মুখোমুখি সমর্পিতা
ঘটক
সম্পাদক রংরুট: সকলের আগে ত্রৈমাসিক রংরুটের পক্ষ
থেকে আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। রংরুটের এই বিশেষ সংখ্যায় আপনাকে স্বাগতম। আপনার লেখালেখির সূত্রপাত
সম্বন্ধে যদি আলোকপাত করেন। সময়ের পরিধিতে এবং পরিবেশের প্রেক্ষাপটে। জীবনের বিভিন্ন
পর্বে কোন কোন বিশেষ ব্যক্তিত্ব আপনার জীবনদর্শনের গড়ে ওঠায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন?
সমর্পিতা ঘটক: রংরুটকেও আন্তরিক ধন্যবাদ। নিজের চিন্তা, কথা
বলার এমন পরিচ্ছন্ন পরিসর পেয়ে ভালো লাগছে আমারও। প্রভাবের কথা প্রসঙ্গে প্রথমেই
বলতে হয় বাবার কথা। থোড় বড়ি খাড়ার বাঁধনে কখনও বাঁধতে চাননি আমায়। জীবনকে পিপাসুর
মতো শুষে নেওয়ার ইচ্ছে বাবার থেকে পাই। যা নতুন, যা অভিনব, যা
গভীর, যা
স্থূল নয় সেসব কিছুর প্রতি আমার আগ্রহ এসেছে তাঁর কাছ থেকে। বাবা বাতিঘর হলে মা
হলেন মাস্তুল। প্রধান চালিকাশক্তি। নিজের সঙ্গীত-জীবন মা ভাসিয়ে দিয়েছেন আমাদের
লালনে। ভালো গান, সুর আমার জন্মের আগে থেকেই আমার শিরায় প্রবাহিত। গানের
প্রভাব আমার জীবনে বিপুল। দিদি লেখালেখির ক্ষেত্রে বিশেষ করে কবিতা লেখার ক্ষেত্রে
ভীষণ সাহস যুগিয়েছে আমায় প্রতিনিয়ত। ওঁর গভীর বোধ, সাহিত্যপ্রীতি, সমালোচনা
আমায় আন্দোলিত করেছে ছোটো থেকেই। বিয়ের পর স্বামীর উৎসাহ পেয়েছি
নিরন্তর। আমার সব লেখা সেই পড়ে প্রথমে, মতামত দেয়। শ্বশুরমশাই বলেন, ‘লেখা
ছেড়ো না’। এছাড়া অগণিত বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী, স্বজনের
মতামত আমায় এগিয়ে দিয়েছে একটু একটু করে।
সম্পাদক রংরুট: বাংলা কাব্যসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের
গুরুত্ব এবং আপনার জীবন ও সাহিত্যসাধনার
যাত্রাপথে বিশ্বকবির ভূমিকা ঠিক কি রকম?
সমর্পিতা ঘটক: বাংলা কাব্যসাহিত্য রবীন্দ্রনাথ ছাড়া ভাবা যায়
না। আমার সামান্য সাহিত্য সাধনায় তিনি এবং আরও অনেক কবির ভূমিকা রয়েছে। জীবনের
যাত্রাপথে কতটা মানি তা বোধহয় আমি জানিনা। তবে দুঃখে, আনন্দে
কিংবা চমক লাগার সময় তাঁর সৃষ্টি বিশেষত গান সঙ্গী হয়। তাঁর গানে মহৌষধ আছে।
সম্পাদক রংরুট: রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘মানুষের
উপর বিশ্বাস হারানো পাপ’; একজন সাহিত্যিকের প্রত্যয়ে মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখাটা
কতটা জরুরী বলে আপনার মনে হয়? আর বিশ্বাসভঙ্গেরর দহন তার প্রতিভাকে কি ভাবে সমৃদ্ধ করে
তুলতে পারে?
বা আদৌ
পারে কি?
সমর্পিতা ঘটক: মানুষের জন্যই সাহিত্য সৃষ্টি হয়, তাকে
বিশ্বাস করেই কিছু লেখার কথা ভাবি। তবে কিছু বন্ধু, পরিজনদের
কপটতা,
ছল আমায় আহত করেছে তবে সেই আঘাত সৃষ্টির প্রেরণাও যুগিয়েছে।
সৃষ্টির পর সে দহন কমেছে। সৃষ্টির মধ্যে দহন যেমন থাকে তেমন থাকে সৌন্দর্য।
সম্পাদক রংরুট: রবীন্দ্রনাথের যুগের পর আমরা বহুদূর এগিয়ে এসেছি! জীবন ও
সাহিত্যের ভিতর ও বাইরে ঘটে গিয়েছে বিপুল পরিবর্ত্তন! আজকের দিনে সাহিত্যে আধুনিকতা বিস্তর পরীক্ষা নিরীক্ষার
মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে কোথাও কি একটা আবর্তের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে বলে মনে করেন
আপনি? নাকি বাংলাসাহিত্য
আরও বেগবান হয়ে আধুনিকাতার পরিসরটিরই আরও বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে বলে মনে হয় আপনার?
সমর্পিতা ঘটক: সাহিত্য স্থাণু নয়, এগিয়ে
চলাই তার ধর্ম। বাংলা সাহিত্য ঘুরপাক খাচ্ছে কিনা বলা শক্ত কারণ আমরা দেখি নতুন
কবি ও সাহিত্যিক নানাবিধ সৃষ্টি উপহার দিয়ে চলেছেন, কতটা
নতুনত্ব তার মধ্যে আছে তা নিক্তিতে ওজন করা সম্ভব নয়। অনেক সৃষ্টির মধ্যে যা নতুন, যা
প্রাণবান তাই টিকে থাকবে।
সম্পাদক রংরুট: সামাজিক দায়বদ্ধতার নিরিখে, একজন সাহিত্যেকের সমাজসচেতনতা কতটা জরুরী বলে মনে হয় আপনার? এবং এই সমাজসচেতনতার
প্রসঙ্গে
সাহিত্যিকের দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক মতাদর্শ কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
সমর্পিতা ঘটক: শিল্পী সাহিত্যিকদের সমাজচেতনা থাকবেই। থাকাটা
জরুরি। কেউ কেউ এই চেতনা নিয়ে সোচ্চার হন, কেউ
নির্লিপ্ত থাকেন। দেশপ্রেম শব্দটির ব্যঞ্জনা এখন বদলে গেছে। উগ্র জাতীয়তাবাদের
সমার্থক হয়ে উঠেছে দেশপ্রেম। রাজনৈতিক মতাদর্শহীন মানুষ হয় না। প্রকাশভঙ্গিতে
তারতম্য থাকে। আর মতাদর্শ থাকা ও দলদাস হয়ে যাওয়া কিন্তু ভিন্ন বিষয়।
সম্পাদক রংরুট: সাহিত্যসাধনা বা কাব্যচর্চার প্রসঙ্গে কবি জীবনানন্দ পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান ও সুস্পষ্ট
ইতিহাসচেতনার উপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন।
তাই এই সমাজসচেতনতার ভিত্তি সুদৃঢ় ইতিহাসবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে কতটা
জরুরী বলে মনে করেন আপনি, এবং কেন?
সমর্পিতা ঘটক: আমরা ইতিহাসের সন্তান। আমাদের সমস্ত সৃষ্টি এবং
স্বপ্নে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে ইতিহাসবোধ। কোন কবির রচনায়
কীভাবে তা ব্যক্ত হয় সেটি বিশেষ প্রণিধানের বিষয়। জীবনানন্দ সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ
সেইজন্য অগাধ ও উত্তরোত্তর তা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সম্পাদক রংরুট: স্বদেশপ্রেম, নিজের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর
প্রতি দায়বদ্ধতা- নিজের চারপাশের প্রবাহমান সময়ের সাথে আত্মসংলগ্নতা এগুলি একজন
সাহিত্যিককে কি আন্তর্জাতিকতার প্রেক্ষিতে
সীমাবদ্ধ করে তোলে বলে মনে করেন আপনি?
সমর্পিতা ঘটক: স্বদেশপ্রেম এবং আন্তর্জাতিকতার মধ্যে
শিল্পসাহিত্যের বিরোধ নেই। আমি যেমন পড়ি রবীন্দ্রনাথ তেমনই পড়ি লোরকা, হুইটম্যান, নেরুদা।
সম্পাদক রংরুট: আধুনিক জীবনেরর গতি সর্বস্বতা ও ভোগবাদী সংস্কৃতি
সাহিত্যকে কি ক্রমেই কোণঠাসা করে দিয়ে ভবিষ্যতের জন্যে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলবে বলে
মনে করেন আপনি?
গত এক
দশকে, গোটা বিশ্বে
ইনটারনেট বিপ্লবে আপনি বাংলাসাহিত্যের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কতটা আশাবাদী?
সমর্পিতা ঘটক: প্রথমেই রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি স্মরণ করি-
“চিত্তের দর্শন,
স্পর্শন , শ্রবণ, মননশক্তিকে
যদি সচেতন রাখতে হয়, যা কিছু পাওয়া যায় তাকেই পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করবার শক্তিকে
যদি উজ্জ্বল রাখতে হয় তাহলে নিজেকে অতিপ্রাচুর্য থেকে বঞ্চিত করা চাই”
(ছিন্নপত্র)। দ্রুত গতি এবং ভোগবাদী সংস্কৃতি সাহিত্যকে সঙ্কুচিত অবশ্যই করছে
কিন্তু সাহিত্য কখনওই অপ্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে হয় না। বাংলা সাহিত্য শিল্পবিপ্লব এবং
অন্যবিধ যন্ত্রের উদ্ভাবনের পরও টিকে আছে। ইন্টারনেটকে কীভাবে সাহিত্য ব্যবহার
করবে তার ওপরই সম্ভাবনা নির্ভর করবে।
সম্পাদক রংরুট: আমাদের সমাজসংসারে নারীর
অবস্থান আপনাকে কতটা ও কিভাবে বিচলিত করে? আপনার ব্যক্তিজীবনের দৈনন্দিন
ছন্দে এর প্রতিফলনের সরূপ সম্বন্ধে একটু বিস্তৃত ভাবেই জানতে চাইছি।
সমর্পিতা ঘটক: আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে
সমাজে নারীর অবস্থান এখনও যথেষ্ট টলমল। সংসার সামলে বাইরের জগতে তাকে পা রাখতে হয়।
আলোর স্পর্শ পেতে সে উদগ্রীব কিন্তু সময় বন্টনে সংসার, কাজ, পরিবার
অগ্রাধিকার পায় তাই তার সবকিছু মাপা। ছেঁটে ফেলতে হয় তাকে তার অনেক ইচ্ছে, অনেক
উড়ান। আমার ব্যক্তিজীবনে তেমন কোনও হার্ডল ছিল না। লেখালেখির ক্ষেত্রে বাধা আমি
পাইনি কখনও।
সম্পাদক রংরুট: তথাকথিত একাডেমিক
নারীবাদের চর্চা আমাদের তৃতীয়বিশ্বের
এই আর্থসামাজিক পরিসরে কতটা ফলদায়ী ও আশাব্যঞ্জক বল মনে করেন?
সমর্পিতা ঘটক: যারা কাগজ পড়েন, জার্নাল
পড়ছেন তারা এই চর্চায় সমৃদ্ধ হন সরাসরি অবশ্যই। এই চর্চার তাত্ত্বিক যাপনে তারা
প্রভাবিত হন,
তাদের মাধ্যমে এই চর্চা যখন হাতে কলমে ছড়িয়ে যায় ব্যাপক
অংশের কাছে,
ভিন্ন আর্থ-সামাজিক পরিসরে, মেয়েদের মধ্যে
সচেতনতা গড়ে তোলা হয়, তাদের বেঁচে থাকার দিশা দেখানো হয় তখন এই চর্চা মনে আশা
যোগায়।
সম্পাদক রংরুট: আর ঠিক এই প্রসঙ্গেই জানতে
ইচ্ছে করছে,
বিশেষত
একজন লেখিকার দৃষ্টিকোণ থেকে; আমাদের
পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ সভ্যতায় একজন লেখিকার ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার
মনে হয়?
আপনার
নিজের লেখালেখির সূত্র ধরেই যদি বলেন!
সমর্পিতা
ঘটক: আমার
কখনওই পড়ার সময় মনে হয় না, এ লেখা পুরুষের না নারীর।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সমস্ত ক্ষেত্রেই নারীকে নিজের জায়গা লড়ে তৈরি করতে হয়েছে।
সাহিত্য বা শিল্প সাধনায় এখনকার লড়াইটা বোধহয় ভালো লেখা আর মন্দ লেখার মধ্যে।
মান্ধাতা আমলের যে চিন্তাধারা ছিল সৃষ্টির প্রবাহে তা ভেসে গেছে অনেকখানি, যেটুকু
আছে তাও ভেসে যাবে অচিরেই।
সম্পাদক রংরুট: ভবিষ্যত প্রজন্মের সাহিত্যের
কাছে আপনার প্রত্যশা ও দাবী কি?
সমর্পিতা ঘটক: আমি নিজেই নতুন, দাবী
জানানোর যোগ্যতা আমার নেই। আমার চাওয়া এটুকুই লেখক ও পাঠকের মধ্যে সততা থাকুক।
গভীরতা থাকুক। যত্ন থাকুক। ফেসবুকের লেখা বা ওয়েবজিন কিংবা মুদ্রিত বই যাই হোক না
কেন উৎকৃষ্ট সৃষ্টি চিরস্থায়ী হোক। বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা ফিরে আসুক।
সমর্পিতা ঘটক: লেখক ও অনুবাদক। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর। বিভিন্ন
পত্র পত্রিকায়, ওয়েবজিনে লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
কপিরাইট রংরুট
কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন