সম্ভবত: গৌরীকেদারই একমাত্র শিল্পী যিনি একই সঙ্গে তিনটি নামে রেকর্ড করতেন। স্বনামে
বাংলা আধুনিক গান, ‘গোলাম কাদের’ নামে গজল, ইসলামী গান ও
বাংলা কাওয়ালি এবং ‘সুকুমার ভট্টাচার্য’ নামে পল্লীগীতি।
শিল্পীর হিন্দী ও উর্দু উচ্চারণ ছিল প্রশংসার যোগ্য। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা
পরবর্তীতে তাঁর স্মৃতিচারণায় শোনা, একবার লক্ষ্ণৌ এর মুসলিম
এসোসিয়েশন থেকে চিঠি আসে যে তারা গোলাম কাদেরকে সম্বর্ধনা দিতে চান। তাঁর অসংখ্য
গুণমুগ্ধ, ভক্তের একান্ত ইচ্ছে তাঁকে সম্বর্ধনা দিয়ে সম্মানিত করার।
শিল্পী নাম, যশের উর্ধ্বে এতোটাই বলিষ্ঠ ও সৎ ছিলেন যে তিনি গ্রামাফোন কোম্পানি কে তৎক্ষণাৎ বলেন, তাঁর আসল পরিচয় ওই মুসলিম এসোসিয়েশন কে জানাতে, কোনোভাবেই কোনো ছলনাতেই তিনি সম্মানের সহজ পথ বেছে নেন নি। ১৯৪১এর মে মাস। প্রণব রায়ের কথায় ও সুকৃতি সেনের সুরে তাঁর সুপার ডুপার হিট রেকর্ড ‘কতদিন, কতদিন তুমি কাছে নাই।’ এরপর থেকেই গ্রামাফোন কোম্পানি তাঁকে রয়ালটি দেওয়া শুরু করে।~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
শিল্পী নাম, যশের উর্ধ্বে এতোটাই বলিষ্ঠ ও সৎ ছিলেন যে তিনি গ্রামাফোন কোম্পানি কে তৎক্ষণাৎ বলেন, তাঁর আসল পরিচয় ওই মুসলিম এসোসিয়েশন কে জানাতে, কোনোভাবেই কোনো ছলনাতেই তিনি সম্মানের সহজ পথ বেছে নেন নি। ১৯৪১এর মে মাস। প্রণব রায়ের কথায় ও সুকৃতি সেনের সুরে তাঁর সুপার ডুপার হিট রেকর্ড ‘কতদিন, কতদিন তুমি কাছে নাই।’ এরপর থেকেই গ্রামাফোন কোম্পানি তাঁকে রয়ালটি দেওয়া শুরু করে।~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
শ্রদ্ধার্ঘ
সুমনা পাল ভট্টাচার্য
ট্রেন আসতে এখনও
খানিক দেরী। ওয়েটিংরুমে বসে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছি। পাশে বসে থাকা বছর আশির
বৃদ্ধটি হঠাৎই গুনগুন করে উঠলেন আমার খুব চেনা সুর।
“নাই বা হল মিলন
মোদের...”
গুনগুন করছেন এক
কলি, আর আপন মনেই বলে চলেছেন, “আহা, কী সব কথা, এই সুর...কোথায়
এসব এখন! আহা আহা...”
আমি আর থাকতে
পারলাম না, বৃদ্ধ ভদ্রলোকটির দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলাম, “নমস্কার জ্যেঠু, আপনি এই গানটি
জানেন?”
ভদ্রলোক আমায়
বেশ আপাদমস্তক মেপে 'এ খুকি বলে কি!' এ হেন একটা ভাব দেখিয়ে
বললেন, “তোমরা চেনো এসব শিল্পী কে? শুনেছো নাম? এটা কার গান জানো? ইনি আমার শৈশব
আর কৈশোর জুড়ে আছেন, বুঝলে মা? এ গান সে যুগের বিখ্যাত শিল্পী শ্রী গৌরীকেদার
ভট্টাচার্যের। আমার বাড়িতে এনার গানকে পুজো করা হত, বুঝলে মা!
বাবাকে দেখতাম, কী অসম্ভব তাগিদের সাথে শিল্পীর সব রেকর্ড সংগ্রহ করতেন।
আহা! কি কথা, গলার কি রেঞ্জ... ‘নাই বা হল মিলন
মোদের, এই জীবনে তোমায় আমি ভুলব না গো, তোমার কথাই রইবে মনে’।
কত গভীর
অনুভব! আছে, তোমাদের এখনকার
গানে?”
যেন একমুঠো
চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতেই গড়গড়িয়ে বলে গেলেন তিনি কথাগুলো এক নি:শ্বাসে। আবেগে, উত্তেজনায় তাঁর
ঘোলেটে চোখ ছলছল করছে।
আমার কী মনে হল, কে জানে!
ভদ্রলোককে একটা প্রণাম করলাম, তারপর তাঁর দিকে চেয়ে বললাম, “উনি আমার
ঠাকুরদা। আজ আপনি আমায় অনেক কিছু দিলেন জ্যেঠু...”
এক নিমেষে
ভদ্রলোকের চোখ মুখ বদলে গেল। আমার দুটি হাত নিজের কাঁপা মুঠোয় চেপে ধরলেন, তারপর বললেন, “হে ভগবান, এ সৌভাগ্যও আমার
হওয়ার ছিল? তোমার ঠাকুরদা, তুমি তার আত্মার
জন, তুমি তার উত্তরসূরি... ওহ, আর আমি তোমাকেই বলছি তাঁর কথা? তার মানে তুমিও
নিশ্চয় খুব ভালো গান করো, তাই তো?”
আমি হেসে বললাম, “না জ্যেঠু ওই আর
কি,তেমন কিছু নয়”। এবার বেশ ক্ষিপ্র স্বরে ব্যস্ত হয়ে তিনি বললেন,“তা তো বললে চলবে
না, এ ধারা তো তোমরাই বহন করে নিয়ে যাবে...” আমি খুব লজ্জার
সাথে মাথা নাড়লাম। সত্যিই তো, দাদুর সম্পর্কে আজ যতটুকু জানি,তা কাগজ পড়ে, তথ্যচিত্র দেখে, কিছু মানুষের মুখ থেকে শুনে...
কিছুদিন আগেই
রবীন্দ্রসদনে দাদুকে নিয়ে হয়ে গেছে এক বিচিত্র সঙ্গীত সন্ধ্যা, দাদুর
জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে। বর্তমান প্রজন্মের প্রথিতযশা শিল্পীরা গেয়েছিলেন দাদুর
বিভিন্ন গান। জানিয়েছিলেন তাঁদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আমার ব্যাগ
হাতড়ে পেলাম, দাদুর সঙ্গীতজীবন সম্পর্কে প্রকাশিত একটি ছোটলেখনী, যা সেদিন তুলে
দেওয়া হয়েছিল প্রত্যেক শ্রোতা দর্শকের হাতে এবং নতুন করে এইচ এম ভি মিউজিক এর
সাহায্যে দাদুর গানগুলিকে সংকলিত করা 'শতজনমের প্রেম' সিডি টি, ও দুটোই তুলে
দিলাম তাঁর হাতে।
ট্রেন এসেছে।
উঠতে হবে। “ভাল থাকবেন জ্যেঠু...”
ভদ্রলোক তখন
আবেগে বিহ্বল।
তাঁর ঠিকানা, ফোননম্বর সব
ধরিয়ে দিলেন আমায়। বললেন, “একদিন আসবে তো,
মা? সেদিন কিন্তু দাদুর অনেক গান শুনবো তোমার গলায়!” বললাম, “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই জ্যেঠু”।
ট্রেন তার গতি
নিচ্ছে ধীরে ধীরে, একটু একটু করে ছোট হয়ে আসা মানুষটি তার দু’হাত তুলে
আশীর্বাদ করছেন।আমায় আর আমি সামনের পথের অনন্ত যাত্রার অঙ্গীকার নিয়ে এগোচ্ছি
সম্মুখে।
দাদুর জন্ম
চট্টগ্রামের পরৈকোড়া গ্রামে। পিতা কবিরাজ অপর্ণাচরণ ভট্টাচার্য্য ও মাতা বাসন্তীদেবী।
পেশাগত কারণে তাঁর বাবা চলে আসেন বারাণসীতে। শিল্পী ছোটবেলায় মাত্র তিন বছর বয়স
থেকে গান শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন বারাণসীর বিশিষ্ট ধ্রুপদাচার্য হরিনারায়ণ
মুখোপাধ্যায়ের কাছে। এরপরই কবিরাজ অপর্ণাচরণ তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রকে পাঠিয়ে দেন
কলকাতায় বিদ্যাশিক্ষার জন্য। কলকাতার কালিঘাট অঞ্চলে তার বসবাস শুরু হয়। রামঋক
ইন্সটিটিউশনে শুরু হয় পড়াশুনা। স্থান পরিবর্তন বা পড়াশোনা কোনোটাই তাঁকে সংগীত
থেকে দূরে রাখতে পারেনি। ১৯৩৩ সালে প্রথম আকাশবাণীর ভ্যারাইটী প্রোগ্রামে তার গান
গাইবার সুযোগ হয়।
এমনি এক
অনুষ্ঠানে শিল্পীর গানশুনে মুগ্ধ অনুপম ঘটক
গৌরীকেদারকে যোগাযোগ করিয়ে দেন হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানীর সঙ্গে।
ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭, প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম রেকর্ড – “সুরের ধারায়
স্নান করাবো”।
গীতিকার নরেশ্বর ভট্টাচার্য ওসুরকার গোকুল
মুখোপাধ্যায়। ঐ বছরেরই ডিসেম্বর মাসে শিল্পী রেকর্ড করেন আরও দুটি বাংলা ইসলামী
গান, ‘উঠেছে দীনের রবি’ ও ‘নবীন মদিনায় জানাইতে ব্যথা’; কথা: আর.সুলতান
ও সুর অনুপম ঘটক।
সম্ভবত:
গৌরীকেদারই একমাত্র শিল্পী যিনি একই সঙ্গে তিনটি নামে রেকর্ড করতেন। স্বনামে বাংলা
আধুনিক গান, ‘গোলাম কাদের’ নামে গজল, ইসলামী গান ও বাংলা কাওয়ালি এবং ‘সুকুমার
ভট্টাচার্য’ নামে পল্লীগীতি। শিল্পীর হিন্দী ও উর্দু উচ্চারণ ছিল প্রশংসার যোগ্য।
এ প্রসঙ্গে একটি
ঘটনা পরবর্তীতে তাঁর স্মৃতিচারণায় শোনা, একবার লক্ষ্ণৌ এর মুসলিম
এসোসিয়েশন থেকে চিঠি আসে যে তারা গোলাম কাদেরকে সম্বর্ধনা দিতে চান। তাঁর অসংখ্য
গুণমুগ্ধ, ভক্তের একান্ত ইচ্ছে তাঁকে সম্বর্ধনা দিয়ে সম্মানিত করার। শিল্পী নাম, যশের উর্ধ্বে
এতোটাই বলিষ্ঠ ও সৎ ছিলেন যে তিনি গ্রামাফোন কোম্পানি কে তৎক্ষণাৎ বলেন, তাঁর আসল পরিচয়
ওই মুসলিম এসোসিয়েশন কে জানাতে, কোনোভাবেই কোনো ছলনাতেই তিনি সম্মানের সহজ পথ বেছে নেন নি।
১৯৪১এর মে মাস।
প্রণব রায়ের কথায় ও সুকৃতি সেনের সুরে তাঁর সুপার ডুপার হিট রেকর্ড ‘কতদিন, কতদিন তুমি কাছে
নাই।’ এরপর থেকেই গ্রামাফোন কোম্পানি তাঁকে রয়ালটি দেওয়া শুরু করে।
আগষ্ট ১৯৪১
চিত্রশিল্পী অমূল্যকুমার মুখোপাধ্যায় ও পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দৌহিত্রীর
একমাত্র কন্যা ষোড়শী শেফালীর সঙ্গে শিল্পী পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। শিল্পীর
জনপ্রিয়তার পালে যেন উজান হাওয়া লাগল বিবাহের পরে। তাঁর ছিল সাত পুত্র ও এক কন্যা।
কখনও শৈলেন রায়ের কথা ও কমল দাশগুপ্তের সুর, কখনও বা মোহিনী
চৌধুরীর কথা ও চিত্ত রায় বা দূর্গা সেনের সুর, বা প্রণব রায়ের
কথা ও সুবল দাশগুপ্তের সুর। এভাবে একটার পর একটা সুপারহিট গান তিনি উপহার দিয়ে
গেছেন।
গৌরীকেদার
জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছিলেন বিরহের গানের হাত ধরে। তাঁর কণ্ঠে বিরহের গান এক
অন্য মাত্রা পেতো, যা শ্রোতার মনকে নাড়িয়ে দিতো ভিতর অবধি। শৈলেশ দত্তগুপ্তের
সুরে আর মোহিনী চৌধুরীর কথায় ‘নাই বা হল মিলন মোদের’ বা ‘এনেছি আমার
শতজনমের প্রেম’ বা শৈলেন রায়ের কথায় আর কমল দাশগুপ্তের সুরে ‘নিও না গো অপরাধ’ বা অরূপ
ভট্টাচার্যের কথায় ও শৈলেশ দত্তগুপ্তের সুরে ‘সমাধিতে মোর ফুল
ছড়াতে কে গো এলে’ - গানগুলির আকুল আর্তি শ্রোতা-হৃদয়কে ছুঁয়ে গেছে বারবার।
১৯৪৫ সালে
শিল্পী হলেন গ্রামাফোন কোম্পানির এক্সক্লুসিভ আর্টিস্ট। পরিস্থিতি ও প্রয়োজন
অনুযায়ী শিল্পী গেয়েছেন বিভিন্ন গান। তারই কিছু নমুনা… দেশ স্বাধীন হল, শিল্পীগাইলেন, ‘বল ভাই মাভৈ
মাভৈ, নবযুগ ঐ এলোঐ’ বা দূর্গা সেনের সুরে ‘জিন্দাবাদ
জিন্দাবাদ হিন্দুস্তান’। প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হল, শিল্পী গাইলেন,‘চক্রশোভিত তিনরঙা ঐ জাতীয় পতাকাখানি,মানুষের মাঝে
করিবে প্রচার সুখশান্তির বাণী’।
দেশভাগের
ফলস্বরূপ হাজার হাজার উদ্বাস্তু যখন বাঁধভাঙা বন্যার মতো এদেশে আসছে, তখন মরমী শিল্পী তাঁর
দরদী কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন, ‘আমি এক বাস্তুহারা ভাই, আমি স্বদেশে
বিদেশী হইলাম, দেশ বলিতে নাই রে, আমার দেশ বলিতে নাই’। সুভাষচন্দ্র নিখোঁজ। গৌরীকেদার গাইলেন, ‘বিপ্লবী নেতা হে
বীর সুভাষ তুমি তো এলে না ফিরে’।
শিল্পীর বিস্তার
ছিল বিভিন্ন গানে। উর্দু গজল ,হিন্দি ভজন, ভাটিয়ালি, শ্যামাসঙ্গীত, আধুনিক, ইসলামী গান, বাংলা কাওয়ালি, পল্লীগীতি এরকম
নানাবিধ গানে তিনি ছিলেন স্বমহিমায়
উজ্জ্বল ও ভাস্বর। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. যতীন্দ্রবিমল চৌধুরী ও ড. রমা চৌধুরীর
অনুরোধে বেশ কিছু সংস্কৃত গানে ও নাটকে সুর দিয়েছিলেন তিনি। ড: ধ্যানেশনারায়ণ
চৌধুরী এসেছেন কতোদিন তাঁর কাছে সেইসব গান তুলতে। এমনি অসম্ভব প্রতিভাবান, গুণী, নিরহংকারী মানুষ
ছিলেন এই শ্রী গৌরীকেদার।
১৯৪৮ থেকে ৫০ ওই
সময়ে অন্যান্য শিল্পীরা যখন মজলিসের দর রাখতেন ২০-৩০ টাকা, তখন গৌরীকেদারের
অনুষ্ঠান করার দর ছিল ১০০ টাকা। ফলে তিনি মজলিসের অনুষ্ঠান কমই করতেন, কিন্তু তার রেকর্ড
করা, সুর করা গানগুলি এতো পপুলার হয়েছিল যে
সেইসব অমর গান নিজেদের কণ্ঠে তুলে নিতে তাঁর কাছে আসতেন ড. ধ্যানেশনারায়ণ
চক্রবর্তী, সত্যেশ্বর মুখার্জী, শিশির ভট্টাচার্য (শিবানন্দ গিরি), তরুণ বন্দোপাধ্যায়, পান্নালাল বোস (যিনি
পান্নালাল কাওয়াল নামে বিখ্যাত ছিলেন) প্রমুখ বিশিষ্টজন। স্মৃতিচারণায় শোনা যায়, তাঁর মাণিকতলার
বাড়িতে থাকাকালীন সেই ঘরে অজস্র সুর ও কথার নিরন্তর সৃষ্টি হতে দেখেছেন
প্রত্যক্ষদর্শীরা, তাঁর পরিবারের মানুষজনেরা। কে না এসেছে, তাঁর সেই কুটীরে
সুরের বৈভব সাজাতে। চিত্ত রায়, শৈলেশ দাশগুপ্ত, দূর্গা সেন, প্রণব রায়, অরূপ
ভট্টাচার্য এমন অনেকে। কতো কথা যে সেখানে
ভেঙেছে, গড়েছে, কতো কালজয়ী সুর যে সেখানে সৃষ্টি হয়েছে তা বলার নয়।
ভারত সেবাশ্রম
সংঘের স্বামী বিজয়ানন্দ শিল্পীর বাড়িতেই শিল্পীর কাছে আসতেন গান শিখতে। তাঁর
একান্ত অনুরোধেই শিল্পী বেশকিছু সঙ্ঘগীতির স্বরলিপিও করে দিয়েছিলেন।
অজস্র বাংলা
ছবিতে গান গেয়েছিলেন তিনি। ছবির গানে সুর দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য কয়েকটি নাম:
ইন্দ্রজাল, মৌচাকে ঢিল, প্রার্থনা, নন্দরাণীর সংসার, পরশপাথর, ওরে যাত্রী, নিমাই সন্ন্যাস, চন্দ্রশেখর, শান্তি ইত্যাদি।
অসংখ্য হিন্দী
ছবিতেও গান গেয়েছিলেন তিনি। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত ১৫০ টিরও বেশি হিন্দী
ভার্সান গান তিনি গেয়েছিলেন।
এ হেন বহুল
গুণের আধার প্রণম্য গৌরীকেদার ১৯৫৫ সালের পর হঠাৎ জনপ্রিয়তার শীর্ষে
থাকাকালীন রেকর্ড করা বন্ধ করে দেন ।
জলসাতেও আর গাইতেন না। স্মৃতিস্মরণের সময়
জানা গেছে, যদিও তিনি বিরহের গানে, রোম্যান্টিক গানে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, কিন্তু একথা
অনস্বীকার্য যে রাগ- রাগিণীর উপর তার দখল
ছিল মারাত্মক। এমনিই গুণাধিকারী গৌরীকেদার স্থির করেছিলেন তিনি রাগাশ্রয়ী বাংলা
গানের উপর রেকর্ড করবেন।
তখনকার দিনে
যেমন স্যাম্পেল কপি হত রেকর্ডের, সেইসব কাজও সারা হয়ে গেছিল, অত্যন্ত অপরূপ
সে গানের কথা, সুর ও গায়কী, (ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে
জানা যায়)। গান লিখেছিলেন অরূপ ভট্টাচার্য
ও সুর করেছিলেন চিত্ত রায়। এমন যখন সবকিছু অতি সুন্দর ভাবে এগোচ্ছে, হঠাৎই অজানা
কারণে গ্রামাফোন কোম্পানি এই রেকর্ডটি বের করার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলল। শোনা যায়, শিল্পী এই
ঘটনাতে আঘাত পান ও এটিও হয়ত একটি কারণ তার জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকাকালীন এভাবে
রেকর্ড করা বন্ধ করে দেওয়ার। কিন্তু এও সত্যি যে ওই একই রেকর্ড একইভাবে করার জন্য
তার কাছে মেগাফোন ও হিন্দুস্তান কোম্পানি বারেবারে এসেছিলেন, কিন্তু
শিল্পী-মনে কোন তীর যে বিঁধেছিল, তিনি আর রাজিই হলেন না।
১৯৫৫- ৫৬ সাল
খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীর জীবনে। আমাদের গৃহদেবতা বটুক ভৈরবের প্রভাব ঠাকুরদার
উপর প্রবল ভাবে ছিলই, এই সময় তিনি অন্য গান গাওয়া বন্ধ করে দিলেন। শুধুই
শ্যামাসংগীত গাইতে লাগলেন। কালীঘাটে মায়ের মন্দিরে, বকুলেশ্বর
ভৈরবের মন্দিরে, তিনি গান গেয়ে বেড়াতেন।
এক অদ্ভুত আধ্যাত্ম চেতনার বিকাশ ঘটে এই সময় তাঁর মধ্যে।
যে কণ্ঠে, "আমি যে দেখেছি
প্রিয়ার নয়নে জল", বা " মোর হাতে ছিল বাঁশি, তার হাতে
ফুলডোর" শুনে প্রেমাসিক্ত হয়ে উঠত মানুষের হৃদয়, সেই একই কণ্ঠে
"শ্মশানকালীর নাম শুনে রে ভয় কে পায়" শুনে মানুষের মন ভক্তিরসে একই
অনন্যতায় সিক্ত হয়ে উঠতো। এমনই ছিল তার গায়কী, তার সুরের আবেগ।
২৩ শে এপ্রিল
১৯৭৪ সাল তিনি সংসারত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন; নাম গ্রহণ করেন, মোহন্ত চন্দ্রশেখর গিরি। শেষজীবনটা সন্তানদের অনুরোধে
তিনি গৃহী সন্ন্যাসী রূপে সংসারেই কাটান। ১৯৮৩ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি এই মহাপ্রাণ
সংগীতসাধক দূরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে রামকৃষ্ণ মিশন সেবায়তনে শেষ নি:শ্বাস
ত্যাগ করেন। তাঁর দেহ বিলীন হয়েছিল মহামৃত্যুর অসীমে, কিন্তু তাঁর
সুরের ঝর্ণা আজও একই কল্লোলে একই উদ্দামতায় জনপ্রিয় ও শ্রুতিমধুর।
ট্রেন ছুটছে
দ্রুত গতিতে। ছন্দ, সুরে তালমগ্ন চেতনায় আমি বুঁদ হয়ে আছি রক্তের জঠরে। নিজের
আনমনেই গুনগুনিয়ে উঠছি দাদুর গাওয়া গানের কলি। চোখের সামনে ভেসে উঠছে শ্রদ্ধায়
নিমজ্জিত বৃদ্ধ ভদ্রলোকটির দুটি বাঙ্ময় চোখ।
মনে মনে যে
কতবার তানপুরার গায়ের ধূলো ঝেড়ে ফেললাম, সে কেবল জানলাম আমি আর
শ্রদ্ধার্পণে রইলো প্রতিশ্রুতি, দাদুর মহান আত্মার কাছে, যে তাঁর
উত্তরসুরীর চেতনায় বেঁচে থাকবে তার সুরের পবিত্র গঙ্গা এমনই ভাবে চিরদিন....
প্রণাম।।
-----------------------------------------------------------------
*** শ্রী গৌরীকেদার
ভট্টাচার্যের জীবনকে কেন্দ্র করে দুটি ভাগে 'তর্পন' নামে
তথ্যচিত্রটি তৈরি করেছিলেন শম্পা মিত্র। নীচে লিঙ্কদুটি দেওয়া হল। দেখলে বুঝবেন এই
মহাপ্রাণ শিল্পীর মানব সাধনা, ও সঙ্গীত সাধনার ব্যপ্তি কি বিশাল।
সুমনা
পাল ভট্টাচার্য