কেয়া চ্যাটার্জি ~ করোনা আবহ ও সভ্যতা

 

করোনা আবহ ও সভ্যতা

 


আমি একজন অতি সাধারণ একজন মানুষ। আমি সরকারি বা বেসরকারি চাকুরেও নই। তাই এই করোনা আবহ সম্বন্ধে আমার সকল অনুভূতিই একজন সাধারণ পৃথিবীবাসি হিসেবেই লিখবো। ২০২০ সালের মার্চ যখন কেন্দ্রীয় সরকার লকডাউন ঘোষণা করলো তখনও আমি এই ক্ষুদ্র মারণ ভাইরাসটির জন্মস্থান বাদে তার সম্বন্ধে অন্যান্য তথ্য কিছুই জানতাম না। যদিও এর আবির্ভাব, আবির্ভাবের উদ্দেশ্য নিয়ে নানা মুনি নানা মত দিয়ে জাচ্ছেন এখনও।


আমার সন্তান খুবই ছোট। সদ্য স্কুলে যেতে শুরু করেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে নতুন ক্লাসে উঠেছে। নতুন বই, নতুন ইউনিফরম— নতুন উদ্দীপনা। গত বছর স্বামী স্কুল শিক্ষক থেকে কলেজ অধ্যাপক পদে উন্নীত হয়েছিলেন— নতুন আনন্দ। কিন্তু হঠাৎ এক ধাক্কায় সব উদ্দীপনা, আনন্দ, উত্তেজনা নিমেষে ভ্যানিস হয়ে মনের মধ্যে শুধুই দুশ্চিন্তার বীজ রোপণ করে দিয়ে গেল। ঝড়টির নাম করোনা ভাইরাস।


লকডাউনের পর পরেই পাড়ায় ভিড় বাড়তে শুরু করলো কিছু অপরিচিত মুখের। কিশোর, সদ্য কিশোর। ভ্যান নিয়ে সব্জি, ফল, মাছ বিক্রি করতে বেরিয়েছে। কথায় কথায় পরিচয় বাড়ে। ওদের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা অর্ধেক হয়ে আটকে গেছিল। ভবিষ্যতে আদৌ পরীক্ষা হবে কি না, ওরা পাশ করবে কি না, সেই পাশের আদৌ মূল্য থাকবে কি না— ওদের চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া প্রকট ও উজ্জ্বল। রেজাল্ট বেরোনোর পরে ওদের দেখতে পাইনি। হয়তো স্বপ্নের সন্ধান পেয়ে গেছে। কিন্তু মেঘ ঘনিয়েছে অন্যত্র। প্রাক্তন স্কুলের স্কুলের উচ্চমাধ্যমিক পাশ মেধাবী ছাত্র তার স্যারকে ফোন করে ক্ষোভ উগরে দেয়, স্যার আরো নম্বর পেতাম। আমার ন্যায্য মূল্যায়ন হয়নি। আমার স্বপ্ন শেষ।


এ তো গেল কিছু অভিজ্ঞতার কথা, এবার আসি কিছু বিশ্লেষণধর্মী কথায়। করোনা আবহে আমরা কি কি হারালাম? সেই তালিকা তৈরি করতে বসলে সংখ্যাটা পরিমাণে পরিণত হবে। গৃহবন্দী দশায় আমরা সব থেকে বেশি যেটা হারিয়েছি তা হলো মানসিক শান্তি ও ধৈর্য। যে প্রজন্ম এই বছর স্কুল, কলেজ বা অন্যান্য পরীক্ষা উত্তীর্ণ হলো তারা কিছুতেই ভরসা করছে না এই মূল্যায়ন। আর সমাজও নিস্তরঙ্গ জীবনে একটা খোরাক পেয়ে তাদের মনোবল চূর্ণ করার হিংস্র খেলায় মেতে উঠেছে নির্দয়ভাবে। সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রাপ্ত নম্বর নিয়ে নানা ট্রোল, মিম বানিয়ে নিজেদের স্মার্টনেস জাহির করার নেশায় তারা দুমড়ে মুচড়ে ফেলছে ভবিষ্যতের শিরদাড়া।


দ্বিতীয় পর্যায়ে আসে জীবিকা। সারা বিশ্ব জুড়ে অগুনতি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। কাজ মানে শুধু অফিসের কাজই নয়, শ্রমিক, মজুর, কুলি-কামিন তালিকাটা নেহাত ছোট নয়। কাজ হারিয়ে ভিন রাজ থেকে দলে দলে নিজ রাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক। ট্রেন, বাস বন্ধ। অগত্যা উপায়ন্তর না দেখে সাহায্য নিয়েছেন ঈশ্বর প্রদত্ত দুটি পায়ের ওপর। মাইলের পর মাইল স্ত্রী, সন্তান, লটবহর সমেত তারা হেঁটেই চলেছেন। খিদের জ্বালায় চিতকার করছে কোলের শিশুটা। মা তাকে ভোলানোর জন্য উনুনে পাথর ভরে মিছিমিছি রান্নায় ব্যস্ত। কোথায় পাবে খাবার? কাঁদতে কাঁদতে মৃত্যু হলো কতো শিশুর, কতো বৃদ্ধের। হিসেব রাখা সম্ভব নয়।


কাজ হারিয়েছেন উচ্চপদস্থ কর্তা, নিম্নপদস্থ কেরানি। যুবক যুবতীরা হতাশ হলেও তাদের কাছে সুযোগ আছে আবার ঘুরে লড়াই করার। কিন্তু যারা মধ্য বয়সে চাকরি হারালেন তাঁদের কাছে সুযোগ খুব কম। সেই বয়সে নতুন করে সব কিছু শুরু করার মনোবল বা সুযোগ পারতপক্ষে খুব মানুষেরই থাকে। হতাশায় ডুবে যাচ্ছে মানিব জাতির একটা বড় অংশ। অস্থিরতা বাড়ছে পরিবারের মধ্যেও। পারিবারিক অসহিষ্ণুতা বেড়েই চলছে ক্রমশ।


বন্ধ হয়েছে বড় বড় ব্যবসা। শপিং মল, রেস্তোরাঁ, সিনেমা হল, মালটিপ্লেক্স রীতিমতো ধুঁকছে। সাথে ছোট ব্যবসায়িদের মাথায় ভেঙে পড়েছে দেনার পাহাড়। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত দোল উৎসবে অনুষ্ঠিত মেলা সর্বজনবিদিত ও বিখ্যাত। সেই মেলার দিন গোনেন শত শত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ধার দেনা করে পণ্য কেনেন, মেলায় বিক্রি হলে তা শোধ করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে। কিন্তু এই বছর সেই অনুষ্ঠান শুধু বাতিলই হলো না, আরো কয়েক বছরের জন্য স্থগিত রাখা হলো। ভাতের সাথে চোখের জল মিশলো কতো পরিবারের তার ইয়ত্তা নেই।


এমনকী এই থাবা বসলো আরো কিছু উৎসব সংক্রান্ত ব্যবসায়ে।  পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত পূজা পার্বন বা কেনা কাটায় সাধারণ মানুষ কাঁচি চালিয়েছেন। বস্ত্র ব্যবসায়ী, ফুল-ফল ব্যবসায়ী, পুরোহিত এরকম কতো মানুষের জীবন যাপন যে সেই কাঁচির নিচে ক্ষতবিক্ষত হলো! একই সারিতে বসানো যায়  ঈদ, মহরম উতসবকে। মহারাষ্ট্র রাজ্যের গণেশ পুজো এবং আরো অনেক পার্বন। চিত্রটা কিন্তু সর্বত্র একই।


বন্ধ হয়েছে সিনেমা হল। ছবির প্রযোজকরা O T T প্ল্যাটফর্মে সিনেমা রিলিজ করিয়ে হয়তো নিজেদের লভ্যাংশের কিছু অংশ লাভ করেছেন কিন্তু সিনেমা হলের সাথে যুক্ত কর্মীদের কারুর চাকরি চলে গেছে কেউ বা বিনা বেতনেই কালাতিপাত করছেন। সাময়িক সময়ের জন্য বেছে নিয়েছেন নতুন জীবিকা। তবে কিছু মানুষদের জীবিকা পরিবর্তন করার কোন উপায় থাকে না। অভিনেতা, অভিনেত্রী, টেকনিশিয়ান বা এরকম জীবিকার সাথে যুক্ত অন্যান্য ব্যক্তিরা কিন্তু অপেক্ষা করেছেন লকডাউন ওঠার। বন্ধ হয়েছে ধারাবাহিক, যাত্রা, থিয়েটার, পথ নাটিকা ও আরো অন্যান্য অনুষ্ঠান।


এই তো গেল দেশের খবর। বিদেশের দৃশ্যটা কিরকম? সেখানকার দৃশ্য আরো ভয়ংকর। আমাদের দেশে বিভিন্ন কল কারখানা বন্ধ হওয়ার ফলে খাদ্যদ্রব্য সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর মূল্য বেড়ে গেলেও তা সাধারণ মানুষের কাছে লভ্য ছিল। সব্জি, ফল, মাছ-মাংস ইত্যাদি একটু চড়া দামে হলেও কিনতে পেরেছি। দরিদ্র শ্রেণীর বেশ কিছু অংশের মানুষ সরকারের থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী পেয়েছেন। তাছাড়াও কিছু জন দরদী ব্যক্তি তাঁদের সাধ্য মতো সাহায্যের হাত এগিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বিদেশে চিত্রটি ছিল একটু অন্যরকম। সেখানে সপ্তাহে একদিন বাজারে বেরোনো যেতো। তিন চার ঘণ্টা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে যতসামান্য খাদ্য ও ফ্রোজেন ফুড নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছিল সাধারণ মানুষদের। তার ওপর মনের ভিতর প্রবল আশঙ্কা ও মৃত্যু ভয় থাবা বসিয়ে মনোবল ভেঙে দিয়েছে। কোথাও প্রেসিডেন্টের সহধর্মিনী অসুস্থ, কোথাও স্বয়ং প্রেসিডেন্ট অসুস্থ। সেখানে সাধারণ মানুষের জীবন তো  বিশ বাঁও জলে। গোদের ওপর বিষ ফোঁড়া হয়ে দেখা দিল আমেরিকার শেতাঙ্গ- কৃষ্ণাঙ্গ যুদ্ধ। প্রতিবাদে ফেটে পড়ল গোটা দেশ। আইন অমান্য করে তারা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলেন, পুলিশের সাথে তরজা শুরু করলেন। বাড়তে থাকল অসহিষ্ণুতা, বাড়তে থাকল সংক্রমনের হার। লাখে লাখে মানুষ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লেন। কবরস্থানে জায়গা নেই, পুড়িয়ে ফেলা হলো দেহ, যেভাবে পুড়িয়ে ফেলা হয় জঞ্জাল। মনের ভিতর শুধুই মৃত্যুভয় থাবা বসিয়ে চলছে।


এবার আসা যাক মানসিক ধসে। চমকাচ্ছেন? মানসিক ধস? সে আবার কি? আসলে জগতের সাথে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে মানুষের মনে একটা বিশাল গহবর সৃষ্টি হয়েছে। সেই গহবরে তলিয়ে গেছে মানবিকতা। দেশ জুড়ে ব্যস্ত থাকা স্বাস্থ্যকর্মী, ডাক্তার, নার্সদের সাথে করা ব্যবহার তার পরিচায়ক। কোথাও ভাড়া বাড়িতে বা হোস্টেলে থাকা নার্স চারদিন ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম ও জনসেবার  পর ফিরে দেখে মালিক পক্ষ তাকে বাড়ি ছাড়ার নোটিস ধরাচ্ছে। কারণ রোগটা তাদের কাছ থেকে ছড়িয়ে পড়বে। আবার কোথাও ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা চিকিতসার কাজে গেলেও হেনস্থা হয়েছেন সাধারণ মানুষের হাতে। করোনা আবহ আমাদের শিখিয়েছে প্রকৃত শিক্ষার কতটা অভাব আমাদের দেশে। কোভিড পসিটিভ রোগী হাসপাতাল যাওয়ার আগেই রাস্তায় কষ্ট পেয়ে মারা যাচ্ছেন। সাহায্যের হাত নিয়ে এগিয়ে আসেনি কেউ। কোথাও আবার হাসপাতালে বেড না পেয়ে রোগী হাসপাতালের সামনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। আবার যারা সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছেন তাঁদের পরবর্তী সময়ে সাহায্য করেনি বা কোভিডের লক্ষণ দেখা গেছে এমন ব্যক্তির সাথে দুর্ব্যবহার করতেও পিছপা হয়নি কেউ। আমরা নিজেরাই সমাজের শত্রু হয় উঠেছি। রোগের সাথে না লড়ে, লড়ে চলেছি রুগীর সাথে।


শিক্ষা ব্যবস্থার চাকা তো একেবারেই থেমে গেছে। বন্ধ হয় গেছিল বড় বড় পরীক্ষা। সরকারের উদ্যোগে ফলাফল বের করা হলেও তা নিয়ে জল্পনার শেষ নেই। অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে স্কুল গুলি পড়াশোনার প্রচেস্টা অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু অত্যধিক স্ক্রিন টাইম ও ডিস্প্লের দিকে চেয়ে থাকার ফলে ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে নানান চোখ ও স্পাইনাল কড সংক্রান্ত রোগ। দীর্ঘদিন বাড়িতে বন্দি থাকার ফলে ছোট ছোট শিশুদের চারিত্রিক   বৈশিষ্ট পাল্টে যাচ্ছে। শারীরিক স্থুলতা, অতিরিক্ত গ্যাজেট এর প্রতি আকর্ষণ তাদের অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।


বই ব্যবসার ওপর এক কালো ছায়া নেমে এসেছিল আমফান ঝড়ের পরে। একে লকডাউনের ফলে কলেজস্ট্রিট অঞ্চল ধুকতে শুরু করেছিল। সেই দুরবস্থা বাড়িয়ে তোলে সর্বনাশা তাণ্ডব। ছোট ছোট বইয়ের দোকান ভেঙে যায়, ডুবে যায় ছাপাখানা, নষ্ট হয়ে যায় সহস্র বই। শুধু প্রকাশক বা লেখক নন, বই ব্যবসার সাথে যুক্ত কর্মীরাও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এর মধ্যেই মাথাচারা দিয়ে ওঠে ডিজিটাল বইয়ের ব্যবসা।


অনলাইন কাজের ফলে কর্মীদের ওপর কাজের চাপ ও পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থা। যার ফলে মানসিক  জতসাচাপও সমপরিমানে বেড়ে গেছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে মহিলাদের ওপর মানসিক ও শারীরিক চাপ বৃদ্ধির পরিমাণ বেশি। গৃহকর্মসহায়িকা না আসায় কর্মরতা মহিলাদের বাড়ির কাজ, সন্তানের কাজ গুছিয়ে করতে হয়েছে অফিসের কাজ। আবার যারা গৃহবধূ তাঁদের চব্বিশ ঘণ্টা সমস্ত কাজের ভার বহন করতে য়েছে। তাঁদের সাহায্যের জন্য হাত এগিয়ে আসেনি। ফলে বেড়ে গেছে পারিবারিক কলহ, অসহিষ্ণুতা, সহমর্মিতা।


এতো খারাপের মধ্যেও আলোর খবর তো থেকেই যায়। অন্ধকারের শেষে আলো আছে বলেই তো আমরা শত বিপর্যয়ের ঝড় সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখি। ঘরবন্দি দশায় শরীরের সাথে মন ভালো রাখতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। যে যতসামান্য পরিচ্ছন্নতা সংক্রান্ত নিয়মাবলি- যথা - বাইরে থেকে এসে হাত পা মুখ ধোয়া, জামা কাপড় বদলানো, খাওয়ার আগে হাত ধোয়া ইত্যাদি , আমরা অবজ্ঞা করে গেছি, সেগুলি নবরূপে ফিরে  এসেছে। বরং আরো ভয়ংকর রূপ নিয়ে ফিরে এসেছে। মানবজাতির একটা বড় অংশ পরিচ্ছন্ন হতে শিখছে। তার সাথে কোয়ারেন্টাইন কালে মানুষ নিজের ভালবাসার মানুষদের সাথে শখ বা passion গুলিকেও সময় দিতে পারছেন। কেউ আঁকছেন ছবি, কেউ গাইছেন গান, কেউ নৃত্যের তালে মুখরিত করছেন ধরণী, কেউ নতুনভাবে নিজেকে আবিষ্কার করে আবার আবৃত্তি করছেন প্রিয় কবির কবিতা। মানুষ স্বনির্ভর হতে শিখেছে। চুল কাটা থেকে ফুচকা বানানো, ঘর মুছা থেকে বাল্ব পাল্টানো, সবাই কিন্তু বেশ কয়েক মাসের জন্য কাজগুলি নিজেই করে নিয়েছেন। পাশাপাশি নিজের জীবিকাটুকু বাদ দিলে যে অন্যান্য জীবিকার মানুষরা আছেন, যাদের অনেকেই অশ্রদ্ধা করতে পিছপা হতো না, তারা যে সমাজের জন্য কতটা প্রয়োজনীয় সেই সত্যের উপলব্ধি হয়েছে অনেকের। সব্জি বিক্রেতা থেকে, ফুচকা বিক্রেতা, রিক্সাচালক থেকে জলের ভারী— সবাই আমাদের জীবনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তার সঙ্গে মানুষ এটাও জেনেছে যে এঁদের কাজ মোটেই সহজ কাজ নয়।


নতুন নতুন জীবিকার সৃষ্টি হয়েছে। অনলাইন সুবিধার জন্য বাচ্চারা বাইরে যেতে না পারলেও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়নি। অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা নতুন যুগের শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটি অভিনব পদ্ধতি হিসেব আত্মপ্রকাশ করেছে।  দূরত্ব আর দূরত্ব নেই এখন। গোটা দুনিয়াটাই বিনি সুতোর মালায় গাঁথা। যে কাজে দূরত্বটাই একটা বিরাট ব্যাপার ছিল সেই কাজ আর আটকে থাকছে না।  অনেকেই এই অনলাইন ব্যবস্থায় নতুন ব্যবসা চালু করেছেন। কেউ আবার নিজের পুরনো ব্যবসাকে নতুন মোড়ক দিয়েছেন। কেউ পড়াশোনা ও কাজের পাশাপাশি করে নিচ্ছেন নতুন কোর্স, কেউ বা শিখতে শুরু করছেন অন্য কোন গঠনমূলক শিক্ষা। কেউ শিখছেন গান, কেউ ঝালিয়ে নিচ্ছেন রং তুলি হাতে কব্জির চলাফেরা, কেউ বা দেখে নিচ্ছেন নৃত্যে সে এখনো পারদর্শী কি না। বই পড়ার অভ্যেস বেড়েছে। ফলে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে বই ব্যবসায়িরা।


ব্যস্ততার দৌড়ে যে মানুষগুলির সাথে যোগাযোগ ছিল না একদমই, তাঁদের সাথে আবার কথা হচ্ছে। মোবাইলের আয়তাকার স্ক্রিনে ভাল করে দেখা যায় না আপনজনের মুখ। মনে পরে যায় বাইরের পৃথিবীটা দেখা হয়নি বহুদিন। দেখা হয়নি মানুষের মুখ। এটাও একটা ভালো দিক। যন্ত্র সর্বস্ব জীবনে যন্ত্রই যে সব কিছু নয় তার উপলব্ধি। প্রকৃতিকে বিনষ্টকারী মানুষ আজ প্রকৃতি দেখার জন্য হাহাকার করে উঠছে। এ তো প্রকৃতিরই জয়।


এবার একটু বিশ্লেষণমূলক আলোচনায় আসা যাক। এবং সেই আলোচনার অবতারনা করলে প্রথমেই বলতে হয় যে মানুষের মতো অশিক্ষিত, উদাসীন ও দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রাণী গোটা বিশ্বের অন্য কোন প্রাণী নয়। কোভিড-১৯ একটি সনক্রমন জনিত ব্যাধি জানা সত্ত্বেও তারা বাইরে বেরোচ্ছেন, বাজারে যাচ্ছেন ঘনঘন, মাস্ক পড়ছেন না, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখছেন না। সরকার যতই লকডাউন ঘোষণা করুক না কেন চায়ের দোকানে বসে আড্ডা মারতে ও সেই আড্ডার ভিডিও শ্যুট করতে বাঙালী বেরিয়ে পড়েছে। ডাক্তার বলছেন পুষ্টিকর খাদ্য খেতে, অতএব চলো বাজারে। ভারতবর্ষে কেরালা একমাত্র রাজ্য যা সম্পূর্ণ করোনা মুক্ত রাজ্য হিসেব ঘোষিত হয়েছিল কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে সেই রাজ্যেই গোষ্ঠী সংক্রমনের জেরে বিপুল পরিমাণে রোগীর পরিমাণ বাড়তে থাকে। ভারতবর্ষের মহারাষ্ট্রে সংক্রামিত্র পরিমাণ বাড়তে বাড়তে চিনদেশকেও অতিক্রম করে ফেলে। বর্তমানে ভারত বিশ্বে সংক্রমনের নিরিখে প্রথম।


দ্বিতীয় দফায় আসে সরকারের ভূমিকার কথা। করোনা ভাইরাস ভারতবর্ষ সহ বহুদেশের সরকারের অপদার্থতা ও অন্তঃসারশূন্যতা প্রকট করে দিয়েছে। দেশ জোড়া লকডাউনে যখন সব কিছু বিধ্বস্ত তখন পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা রাজ্যে ধেয়ে এলো সর্বনাশি আমফান ঝড়। এরকম বিধ্বংসী ঝড় কয়েক শতাব্দীতে কেউ দেখেনি। কলকাতা সহ জেলা গুলি বহুল পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। বাড়িতে বাড়িতে লোডশেডিং, গাছ উপড়ে পড়ে আছে অগুনতি স্থানে, কোথাও বাড়ি ভেঙেছে, কোথাযও মানুষ মারা গেছেন। গাছ তুলতে মিলিটারি সহায়তা প্রয়োজন হলো রাজ্যের। অপর দিকে বিদ্যুৎ বিভাগ সাধ্যমত পরিষেবা দিয়েও ব্যর্থ। উল্টে দুমাস পরে বিদ্যুৎ বিলে টাকার অঙ্ক দেখে মানুষের হৃদপিন্ড চলাচল আটকে যাওয়ার উপক্রম। রাজ্য সরকারের যখন নাকানি চোবানি অবস্থা তখন কেন্দ্রীয় সরকার শ্রমিক এক্সপ্রেস চালু করে ভিন রাজ্যে কর্মরত শ্রমিকদের নিজ রাজ্যে পাঠিয়ে দিলেন। রাজ্য সরকারের সেই অবস্থা সামাল দেওয়ার স্তম্ভ নড়বড়ে। ফলে অভিমান করে ও প্রায় হেরে গিয়ে রাজ্যে শুরু হয়ে গেল আনলক প্রসেস। স্কুল কলেজ বাড়ে সমস্ত সরকারি বেসরকারি অফিস খুলে দেওয়া হলো। ট্রেন বন্ধ, বাস চলছে সীমিত পরিমাণে। এদিকে সমস্ত কর্মীদের সঠিক সময়ে ১০০ শতাংশ উপস্থিতি দিতে হবে, এই ঘোষণা করা হলো। চাকরি বাচাতে মরিয়া মানুষ গুলো প্রায় বাদুড় ঝোলা হয়ে ছুটল অফিস। social distancing  নাম গন্ধ নেই। কেন্দ্র রাজ্যের তরজায় উলুখাগড়া সাধারণ মানুষের প্রাণ যায় যায় অবস্থা। এই অবস্থার গালভরা নাম- নিউ নরমাল।


করোনা নিয়ে আর যাই হোক দাপিয়ে রাজনীতি করে গেল আমেরিকা ও ভারতবর্ষের মতো দেশ। donald trump কখনও চিনের সাথে অসন্তোষ বাড়িয়েছেন কখনও হুমকি দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে। সব নিজের প্রচারের জন্য। আরেকদিকে ভারতবর্ষে ভারচুয়াল দলীয় সমাবেশ হল কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে। এদিকে লকডাউনের জেরে আনাজ ও শস্য নষ্ট হয়েছে, পচে গেছে দুধ, ফলাদি। কৃষক অভুক্ত পরিবারের দিকে তাকিয়ে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এ সব কিছুই মিডিয়া সন্তর্পনে এড়িয়ে গেছে। টিভি স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে ভগবানের স্বর্ণ মন্দিরের জৌলুস। এই আমাদের ভারতবর্ষ।


এদিকে সরকার যতই অভয়বাণী শোনাক না কেন সংবাদ মাধ্যম কিন্তু  তার কাজ করে গেছে।  প্রথম দিন থেকে বিশ্ব জুড়ে সংক্রামিত ব্যক্তি ও মৃত্যুর হার বারংবার টিভি স্ক্রিনে ফ্ল্যাশ করে করে, মানুষের কানে ঢেলে দিয়ে আতঙ্কের পরিমাণ বাড়িয়ে গেছে। বেড়েছে মানসিক চাপ। তার সাথে সহযোগিতা করেছে ভাক্সিনের আগমন বার্তা। মানুষকে টিভির সামনে বসিয়ে রেখে টিআরপি বাড়ানোর সহজ পন্থা। যেখানে সমীক্ষা ও ইতিহাস বলছে যে যেকোনো মহামারির অ্যান্টিডট আসতে কমপক্ষে পাঁচ বছর সময় লাগে সেখানে সংবাদ মাধ্যম তথা সোশ্যাল মিডিয়া রটিয়ে দেয় যে ভাক্সিন চলে আসবে ডিসেম্বরেই। অসহায় মানুষকে বিভ্রান্ত করা খুব সহজ কাজ আসলে। রাশিয়া একটি ভাক্সিনের সন্ধান পেয়েছেন বটে, এছাড়াও আরো অনেক বিজ্ঞানী করোনা ভাইরাসের ভ্যাক্সিনের গবেষণায় রত, কিন্তু তা মানুষের কাছে কবে পৌছবে? আদৌ সুলভ মূল্যে পাওয়া যাবে কি না? তার উত্তর একমাত্র ঈশ্বরই জানেন।


সবশেষে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই সেই সব মানুষদের যাঁরা নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করে সমাজের জন্য লড়ে গেছেন। পুলিশকর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী, ব্যাংকার, ডাক্তার, নার্স, সরকারি কর্মচারি সকলে অনবরত পরিষেবা দিয়ে গেছেন। বাড়ির বাইরে থেকেছেন, বাড়ি ও পরিবারের থেকে দূরে থেকেছেন, নিজের সন্তানের জন্ম, পিতার মৃত মুখ দেখতে পারেন নি কতজন।  প্রাণ দিয়েছেন কতো ডাক্তার, নার্স, পুলিশ ও আই.এ.এস অফিসার। যাঁদের আমরা হারালাম তাঁদের স্থান পূরণ হবে না আর কখনো। যাঁরা লড়ে ফিরে এসেছেন তাঁরা একটি সময়ের দলিল হয়ে রইলেন। মানুষ গুহা জীবন থেকে লড়াই শিখেছে। মানুষ লড়ে ফিরে আসতে জানে। তাই জানি এই দুঃসময় কেটে যাবে একদিন। সূর্য উঠবে স্বাধীনতার। শুধু মানুষকে প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য মিলিয়ে বাঁচতে হবে। আবার যেন ফিরে না আসে আমাজন রেইন ফরেস্ট বা অস্ট্রেলিয়া জঙ্গলের দহন কাণ্ডের মতো ঘটনা। প্রকৃতিই আমাদের সৃষ্টিকর্তা। তাই অবাধ্য সন্তানকে শাস্তিও তিনি অনায়াসে দিতে পারেন।


কপিরাইট কেয়া চ্যাটার্জি কর্তৃক সংরক্ষিত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন