সুরঞ্জন অধিকারী :কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় মৃত্যুচেতনা




কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় মৃত্যুচেতনা
                    

     রবীন্দ্র সমকালে বাংলা কাব্য কবিতায়, রবীন্দ্র চিন্তা চেতনার বাইরে, যে নূতন কাব্যস্বর শোনা গিয়েছিল তা কবি জীবনানন্দ দাশের হাত ধরেই। বাংলা কাব্য কবিতার জগতকে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহীরুহের মতো গ্রস্ত করে রেখেছিলেন। তাকে অতিক্রম করা খুবই কঠিন কাজ ছিল। তবে তা যে অসম্ভব নয়, তা প্রমাণ করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। সমকালীন নবীন স্বাতন্ত্র কামী কবিরা, শুরু করেছিলেন রবীন্দ্র বিরোধিতা। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, মোহিতলাল মজুমদার প্রমুখ কবিরা, নিজের মতো করে নিজস্ব কাব্য প্রত্যয় গড়ে তোলার চেষ্টা করলেন। জীবনানন্দের প্রথম কাব্য "ঝরা পালকে" (1927) কিছুটা রবীন্দ্র প্রভাব থাকলেও, তিনি তা অচিরেই অতিক্রম করে যান।


     জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ গুলি হল---
'ঝরা পালক' (1927), 'ধূসর পান্ডুলিপি' (1936) 'বনলতা সেন' (1942), 'মহাপৃথিবী' (1944) 'সাতটি তারার তিমির' (1948), 'জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা', (1954), কবির মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় 'রূপসী বাংলা' (1957) 'বেলা অবেলা কালবেলা' (1961)

     কাব্য কবিতার ধারণায় কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যের ভূমিকায় বলেছেন,"কবিতা রসেরই ব্যাপার, কিন্তু এক ধরনের উৎকৃষ্ট চিত্তের বিশেষ সব অভিজ্ঞতা ও চেতনার জিনিস---- শুদ্ধ কল্পনা বা একান্ত বুদ্ধির রস নয়।"সমকালের সাহিত্যের প্রখ্যাত সমালোচকগণ জীবনানন্দ দাশের কাব্য কবিতাকে খুব একটা সাদরে গ্রহণ করতে পারেননি। অনেক সময় তারা বিরূপ সমালোচনা করেছেন। ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন কবি। এমনকি কবিতা লেখার অপরাধে কলেজের চাকুরী থেকে, বরখাস্ত হতে হয়েছিল কবিকে। কবি তাঁর কাব্য কবিতার সম্পর্কে বলেছেন,"আমার কবিতাকে এ কাব্যের কবিকে নির্জন নির্জন বা নির্জনতম আখ্যা দেওয়া হয়েছে; কেউ বলেছেন,এ-কবিতা প্রধানত প্রকৃতির বা প্রধানত ইতিহাস ও সমাজ-চেতনার, অন্য মতে নিশ্চেতনার; কারো মীমাংসায় এ কাব্য একান্তই প্রতীকী; সম্পূর্ণ অবচেতনার সুরিয়ালিস্ট।"

     আলোচনার সুবিধার্থে, জীবনানন্দের কাব্য কবিতাকে, বিষয়বস্তুর দিক থেকে, আমরা নানা ভাগে ভাগ করে নিতে পারি। যেমন -- জীবনানন্দের দুঃখবাদ -- আলো-অন্ধকার;  সমাজ-ভাবনা, ইতিহাস চেতনা --ঐতিহ্যানুসৃতি; চিরকাল ও সমকালের সমন্বয়; সমকাল চেতনা--নস্টালজিয়া; প্রকৃতি চেতনা-- হেমন্তের কবি;    মৃত্যু চেতনা;   প্রেম চেতনায়-- দেহী--অদেহীর মিলন;   প্রেম ভাবনায় স্বাতন্ত্র্যতা-- বনলতা সেন; চিত্ররূপময়তা; নাটকীয়তা সৃষ্টি প্রভৃতি। আজকের প্রবন্ধে আমরা জীবনানন্দ দাশের বহু বিতর্কিত মৃত্যুচেতনা নিয়ে আলোচনা করবো।

    পৃথিবীর এখন ক্রান্তিকাল। এক বিরাট বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে পৃথিবী  অতিবাহিত হচ্ছে। করোনার ভয়াল আক্রমণে সারা পৃথিবী থরহরি কম্পমান। অগনন মানুষের মৃত্যু আমাদের শোকস্তব্ধ করেছে। ওদিকে ভূমধ্যসাগর, চীন সাগর বা ভারতের লাদাখকে কেন্দ্র করে, যুদ্ধের দামামা বেজে উঠছে। প্রবল শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী চীনের সামরিক শক্তির হুঙ্কারে, যেকোনো সময় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে যেতে পারে! এমন পরিস্থিতিতে জীবনানন্দ দাশের কবিতা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে বিমূঢ় বিভ্রান্ত সময়ে জীবনানন্দ দাশের বেশিরভাগ কবিতা লেখা হয়েছিল। তাই সমকালের চেতনার পরিচয় কবির কবিতার ছত্রে ছত্রে পাই। দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ--বাঙালি হৃদয় ভাগ, উদ্বাস্তু স্রোত কবি দেখেছেন স্বচক্ষে। অগণন মানুষের মৃত্যু দেখেছেন কবি। তাই কবির বহু কবিতায় মৃত্যুচেতনার পরিচয় পাই আমরা।

     বিমূঢ় বিভ্রান্ত যুগের অভিঘাতে কবি ক্ষতবিক্ষত। কবি চিত্তও বিক্ষুব্ধ। হৃদয়ের প্রাচীন মূল্যবোধগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিক্ষুব্ধ কবিহৃদয় প্রেম ও সৌন্দর্য চেতনায় সাড়া দিতে পারছে না। জীবন জিজ্ঞাসাও ধূলিধূসরিত।
এক গভীর শূন্যতা বোধ, মানুষের যান্ত্রিকতা,হৃদয়হীনতা সম্পর্কের শীতলতা,কবির কবিতায় মৃত্যুচেতনা জন্ম দিয়েছে। সমাজ-সংসারের অপ্রাপ্তি, ভারত ও বিশ্বের নানা আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনা, কবি হৃদয়ে জাগিয়ে তোলে মৃত্যুর প্রতি প্রবল আকর্ষণ। "ঝরা পালক" কাব্যের "পিরামিড" কবিতায় মৃত্যুচেতনা কথা আছে। যেমন--

"একে একে ডুবে যায় দেশ জাতি সংসার সমাজ;
কার লাগি,হে সমাধি, তুমি একা ব'সে আছো আজ--
কী এক বিক্ষুব্ধ প্রেতকায়ার মতন!"
        এই কবিতার উক্ত পংক্তিগুলো আমাদের এই সমকালেও হৃদয়ে গভীর অনুরণন তোলে।

     "ধূসর পান্ডুলিপি" কাব্যের বহু কবিতায় মৃত্যুচেতনা প্রকাশ ঘটেছে। বিক্ষুব্ধ কবিচিত্তকে জাগতিক সৌন্দর্য আর আকর্ষণ করতে পারে না। পৃথিবীর সবাই যে কাজে আনন্দ পায়, কবিহৃদয় সেসব জিনিসে, কোনো স্বাতন্ত্র্য অনুভূতি জাগায় না আর। "বোধ" কবিতায় আমরা মৃত্যুচেতনার অদ্ভুত প্রকাশ দেখতে পাই-----

"সকল লোকের মাঝে বসে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধা ?
আমার পথেই শুধু বাধা ?"

কোন এক অন্তর্নিহিত বোধ কবিকে বারবার পৃথিবীর আনন্দ আস্বাদ নেওয়া থেকে বিরত করছে। এই কাব্যের "সহজ" কবিতায় পাই----

"কাস্তের মতো বাঁকা চাঁদ
জেগে ওঠে-- ডুবে যায় -- তোমার প্রাণের সাধ
তাহাদের তরে ;
যেখানে গাছের শাখা নড়ে
শীতরাতে -- মড়ার হাতের শাদা হাড়ের মতন!"

     কবির মৃত্যুচেতনায় রয়েছে জীবন-মৃত্যুর সীমানার এক দোলাচল হৃদয়বৃত্তি। "অনেক আকাশ" কবিতায়
পাই-----
"অন্তরের আকাঙ্ক্ষা রে সকলের বিদায় জানায়
জীবন-মৃত্যুর মাঝে চোখ বুজে একাকী দাঁড়ায়ে.."
ঘন অন্ধকারের আড়ালে যেন কবিচিত্ত পথ হারিয়ে ফেলেছে।

"অবসরের গান"কবিতাতেও রয়েছে মৃত্যুর কথা।
"জীবন কবিতায়" জীবন মৃত্যুর চিরন্তন সত্যের কথা আছে-----
"যে পাতা সবুজ ছিল-- তবুও হলুদ হতে হয়,---
শীতের হাড়ের হাট আজো তারে যায় নাই ছুঁয়ে;
যে-মুখ যুবার ছিল,- তবু যার হয়ে যায় ক্ষয়"

প্রেমে দারুণ অতৃপ্তি কবিকে মৃত্যুর প্রতি আকৃষ্ট করে!
তাই কবি বলেন ----
"মৃত্যুর মতন শান্তি চাই"
                        (--কবিতা, "প্রেম")

     "বনলতা সেন" কাব্যের 'আমি যদি হতাম' কবিতায় রয়েছে মৃত্যুর ভয়াবহ প্রত্যক্ষ চিত্র----

"হয়তো গুলির শব্দ আবার ;
আমাদের স্তব্ধতা,
আমাদের শান্তি।"
"শিকার" কবিতায় আমরা পাই----
"একটা অদ্ভুত শব্দ!
নদীর জল মচকা ফুলের মতো লাল।"
শিকারির গুলিতে হরিণের রক্তে লাল হয়ে ওঠে নদীর জল। এইভাবে "সুচেতনা", "শঙ্খমালা", "অন্ধকার", "সুদর্শনা," প্রভৃতি কবিতায় আমরা মৃত্যুচেতনার পরিচয় পাই।

"দক্ষিণ শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়
সে আগুনে হায়।" (শঙ্খমালা)
অথবা, "সুদর্শনা! তুমি আজ মৃত।"(সুদর্শনা)
রূপসী বাংলা কাব্যে বারবার বাংলার শ্মশানের চিত্র, মৃত্যুর চিত্র এসেছে ----
"কোথাও আসিবে মৃত্যু কোথাও সবুজ, মুথা ঘাস আমারে রাখিবে ঢেকে।"

      "মহাপৃথিবী" (1944) কাব্যের অন্তর্গত "আট বছর আগের একদিন" কবিতায় মৃত্যুচেতনার চূড়ান্ত পরিচয় রয়েছে। জীবনে 'প্রেম' শব্দটার অতি ব্যবহারে, কালের স্রোতে ক্ষয় লেগেছে। এই কবিতায় একটা মানুষ আত্মহত্যা করছে---একজন সাধারণ মানুষের জীবনে সাফল্য বলতে যা বোঝায়, তা তিনি সবই পেয়েছেন। ভরা ফাল্গুনের, বসন্তের রাত্রে, যখন রূপসী প্রিয়ার সাথে, যৌবনের রসে মত্ত হওয়ার কথা ছিল তার, তখন তাকে কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার পরিবর্তে দেখা যায়, আত্মহননে উদগ্রীব হয়ে উঠতে। চাঁদ ওঠে রাত্রির আঁধার চিরে, আর যুবকটি ডুবতে চাইছে অন্তহীন আঁধারে! কি অদ্ভুত বৈপরীত্য! জীবনের সবকিছু থাকা সত্ত্বেও জোৎস্না রাতে, ঘুম ভেঙে যাবার পর, মড়কের ইঁদুরের মতো, সে কেন মৃত্যুকে বেছে নিল?

