শিক্ষা ও চেতনার আলোকে
রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ
মানব সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রেই এক এমন এক সৃষ্টির সাক্ষর রেখে গেছেন যার প্রভাব
সর্বকালের জন্যই প্রযোজ্য। কবি ও সাহিত্যিক হিসাবেই আমরা তাঁকে বেশি চিনি কিন্তু তাঁর
বহুমুখী প্রতিভা অন্যান্য বিষয়েও ছাপ রেখে গেছে। চিন্তাবিদ মনীষী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিভিন্ন গদ্য রচনার মধ্য দিয়ে তাঁর সুচিন্তিত মতামত
ব্যক্ত করেছেন। দেশের বর্তমানের যে পরিস্থিতি সেজন্য যথেষ্ট শিক্ষার
অভাব আছে বলে মনে করি। রবীন্দ্রনাথ
বলেছেন --'' অশক্তকে শক্তি দেবার একমাত্র উপায় শিক্ষা।' প্রাচীন ভারতবর্ষে
ছাত্রদের কর্তব্য ছিল শুধু জ্ঞান অর্জন।" ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ
" --সেজন্য চাই শরীর ও মনের সমন্বয়, তবেই সে সাধনায় সিদ্ধিলাভ সম্ভব। তিনি বলেছেন --''বিদ্যালাভ করা কেবল
বিদ্যালয়ের ওপর নির্ভর করে না, অনেক ছাত্র বিদ্যালয়ে যায়, উপাধি পায় অথচ বিদ্যা পায় না।'', ''একখণ্ড পাথর ও একটি
বীজের মধ্যে মূলগত পার্থক্য রয়েছে; পাথর একখণ্ড পাথর মাত্র,কিন্তু বীজের মধ্যে ভাবীকালের
সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে। উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে এই সম্ভাবনাকে রুপ
দেবার প্রয়োজন আছে।'' ''ভ্রূণকে গর্ভের মধ্যে এবং বীজকে মাটির মধ্যে নিজের
উপযুক্ত খাদ্যের দ্বারা পরিবৃত হইয়া থাকিতে হয়। ......''কেবল ইন্দ্রিয়ের
শিক্ষা নয়,কেবল জ্ঞানের শিক্ষা
নয়, বোধের শিক্ষাকে
আমাদের বিদ্যালয়ে প্রধান স্থান দিতে হবে। আমাদের স্কুল কলেজেও তপস্যা
আছে কিন্তু সে মনের তপস্যা, জ্ঞানের তপস্যা; বোধের তপস্যা নয়।
এইজন্য
তিনি ব্রহ্মচর্যের সংযমের কথা বলেছেন। বুদ্ধিকে সরল ভাবে বাড়তে দিতে
হবে। বিশ্বভারতী গ্রন্থে তিনি বলেছেন
যে মানুষ তপস্বী, বাল্যকাল থেকেই এই জীবনের জন্য সাধনা করতে হবে। প্রার্থনার দ্বারাই
এই শক্তি লাভ করতে হবে। বিদ্যালাভের জন্য রবীন্দ্রনাথ যেমন শৃঙ্খলা ও
নিয়মানুবর্তিতার কথা বলেছেন,তেমনি মনের বিকাশের জন্য স্বাধীনতার কথাও বলেছেন। মনের বিকাশের জন্য
প্রয়োজন বন্ধন ও মুক্তি।শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ে তিনি এই দুটিরই
প্রবর্তন করতে চেয়েছেন। একসাথে মিলে মিশে বিদ্যালয়ের কাজ করার ওপর তিনি
জোর দিয়েছেন। চারিদিক সুন্দর পরিচ্ছন্নতার মধ্যে সুস্থ্য পরিবেশে
শিশুরা বেড়ে উঠবে এই তাঁর ঐকান্তিক ইচ্ছা ছিল। আদর্শ বিদ্যালয়
তৈরির জন্য তিনি বিশ্বপ্রকৃতির সাথে ছাত্রদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। বিশ্বপ্রকৃতি ও
মানব সমাজ এই দুইয়ের সমন্বয়েই
শিক্ষায় পূর্ণতা আসবে। তিনি বলেছেন -- ''আমার একান্ত ইচ্ছা
ছিল যে,
এখানকার
এই প্রভাতের আলো,শ্যামল
প্রান্তর,গাছপালা যেন শিশুদের
চিত্তকে স্পর্শ করতে পারে কারণ প্রকৃতির সাহচর্যে তরুণ চিত্তে আনন্দ সঞ্চারের দরকার আছে।'' শান্তিনিকেতনের গাছ
পালা পাখির মধ্যে তিনি শিশু মনের বিকাশ চেয়েছিলেন। তাই তিনি লোকালয়
থেকে দূরে নির্জনে মুক্ত আকাশের উদার প্রান্তরে গাছপালার মধ্যে আশ্রম বিদ্যালয়
স্থাপন করলেন। আমাদের প্রচলিত বিদ্যালয়ের সঙ্গে তাই রবীন্দ্রনাথের
আশ্রম -বিদ্যালয়ের অনেক পার্থক্য।
রবীন্দ্রনাথ
চেয়েছিলেন ছায়াময় গাছের তলায় ক্লাস হবে।কিছু পড়া হবে শিক্ষকদের সাথে
ভ্রমণ করতে করতে প্রকৃতির সান্নিধ্যে ।সন্ধ্যায় তারা আকাশের নক্ষত্র
চিনবে। সঙ্গীত চর্চা করবে আর ইতিহাস,পুরাণের চর্চা।সেজন্য এই বিদ্যালয়ে
চেয়ার টেবিলের কোন প্রয়োজন নেই। সবাই মাটিতে বসবে,অনাড়ম্বরভাবে
বিভিন্ন জ্ঞানের সাথে পরিচিত হবে। শিক্ষার জন্য তিনি মাতৃভাষার
ওপর জোর দিয়েছেন। মাতৃভাষাতেই তিনি শিক্ষা দেবার কথা বলেছেন।মাতৃভাষাই সেই
মাতৃদুগ্ধ। মাতৃভাষাকে তিনি প্রাধান্য দিলেও তিনি অন্য ভাষাকেও
প্রাধান্য দিয়েছেন। আমাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ করার জন্য আর সারা বিশ্বের সাথে
সম্পর্ক করার জন্য তিনি ইংরাজি ও অন্যান্য ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। তিনি
চেয়েছিলেন সারা বিশ্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে এক সুরে এক সূত্রে গেঁথে ফেলতে।
''এক সূত্রে বাঁধিয়াছি
সহস্রটি মন
,একই কারজে
সঁপিয়াছি সহস্র জীবন --
বন্দে
মাতরম।।
সংস্কৃত
ভাষা: সংস্কৃত ভাষা কে
আলাদা মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন কবি। বিশ্বপ্রকৃতি যেমন আমাদের
শিক্ষা দেয়,
তেমনি
অন্তঃ প্রকৃতির ও আলাদা রস, ধ্বনি, রঙ আছে। সেই সম্বন্ধ
স্থাপনের জন্য তিনি বলেছেন -- " "ভারতবর্ষের চিরকালের যে চিত্ত সেটার আশ্রয় সংস্কৃত ভাষা। এই ভাষার তীর্থ পথ
দিয়ে আমরা দেশের চিন্ময় প্রকৃতির স্পর্শ পাব,তাকে অন্তরে গ্রহণ করব,শিক্ষার এই লক্ষ্য
আমার মনে দৃঢ় ছিল। ইংরাজি ভাষার ভিতর দিয়ে নানা জ্ঞাতব্য বিষয় জানতে পারি, সেগুলি অত্যন্ত
প্রয়োজনীয় কিন্তু সংস্কৃত ভাষার একটা আনন্দ আছে,সে রঞ্জিত করে আমাদের মনের
আকাশকে;
তার
মধ্যে আছে একটি গভীর বাণী, বিশ্বপ্রকৃতির মতই সে আমাদের শান্তি দেয় এবং চিন্তাকে
মর্যাদা দিয়ে থাকে।" আজ আমরা সন্তানকে অনেক ভাষা শিক্ষা দিই, প্রয়োজনের জন্য। কিন্তু বাংলা, সংস্কৃত এগুলো আর
মর্যাদা পাচ্ছে না, সেই খুব দুঃখের কথা।
কবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কবি, দার্শনিক তাই তিনি দর্শন ও মননকে কে স্থান দিয়েছেন তাঁর লেখনীতে। বিজ্ঞান চর্চার
প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি অনুভব করেছেন। বিজ্ঞান সভ্যতার অগ্রগতি এনে
দেয়, বিজ্ঞান সত্য।
রবীন্দ্রনাথের
এই বিশ্ব ভাতৃত্ব বোধ, মানবতা, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি বোধ নানা কারণে ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। আবার ভারতবর্ষ অন্য
দেশের দিকে এই মহামারীর সময় হাত বাড়িয়ে
দিয়েছে। প্রেম,ভালোবাসা, মৈত্রীর বন্ধনে বাঁধতে চেয়েছে। মানুষ আজ বিচ্ছিন্ন। নানা কারণে চেতনা,বোধ লুপ্ত হয়েছে। মানুষের চলার পথ
সত্যের। সেই সত্যের প্রতি নিষ্ঠা রেখে চলতে হবে। সেই সত্য চিন্তা
ভাবনা আজ পথভ্রষ্ট। জাতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতি শিক্ষার জন্য তিনি রামায়ন, মহাভারতকে আলাদা
বিষয় হিসাবে পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছেন। এই দুই মহাকাব্য
মনের বিকাশের জন্য প্রয়োজন। এই দুই মহাকাব্যের ঘটনা
বৈচিত্র্য ছেলেমেয়েদের আনন্দ দেবে এবং প্রাচীন সংস্কৃতির সাথে পরিচিত করাবে ।
এই
প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন -- ''আমি সন্ধ্যায় তাদের নিয়ে রামায়ণ মহাভারত পড়িয়েছি।
হাস্য
করুণ রসের উদ্রেক করে তাদের হাসিয়েছি,কাঁ দিয়েছি। তাছাড়া নানা গল্প বানিয়ে বলতাম।'' এইভাবে তিনি অভিনয়ে
গানে গল্পে মনটি ভরিয়ে দিতেন।
শান্তিনিকেতনের পাঠ্য বিষয় সম্পর্কে
শ্রীপ্রমথনাথ বিশী লিখেছেন -- প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার আর একটি প্রধান ত্রুটি এই
যে ইহাতে শিশুকে অত্যন্ত বেশি শিশু এবং বয়স্ককে একেবারে সর্বজ্ঞ মনে করা হয়। .... শান্তিনিকেতনে
শিশুদের শিশু মনে করা হয় না। এখানকার নিম্নতর শ্রেণীর পাঠ্য
তালিকা লক্ষ্য করলে বিস্ময়ের অবধি থাকে না। এই সব বই কলেজের উচ্চতম
শ্রেণীতে দিতেও সঙ্কোচ বোধ করবেন। ''দ্বিতীয় পুস্তক ছিল
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর 'ছেলেদের মহাভারত ' শিক্ষা জীবনের প্রারম্ভেই
রামায়ণ মহাভারত ও রবীন্দ্র কাব্যের উপর প্রতিষ্ঠা পাইয়া বাঁচিয়া গেলাম।
তিনি
বলেছিলেন যে দেশের প্রকৃত পরিচয় জানতে হলে ইতিহাস জানতে হবে। এই প্রকৃত ইতিহাস
শুধুমাত্র মারামারি কাটাকাটির ইতিহাস মাত্র নয়, এই ইতিহাস ভারতবর্ষের মানুষকে
সুখ দুঃখ,
উত্থান
পতন, জ্ঞান বিজ্ঞানের
স্বাক্ষর বহন করবে। কিন্তু ছেলেবেলা থেকে আমরা যে প্রণালীতে শিক্ষা পাই
তাতে দেশের সাথে বিচ্ছেদ ঘটে এবং দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ভাব জন্মায়।
রবীন্দ্রনাথ
বলেছেন যে একদিকে আত্ম একদিকে পর, একদিকে অর্জন একদিকে বর্জন; একদিকে সংযম একদিকে স্বাধীনতা
একদিকে আচার একদিকে বিচার মানুষকে টেনেছে। এই দুই তাল বাঁচিয়ে সমে এসে
পৌঁছানোই মনুষ্যত্বের শিক্ষা। আজও সমাজের ভিতরের দ্বন্দ্বে
ভারতবর্ষের ইতিহাস লেখা হয় নি। ইতিহাসের প্রকৃত রূপ টির সাথে
পরিচিত হতে হবে।
প্রাচীনকাল
থেকেই নানা জাতি নানা ধর্ম সম্মেলনে যে সৃষ্টি ভারতের শিল্প কলায়, তার স্থপতি আর
বিজ্ঞানে তার নিদর্শন আছে। চারুশিল্পের দ্বারা আমরা বিশ্ব
মানবের সৃষ্টি বৈচিত্রের সঙ্গে আমাদের মনের যোগ স্থাপন করতে পারি। কারু শিল্পের
সাহায্যে জীবনযাত্রার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসকে সুন্দর করে ভোগ করতে পারি। এই অনুভবের জন্য
বিদ্যালয়ে,
গ্রন্থাগারে, পড়ার ঘরে, শিল্প সৃষ্টি রাখলে
সবার শিল্প বোধ জাগ্রত হবে।
সংগীত ও
নৃত্য:
শিল্প
চিত্রকলার মত তিনি সংগীত ও নৃত্যকে শিক্ষা ক্ষেত্রে স্থান দিতে চেয়েছেন। সঙ্গীতের ধারাকে
তিনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ও জন সঙ্গীত এই দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের
প্রাচীন পদ্ধতি ধরে রাগ রাগিণীর অনুশীলন। আর একটি সঙ্গীতের
ধারা হল নদীর মত যা বয়ে গেছে ...লোকসংগীত, যাত্রা,পাঁচালি,কীর্তন ইত্যাদি
বিভিন্ন ধারার গান।
রবীন্দ্রনাথের বিচরণ জীবনের প্রতিটি
ক্ষেত্রে,
বিশাল
ব্যাপ্তি। কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাসে উঠে এসেছে তাঁর সমাজচিন্তা, শিক্ষাচিন্তা, ধর্মচিন্তা, নান্দনিকচিন্তা ..আজকের যুগেও তা প্রাসঙ্গিক। সময়ের সাথে তাল
মিলিয়ে চলেছে তাঁর ভাবনা যা উত্তরণের পথ দেখায়। শিক্ষা, ভাষা, শিল্প, জীবনচর্চা
প্রতিটি বিষয়ে তাঁর লেখা, আগামীদিনের পথ
দেখাবে। তাঁর চিন্তা, চেতনা, দর্শন, মনন, বোধ বাঙালিকে
উজ্জীবিত করে সৃজনশীল তৈরি করার প্রয়াস যা তিনি সারাজীবন ধরে করে গেছেন। ভারত ও বাংলাদেশ; স্বাধীন এই দুটি
দেশের জাতীয় সংগীত তাদের স্বাধীনতার বহু যুগ আগেই রচনা করে গেছেন। তিনি যে তাঁর
কালের শ্রেষ্ঠ রূপকার শুধু তাই নয়, তিনি সর্ব কালের।
''বিশ্ব সাথে যোগে
যেথায় বিহার
সেইখানে
যোগ তোমার সাথে আমারও ''
এই
বিশ্ব লোক ও অন্তর লোকের মিলন ঘটিয়েছেন
তিনি।
"তাঁর অন্তর্মুখীন
ভাবনার পথ ধরে সেই দেবতার সন্ধান পাই। মনের মাঝেই সেই চিরসুন্দরের
বাস --বাউলের এই ভাবনা, এই সত্য তিনিই প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।
তাঁর
স্বদেশ ভাবনার মৌলিকতা শুধুই দেশের স্বাধীনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বাক
স্বাধীনতা,
চিন্তার
স্বাধীনতা,
ব্যক্তির
স্বাধীনতা,
সমাজের
স্বাধীনতা ও জাতীয় স্বাধীনতা সব কিছুর প্রকাশ ঘটেছে তাঁরকবিতায়,গানে,উপন্যাসে,নাটকে,প্রবন্ধে যা আজকেও
পথ দেখাবে এবং আগামীতেও। স্বদেশ পর্যায়ের গান আজকের দিনেও সমান
প্রাসঙ্গিক। সেগুলো
আত্মবিশ্লেষণের গান, আত্মজাগরণের গান, আত্মশুদ্ধিতে জেগে ওঠার মন্ত্র। রাখীবন্ধনের
উৎসব মধ্য দিয়ে তিনি গড়ে তুলতে
চেয়েছিলেন হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি
যা সার্থক হয়ে ওঠেনি। সেজন্য নানা
রাজনৈতিক কারণ দায়ী। দাঙ্গা, হিংসা, দলাদলির মাঝে তাঁর লেখনী আজও
সমুজ্জ্বল।
‘বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা-
সত্য
হউক,
সত্য
হউক,
সত্য
হউক হে ভগবান ॥
বাঙালির
প্রাণ,
বাঙালির
মন,বাঙালির ঘরে যত
ভাইবোন
এক
হউক,
এক
হউক,
এক
হউক হে ভগবান ॥’
হিন্দু, মুসলমান, জাত-পাত-বর্ণগোষ্ঠীর
সংকীর্ণতা ছাড়িয়ে তাঁর লেখনী অনেক ঊর্ধ্বে।
তিনি
চেয়েছিলেন এই দূরত্ব বৈষম্য দূর করতে। তাঁর লেখায়
সেই আক্ষেপের সুর ছিল স্পষ্ট।
‘এবার আমাদের স্বীকার
করিতেই হইবে হিন্দু-মুসলমানের মাঝখানে একটা বিরোধ আছে। আমরা যে কেবল স্বতন্ত্র
তাহা নহে। আমরা বিরুদ্ধ। আমরা বহুশত বৎসর পাশে পাশে থাকিয়া এক ক্ষেতের ফল, এক নদীর জল, এক সূর্যের আলোক ভোগ
করিয়া আসিয়াছি;
আমরা
এক ভাষায় কথা কই, আমরা একই সুখ-দুঃখে মানুষ, তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ
মনুষ্যচিত যাহা ধর্মবিহিত তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই, আমাদের সুদীর্ঘকাল ধরিয়া এমন
একটি পাপ আমরা ঘোষণা করিয়াছি যে, একত্রে মিলিয়াও আমরা বিচ্ছেদকে ঠেকাইত।
তাঁর
লেখায় ধবনিত হয়েছে উপনিষদের সুর। বন্ধু, প্রভু,দয়াময় এই শব্দের ব্যপ্তি, অনুভবে তাঁর ঈশ্বর চিন্তা র প্রকাশ ঘটেছে। প্রকৃতি প্রেম, মানব প্রেম বারে
বারে ধরা পড়েছে নান্দনিকতায়। মানব প্রেম,মানবতা,ভা লবাসা যার
মূলমন্ত্র। নিজের ধর্মকে তিনি বলেছেন ‘মানুষের ধর্ম’। ১৯৩০ সনে
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে Hubert বক্তৃতায় তিনি Religion of Man নামে এই বক্তৃতা
দিয়ে তৎকালীন বিদগ্ধ সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সত্য, মঙ্গল এবং আনন্দ এই তিন ছিল
তাঁর আত্ম উপলব্ধি।
''মন, জাগ' মঙ্গললোকে অমল
অমৃতময় নব আলোকে
জ্যোতি
বিভাসিত চোখে।।
যেখানে আনন্দ, প্রেম, মৈত্রী সেখানেই মঙ্গল। প্রকৃতির মধ্যে সেই
আনন্দ অনুভব,সেই আনন্দলোক যেখানে
সত্য ও সুন্দরের বাস।
''নিবিড় ঘন আঁধারে
জবলিছে ধ্রুবতারা।
মন
রে মোর,
পাথারে
হোস নে দিশেহারা।।"
তাঁর গান
অন্ধকারে পথ চলার আলোক বর্তিকা। কবির মতে মানবসমাজে কল্যাণ আর
প্রকৃতিতে শান্তি প্রতিষ্ঠাতেই ঈশ্বরের প্রকৃত প্রকাশ।'' বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি
......প্রশ্ন করেছেন "কেন এ হিংসা দ্বেষ কেন এ ছদ্মবেশ ....আত্ম নিবেদনের সুর, প্রার্থনা বেজেছে
তাঁর লেখনীতে।
আজকের
পৃথিবীতে যে শোষণ, নিপীড়ন, হিংসা, বিদ্বেষ, অসহনশীলতা, তাঁর ছবি ফুটে উঠেছিল
কবির লেখনীতে।
''হিংসায় উন্মত্ত
পৃথ্বী,
নিত্য
নিঠুর দ্বন্দ্ব;
ঘোর
কুটিল পন্থ তার, লোভ জটিল বন্ধ।। ....
........
শান্ত
হে,মুক্ত হে,হে অনন্তপুণ্য,
করুণাঘন, ধরণী তল কর ' কলঙ্কশূন্য।।
আজকের
পৃথিবী রবীন্দ্র অনুসারী নয়। ধর্ম যখন ধর্মকে আঘাত করে তখন
কোথাও সমাজের কল্যাণ সাধিত হয় না। অশ্রাব্য রবীন্দ্র সংগীত শুনতে
পাই ইউ টিউবের দৌলতে যার বিকৃত অশালীন
ভাষা প্রভাব ফেলেছে আজকের প্রজন্মের ওপর। প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে না তারা, বিষিয়ে যাচ্ছে সমাজ। এর কারণ প্রয়োজনীয় অধ্যয়ন, প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করি না। রবীন্দ্রনাথের
শিক্ষা, দর্শন, মননকে অন্তরে ধারণ করে সেই আদর্শে পথ চলা নেই। বর্তমান যুগে সারা বিশ্বজুড়ে যে তামসিকতা, মানুষে মানুষে
বিচ্ছিন্নতা,
জীবনকে
গ্রাস ফেলছে তাতে সেই সাধনার পথ ধরে অধ্যাত্মলোকে প্রবেশ রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। রবীন্দ্রনাথ
দেখিয়েছেন সেই সত্যের পথ,সুন্দরের পথ, প্রেমের পথ।
বিতর
বিতর প্রেম পাষাণহৃদয়ে,
জয় জয় হোক তোমারি।।
এই সময়
আমরা দাঁড়িয়ে এক মহাপ্রলয়ের মুখোমুখি যখন মনুষ্যত্ব থেকে মানুষ দূরে চলে যাচ্ছে। মৃত্যু ভয়ে ভীত
মানুষ দিশাহারা তখন এক আশার আলো দেখতে পাই।
''ভয় হতে তব অভয়মাঝে
নূতন জনম দাও হে।।
দীনতা
হতে অক্ষয় ধনে, সংশয় হতে সত্যসদনে,
জড়তা
হতে নবীন জীবনে নূতন জনম দাও হে।।
আমার
ইচ্ছা হইতে প্রভু,তোমার ইচ্ছামাঝে ...
আমার
স্বার্থ হইতে,প্রভু,তব মঙ্গল কাজে ....
অনেক
হইতে একের ডোরে, সুখদুখ হতে শান্তি ক্রোড়ে --
আমা
হতে নাথ,তোমাতে মোরে নূতন
জনম দাও হে।। ''
.
এই ঝড়
একদিন থেমে যাবে, সেদিন হয়তো আমরা আবারও সুন্দর
একটি পৃথিবী দেখতে পাব। সেদিন আমাদের হৃদয়ের বোধ, চেতনা আবার মিলিয়ে
দেবে একসাথে। কবিকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়ে সেই দিনের অপেক্ষা।
কেইরাইট কোয়েলী ঘোষ
কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন