শুধুমাত্র টেকনিক জেনে রসিক এবং রসসৃষ্টিকারী
(রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন, জীবনান্দদাশ) হওয়া যায় না, হওয়া যায় না একজন হুমায়ুন
আজাদ কিংবা সব্যসাচী সৈয়দ শাম সুল হক। আমরা
অনেকেই জানি যে, হুমায়ুন আজাদ একজন ভাষা বিজ্ঞানীও বটে। কিন্তু বিশ্বাস করুন তার
ভাষা বিজ্ঞানের বই আজ পর্যন্ত আমার পড়া হয়নি অথচ তার কবিতার বই আমার সাথে সাথে
বাসে বাসে ঘোরে, কি আশ্চর্য তাই না? এমনই হয়, আমারা এই বদ্বীপরে মানুষেরাই এমন। তাই বলছিলাম, ভাব থাকতে
হয়, ভাব। ভাব
থাকলে টেকনিক অর্জন করে নেয়া যায়। আমি
এমন অনেক কবিকে তাদের সাক্ষাৎকারে বলতে
শুনেছি যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে যে, লিখছেন না কেন, সে উত্তর দিয়েছে, লেখা আসছে
না, ভাব নেই, ভাব তাকে ছেড়ে চলে গেছে কিংবা ভাব শুকিয়ে গেছে। এই হচ্ছ আসল কথা, টেকনিক
দখলে থাকলেই লেখা বেরুবে না, রুপ-রস-গন্ধ সৃষ্টি হবে না। ভাব থাকতে হবে, এই ভাবই
আসল বস্তু। ~~~~~~~~~~~~~~~~
আমরা ভাবের পাগল, রসিক নাগর
সৈয়দ
ওয়ালী
প্রিয় সৈয়দ শামসুল হক, আপনার ‘মার্জিনে মন্তব্য’ পড়তে পড়তেই এই ভাবনা
গুলো মাথায় এলো। ভাবলাম
এগুলোও তো সবার সাথে ভাগাভাগি করে নেয়া যায়, কেননা এগুলোও তো ভাব, নাকি ভাব নয়? যে
ভাবের জ্বালায় মরলাম সারাজীবন, হতে পারলাম না কিছু।
হ্যা, শিল্পের সৃজন কৌশল ও ভাষা বিষয়ক বিভিন্ন মূর্খতা
নিয়েই আমরা লিখতে শুরু করি। যেমন
আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে একুশে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে একটি দেয়াল পত্রিকায় লেখা
প্রকাশের অভিপ্রায়ে আমার লেখালিখির দৃশ্যমান সুত্রপাত হয়েছিল। প্রকৃত অর্থে ঠিক ঐ
বিশেষ সপ্তাহ বা ঐ দিনেই কি আমার লেখালিখি শুরু হয়েছিল? নাকি শুরু হয়েছিল অনেক আগেই, শুধুমাত্র প্রকাশ
ঘটেছিল ঐ বিশেষ সপ্তাহের ঐ বিশেষ দিনটিতে ? ঐ দেয়াল পত্রিকায় লেখা দেয়ার আগেও কি
আমার ভেতরে লেখা বা ভাব বা রূপ বা রস কিংবা গন্ধ জন্ম নিচ্ছিল না, বা জন্ম নেয় নি? যেই রূপ, রস বা গন্ধের সন্ধানে
শিকারি কুকুরের মত নিজেকে-সময়কে-প্রকৃতিকে-জীবনকে আজ অব্দি শুঁকে শুঁকে চলেছি। কিংবা বলা যেতে পারে
অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মত পর্যবেক্ষণ করে চলেছি।
খুব ছোট বেলায় বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে যখন
প্রায় নিয়মিত জানতাম, শুনতাম এবং পড়তাম, ‘বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ,
মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই’ কিংবা ‘ঐ খানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে’ কিংবা ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে,
বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে’ কিংবা, ‘বল বীর চির উন্নত মম শির’। এই সব জেনে জেনে, শুনে
শুনে এবং পড়ে পড়ে কি আমারও ভেতর লেখা জন্ম নিত না, নেয় নি? লেখা বলতে বোঝাচ্ছি সেই
কাংখিত অলৌকিক ভাব, রূপ বা গন্ধ কে, যা আপনাকে তাড়া করে ফিরেছে, যা কথা সাহিত্যক,
হাসান আজিজুল হককে তাড়া করে ফিরেছে, যা হুমায়ন
আজাদকে তাড়া করে ফিরেছে, এবং তাড়া করে ফিরেছে আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ সহ
অনেককে এবং এখনও তাড়া করে চলেছে জানা অজানা অসংখ্য মানুষকে । এবং সেই অলৌকিক রুপের
পেছনে ছুটতে ছুটতে আপনি সৈয়দ শাম সুল হক এবং অন্যান্যরা কবে থেকে যে নিজেরাই সেই
কাঙ্খিত অলৌকিক রূপ বা শিল্প সৃজন করতে শুরু করেছেন তা কি আপনারা নিজেরাও খুব
স্পষ্ট করে টের পেয়েছেন? হয়তো পেয়েছেন হয়তো পাননি কিন্তু আমরা পেয়েছি। আমরা যারা (রসিক) আপনার
এবং আপনাদের লেখা পড়ি তারা টের পাই সেই অলৌকিক রুপ-রস-গন্ধ। কেন পড়ি সেটা নিশ্চয়ই
আপনি এবং আপনারা অন্তত জিজ্ঞেস করবেন না।
হ্যা, এভাবেই প্রায় সকলের ক্ষেত্রেই শুরু হয়। অন্তত আমরা যারা এই
বদ্বীপে বাস করি আরও স্পষ্ট করে বললে এই নদী বিধৌত অঞ্চলে বাস করি তাদের বেশির ভাগ
জ্যোতির্ময় মানুষের ক্ষেত্রে এভাবেই শুরু হতে দেখেছি। না হলে রেলিঙ এর সাথে মাস্টারি মাস্টারি করতে করতেও কেউ
বিশ্ব কবি হয়! হা ঈশ্বর বিশ্ব কবি! কিংবা রুটি বানাতে বানাতে নজরুল! এবং লিখে
ফেলে... কাড়ার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট! ভাবা যায়!
প্রিয় সৈয়দ শামসুল হক, এই যে আমি এখনও শিল্পের সৃজন
কৌশল ও ভাষা বিষয়ক মূর্খতা নিয়ে লিখে যাচ্ছি একে আপনি কি বলবেন? আর সত্য বলতে কি,
পূর্বসূরির যে রক্ত আমি ও আমরা ধারন করে আছি এবং যে পরিবশের ভেতর দিয়ে আমি ও আমরা
বেড়ে উঠেছি তা কি আমাকে আমাদেরকে কিছু শেখায় না? যা নিয়ে শুরু করা যায় এবং চলতে
চলতে, খুজতে খুজতে একটু একটু করে জেনে নিতে নিতে আপনাদের মত সৃষ্টি করা যায় সেই
অলৌকিক, যার সন্ধানে এই তাড়া খেয়ে বেড়ানো?
আমার বিচারে ভাবই মূল কথা টেকনিক নয়। ভাব থাকলে টেকনিক শিখে
নিতে কেইবা পিছপা হয়েছে। আচ্ছা
আপনি বা আপনারাই বলুন, এই যে...’তুমি যে
তুমিই ওগো, সেই তব ঋণ, আমি মোর প্রেম দিয়ে, সুধি চিরদিন’ কিংবা ‘আমি চিরতরে দুরে
সরে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে’ কিংবা ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখী, কেমনে আসে যায়’। এইসব কি শুধুমাত্র
ব্যাকরণ ঘষে আসে কিংবা টেকনিক ব্যাবহার করে সৃষ্টি করা যায়? তাই যদি হতো তবে তো
শ্রী প্রবোধ চন্দ্রসেন, ডঃ সুনীতি কুমার বন্দপধ্যায়, কিংবা ডঃ মুহাম্মদ
শহিদল্লাহ-ই(এই তিন মনিষীর প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি) আমাদের মত রসিকদের
কাছে সব চেয়ে বেশী আদরণীয় হত! তা কি
হয়েছে? হয়নি, বাস্তবতাই এই।
শুধুমাত্র টেকনিক জেনে রসিক এবং রসসৃষ্টিকারী
(রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন, জীবনান্দদাশ) হওয়া যায় না, হওয়া যায় না একজন হুমায়ুন
আজাদ কিংবা সব্যসাচী সৈয়দ শাম সুল হক। আমরা
অনেকেই জানি যে, হুমায়ুন আজাদ একজন ভাষা বিজ্ঞানীও বটে। কিন্তু বিশ্বাস করুন তার
ভাষা বিজ্ঞানের বই আজ পর্যন্ত আমার পড়া হয়নি অথচ তার কবিতার বই আমার সাথে সাথে
বাসে বাসে ঘোরে, কি আশ্চর্য তাই না? এমনই হয়, আমারা এই বদ্বীপরে মানুষেরাই এমন। তাই বলছিলাম, ভাব থাকতে
হয়, ভাব। ভাব
থাকলে টেকনিক অর্জন করে নেয়া যায়। আমি
এমন অনেক কবিকে তাদের সাক্ষাৎকারে বলতে
শুনেছি যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে যে, লিখছেন না কেন, সে উত্তর দিয়েছে, লেখা আসছে
না, ভাব নেই, ভাব তাকে ছেড়ে চলে গেছে কিংবা ভাব শুকিয়ে গেছে। এই হচ্ছ আসল কথা, টেকনিক
দখলে থাকলেই লেখা বেরুবে না, রুপ-রস-গন্ধ সৃষ্টি হবে না। ভাব থাকতে হবে, এই ভাবই
আসল বস্তু।
প্রিয় সৈয়দ শামসুল হক, আপনি এবং আপনারা নিশ্চিন্ত
থাকতে পারেন এই ভেবে যে, আপনারা যে সব অলৌকিক রসের ভাণ্ড রেখে যাচ্ছেন আমাদের জন্য
তা আমাদেরকে নিশ্চিতভাবে আনন্দ দেয়ার পাশাপাশি সমৃদ্ধও করবে এবং আমাদের মধ্যেও কেউ
কেউ তৈরী করবে আরও নিত্য নতুন রসের ভাণ্ড। হয়তো সে সব রসের রুপ-গন্ধ আপনাদের মত হবে
না, আপনারাও যেমন আপনাদের পূর্বসূরিদের মত রস সৃষ্টি করেননি, তবে পানযোগ্য হবে
নিশ্চিত। আপনাকে
অসংখ্য ধন্যবাদ “মার্জিনে মন্তব্য” এর মত একটি অসধারন বই আমাদের উপহার দেয়ার জন্য। শেষ যে কথাটি বিনয়ের
সাথে বলতে চাই-
বোদ্ধা হতে না পারি
আমরা রসিকেরা আছি, থাকব
অনন্ত কালের জন্য।
...
সৈয়দ ওয়ালী