"বধূ শুয়ে ছিল--- পাশে শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল, আশা ছিল--"

আবার,"ঘুম কেন ভেঙে গেলো তার ?"
          "অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল!"
উপরিউক্ত পঙক্তিগুলোতে অপরূপ বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছেন কবি এবং অদ্ভুত রসাবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
"অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল"--কবি এই বক্তব্যেই বেশি জোর দিয়েছেন। তাইতো তিনি এরপর এই গভীর আন্তরিকতায় বলেন,"কোনদিন জাগিবে না আর!"

সবকিছু থাকা সত্ত্বেও যুবকটি কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নিলো ?
"উটের গ্রীবার মতো কোন এক নিস্তব্ধতা এসে
যেন তার জানালার পাশে।"
অথবা,
  "অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়----
  আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
  আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
  খেলা করে ;
  আমাদের ক্লান্ত করে,
  ক্লান্ত---- ক্লান্ত করে ;

     যুবকটির মৃত্যুর স্বপক্ষে কবি এসব যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। দুর্বহ জীবনের বেদনার ভার বইতে না পেরে দুঃসহ যন্ত্রণায় সে বিদ্রোহী হয়ে আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছে। উটের গ্রীবার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক অস্বাভাবিক রহস্যময়তা। চাঁদ ডুবে যাবার পর অদ্ভুত আঁধার নেমে আসে। আর তখন এই 'গ্রীবাও' মৃত্যুব্যঞ্জক হয়ে ওঠে। আলো হলো আস্তিক্য বোধের প্রতীক, চাঁদ যতক্ষণ আকাশে থাকে, জীবনের আশাও বেঁচে থাকে ততক্ষণ ; অনুভূতিও বেঁচে থাকে। কিন্তু যেই মুহুর্তে চাঁদ ডুবে যায়, অন্ধকার নামে, ভয়ঙ্কর স্তব্ধতায়,
আঁধারে জেগে ওঠে আত্মহননের জটিল অনুভূতি।

     এই আত্মহননকারী যুবকের ইচ্ছার বৈপরীত্যে কবি এঁকেছেন জীবনের প্রতি গভীর অনুরাগ ও ভালোবাসার চিত্র। মশা, মাছি, ব্যাঙ, পেঁচা, ফড়িং জীবনকে ভালোবেসেছে বলেই তারা, বেঁচে থাকার চেষ্টা করে।
রক্ত, ক্লেদ ও আবর্জনার মধ্যে যে মাছির বাস সেও রৌদ্রে,আলোতে উড়ে আসার চেষ্টা করে। ফড়িং মৃত্যুর শিহরণ উপলব্ধি করেও বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। অথচ প্রেম, প্রেয়সী, স্বপ্ন, শিশু, সম্পদ সব কিছু থাকা সত্ত্বেও যুবকটি মৃত্যুকে বেছে নিল! আর যখন সে আত্মহননের উদ্যত হয়, তখন কি অশ্বত্থের শাখা প্রশাখা প্রতিবাদ করেনি ? থুর থুরে অন্ধ পেঁচার জীবানুরাগ দেখেও কি যুবকটির বাঁচার সাধ জাগে নি ? আত্মহত্যার আগে সে ছিল প্রতিটি ঘটনার সংঘটক। কিন্তু মৃত্যুর পরে সে হয়ে গেল গল্পের উপাদান। কবি জীবনানন্দ দাশ শোনালেন সেই গল্পের কথা---

"শোনো
তবু এ মৃতের গল্প ; কোনো
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই ;"

