রবীন্দ্রনাথ ও নারীপ্রগতি
আজকের প্রাসঙ্গিকতার আলোয়
মেয়েদের
দুঃখ ও অবমাননায় চিরদিন আমি বেদনা ও লজ্জা বোধ করি. আমার অনেক লেখার মধ্যে অনেকবার
তা প্রকাশও হয়েছে..সমাজশাসনে মেয়েদের সঙ্গে পুরুষের স্বাধীনতার পর্বতপ্রমাণ তারতম্য দীর্ঘকালই
আমাকে দুঃখ দিয়েছে..বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনেদের লেখা চিঠিপত্র থেকে আমরা
রবীন্দ্রনাথের নারীপ্রগতির চেতনা সম্বন্ধে একটা স্পষ্ট ধারণা পেতে পারি।
রবীন্দ্রনাথ পূর্ববর্তী যুগে রামমোহন রায় বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নারীমুক্তির
ক্ষেত্রকে এক সামাজিক আন্দোলনের রূপ দিয়েছিলেন। তাই পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের কলম
ও ভাবধারাকে আমরা নারীমুক্তির চেয়ে নারীপ্রগতির আঙ্গিকেই তুলে আনতে পারি বেশি।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের আধুনিকা স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী
দেবীর আশেপাশে বেড়ে উঠেছিলেন রবি। সেযুগেও বাঙালি সমাজকে তোয়াক্কা না করে
ঠাকুরবাড়ির এই বাঙালি নারী বিলেত ঘুরে এসেছিলেন নির্দ্বিধায়। তাছাড়া কিশোর রবি
ঠাকুরবাড়িতে পেয়েছিলেন তাঁর একমাত্র বন্ধু নতুন বৌঠান কাদম্বিরি দেবীর সান্নিধ্য।
সেই নারীর প্রভাবে প্রভাবিত তরুণ রবি কত সাবলীল কলমে পাঠকদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ভানুসিংহের
পদাবলী। উৎসর্গপত্র থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথের নতুন
বৌঠান কাদম্বরীদেবী তাকে ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাতে অনুরোধ করেন। উল্লেখ্য,
এই গ্রন্থ প্রকাশের ঠিক একবছর আগেই আত্মহত্যা করেছিলেন কাদম্বরী
দেবী।
রবীন্দ্রনাথের বেশিরভাগ ছোটোগল্পই যে সেযুগের সমাজে নারীচেতনার আঙ্গিকে এক
প্রবল ঢেউ, তা একবাক্যে স্বীকার করেছেন একাধিক রবীন্দ্র
গবেষক। এমনকি ১৮৮৯ সালে ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ভারতী পত্রিকায় তিনি নারীমুক্তি
আন্দোলন বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। এরপর তাঁর রচিত 'স্ত্রীর
পত্র', 'বোষ্টমী' ইত্যাদি
গল্পগুলি গতানুগতিক বাঙালি ভাবধারায় এক প্রবল বিপ্লব ছাড়া আর কিছুই না। অন্যদিকে
নতুনের ইঙ্গিতবাহী উপন্যাস ঘরেবাইরে, চতুরঙ্গ আজও
সমাজভাবনায় কতটা প্রাসঙ্গিক তা মননশীল পাঠককে আলাদা করে চেনাতে হয় না।
এদিক
থেকে দেখতে গেলে দেখা যায় প্রচলিত সংগ্রাম ও বিপ্লবের পথে না হেঁটেও তিনি নিজের
অভিমতটুকু খুব স্পষ্ট ভাবে লিখে যেতে কখনো কার্পণ্য করেননি। তিনি নিজেই প্রায় এক
শতাব্দীকাল জুড়ে এক সচল বিদ্যালয়ের ভূমিকা নিয়েছিলেন। নিজের জীবনে প্রতিটি স্তরেই
তিনি নিজের সাথেই লড়াই করে গেছেন অনবরত। নিজের লেখার সূত্র ধরেই বারেবারে
প্রতিষ্ঠা করে গেছেন আরও প্রাসঙ্গিক সমাজবোধের। শুধুমাত্র ইঙ্গিত অথবা কলমের ধারে
নয়, নিজহাতে আশ্রম প্রতিষ্ঠার পর মেয়েদের জন্য রেখে গেছেন শিক্ষার সমান
অধিকার, দিয়ে গেছেন স্বাধীনতার দীক্ষা। বিশ্বভারতীতে
নারীশিক্ষার ভূমিকা নিয়ে কিছুপরেই বিস্তৃত আলোচনায় যাবো. তার আগে দেখে নেওয়া যাক
কবির আত্মোপলব্ধির শাখাপথগুলো। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি 'জয়শ্রী' পত্রিকার সম্পাদিকা উষারাণী দেবীকে
লিখছেন 'সমাজের গভীর পরিবর্তনগুলি অন্তরের থেকে ঘটে।
বাহিরের শিক্ষা এবং অবস্থার যোগে এই পরিবর্তন ক্রমশ বল পেতে থাকে..'। আবার কখনো তিনি পত্রে পাশ্চাত্যের বিপ্লবের সাথে দেশকে এক মাপকাঠিতে
বসিয়ে লিখছেন 'আমাদের দেশেও সেইরকম ঘটবে কিন্তু ঘটবে
অনুকরণ করে নয়, নিজের নিয়মে..'।
এতটাই সুস্পষ্ট ছিল রবীন্দ্রনাথের নারীপ্রগতির চেতনা। ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ্য করলে বোঝা
যায় তিনি পাশ্চাত্য নিয়মে নারীচেতনা জাগরণের বিপ্লবে আস্থা রাখেন নি। কারণ ভারতীয়
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের চেতনা জাগরণে একান্তই প্রয়োজন ছিল এদেশেরই সুস্থ ও
শিক্ষিত সামাজিক পরিমণ্ডল। এর কিছুদিন আগে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শুধুমাত্র
নারীশিক্ষার ওপর আলো ফেলেই বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যেন তারই যথার্থ
ধারক ও বাহক। তার আধুনিক মনন ও পাশ্চাত্য শিক্ষা বারেবারে তাকে এনে ফেলে বাঙালি
সমাজের অন্দরমহলে। যেখানে সুশিক্ষার অভাবে তখন ক্রমাগত পর্দার পেছনে ঠাঁই নেয়
নারী। তাই সেক্ষেত্রে ছাপোষা বাঙালি পরিবারে যাতে ভাঙ্গন না ধরে, সেই দিকে নজর রেখে তিনি পুরোপুরি পাশ্চাত্য শিক্ষার আদপকায়দাকে একদিকে
আটকে রেখে অন্যদিকে দরজা খুলে দেন এদেশের ভাবধারার আঙ্গিকেই। তিনি নারীকে
দেখিয়েছেন পথ। ঘরের চার দেওয়ালে বন্দিনী থেকে শুধুমাত্র পুরুষের আজ্ঞাবহ নারীকে
তিনি দিতে চেয়েছিলেন মুক্তির হাওয়া। পরবর্তীকালে প্রতিটি বাঙালি নারী তাঁর আদর্শে
হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন ঘরেবাইরের বিমলা। সেইযুগের সামাজিক স্তরে কবিশ্রেষ্ঠ
রবীন্দ্রনাথের চেয়েও সমাজসংস্কারক রবীন্দ্রনাথ কতটা সফল, তা
তো আজকের সমাজ বলবে। শৃঙ্খলতার মন্ত্রে তিনি যেভাবে সারা দেশের নারীদের জন্য খুলে
দিয়েছিলেন বিশ্বভারতীর দ্বার তা আজও ধারণ করে চলেছে এক নিজস্ব সত্তাকেই। প্রসঙ্গত
বলা যায়, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা
গুরুদেবের উপস্থিতিতে ১৯৩৪ সালে আশ্রমে ভর্তি হন রবীন্দ্রনাথকে আমৃত্যু তিনি
শ্রদ্ধাচিত্তে 'গুরুদেব' বলে
সম্বোধন করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের সম্মতিতে ৭ জুলাই মা কমলা নেহরুর হাত ধরে ১৭
বছরের ইন্দিরা বম্বে থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে বিশ্বভারতীতে আইএ পড়তে আসেন। এর থেকেই
পাঠক সেইযুগে জাতীয় নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের তীব্র প্রভাব সম্বন্ধে
সহজেই বুঝতে পারবেন।
রবীন্দ্রনাথ
একটি দর্শন, রবীন্দ্রনাথ একটি স্ময়ংসম্পূর্ণ সমাজচেতনা। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে
তরুণ রবীন্দ্রনাথ বেড়ে উঠছেন কলকাতার সেই বাড়িতে, যেখানে
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার মিশেল ভগ্ন শহরকে শেখাচ্ছে মাথা তুলে দাঁড়াতে। যে
বাড়িতে জ্ঞানদানন্দিনীর তত্ত্বাবধানে সাহেবদের মতো পালিত হচ্ছে সত্যেন্দ্রতনয়ের
জন্মদিন পার্টি। আবার মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ নিয়মিত বসাচ্ছেন ব্রাহ্মধর্মের গূঢ়
তত্ত্বপাঠের সভা। বেজে উঠছে ব্রহ্মসংগীতের বাজনা। কবির জীবনে জোড়াসাঁকোর ভূমিকা
তাই অগ্রণী। নতুন বৌঠান কাদম্বরীর সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা কারো কারো চোখে মন্দ হলেও
তিনি কখনো তার পরোয়া করেন নি। নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী তরুণ রবি নিজের একটার পর
একটা কবিতার পাণ্ডুলিপি পড়িয়েছেন তথাকথিত 'অশিক্ষিত'
কাদম্বরীকে দিয়েই। তাঁর এই প্রশস্ত ভাবনারই যেন পরিণতি ঘটে
জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে। শান্তিনিকেতনে।
১৯০৮
সালে ৬ জন বালিকাকে নিয়ে সেখানে নারীবিভাগের প্রথম সূচনা হয়। তখন দেখাশোনার
দায়িত্ব ছিল সুশীলা দেবীর উপর। পরে এই বিভাগটি বন্ধ হয়ে গেলেও আবার ১৯২২ সালে সেটি
প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময়েই শান্তিনিকেতন হয়ে ওঠে 'বিশ্বভারতী'। তখন স্নেহলতা সেন বিভাগটির দেখভাল করতেন। আশ্রমের মেয়েরা পড়াশোনার
পাশাপাশি খেলাধুলাতেও অগ্রণী ভূমিকা নিতে শুরু করে। ভারতীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সে
এক দুর্বার সময়। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সারা দেশে প্রায় অচলাবস্থা জারি হলেও
আশ্রমের আঙিনা ছিল সম্পূর্ণ শান্ত ও রাজনীতিমুক্ত। ছেলেরা ও মেয়েরা একযোগে
গুরুদেবের সান্নিধ্যে গড়ে তুলতে থাকে আত্মচরিত্র। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ চিরকালই
বিশ্বমৈত্রীর স্বপ্নে থাকতেন বিভোর। তাঁর নেতৃত্বে বিশ্বভারতী তখন প্রাচ্য ও
পাশ্চাত্যের যেন এক মিলনক্ষেত্র। তাই তো আলমোড়া জেলে বন্দি থাকাকালীনও পন্ডিত
নেহেরু নিশ্চিন্তে থাকতেন কন্যা ইন্দুকে নিয়ে। গুরুদেবের উপর তাঁর ছিল অগাধ আস্থা।
শুধু নেহেরুই নয়, জাতীয় শিক্ষাক্ষেত্রে নারীশিক্ষায় ও
অগ্রগতিতে তখন থেকেই বিশ্বভারতীর প্রভাব ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশের প্রতিটি কোণে।
ইন্দিরার সাথে সহপাঠিনী হিসাবে আশ্রমে ভর্তি হন অশোকা সিংহ, জয়া আপ্পাস্বামী, সোমা যোশির মতো আরও বহু
অবাঙালি ও ভিন্ন প্রদেশের ছাত্রীরা।
১৯৩৬
সালে নিখিলবঙ্গ নারীকর্মী সম্মেলনের বক্তৃতায় কবি বলেন, নারীর
স্বভাবের মধ্যে রয়েছে সংসারকে শান্তি ও আনন্দ দেবার এক সহজাত প্রবৃত্তি। তাঁদের
স্বভাবের এই রূপটিকে শিক্ষার দ্বারা উদ্ভাসিত করা, সমাজের
অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। তিনি আগাগোড়াই চেয়েছিলেন নারীর রক্ষণশীল মনটাকে
আধুনিকতার মোড়কে মুড়ে ঘুণ ধরা সমাজের কাছে জবাব হিসাবে ফিরিয়ে দিতে। তিনি বিশ্বাস
করতেন নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠায়। আজকের যুগে নারীস্বাধীনতার যে মুক্ত স্রোতের ওপর
ভিত্তি করে সাবলম্বী হয়েছে আধুনিক সমাজ, তারই গূঢ়
তত্ত্বটুকু কবি তৈরী করে গেছেন প্রায় ১০০ বছর আগে। বিশ্বভাতৃত্বের লক্ষে নারীপুরুষ
নির্বিশেষে খোলা আকাশের তলায় রাখিবন্ধন কবির প্রগতিশীল ও আধুনিক সমাজদর্পনের এক
নতুন আঙ্গিক প্রতিষ্ঠা করে সেবিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই।
বিশ্বভারতীর
প্রথম রিপোর্টে দেখা যায়,
কলাভবনের শিল্প বিভাগের পড়ুয়া সংখ্যা ৫০ জন। তাঁদের মধ্যে ১০ জন
ছাত্রী। অন্যদিকে সংগীত বিভাগে ৪০ জনের মধ্যে ২০ জনই ছাত্রী। রবীন্দ্রনাথ সেযুগের
বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সংস্থা গার্ল- চাইল্ড এর স্থানীয় শাখার নামকরণ করেন 'গৃহদীপ'. পরে নাম বদলে নাম রাখেন 'সহায়িকা'। তিনি চাইতেন তাঁর আশ্রমে মেয়েরা হোক
স্ময়ংসম্পূর্ণ, স্বনির্ভর। প্রতিটি কাজে তাঁরা রেখে যাক
পুরুষ সমান কর্মদক্ষতা। বিশ্বভারতী বুকে ধরে আছে সেই সংকল্পটুকু। আজও বিশ্বভারতী
প্রাঙ্গনে প্রতিটি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর কাজেও পুরুষ ও নারী ছাত্রছাত্রীদের
সমদ্যোগ চোখে পড়ার মতন।
‘বিশ্বভারতী নারীবিভাগ’ এই শিরোনাম নিয়ে 'প্রবাসী'
অগ্রহায়ণ ১৩৩০ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি প্রকাশ করেছিল।
যার ছত্রে ছত্রে ছিল নারীপ্রগতির কথা। যাতে উল্লেখ পাওয়া যায় - ‘শান্তিনিকেতন
আশ্রমে বিশ্বভারতীর আন্তর্গত নারী বিভাগ হইতে স্ত্রীলোকদের শিক্ষার জন্য বিশেষ
ব্যবস্থা করা হইয়াছে। আপাতত এখানে অন্যান্য শিক্ষণীয় বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীত,
চিত্রকলা, বস্ত্রবয়ন এবং বই বাঁধানো
প্রভৃতি হাতের কাজ শিক্ষা দেওয়া চলিতেছে। সেইসঙ্গে স্বাস্থ্যতত্ত্ব, রোগী পরিচর্যা, শাকসব্জী, ফুলফলের বাগান তৈয়ারী, বিজ্ঞান বিহিত
গৃহকর্ম-প্রণালী প্রভৃতির বিষয়ে ছাত্রীরা পারদর্শিতা লাভ করে, ইহা আমাদের ইচ্ছা। নারীশিক্ষায়
আগ্রহবান ব্যক্তিদিগের নিকট হইতে যথোচিত আনুকূল্য পাইলে দেশবিদেশ হইতে উপযুক্তা
শিক্ষয়িত্রী সংগ্রহ করিয়া এখানে উচ্চ আদর্শের নারী শিক্ষালয় গড়িয়া তুলিতে
কৃতকার্য হইব।’
তাই
আজকের থেকে এক শতাব্দী আগেও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আজকের দিনেরই আধুনিক পুরুষ। সেই
রক্ষণশীল সমাজেও তিনি এমন এক প্রতিষ্ঠান নিজে হাতে তৈরী করেছিলেন যেখানে তাঁর
নিজের ইচ্ছেগুলোই বাস্তবে পরিণত করা যায় অনায়াসে। আর এখানেই তাঁর প্রাসঙ্গিকতা।
তবে
স্বপ্নপূরণে রবীন্দ্রনাথ কতটা সার্থক, তাঁর বিচার করতে বসলে খুলে বসতে হয়
ইতিহাসপঞ্জী। আগেও বলেছি নারীশিক্ষা এবং নারীমুক্তির জন্য রবীন্দ্রনাথ পথিকৃৎ নন।
তাঁর অন্তত অর্ধশতাব্দী আগেই কলকাতার বুকে প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে নারীশিক্ষার মন্দির
বেথুন কলেজ। তাই নারীশিক্ষার আধারে রবীন্দ্রনাথ শীর্ষক আলোচনায় আমরা তাঁর সামাজিক
কর্মকাণ্ডগুলো তুলে এনে সহজেই বুঝতে পারি তাঁর আধুনিকমনস্ক মননটাকে। তিনি যে সময়ের
চেয়ে ১০০ বছর এগিয়ে ছিলেন তাঁর পরিচয় আজও ছড়িয়ে আছে শান্তিনিকেতনের আনাচেকানাচে।
১৯৪০ সালে শান্তিনিকেতনে চারটি বিভাগ। কলাভবন, সংগীতভবন,
শিক্ষাভবন এবং পাঠভবন। বিশ্বভারতীর রেকর্ড বলছে সেই বছর কলাভবনে
৭৫ জন পড়ুয়ার মধ্যে ৩৩ জন ছাত্রী. সঙ্গীতভবনে মোট ৪৪ জনের মধ্যে ২৮ জনই ছাত্রী।
শিক্ষাভবনে ১২৬ জনের মধ্যে ৩৬ জন ছাত্রী এবং পাঠভবনে ১৭৮ জনের মধ্যে ৬১ জন ছাত্রী।
'প্রবাসী' ১৩৩২ সংখ্যায় নারীশিক্ষা বিষয়ক
বিস্তৃত খবর প্রকাশ হয়। সেখানে স্পষ্ট বলা হয় বিশ্বভারতীর মতো শিক্ষার ব্যবস্থা
সারা ভারতে আর কোথাও নেই। পাঁচ জন ছাত্রীকে বিনা বেতনে আহার খরচ বাদে যাবতীয়
সাহায্যও করা হয় সেখানে। রবীন্দ্রনাথের নারীশিক্ষায় সদিচ্ছার বিষয়টি বারবার বহু
পত্রিকা তুলে এনেছে বিস্তৃতভাবে। 'প্রবাসী' ১৯৩৯ আষাঢ় সংখ্যা আচার্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নারীশিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন
কর্মসূচি নিয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ করে। একেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকে উচ্চশিক্ষা
পর্যন্ত প্রতিটি স্তর নিয়ে তাঁর সুচিন্তিত ভাবনাগুলোর বিশ্লেষণ ছিল সেই সংখ্যায়।
বারাণসী মহাবিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রিন্সিপাল শ্রীমতি আশা অধিকারী বিনা বেতনে প্রায়
একবছর এই কাজে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন নিজেকে। এমনই ছিল শান্তিনিকেতনের
মুক্তপ্রাঙ্গনে নারী শিক্ষার ছবি। এমনকি হংকং এর হিন্দু বণিক সমিতি বিশ্ববিদ্যালয়ে
নারীশিক্ষা প্রসারের সংকল্প নিয়ে কবিগুরুর হাতে প্রচুর অর্থসাহায্য পর্যন্ত
করেছিলেন।
ঘনিষ্টজনেদের
লেখা গুরুদেবের বিভিন্ন চিঠিতে নারীশিক্ষা বিষয়ক তাঁর বিভিন্ন সংকল্পের কথা উঠে
এসেছে বারেবারে। চিরকালই তিনি চেয়েছেন তাঁর আশ্রমে মেয়েদের একাধারে স্ময়ংসম্পুর্ণা
এবং স্বাস্থবতী হিসাবে সমাজের সামনে তুলে ধরতে। অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা একটি চিঠিতে
কবি লিখছেন 'যেদিন থেকে আশ্রমে আমি মেয়েদের স্থান দিয়েছি সেইদিন থেকেই আমার মনে এই
কল্পনা ছিল যে আশ্রম রচনায় মেয়েদের ত্যাগ এবং সেবা সুন্দর এবং প্রাণবান হয়ে উঠবে।'
কপিরাইট কৌশিক চক্রবর্ত্তী কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন