা সূত্র তৈরি করে। জামাল আর মায়ের কথায় যখন তখন লতিফার গায়ে হাত তোলে না। তেমনি লতিফার মনে হতে থাকে জীবনটা মন্দ নয়।
কিন্ত ছেলে আর ছেলে বউয়ের মধ্যে ভাব দেখে শাশুড়ির মাথায় চিন্তার পাহাড় জমে। ছেলে বউয়ের কথামত চলবে সেটা সে কোন মতেই সহ্য করতে পারছিল না। শুরু হয় গোপন অত্যাচার। জামাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে
গেলেই খুঁটিনাটি নিয়ে লতিফাকে অতিষ্ঠ করে তোলে। ধীরে ধীরে লতিফার মনে ঝড় ওঠে। যে গভীর দীঘির স্থির পানি তুফানেও আন্দোলিত হতনা সেখানে
ঝিরঝিরে হাওয়াতেই ঝড় উঠতে শুরু করল। শাশুড়ির প্রতিটা
অন্যায়ের বিরুদ্ধে সে প্রতিবাদ করতে লাগল।
মাজেদা বেগম হারার পাত্রী ছিলেন না। লতিফা তাকে অপমান করে, ঠিকমত খেতে দেয় না,বাবার বাড়িতে টাকা পাচার করে ইত্যাদি অভিযোগে তিনি ছেলের মন বিষিয়ে তুললেন। সেদিন ছিল রমজান মাসের সতের তারিখ। লতিফার শরীরটা ভাল ছিল না। তাই দুপুরের নামাজ পড়ে
ঘরে শুয়ে ছিল। উঠে ইফতারি এবং রাতের রান্না করবে। কিন্তু ক্লান্ত চোখে কখন ঘুম জড়িয়ে আসে আর ঘুমিয়ে পড়ে।
বাইরে থেকে জামাল বাড়িতে পা রাখতেই মাজেদা বেগম ছেলের উপর ঝামটা দিয়ে ওঠে,
হুন তোর বউ কইলাম বড় বাড়াবাড়ি করতাছে।
ক্যান আবার কি হইছে?
আবার কি হইব শইল খারাপ কইয়া পাক ঘরে আইবার চায় না। আমি কইতেই কইল, পালপুরির লাইগা সে পাক করতে পারব না। বাপু আমার মাইয়া আর আমি যদি তোমাগো ঘাড়ে পালপুরি হইয়া যাই তাইলে আমাগো তোমরা
ভিন্ন কইরা দ্যাও। যার কেউ নাই তার আল্লাহ আছে। এইসব হুননের লাইগাই তোমারে পেটে ধরছিলাম?
জামাল ঘরে ঢুকে দেখল লতিফা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। কিছুদিন যাবত মা এরকম অনেক অভিযোগ করে আসছে কিন্তু সে গায়ে লাগায় না। কিন্তু আজ যেন তার মাথায় আগুন ধরে যায়।
সে লতিফার গা থেকে কাঁথা সরিয়ে হ্যাঁচকা টানে লতিফাকে উঠিয়ে বসায়। তারপর চুল ধরে চড়, ঘুষি, লাথি
চলতে থাকে।
নবাবের বেটি, ঘরে আইতেই তোর নামে নালিশ শোনা লাগে ক্যান?
আইজ তরে মাইরাই ফালামু। আমার মা বইন তোর কাছে পালপুরি লাগে?
লতিফা অবাক হয়ে যায়। আজ তার সাথে শাশুড়ির কোন কথাই হয় নাই।
মারতে মারতে একসময় জামাল ক্লান্ত হয়ে থামল। লতিফা বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকে। পাঁচ বছর বয়সী ছেলেটি
অবাক বিস্ময়ে একবার মায়ের দিকে চায় একবার বাবার দিকে। চিৎকার করে কাঁদে কিন্তু বাবা কানে পুত্রের সে কান্না পৌঁছায় না। সে বীর দর্পে বাইরে বেরিয়ে যায়। মাজেদা বেগম ঘরে উঁকি
দিয়ে লতিফাকে দেখে তারপর তৃপ্ত মুখে পাড়া বেড়াতে বের হয়।
বহুক্ষণ পর লতিফা ধীরে ধীরে উঠল। সমস্ত শরীর মনে হচ্ছে
থেঁতলে গিয়েছে। লতিফার মনে উড়ন্ত প্রজাপতির সুখের শেষ
হয়েছিল অনেক আগেই। বুকের মধ্যে সর্বসময় দুঃখের গজাল বিঁধে
পীড়িত করে রাখত। এর মাঝেই তার ছোট্ট মানিক ছিল ছোট্ট একটু
সুখ। সেই সুখের লোভেই সে বাঁচতে চেয়েছিল কিন্তু আজ কিছুক্ষণের জন্য সঞ্জীবনী
সন্তানের কথা সে বিস্মৃত হল। সমাজ-সংসার, বাবা-মা,
স্বামী, শাশুড়ি সবার প্রতি জমে থাকা
বিন্দু বিন্দু অভিমান গুলো এক সাথে জড়ো হয়ে সেদিন সমুদ্রের মত গর্জে উঠেছিল। সেই উথাল পাথাল ঢেউয়ের সাথে তাই নিঃসীমে হারিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল।
বিছানায় ছেলেটি ঘুমিয়ে আছে। অসময়ের ঘুম। লতিফাই তাকে রূপকথার গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। ঘুমন্ত সন্তানকে কিছু সময় বুকে চেপে ধরে শেষ বারের মত ওম দেয়। মায়ের চোখের তপ্ত পানিতে ছেলের চুল, গাল ভিজে উঠছে। একি মায়া! একি ভয়ংকর কষ্ট!
ঘরের কোণে তাকের উপর শিশিটির দিকে লতিফা সম্মোহনী দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। তারপর সেটা নামিয়ে পুরো টুকু গরল গলায় ঢেলে দেয়। বিছানায় মানিক বড় এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে। ওর কি শীত লাগছে? লতিফার চোখের সামনে সবকিছু
ঝাপসা হয়ে আসছে।
ঝাপসা চোখে দেখে কারুকাজে সজ্জিত পালকি চলে যাচ্ছে। চার বেহারা ঘুঙুর পায়ে
তালে তালে কদম ফেলছে। ওদের কোমর দুলছে। মুখে অদ্ভুত গুনগুন ঘুম পাড়ানি সুর।
পালকি চলে,
পালকি চলেরে হুন
হুনা রে হুন হুনা .......
পালকি চলে রে... অঙ্গ ঢলে রে .....
সূর্য ঢলে পালকি চলে ...
হুন হুনা,
হুন হুনা, হুন হুনারে হুনহুনা
............
ম্যারিনা
নাসরীন