জীবনের ব্যর্থতা, অসহায়তা, হতাশা, অবসাদ মানুষকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। অথচ এই যুবকের জীবনে এসব কিছুই ছিলনা। তার বিবাহিত জীবন সুখের ছিল, তার স্ত্রী ছিল তার মর্ম সহচরী। সে, "মধু আর মননের মধু দিয়েছে জানিতে"। এরপরেই কবি এসেছেন বোধের জগতে। সব মানুষের কাছে চাওয়া পাওয়া এক হতে পারে না, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে থাকে বিস্তর ব্যবধান। সব কিছু পাবার পরও আমাদের,"অন্তর্গত রক্তের ভিতরে"
বিপন্ন বিস্ময়ের জাগরণ ঘটে। যা আমাদের "ক্লান্ত, ক্লান্ত করে।" এই ক্লান্তির হাত থেকে মুক্তির সুতীব্র বাসনায়, হৃদয় জুড়াতে আত্মহত্যার এই আয়োজন।

কবি এই মৃত্যুকে সমর্থন করেননি। তাই তিনি বিদ্রুপ করে বলেন---
"জীবনের এই স্বাদ-সুপক্ক যবের ঘ্রান হেমন্তের বিকেলের/
তোমার অসহ্য বোধ হল ;
মর্গে কি হৃদয় জুড়ালো,
মর্গে ---গুমোটে
থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে।"
কবি মৃত ব্যক্তির মৃত্যু যন্ত্রণা অনুভব করেন। তার এই আত্মহননকে তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি নি। প্রকৃতিতে আমরা দেখি যেখানে খাদ্য ও খাদকের সম্পর্ক, সেখানেও সমস্ত প্রাণী, জঙ্গলে রাজত্বে বসবাস  করেও, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আরো কিছুক্ষণের জন্য বেঁচে থাকতে চায়! এমনকি ---
"গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
আরেকটি প্রভাতের ইশারায় --"
অথবা,
"মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসে।"
অথবা,
"রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি।"

     সমস্ত ইতর প্রাণীরাও আর কিছুক্ষণ বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু কবির বিরুদ্ধেও যুক্তি দেওয়া যায়। এইসব মনুষ্যেতর প্রাণীদের তো, মানুষের মতো ব্যথা-বেদনার ভার বইতে হয় না! তাই জীবনের প্রতি উষ্ণ অনুরাগ তাদের স্বাভাবিক। মানুষটির মৃত্যু হলে বুড়ো পেঁচা চোখ উল্টিয়ে দুই একটা ইঁদুর ধরার প্রস্তাব রাখে, জীবন সংগ্রামে নেমে পড়ে। সেই যুবকটির আত্মহত্যার কারণ কবির ভাষায়---

"জানি---- তবু জানি
নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়---
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে,
ক্লান্ত----- ক্লান্ত করে
লাশকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।"

      মৃত্যুচেতনার মধ্যে জীবনের যে হতাশা ও নৈরাশ্যবাদ রয়েছে তা "বেলা অবেলা কালবেলা" কাব্যের "তবু," "1946- 47", "পৃথিবীতে এই" প্রভৃতি কবিতায় তিনি মৃত্যুচেতনাকে অতিক্রম করে জীবনের আশাবাদের কথা বলেছেন। যেমন---

"তবুও মানুষ অন্ধ দুর্দশার থেকে স্নিগ্ধ আঁধারের দিকে
অন্ধকার হ'তে তার নবীন নগরী গ্রাম উৎসবের পানে
যে অনবনমনে চলেছে আজও---- তার হৃদয়ের
ভুলের পাপের উৎস অতিক্রম ক'রে চেতনার
বলয়ের নিজগুণ র'য়ে গেছে ব'লে মনে হয়।"
                                         (কবিতা-১৯৪৬--৪৭)

কপিরাইট সুরঞ্জন অধিকারী কর্তৃক সংরক্ষিত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন