যমুনায় অনেক জলের ঢেউ
বয়ে যায়। লোকটির কাঁচা পাকা
দাড়িতে ঢাকা মুখের নিচের দিক। পাকার ভাগই বেশি। হাল্কা হলদে ছাপ কিছু অংশে। গোঁফের
রেখা মিলে মিশে গেছে দাড়ির সংগে। কিছু নেমে এসেছে ওপরের ঠোঁটে। এমনি গোঁফের কিছু
এলোমেলো চুল ওপরের পাতলা ঠোঁটে নেমে এলেই সোহনির হাসি পেয়ে যায়।
ইশ! কি বিচ্ছিরি রে বাবা। অস্বস্তি হয় না? আমারই
ত অস্বস্তি লাগে দেখে।
আগে দাড়িতে আরো বেশি রং ছিল ।কমলা ঘেঁষা
মেহেন্দি রং। চুলগুলো লম্বা হয়ে প্রায় কাঁধের কাছে। নিচের দিকে চুলের ডগাগুলো
কোঁকড়ানো। গোল হয়ে গুটিয়ে থাকে।
এখন চোখে সূর্মা । গায়ে
মলমলের পাতলা জামা। সাদা। কখনো হাল্কা নীল। বুকের ওপর দিয়ে কোনাকুনি এনে পাশে
রেশমের দড়ি দিয়ে বাঁধা। কোমরবন্ধ আছে। দরবারের পোষাকের মত জরি পাথর দেওয়া নয়।
হাল্কা সুতির। ঢিলেঢালা।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
হাভেলীর গল্প
সোনালি পপু
চুপটি করে শুয়েছিল সোহনি।
মন খারাপ। মন খারাপ। এদের থেকে শুনে শুনে মাথায় অনেক উর্দু শব্দ তুলে নিয়েছে। মগজে
ঘোরে মিঠে শব্দ। ইয়ে দিল কমবখত বড়ি বেআদব।
মানতাহি নহি।
কেন যে। কেনই যে।
সে লোকটা আমার কেউ না।
ভিন জাত।বদ চলন। তার তো নজর একশো হারেমের জানলায়, খিড়খিড়িতে।
থাক না।
আমার কি? আমি ত
দিব্যি খেয়েপড়ে সেজেগুজে,গান শুনে,পায়েল বাজিয়ে আছি। কে কি করছে, মুঝে ক্যা আতাযাতা। ধুত।
তবু উপুড় হয়ে পড়ে থাকে
বিছানায়। এলো চুল ছড়িয়ে থাকে চারপাশে।
যাব না অটরিয়াতে।
বিকেলে রোদ পড়ে এলেই
জেনানা মহল পাটরানীজির মহলের সামনেকার উঠোনে জড়ো হয়।পাহারাদার সিপাহীদের সংগে
সেইখানেই সবার কথাবার্তা হাসিঠাট্টা।
যত সাজগোজ, চুল
বাঁধার কায়দা, মেহেন্দির নকশা সেই খানেই ফুটে ওঠে।
নাঃ সোহনি নেই। সে
যাবেনা এর মধ্যে। নিজের বুকের মধ্যেকার ছুরি বেঁধা যন্ত্রনাকেই সহেলী বানিয়ে নিজের
ঘরটিতে চুপটি আঁধারে শুয়ে থাকবে ।থাকো তোমরা রংগিন মানুষেরা। নিজেদের রংদার
দুনিয়ায় কথার মারপ্যাঁচ,
চোখের ঝিলিক, ঠোঁটের হাসি চালাচালি সওদা
বেচাকেনা করার মজার খেলা নিয়ে থাকো।
সোহনি হাটে বিকোনোর মত
জিনিসের মালিক না।তার যা সামান, সব পুজোর কাজে লাগবে বলে সে তুলে রেখেছে।
রাজস্থান থাকতে শুনে
শুনে গান শিখেছিল। গুনগুন করে চোখ বুজে,এরি ম্য তো প্রেমদিওয়ানি মোরি
দরদ না জানে কোয়।
জয়জয়ন্তীর করুণ মোচড়
চোখের জল হয়ে ঝরে পড়ে।
হাতের পিঠ দিয়ে চোখের জল
মুছতে গিয়ে হঠাৎ বিছানার পাশে চোখ পড়ে।
কে?
কে দাঁড়িয়ে এখানে?
ভীষন চমকে গায়ের ওড়না
টেনে ধরমড় করে উঠে বসে ।থরথর করে কাঁপতে থাকে ভিতরটা।
“ তুমি?”
“এত ভয় পেলে?”
রাগ,ভিতরে
জমে থাকা কষ্ট, সব বন্যার জলের মত উপচে পড়ে।
খাড়ি হিন্দি, উর্দু্, রাজস্থানি ,কিছু গালি বাকি থাকে না। সব আছড়ে পড়তে থাকে এই হাসিমুখ লোকটির ওপর।
তার কোন দুঃখ দেখা যায়
না অবশ্য তার জন্য। সোহনি হাঁফাতে হাঁফাতে দম নেবার জন্য একটু থামতেই সে বিছানার
পাশে বসে পড়ে।
“আমি এলাম, খুসি
হওনি?”
সোহনির ভিতরে একগাদা হাসি, মেঘ
ভাংগা রোদের মত ছড়িয়ে পড়ে। কোথায় পালিয়ে যায় মন খারাপ গুলো। বুকের মাঝখানে যে
পাথরচাপা দেওয়া যন্ত্রনা,
সে কখন হাল্কা হয়ে মিলিয়ে গেলো?
বাইরে একটু ও হাসেনা
কিন্ত। উঁহু।
এতই শস্তা হাসি কেনা,মিঞাসাব?
“ এরকম মেয়েদের ঘরে হুটপাট না বলে
ঢুকে যাবার অভ্যাসটা কত দিনের?” খুব
গম্ভীর গলায় জিগেস করে।
হাত বাড়ান মিঞা।
মোটাসোটা লাল টুকটুকে হাতের পাতা সোহনির কোলের ওপর।
“দেখো, হাতে
লেখা আছে কিনা।”
ইস!
ভিতরের শিরশির করে ওঠাটা
চাপা দিতেই তাড়াতাড়ি হাতটা ধরে ফেলে সোহনি।
বাবা,কি গরম
একটা হাত !
ভিতরটা এলোমেলো হয়ে
যাবার আগে কথার ফুলঝুরি ফোটায় কন্যে।
“এসব আমায় বলে কি হবে? আমি কি
গণক ঠাকুর। কেবল বাজে কথা। এইসব বলেই লড়কি পটানোর আদত না?”
“কাকে আর পটাচ্ছি? এসে বসে আছি ত তোমার ঘরে।”
“কেনই বা?”
“তুমিই বল। এইজন্যই ত হাত দেখতে
বললাম। দিল তো আপকি নজর পে আতি নহি। ক্যা করে।”
আর হাসিকে ঠেকিয়ে রাখা
যায় না।
একগাল হেসেই সোহনি বলে,”ইস,এ ঘরে
এলে, কেউ দেখলে?”
“তো? অন্দরমহলের
সবার দেখভাল আমার দ্বায়িত্ব না? একটা বুঝদিল লড়কি,বিকেলের
ফুরফুরে হাওয়ায় দুপাট্টা না উড়িয়ে, চুড়ির ছুন ছুন না শুনিয়ে ,আঁধিয়ারা
কমরে মে কেনো পড়ে আছে কে খোঁজ রাখবে,হুঁ?”
“বুঝদিল হলাম আমি?” কিল
দেবে বলে মুঠো করে হাত তোলে সোহনি।
খপ করে হাতটা যে অন্যজন
ধরে ফেলবে বুঝতে পারেনি।
তার বুকের ওপর একটানে
এসে পড়ে, এলোমেলো চুলে ঢাকা মুখটা তুলে খালি বলে,
“দরজা খোলা।”
কাজকরা কাঠের ছোট্ট
দরজার শক্ত বাটাম বন্ধ হয়ে যায় ভিতর থেকে।
যমুনায় অনেক জলের ঢেউ
বয়ে যায়।
লোকটির কাঁচা পাকা
দাড়িতে ঢাকা মুখের নিচের দিক। পাকার ভাগই বেশি। হাল্কা হলদে ছাপ কিছু অংশে। গোঁফের
রেখা মিলে মিশে গেছে দাড়ির সংগে। কিছু নেমে এসেছে ওপরের ঠোঁটে।
এমনি গোঁফের কিছু
এলোমেলো চুল ওপরের পাতলা ঠোঁটে নেমে এলেই সোহনির হাসি পেয়ে যায়।
ইশ! কি বিচ্ছিরি রে বাবা। অস্বস্তি হয় না? আমারই
ত অস্বস্তি লাগে দেখে।
আগে দাড়িতে আরো বেশি রং ছিল ।কমলা ঘেঁষা
মেহেন্দি রং। চুলগুলো লম্বা হয়ে প্রায় কাঁধের কাছে। নিচের দিকে চুলের ডগাগুলো
কোঁকড়ানো। গোল হয়ে গুটিয়ে থাকে।
এখন চোখে সূর্মা । গায়ে
মলমলের পাতলা জামা। সাদা। কখনো হাল্কা নীল। বুকের ওপর দিয়ে কোনাকুনি এনে পাশে
রেশমের দড়ি দিয়ে বাঁধা। কোমরবন্ধ আছে। দরবারের পোষাকের মত জরি পাথর দেওয়া নয়।
হাল্কা সুতির। ঢিলেঢালা।
সেদিন উঁচু পাঁচিলের
পাশে দাঁড়িয়ে জিগেস করছিল,
"ঘর থেকে চলে গেলে যে?সবাই তো বসে গান শুনছিল।"
"তো? কাউকে
তো বিরক্ত করিনি। খুব আস্তে আস্তে পিছন দিয়ে বেরিয়ে এসেছি।"
" না,মানে,বেরিয়ে
এলে কেনো?
"
"তোমার কি? তুমি
কেন জিজ্ঞেস করতে এসেছ?
"
"আঃ", বিরক্তির
চাপা আওয়াজের সংগে ভুরু কোঁচকায় লোকটি।
"সোজা প্রশ্নের সোজা উত্তর দিতে
পারো না?"
"না। পারি না।"
নীল রেশমের ওড়নায় এবার
ঢাকা পড়ে মাথা,মুখের এক পাশ।
"আর কিছু জিজ্ঞেস করার না থাকলে, আপনি
আপনাদের গানের আসরের সুন্দরীদের কাছে ফিরে যেতে পারেন।”
ভুরু কুঁচকে তাকিয়েই থাকে অন্য জন।যেন কি বলবে
ভেবে পাচ্ছে না। তারপর হঠাৎ কি মনে করে
বলে, "সুন্দরী? ওঃ,তা এ আসরে সবারই তো চামড়ায় টান। খিটখিটে বুড়িদের সামলানো আমার কাজ না।"
এবার কুলকুল হাসি
ফোয়ারার মত বেরিয়ে আসে মেয়েটার বুকের মধ্যে থেকে। চুনচুন আওয়াজ হয় সাচ্চা চাঁদির
ঝিলিমিলি কাজ করা চুড়িতে।
ঠোঁট কামড়ে হাসতে হাসতে
ঝুঁকে পড়ে সোহনি,"
মিঁয়া সাব,ঠিক মত খিদমতগারি করে খুশি রাখতে পারলে কোন মেয়েই খিটখিট
করে না। এত বছরে এও যদি না শিখলে, তো শিখলে কি?"
হাসির দমকে লাল হয়ে যায়
মুখ।
সেই লালের আভা ছড়িয়ে পড়ে
মিঁয়া সাহেবের দাড়ির ওপরের ফাঁকা গালের চামড়ায়।
"হুঁ, বদ
বুদ্ধি বড় বেশি হয়েছে তোমার। তমিজ বলে কোন জিনিস শিখে ছিলে কখনও---"
"নাঃ",মজার
মুখভংগীর সাথে ওড়না সরে,
"আজ্ঞে না,চুল তো আমারও ওমনিই সাদা হল।"
"সে হতে এখন ও ঢের বাকি---"
পাঁচিলের ওদিক থেকে দু
তিনটি নারী কন্ঠের ডাক শোনা যায়, "আরে সোহনিজি কা গইল বা..."
"চলে যাচ্ছি। "
তাড়াতাড়ি পা চালায়
সোহনি। দুপুরের গরমের ভাপ লেগে থাকে মেঝের পাথরে সন্ধে বেলা অবধি।
যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে
আবার নিঃশব্দে হাসে।
"কি হল?"
"ইশশ,দাড়ি
না তো,যেন লোহার তার।"
হাতের এক টানে ডান কাঁধ
থেকে আঁচল সরে যায়।ধবধবে সাদা গায়ে লাল ছোপ ছোপ।
"দাড়ি কাটতে পারো না মিঁয়া সাব? নয় তো
সাঁওরিদের সংগে খাতিরদারি কর গিয়ে।তাদের চামড়ায় দাগ ফুটে উঠবে না।"
দৌড়ে চলে যাচ্ছিল লালচে
পায়ের পাতা। গরম হাত ওড়নার এক প্রান্ত ছুঁয়ে যায়।পিছনে ভারি হয়ে আসা গলা বলে," তব তো নহী বোলা কি তকলীফ হুই"।
এবার নির্মল হাসি পিছনে
ফেরে।
"তকলীফ তব নহী হুয়া,ইয়ে
বাদ মে দিখাই দি। পাগল। ছোড়ো ভি,আমি খাবার সময় আসবো। "
ছম ছম পায়েল ব্যস্ত হয়ে
এগিয়ে যায় অন্দরমহলের জাফরির দিকে।
ইতিহাসের ছাত্রী সঞ্চারী একটা মিষ্টি গন্ধ
পাচ্ছিলো।
ক্লাসের বন্ধুদের সাথে কলেজের ট্যুরে এসেছে
আগ্রা। বসে আছে পুরোনো কেল্লার চাতালে।
গন্ধটা পুরোনো মাটিতে
চাপা পড়ে থাকা জীবনের। ভুলে ভুলে ফেলে আসা বাতি দানের,যার
মধ্যে গন্ধ তেল ভরে ছিল রাতের বিছানায় নেশা ধরানোর আশায়। কুলুঙ্গিতে পড়ে আছে। কাজল
পড়ার রূপোর কাজ করা সূর্মা দান,মাটি চাপা পড়ে কালো ভুষূন্ডি। ওকে আজকের দিনের মানুষ চিনতে
পারবে না। এই বিজলি বাতির দিনে মশাল জ্বলা চোরা গলি দিয়ে ভালবাসার ঘরে পৌঁছাব কি
করে?
বুক ভাংগা দীর্ঘশ্বাস
ফেলে জীন্স আর জামায় লেগে থাকা খাবারের গুঁড়ো ঝেড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় মেয়েটা।
বাস হর্ন দিচ্ছে। যেতে
হবে.
সোনালি পপু