কোনো এক রাখীতে আমার জন্ম। ঠিক জন্ম নয়, এদের ঠাকুর্দার বাবা গৃহপ্রবেশ করে ওই দিন। তারপর থেকে
প্রতি রাখীতে আমায় সাজানো হয়, রাখীর উৎসবের সাথে
সাথে আমার জন্মদিন বা বলা যেতে পারে এদের পদার্পণ দিন পালন হয়। প্রথম দিকে
সাদামাটা করে নিজেদের মতো করে দিনটা পালন হ'ত পরে সেটা
বড়সড় উৎসবে পরিণত হয়। আজও এই পরিবারের এখনের প্রজন্ম এসেছে, পালন করেছে ঠিকই, শুধু তাল
কেটে যাচ্ছিল ওদের বুঝতে পারছিলাম। ভাবছিলাম, ওদেরকে বোঝাই, যে বয়স হলে সব্বাইকে চলে যেতে হয়, আমারও হবে। তবে মানুষের মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চলে যাবার
দিনটা আগাম জানা যায় না,
আমারটা ওরা জেনে গেছে। অবশ্য আমি বয়স হিসেব করতে পারিনা, তবে,
আমি পাঁচ প্রজন্মকে দেখলাম, তাদের কতো সুখ দুঃখের সাক্ষী রইলাম। এই যে দুইবোন এদের নাম পিতু-মুন্নি; হ্যাঁ, ভালো নামও আছে
চান্দ্রেয়ী আর গরিমা। ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
রাখী
পূর্ণিমা
মৈত্রেয়ী
চক্রবর্তী
এক চিলতে আকাশে রাখী পূর্ণিমার চাঁদটা যখন ঠিক আমার মাথার ওপর এলো, অল্প টুকুন চাঁদের আলো পেয়েই মনে হ'ল যেন কতো পেলাম। এক সময়ে তো সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ত জোৎস্না, তখন তো আর চারদিক এতো ঘিঞ্জি ছিল না। কতো দূর অবধি দেখা যেত, চারদিক খোলামেলা ছিল। তখন আমি সবার ওপরে তিনতলা নিয়ে মাথা
তুলে দাঁড়িয়ে থাকতাম। সবাই আমায় রাজবাড়ি বলত, আর গর্বে আমি
অহঙ্কারী হয়ে উঠতাম আরো।
আমার মনে হচ্ছিল, ঠিক এই সময়ে ওরা ছাদে আসবে, প্রত্যেক পূর্ণিমার মতো আজ রাতেও পাঁচিলে ভর দিয়ে চাঁদ দেখে চুপিসাড়ে নিচে চলে
যাবে। ওরা আসে তবে এক সাথে
নয়,
যেন পরস্পরের কাছে ধরা দিতে নারাজ। তবে অবাক কাণ্ড এবার
দেখি দু'জনে প্রায় একই সময়ে এল। আলসেতে ভর দিয়ে দাঁড়াল, কতোক্ষণ আমার শ্যাওলা পড়া গায়ে হাত বোলাল, টপটপিয়ে জল পড়ছে দেখে প্রথমে ভাবলাম বৃষ্টি নামল বুঝি, পরে বুঝলাম ওরা কাঁদছে। বেশ খানিকক্ষন কাঁদল, তারপর বড়জন ছোটোজনকে নিয়ে নিচে চলে গেল। ওরা দু'জন এই পরিবারের দুই মেয়ে। বড়জন বিয়ে হয়ে স্বামীর সাথে থাকতে
না পেরে ফিরে এসেছে,
ছোটোজন দিদির অবস্থা দেখে বহুদিন ঠেকিয়ে রেখে, অতি সম্প্রতি বিয়ে করেছে।
কোনো এক রাখীতে আমার জন্ম। ঠিক জন্ম নয়, এদের ঠাকুর্দার বাবা গৃহপ্রবেশ করে ওই দিন। তারপর থেকে
প্রতি রাখীতে আমায় সাজানো হয়, রাখীর উৎসবের সাথে
সাথে আমার জন্মদিন বা বলা যেতে পারে এদের পদার্পণ দিন পালন হয়। প্রথম দিকে
সাদামাটা করে নিজেদের মতো করে দিনটা পালন হ'ত পরে সেটা
বড়সড় উৎসবে পরিণত হয়। আজও এই পরিবারের এখনের প্রজন্ম এসেছে, পালন করেছে ঠিকই, শুধু তাল
কেটে যাচ্ছিল ওদের বুঝতে পারছিলাম। ভাবছিলাম, ওদেরকে বোঝাই, যে বয়স হলে সব্বাইকে চলে যেতে হয়, আমারও হবে। তবে মানুষের মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চলে যাবার
দিনটা আগাম জানা যায় না,
আমারটা ওরা জেনে গেছে। অবশ্য আমি বয়স হিসেব করতে পারিনা, তবে,
আমি পাঁচ প্রজন্মকে দেখলাম, তাদের কতো সুখ দুঃখের সাক্ষী রইলাম। এই যে দুইবোন এদের নাম পিতু-মুন্নি; হ্যাঁ, ভালো নামও আছে
চান্দ্রেয়ী আর গরিমা।
এই পিতু-মুন্নির ঠাকুর্দার বাবার নাম ছিল চক্রপাণি
বন্দোপাধ্যায়,
সে আর তার স্ত্রী শশিবালা মিলেই প্রথম আসে আমার ঘরে। কোলে
পিতু-মুন্নির ঠাকুর্দার দাদা ভূদেব। ছোট্ট
ছোট্ট হাতে পায়ে হামা দিত ওই নিচের লাল উঠোনে। পরে গাড়ি কেনাতে যেটার নাম গাড়ি
বারান্দা হ'ল। ভূদেবের পরে একজন না দু'জন বুঝি জন্মেই মারা গেছে, ক'জন এখন আর ঠিক মনে করতে পারি না। তারপর সুদেব অর্থাৎ
পিতু-মুন্নির ঠাকুর্দা। ভূদেব সুদেবের বেশ ছোটো একটা বোনও ছিল, আনন্দময়ী। কটাদিন কলকাকলি, ছাদের পাঁচিলে কাঁথা শুকোনো, তারপরেই দেখ না দেখ
ছেলেমেয়েগুলো যেন বড় হয়ে গেল সব। ছাদে, গাড়ি বারান্দায় পুতুল খেলত, এক্কা দোক্কা খেলে বেড়াত আনন্দময়ী; একদিন দুপুরে
ছাদে এসে ওই কোনাটায় যেখানে ওর পুতুলের সংসার সাজানো, সেখানে বসে কেমন আমার একটা পাঁচিলে মুখ গুঁজে কাঁদছিল আর
বিড়বিড় করছিল 'যাব না, যাব না, তোকে ছেড়ে কোত্থাও যাব না' তারপর কটাদিন দেখতে পেলাম না ওকে,
ভাবলাম শরীর খারাপ বুঝি, তারপরেই দেখি
ভিয়েন বসল,
প্যান্ডেল হ'ল, কতো লোকজন; টুক করে বিয়ে হয়ে
গেল মেয়েটার। কি ক্ষতি হ'ত আর কটাদিন ও খেলে বেড়ালে? বুঝলাম এ কটাদিন আটকে রাখা হয়েছিল কেন, আর সেদিনের
কান্নার কি মানে।
অবশ্য আনন্দময়ী চলে গেলেও আমার ঘর খালি রইল না। বছর ঘোরার
আগেই জোড়া বৌএর পা পড়ল উঠোনে। দুধে আলতায় পা ডুবিয়ে ছোট্ট ছোট্ট রাঙা পায়ের ছাপ
ফেলে ঘরে এল ভূদেব সুদেবের বৌ, সুভাষিনী আর
সুকুমারী। ওরা দুই জা হ'ল কিন্তু ওরা খুড়তুতো জ্যেঠতুতো বোন। সুভাষিনী এ পরিবারের
বড় বৌ হ'ল,
কতোই বা বয়স তখন? বারো তেরো
বছর হবে,
সে অত টুকুন বয়সেও পাকা গিন্নী। মাথার কাপড় কখনও সরে যেত না, বরং একগলা ঘোমটার আড়ালে অমন প্রতিমার মতো মুখটা প্রায় দেখাই
যেত না। আর দিনভর কতো কাজই যে করত, সেই কোন
সকালে উঠে উনোন ধরিয়ে রান্না করত, বাসন মাজত, কাপড় কাচত, আবার শীতের দিনে বড়ি
দিত,
আচার বানাতো। তার সুভাষিনী নাম সার্থক করে ছিল, যেমন মিষ্টি গলার আওয়াজ ছিল তেমনই সুন্দর করে কথা বলত, খুব অবশ্য কথা বলতে শুনিনি তাকে। বাড়ির কারোর তাকে নিয়ে
কোনো অভিযোগ ছিল বলে তো মনেহয় না। তবে সুকুমারী আরোও ছোটো, বলতে গেলে দুধের শিশু, সে সবটা
পুষিয়ে দিত। শাড়ি পরলেও ঘোমটা রাখত না, সিঁড়ি দিয়ে
তুরতুর করে মাঝে মাঝেই ছাদে পৌঁছত, কাজকর্ম তো
পারতও না,
করতও না। ছাদের কোনায় আনন্দময়ীর ফেলে যাওয়া পুতুলের সংসার
খুঁজে পেয়ে সেই নিয়ে মত্ত থাকত। বাড়ির মানুষদের তাকে নিয়ে কতো অভিযোগ, অনুযোগ। বেশিরভাগ সময় দিদি সুভাষিনী তাকে সামলাত আবার তার
হয়ে গঞ্জণাও সহ্য করত। কতো বোঝাত বিকেলে যখন ঘরে বসে চুল বাঁধত বোনটার, কেমন করে কাজ কর্ম করতে হয়, স্বামীর সেবা করতে হয়। সুদেবের বয়স কম হলে কি, সে বড্ড কড়া ধাঁচের মানুষ ছিল। তার পরিপাটি কাপড়জামা চাই কালেজ যাবার কালে।
রান্না সুস্বাদু শুধু নয় রীতিমতো পঞ্চব্যঞ্জণ লাগত তার। রাতে ঘুমের সময়ে বউ পদসেবা
করবে,
বাতাস করবে তবে না? কাজেই এমন
দুরন্ত অবাধ্য বৌ নিয়ে সে বেজায় অসুখী ছিল। একদিন তো ছাদের দরজা বন্ধ করে দুপুর
রোদে বন্দী করে শিক্ষা দেবার চেষ্টা করেছিল সুকুমারীকে। মেয়েটা ক্ষিধেয় তেষ্টায়
গরমে অজ্ঞান হয়ে অসুস্থ হয়ে সে যা তা কাণ্ড। তাতেও না শোধরাল সুদেব না সুকুমারী, সুস্থ হতেই আবার শুরু বাচ্চা মেয়েটার দৌরাত্ম্য, আর সুদেবের শাষন।
চোখের সামনে বড় হ'ল সুকুমারী, একদিন ওর প্রিয় ছাদের কোনায় লুকিয়ে বসে কি কান্না, শাড়ি কাপড় ভিজে ছাদ ভেসে যেতে থাকল রক্তে। খুব খারাপ লাগছিল
মেয়েটাকে সাহায্য করতে না পেরে। পঞ্চার মা তাকে খুঁজতে এসে দেখে এই অবস্থা। আবার
সেই বিপদউদ্ধারকারীনি বড়দিদির ডাক পড়ল, এমন করে
বোনকে শান্ত করে নিয়ে গেল নিচে যেন সে কতো অভিজ্ঞ একজন মানুষ। সবখানে সেদিন শুধু
গুজগুজ ফুসফুস ছোটোবৌ এর কাণ্ড আর সে বড় হয়েছে এই খবরে।
দুই বউ ঘরে আসার পর পরিবারের গিন্নীর মানসিকে শুরু হয়
দুর্গাপুজো। তার কাজ কি আর কম? সেখানেও বড় বৌমাই
নিঃশব্দে সব করে। বাড়ির মেয়ে বৌ রা অবশ্য পুজোর কাজ করত ভেতরে বসে, সেসব সামনে নিয়ে যেত ঝি চাকরেরা। সব সেরে মায়ের আরতি দেখত
দোতলার বারান্দার ঝিকের আড়াল দিয়ে, সেই
বারান্দারই আরেক প্রান্তে পুজো হ'ত। প্রায় প্রতিদিনই
সুদেবের নালিশ থাকত সুকুমারীর মুখ দেখতে পেয়েছে লোকজন। তাদেরও বলিহারি বাপু, ছোট্ট একটা মেয়ে, তায় ঝিকের
আড়ালে দাঁড়ানো সে ঘোমটায় মুখ ঢেকেছে কিনা সেটা উঁকি দিয়ে দিয়ে দেখা চাই, সুদেবের কানে তোলা চাই। তবে একটা দুর্ঘটনাই আমূল পাল্টে দিল
সুকুমারীকে।
সেদিন সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার। পরপর ক'দিন ক্রমাগত বৃষ্টির ফলে কেমন প্যাচপ্যাচে মন খারাপ করা
আবহাওয়া। সকলেই আশা করেছিল রোদ উঠবে বুঝি, তার বদলে
দিনটা কেমন করে শুরু হ'ল। ছুটির দিন তায় অমন মেঘলা বলে, সবাই ই একটু বেলা অবধি ঘুমাচ্ছিল। সুকুমারীর "ও দিদন, দিদন রেএএএ, আমি তোর সব
কথা শুনব,
তুই আমায় ফেলে যাস নাআআ" বুকফাটা কান্নায় ঘুম ভেঙে যে
যেখানে ছিল দৌড়ে এল। রোজকার মতো সকালে উঠে নিত্যকর্মে লেগেছিল সুভাষিনী, শুধু আগের রাত্রে মরচে পড়া লোহায় কেটে যাওয়া হাত কে আমল
দেয়নি সে,
কাউকে জানতে দেওয়া তো দূর, তাছাড়া সে বলবেই বা কাকে? সে যতো রাত্রে ঘুমোতে
যেত তখন তো পুরো পৃথিবী ঘুমের রাজ্যে। ধনুষ্টঙ্কারে বেঘোরে প্রাণ হারাল সোনার
পুতুলটা। মৃত্যুর কারণ প্রথমটা ধরতে না পারলেও পরে আবিষ্কৃত হয়। একমাথা সিঁদুরে
দুপায়ে আলতা মেখে লাল চেলিতে সেজে ঠিক যেমন করে এসেছিল তেমন করেই চলে গেল সবার
থেকে দূরে,
যাবার সময়ে তখন ধরা পরে, সে নাকি
অন্তঃসত্বা ছিল। ভূদেব এমনিতেই শান্ত ভোলেভালা প্রকৃতির, পড়াশোনাতেও তেমন মাথা ছিল না, বিষয় আশয়ের প্রতি লোভ নেই, কাপড়জামার পরিপাট্য
নেই,
খাবার সময়ে একটু ডাল ভাত হলেই তার হয়ে যেত, স্ত্রী মারা যাবার পর সে যেন আরোও নির্বিরোধী হয়ে গেল। ওদের
মা বাবা শশিবালা চক্রপাণি তখনও জীবিত, তাদের সামনে
দিয়েই একদিন সন্ন্যাসী হয়ে চলে গেল ভূদেব আর ফিরল না। শশিবালা পরের পর এমন সব
মানসিক ধাক্কায় শয্যা নিলেন। এই সময়ে অদ্ভুতভাবে পরিবর্তিত সুকুমারী কে পেল গোটা
সংসার। দিদির শিক্ষা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে শুরু করল সে। সুভাষিনীর শূন্যস্থান
এমন ভাবে ভরে দিল যে সবাই অবাক নতুন রূপের সুকুমারীকে দেখে। শশিবালার ইচ্ছা
অনুযায়ী চক্রপাণি তাকে নিয়ে কাশি বাসী হল। সেখানে শশিবালার মৃত্যুর পর চক্রপাণিও
শেষ জীবনটা কাশিতেই কাটিয়ে দিল। ওদের আর কোনোদিন না দেখলেও মৃত্যুসংবাদের তার গুলো
ঠিক এসে গেছিল,
চক্রপাণি কাশীবাসি হতেই সংসারের কর্তা হ'ল সুদেব।
চক্রপাণি যখন আমার ঘরে আসে, তখন ইংরেজ আমল হলেও তেমন অভাব অনটন বা ঝামেলা ঝঞ্ঝাট ছিল না। কিন্তু ক্রমে
ক্রমে দেখলাম সময় বদলাল,
কতো দাঙ্গা হাঙ্গামা সব শেষ করে স্বাধীন হ'ল দেশ। তাতেও কি শান্তি এলো নাকি? সেই কিছু না কিছু লেগেই থাকত। কতো রকমের মানুষ তাদের কতো
রকমের প্রত্যাশা,
দাবি নিয়ে আন্দোলন, কতো মানুষ
গৃহহীন,
খাবার নেই। এতো ঘর থাকতেও আমি তো কাউকেই আশ্রয় দিতে পারিনি।
দিন বদলায় ঘরে ঘরে কতো নতুন প্রযুক্তি, খবরের কাগজ থেকে রেডিও। সুশীল আর অর্ঘ্য দুই ছেলের মা হ'ল সুকুমারী। সুদেব যথেষ্ট উপার্জন করে বেশ সমাজের কেউ কেটা
ধরনের হয়ে চলাফেরা করত,
মোটর গাড়ি কিনেছিল তখনকার দিনে, সে ও আবার ড্রাইভার কোচোয়ান সহ। পরে তো টেলিফোনও লাগল বসবার
ঘরে। সেটা যতোটা না কাজে লাগত, তার চেয়ে লোক দেখাতে
লাগত বেশি। দুর্গোৎসব,
পদার্পণ উৎসব তার আমলে আরোও জাঁক জমকে হতে শুরু করে। আগে
যেখানে পোটোপাড়া থেকে মায়ের একচালা মুর্তি ডুলি করে নিয়ে এসে দোতলার বারান্দায়
বসানো হ'ত,
সুদেব প্রচলন করল ওই দোতলার বারান্দায় বসেই মুর্তি গড়ে পুজো
করা। সুতরাং রথের দিন থেকে মোচ্ছব শুরু।
পদার্পণ তো রাখীর দিনে সেটা একান্তই এই পরিবারের নিজস্ব উৎসব, সমাজে নাম কিনতে হলে সেটাকে জাঁকিয়ে বেশ কটাদিন ধরে না করতে
পারলে হয়?
কাজেই আগে যেটা একদিনের উৎসব ছিল সুদেবের পৃষ্ঠপোষকতায় সেটা
সাতদিন ধরে শুরু হ'ল। বড় করে ঝুলন সাজিয়ে শেষ হ'ত পদার্পণ উৎসবে রাখী পরিয়ে। আর এই কটাদিন ওই অতোবড় খাবার দালান সারাদিন ভরে
থাকত লোকে। রান্নাঘরের বিশাল বিশাল উনোনগুলো জ্বলতেই থাকত দিনরাত। কীর্তনিয়ারা আসত, এমনিতেই রসিক সুদেবের আবার ছুটিরদিনে বেশ বন্ধু তাঁবেদার
সহযোগে আসর বসানোর অভ্যেসও তৈরী হয়েছিল, সেখানে
গানবাজনা হ'ত কাজেই উৎসবে বাদ যাবে কেন? তার হাবভাব জমিদার মার্কা ছিল, ফলে
সুকুমারীর ওপর বেশ অত্যাচার চলত। সে যে ঠিক কি করে পয়সা রোজগার করত সেটা আমার কাছে
স্পষ্ট নয়। লোকের কানাঘুষোতে যা শুনেছি সুদেব সুদের কারবরি আবার কেউ বলত ব্যবসা
করে কিছুর। বলেনা 'দেওয়ালেরও কান আছে' তাইতে আমার
ঘরে ঘরে বিভিন্ন মানুষের মুখে শুনে এটুকু বুঝেছিলাম সুদেব বেশ বাঁকা পথেই টাকা
রোজগার করে এবং রোজগার বলে রোজগার? পরের তিন
পুরুষ বসে খেতে পারে এমন পরিমান রোজগার করেছে সে। এহেন টাকার কুমির সুদেবের উৎসব, তার আয়োজিত আসর, সে সব কি যে
সে রকম হতে পারে?
তাই আসরের দিনে বৈঠক খানায় ব্যবস্থাপত্রে এতোটুকু অবহেলা না
হয় সে দায়িত্ব ছিল সুকুমারীর। সে বেচারা সামনে এসে দেখতে তো পারত না কিন্তু কোথায়
কোনটা রাখা,
কোথায় কোনটা পাতা, চাদর কাচা
ধোওয়া কিনা,
পাতার সময়ে ভাঁজ পড়েনি তো সবই দরজার আড়াল থেকে চাকরদের
জিজ্ঞেস করে করে ঠিক রাখত। আর উৎসবে তো সুকুমারীর নাওয়া খাওয়া ঘুম বিশ্রাম সব
ভণ্ডুল। হ্যাঁ,
তবে সুকুমারী অন্য কিছুতে বাধা না দিতে পারলেও সুদেবের পায়ে
ধরে অনুরোধ করায় বৈঠকখানার আসরে বাঈ নাচেনি কোনোদিন।
দুই ছেলে একটু বড়
হবার পর অবশ্য সুকুমারীর অবস্থা ফিরল কিছুটা। চাকর বাকর, রান্নার ঠাকুর, বাসন মাজার
ঝি,
সাঁঝো ধোপা ছাড়াও আর্থি প্রার্থী ভর্তি বাড়ি কাজেই নানান
রকম কাজের সাহায্যকারি জুটল তার, তখন অবসর সময় কাটাত
উলবুনে বা সেলাই করে। ইতোমধ্যে চারিদিকে কতো নতুন বাড়ি গজাল, তারা পুরোনো হ'ল, শান্ত এলাকাটা কেমন জমজমাট হ'ল। কতো দোকান পাট নিত্য নতুন মানুষজন। তাতে প্রথমদিকে ভালো লাগলেও এখন বড্ড
হাঁপ ধরে যায়। তপতী বলে যে পাশের বাড়ির শ্যামলা মতো মিষ্টি মেয়েটা প্রায়শই আসত
সুকুমারীর কাছে "কাকিমা কাকিমা" করে। ভারি ভালো লাগত ও এলে। কেমন মনে হত
মেয়েটা পা ফেলে এতো সন্তর্পনে যেন ব্যথা না লাগে আমার। সেলাই শিখত, লিখতে পড়তে না জানা সুকুমারীকে বই,খবরের কাগজ পড়ে শোনাত। আবার কখনও সুশীলের কাছে পড়া বুঝতেও
আসত। সেবার দোলের সন্ধ্যায় যখন সারা শরীরে মোলায়েম চাঁদের আলো মেখে আমি সদ্যস্নাত'র মতো স্নিগ্ধতা উপভোগ করছিলাম, সেই সময়ে সুশীল প্রথমবার ছাদের কোনায় বসে সিগারেট ফুঁকছিল, আর কেমন অশান্ত ভাবে পায়চারি করছিল; একটু পরেই বুঝলাম অস্থিরতার কারণ। তপতী এলো ছাদে, পাঁচিলে ভর দিয়ে দাঁড়ানো সুশীলের পাশে এসে দাঁড়িয়ে আস্তে
করে জিজ্ঞেস করে
"আমায় ডেকেছিলে কেন সুশীলদা?" তার আসার খবর দেখি আমি টের পেলেও সুশীল পায়নি। একটু চমকে
"হ্যাঁ, শোন___"
"ঈস্ কি বাজে গন্ধ, তুমি সিগারেট
খাচ্ছিলে?
ছিঃ!! দাঁড়াও আমি কাকিমা কে বলে দেব" বলে চলে যেতে
গেছে,
পাঁচিলে তপতীর দু'পাশে হাত
রেখে আটকালো সুশীল,
"বাজে গন্ধ না? তবে সেদিন যে
বলছিলি শ্যামলদা'র ঘরে কেমন মিষ্টি মিষ্টি সিগারেটের গন্ধ?"
"ও মা!! কি হিংসুক, দাদা বলে সেই
কোন বিলিতি ব্র্যান্ডের সিগারেট খায়"
"তুই সকালে এলি না যে বড়?"
"কি করে আসব বলো? তোমাদের
বাড়ির দোল উৎসবে কী কী হয় সে কি আর কারো অজানা? অত গান বাজনা
মদ্যপান চলে,
সাথে কি কিছুটা বেলেল্লাপনা করে না সাধারণ লোকে? আর কাকাবাবু আমার আসাটা পছন্দ করেন না আমি জানি"
"তাহলে আর কি? এখনই বা এলি
কেন?"
"এখন তো বাড়ি ফাঁকা, কাকাবাবু
সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে তো অন্যবাড়ি উৎসব মানাচ্ছেন। আর না এলে তোমায় একটুও রঙ দিতে
পারতাম না যে" বলে শাড়ির আঁচলের আড়াল থেকে ছোট্ট একটা ফাগের ঠোঙা বের করে
সুশীলের পায়ে রঙ দিয়ে প্রণাম করল। ওযে ফাগ নিয়ে এসেছে সেতো আমি বা সুশীল কেউই
লক্ষ্য করিনি। ওর দু'গালে রঙ দিয়ে
"আমায় বিয়ে করবি তপু?" মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল সুশীল।
"তুমি না একটা যাচ্ছেতাই" বলে সুশীলকে দুই হাতে সরিয়ে
দৌড় দিল নিচের পানে। ফাগের ঠোঙার ফাগ অনেকটা ঢেলে গেল সুশীলের গায়ের সাদা
পাঞ্জাবীতে কতক উড়ল খুশির হাওয়ায়। এই প্রথম, সিঁড়িতে ওর
চঞ্চল পায়ের ছোঁওয়া ;
ও যে পায়ে নূপুর পরে এতোদিন টেরই পাইনি, নূপুর ঝুনঝুনিয়ে দৌড়ে গেল সুকুমারীর ঘরে। গিয়েই পিছন থেকে
গলা জড়িয়ে "কাকিমা" করে দাঁড়ায়। নিজের উপচে পড়া আনন্দ যেন ভাগ করে নিতে
চায় সুকুমারীর সাথে।
"কিরে পাগলি, হ'ল কি?" বলতে বলতে সুশীল
হাজির ওই ঘরে।
"বড় খোকা কিছু বলবি? ওকি রে এবেলা
গায়ে এতোগুলো ফাগ এলো কোত্থেকে?" সুশীলকে দেখেই
সুকুমারীর গলা ছেড়ে মুখরাঙা করে সুকুমারীর পিছে লুকিয়েছিল তপতী, এখন সুকুমারীর প্রশ্নে সুশীলকে ইশারায় কিছু না বলতে অনুরোধ
করতে লাগল। সুশীল দুষ্টু চোখে ওর দিকে তাকিয়ে, হাসতে হাসতে
বলল
"ওই ছাদে গেছিলাম মা, বোধহয় কেউ
দুষ্টুমি করে ফাগের ঠোঙা রেখে দিয়েছিল পাঁচিলে" সুকুমারী পুরোটাই লক্ষ্য
করেছে শুধু কিছুই না বোঝার ভান করে রইল। সুযোগে তপতীও নিজের বাড়ি অভিমুখে রওনা দিল
"এখন আসি গো কাকিমা" বলে। তপতীকে নিঃশব্দে সিঁড়ি অবধি
এগিয়ে দেয় সুশীল,
সিঁড়ির সামনে এসে এদিক ওদিক দেখে, যতোটা সম্ভব নিচু স্বরে "আমার প্রশ্নটার উত্তর কিন্তু
পাইনি" বলল সুশীল। তপতী আরোও একবার লজ্জায় লাল হয়ে একটা মুখ ভেংচি দিয়ে
"কিচ্ছু বোঝে না" বলে সিঁড়ি দিয়ে হুড়মুড়িয়ে নামতে লেগেছে, সিঁড়ির বাঁকে আরেকটু হলেই ধাক্কা লাগছিল অর্ঘ্যর সাথে। তপতী
নিজেকে সংযত করে ধীর পায়ে চলে গেলেও, সিঁড়ির মাথায়
দাঁড়ানো সুশীল আর সিঁড়ি বেয়ে তপতীর অমন দৌড়ে পালানো দেখে অর্ঘ্য দুইয়ে দুইয়ে চার
করে ফেলে দু'জনের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিল
"বাবাহ্!! এযে দেখি দোলের রাতে রাধা কেষ্টর লীলে, বেমালুম জনসমক্ষে?" অর্ঘ্য তার বাবার ছায়া বললেও কম বলা হয়, একেবারে
সুদেবের মতোই। সুতরাং সুদেব যাদের পছন্দ করে অর্ঘ্যও করে, যাদের সুদেবের না-পসন্দ্ অর্ঘ্যরও অপছন্দ তাদের; অর্ঘ্য হয়ত সুদেবের থেকেও কুটিল। সুদেব যা করেছে নিজের
চেষ্টায়,
নিজের বুদ্ধিতে অর্জন করেছে। কিন্তু অর্ঘ্য সব সময়ে তার বাবার নেক নজরে থেকে
মোটামুটি তাঁবেদারি করে সব পেতে চায়। সম্পত্তির প্রতি প্রবল লোভ। সে ভালই জানত
সুদেব মরে গেলেও এই সম্পর্ক মেনে নেবে না, কাজেই সুশীল
তপতী কাহিনী সুদেবের কাছে অর্ঘ্যই পৌঁছে দিল। সুশীল তপতীর কথাবার্তা আমার যতোই
পছন্দ হোক,
বাধ সাধল পরিবারের কর্তা।
সেই দোলের দিনেরই
দুপুরে সবার খাওয়া দাওয়া মিটবার ঠিক পরে পরেই গাড়ি বারান্দায় "মা গো, সন্ন্যাসীকে ভিক্ষা দে মা" ডাক দিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল
জটাজুট ধারি,
গৈরিকবসন পরিহিত এক বৃদ্ধ। পায়ের স্পর্শ গাড়ি বারান্দায়
পড়তেই আমি চিনলাম বহু কালের পুরোনো পরিচিত ছোঁওয়াকে, সে যে আবার কোনোদিন ফিরতে পারে ভাবিনি। তখন কর্তা অর্থাৎ সুদেব পান চিবোতে
চিবোতে,
বৌএর পদসেবা নিতে নিতে সুখের দিবানিদ্রায় মগ্ন। বিকেলে আবার
কার বাড়ি আসর,
সেখানে যাওয়ার আছে। সন্ন্যাসীর ডাকে দেখি সুকুমারীও কেঁপে
উঠল। বাড়ির পুরোনো ঝি কে ডেকে সন্ন্যাসীকে খাবার দালানের পাশের ঘরে বসাতে বলল।
ততোদিনে সব ঘরে ঘরে বিজলিবাতি, পাখা লেগেছে। ঝি
পাখা টাখা চালিয়ে দিয়ে সন্ন্যাসীকে বসতে দিয়ে চলে গেল। একটু পর সুকুমারী পাথরের
গেলাসে মিছরির সরবৎ পাথরের থালায় কিছু ফল মিষ্টি নিয়ে হাজির। আস্তে করে ভূদেবের সামনে
সব সাজিয়ে,
সেই খানেই মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে
"বট্ঠাকুর, আপাততঃ এটুকু খান, রাতে আপনার জন্য আমি রেঁধে দেব, পরিষ্কারে, কেমন?" প্রায় ফিসফিস করে এক গলা ঘোমটার আড়াল থেকে বলল কথাগুলো। সে
একে তো এই প্রথম বোধহয় কথা কইল ভূদেবের সাথে, তার সেই
ছোট্ট বয়সে কী করেছে মনেও নেই এখন। আর সুকুমারী নিশ্চয় জানত, ভূদেব ফিরেছে একথা সুদেব শুনলে কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে
তার। তাই কাক পক্ষীকেও টের পেতে দিতে চায় না, সন্ন্যাসীর
পরিচয়। কিন্তু সুকুমারী যতোই গোপন রাখার চেষ্টা করুক না, দুনিয়া বড় বিচিত্র জায়গা। সুকুমারী স্বয়ং সন্ন্যাসীকে খাবার
দিতে গেছে,
এই ঘটনাতেই কিছু মানুষ 'ডাল মেঁ কুছ
কালা হ্যায়'
ধরেছে। তার ওপর এই পরিবারের বড় ছেলের সন্ন্যাসী হয়ে চলে
যাবার খবরটা তো কারো অজানা নয়। এছাড়াও শৌখিন সুদেব নিজেকে রাজা রাজড়ার মতো প্রমান
করতে বাড়ির পুরুষ মানুষদের বড় বড় তৈলচিত্র বৈঠকখানায় টাঙিয়ে ছিল। তাদের বিয়ের সময়ে
বুঝি ফটোগ্রাফার এনে সবার ফটো তুলিয়ে ছিল, সেই ফটো
দেখেই আঁকানো। এবার ওই ছবির ভূদেবের সাথে যদিও এই সন্ন্যাসী ঠাকুরের চেহারার প্রায়
কোনো মিল নেই,
তবু,
মানুষে ঠিক কেমন মিল খুঁজে পায়। আর তাতেই বাতাসে ছড়িয়ে গেল
ভূদেব ফিরেছে। কথাটা অবশ্য একেবারে মিথ্যাই বা বলি কিকরে?
ঘুম ভেঙে উঠে সুকুমারীকে দেখতে না পেয়ে হাঁক দিতেই, এক ঝি এসে টুক করে খবর দিয়ে গেল ভূদেব ফিরেছে আর গিন্নী মা
স্বয়ং তাঁর আতিথেয়তায় লেগেছেন। ব্যস এটুকুই আগুন জ্বালানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। যদিও
সুদেব খুব কূটবুদ্ধি সম্পন্ন, কোন কথা ঠিক কোন
সময়ে বলতে পারলে তার ওজন ঠিক থাকে সে বিষয়ে সচেতন। কাজেই ধুম করে কিছু বলে বসে না, চট করে মাথাও গরম করে না। সুকুমারী এসে সুদেব জেগে গেছে
দেখে স্তস্ত্র হাতে তার গিলাকরা পাঞ্জাবী, চুনোট করা
ধুতি,
চাদর, পানের ডিবে, আতরের শিশি সব এগিয়ে দেয়। যদিও হাতের সামনে সবই গোছানই ছিল।
কিন্তু সুদেব,
বাবা অমন একটা পুরুষ মানুষ, সে কিনা নিজের হাতে সব নিয়ে নেবে? তৈরী হয়ে বের
হবার সময়ে গম্ভীর আওয়াজে সুকুমারীকে নির্দেশ দিল
"সন্ন্যাসী ঠাকুর যেখান থেকে এসেছেন ওনাকে আবার সেখানেই চলে
যেতে দেখতে চাই। এ বাড়িতে কিন্তু ঠাঁই নেই। টাকা পয়সা কিছু লাগলে ছোটো খোকার থেকে
নিয়ে দিয়ে দিও,
ছোটো খোকাকে বোলো আমার নির্দেশ। সন্ন্যাসীদের পূর্বাশ্রমের
কথা মনে রাখতে হয় না,
কাজেই উনি এখন আর যেন এই বাড়ির সাথে আত্মীয়তা জুড়বার চেষ্টা
না করেন,
কথাটা তোমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য" কথাটা বলে সুদেব চলে
গেলেও সুকুমারী কিন্তু সন্ন্যাসীকে খাতিরযত্ন করতেই থাকল, এমনকি তপতী এলে পরে তাকেও নিয়ে গেল আশির্বাদ পাওয়ানোর জন্য, সুশীলকেও।
"বট্ঠাকুর, আপনার ভাইয়ের বড়
ছেলে"
"শোনো মা, আমি সন্ন্যাসী মানুষ, পূর্বাশ্রমের কথা আমার মনে রাখতে নেই। তুমি আমায় অমন করে
সম্বোধন কোরো না। তোমার সন্তানদের কল্যাণ হোক, কিন্তু তাদের
সাথে আমার সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে তাদের জন্মের পূর্বেই। সুতরাং তুমি আমার আত্মীয় বলে
পরিচয় দিও না। এতে সংসারে অশান্তি আসতে পারে"
"তবে যে আপনি ফিরে এলেন?"
"হ্যাঁ, এলাম। কারণ, আমার মহাপ্রস্থানের সময় এগিয়ে আসছে। মনের মধ্যে কোনো
আকাঙ্ক্ষা ফেলে রাখতে নেই,
তাহলে পুনর্জন্ম নিয়ে ফিরে আসতে হবে, মুক্তি লাভ হবে না। তোমাদের ভরা সংসার, আমার শৈশবের, যৌবনের
স্মৃতি বিজড়িত এই ভবনকে একবার দেখার সাধ জেগেছিল। সেই সাধটুকু পূর্ণ করতেই আসা; ও কি বৌমা, তুমি কাঁদ কেন? সবাইকেই তো যেতে হয় বল? তোমার দিদির
চলে যাওয়াটা আমি আজও ভুলতে পারিনি"
"আপনি তাহলে বাকি দিন কটা এখানেই থাকুন, এখানে কোনো কিছুর তো অভাব নেই। না ঘরের, না টাকাপয়সার, না
খাওয়াদাওয়ার"
"তুমি তো জান মা, এসবের প্রতি
গৃহী অবস্থাতেও আমার আকর্ষণ ছিল না, সন্ন্যাসীর
কিসে লাগবে এসব?
আমি যদি কিছু মাত্র পূণ্যার্জন করে থাকি, তার জোরে আশির্বাদ করি স্বামী সন্তান নিয়ে তুমি সুখে থেকো।
তবে তোমার জ্যেষ্ঠকে দেখলাম কনিষ্ঠটি কই?"
"সে তার বাপের অনুগামী, কোথায় যায়
কীইবা করে,
মেয়ে মানুষকে জানাবার প্রয়োজন বোধ করে না, আমি ওর গর্ভধারিনী হলেও মেয়ে মানুষ বৈ তো নই"
"দুঃখ করে না মা, হাতের সব
আঙ্গুল কি সমান হয়?
তোমার স্বামী আর আমি সহোদর হয়েও কতো তফাৎ। জ্যেষ্ঠ আর ওই
মেয়েটির বুঝি বিবাহ দেবার ইচ্ছা তোমার? মেয়েটি
সুলক্ষণা,
তোমার পুত্র সুখীই হবে। আচ্ছা, তুমি কি জানো আমাদের সহোদরা আনন্দময়ীর খবর?" নিঃশব্দে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে সুকুমারী। তারপর ধীরে ধীরে
বলে "তিনি বহু বছর হয় স্বর্গে গেছেন, একটি পুত্র
রেখে। তবে ঠাকুরজামাই শুনেছি আবার বিয়ে করেছেন, এর বেশি খবর
জানি না,
বড় একটা আসেন না। আপনার ভাই বোধহয় নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, তবে সে খবর আমার কাছে আসে না"
"সন্ধে নামছে,এবার আমায়
বিদায় দিয়ে তুমি তোমার ঘরে যাও। কাজের মানুষদের কৌতুহলী দৃষ্টি তোমার ক্ষতি করতে
পারে"
"আপনাকে কী দেব সঙ্গে? পাথেয়?"
"হাসালে তুমি বৌমা, কিসের পাথেয়? আমি যেমন এসেছি তেমনই চলে যাব। শুধু এটুকু বলতে পারি আমার
আসা সফল। কানায় কানায় পরিপূর্ণ আমি। তোমাদের মঙ্গল হোক, চলি"
"আসি বলে যান"
"বেশ আসি, তবে তোমায় কষ্ট দিতে
পারব না তাই বললাম,
নইলে সত্যিই আমি আর আসব না। এ জন্মে তো নয়ই, যদি মুক্তি পাই তবে তো পরজন্মটাই হবে না, কাজেই___ কল্যাণমস্তুঃ"
যেই সময়ে সুকুমারী ভূদেবের সাথে কথা বলছিল সেই সময়েই ছাদে
সুশীল আর তপতীর কথা হচ্ছিল। অর্ঘ্য বাড়ি এসেই খাস চাকরের থেকে খবর পেল সন্ন্যাসী
ঠাকুরের,
তপতী-সুশীলের ছাদে একান্তে দেখা করার খবরটাও; সুশীলদেরকে সচক্ষে
দেখলই সে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে পরিষ্কার কাপড় জামায় সেজে চলে গেল সুদেব যে বাড়ি গেছে
সেখানে।
রাত্রে ঘরে ফিরে সুদেবের জেরা শুরু
"ছোটো বৌ, তোমার ওই সন্ন্যাসী
ঠাকুর বিদেয় হয়েছেন?"
মাথা নিচু করে হ্যাঁ বলে সুকুমারী।
"কি নিলেন তিনি?"
"কিচ্ছু না"
"তবে?
এলেনই বা কেন?"
"ওঁর মহাপ্রস্থানের সময় হয়ে এসেছে, বললেন এ বাড়ি একটিবার দেখার ইচ্ছে জেগেছিল মনে, আকাঙ্ক্ষা অবশিষ্ট রাখতে নেই নাকি তাই এসেছিলেন" এমন
অপ্রত্যাশিত উত্তরে কিছু সময় চুপ মেরে গেল সুদেব।
"শোনো, তোমার বড় ছেলের জন্য
একটি মেয়ে দেখেছি,
ধবধবে রং, কুঞ্জবালা নাম, এগার বছর মতো বয়স, ঘর
গেরস্থালির সব পারে,
শুধু ঋতুমতী হয়েছে বলে মেয়েটির বাপ অনেক দেবে থোবে। আগামী
মাসের বারো তারিখ বিয়ে। পাকাকথা দিয়ে এসেছি আমি। তোমার পুত্তুরকে জানিয়ে দিও"
"সে কি? আপনি পাকা কথা দিয়ে
এলেন?
অতোটুকুন মেয়ের সাথে বড় খোকার বিয়ে? সে মেয়ে তো লেখাপড়া কিছু জানে না"
"হ্যাঁ,পাকা কথা দিয়ে এসেছি, তো?
আজকাল তোমার অনুমতি নিয়ে তবে কাজ করতে হবে নাকি আমায়?"
"তা'নয়,
তবে কিনা বড় খোকা বড় হয়েছে, কালেজ পাশ দিয়েছে,
তার একটা মতামত,পছন্দ অপছন্দ
তো আছে। এখন কি আর আপনাদের দিনকাল আছে?"
"অ। তোমার তো দেখছি অনেক বুদ্ধি!! তোমার রুচি জানতে বুঝতে কী
বাকি আছে,
ভেবেছ? ওই কায়েত বাড়ির
কালেজে পড়া কালো আধবুড়ি মেয়েটা তো? কি নামের
ছিরি..যত্তসব আধুনিক মেলেচ্ছপনা। এতো বয়স হ'ল বাপ মা
বিয়ে না দিয়ে তাকে লেখাপড়া শেখায় আর আমার ছেলের দিকে লেলিয়ে দেয়। শোনো ছোটোবৌ, ওইসব বেম্মোগিরি আমার বাড়ি আমি জীবিত থাকতে হবে না, স্পষ্ট বলে রাখছি"
কথাটা সুশীলের কানে পৌঁছতে দেরি হয়নি, আমি তো ভেবেছিলাম সুশীল যেমন শান্ত, নির্বিরোধী, কতকটা ওর
জ্যেঠামশায়ের স্বভাবের,
সে হয়ত চুপচাপ কর্তার নির্দেশ মেনে নিয়ে কুঞ্জবালার স্বামী
হয়ে কাটিয়ে দেবে জীবন অথবা সে ও সন্ন্যাসী হয়ে চলে যাবে। কিন্তু কার ভেতরের আগুন
কি সে জ্বলে ওঠে সে কে জানে? এই ঘটনার মানে দোলের
দিনের কয়েকদিন পর একরাত্রে আমি টের পেলাম সুশীল তার বড় ট্রাঙ্কটায় তার প্রয়োজনীয়
জিনিস পত্র ভরে নিচ্ছে। দৃশ্যটায় একটু খটকা লেগেছিল বৈকি। তবে পুরোটা পরিষ্কার হ'ল পরদিন সকালেই। সকালে যখন সুদেব তার শোবার ঘরের দরজার দিকে
পিঠ ফিরে,
শ্বেতপাথরেরে টেবিলে বসে রেডিওতে খবর শুনতে শুনতে আরাম করে
চায়ে চুমুক দিচ্ছে সেই সময় সুশীল এসে দাঁড়াল তার ট্রাঙ্ক নিয়ে।
"বাবা, আপনি ব্যস্ত?" জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকে দেখে সুদেব, আন্দাজ করেছে কিছু বলবে তার বৈবাহিক বিষয়ে, 'সাত সকালে সবে মৌজ করে চা আর রেডিও নিয়ে বসেছি এখনি হাজির, একটু শান্তি দেবে না' এই রকম একটা
মুখভঙ্গী করে জিজ্ঞেস করল
"কি বলবে? তোমার কি এটুকু তর
সইল না?
আমি খবরটা শুনে নিতাম, তারপর না হয়
বলতে"
"না আসলে দেরি হয়ে যাবে" নম্রস্বরে বলে সুশীল
"কিসের দেরি অ্যাঁ? বাবুটির
কোথায় যাওয়ার আছে?
পাশ তো দেওয়া হয়ে গেছে বলেই জানতাম, নাকি এখন বিলেত যাবেন পড়তে?"
"আজ্ঞে, ঠিক তা নয়। আমি একটা
চাকরি পেয়েছি দক্ষিণে,
আমি সেখানেই যাচ্ছি" কথা শেষও করতে পারল না সুদেব
ছ্যাঁকা খাওয়ার মতো লাফিয়ে উঠল
"কী?
কী বললে? চাকরি? দক্ষিণে? এই কে আছিস? তোদের গিন্নীমা কে ডাক দে তো। তুমি চাকরি জোগাড় করেছ অথচ
আমার অনুমতি নেবার প্রয়োজন বোধ করনি? আজ একেবারে
রওনা দেবার মুখে এসে আমায় খবর শোনাচ্ছ? কি শিক্ষার
নমুনা,
তা এইসব শিক্ষে বুঝি কালেজে দেয়? নাকি প্রতিবেশিদের ঘরে?" সুকুমারী এত্তেলা পেয়ে তড়িঘড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু বাপ ছেলের কথার এক বর্ণও মাথায় ঢুকছে না।
"এই যে, ছেলের মা, দেখো, তোমার সুপুত্তর
কোথায় নাকি চাকরি করতে যাচ্ছেন তার বাপ এখনও জীবিত ভুলেই গেসলেন। অনুমতি টনুমতির
ধার ধারেন না,
সোজা এয়েছেন উনি বের হচ্ছেন সেই খবর শোনাতে। ওই দেখো, বাস্কো প্যাঁটরা গুছিয়েই এয়েছেন। শোনো বড় খোকা, তুমি যেখানে যাবে যাও, তবে সামনের
মাসের বারো তারিখের আগে হবে না। তুমি শোনোনি? তোমার মা
বলেনি যে,
তোমার বিয়ে?"
"আজ্ঞে বলেছেন, তবে সে জন্যই
আমি আরোও তাড়া করে চাকরিটা জুটিয়েছি, আমায় মাফ
করবেন,
সে মেয়েকে বিয়ে করা আমার সম্ভব নয়" ইতোমধ্যে অর্ঘ্যও
এসে দাঁড়িয়েছে।
"হ্যাঁ বাবার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করবেন কী করে? উনি তো__"
"ভাই,
বড়দের মাঝে কথা না বলাটাই সৌজন্য। হ্যাঁ বাবা, আমি শুধু চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছি টুকুনই বলতে আসিনি, আমি এটাও জানাতে এসেছিলাম আমি বিয়ে করে আমার স্ত্রীকে নিয়ে
যাব,
তবে আপনার পছন্দকরা মেয়েকে নয় আমি তপতীকে বিয়ে করব। আপনি ওই
মেয়ের বাড়ি কথা দিয়ে আসার আগেই আমি নিজের কাছে এবং তপতীর কাছে কথা দিয়ে ফেলেছি।
আপনাদের আশির্বাদ চাইব"
"কী নির্লজ্জ বেহায়া পুরুষ, বাপের মুখের ওপর বলছে নিজের বিয়ের কথা? তাও আবার
কায়েত বাড়ির ধিঙ্গি মেয়েকে?
ছি ছি, মুখে বাধল না
ভালবাসাবাসির কথা বলতে?
দেখো ছোটোবৌ, তোমার গুণধর
বড়খোকার কাণ্ড। বড় খোকা,
তোমার ধারনা আছে আমি এর জন্য কী করতে পারি?"
"আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনি ত্যাজ্য
করবেন আমায়। আমি নিজেই বলে যাচ্ছি আপনার স্থাবর অসস্থাবর বিষয় সম্পত্তি কোনোকিছুর
প্রতি আমার কোনো লোভ নেই,
আপনি সবই ছোটো খোকার নামে করে দিন। শুধু আমার চিঠি এলে
মায়ের হাতে পৌঁছে যেন দেওয়া হয়, সেই অনুমতিটুকু চাই, আর কিচ্ছু না। আমি আসি, ট্রেনের সময়
হয়ে যাবে" বলে সকলকে প্রণাম করে বের হয়ে গেল সুশীল। তখনকার মতো হতবাক হয়ে
দাঁড়িয়ে রইল পুরো পরিবার। সুদেব তার বড়খোকার মতিভ্রমের জন্য সুকুমারী এবং সন্ন্যাসী
রূপী ভূদেবকে দায়ী করে বেশ স্বস্তি পেল।
পরের মাসের বারো তারিখে কুঞ্জবালার বিয়ে হ'ল এই পরিবারেই তবে ছোটো খোকার সঙ্গে। সুশীলের জীবন মনেহয়
বেশ সুখেরই হয়েছিল,
চিঠি আসত নিয়মিত, তবে সব যে
সুকুমারীর হাতে পৌঁছত তা'নয়। যেটা পৌঁছত সেটাও বলাইবাহুল্য অর্ঘ্যর ছাড়পত্র পেলে
তবেই যেত। কোনো একটা চিঠিতে সুশীল তপতীর মেয়ে হবার খবর আসে, সুকুমারী তার নাম দেন চান্দ্রেয়ী। কুঞ্জবালা বয়সে ছোট্টটি, পাড়াগাঁয়ের মেয়ে বলে সকলেই ভেবেছিল সে বেশ নরম সরম, কাঁচা বুদ্ধির হবে বুঝি বা। কিন্তু আসলে বের হ'ল উল্টোটাই, একেবারে
রাজযোটক। অতটুকুন মেয়ের যে কতো কূটবুদ্ধি থাকতে পারে কেউ ধারনাই করতে পারেনি।
বাড়ির কাজের মানুষদের থেকে শুরু করে অর্ঘ্য অবধি সব্বাইকে পরিচালনা করত নিপূন
ভাবে। বড়খোকা চলে যাবার পর থেকেই সুকুমারী বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, তার ওপর নতুন বৌ সে বেশ কটকটি সুকুমারীকে চার কথা শোনাতে
ছাড়ে না। সব মিলিয়ে দেখলাম সুকুমারী কেমন যেন হয়ে গেল। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে
একদিন চলেও গেল দুনিয়া ছেড়ে। সুদেব অবশ্য এরপরেও বেশ কটা বছর বেঁচে ছিল। অর্ঘ্যর
মেয়ে গরিমা বা মুন্নি আর ছেলে প্রাঞ্জল বা পুনু দু'জনকেই দেখে গেছে।
দিন বেশ চলছিল পাড়াটা আরোও বদলে যাচ্ছিল, এখন রেডিওর বদলে টিভির রমরমা। বাড়িতে একটা কোলাব্যাঙের মতো
ফোনের বদলে সবার হাতে হাতে চ্যাপ্টা চৌকো ফোন। আশেপাশে আমার মতো বৃদ্ধ আর কেউ রইল
না। এক এক করে তাদের গুঁড়িয়ে দিয়ে চৌকোনা লম্বা বাক্স পারা সব বিল্ডিং উঠল, কেউ পাঁচতলা কেউ সাততলা, কেউ দশ। ফলে
আমি নিচু হয়ে গেলাম সবার মধ্যে,ছোটো হয়ে গেল আমার
আকাশ। দিনগুলো ভালোয় মন্দয় কাটছিল। তবে রাখী এলে আমার আজও শশিবালাকে মনেপড়ে, আবছা করে সুভাষিনীকেও।
দেশের পশ্চিম ঘুরে আসা শশিবালা প্রতি রাখীতে আমার ছাদের
পাঁচিলের একটা নির্দিষ্ট ইঁটে লাল হলুদ সুতো পেঁচিয়ে বানানো রক্ষাবন্ধনের ধাগা
বেঁধে দিত,
সুভাষিনী একবারই মনেহয় সুযোগ পেয়েছিল। নিয়ম ধরে রাখে
সুকুমারী,
বিয়ে হবার আগে তপতীও বেঁধেছে তার সঙ্গে, বিয়ের পর তো আর সুযোগই পেল না এই পরিবারে ঠাঁই ই তো হ'ল না তার। কুঞ্জ অত নিয়মের ধার ধারেনি, মনে থাকলে বেঁধেছে কোনো বার ভুলেও গেছে। তবে চান্দ্রেয়ী তার
মায়ের কাছ থেকে শুনেছিল,
সে তার খুড়তুতো বোন আর মেয়েকে নিয়ে আবার বাঁধা শুরু করে।
রাখীতে তাদের ভাইকেও যেমন রাখী বাঁধত তেমনই আমাকেও।
চান্দ্রেয়ীর এ বাড়িতে আসাটা বড় করুণ। একদিন সকালে যেমন তার
বাবা বের হয়ে গেছিল এই পরিবারের কাছে বিদায় নিয়ে, ঠিক তেমনই আরেকদিন খুব ভোরে এক মাদ্রাজী ভদ্রলোক মিস্টার নাম্বুদিরি, হাত ভাঙা ছোট্ট চান্দ্রেয়ীকে নিয়ে এসে দাঁড়ায় গাড়ি
বারান্দায়। তখন মাত্র সুদেব গত হয়েছে, শ্রাদ্ধশান্তি
মেটেনি তখনও। ভদ্রলোক একবর্নও বাঙলা জানত না, ইংরেজিতে
বুঝিয়ে বলে যে,
চান্দ্রেয়ী ওরফে পিতু ওদের প্রতিবেশি। মাসখানেক আগে পিতু ওর
মা বাবা সহ মিস্টার নাম্বুদিরি ও তার পরিবার কোথাও একটা ঘুরতে গেছিল। সেখান থেকে
ফেরার পথে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে গাড়ির ড্রাইভার সহ সুশীল, তপতী এবং মিসেস নাম্বুদিরি মারা গেছে। অল্প চোট পেলেও
অদ্ভুতভাবে বেঁচে গিয়েছে পিতু, মিস্টার নাম্বুদিরি
ও তার চার সন্তান। শ্রীনাম্বুদিরি পিতুকেও তার সন্তানদের সাথেই রেখেছিল, কিন্তু বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে পিতু একদম নিরামিষ রান্না
খেতে পারে না,
এদিকে নাম্বুদিরিরা কড়া ব্রাহ্মণ তারা মাছ মাংসের ধার দিয়েও
যায় না। তাই পিতুকে তার কাকার বাড়ি নিয়ে এসেছে, যদি কাকারা
নিতান্ত অস্বীকার করে তাহলে শ্রী নাম্বুদিরির পক্ষে খুবই ঝামেলার হয়ে যাবে এই
মেয়েকে মানুষ করা। এতোটুকু শিশু সে দিনের পর দিন না খেয়ে থাকছে এতে শ্রীনাম্বুদিরি
মনঃকষ্টে ভুগছে। অর্ঘ্য দূর করে দিতে চাইলেও কুঞ্জ রেখে দেয় পিতুকে। হাতভাঙা সে তো
ক'দিনের মামলা, সেই
অবস্থাতেও ছোট্ট মুন্নি-পুনুকে দেখে রাখতে পারবে। আর হাত সেরে গেলে তো কথাই নেই
অনেক কাজই করাতে পারবে। এখন এই ব্যাপার বাড়িতে কুঞ্জ কি বাচ্চা কোলে ঘুরবে নাকি? অতএব রয়ে গেল পিতু, মোটামুটি ঝি
হিসাবেই। তবে যেহেতু ছোটোর থেকে মুন্নি ওর সাহচর্য পেয়েছে আর জ্ঞান হবার পর জেনেছে
পিতু তার আপন জ্যেঠতুতো দিদি তখন দিদি বোনে কী যে ভাব ভালোবাসা না দেখলে বিশ্বাস
হয় না।
পিতু যতো বড় হয়, ততোই রূপ
বাড়ে,
এযেন সেই রূপকথার দুঃখী রাজকন্যের মতোই। কুঞ্জবালা তাকে
যতোই কম খেতে পরতে দিক,
সে তাতেও চাঁদের আলোর মতো স্নিগ্ধ রূপ নিয়ে বেড়ে ওঠে। কুঞ্জ'র বুদ্ধিতে, অর্ঘ্য তার
বাজারে বেশ কিছু ঋণ ছিল,
এমন একজনের সাথে বিয়ে দিয়ে দিল পিতুর। নিজের পিঠ বাঁচাতেই
করল এ কাজ,
অথচ সমাজে সবাই দেখল, অন্যজাতে
বিয়ে করে গৃহত্যাগী মৃত দাদার মেয়েকে এতোদিন পালনই করল না, ঘটা করে বিয়েও দিল বেশ নামজাদা লোকের সাথে। হ'লই বা দোজবর, সোনার আংটি
আবার ব্যাঁকা!!! মেয়েটা চলে যাবার সময় এমন ভাবে পিছন ফিরে আমায় দেখছিল, তখন কি আর ভেবেছি পিতু ফিরে আসবে আমার ঘরে? বছর ঘোরার আগেই মেয়ে হ'ল আর মেয়ের
কয়েক মাস বয়স থেকেই আবার এই পরিবারে সে। এরপরে প্রাঞ্জল বিদেশ পাড়ি দিল, অর্ঘ্যও গত হয়েছে, পড়ে রইল
অসুস্থ অশক্ত কুঞ্জবালা,
পিতু-মুন্নি আর পিতুর মেয়ে শর্বরী। আর জৌলুসহীন, বিপজ্জনক ভাবে একদিক ভেঙ্গে পড়া, কার্নিশের ফাটলে বট অশ্বত্থ গাছের চারা, সারা গায়ে শ্যাওলা ধরা, রং প্রায়
মুছে যাওয়া আমি। কতোকাল যে রক্ষণাবেক্ষণ হয় না, কে করবে কার
এতো সময় বা সঙ্গতি আছে?
চান্দ্রেয়ীর অবস্থা দেখে গরিমা বেচারা ভয়ে অস্থির নইলে
আদিত্য নামের ছেলেটা কবের থেকে অপেক্ষা করছে ওকে বিয়ে করবে বলে। ছেলেটা বাঙালি নয়, তবে ওর কথা শুনে সেটা বোঝা যায় না। গরিমা মাঝে মাঝে পিছে
লাগে তাইতে ধরা পড়ে
"ওয়ে মেড়ো, তুই বেশি বকবক করিস
না,
বাঙালিরা কেমন সেটা তোর থেকে শুনব না, যা"
"আমি কতো বার তোকে বলব আমরা মাড়োয়ারী নই"
"ওই হ'ল, মেড়ো না হলে পাঁইয়া"
"কি বুদ্ধি তোর বাবা, জাঠকে বলিস
মাড়োয়ারী না হলে পাঞ্জাবী।" ওদের ঝগড়া, খুনসুটি সব
সময় চলে। কিন্তু আমার তো অভিজ্ঞতা কম হ'ল না ঠিক ধরা
পড়ে ওদের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ। শুক্লপক্ষের রাত গুলোতে আমি শুনতাম ওদের কথোপকথন।
প্রায় সময়ই গরিমা আসত ছাদে চাঁদ দেখতে, হাতে থাকত
মুঠো ফোন। আর অবধারিত ফোন আসত আদিত্যর। বেশির ভাগ সময় স্পিকার ফোনে কথা বলত মুন্নি
আর তাতে আমার সুবিধেই হ'ত।
"কি রে ছাদে?"
"হুঁ। তুই?"
"বলত কোথায়?"
"আর কোথায়, টেরাসে হবি"
"গুড গেস। তবে এখন আমি সালমাদের বাড়ি, বিরিয়ানী সাঁটাচ্ছি" বলে খিক খিক করে হাসে।
"তুই?
আবার? উফ তোকে নিয়ে আমি___। কি নির্লজ্জ রে!
একটা টোটাল ভেজি ফ্যামিলির ছেলে হয়ে বিফ খাচ্ছিস, সেটা বলতে লজ্জা করছে না? ঢাক পেটাচ্ছিস"
"শ্শ্শ্। তুই এতো চ্যাঁচাচ্ছিস তোর বাড়ি কেন পুরো পাড়া জেগে
যাবে আর আমার কানের পর্দা ফেটে যাবে"
"কথা ঘোরাবি না। তুই আসবি না কাল থেকে, তোর মুখও দেখতে চাই না" গলা নামিয়ে হিস হিস করে বলে
মুন্নি।
"ও,
যাব না বলছিস? ঠিক আছে
তাহলে কাল পুণমের সাথেই মুভিটা মেরে আসি" বলে আবার হাসে।
"তুই গিয়ে দেখ, আমি তোর কি
হাল করি"
"কি করবি? এই যে বললি তোর কাছে
যেতে বারণ,
তারপর কি যেন আমার মুখ দেখবি না"
"তোর ঠ্যাং ভেঙে গলায় ঝুলিয়ে দেব, পুণমের সাথে মুভি দেখার সখ ঘুচিয়ে দেব" বলতেই ওদিক
থেকে হো হো করে হাসির আওয়াজ, তারপরে গলা সফ্ট করে
বলে
"কেন রে, তুই এতো পাগলি?"
"জানি না, যা"
"কাল অফিস আছে? যাবি তো
মুভিতে?"
"হুঁ,
অফিস তো আছেই, মুভিটা ঘরে
এনে দেখলে হয় না?
বেশ দিদি, শর্বরী সবাই মিলে?"
"সে আরেকবার দেখব, কিন্তু প্লিজ
কালকে হলে দেখি চল। যাবি তো?"
"হুঁ,
না গেলে তুই ছাড়বি?"
"এগ্জ্যাক্টলি। আচ্ছা শোন, এবার নিচে যা,
হিম পড়বে মাথায়"
"না পড়বে না, এখন আর হিম
পড়ে না"
"তবু,
তুই না গেলে তো পিতুদি আসতে পারবে না ছাদে"
"হুঁ। দিদিটার জন্য বড় মন কেমন করে রে"
"জানি"
"দিদিটা কেন যে কাঁদে, এমন চাঁদের
আলোয় শুধুই কাঁদে"
"তোকে কাল বলব, আমার একটা আইডিয়া
এসেছে। এখন লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঘুমোতে যা"
"তুই ও যা। আমি জানি তুই বাড়িতে, টেরাসে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখতে দেখতে কথা বলছিস"
"তাই?
তাহলে তখন চ্যাঁচালি কেন? আর ঘুমের বারোটা বাজিয়ে এখন 'ঘুমোতে যা' বলে লাভ আছে?" কথা বলতে বলতে নিচে চলে যায় মুন্নি। প্রায়শঃই ওদের ঝগড়া এমনকি মারপিট করতেও
দেখা যায়। মারপিট ঠিক নয় মারটা এক তরফা চলে আর আদিত্য প্রথমে মার খায়, তারপর ঠেকায়, তারপর ঠিক
একটা সুযোগে খপ করে চড়ুই পাখির মতো গরিমাকে ওর বলিষ্ঠ দুই হাতে জড়িয়ে ধরে, যাতে আর নড়াচড়ারও ক্ষমতা না থাকে ওর, মারধোর তো দূর। যদিও খানিকক্ষণ নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা
চালায়,
কিন্তু আদিত্যর আদরের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়, তখন আবার আহ্লাদ করে আদরও খায়। কিন্তু এতো কিছুর পরেও বিয়ের
প্রসঙ্গ উঠলেই
"না রে, তুই তো অন্ততঃ বোঝ, দিদির এই হাল, আমি কি করে
যে বোঝাই তোকে"
"তুই কী ভাবিস যে আমিও ওই লোকটার মতো তোর অবস্থা করব? এতো বছর মিশেও তোর ভরসা হ'ল না?"
"নাঃ,
এ নিয়ে কথা বলতে গেলেই তুই সেন্টি হয়ে যাস। আমি কখন বললাম
যে,
তুইও ওইরকম করবি? কিন্তু কিছু
আন অ্যাভয়েডেবল্ সিচ্যুয়েশন আছেই, আর সেগুলো তুইও
অস্বীকার করবি না,
কেন এই তো ভালো আছি। বিয়ে করতেই হবে এমন কোনো কথা আছে?" আর এগোয় না বেশিরভাগ সময়েই এমন করে আধা খাচড়া অবস্থায় থেমে
যায়। হয় কাজ থাকে কোনো বেরিয়ে যায়, নয়ত পিতু আসে
খাবার দিতে,
কিছু না কিছু বাধা পরেই।
এবারে রাখী পূর্ণিমার কয়েকদিন আগের থেকেই পুনুর সাথে ওদের
কথোপকথন টুকটাক কানে আসছিল। এখন প্রযুক্তি এতো উন্নত যে, বিদেশে থাকা পুনু ও তার পরিবারের সাথে সামনা সামনি বসে কেমন
কথা বলে ওরা। কেমন যেন বুঝতে পারছিলাম আমার দিন ঘনিয়ে আসছে, ওরা খোলাখুলি কথা বলে, দেওয়ালেরও
কান আছে বোঝে না। এরই মধ্যে একদিন দুপুরে মুন্নির রাগারাগিতে চমকে গেলাম। কিছুই না, সেদিন মুন্নি কি কারণে যেন দুপুর থাকতে অফিস থেকে ফিরে
এসেছে। এসেই ওর বিছানায় বাইরের জামা কাপড় পরা আদিত্যকে ঘুমন্ত অবস্থায় পেয়ে
চূড়ান্ত পিটপিটে মুন্নি খেপে লাল, ঠাস ঠাস করে মারতে
লেগেছে,
"ওই ওই, ওঠ ওঠ বলছি, হাজার এক দিন মানা করেছি নোংরা বাইরের জামা কাপড় নিয়ে আমার
বেডে বসবি না,
আমি ঘরে নেই সেই সুযোগে তুই___"
"আঃ,
গরু কি করিস?"
"কি বললি আমি গরু? তাহলে তুই কি
অ্যাঁ তুই কি?
তুই ব্যাটা একটা মহিষ, চল ওঠ
ওঠ" খপ করে ওর হাত দুটো ধরে নিজের হাতের ওপর আধশোওয়া করে ধরেছে আদিত্য।
"হি,হি,
এবার? দেখ, তুই নিজেই বাইরের জামা কাপড়ে তোর বেডের ওপর"
"ছাড় কিন্তু"
"মাথা খারাপ? এই সুযোগ কেউ
ছাড়ে?"
"তুই আমায় গরু বললি কেন?"
"আহা কতো আদর করে 'গরিমা'টাকে ছোটো করে 'গরু' বানালাম, তুই বুঝলিই না? কেমন মেয়েরে তুই? নাঃ তোর থেকে
পুণম ভালো,
বেশ পুন্নি বলে ডাকলে কি মিষ্টি করে সাড়া দেয়, ভাবছি ওকেই বিয়েটা করব"
"কর না, সেটা আমায় শোনাচ্ছিস
কেন?
ঠিকই তো আছে, তুই থাক তোর
ওই পুন্নি না শাকচুন্নি তাকে নিয়ে"
"খুব চটেছিস না? কই? তাকা আমার দিকে" বলে মুখটা নিজের দিকে ফেরায়।
"নাঃ চটব কেন? তোর যাকে
খুশি তুই বিয়ে করতে পারিস,
খামোখা আমার জন্য তোর জীবনটা বরবাদ করিস না"
"নাঃ,
মেয়েটাতো দেখছি আজ খুব সেন্টি হয়ে রয়েছে, কি হয়েছে রে? আরে হ্যাঁ
শরীর খারাপ নাকি?
এই সময়ে বাড়িতে এলি যে?" আলতো আলতো করে গালের ওপর নাক ঘষে, চুমো দেয়
গালে।
"যাক,
সেটা চোখে পড়েছে"
"কি করব, চোখ খোলালি তো
পিটুনি দিয়ে,
একটু আদর করে ডাকবি কোথায় তা না। তারপরে বেশ আমি আদর করার
মুডে রয়েছি দেখেও তো চুপ থাকবি, তাও না। হ্যাঁ রে সব
সময় এমন মারপিট করতেই ইচ্ছে করে তোর? আচ্ছা ছাড়, কি হয়েছে সেটা বল" বলতে বলতে আরোও বুকের ভেতরে টানে।
"কিছুই না, আজ আবার প্রতীক
এসেছিল ওর প্রব্লেম নিয়ে"
"তো?
ওর সাথেও লড়াই করেছিস?"
"ধুর বাবা বলতেই দেয় না, শোন না।
প্রতীকের মা নাকি কোন মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে চায় ওই সব জাত কুল মেনে, এদিকে প্রতীক প্রেম করে এক তামিল মেয়ের সাথে। এবারে কেসটা
ঘেঁটে গেছে যখন প্রতীকের মা মেয়েটার মুখোমুখি হয়েছে। সে মেয়ে নাকি কট্টর পন্থী
বলেছে বাড়িতে মাছ মাংস খাওয়া চলবে না, এদিকে
প্রতীকের মা সেসব শুনতে রাজি নন, বাঙালি বাড়িতে মাছ
মাংস হবে না?
তাই হয়? প্রতীক না পারে মা
কে বোঝাতে না পারে এই মেয়েকে বোঝাতে, আবার এই
কারণে ওকে ছেড়ে মায়ের পছন্দ করা মেয়েকেও বিয়ে করে নিতে পারছে না। অথচ বিয়ের আগেই
যদি এই অবস্থা হয় তা'হলে বিয়ের পর কী দাঁড়াতে পারে বুঝতে পারছিস? আমায় সব বলার পর আমার কেমন শরীর অস্থির করে উঠল, খুব চাপ চাপ লাগছিল বলে ছুটি করিয়ে ফিরে এলাম, প্রতীককে উত্তর দেব কি? আমিও তো সেই
একই প্রব্লেমের সামনে দাঁড়িয়ে" চুপ করে থাকে দু'জনেই, খুব সাহায্য করতে
ইচ্ছে করে ওদের। গরিমার বলা আরও বাকি ছিল, আর আজ সবটা পরিষ্কার
হল আমার যে,
ও কেন বিয়ে এড়িয়ে যায়।
"দেখ,
আমাদের প্রব্লেমটাও কিন্তু এক। তোর মা বাবা চান পুণমের সাথে
বিয়ে হোক,
সে তোদের স্বজাতি। আমায় হয়ত মেনে নেবেন, তবে আমি মাছ মাংস খাওয়া পাবলিক। হ্যাঁ, ওই নিরামিষ খাবার এক দুদিন খেয়ে নিতে পারব, তাই বলে আমিও যদি তোর মতো বাইরে গিয়ে লুকিয়ে খেয়ে আসি সেটা
ওঁদের কাছে শকিং হবে না বল?
তুই আমার এই নন-মেয়লি রূপটা রেলিস করিস বলে যে তোর বাবা মা
ও করবেন তেমনটা না ও হতে পারে, তাই না? আর এই যে, আমি পিটপিটে, আমি ঝগড়ুটি, তোর গায়ে হাত
তুলি এগুলো এখন যেমন বেশ মজার বা প্রেমের চোখে তুই দেখছিস বিয়ে করে এক ছাদের নিচে
চব্বিশ ঘন্টা থাকতে শুরু করার পর দেখবি এগুলোকেই অসহ্য লাগবে"
"বুঝলাম তুই যে পয়েন্টগুলো তুলেছিস সত্যিই সেগুলো ভাববার মতো, কিন্তু দেখ, প্রাঞ্জলও তো
ইটালিয়ানকে বিয়ে করে দিব্যি আছে, সে মেয়েও তো টোটাল
ভেজিটেরিয়ন অথচ পুনু তো ননভেজ খাওয়া ছাড়েনি, তাহলে? আসলে কি জানিস এই বিয়ে করা, সংসার করা এটসেট্রা ব্যপারগুলো না টোটাল অ্যাডজাস্টমেন্টের কেস। ধর, আমি যদি ননভেজ ফ্যামিলির হতাম প্রতীকের মতো, তুই ভেজ ওই মেয়েটার মতো তাহলে বোঝাতাম যে, ভাই আমাদেরও প্রচুর ভেজি আইটেম আছে দরকারে তুই সেগুলো খা___"
"আঃ,
ওদেরটা ওদেরকেই মেটাতে দে, তুই আমাদেরটা কীভাবে হ্যান্ডেল করবি সেটা বল" শুনে, কাছে টেনে খুব আদুরে গলায় বলে আদিত্য
"সেটা অলরেডি সলভ্ড"
"মানে?"
"মানেটা আর কিছুই না, প্রব্লেম সলভ
করে ফেলেছি,
আর সেই জন্যই দুপুর থাকতে তোর ঘরে এসে বসে আছি"
"কি করেছিস তুই?" গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করে গরিমা
"সিম্পল, ভেরি সিম্পল, মা কে গিয়ে বললাম তোর কথা, বাবাও ছিল তখন। ওরা শুনে তোর সাথে দেখা করতে আই মিন তোকে নিয়ে যেতে বলেছে। তবে
আমি ক্রিস্টাল ক্লিয়ার বলেছি ওদের যে তুই লম্বা বেনী ঝোলানো, ইন্ডিয়ান ড্রেস পরা মেয়ে না। তুই মাছ চিকেন কেন বিফ পর্কও
খাস আমারই মতো। তুই রান্না জানিস না, শুধু তুই
মেয়েটা খুব ভালো,
পড়াশোনায় ভালো, দারুন ভালো
চাকরি করিস। বাড়িতে সবাই দেখলাম কেমন অদ্ভুত ভাবে মেনে নিল সবটা, শুধু মা বলেছে তুই ওই সব আমার সাথে বাইরে যখন যাবি তখন যেন
খাস মানে ঘরে বসে রেঁধে খাস না বা ঘরে এনে খাস না। আর ল্যাঙ্গোয়েজটা ততো প্রব্লেম
নেই,
মা তোকে শিখিয়ে দেবে কারণ আমাদের দেশের বাড়িতে তো কেউ বাঙলা
বুঝবে না"
"আর পুণম? ওকে বলিস নি?"
"কে পুণম?"
"মানে টা কী?"
"মানে ওটা তো একটা ইমাজিনারি ক্যারেকটর, তোকে ক্ষ্যাপানোর জন্য" বলেই হো হো করে হাসতে হাসতে
শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মুন্নিকে যাতে কোনো মতেই মার খেতে না হয়।
"দেখ,
ওরা এতোটা ছাড় দিয়েছে, তোর আমার
কিছু অ্যাডজাস্ট তো করতেই হবে ওদের সাথে বল? পারব না আমরা?" মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে গরিমা।
"চল,
এখন তাহলে বাইরে যাই, খেয়ে ফিরব, আর দিদির কেসটাও সলভ করেছি, বাড়ির কেসটাও মোটামুটি সলভড। খেতে খেতে বলব"
"দিদির কেসটা কী? ওই তোর কাজিন? তা'
সে রাজি?"
"হবে না? পিতুদির মতো সুন্দরী
দেখে সে কী বলে জানিস?
বলে,
এই মেয়েকে কী করে ওর বর ছেড়ে দিল? কেমন লোক যে, এই মেয়েকে
কষ্ট দিল?
প্রোমোটার বাবু নাকি দুরাত ঘুমোতেই পারেনি পিতুদির কথা ভেবে
ভেবে" খুব হাসে দু'জন মিলে।
"হ্যাঁ, ভাইয়া নিজেও তো
ডিভোর্সি,
ওর নিজেরও তো একটা মেয়ে আছে, কিন্তু ভাবী মানে ওর ওয়াইফ ছিল যে, সে তো মেয়ের
সাথেও দেখা করতে দেয় না। কাজেই ভাইয়া শর্বরীকে দেখেও খুব খুশি" কথা বলতে বলতে
বের হয়ে গেল ওরা। এ হেঃ আমি যে কিছুই শুনতে পেলাম না বাড়ির ব্যপারটা কী সলভ করল, আমি যদি যেতে পারতাম ওদের পিছু পিছু। তবে অনুমান একটা করলাম, কিছুদিন আগে পুনুর সাথে কথা বলছিল ওরা যে, আদিত্যর কোন দাদা নাকি প্রোমোটার, সে অফার দিয়েছে এই পুরোনো বাড়ি ভেঙে নতুন ফ্ল্যাট তুলবে, যেটাতে পিতু, মুন্নি আর
পুনুর নামেও একটা করে ফ্ল্যাট থাকবে। বোধহয় ওদের মায়েরটা কম্প্রোমাইজ করতে হবে, আর যতোদিন কাজ চলবে ততোদিন তিন মহিলার থাকার বন্দোবস্ত করে
দেবে। আর খুব সম্ভব পুনু এবার আসবে মাকে নিতে। তার মানে দুইয়ে দুইয়ে চার হ'ল। মুন্নি আদিত্যকে বিয়ে করে নেবে, পিতু ওই প্রোমোটারকে বিয়ে করে মেয়ে নিয়ে চলে যাবে, আর কুঞ্জবালা ছেলের হাত ধরে বিদেশ পাড়ি দেবে।
এতোদূর আমি স্পষ্ট বুঝে গেছি, আর তাই পুনু সপরিবারে আসায় আমার কোনো হেলদোল হ'ল না। পঞ্চম প্রজন্ম পুনুর ছেলে, পিতুর মেয়ে
দৌড়ে বেড়াচ্ছে সিঁড়ি বেয়ে তবু আমার শিহরণ হয় না। ওরা কাঁদছে, তার মানে আগামীকাল থেকে জিনিসপত্র সরানো শুরু হবে। মুন্নির
তো বিয়ে নম নম করে হয়েই গেছে, সে তো কোথায় গিয়ে হ'ল জানি না, হঠাৎই শুনলাম বিয়ে
নাকি হয়ে গেছে কাগজে সই করে। এখন পিতুরটা ও হয়ে গেল নাকি? টের পাইনি। কাল পুনুরা মনেহয় রওনা দেবে, ওদের আর থাকার যো নেই। যাক চলেই যাক সবাই ঘর খালি করে, তাহলে অন্ততঃ আমার মরতে কষ্ট হবে না।
ওই দেখো, ভোরের আলো ফুটে গেছে, চারিদিকে কেমন সুন্দর পরিবেশ। ও কি? আদিত্য তার সম্প্রদায় এতো সকালে কেন? তার মানে কি___ নাঃ আমি ভয় পাব না,
বাধাও দেব না। 'জন্মিলে
মরিতে হবে,
জানে তো সবাই, তবু মরণে
মরণে অনেক ফারাক আছে ভাইরে সব মরণ নয় সমান।' কিন্তু
ব্যাপারটা কেমন গোলমেলে লাগছে, আদিত্যরা এতো হৈ হৈ
করে হাসছে,
আবার দেখো, ফুল মালা নারকোল, কি কেস? এঃ, আমিও দেখি এই বাচ্চাগুলোর মতো ভাষা বলছি। যাক গে, ঘটনাটা দেখতে হয় তো। বরং আদিত্য আর মুন্নির কথা গুলো শুনে দেখি
কিছু উদ্ধার হয় কি না। বাকিরা তো আধা ঘুমে, নয়ত পুরো
ঘুমে,
জাগবে কখন কে জানে!!
"কি রে? এতো সকালে আসবি
বলিসনি তো"
"আরে আমিই কী জানতাম নাকি? এ শা___,
সরি,
ব্যাটা প্রোমোটার তার কী সব মহুরত টহুরত আছে সেই সময়েই নাকি
পূজা করতে লাগবে,
আজ শুভদিন। আমি বললাম বস্ আমি নিয়ে যাচ্ছি, সেখানে গিয়ে তোমার যা খুশি তুমি করো, আমি আমার বউ নিয়ে দেব ঘুম, ওই পৌঁছে দেওয়া অবধি আমার ডিউটি"
"পুজো? কীসের পুজো? বাড়ি খালি করার আগে আবার পুজো করে নাকি? ওয়ে,
কাল আমি ছিলাম না দেখে ড্রিঙ্ক করেছিস নাকি? আর পুজো তো ওই লোকগুলো কারা?"
"ওরা?
ও ওরা তো প্রোডিউসারের লোক। পুজোর কেসটা তো ওদেরই"
"যাত্তারা এর মধ্যে আবার প্রোডিউসার এলো কোত্থেকে? প্লিজ আমায় বল সবটা, আমি তো কিছুই
ধরতে পারছি না। শোন না,
তুই যা চাইবি দেব, শুধু এটা
একটু খোলসা কর আমায়"
হ্যাঁ বাপু, আমারও সেই একই কথা একটু খোলসা করে বলো দিকিনি বাপ, এই পুজোর কেসটা কী? ওই দেখো, আগেই বউকে জড়ায়, অবশ্য নতুন
বৌ,
আদর সোহাগ তো করবেই, কিন্তু সে
করতে গিয়ে কথাটা না বললে তো মুস্কিল।
"তোকে একটু সারপ্রাইজ দিলাম, দেখ এই বাড়িটা ভেঙে ফেলবে এটা মনে হলেই আমারও না কেমন লাগছিল। তোদের কতো
স্মৃতি এই বাড়ি ঘিরে আর শহরের মধ্যিখানে এমন একটা বাড়ি, এতোযুগ ধরে রয়েছে, রাতারাতি
সেটাকে হাপিস করে দেওয়া হবে? তাই ভাইয়াকে জিজ্ঞেস
করলাম ভেঙে বিল্ডিং তোলা ছাড়া আর কোনো উপায় আছে কি না। ভাইয়া তখন বলল যে, এই বাড়িটা সারিয়ে মেগা সিরিয়াল ওয়ালাদের ভাড়া দেওয়া যেতে
পারে। তারা নাকি এমন বাড়ি খোঁজে। তুই বিয়ে করে আমাদের বাড়ি, পিতুদি বিয়ে করে ভাইয়ার বাড়ি, তোর মা পুনুর সাথে চলে যাবে, তো এবাড়িতে শুটিং
হলে,
কারোও কোনো অসুবিধাই হবে না। ওই প্রোডিউসারের লোক এসে আগে
একদিন বাইরে থেকে দেখে পছন্দ করে গেছে, আজ রাখী তো, এই সকালবেলায় কোন সময়টা নাকি শুভ্ মহুরত ওরা পুজো টুজো করবে, এরপর এটাকে ভাইয়া সারিয়ে, ওদের ডিমান্ড মতো সেটের বাড়ি বানিয়ে দেবে, বুঝলি কিছু?"
বুঝলাম, বুঝলাম আমিও সবটা
বুঝলাম,
তার মানে গতকাল আগাম রাখী মানিয়েছিল ওরা, আজ ঘর খালি করতে হবে ভেবে, বেঁচে থাক বাবা তোরা,
খুব সুখে থাক সবাই, নাই বা থাকলি
আমার ঘরে,
এমন নতুন জন্ম ক'জনের ভাগ্যে
জোটে?
আজ রাতের চাঁদের আলো আমি নতুন করে মাখব সেই প্রথম দিনের
মতো।
মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী