সমাজ সংস্কৃতি সমকাল। আমাদের অস্তিত্বের
তিনটি স্তম্ভ স্বরূপ। আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যক্তি আমির স্বরূপ গড়ে ওঠে কিন্তু
এই তিনটি বিষয়ের ঘাত প্রতিঘাতের সংমিশ্রনেই। সেই ব্যক্তি আমির স্বরূপ সমষ্টির
দিগন্তে নিজেকে কিভাবে প্রতিষ্ঠিত করে তুলবে হয়তো সেইটাই আমাদের প্রত্যেকের নিজের
নিজের পথ। আবার সেই পথের কতটুকু রংরুট আর কতটুকু নয়, সে বিচার কালান্তরের হলেও
সমকাল কিভাবে সেই ব্যক্তি আমির দর্পনে দৃশ্যমান সেটিও বড়ো কথা। তাই আমাদের সমাজ
সংস্কৃতি সমকাল কি ভাবে আমাদের গড়ে তুলছে, বা একটু উল্টো দিক দিয়ে বললে, কিভাবে
আমরা আমাদের সমাজ সংস্কৃতি সমকালকেও রূপ দিচ্ছি, আর সেই দেওয়ার পথ রংরুট না
মনুষ্যত্বের দিগন্ত প্রসারী রাজপথ সেই দিকেই আলোকপাত করার উদ্দেশ্য লক্ষ্য ও বাসনা
নিয়ে হাজির ভিন্ন স্বাদের ত্রৈমাসিক ‘রংরুট’। সমাজ সংস্কৃতি সমকালের বলিষ্ঠ
দর্পন।~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
রংরুট
কিন্তু চিন্তাশীল মানুষ, সৃজনশীল সত্ত্বা
কি তাই বলে সব ইন্দ্রিয়ের শাটার নামিয়ে দিয়ে চুপ করে বসে থাকবে? স্বয়ং কবিই তো
সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ। শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। শেষ কথা বলাটাই আসল বিষয় নয়। শেষে গিয়ে
পৌঁছালে তো আর বাকি কিছুই থাকে না। দাঁড়ি টেনে দাঁড়িয়ে যেতে হবে একেবারে। না আজকের
কথাটুকু আজকেই বলে যেতে হবে আজকের মতো করে। আজকের প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে দিতে।
নীতি আদর্শের কথাই তো সব নয়। মানুষের অস্পষ্ট প্রশ্নগুলিকে সুস্পষ্ট করে তুলতে
হবে। মানুষের প্রতিদিনের সমস্যাগুলির মুখোমুখি মোকাবিলা করাই কি আসল মনুষত্ব নয়?
আমাদের মূল প্রশ্ন এইখানেই। আমরা কজন এই মুখোমুখি মোকাবিলার পথে হাঁটি? হেঁটেছি?
হাঁটবো আদৌ? রোজাকার হেডলাইনে নিজে খবর না হওয়া অব্দি আমাদের কজনের টনক নড়ে আদৌ?
কজন আমরা উচিৎ কে ঔচিত্যে দাঁড় করিয়ে থাকি? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তো অশুভ শক্তির সাথে
দুর্নীতির সাথে আপোষ করে চলতে শেখাকেই আমরা জীবন বাস্তবতা ধরে নিজেদের মনে বদ্ধমূল
করে নিই। এবং কেউই কিন্তু সেটিকে রংরুট বলে স্বীকার করতে রাজী নই। অনেকেই বলবেন
ঠিকই তো কে আর নিজে থেকে ক্ষুদিরাম হতে যাবে? ঢাল নাই তলোয়ার নাই, নিধিরাম
সর্দ্দার হওয়াটাই কি আদর্শ নাকি? কিন্তু এই ভাবে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়াটাই যদি
দস্তুর হয় সমাজের, এই সময়ের বা সকল যুগেরই তবে তো এই পথকে রংরুট বললে মস্তবড়ো ভুলই
হয়ে যাবে তাই না? গোটা সমাজ যে পথে চলেছে, সেই পথ কি করে রংরুট হতে পারে?
কিন্তু শুধু কি আমাদের সমাজই এই ভাবে
ভাবছে? উন্নত অনুন্নত বিশ্বের নানান প্রান্তের বিভিন্ন সমাজের ভাবনার প্রকরণগুলিই
বা ঠিক কি রকম? কোনটা তাদের কাছে রংরুট, আর কোনটা নয়; সেটিও কি জানার বা বোঝার
প্রয়োজন নাই আমাদের? বিশ্ব থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে চলার দিন তো আজ আর নাই। তাহলে?
অর্থাৎ আমরা চাই বা না চাই, এই দ্বন্দ্ব কিন্তু আমাদের চারপাশ ঘিরে আমাদের দিকেই
নিষ্পলক তাকিয়ে রয়েছে। তাকিয়ে থাকবে। ডারুইনের ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট’ যত বড়োই
অমোঘ সত্য হোক না কেন, সেই সত্যকে শিরোধার্য্য করে হলেও আমাদের ঠিক করতেই হবে আমরা
কোন রুটে আছি। ঠিক যদি করে নিতে না পরি ঠিকমতো তবে সেটিই হয়তো অনেক বড়ো এক রংরুট।
যার সত্যই শেষ নাই। শেষ কথা বলা তো দূরস্থান।
সমাজ সংস্কৃতি সমকাল। আমাদের অস্তিত্বের
তিনটি স্তম্ভ স্বরূপ। আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যক্তি আমির স্বরূপ গড়ে ওঠে কিন্তু
এই তিনটি বিষয়ের ঘাত প্রতিঘাতের সংমিশ্রনেই। সেই ব্যক্তি আমির স্বরূপ সমষ্টির
দিগন্তে নিজেকে কিভাবে প্রতিষ্ঠিত করে তুলবে হয়তো সেইটাই আমাদের প্রত্যেকের নিজের
নিজের পথ। আবার সেই পথের কতটুকু রংরুট আর কতটুকু নয়, সে বিচার কালান্তরের হলেও
সমকাল কিভাবে সেই ব্যক্তি আমির দর্পনে দৃশ্যমান সেটিও বড়ো কথা। তাই আমাদের সমাজ
সংস্কৃতি সমকাল কি ভাবে আমাদের গড়ে তুলছে, বা একটু উল্টো দিক দিয়ে বললে, কিভাবে
আমরা আমাদের সমাজ সংস্কৃতি সমকালকেও রূপ দিচ্ছি, আর সেই দেওয়ার পথ রংরুট না
মনুষ্যত্বের দিগন্ত প্রসারী রাজপথ সেই দিকেই আলোকপাত করার উদ্দেশ্য লক্ষ্য ও বাসনা
নিয়ে হাজির ভিন্ন স্বাদের ত্রৈমাসিক ‘রংরুট’। সমাজ সংস্কৃতি সমকালের বলিষ্ঠ দর্পন।
প্রকাশিত হবে প্রতি বছর বৈশাখ শ্রাবণ কার্তিক মাঘ।
যে কোন সৃষ্টির শুরুই হয় অঙ্কুরের
মাধ্যমে। তাই আমাদের এই প্রথম সংখ্যাটির কলেবরও খুব বড়ো নয়। কিন্তু যে কোন
সৃষ্টিরই মধ্যেই যেমন তার ভবিষ্যতের একটি দিশা থাকে অস্পষ্ট অস্বচ্ছ হলেও; রংরুটের
পাঠকও সেই দিশাটুকুর হদিশ নিশ্চয় খুঁজে পাবেন এবারের এই প্রথম নিবেদনেই। এই সময়ের
অন্যতম বলিষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও বর্ষীয়ান চিন্তাবিদ বদ্বীপ প্রকাশনের কর্ণধার
শামসুজ্জোহা মানিকের মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি ও আওয়ামীলীগের ভুমিকা পাঠককে নতুন ভাবে
ইতিহাসকে জানতে ও বর্তমাকে বুঝতে সাহায্য করবে। সুস্পষ্ট বক্তা ও অনুপম লেখনীর
অধিকারী অমলেন্দুর ভাষার ইতিবৃত্ত সমাজ সংস্কৃতি সমকালকে ইতিহাসর আলোকে অনুধাবনে
বিশেষ ভাবে সাহয্য করবে সন্দেহ নাই। আমাদের চারপাশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের ওঠা পড়া
নিয়ে অলভ্যর ধারাবাহিক প্রবন্ধেও উঠে আসছে সেই সমাজ সংস্কৃতি সমকাল তার ঐতিহাসিক
প্রক্ষিতেই। পারমিতার রচনায় ধরা পড়েছে নারীর অবস্থান, একজন নারীর বলিষ্ঠ উচ্চারণে।
বাংলা লিটিল ম্যাগের ইতিহাসের পথ ধরে শৌনকের সুরম্য আলোচনায় লিটিল ম্যাগ ভক্তরা
সত্যইই চমৎকৃত হবেন আশা রাখি। আমাদের সাহিত্যসম্পূট বিভাগে এবারের নিবেদনে
রেজওয়ানের বিস্তৃত আলোচনায় জীবনানন্দ দাশের ‘ক্যাম্পে’ কবিতা। অনেক অজানা তথ্য
জানতে ও ভুল ধারণা দূর করতে সাহায্য করবে নিঃসন্দেহে। মৌ দাশগুপ্তের লেখায়
রবীন্দ্রভাবনায় মহাকাব্য। রম্যরচনায় সংখ্যাটিকে সমৃদ্ধ করেছেন সৌম্য ও সঙ্গীতা।
এছাড়াও অন্যান্য বিভাগে লিখছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক বিপ্লব রহমান,
বাংলাদেশের সংকট ও সমস্যা নিয়ে। ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বলিষ্ঠ আলোচনায় রওশন আরা
বেগম। সংক্ষিপ্ত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সূত্রপাতে রয়েছেন কাকলি ভট্টাচার্য ও
শাখা নির্ভানা। এই সংখ্যার অন্যতম বিশেষ নিবেদন স্মৃতিতর্পন বিভাগে বাংলা নাটকের
চার মহীরূহ বিজন ভট্টাচার্য শম্ভু মিত্র উৎপল দত্ত ও অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে
এই সময়য়ের বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব শ্রী ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের বিস্তৃত আলোচনা। এঁদের
সকলের কাছে আমাদের একান্ত কৃতজ্ঞতা।
বাঙালির সকল কাজের কাজী আর সকল পারাপারের
কাণ্ডারী সেই মানুষটির জন্মদিন পঁচিশে বৈশাখ আমাদের জাতীয় সত্ত্বায় উদ্বোধিত হয়ে
ওঠে আমাদের প্রতিমুহূর্তের অস্তিত্বের মধ্যে দিয়েই। এমনই তাঁর অমোঘ প্রভাব। যে কোন
শুভকর্মে তাঁর ছোঁয়াটুকু আমাদের সত্যই শক্তি জোগায়। বল দেয়। উদ্বুদ্ধ করে আরও নতুন
নতুন দিগন্ত প্রসারণের। তাই সেই শুভলগ্নেই যাত্রা শুরু হলো রংরুটেরও। পথ ঠিক হোক
আর ভুল হোক, পথে নামাটাই প্রথম কথা। আর পথে চলাটাই আসল। সেই চলার মধ্যে দুঃখতাপ
প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি লাভক্ষতি যাই থাকুক আর নাই থাকুক, পথে চলার আনন্দটুকুই সবচেয়ে
বড়ো কথা। যে মানুষটি আমাদের এত বড়ো একটি সত্যের উপলব্ধিতে পৌঁছিয়ে দিয়ে গিয়েছেন,
তাঁকে স্মরণ করেই তাঁরই জন্মতিথিতে আমরাও শুরু করলাম এই পথচলা।