অটো ওয়ালার রোজগেরে হাঁকডাকের জন্য অপেক্ষা না
করে তিতিরকে নিয়ে অটোর মধ্যে সেঁধিয়ে যেতেই সাথে সাথে আরও দুটো লোক মউলির পাশে
অটোতে চেপে বসল। এই ছোট্ট শহরে যাতায়াতে অটোই একমাত্র ভরসা। কিন্তু পেছনে তিনজনে
এই অটোতে বসা যেন রীতিমত অস্বস্তিকর। তার উপর মউলির কোলে তিতির। কিছুদূর যাবার পরই
মউলি টের পাচ্ছিল অকারণেই বার বার মাঝের ব্যক্তির হাত মউলির কাঁধ স্পর্শ করছে।
যদিও সে জানে এ অভিজ্ঞতা মউলির বা মউলির বয়সী মেয়েদের খুব চেনা এক জীবনেরই অঙ্গ, এ দেশে। যা সে আরো
হাজার টা মউলির মতই পার করে এসেছে। মনে মনে বলে ওঠে, তিতির না থাকলে তোমার হাত দেবার ইচ্ছের গুষ্টির
ষষ্ঠী পুজো করে ছেড়ে দিতাম এখুনি। আর কেনই বা করবে না। ডাকাবুকো বলেই তো গোটা কলেজ
চিনত মউলি কে। মনে পড়ে আদ্রা লোকালে, যেদিন বাপের বয়সী লোকটা কে কান ধরা করিয়েছিল, তার পরেরদিন কলেজে সে কি খাতির! ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
স্পর্শ
সোমস্নিগ্ধ মুখোপাধ্যায়
আকাশের দিকে দুচোখ ভালোলাগা নিয়ে তাকিয়ে ছিল
মউলি। বছরের প্রথম বোশেখ ঝড় উঠোনের ইউক্যালিপটাস গাছটাকে পুরো অগোছালো আর আলুথালু করে দিয়েছে, খুব সকালে ঘুমন্ত
পলাশকে বিছানায় রেখে,
তিতির কে স্কুলের
জন্য রেডি করতে ওঠা মউলিরই মত। অবাক হয়ে
সে ভাবছিল, গাছগুলোও কি তার মত উপভোগ করে ঝড়ের
আদর? যেমন সে মুখিয়ে থাকে পলাশের স্পর্শ পাবার জন্য। একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে নানা
ভাবনায় এফোঁড় ওফোঁড় হতে হতে সে দেখছিল আস্তে আস্তে কেমন করে সন্ধে নামছে এই ব্যপ্ত চরাচরে। পলাশ কে পাশে না
পেয়ে, মউলির যেন বড় একা লাগছিল এই চৈত্রের সন্ধ্যায়।
আজ একমাস হল তারা এই নতুন বাড়িটায় এসেছে। শিফট
এর হাজারো ঝামেলা সামলে এই সবে তারা একটু থিতু হতে শুরু করেছে। তিতিরকে নতুন
স্কুলে ভরতি থেকে শুরু করে, কেবল কানেকশন, গ্যাসের লাইন, সব প্রায় একা হাতেই সামলেছে সে। সপ্তাহের অন্য
দিন গুলোর মতই আজও বোধহয় পলাশের ফিরতে নটা
বেজে যাবে। সরকারি চাকরির এই ঝামেলা। নিজের বাবাকে দেখে দেখে তো বড় হয়েছে সে। মা
এর সাথে নিত্য অশান্তি লেগে থাকত। ভোট এলে তো আর কথাই ছিল না। বাবার বাসা ফিরতে এক
এক দিন রাত বারোটা। কিন্তু সে সব ভেবে আর কি হবে, ঘরে প্রায় কিছুই নেই। তাই উপায়ান্তর না দেখে
মউলি একাই তিতিরকে নিয়ে বাজার যাবে বলে ঠিক
করে ফেলল। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই সে বেশ বুঝতে পারছিল
পাশের কোয়ার্টার এর বোস বউদির দৃষ্টি কোনও এক অজ্ঞাত কোণ থেকে ঠিক তাকে জরিপ করছে।
বোস বউদির এই স্বভাব। এই একমাসে এরকম আরো অনেক কিছুই মউলি জেনে গেছে, এই হাউজিংএর। তাই, আগেভাগে মউলিই বলে
উঠল -
বউদি, বাজার যেতেন নাকি?
অপ্রস্তুত উত্তর এল - না,না, কিন্তু তু
তুমি...একাই? -পলাশ আসবেনা?
না, বউদি ওর আজও ফিরতে দেরী হবে।
অকারণ এই কৌতুহল একেবারেই না পসন্দ মউলির। তাই, আর মেকি কথাবার্তা
না বাড়িয়ে সে তিতিরকে নিয়ে অটো ধরার জন্য রাস্তায় এসে দাঁড়াল। হঠাৎ ঝড়ে সাঁঝবাতিরা
না জ্বলায় এই সন্ধে সাতটাকেও অনেক রাত বলে মনে হচ্ছে এই ছোট্ট জনপদে।
মউলির মনে আসে পুরুলিয়ার কথা। দাদামণি রাত ন টার
সময় ট্যুইশন সেরে, বাড়ি ফিরে, চা খেয়ে আড্ডা দিতে বেরত। তাই সন্ধে সাতটা বিয়ের
আগে মউলির কাছে বিকেল বলে মনে হত।
মার্কেট...... মার্কেট....
অটোটা তিতিরের একদম গা ঘেঁষে দাঁড়াল।
-বড় মার্কেট যাবে?, মউলি জিজ্ঞেস
করল।
-চড়ুন, চড়ুন, জলদি করুন,জলদি করুন, মার্কেট... মার্কেট... অটো ওয়ালার রোজগেরে
হাঁকডাকের জন্য অপেক্ষা না করে তিতিরকে নিয়ে অটোর মধ্যে সেঁধিয়ে যেতেই সাথে সাথে
আরও দুটো লোক মউলির পাশে অটোতে চেপে বসল। এই ছোট্ট শহরে যাতায়াতে অটোই একমাত্র
ভরসা। কিন্তু পেছনে তিনজনে এই অটোতে বসা যেন রীতিমত অস্বস্তিকর। তার উপর মউলির
কোলে তিতির। কিছুদূর যাবার পরই মউলি টের পাচ্ছিল অকারণেই বার বার মাঝের ব্যক্তির
হাত মউলির কাঁধ স্পর্শ করছে। যদিও সে জানে এ অভিজ্ঞতা মউলির বা মউলির বয়সী মেয়েদের
খুব চেনা এক জীবনেরই অঙ্গ, এ দেশে। যা সে আরো হাজার টা মউলির মতই পার করে এসেছে। মনে
মনে বলে ওঠে, তিতির না থাকলে তোমার হাত দেবার ইচ্ছের গুষ্টির ষষ্ঠী পুজো করে ছেড়ে দিতাম
এখুনি। আর কেনই বা করবে না। ডাকাবুকো বলেই তো গোটা কলেজ চিনত মউলি কে। মনে পড়ে
আদ্রা লোকালে, যেদিন বাপের বয়সী লোকটা কে কান ধরা করিয়েছিল, তার পরেরদিন কলেজে সে কি খাতির!
সৌম্য, যে সৌম্যর এত দেমাক ছিল - না হলে সে কিনা এসে
প্রস্তাব দেয়,
- অ্যাই, তুই এবারে আমাদের
হয়ে জি এস দাঁড়াবি?
মউলি হেসেছিল।
কিন্তু কত পাল্টে গেল জীবন। কত পাল্টে গেল সেই
মেয়ে এই ক বছরে। বিশেষ করে তিতির আসার পর। সারাক্ষণ তিতিরকে নিয়ে হাজার ভাবনা আসে
মনে।
একটা এইটুকু মেয়ে, কত্ত দায়িত্বশীল, কত্ত সাবধানী করে তুলল, সেদিনের সেই মউলিকে!
সে যে এখন মা, আর এক জনের!
তাই ঠাটিয়ে লোকটা কে একটা চড় কষাতে ইচ্ছে হলেও কে যেন আটকে দিচ্ছে মউলি কে। তবু অনেকক্ষণ
ধরে লোকটা মউলির গায়ে পড়তে থাকায় এবার মউলির চেতনা বিদ্রোহ করে উঠল।
- ভদ্রভাবে সোজা হয়ে
বসুন, কি হচ্ছে তখন থেকে, বারবার অকারণ টাচ করছেন, বেশ ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠল মউলি ।
-এত অসুবিধা তো অটোতে
চড়ার কি দরকার, ট্যাঁকের পয়সা খসিয়ে তো গাড়িতে চড়লেই হয়, অনিবার্য বিদ্রূপ
উড়ে এল মউলির দিকে।
- ভদ্রভাবে কথা বলুন।
আমি কিসে চড়ব, সেটা আপনি বলে দেবেন?
অটোর ভেতরে লোকদুটোর হাবভাব ঠিল ভাল ঠেকছিল না
মউলির। তাই, আর কথা না বাড়িয়ে সে অপেক্ষা করছিল নামবার জন্য। যেকোন কারণেই হোক বড় ভয়
করছিল তার। হয়ত বা তিতির সাথে আছে বলেই। বড় রাস্তা পেরিয়ে
অটোটা ততক্ষণে গলির মুখটার কাছে এসে পরেছে। কিন্তু মউলি টের পাচ্ছিল গলির
অন্ধকারের সুযোগে সেই নোংরা হাত এবার
শালীনতার সীমা ছাড়াচ্ছে। কাঁধ থেকে নিচে, সেখান থেকে আরো...আরো নিচে...। মউলি চীৎকার করে উঠল,
- অ্যা...ই...কি হচ্ছে
এসব! গা..গাড়ি...থামা..ন, থামান বলছি।
মউলির চিৎকারে তিতির চমকে ওঠে!
-কি হল, মা? মা?
আধো আধো তিতিরের জানতে চাওয়ার কাছে মউলি নির্বাক
হয়ে তাকিয়ে থাকে! অসহায়! স্থাণুবৎ!
কি হল? কি উত্তর সে দেবে তিতিরকে! কি উত্তর দেবে এক মা
তার আত্মজাকে?
- শ্লীলতাহানি!
এই জবাব সে দেবে তার একরত্তি মেয়েকে? শিখিয়ে দেবে এক নতুন
শব্দ!এই বয়সেই!
এক প্রচন্ড বিবমিষায় গা গুলাতে থাকে মউলির।
তিতিরকে জড়িয়ে ধরে এক লাফে অটো থেকে রাস্তায় নেমে পড়ে সে। এক অব্যক্ত কান্না
আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে তার সর্বাঙ্গ, অজগরের মত। মউলির ভীষণ একা লাগছিল ওই চৈত্রের
সন্ধ্যার পৃথিবীতে। কোনও অবলম্বন না পেয়ে, আরও বেশি করে তাই সে জড়িয়ে ধরে তার আত্মজাকে।
আরো, আরো বেশি করে।
- এ কোন পৃথিবীতে আমরা
তোকে নিয়ে এলাম তিতির!! মউলির চীৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে।
সন্ধ্যার অন্ধকার তখন যত গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছিল ঐ ছোট্ট জনপদের গলিটায়, এক জন্মদাত্রী দুহাত
দিয়ে তত আষ্টেপৃষ্ঠে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরছিল তার কন্যার শরীর। আহা, মায়ের স্পর্শ দিয়ে
যতটুকু আগলে রাখা যায় তাকে। এখনো যে সামনে চলার বহু পথ বাকী।
সোমস্নিগ্ধ মুখোপাধ্যায়