সম্পাদকের কলমে


সম্পাদকের কলমে

সংকটকালের নতুন একটা সমার্থক শব্দের খোঁজ পেলাম তবে আমরা। করোনাকাল। সেই করনোকালে, মানুষের জীবন ও মৃত্যুর ভিতর ব্যবধান কমতে কমতে শুধু একটা হাঁচি কি একটা কাশিতে এসে দাঁড়িয়েছে। কিংবা হয়তো একটুকু ছোঁয়াই জীবন মৃত্যুর ভিতর ব্যবধান দূর করতে যথেষ্ঠ। না আমরা আর ছোঁয়াছুঁয়ির ভিতরে নাই। তাই চোখের সমানে একজন রুগীর এম্বুলেন্সে ওঠার প্রাণান্তকর চেষ্টা বার বার ব্যার্থ হতে দেখেও, মোবাইলে সেই দৃশ্য তুলতে থাকলেও। মানুষের ভিড় থেকে একজন মানুষকেও খুঁজে পাওয়া গেল না, রুগীকে এম্বুলেন্সে তুলে দেওয়ার। সকলের চোখের সামনে মনুষ্যত্বের ছোঁয়াটুকু পেল না বলে পথের ধুলোতেই গড়িয়ে গেল একটা অমূল্য জীবন। মানুষের প্রাণ বাঁচানোর কাজ যে প্রতিষ্ঠানের। সেই হাসপাতালের দোরগোড়াতেই। মানুষের সমাজ আজ মনুষ্যত্বের ছোঁয়াটুকু বঞ্চিত। না, এই অবস্থা একদিনে হয় নি। এই অবস্থার জন্য শুধুমাত্র করোনাই দায়ী নয়। দায়ী সমাজিক অবক্ষয়। রাজনৈতিক দূর্নীতির সীমাহীন দুর্বৃত্তায়ন। মানুষ থেকে মানুষের দূরত্ব যত বেশি বৃদ্ধি পেতে থাকবে, ততই মানুষকে এমন ভাবেই পথের ধুলায় জীবন দিতে হবে গড়িয়ে। অথচ মানুষের কথাই ছিল মানুষেরই সাথে থাকার। এই চিত্র কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একটা সামগ্রিক গ্যাংরিনের খণ্ডচিত্র মাত্র। মানুষের সাথে আর থাকে না মানুষ।


মানুষের সাথে থাকার আর এক নাম সহিত্য। জীবনের সাথে থাকার নামও সহিত্য। সেই সহিত্যেরই আর এক গালভরা নাম সাহিত্য। সাহিত্য বানানো গল্পের ফেনানো কাহিনী নয়। সাহিত্য আমদেরই জীবনের চালচিত্র। জীবনের ভিতরে যে জীবন। সেই জীবনের সীমাহীন দিগন্তের সুর লয় তাল, অসুখ অসঙ্গতি অভাব নিয়েই সাহিত্য। সাহিত্যের ভিতর দিয়েই আমরা খুঁড়তে পারি আমাদের গভীরতাকে। সাহিত্যের ভিতর দিয়েই আমরা বিস্তৃত করতে পারি আমাদের দিগন্তকে। সাহিত্যের ভিতর দিয়েই আমরা অর্জন করতে পারি আমাদের সুস্থতাকে। এই কারণেই ইতিহাস ও বর্তমান। সমাজ ও সংস্কৃতি সব কিছুকে মিলিয়ে নিয়েই সাহিত্য। যে সত্য ঘটনাটি উল্লেখ করেই এই আলোচনার সূত্রপাত। সাহিত্যেরও শুরু কিন্তু সেইখান থেকেই। প্রতিদিনের চলমান জীবন। চারপাশের প্রবাহমান সময়। আবাহমান ঐতিহ্য উত্তরাধিকারের সংস্কৃতি নিয়েই সাহিত্যের কাজ। এসব কিছুর বাইরে সাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতা থাকুক আর নাই থাকুক, কোন প্রয়োজন নাই নিশ্চিত।

করোনাকাল আর মনুষ্যত্বের সংকট যখন সমার্থক হয়ে ওঠে, সর্বাত্মক ছাপ রাখতে শুরু করে জীবনের পরতে পরতে। তখন সাহিত্যের কাজ কি হবে? হতে পারে? সুসময় ফিরে আসার অপেক্ষায় হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা। চুপ করে? না’কি, জীবন ও মৃত্যুর সেই সূক্ষ্ম ব্যবধানে দাঁড়িয়েই মৃত্যুর ক্যানভাসেই জীবনকে তার সত্যমূল্যে উপলব্ধি করা? জীবনকে তার সত্যমূল্যে উপলব্ধি করতে গেলে অনেক বড়ো সাধনার প্রয়োজন। যেমন সন্তানের মা হতে গেলে নারীকে অনেক বেশি যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। তেমনই জীবনের ভিতে সাহিত্যকে ধরতে গেলেও প্রয়োজন সেই সাধনার। বেদনাকে সহ্য করতে পারাই সেই সাধনার একমাত্র পথ নয়। বেদনাকে জীবনের সত্যের ভিতরে দিয়ে আনন্দের সাথে মিলিয়ে নিতে পারাই সেই সাধনার পথ। এই কারণেই সঙ্কটকাল যত বেশি পরিব্যাপ্ত হয়ে ওঠে, আমাদের সাহিত্যবোধের দৃষ্টি তত বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। খুলে যেতে থাকে এক একটি নতুন থেকে নতুনতর দরজা।

ফলে এটা মনে করার বিশেষ কোন কারণ নাই। সংকটকাল বা করোনাকাল সাহিত্য করার সময় নয়। বরং সাহিত্যের সত্যে এই সময়কে পরখ করে নিয়ে দেখতে হবে, সত্যই কতটুকু এগোলো আমাদের মানব সভ্যতা। না, কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে তার বিচার করা যায় না। কিন্তু ঘটনার পরম্পরার ভিতর দিয়ে একটি একটি করে পাপড়ি খসানোর মতো, একটু একটু করে আমাদের স্বকল্পিত বিশ্বাসের অন্ধত্বের মোহভঙ্গের ভিতর দিয়ে সম্ভব হতে পারে সেই কাজ। ঠিক এই সময়ের জন্য না হলেও অন্তত পরবর্তী সময়ের জন্য তো বটেই। সমকাল অধিকাংশ সময়েই গান্ধারীর মতো চোখে কালো ফেটি বেঁধে রাখে। ফলে তার পক্ষে কোন কিছু স্পষ্ট দেখা খুবই দুরূহ। আর ঠিক সেইখানেই সাহিত্যের কাজ। সমকালের চোখে বাঁধা সেই কালো ফেটি খুলিয়ে দেওয়া।

আমরা যদি চিরকালের সাহিত্যের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই। মনে হয় এরকমই দেখতে পাবো। সাহিত্য শুধুই গল্প বলে না। কবিতা আবৃত্তি করে না। কিংবা নাটক মঞ্চস্থ করে না বিনোদনের নিমিত্তে। সাহিত্য সমকালকে স্পষ্টতর করে তোলে। বিভিন্ন কালের প্রেক্ষিতে তার তুলনামূলক অবস্থানের আলোচনা করে। যার ভিতর দিয়ে শুধুই যে অন্ধকারে আলোর রেখাই খুঁজে পাওয়া যায় তাই নয়। অন্ধকারের গভীরতা ও তার সরূপও উদ্ঘাটিত হয়। সেখানেই সাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতা। সেখানেই সাহিত্যের সাথে আমাদের সহিত্ব। জীবন ও জগতের।  

গোটা বিশ্বই এক বা একাধিক রংরুট ধরে এগিয়ে চলেছে। না এটা আসলেও কোন এগোনোও নয়। সমায়ের নিরিখে এগোন। কিন্তু সময়ের নিরিখে এগোনো হলেও মানবতার নিরিখে যে এগোনোই হবে, বলা যায় না তেমনটা। আর পথটা যদি রংরুট হয় তবে তো কথাই নাই। সে এগোনো পেছোনোর অধিক। সমাজতন্ত্রের পতনের পথ ধরেই কি এই রংরুটের সূচনা। হয়তো তাই। কেননা বিশ্বজুড়েই গণতন্ত্রই এখন গভীর সংকটে। মিডিয়ার প্রচার নির্ভর এই গণতন্ত্রের প্রাণভোমরাই হলো মিসইনফর্মেশন আর ফেক নিউজ। গণতন্ত্রের কফিনের উপরে দাঁড়িয়েই ছড়ি ঘোরাচ্ছে ধনতন্ত্র। ধনতন্ত্র মূলত সেইটিই করে থাকে। কারণ প্রকৃত গণতন্ত্রে কখনোই ধনতন্ত্র সফল হবে না। সফল হবে একমাত্র মেকি ছদ্মবেশী গণতন্ত্রেই। কিন্তু বিশ্বজুড়ে মানুষের সেই মেকি গণতন্ত্রের রংরুট ধরে এগোনোর প্রয়াস আসলেই যে একটি ছেলেভুলানো ছড়া, সেই সত্যের দিকে মানুষের দৃষ্টিকে প্রসারিত করাও সেই সাহিত্যেরই অন্যতম প্রধান একটি কাজ। তাই যাঁরা মনে করেন, আমরা সাহিত্যে আছি। রাজনীতিতে নাই। আসলে তাঁরা সাহিত্যও বোঝেন না। রাজনীতিও বোঝেন না। এও বোঝেন না যে, তাদের চলাচল তাই রংরুট ধরেই।

ত্রৈমাসিক রংরুট তাঁদের জন্যেই। তাঁদের চোখের কালো ফেটিটি খুলে দেওয়ার প্রয়াসেই রংরুট ওয়েব জার্নালের জন্ম। কিন্তু রংরুট ধরে ঘুরপাক খাওয়া এই সময়ে অধিকাংশ মানুষের চোখের পটি খুলে দেওয়ার ক্ষমতা কোন একটি পত্রিকার কাজও নয়। সম্ভবও নয়। সেই দাবি করাও মানসিক অসুস্থতার বেশি কিছু নয়। আমরা সেরকম দাবি করিও না। কিন্তু বিভিন্ন দিগন্তে কাজ করতে থাকা, অনেকের নানবিধ প্রয়াসের ভিতর দিয়েই অসম্ভবও হতে পারে সম্ভব। ত্রৈমাসিক রংরুট সেই অসংখ্য ছোট ছোট ক্ষুদ্র প্রয়াসের একটি। তাও তার শৈশবে। ফলে ইচ্ছা থাকলেও আমাদের সীমিত সাধ্যে অপূর্ণ রয়ে যায় অনেকটাই। প্রথমত এই করোনাকালে সম্পূর্ণ একটি সাহিত্যসংখ্যা করার পরিকল্পনা নেওয়াই একটি দুরূহ কাজ। তারপর আমাদের সীমিত সাধ্যে সে কাজ কার্যকর করা সত্যই আরও কঠিন। সাধ ও সাধ্যের মধ্যে যে দুরপনেয় দূরত্ব রয়ে যায়, সে বেদনার ভার কম নয়। তবুও যেটুকু প্রয়াস শেষ অব্দি এই সাহিত্যসংখ্যার দুই মলাটের ভিতর সমন্বিত করা গেল, সেটুকুই আমাদের অর্জন। অনেকটা কেন বেশিরভাগটাই অধরা মাধুরীর মতো কল্পনায় রয়ে গেলো। যেটুকু পরিবেশন করা সম্ভভ হলো, আশা করবো। সেই সামন্য অঞ্জলিতে আমাদের পাঠকবর্গ কিছুটা হলেও ভাবনা চিন্তার সামান্য খোড়াক পাবেন। অনেকটা মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়ের মতো এই সামান্য সম্ভার। তবু আমরা চেষ্টা করেছি, এই সময়ের বেশ কজন চিন্তাশীল লেখক লেখিকাদের সমাজ সময় সমকাল বিষয়ক ভাবনাচিন্তাকে তাঁদের সাহিত্যবোধের পরিমিতিতে ধারণ করে পাঠকের সমীপে পৌঁছিয়ে দিতে। আর সেই উদ্দেশ্যকেই সমানে রেখে, গোটা সংখ্যাটিকে আমরা দুটি ভাগে উপস্থাপন করেছি। প্রথম ভাগে এক ডজন প্রবন্ধ, আর দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে সমসাময়িক বিশেষ কয়েকজন লেখক লেখিকার সাথে একান্ত সাক্ষাৎকার। সংখ্যাটি ভালো লাগুক মন্দ লাগুক, আমরা পাঠকের মতামতের প্রত্যাশী। আমদের কৃতজ্ঞতা, সংখ্যাটিকে পরিপূর্ণ করে তুলতে যাঁরা আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। লেখা দিয়ে। সাক্ষাৎকার দিয়ে। তাঁদের প্রতি।

কপিরাইট বংরুট কর্তৃক সংরক্ষিত



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন