ব্যাপ্তিময়
আত্মোন্মচনের কবি বিভাস
কবিতা
একটা মুহূর্তের হলেও মুহূর্ত মহাকালেরই অংশ। সুতরাং মুহূর্তই মহাকালেরই সমষ্টি।
প্লেটো Timbacus
গ্রন্থে
বলেছেন : Moving
Image of eternity. সমস্ত ছবিই মহাকালের অন্তর্ভুক্ত। তেমনিভাবেই ব্যক্তি ব্যষ্টির অংশ।
ব্যষ্টি শাশ্বত প্রবহমান জীবনাচার । মানবসমষ্টি । কবি বিভাস রায়চৌধুরী এই
মুহূর্তের উত্থানেই মহাকালের দরোজা খুলেছেন ।
ব্যক্তি-অনুভূতির
প্রচ্ছায়ায় চিরন্তন মানব-অনুভূতির কথাই বলেছেন। তাই তাঁর চেতনা ও জাগরণে স্বপ্নকে, ইহজন্ম এবং
পূর্বজন্মকে একসঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন। তাঁকে যেমন মেঘের মধ্যে দেখি, তেমনি বৃষ্টির মধ্যে, মাটির মধ্যে, গাছের মধ্যেও তাঁর
সর্বাত্মক ব্যাপ্তির চলাচল থাকে। তাঁর কবিতা শুধু পার্থিব দেনা-পাওনায় বন্দি
থাকেনি,
তা
পরিব্যাপ্ত হয়েছে অপার্থিবতায়, রহস্যে, ভাষাহীন অগোচরের বোধে। খিদের মতো জৈববৃত্তিও আবহমান
মানবচরিত্রে রূপ পেয়েছে অনপনেয় প্রবৃত্তি হয়ে। নিজেকে “উদ্বাস্তুর ছেলে" বলেও
এই বিশ্ববোধের দূরে সরে থাকেননি। সমস্ত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় তাঁর কবিতার সংলাপগুলি
নিজের সঙ্গেই কথা বলা মনে হয়েছে।
প্রথম
কাব্য “নষ্ট প্রজন্মের ভাসান" (১৯৯৬) কাব্যে খড়কুটো ধরে বেঁচে থাকার আর্তি
আর নিজেকে নিয়ে অস্থির এক মনখারাপের ভেতর কবির প্রবেশ। নিজেকে চেনার, সময়কে চেনার ভেতর
কবির আত্মঅন্বেষণের এক মহাজাগতিক প্রশ্রয় দেখতে পাই। “শোক খুঁটে খেয়ে বেঁচে
আছি" বললেও আত্মঘাতী স্পর্ধায় মহাশূন্যের ভোজে নিজেকে উৎসর্গ করার প্রক্রিয়াটি
শুরু হয়েছে। মৃত্যু, পুনর্জন্ম এবং পরজন্মের পথগুলি দেখতে পেয়েছেন। গতিময় বহুমুখী
জীবন-প্রত্যয়ের ভাষাও পেয়েছেন । চেতন-অবচেতনে গড়িয়ে গেছেন জৈব অনুভূতির ক্রিয়ায়।
ব্যাপ্তির সংরাগে বস্তু-নির্বস্তু সব তফাত মুছে ফেলেছেন। “দায়" কবিতায় কবি
বলেছেন :
“আত্মোন্মচনের মতো
জ্যান্ত ঘূর্ণিঝড় পাক খেতে থাকে… ওঃ!
আমার
তারাবমি হবে…
আমার
বৃক্ষবমি হবে…
মা, আমি
কবিতাসম্ভাবা!"
“কবিতাসম্ভাবা"
হয়ে ওঠার পেছনে বহু জন্মের ঘুম-জাগরণ এবং “অস্তিত্বের মধ্যে আর এক অস্তিত্বের
নড়াচড়া" টের পান। পাতালের আর্তনাদ, সময়ের বিভ্রান্তি এবং ভয় ও
ভালোবাসা কবিকে এই প্রেরণা এনে দিতে থাকে। ক্রিয়াগুলি চরিত্র, বিশেষ্যগুলি
অস্তিত্বের প্রাণময় ব্যঞ্জনায় উত্তেজিত। কবি এভাবে টের পান :
“তৃষ্ণা তাড়া করছে
ঝরনাকে…
বাঁশি
তাড়া করছে সুরকে…
ঘর তাড়া
করছে জানালাকে…
বিষ
তাড়া করছে চুমুককে…"
তখন
উন্মুখ কবির অস্থির গোঙানি শুরু হয়, কবিতার বীজতলার দিকে এগিয়ে যান। “সম্পূর্ণ নতুন
উপত্যকা" জেগে উঠতে দেখেন। ওকে যতই “নষ্ট" বলা হোক, সে তো “আগুন আর
সেতুর" সন্তান। এই "আগুন" আর “সেতু" দুইই আত্মোন্মচনে নিজেকে
সভ্যতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার ধারা। আগুন ব্রহ্ম উপাদানের অংশ। রবীন্দ্রনাথ একটি
সমর্পণের গানে গেয়েছেন :
“ওরে আগুন আমার ভাই
আমি তোমারই জয় গাই।"
আগুনের
এই জয় যে আগুনের মতোই লেলিহান উত্থানে মিশে যাওয়া এবং প্রকাশ হওয়া তা বলাই
বাহুল্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ফ্রান্সের সেনানায়ক তাত্ত্বিক ফার্দিনান্দ ফচ্
এই আগুন সম্পর্কে যে মূল্যবান কথাটি বলেছিলেন The principles of war গ্রন্থে তা হল : The most powerful
weapon on earth is the human soul on fire. কবি বিভাস রায়চৌধুরীও
জীবনযুদ্ধের সৈনিক হিসেবে সভ্যতার সেতুতে অগ্রসর হয়েছেন এই আত্মপ্রজ্জ্বলিত আগুনের
ক্রিয়াসংযোগে। রক্ত-মাংসের ভ্রূণে জেগে উঠতে চাইছে তাঁর রূপ। সুতরাং তার পরিচর্যা
চায়। বাস্তব পরিস্থিতির মোকাবিলা করে তাঁকে বেঁচে থাকতে হবে। সেই জন্য স্পষ্ট
বক্তব্য কবির :
“চাই না রোদ-বৃষ্টির
উজ্জ্বল মুকুট
চাই না ডানাঅলা পাখির সংগীত-প্রতিভা
চাই না নদীর আনমনা প্রাণ,
চাই না, চাই না লোকে বলুক, 'ওই দ্যাখ হেঁটে
যাচ্ছে কবি'
"
কবি চান
একটু বেঁচে থাকতে আর দু'চোখ দিয়ে দেখতে। কবিকে এই মফস্সল সীমান্ত শহর স্বীকৃতি
দিক।
“নষ্ট প্রজন্মের
ভাসানে"ই স্পষ্ট হয়ে গেছে কবির আকুলতা কোথায়, কোথায় তাঁর স্থিতি ও প্রজ্ঞা।
ছিন্নমূল জীবনের প্রত্যয়দগ্ধ যাপনের নিরন্তর গতিতে কবি দেখেছেন চারিদিকে ব্যঙ্গ
বিদ্রুপের কোলাহল। শরীরে আত্মসত্তার বিনীত উপলব্ধিগুলি পিঁপড়ে হয়ে নেমে এসেছে।
ঘরময় বিষণ্ণ ক্রোধপাতের চিহ্নে মিশে গেছে। এক আমি সহস্র আমির রূপে কবি ছড়িয়ে
গেছেন । প্রাণীতে-উদ্ভিদে, পুষ্পে-প্রজাপতিতে এবং বেঁচে থাকা ও আত্মহত্যার ক্রিয়ায়
বিভাজিত হয়েছেন । সীমান্ত শহরের দারিদ্র্য, ক্ষুধা, শরীর বিক্রি, পাচার হওয়া, গুলি খাওয়া সবই কবি
দেখেছেন। সেই অন্ধকার আর মূল্যবোধের অবক্ষয় বোধের দরোজায় বারবার ধাক্কা দিয়েছে।
কবি কোনো
রাজনৈতিক দলেই সামিল হতে পারেননি। কোনো সামাজিক নিরাপত্তাও কবির নেই। কোনো
সম্প্রদায়ও স্বীকার করেন না। শুধু এক বুনো ষাঁড়ের খ্যাপা দেবতা কবিকে চালিত করে।
দেশ-ধর্ম-সম্প্রদায় হারা মানবব্যাপ্তির মহাযজ্ঞে নেমেও কবি অসহায় বোধ করেছেন। তাই
রুগ্ন মৃত্যুপথযাত্রী মা-কে বলতে পারেননি “মাগো, এই তো আমি —"
যে কবি
সময়ের ঘাতকের কাছে অস্ত্র ধরে দাঁড়াবেন, সে কবি যে নিজেই আত্মঘাতী, নিজেই অসুস্থ, নির্বীর্য হয়ে উঠেছেন
। বেদেনীর সন্তানের মতো মনে হয়েছে নিজেকে। সাপের সঙ্গে (প্রবৃত্তি = সাপ), মৃত্যুর সঙ্গে খেলতে
খেলতে কবির এই উদয় শুধু সাহিত্যে নয় ; যুগের ইতিহাসে, সময়ের ইতিহাসে, মূল্যবোধের ইতিহাসে
এক বিবর্তনের সূচনা করেছে। বাংলা কবিতায় নব্বই দশকে যে পরিবর্তন দেখা দিয়েছে তার
সমূহ বৈশিষ্ট্যেই আমরা বিভাস রায়চৌধুরীকে পাই। গ্রামজীবনের, উদ্বাস্তু জীবনের
বেদনাময় কান্না শুনতে পাই। হাহাকার শুনতে পাই, সর্বোপরি জীবনের ভাঙন ও বঞ্চনা
কতখানি তীব্র তা উপলব্ধি করতে পারি।
“উদ্বাস্তু শিবিরের
পাখি"(১৯৯৬) বিষণ্ণঘোর জীবনের পাঠশালায় প্রেম ও কুয়াশায় অস্তিত্বের অন্বেষণ
কবিকে তাড়িত করেছে। “দ্রুতদৌড়ে একটি ঘোড়া অস্ফুট আলোর ভেতর হারিয়ে ফেলল শরীর…" এই শরীর
হারানোর পরও আত্মার ঘুম আসেনি, 'জীবনের দুর্দান্ত গন্ধ' বয়ে ফিরে ফিরে চেয়ে থেকেছে।
মেয়েদের সাংঘাতিক পূর্বরাগেও ধরা দেয়নি। সতীশ মাস্টারের পাঠশালায় প্রেম শিখেছিল
ঠিকই, কিন্তু চাকরি হয়নি
বলে প্রেমও সার্থকতায় পৌঁছয়নি। দিন-আনি দিন-খাই জীবনে “ভালবাসি ভালবাসি" বলে
“হু-হু কেঁদেছিলাম একদিন"। এসব তো পাণ্ডুলিপি জানে। যা কিছু দুর্বলতার
মুহূর্ত সবই পাণ্ডুলিপি জমা রেখেছে। সেই পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে কবির বক্তব্য :
“দিন-আনি, দিন-খাই একটা জীবন
যখন নিজেকে তুচ্ছ করে
পাণ্ডুলিপি বাঁচায় —
সে অভিজ্ঞতা কী করে
বোঝাব?"
সে
অভিজ্ঞতা বোঝানো যায় না, স্বাভাবিকভাবেই বিষণ্ণ শববাহকদের সঙ্গে কবির দেখা হয়েছে।
নিজেই নিজেকে দাহ করেছেন :
“জীবনে প্রচণ্ড আস্থা
আছে, তবু মনে হয়
আমি আমারই শবদেহ পুড়িয়ে ফিরছি…"
বর্তমানে
যে “উপজন্ম" নিয়ে কবি চলেছেন সেখানেও নিছক স্বপ্ন নেই, স্বপ্নের ষড়যন্ত্র
আছে। আত্মিকসংকটের মতো কবিকে গ্রাস করেছে এক শূন্যতার দুর্মর অভিক্ষেপ । তাই নিজের
মৃত্যু বহন করা থেকে দাহ করা, অথবা কুকুরের মুখে লাশ হয়ে উঠে আসা — সবই স্বয়ংক্রিয়
অবক্ষয়ী বিবর্তন। যেখানে মূল্যবোধহীন সমাজই কবিকে ঘিরে আছে।
তবু এক
রোমান্টিকতার বাতাবরণের ভেতর নিজের আশ্রয়টির দিকে কবি ফিরে যেতে চেয়েছেন। ঝুঁকে
থাকা মাথাভাঙা চাঁদের রহস্য জাগানো কখনো ফুরোয় না। নৌকার উপর গাছের ঝুঁকে থাকা, চাঁদে চাঁদ লাগা, স্বয়ং রহস্যের গায়ে
এঁকে নেওয়া মাছ কেউকেই বোঝানো যাবে না। চিত্রলিপির রহস্যময় বোধের দরোজায় কবি
একাকী দাঁড়িয়ে থাকেন। দেশভাগের বেদনা, উদ্বাস্তু জীবন কবির উপলব্ধিকেও উদ্বাস্তু করে
দিয়েছে। তাই আত্মপ্রশ্ন আর্তপ্রশ্ন হয়ে বেজে উঠেছে :
“ওই নৌকা, ওই চাঁদ, জলে জলে রহস্য
জাগিয়ে
আমাকে
বঞ্চিত করো?
দেশ
ভাগ?"
এই
বেদনাই চারিত হয়েছে শব্দে শব্দে তরঙ্গের মতো। বিচ্ছিন্ন মনে হয়েছে ভেসে যাওয়া
মেঘকেও। কেননা সে-ও ভাষা হারা, ওর-ও বন্ধু নেই। ওপার বাংলার শেকড়ের টান বারবার ব্যথিত
করেছে। মুজিবর রহমানের ডাকও তাঁর চৈতন্যকে উদ্বেলিত করেছে। সব প্রেম-প্রেরণা, ভালোবাসা, মুগ্ধতা, শক্তি-সামর্থ্যকে
বিভাস আগুনের উপমায় ব্যঞ্জিত করেছেন। কবিতায় বারবার লিখেছেন :
১.
আগুনের প্রতি আমার অসম্ভব ঝোঁক
২.
আগুনের সীমান্তে প্রচণ্ড বেঁচে থাকা
৩. আগুন, তোমার সমর্থনে আমি
এক সন্ধেকে খাড়া করব
আগুন যে
একটা সময়েরও পরিচয় এবং পরিস্থিতির প্রতি কবির নির্দেশ তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নানা
অসামঞ্জস্য আর ক্ষুণ্ণিবৃত্তি জীবনের সঙ্গে পরিচিতি ঘটতে ঘটতে আগুনের নির্মিৎসা
পর্যাপ্ত হয়ে ওঠে কবির জীবনে। মৃত্যু আর জীবনকে চিনতে শেখেন ।
“কালোপূর্বরাগে"র পর্যায়ে লেখেন :
“ঘন ঘন রাত্রি নামে… রাত্রি এলে স্বপ্ন
জমে যায়,
চা খাচ্ছ, চায়ের কাপ বাংলা
জানে, শহীদ পাঠায় —
দু'চোখে দেশলাই যেই, দাউ দাউ চায়ের
বাগান।"
ভাষাবিপ্লবী
আর জীবনবিপ্লবীর এখানেই মেলবন্ধন ঘটে। কবি যা নিজের অভিজ্ঞতায় পেয়েছেন।
বিভাস রায়চৌধুরীর অন্যতম একটি
বৈশিষ্ট্য হল ভাষাপ্রেম। বাংলা ভাষা তাঁর প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাসে মিশে আছে।
শিরা-ধমনীতেও প্রবাহিত হয়। আবার প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানেই বাংলা ভাষা উচ্চারিত
হয়। বৃষ্টিধারা,
মেঘ, শিশির বিন্দু, জলকণা, ঘাস-ফুল-পাখি এবং
উদ্ভিজ্জ সবাই বাংলা ভাষা জানে। রাত্রির অন্ধকার থেকে সূর্যালোকের প্রতিটি তরঙ্গ
বাংলা ভাষায় কবিকে ডাক দেয়। বাংলাদেশ আর বাংলা ভাষা সমগ্র হৃদয় জুড়ে বিরাজ করে
কবির।
“শিমুলভাষা, পলাশভাষা"(১৯৯৯)এমনি
একটি কাব্যগ্রন্থ যেখানে ভাষাই সমগ্র সত্তাকে অধিকার করে থাকে। এখানেই কবি ঘোষণা
করেছেন : “মৃত্যুর ভেতরে লিখি".... মৃত্যুর ভেতরে লেখা তো সহজ নয়, যখন নিজেকেই বাংলা
ভাষা করে তোলেন কবি, তখনিই তা লেখা হতে থাকে। বাহান্ন সাল বা একাত্তর সাল জুড়ে যে ভাষা
আন্দোলন এবং স্বাধীনতার যুদ্ধ ঘটে গেছে ; সেই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণকে স্মরণ করেই আত্মস্থ হয়ে
কবি লিখলেন :
“ভাষার মগজ ভেসে আসে।
সকালবেলা।
বাহান্ন
বা একাত্তর,
আমাদের
নব্বইয়ের ভাষা।"
যে
যুবক-যুবতীর প্রাণের বিনিময়ে ভাষা রক্ষা পেল, দেশ রক্ষা পেল, মানুষ তাদের অধিকার
ফিরে পেল —সেই ভাষাই তো কবির ভাষা। প্রাণের পিপাসা সেখানে জেগে ওঠে। স্বপ্ন জেগে
ওঠে। ভালোবাসা ও প্রেম জেগে ওঠে । কবি পাহারা দেন। ভাষাকে রক্ষা করার সংকল্প নেন।
কবিতায় লেখেন :
“বুকের ভেতর আমি আগলে
আগলে রাখি ভাঙাবুক
ভাঙা
বাংলা জোড়া লাগলে সেরে যাবে আমার অসুখ…"
হৃদয় থেকে
বাংলাকে কেউই বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। রাজনৈতিকভাবে ভূখণ্ডকে ভাঙা যায়, কিন্তু ভাষা ও
হৃদয়ের উচ্চারণকে আলাদা করা সম্ভব নয়। তাই বারবার ফিরে আসে বাংলাকে একটি বাংলাতেই
পরিণত করার আবেদন।
নব্বই দশক মূলত বিপ্লবীচেতনাকে শানিত করার
দশক। এই দশকেই মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটেছে। পরিবার, সমাজ, দেশ, জাতি ও ব্যক্তিভাঙনের কাল শুরু
হয়েছে। Crisis
of identification দেখা দিয়েছে । তাই সমস্ত রোমান্টিকতা Anti-Romantic হয়ে ফিরে এসেছে
অনুভূতিতে। এই দশকেই বিভাস লিখেছেন :
"নব্বই দশকে চাঁদ
মৃত্যুর প্রতীক"
না, প্রেম নয়, দুধভাত খাওয়ার বাটি
নয়, কপালে টিক নয়, আত্মহত্যা করার
প্রবণতা জেগে উঠেছে চাঁদের আলোয়। শুধু কবিতাতেই নয়, “অশ্রুডানা" নামক উপন্যাসেও
যুগের অসফল অসম প্রেমিক-প্রেমিকা চাঁদের আলোয় আত্মহত্যার প্রেরণা পেয়েছে। এক পরম
শূন্যতা বা নাথিংনেস্ তাদের চালিত করেছে। জাঁ পল সার্ত্রের মতো তাদেরও মনে হয়েছে :
It is
therefore senseless to think of complaining since nothing foreign has decided
what we live, or what we are. কবি দেখলেন সমগ্র দেশটাই “আত্মহত্যাপাড়া" :
“সব হচ্ছে জানা কথা, সব কথা ঘুরছে
মোড়ে-মোড়ে
আত্মহত্যাফুল
ফোটে দ্যাখো সব কবির ভেতরে"
স্বাভাবিকভাবেই
অন্ধকারের ভেতর ভবিষ্যৎহীন একটা যুগের চলা শুরু হয়েছে যা “নিয়তির মতো"।
“মৃত্যুপাগলা" কবির মতো বিভাসও Automatic writing হয়ে গেছেন আর ঘোড়া হয়ে ছুটে
চলেছেন সমস্ত রাস্তায়। ঘোড়ার ভাষাও বাংলা, ঘোড়ার স্মরণীয় দিনটি “একুশে
ফেব্রুয়ারি"।
নব্বই
দশকে নানা অভিঘাতের মধ্যে বেঁচে থাকার প্রশ্নটিই বারবার জেগে উঠেছে। বেদনার শেষ
হয়নি কখনো। মৃত্যুর পরও মৃত্যু এসেছে। হাঁড়িতে চাল পড়েনি। অনাহার ক্লিষ্ট জীবনের
সেই ধূসর ক্লান্ত দিনগুলি জীবন শেষ করে দিতে চেয়েছে। যে কবি ভাতের বদলে ভাটিয়ালি
লিখে চলেছেন,
স্বপ্নের
বদলে মৃত্যু লিখে চলেছেন —কে তাঁর মূল্যবোধ ফিরিয়ে দেবে? বাংলা-প্রেমে, বাংলার প্রেমে
জীবনের ব্রত হলেও কবিকে তো দরিদ্রই থাকতে হয়েছে :
“এত এত ধানক্ষেত, এত এত বাংলাদেশ লিখে
ভাতের
হাঁড়ির কাছে জব্দ, ভাত নেই কোনোদিকে!"
নব্বই
দশক বিশেষ করে গ্রামের প্রান্তিক জীবনের কবিদের কাছে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা দান করেছে।
চাকুরিবিহীন,
আশা-আকাঙ্ক্ষাবিহীন, প্রেমিকাশূন্য
জীবনের অন্তরাকে বাজিয়ে তুলেছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত বাঁচার আকুলতা নিঃশেষ হয়নি
তবুও। বিভাসের উচ্চারণে ধরা পড়ে :
“আমি ওই পাখিকে কখনও
অনুমতি দেব না মৃত্যুর….."
এই
সিদ্ধান্তই বাঁচিয়ে দিয়েছে সদর্থক চেতনাকে। কবিরা আবার ফিরে এসেছেন জীবনের কাছেই।
আর খুঁজে পেয়েছেন লেখার আবেগ :
“আমার অক্ষর খ্যাপা, আমার আবেগ চইচই…"
এই আবেগ
আছে বলেই আরও জীবনপ্রত্যাশী করে তুলেছে কবিকে। যে অভিজ্ঞতার সঞ্চয় কবি করেছেন
তাতেই লিখনপ্রয়াসী হয়ে উঠেছেন। “মাথার ভেতরে গুজবের মতো আসে কবিতার" এখানেই
স্বয়ংক্রিয়তা পেয়েছেন । “জীবনানন্দের মেয়ে"(২০০২)কাব্যে আরও ব্যাপ্তি পেয়েছে
কবির কলম । এই কাব্যেই প্রতিটি অপমানের আয়না ভেঙে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। শরীর
ক্ষততেই সারিয়ে নিয়েছেন। সংগ্রামী দৃপ্ত “বেঁচে থাকার কারণটা কী" তা বুঝিয়ে
দিয়েছেন বিভাস। কবিতাকে জাগিয়ে দিয়েছেন এখানেই । মুগ্ধতার কাছেও আত্মসমর্পণ
করেননি। বরং শরীরই মন্দির হয়ে উঠেছে প্রেমের, পূজার, কবির বসতের । তাই লিখেছেন :
" শরীর স্বভাবকবি ।
এস প্রেম, প্রেরণা যোগাই…"
দুঃখ
পাওয়াও এখানে পরমপ্রাপ্তি হয়ে এসেছে। চোখে মোমবাতির আলো জ্বলে উঠেছে। মনে বিষাদের
তরবারি। মৃত্যুমেঘে শরীর নির্মাণ । কবিতা-রাক্ষসের কাছে গ্রস্ত হন। কবি জানেন “দিন
আসছে"।“আজ শুধু ভালোবাসা হোক"। বাড়ি বাড়ি আত্মহত্যা ছোঁড়া স্বদেশ
কোনো শফথের ডাকও দিচ্ছে। এই কাব্যেই ফিরে এসেছেন শক্তি-সুনীল-শঙ্খ-বিনয়-ভাস্কর-জয়
বাংলার কবিগণ। তাঁদের সেইসব স্মরণীয় কবিতারা বিভাসের কবিতার শিরোনামে বসেছে আর
সেইসব শূন্যতার কাছে উত্তর চেয়েছে।
জীবনের
কাছে জীবনের উষ্ণতার সম্মোহন কতটা আত্মমগ্ন পথে প্রবাহিত, কতটা মেদুরতায় স্পর্শ করতে পারে
—বিভাস তা দেখিয়ে দিয়েছেন। জীবনানন্দের না-ছাপা কবিতাকে দিয়েছেন নিজ সত্তার
উপলব্ধির মেয়েকে যা কারও চেতনায় কখনো করাঘাত করেনি। যে মেয়েটি বলেছে : “যে কোনো লেখার পাশে দেখবে আমার এই একলা হেঁটে
যাওয়া"... আমাদের বিন্যস্ত জীবনে নয়, বরং সভ্যতার কদাচারী ঘৃণিত
অবহেলিত জীবনের মর্মবিদারী মর্মচ্ছটায় তার অবগাহন। ঘুরে দাঁড়াবার, প্রতিবাদ করবার ভাষা
পেয়েছেন বিভাস :
“বাঙালের ছেলে কবিতা
লিখছি,
এটাই
আমার চোখরাঙানি"
আশ্চর্য
শব্দক্ষমতার অধিকারী বিভাস। পর্ব-পর্বান্তরে ছন্দময়তায় এক সিঁড়িভাঙাপথ তিনি নির্মাণ
করতে পারেন। পূর্ণচ্ছেদ ব্যবহার করেন, আবার করেন না-ও। তন্দ্রাচ্ছন্ন ইমোজিস্ট কবিকে
কোথাও মেটাফোরিক অনুভাবনায় গড়াতে দেখা যায়। কখনো বাস্তব চিন্তনের ভেতরও ঘোর
রহস্যের বাতাবরণ সৃষ্টি করেন। তাঁর অস্তিত্বের নিবিড় সংশ্লেষে বেদনাক্লান্ত
হাহাকার ধ্বনিময়তায় আশ্রয় পায় । ব্যাপ্তি আর স্বয়ংক্রিয়তায় কবি পর্যটন সারেন ।
পরবর্তী
কাব্যগুলি এইসব প্রক্রিয়াকেই আশ্রয় করেছে। চণ্ডালিকা গাছ(২০০৬), যখন ব্রিজ পেরোচ্ছে
বনগাঁ লোকাল (২০০৮), পরজন্মের জন্য স্বীকারোক্তি (২০১১) ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থগুলি কবির
পরিপার্শ্ব জীবনাবেগের সঙ্গে আত্মক্ষরণের গভীর সংযোগ স্থাপন করেছে। অনেকাংশেই কবি
মিতবাক্,
দার্শনিক
এবং বোধের সংজ্ঞাবাহী তীব্র শব্দসঞ্চারী শিল্পী । তথাকথিত যুগের গড্ডালিকা প্রবাহে
গা ভাসিয়ে কখনো পোস্টমডার্ন ধারাকে অনুসরণ করতে চাননি, অথচ কবিতায় একটা নতুন ধারা
এসেছে। যে ধারা প্রতিক্রিয়াশীল মননে সর্বদা টংকার তুলতে সক্ষম। বিভাস “চণ্ডালিকা
গাছ"-এ লিখেছেন :
“বোবা আয়নার চোখে
যে-কোনো প্রেমিক মৃত"
এই
কবিতার ভাষা একেবারে দার্শনিকের মতো। কোথাও মেদ নেই। প্রতিটি শব্দ ওজন করে বসানো।
আর একটি কবিতায় লিখলেন :
“আজ নিশ্বাস ফেলবার
আগে
বৃষ্টি নেমেছে।
যাই।"
চারটি
শব্দ, দুটি শব্দ, একটি শব্দ কবিতার
পংক্তিতে বসেছে। এমনকী একটি শব্দই একটি বাক্যের মর্যাদা পেয়েছে। লোকায়ত জীবনের
ছবি, নানা উপকথা, কাব্য-পুরাণের
চরিত্ররাও কখনো কখনো তাঁর কবিতায় উঁকি দিয়ে জীবন দেখে গেছে। যে জীবন পুরোনো জ্বর
লেখে, পুরোনো মৃত্যু লেখে, পুরোনো প্রেম লেখে।
“বজ্রধ্বনি : ২" পাঁচালির শেষ দু লাইনে বিভাস লেখেন :
“নগ্নলাশ আকাশ গঙ্গায়
সে-দৈবকে বিভাস লিখে যায়…."
“নগ্নলাশ" তো
সেই বাল্মীকিজন্মের প্রদাহকে নিজ সত্তায় তুলে নেন বিভাস। বঙ্গদেশের আন্দোলনে সামিল
হয়ে শহিদের দলেও নিজ চেতনাকে চালিত করেন। আবার নিরন্ন হাজার হাজার কবির মধ্যেও
নিজের চেহারা দেখতে পান। যাযাবর জীবন থেকে নৌকার মাঝি-মল্লারের জীবনেও ভিড়ে যান
তিনি। এভাবেই তাঁর সীমাহীন ব্যাপ্তি সর্বকালেই সর্বমানুষের মধ্যেই জেগে ওঠে ।
বনগাঁ ব্রিজ পেরোনো বনগাঁ
লোকালের ধ্বনিময়তার সঙ্গে জীবনের একটা অদ্ভুত মিল পান কবি। যাত্রীদের হৃদয় ভাঙার
ধ্বনি কবির কাছে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে। তরুণ-তরুণীদের প্রণয়লীলার নানা আকুলতার
অনুরোধ শুনতে পান —“কেন হৃদয় চুরমুর করে ভেঙে যাচ্ছে" কবি জানেন না। কোথায়
ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে সেটাও বুঝতে পারেন না।
জীবনের
নানা টানাপোড়েন আর অভাবী সংসারের ছবি, মদ খেয়ে বমি করা, বন্যায় ডুবে যাওয়া গ্রামের
অবস্থা,
হাতির
হানা সব বিবরণেই অকপট হয়ে ওঠেন। কবিতা এখানে জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। কবি অপমান
লিখেছেন,
উদ্বেগ
লিখেছেন,
ফতুর
দিনযাপনের কথা লিখেছেন। বনগাঁ লোকাল এই অন্ধকারের লাইনে সব কথা কবির মনে তুলে
দিয়েছে। নিজের “দাহপত্র" লিখে জানিয়েছেন :
“কেউ ছিল না, শরীর ছিল শুধু।
পাহাড়ি পথে একলা ছোটে বাস।
অতলগামী খাদ পেয়েছি পাশে
কবিজীবন শীতল সন্ত্রাস।"
এই
কবিজীবনের “শীতল সন্ত্রাস" চলতেই থাকবে, তবেই সৃষ্টি হবে কবিতা, শিল্প হবে আরও
তীক্ষ্ণ,
আত্মবাদী, নির্ব্যাজ এবং
সম্পৃক্ত। কান্নাময় জীবনের অভিব্যক্তিতে খিদে ও স্বপ্নকে একই সঙ্গে লালন করে
চলেছেন কবি। “নিজেকে হত্যার গন্ধ" বহন করেছেন। তবুও সুইসাইডাল নোট কুড়িয়ে
কুড়িয়ে দুঃখিত পুরুষের ভোরের দিকে চলে যেতে দেখেছেন। কারণ এজীবন তো ব্যাঙ্ক থেকে
লোন নেওয়া জীবন নয়। অন্যের বাগানে চুরি করে খাওয়া জীবনও নয়। এজীবন তবুও স্বপ্নের।
বাঁচবার আকাঙ্ক্ষার জীবন।
“পরজন্মের জন্য
স্বীকারোক্তি" আর এক ভালোবাসার পর্যটন। “ভালোবাসা", “সেতু", “জল", “গাছ" কবির
আশ্রয় ও মাধ্যম হয়ে ওঠে। যাদের কেন্দ্র করে কবি ঘুরপাক খান। বাবার মৃত্যু বারবার
ফিরে আসে। অবচেতন ধরাও দেয়। মায়ের ডাকনাম “বৃষ্টি"। বাবা বর্ষা ৠতু। সুতরাং
প্রকৃতির সঙ্গেও জীবনের সম্পর্ক গভীর। কবি সেই উপকথার জন্ম দেন। ব্যাকুল নিশ্চুপ
বাবার জন্য সবাই মা-কে ডাকে :
“বোন ডাকছে —আয়
বৃষ্টি…
ভাই ডাকছে —আয় বৃষ্টি….
আমি ডাকছি —আয় বৃষ্টি…."
কিন্তু
বৃষ্টির কোনো দেখা নেই। মা-ও হারিয়ে গেল। জীবনের দাবি থেকেই উপকথাটি ব্যত্যস্ত হয়ে
উঠেছে। সম্পর্কের নিবিড় সুতো মা ও ভাষাতে, বৃষ্টি ও মেঘে এবং বাবা ও মা-তে
নিবেদিত এক অনপনেয় ব্যাপ্তির ক্ষেত্র। এভাবেই জীবনের গভীর ও ঘন প্রচ্ছদে আমাদের
বোধের জগৎটি আবৃত করে রেখেছেন বিভাস। কবিতার ভাষায় ও ছন্দে যতই ধ্বনিময়তা থাকুক
না কেন —ভেতরে আছে স্তব্ধতা। কবি তাই বলেছেন :
“বাক্যের শরীরে যত কথা
গভীরে ততই নীরবতা"
নীরবতাই
প্রকৃত কবিতার ধর্ম । কথার মধ্যে নীরবতাকে উপলব্ধি করতে হয়। উপলব্ধির কোনো ভাষা
নেই। নীরবতা বা স্তব্ধতাই আমাদের ঈশ্বরের কাছাকাছি পৌঁছে দেয়। বিভাসের কবিতায়
বারবারই এই নীরবতা ফিরে আসে। গাছ-মাটি-মেঘ-ঘাস ও জলের সমীপে। মাদার টেরেসা এই
নীরবতার কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন : We need to find God, and he cannot be found in noise
and restlessness, God is the friend of silence. See how nature —trees, flowers,
grass —grows in silence, see the stars, the moon and the sun, how they move in
silence….. We need silence to be able to touch souls. কবিও এভাবেই নীরবতার
ভেতর দিয়ে তাঁর অন্তর্জগতের ঈশ্বরকে বোধের দরোজা খুলে দিয়েছেন । ছুঁতে পেরেছেন
গভীরভাবে । তাই মৃত পিতাও ফিরে এসেছেন। চেতনা প্রবাহ পৌঁছেছে পরজন্মেও। গাছও কথা
বলেছে। নক্ষত্রলোকও ইশারা করেছে। ঘাস-ফুল সবাই কবির অনুগামী হয়েছে।
বাংলা
কবিতার পরিবর্তনে যে নতুন ধারায় কবি উঠে এসেছেন তা একান্তই নিজস্ব। ভাষা বদলে, রহস্যে, আত্মোন্মচনে, সময় ও ঐতিহাসিক
সন্ধিক্ষণে এবং মূর্ত ও বিমূর্তযাপনে বিভাস চূড়ান্ত স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর
কবিতার বিষয় আছে, কিন্তু বিষয়াতীত এক উপলব্ধির বিস্ময় আছে, যেখানে আমরা প্রবেশ করলেও
চূড়ান্ত সমাধানে পৌঁছাতে পারিনি। কোথাও সিদ্ধান্ত নেই, আবেগের নিষ্ঠাহীন প্রাচুর্য নেই, বরং দার্শনিকের
প্রত্যয় আছে,
প্রত্ন-প্রেম
আছে।
কপিরাইট তৈমুর খান
কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন