গঙ্গা:
পবিত্র অথবা অপবিত্রের গল্পগাথা
অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী
পর্যন্ত হিন্দু জনজীবন আন্দোলিত হয়ে ওঠে গঙ্গার নাম-মাহাত্ম্যে, গঙ্গা মাহাত্ম্যে। ভারত নদীমাতৃক দেশ। ভারতের বিভিন্ন নদীকে
কেন্দ্র করে নগর, তীর্থস্থান, বাণিজ্যকেন্দ্র প্রভৃতি সৃষ্টি হয়েছে। তাই ঋগবেদ থেকে শুরু
করে সংস্কৃত সাহিত্যগুলিতে বিভিন্ন নদনদীর গুণকীর্তন শোনা যায়। ভারতীয় সমাজের
প্রাণসঞ্চার ঘটিয়েছে নদনদী। প্রাচীন নদনদীর সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান নদনদীর অবস্থান,
সাদৃশ্য, ভুগোল, ইতিহাস, বিজ্ঞান, পুরাণ, লৌকিক-অলৌকিক, পবিত্র-অপবিত্র, নিকৃষ্ট-উৎকৃষ্টতা
অনুধাবন করলে আমাদের জ্ঞান ও গবেষণা
সার্থক হবে।
ভারত ও বাংলাদেশে
প্রবাহিত গঙ্গা একটি আন্তর্জাতিক নদী। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের এই নদী জাতীয় নদীও
বটে। গঙ্গার দৈর্ঘ্য ২ হাজার ৫২৫ কিলোমিটার ---
পশ্চিম হিমালয়ে ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যে গঙ্গার উৎসস্থল। দক্ষিণ ও পূর্বে
গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গঙ্গা বঙ্গোপসাগরে এসে মিশেছে ।
জলপ্রবাহের ক্ষমতা অনুসারে গঙ্গা বিশ্বের প্রথম কুড়িটি নদীর মধ্যে অন্যতমা।
গাঙ্গেয় অববাহিকার জনসংখ্যা ৪০ কোটি এবং জনঘনত্ব ১ হাজার জন। ফলত এটিই বিশ্বের
সবচেয়ে জনবহুল নদী অববাহিকা। হিন্দুদের
কাছে গঙ্গা একটি পবিত্র নদী। তাঁরা গঙ্গাকে দেবীজ্ঞানে পুজো করেন। গঙ্গার ঐতিহাসিক
গুরুত্বও অপরিসীম। একাধিক পূর্বতন প্রাদেশিক ও সাম্রাজ্যে রাজধানী (কলকাতা,
কনৌজ, পাটলিপুত্র, কাশী, মুর্শিদাবাদ,
মুঙ্গের ও এলাহাবাদ) এই নদীর তীরেই অবস্থিত।
মূল গঙ্গা নদীর উৎসস্থল
ভাগীরথী ও অলকানন্দা নদীর সঙ্গমস্থল। হিন্দু সংস্কৃতিতে ভাগীরথীকেই গঙ্গার মূল
প্রবাহ বলে মনে করা হয়। যদিও অলকানন্দা নদীটি দীর্ঘতর। অলকানন্দার উৎসস্থল
নন্দাদেবী, ত্রিশূল ও কামেট শৃঙ্গের
বরফ-গলা জল। ভাগীরথীর উৎস গোমুখের গঙ্গোত্রী হিমবাহ (উচ্চতা ১২,৭৬৯ ফুট)। গঙ্গার জলের উৎস অনেকগুলি ছোটো নদী। এগুলির মধ্যে
ছয়টি দীর্ঘতম ধারা এবং গঙ্গার সঙ্গে তাদের সঙ্গমস্থলগুলিকে হিন্দুরা পবিত্র মনে
করে। এই ছয়টি ধারা হল অলকানন্দা, ধৌলীগঙ্গা,
নন্দাকিনী, পিণ্ডার, মন্দাকিনী ও
ভাগীরথী। পঞ্চপ্রয়াগ নামে পরিচিত পাঁচটি সঙ্গমস্থলই অলকানন্দার উপর অবস্থিত।
এগুলি হল বিষ্ণুপ্রয়াগ, নন্দপ্রয়াগ ,
কর্ণপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ এবং সবশেষে দেবপ্রয়াগ যেখানে ভাগীরথী ও
অলকানন্দার মিলনের ফলে মূল গঙ্গা নদীর জন্ম হয়েছে। হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে
গঙ্গার দৈর্ঘ্য ২৫০ কিলোমিটার। হৃষিকেশের কাছে গঙ্গা হিমালয় ত্যাগ করে তীর্থশহর
হরিদ্বারে গাঙ্গেয় সমভূমিতে পড়েছে। হরিদ্বারে একটি বাঁধ গড়ে গঙ্গা খালের
মাধ্যমে গঙ্গার জল উত্তরপ্রদেশের দোয়াব অঞ্চলে জলসেচের জন্য পাঠানো হয়ে থাকে।
এদিকে গঙ্গার মূলধারাটি হরিদ্বারের আগে সামান্য দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী হলেও হরিদ্বার
পেরিয়ে তা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাঁক নিয়েছে।
এরপর গঙ্গা কনৌজ, ফারুকাবাদ ও কানপুর শহরের ধার দিয়ে একটি অর্ধ-বৃত্তাকার
পথে ৮০০ কিলোমিটার পার হয়েছে। এই পথেই
রামগঙ্গা (বার্ষিক জলপ্রবাহ ১৮ হাজার ঘনফুট) গঙ্গায় মিশেছে। এলাহাবাদের ত্রিবেণী
সঙ্গমে যমুনা নদী গঙ্গায় মিশেছে। সঙ্গমস্থলে যমুনার আকার গঙ্গার চেয়েও বড়ো।
যমুনা গঙ্গায় ১ লক্ষ ৪ হাজার ঘনফুট জল ঢালে, যা উভয় নদীর যুগ্মপ্রবাহের জলধারার মোট ৫৮.৫%। এখান থেকে
গঙ্গা পূর্ববাহিনী নদী। যমুনার পর গঙ্গায় মিশেছে কাইমুর পর্বতমালা থেকে উৎপন্ন
নদী তমসা (বার্ষিক জলপ্রবাহ ৬ হাজার ৭০০ ঘনফুট)। এরপর মিশেছে দক্ষিণ হিমালয়ে
উৎপন্ন নদী গোমতী (বার্ষিক জলপ্রবাহ ৮ হাজার ৩০০ ঘনফুট)। তারপর গঙ্গায় মিশেছে
গঙ্গার বৃহত্তম উপনদী ঘর্ঘরা (বার্ষিক জলপ্রবাহ ১ লক্ষ ৬ হাজার)। ঘর্ঘরার পর
দক্ষিণ থেকে গঙ্গার সঙ্গে মিশেছে শোন (বার্ষিক জলপ্রবাহ ৩৫ হাজার ঘনফুট), উত্তর থেকে মিশেছে গণ্ডকী (বার্ষিক জলপ্রবাহ ৫৮ হাজার ৪০০
ঘনফুট) ও কোশী (বার্ষিক জলপ্রবাহ ৭৬ হাজার ৫০০ ঘনফুট)। কোশী ঘর্ঘরা ও যমুনার পর
গঙ্গার তৃতীয় বৃহত্তম উপনদী।
অপরদিকে এলাহাবাদ থেকে
পশ্চিমবঙ্গের মালদহ পর্যন্ত গঙ্গা বারাণসী, পাটনা, গাজিপুর, ভাগলপুর, মির্জাপুর,
বালিয়া, বক্সার, সৈয়দপুর ও চুনার
শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ভাগলপুরে নদী দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বইছে।
পাকুরের কাছে গঙ্গার ঘর্ষণক্ষয় শুরু হয়েছে। এরপর গঙ্গার প্রথম শাখানদী
ভাগীরথী-হুগলির জন্ম, এই নদীই দক্ষিণবঙ্গে
গিয়ে হয়েছে হুগলি নদী হয়েছে। বাংলাদেশ সীমান্ত পেরোনোর কিছু আগে হুগলি নদীতে
গড়ে তোলা হয়েছে ফারাক্কা বাঁধ। এই বাঁধ ও ফিডার খালের মাধ্যমে জলপ্রবাহ
নিয়ন্ত্রণ করে হুগলি নদীকে আপেক্ষিকভাবে পলিমুক্ত রাখা হয়। ভাগীরথী ও জলঙ্গী নদীর
সঙ্গমের পর হুগলি নদীর উৎপত্তি। এই নদীর বহু উপনদী রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো
উপনদীটি হল দামোদর নদ, অববাহিকার আয়তন
২৫ হাজার ৮২০ কিলোমিটার। হুগলি নদী সাগরদ্বীপের কাছে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে।
বাংলাদেশে যমুনা নদীর সঙ্গমস্থল পর্যন্ত গঙ্গার মূল শাখাটি পদ্মা নামে পরিচিত। আরও
দক্ষিণে গিয়ে গঙ্গা ব্রহ্মপুত্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখানদী মেঘনার সঙ্গে মিশে
মেঘনা নাম ধারণ করে শেষপর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদীর বদ্বীপ
বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও
সুরমা-মেঘনা নদীর মিলিত জলপ্রবাহের চেয়ে একমাত্র আমাজন ও কঙ্গো নদীর জলপ্রবাহের
পরিমাণ বেশি। পূর্ণ প্লাবনের ক্ষেত্রে একমাত্র আমাজনই দুই নদীর মধ্যে বৃহত্তর।
আমরা এবার জেনে নিতে পারি
ভারতের ভূতত্ত্ব অবস্থা। ভারতীয় উপমহাদেশ ইন্দো-অস্ট্রেলীয় পাতের উপর ভারতীয়
পাত নামে একটি ছোটো পাতের উপর অবস্থিত। এর গঠনপ্রক্রিয়া শুরু হয় ৭৫ কোটি বছর আগে
দক্ষিণের মহামহাদেশ গণ্ডোয়ানার উত্তরমুখে অভিসরণের সময় থেকেই। এই গঠনপ্রক্রিয়া
চলে ৫০ কোটি বছর ধরে। এরপর উপমহাদেশের পাতটি ইউরেশীয় পাতের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এর
ফলে জন্ম হয় বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতমালা হিমালয়ের। এই উত্থানশীল হিমালয়ের ঠিক
দক্ষিণে পূর্বের সমুদ্রতলে পাত সঞ্চারণের ফলে একটি বিশাল চ্যূতির সৃষ্টি হয়। এই
চ্যূতিটি সিন্ধু নদ ও তার উপনদীগুলি এবং গঙ্গার আনীত পলিতে ভরাট হয়ে বর্তমান
সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমির জন্ম দিয়েছে। সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমি ভূতাত্ত্বিক পরিভাষায়
একটি অগ্রভূমি অববাহিকা। পবিত্র গঙ্গা নদীর জলবিদ্যা, বিশেষত গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে, বেশ জটিল। তাই নদীর দৈর্ঘ্য, জলধারণ ক্ষমতা ও অববাহিকার আকার ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে পরিমাপ
করা হয়ে থাকে। নদীর 'গঙ্গা' নামটি হিমালয়ে ভাগীরথী-অলকানন্দার সঙ্গমস্থল থেকে ফারাক্কা
বাঁধের কাছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নদীর প্রথম শাখানদীর উৎপত্তিস্থল পর্যন্ত
ব্যবহৃত হয়। গঙ্গার দৈর্ঘ্য সাধারণত মনে করা হয় ২,৫০০ কিলোমিটার (প্রায় ২,৫০৫ কিলোমিটার থেকে ২,৫২৫ কিলোমিটার, অথবা সম্ভবত ২,৫৫০ কিমি)। এইসব ক্ষেত্রে
নদীর উৎস ধরা হয় গোমুখে গঙ্গোত্রী হিমবাহের ভাগীরথী নদীর উৎসস্থলটিকে এবং নদীর
মোহানা ধরা হয় বঙ্গোপসাগরে মেঘনার মোহনাটিকে। অন্য মতে, গঙ্গার উৎস ধরা হয় হরিদ্বারে, যেখানে গঙ্গার পার্বত্য প্রবাহটি গাঙ্গেয় সমভূমিতে প্রবেশ
করেছে।
জানার বিষয় হল, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেঘনার বদলে শাখানদী হুগলির
দৈর্ঘ্যশুদ্ধ গঙ্গার দৈর্ঘ্য মাপা হয়। এই দৈর্ঘ্যটি মেঘনার দৈর্ঘ্যের চেয়ে বড়ো।
ভাগীরথীকে উৎস ধরে হুগলিসহ গঙ্গার দৈর্ঘ্য মাপলে মোট দৈর্ঘ্য বেড়ে দাঁড়ায় ২,৬২০ কিলোমিটার এবং হরিদ্বার থেকে হুগলির মোহানা পর্যন্ত
গঙ্গার উৎস দাঁড়ায় ২,১৩৫ কিলোমিটার।
অন্য মতে, ভাগীরথীর উৎস থেকে
বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত গঙ্গার দৈর্ঘ্য মাপা হয়। কারণ এরপর নদীটি পদ্মা নাম
নিয়েছে। এই দৈর্ঘ্যটি হল ২,২৪০ কিলোমিটার।
একই কারণে, নদীর অববাহিকার আকার
সম্পর্কের ভিন্নমত বর্তমান। নেপাল, চিন ও বাংলাদেশ
রাষ্ট্র এবং ভারতের এগারোটি রাজ্য (হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ,
মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, বিহার, ঝাড়খণ্ড, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান,
পশ্চিমবঙ্গ) ও জাতীয় রাজধানী অঞ্চল দিল্লি
জুড়ে এই অববাহিকা অবস্থিত। ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকা বাদে বদ্বীপ-সহ গাঙ্গেয়
অববাহিকার আয়তন প্রায় ১০ লক্ষ ৮০ হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে ৮ লক্ষ ৬১ হাজার
কিলোমিটার ভারতে, ১ লক্ষ ৪০ হাজার
কিলোমিটার কিমি নেপালে, ৪৬ হাজার কিমি বাংলাদেশে ৩৩ হাজার কিলোমিটার। গঙ্গা ও
ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার যৌথ অববাহিকার সামগ্রিক আয়তন প্রায় ১৬ লক্ষ কিলোমিটার বা ১৬
লক্ষ ২১ হাজার কিলোমিটার।
গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকা বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল ও চিন জুড়ে প্রসারিত হয়ে আছে।
গঙ্গার জলধারণ ক্ষমতা
কতটুকু ? দেখব, তবে গঙ্গার জলধারণ ক্ষমতা সম্পর্কের বিভিন্ন মত প্রচলিত
আছে। সাধারণত মেঘনার মোহানার কাছে গঙ্গার জলধারণ ক্ষমতা মাপা হয়। এই পরিমাপের ফলে
গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার
মিলিত জলের পরিমাণ জানা যায়। তিন নদীর বার্ষিক গড় জলধারণ ক্ষমতা ১৩ লক্ষ ঘনফুট
বা ১৫ লক্ষ ঘনফুট। কোনো কোনো মতে, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার জলধারণ ক্ষমতা আলাদা আলাদাভাবে দেখানো
হয়। পৃথকভাবে এই তিন নদীর জলধারণ ক্ষমতা যথাক্রমে ৫ লক্ষ ৮৮ হাজার ঘনফুট, ৭ লক্ষ ঘনফুট ও ১ লক্ষ ৮০ হাজার ঘনফুট। বাংলাদেশের
হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে গঙ্গার সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ ২৫ লক্ষ ঘনফুটেরও বেশি বলে
নথিবদ্ধ হয়েছে। একই স্থানে সর্বনিম্ন জলপ্রবাহ ছিল প্রায় ৬ হাজার ৪০০ ঘনফুট
(১৯৯৭খ্রিস্টাব্দে)। দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমি বায়ু-ঘটিত বর্ষাকালের দ্বারা গঙ্গার
জলচক্র নিয়ন্ত্রিত হয়। জুন থেকে
সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে বর্ষার ৮৪% শতাংশ বৃষ্টিপাত হয় । অপরদিকে গঙ্গার নিজস্ব
জলপ্রবাহও ঋতুনির্ভর। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পরিমাপ অনুসারে, শুখা মরসুম ও বর্ষাকালের জলপ্রবাহের অনুপাত ১:৬। এই
ঋতুনির্ভর জলপ্রবাহ এই অঞ্চলে ভূমি ও জলসম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত নানা সমস্যার
জন্মদাতা। ফলে খরা ও বন্যা দুই-ই দেখা যায়। বিশেষ করে বাংলাদেশে, শুখা মরসুমে খরা ও বর্ষাকালে বন্যা একটি প্রধান সমস্যা।
অনেক বড়ো নদী রয়েছে
গাঙ্গেয় বদ্বীপে । এগুলির কোনোটি শাখানদী, কোনোটি-বা উপনদী । বস্তুত এই সব নদনদী সৃষ্টি করে রেখেছে এক জটিল নদীজালিকা । এদের
মধ্যে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র বৃহত্তম নদী।
দুই নদীই একাধিক শাখানদীতে বিভক্ত হয়েছে, আবার শাখানদীগুলিও পরস্পর মিলিত হয়েছে। তবে মাঝে মাঝে এই নদীজালিকাগুলিতেও
ভৌগোলিক পরিবর্তন দেখা যায়। দ্বাদশ শতাব্দীর আগে গঙ্গার মূল প্রবাহ ছিল
ভাগীরথী-হুগলি শাখানদীটিই । পদ্মা ছিল
একটি ছোটো শাখানদী মাত্র। তবে গঙ্গা বঙ্গোপসাগরে মিলিত হত আদিগঙ্গার মাধ্যমে,
আধুনিক হুগলি নদীর পথে নয়। দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে
ভাগীরথী-হুগলি ও পদ্মার আকার প্রায় একই হয়ে দাঁড়ায়। ষোড়শ শতাব্দীর পরে পদ্মা
আকার বৃদ্ধি পায় এবং তা গঙ্গার মূল প্রবাহপথে পরিণত হয়। অনেকে মনে করেন, ভাগীরথী-হুগলির প্রবাহপথটি ক্রমে ক্রমে পলি পড়ে রুদ্ধ হয়ে
যায়। সেই জন্যই গঙ্গার মূল প্রবাহ পদ্মার পথে সরে গিয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর
প্রায় শেষদিকে পদ্মাই গঙ্গার মূল প্রবাহপথ হয়ে দাঁড়ায়। গঙ্গার মূল প্রবাহপথ
পদ্মায় সরে যাওয়ার ফলে ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর পৃথকভাবে বঙ্গোপসাগরে না মিশে
একসঙ্গে মিলিত হয়। গঙ্গা ও মেঘনার বর্তমান সঙ্গমস্থলটি দেড়শো বছর আগে গঠন হয়ে
গেছে।
আঠারো শতকের শেষদিকে
নিম্ন ব্রহ্মপুত্রেরও প্রবাহপথে নাটকীয় বদল এসেছিল, ফলে গঙ্গার সঙ্গে এর সম্পর্কটিই যায় বদলে। ১৭৮৭ সালের
বিধ্বংসী বন্যা তিস্তা নদীর প্রবাহপথটি ঘুরে যায়। এই নদী আগে গঙ্গা-পদ্মার উপনদী
ছিল। ১৭৮৭ সালের বন্যার পর নদীটি গতিপথ পালটে পূর্বদিকে গিয়ে ব্রহ্মপুত্রে পড়ে।
ফলে ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ দক্ষিণে সরে আসে এবং একটি নতুন নদীপথের সৃষ্টি হয়।
ব্রহ্মপুত্রের এই নতুন প্রধান গতিপথটির নাম হয় যমুনা নদী। এটি দক্ষিণে প্রবাহিত
হয়ে গঙ্গা-পদ্মায় মিলিত হয়। আগে ব্রহ্মপুত্রের গতি ছিল কিঞ্চিৎ পূর্বমুখী। তা
ময়মনসিংহ শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনা নদীতে মিশত। বর্তমানে এই নদীপথটি
একটি ছোটো শাখানদী হলেও পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নামে ব্রহ্মপুত্র নামটি অব্যাহত আছে।
লাঙ্গলবাঁধে পুরোনো ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার সঙ্গমস্থল হিন্দুদের কাছে আজও পবিত্র। এই
সঙ্গমের কাছেই ঐতিহাসিক উয়াড়ি-বটেশ্বর অবস্থিত। ভৌগোলিক ব্যাপারটা যতটা সম্ভব
আলোচনা করা গেল। কিন্তু গঙ্গার একটা আস্ত ইতিহাস আছে। সে ব্যাপারেও আলোচনা করার
লোভ সামলাতে পারছি না।
১৯০০ থেকে ১৩০০
খ্রিস্টপূর্বাব্দ সিন্ধুসভ্যতার অন্তিম হরপ্পা পর্যায়ে হরপ্পাবাসীরা সিন্ধু
উপত্যকা ছেড়ে পূর্বদিকে বসতি স্থাপন করতে করতে গঙ্গা-যমুনা দোয়াব পর্যন্ত চলে
আসে। যদিও কেউই গঙ্গা পার হয়ে পূর্বতীরে বসতি স্থাপন করেনি। খ্রিস্টপূর্ব
দ্বিতীয় সহস্রাব্দের গোড়ার দিকে হরপ্পা সভ্যতার ভেঙে যাওয়ার সময় থেকে ভারতীয়
সভ্যতার প্রাণকেন্দ্রটি সিন্ধু উপত্যকা থেকে সরে চলে আসে গাঙ্গেয় অববাহিকায়।
গাঙ্গেয় অববাহিকায় অন্তিম হরপ্পা বসতি এবং সমাধিক্ষেত্র এইচ পুরাতাত্ত্বিক
সংস্কৃতি, ইন্দো-আর্য জাতি ও বৈদিক
যুগের মধ্যে কোনো সংযোগ থাকলেও থাকতে পারে।
আদি বৈদিক যুগ বা
ঋগ্বেদের যুগে গঙ্গা নয়, সিন্ধু ও সরস্বতী
নদীই ছিল পবিত্র নদী। কিন্তু পরবর্তী তিন বেদে গঙ্গার উপরের অধিক গুরুত্ব আরোপ করা
হয়েছে। তারপর মৌর্য থেকে মুঘল সাম্রাজ্য পর্যন্ত অধিকাংশ ভারতীয় সভ্যতারই
প্রাণকেন্দ্র ছিল গাঙ্গেয় সমভূমি। ৩৫০ থেকে ২৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম যে
ইউরোপীয় পর্যটকের রচনায় গঙ্গার উল্লেখ পাওয়া যায়, তাঁর নাম মেগাস্থিনিস। তাঁর রচিত ইন্ডিকা বইটিতে বেশ
কয়েকবার গঙ্গার উল্লেখ পাওয়া যায় --- "ভারতে অনেক বড়ো ও নৌবহনযোগ্য নদী
আছে। এই নদীগুলি উত্তর সীমান্তের পার্বত্য অঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়ে সমতল অঞ্চল
বরাবর প্রবাহিত হয়েছে। অনেকগুলো নদী আবার পরস্পর-পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে
সম্মিলিত রূপে গঙ্গা নদীতে মিশেছে । গঙ্গা নদী উৎসের কাছে ৩০ স্টেডিয়া চওড়া।
গঙ্গা নদী উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে গঙ্গারিডাই দেশের পূর্ব সীমান্তের মহাসাগরে
পড়েছে।" এরপর ১৯৫১ সালে ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কথা ঘোষণা
করলে ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের (এখন যেটা বাংলাদেশ পরিচিত) মধ্যে গঙ্গার জলবণ্টন
নিয়ে বিবাদ শুরু হয়। এই বাঁধ নির্মাণের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল ৪০ হাজার ঘনফুট জল
গঙ্গা থেকে ভাগীরথী-হুগলি নদীর পথে ঘুরিয়ে দেওয়া যাতে কলকাতা বন্দরের নাব্যতা
রক্ষিত হয়। সেই সময় শুখা মরসুমে গঙ্গায় মোট জল থাকত ৫০হাজার থেকে ৫৫ হাজার
ঘনফুট। ফলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য শুধুমাত্র ১০হাজার থেকে ১৫হাজার ঘনফুট জলই অবশিষ্ট থাকে।
বিবাদের সূত্রপাত হয়
পূর্ব পাকিস্তান এ ব্যাপারে আপত্তির কথা জানালে। ১৯৯৬ সালে একটি ৩০ বছরের চুক্তি
সাক্ষরিত হয়। চুক্তির সারকথা গঙ্গায় যদি
৭০ হাজার ঘনফুটের কম জল প্রবাহিত হয়, তবে ভারত ও বাংলাদেশ ৫০% করে --- অর্থাৎ ৩৫ হাজার ঘনফুট জল প্রতি দশদিন অন্তর
পাওয়া যাবে। অবশ্য পরের বছরেই ফারাক্কায়
জলপ্রবাহের পরিমাণ রেকর্ড পরিমাণে হ্রাস পেল। তার ফলে চুক্তির শর্ত মানা প্রায়
অসম্ভব হয়ে পড়ে। অপরদিকে ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশে গঙ্গার জলপ্রবাহের
পরিমাণ ছিল সবচেয়ে কম ( ৬ হাজার ৫০০ ঘনফুট)। পরের বছরগুলিতে অবশ্য শুখা মরসুমের
জলপ্রবাহ স্বাভাবিক হয়ে আসে। কিন্তু সমস্যার মোকাবিলা কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে অবশ্য চিন্তাভাবনার স্তরে আছে।
হিন্দুধর্মের
পুনঃপ্রতিষ্ঠার জনক আদি শংকরাচার্য তাঁর রচিত “গঙ্গাস্তোত্রম্”-এ যে মর্মে বর্ণনা করেছেন, তা এখানে উল্লেখ
করা যাক – “সুরেশ্বরী, ভগবতী, ত্রিভুবনতারিণী,
তরলতরঙ্গযুক্তা, শংকর-মৌলি-বিহারিণী, নির্মলা, দেবী গঙ্গা,
তোমার পাদপদ্মে আমার সুমতি হোক (শ্লোক ১)।
ভাগীরথী সুখদায়িনী মা, তোমার জলের মহিমা
বেদাদিতে খ্যাত ; আমি তোমার মহিমা জানি না ;
হে কৃপাময়ী, অজ্ঞ আমাকে ত্রাণ করো (শ্লোক ২)। হরির পাদপদ্ম থেকে
তরঙ্গাকারে নির্গতা এবং তুষার চন্দ্র ও মুক্তার মতো শুভ্রতরঙ্গযুক্তা গঙ্গা,
আমার দুষ্কর্মের ভার দূর করো এবং কৃপাপূর্বক
আমায় ভবসাগর থেকে উদ্ধার করো (শ্লোক ৩)। তোমার নির্মল জল যে পান করেছে সে
সর্বশ্রেষ্ঠ ধামপ্রাপ্ত হয়েছে। মা গঙ্গা, যে তোমার ভক্ত তাকে যম নিশ্চয় দেখতে অসমর্থ, সে অমর (শ্লোক ৪)।
হে পতিত-উদ্ধারিণী, জাহ্নবী, খণ্ডিত গিরিবরের দ্বারা মণ্ডিত তরঙ্গশালিনী, ভীষ্মজননী, জহ্নুকন্যা,
পতিত-নিবারিণী গঙ্গা, তুমি ত্রিভুবনে ধন্যা (শ্লোক ৫)। পারাবারবিহারিণী, দেববধূগণ কর্তৃক চঞ্চল কটাক্ষে অবলোকিতা গঙ্গা পৃথিবীতে
কল্পলতার মতো ফলদা তোমাকে যে প্রণাম করে সে শোকে পতিত হয় না (শ্লোক ৬)।
নরক-নিবারিণী, কলুষবিনাশিনী, স্বমহিমায় অতি যশস্বিনী জাহ্নবী গঙ্গা কেউ যদি তোমার স্রোতে
স্নান করে তবে সে পুনর্বার মাতৃগর্ভে প্রবেশ করে না (শ্লোক ৭)। উজ্জ্বল
অঙ্গবিশিষ্টা, পবিত্রতরঙ্গশালিনী,
কৃপাকটাক্ষময়ী, ইন্দ্রের মুকুটমণির দ্বারা চরণে প্রণত, সুখপ্রদায়িনী, মঙ্গলপ্রদায়িনী, সেবকের আশ্রয়স্বরূপিণী,
জাহ্নবী, তুমি জয়যুক্ত হও, জয়যুক্তা হও (শ্লোক ৮)। ভগবতী, তুমি আমার রোগ
শোক পাপ তাপ ও কুমতিকলাপ দূর করো। ত্রিভুবনশ্রেষ্ঠা, বসুধার হারস্বরূপা তুমি নিশ্চয় সংসারেআমার একমাত্র গতি
(শ্লোক ৯)। স্বর্গের আনন্দবিধায়িনী, পরমানন্দরূপিণী, কাতরজনের বন্দিতা তুমি
আমার প্রতি করুণা করো। তোমার তটসমীপে যার বাস তার বৈকুণ্ঠেই নিবাস বলতে হবে (শ্লোক
১০)”।
গঙ্গা প্রসঙ্গে
শ্রীশংকরাচার্যের পঞ্চমুখে প্রশংসা। বিশেষণ, বিশেষণ এবং বিশেষণ। গঙ্গা – গম্ + গ (গন্) –ক + স্ত্রীলিঙ্গে আ (টাপ্)। অন্য অর্থে গো-এর অর্থ পৃথিবী। গো + দ্বিতীয়ার
একবচনে = গাম্ (পৃথিবীকে)। গম্ + ড কর্তৃবাচ্যে + স্ত্রীলিঙ্গে = গঙ্গা। গমনার্থে
গম্ ধাতু অর্থাৎ পৃথিবীতে যিনি আগমন করেছেন। এহেন গঙ্গার পরিচয় পুরাণ এবং হিন্দু
ধর্মশাস্ত্রগুলিতে একেক জায়গায় একেক রকম কাহিনি পাওয়া যায়। আমি সেই গল্পগুলি বলার
চেষ্টা করব।
ভগীরথের গঙ্গা :
বিষ্ণুপুরাণ ও ভাগবতপুরাণে বলা হয়েছে, গঙ্গা বিষ্ণুর চরণযুগল থেকে উৎপন্ন হয়ে
স্বর্গলোকে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মাপুরীতে পতিত হয়েছে। সেই গঙ্গাকে
ইক্ষ্বাকুবংশীয় দিলীপের পুত্র ভগীরথ সগর রাজার
৬০,০০০ (ষাট হাজার) সন্তানকে
উদ্ধার করার জন্য পৃথিবীতে নিয়ে আসেন। ভগীরথ গঙ্গাকে সন্তুষ্ট করে মহাদেবের
শরণাপন্ন হন। মহাদেব গঙ্গাকে মাথায় ধারণ করতে সম্মত হলে গঙ্গা মৎস্যাদি জলজন্তু সহ
গগনমেখলার মতো মহাদেবের ললাটে পতিত হলেন এবং ত্রিধা বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হতে
লাগলেন। ভগীরথ তাঁকে পথ দেখিয়ে মর্ত্যে নিয়ে আসেন এবং সগর সন্তানদের উদ্ধার করেন।
মৎস্যপুরাণে গঙ্গা :
ইক্ষ্বাকুবংশীয় সগর রাজার অধস্তন পঞ্চম পুরুষ হলেন ভগীরথ। তিনি দিলীপের পুত্র।
ভগীরথ অষ্টাবক্রমুনির আশীর্বাদে মাংসপিণ্ডরূপ বিকলাঙ্গ থেকে উত্তম দেহ লাভ করেন।
কপিলমুনির অভিশাপে ভস্মীভূত পিতৃপুরুষের উদ্ধারের জন্য তিনি শিবের তপস্যা করে
শিবকে সন্তুষ্ট করেন এবং হিমালয়-কন্যা গঙ্গার প্রবল বেগকে ধারণে রাজি করান। গঙ্গা
অতিবেগে মহাদেবের মস্তকের উপর পতিত হলে শিব তাঁকে মস্তকে জটার মধ্যে আবদ্ধ করেন।
তারপর ভগীরথের অনুরোধে জটা থেকে সাতটি ধারায় ভূতলে অবতরণ করান। গঙ্গার তিনটি
প্রবাহ পূর্বদিকে এবং অন্য তিনটি প্রবাহ পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়। আর একটি প্রবাহ
ভগীরথকে অনুসরণ করে চলে। ভগীরথ সেই স্রোতের পথ নির্দেশ করে দিয়েছিলেন বলে এই
প্রবাহের নাম হয় ভাগীরথী। ভগীরথ দিব্যরথে আরোহণ করে গঙ্গার সঙ্গে পাতালে যান।
সেখানে গঙ্গা সগর-সন্তানদের ভস্মরাশির উপর দিয়ে প্রবাহিত হলে তাঁরা মুক্তিলাভ করে
স্বর্গে যান।
জহ্নুর কন্যা জাহ্নবী :
জহ্নু অতিশয় তপঃপরায়ণ রাজর্ষি ছিলেন। ইনার পিতার নাম সুহোত্র এবং মায়ের নাম
কেশিনী। জহ্নু যুবনাশ্বের কন্যা কাবেরীকে বিয়ে করেন। কাবেরীর গর্ভে জহ্নুর সুনহ
নামে এক পুত্র জন্মায়। জহ্নু সবসময় যজ্ঞাদি কাজে ব্যস্ত থাকতেন। রাজা ভগীরথ
পিতৃপুরুষের উদ্ধারার্থে গঙ্গাকে পাতালে আনয়নকালে মর্ত্যে রাজর্ষি জহ্নু এক যজ্ঞের
অনুষ্ঠানে ব্যস্ত ছিলেন। গঙ্গা জহ্নুর যক্ষভূমি প্লাবিত করে যজ্ঞের সমস্ত দ্রব্য
ভাসিয়ে যান। জহ্নু রেগে গিয়ে গঙ্গাকে তপস্যার প্রভাবে সম্পূর্ণভাবে পান করে ফেলেন।
তারপর দেব, গন্ধর্ব, ঋষি ও ভগীরথের স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে জহ্নু কান দিয়ে (মতান্তরে
জানু বিদীর্ণ করে) গঙ্গাকে প্রবাহিত করে মুক্ত করে দেন।
বামনপুরাণে গঙ্গা :
মেনকার তিন কন্যা – রাগিণী, কুটিলা এবং কালী। ব্রহ্মা কুটিলাকে শিবতেজ ধারণ করতে অনুরোধ
করেন, কিন্তু কুটিলা শিবতেজ
ধারণের অক্ষমতা জানালে ব্রহ্মা তাঁকে শাপ প্রদান করে বলেন, “তুমি নদী হয়ে মর্ত্যে বয়ে যাও”। এই কুটিলা নদীই
কার্তিকের জন্মকালে শিবতেজ ধারণ করে শরবনের মধ্যে নিক্ষেপ করেছিলেন। কুটিলা নদীই
আজও গঙ্গা নামে পরিচিত।
অন্য আরও শাস্ত্রকাহিনি :
(১) ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে গঙ্গার জন্ম বিষ্ণুর দেহ থেকে। তিনি আবার বিষ্ণুর স্ত্রী।
বিষ্ণুর তিন স্ত্রী – লক্ষ্মী, সরস্বতী, গঙ্গা। সরস্বতী ও
গঙ্গার বিবাদে অভিশপ্ত হয়ে দুজনে নদীতে পরিণত হয়। (২) শ্রীকৃষ্ণ গঙ্গার প্রেমে
আকৃষ্ট হলে রাধা রেগে গিয়ে গণ্ডুষে পান করতে উদ্যত হলে গঙ্গা ভয়ে কৃষ্ণের চরণে
আশ্রয়ে আশ্রয় নেন। পৃথিবী জলশূন্য হলে দেবতাদের স্তবে কৃষ্ণ গঙ্গাকে নখাগ্র থেকে
বের করেন। তাই গঙ্গার অপর নাম হল বিষ্ণুপদী। পরে ব্রহ্মার অনুরোধে কৃষ্ণ গঙ্গাকে
বিয়ে করেন। (৩) বিকলাঙ্গ রাগ-রাগিণীকে সুস্থদেহে আনার জন্য নারদের পরামর্শে মহাদেব
ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর সামনে গান করেন। এতে
রাগ-রাগিণী পূর্ণদেহ পায়। বিষ্ণু মহাদেবের সংগীতে দ্রবীভূত হলে ব্রহ্মা তাঁকেতাঁর
কমণ্ডলুতে স্থান দেন। সেই দ্রবীভূত বিষ্ণুই গঙ্গা। পরে ভগীরথের আমন্ত্রণে মর্ত্যে
আসেন। (৪) গঙ্গা গিরিরাজ হিমালয়ের এক কন্যা। দেবগণের চেষ্টায় তাঁর সঙ্গে শিবের
বিয়ে হয়। গঙ্গাকে না-দেখতে পেয়ে শোকাভিভূতা মা মেনকা তাঁকে সলিলরূপিণী হওয়ার হওয়ার
অভিশাপ দেন। সেই গঙ্গা ব্রহ্মার কমণ্ডলুতে বাস করতে থাকেন। (৫) মহাকাব্য মহাভারত
অনুসারে, বশিষ্ট কর্তৃক অভিশপ্ত
বসুগণ গঙ্গাকে তাঁদের জননী হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। গঙ্গা রাজা শান্তনুকে এই
শর্তে পতিত্বে বরণ করেন যে গঙ্গার কোনো কাজে রাজা বাধাস্বরূপ হবেন না। একে একে
অষ্টবসুর সাত জন গঙ্গাগর্ভে জন্মগ্রহণ করেন এবং জন্মমাত্রেই গঙ্গা তাঁদের জলে
নিমজ্জিত করে হত্যা করেন এবং তাঁরা শাপমুক্ত হন। রাজা তাঁকে বাধা না দিলেও অষ্টম সন্তান
জন্মের পর শান্তনু গঙ্গাকে বাধা দিতে বাধ্য হন। এই কারণে গঙ্গার অষ্টম সন্তানটি
জীবিত রয়ে যান। এই ব্যক্তিই মহাকাব্যের সর্বজনশ্রদ্ধেয় চরিত্র ভীষ্ম। (৬) বৈষ্ণব
মতে, এই গল্পে ইন্দ্রের পরিবর্তে দেখা যায় তাঁর
পূর্বতন সহকারী বিষ্ণুকে। এই স্বর্গীয় তরলের নাম, এই মতে, "বিষ্ণুপদী"। বামন রূপে বিষ্ণু তাঁর একটি পা রেখেছিলেন স্বর্গে। তাঁর নখের
আঘাতে স্বর্গে একটি ছিদ্রের সৃষ্টি হয়। এই ছিদ্রপথে মুক্তি পায় বিষ্ণুপদী। ধ্রুব
বিষ্ণুপদীকে নিয়ে আসেন স্বর্গে। আকাশে বিষ্ণুপদী আকাশগঙ্গা সৃষ্টি করে উপস্থিত হন
চন্দ্রে। সেখান থেকে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে তিনি চলে যান মেরুপর্বতের শৃঙ্গে
ব্রহ্মলোকে। মেরুপর্বতের শীর্ষে অবস্থিত ব্রহ্মার আসনের পদ্মগুলি থেকে পৃথিবীর
মহাদেশগুলির সৃষ্টি হয়। এখান থেকেই বিষ্ণুপদী অলকানন্দার রূপ ধরে একটি মহাদেশে
অবতীর্ণা হন এবং ভারতবর্ষে গঙ্গা নামে প্রবেশ করেন। (৭) হিন্দুদের প্রাচীনতম
ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদে গঙ্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের নদীস্তুতি (ঋগ্বেদ
১০।৭৫) অংশে পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত নদীগুলির তালিকা পাওয়া যায়। গ্রন্থের
৬।৪৫।৩১ অংশে গঙ্গা শব্দটির উল্লেখ আছে, তবে নদী অর্থে কি না সেটি এখানে পরিষ্কার নয়। ঋগ্বেদ ৩।৫৮।৬ অংশে বলা হয়েছে
"হে বীরগণ, তোমাদের আদিভূমি, তোমাদের পবিত্র সঙ্গীগণ, তোমাদের ধনসম্পদ সবই জাহ্নবীর তীরে।" সম্ভবত এই
স্তোত্রে গঙ্গার কথাই বলা হয়েছে। ঋগ্বেদ ১।১১৬।১৮-১৯ অংশে জাহ্নবী ও গাঙ্গেয়
ডলফিনের উল্লেখ পাওয়া যায়।
হিন্দুগণের জন্ম থেকে
মৃত্যু পর্যন্ত “গঙ্গেব পরমা গতিঃ”। হিন্দুদের
একমাত্র গতি – “ত্বমসি গতির্মম খলু
সংসারে”। সনাতন হিন্দুধর্মে গঙ্গা আর গঙ্গাভক্তি যেন সমার্থক হয়ে আছে,
যুগ যুগ ধরে। অবশ্য এর মূলে আছে ভারতীয়
মুনি-ঋষির জীবনে অপরিসীম গঙ্গাভক্তি – “গঙ্গা শরণাগতি”। গঙ্গা নদীকে ভারতীয়গণ দেবীজ্ঞানে পুজো করে – “পতিতোদ্ধারিণি জাহ্নবী গঙ্গে”। উৎস থেকে মোহানা
পর্যন্ত সম্পূর্ণ গঙ্গা নদীটিই হিন্দুদের কাছে পবিত্র। সব জায়গাতেই গঙ্গাস্নান
হিন্দুদের কাছে একটি পুণ্যকর্ম বলে বিবেচিত হয়। গঙ্গার জলে হিন্দুরা
পূর্বপুরুষদের তর্পণ করে। গঙ্গায় ফুল ও প্রদীপ ভাসায়। এমনকি গঙ্গাস্নান সেরে ঘরে
ফেরার সময়েও কিছু পরিমাণ গঙ্গাজল ঘরোয়া ধর্মানুষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য সংগ্রহ করে
নিয়ে যায়।
বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের
প্রচারক ‘শিবাবতার’ শ্রীশংকরাচার্য মনে করেন, গঙ্গার নিকটে বসবাস করলে বৈকুণ্ঠ বাস হয় – “তব তটনিকটে যস্য নিবাসঃ খলু বৈকুণ্ঠে তস্য নিবাসঃ”। তিনি গঙ্গাকে
এতটাই গুরুত্ব দিয়েছেন যে, তাঁর কাছে
প্রার্থনা করে বলেছেন – “হে ভগবতী,
তুমি আমার রোগ, শোক, পাপ, তাপ ও কুমতিগুলো দূর করো। ত্রিভুবনশ্রেষ্ঠা বসুধার
হারস্বরূপ তুমি নিশ্চয়ই সংসারে আমার একমাত্র গতি।” শুধু শংকরাচার্যই নয়, রামায়ণকার বাল্মীকিও বলেছেন, গঙ্গার তীরে বাস, গঙ্গার জল পান, তাঁর তরঙ্গ নিরীক্ষণ এবং
গঙ্গার নাম স্মরণ করতে করতে গঙ্গার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তিনি যেন মারা যান –
“ত্ব্ত্তীরে বসতস্ত্বদম্বু
পিবতস্ত্বদ্বীচিমুৎপ্রেঙ্খতস্ত্বন্নাম্ স্বরতস্ত্বদর্পিতদৃশঃ স্যাম্মে শরীরব্যয়ঃ”।
হিন্দু পুরাণের সব
জায়গাতেই গঙ্গাজলকে পবিত্র বলা হয়েছে। অনেক জায়গায় স্থানীয় নদীগুলিকে
"গঙ্গাতুল্য" মনে করা হয়। যেমন, কাবেরী নদীকে বলা হয় "দক্ষিণের গঙ্গা"। গোদাবরী
নদীকে মনে করা হয়, ঋষি গৌতম কর্তৃক
মধ্যভারতে আনীত গঙ্গা। হিন্দুদের প্রতিটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গঙ্গাকে আহ্বান করা
হয়। ভাবা হয়, সকল পবিত্র জলেই গঙ্গা
অধিষ্ঠিত। গঙ্গোত্রী, হরিদ্বার, প্রয়াগ ও বারাণসীতে গঙ্গাস্নান হিন্দুদের কাছে বিশেষ
পুণ্যকর্ম। গঙ্গার প্রতীকী ও ধর্মীয় গুরুত্ব ভারতে সংশয়বাদীরাও স্বীকার করেন।
জওহরলাল নেহেরু নিজে ধর্মবিরোধী হলেও তাঁর চিতাভস্মের একমুঠো গঙ্গায় বিসর্জন দিতে
বলেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, "গঙ্গা ভারতের
নদী। ভারতবাসীর প্রিয়। এই নদীকে ঘিরে রয়েছে কত জাতির কত স্মৃতি, কত আশা ও ভীতি, বিজয়ের কত গান, কত জয়পরাজয়। গঙ্গা
ভারতের প্রাচীন সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রতীক। কত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে নিত্য বয়ে
চলে গঙ্গা। তবু সে রয়েছে সেই গঙ্গাই।" আরবি পর্যটক ইবনে বতুতার বর্ণনায় জানা
যায়, মোহম্মদ বিন তুঘলকের জন্য সুদূর হরিদ্বার থেকে
নিজ রাজধানী দৌলতাবাদে বড়ো ঘড়া ভরতি গঙ্গাজল আনা হত। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, আকবরের কাছে
গঙ্গাজল অমৃতসমান ছিল। এমনকি আওরঙ্গজেবের শাহিখানার সঙ্গেও গঙ্গাজল থাকত।
শ্রীশংকরাচার্য গঙ্গাজলের অপরিহার্যতার কথাও বলেছেন – (১) পবিত্র গঙ্গাজল পান করলে মোক্ষ লাভ হয় – “পরমপদং খলু তেন গৃহীতম”, (২) গঙ্গার জলে যিনি স্নান করেন তিনি মোক্ষ লাভ করেন। তাঁকে
জন্মগ্রহণ করতে হয় না – “পুনরপি জঠরে
সোঽপি ন জাতঃ”, (৩) দেবী গঙ্গা পাপীদের
উদ্ধার বা তাঁদের পাপ ও নরক গমন থেকে নিবৃত্ত করেন। অপরাধী ব্যক্তিদের গঙ্গা
সর্বদা কৃপাবর্ষণ করেন।
প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের
কৃষ্ণপক্ষের দশমী তিথিটি হিন্দুরা "গঙ্গাবতরণ" বা গঙ্গার মর্ত্যে
অবতরণের স্মরণে বিশেষভাবে উদযাপন করে। এই দিনটিকে "দশহরা" বলে। এই দিনটি
গঙ্গাস্নানের জন্য বিশেষভাবে প্রশস্ত। এই দিন গঙ্গাস্নান করলে দশবিধ বা দশ জন্মের
পাপ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। যাঁরা এই দিন গঙ্গায় এসে স্নান করতে পারেন না,
তাঁরা তাঁদের বাসস্থানের নিকটবর্তী জলাশয়ে বা
নদীতে স্নান করেন। কারণ, হিন্দু বিশ্বাসে
এই দিন সকল জলাশয় ও নদী গঙ্গাতুল্য হয়। ‘গঙ্গাবতরণ’ হিন্দুধর্মের একটি
প্রাচীন উপাখ্যান। এই গল্পের নানা পাঠান্তর পাওয়া যায়। বেদে আছে, স্বর্গের রাজা ইন্দ্র বৃত্র নামে এক অসুরকে বধ করেন। তার
রক্ত সোমরসের রূপে পৃথিবীতে গড়িয়ে পড়ে।
হিন্দুজীবনে গঙ্গা –
স্বর্গের ঠিকানা : প্রিয়জনের মৃত্যু হলে মৃতের
অস্থি গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। গঙ্গা যেহেতু স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নেমে
এসেছিলেন, তাই তাঁকে মর্ত্য থেকে
স্বর্গে উত্তরণের একটি মাধ্যমও মনে করা হয়। শাস্ত্রানুযায়ী পবিত্র গঙ্গায় অস্থি
ফেললে তিনি যতই পাপী হোন-না-কেন স্বর্গই হবে তাঁর শেষ ঠিকানা। সুরেন্দ্রমোহন
ভট্টাচার্য প্রণীত “পুরোহিত দর্পণ” বলছে – “অদ্যেত্যাদি
অমুকগোত্রস্য প্রেতস্য অমুক দেবশর্ম্মণঃ এতদাস্থি সম সংখ্যক বর্ষ সহস্রাবচ্ছিন্ন
স্বর্গাধিকরণকমহিতত্ব কামোঽমুকস্য এতান্যস্থিখণ্ডানি গঙ্গায়াং নিক্ষিপামি”। অর্থাৎ ….অমুক গোত্রের প্রেত অমুক দেবশর্ম্মণ এর যত সংখ্যক অস্থি তত
সহস্র বছর একটানা স্বর্গাধিকরণ কামনায় অস্থিখণ্ড গঙ্গায় নিক্ষেপ করিলাম।
কুর্মপুরাণে কথিত আছে – “যাবস্ত্যস্থীনি
গঙ্গায়াং তিষ্ঠন্তি পুরুষস্য চ।/তাবদ্বর্ষসহস্রাণি স্বর্গলোকে মহীয়তে”। অর্থাৎ যতদিন
অস্থি গঙ্গাগর্ভে বিদ্যমান থাকবে তত সহস্র বছর মৃত ব্যক্তি স্বর্গলোকে বাস করবে।
কুর্মপুরাণ আরও বলেছে – “দশাহাভ্যন্তরে
যস্য গঙ্গাতোয়েস্থি মজ্জাতি।/গঙ্গায়াং মরণে যাদৃক্ তাদৃক্ ফলমবাপ্নুয়াৎ”। অর্থাৎ দশদিনের
মধ্যে বা অশৌচ মধ্যে যার অস্থি গঙ্গায় নিক্ষেপ করা হয়, সেই ব্যক্তি গঙ্গায় মৃত্যুসম ফল লাভ করে। হিন্দুবিশ্বাস মতে,
স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল -- এই তিন লোকে প্রবাহিত বলে গঙ্গার অপর নাম
ত্রিলোকপথগামিনী। আবার, জীবিত ও মৃত সব
জীবেরই যাত্রাপথে অবস্থিত বলে, তাঁর অন্য নাম
তীর্থ। এই জন্য হিন্দুদের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে গঙ্গাবতরণ উপাখ্যানটি পাঠ করা হয়ে
থাকে এবং মৃতের অন্ত্যেষ্টি ও পারলৌকিক ক্রিয়ায় গঙ্গাজল ব্যবহৃত হয়। গঙ্গার সকল
স্তোত্রেই গঙ্গাতীরে মৃত্যুকে গৌরবান্বিত করা হয়েছে। আচ্ছা, ভিন্ন ধর্মের মানুষেরা গঙ্গায় অস্থি দেন না, তাঁরা কীভাবে স্বর্গে যাবেন ? তাঁরা স্বর্গে যাবেন না ? গঙ্গায় অস্থি দিলে বা স্নান করলে যদি সত্যিই স্বর্গে যাওয়া
যেত, তাহলে তো সারা পৃথিবীর মানুষ গঙ্গায় এসে গা
ধুয়ে যেতে পারত ! ডঃ বি আর আম্মেদকরের ভাষামর্মে বলা হয়েছে – গঙ্গা মাহাত্ম্য ধূর্ত ব্রাহ্মণদের দ্বারা রচিত। গঙ্গায়
অস্থি নিক্ষেপের ফলে ব্রাহ্মণগণই লাভবান হন। অস্থি নিক্ষেপের ফলে কেউ স্বর্গে
গেছেন তার প্রমাণ কেউ দিতে পারেন না। এটা বোকাদের শোষণেরই নামান্তর। যাঁরা এটা
মানেন তাঁরা ব্রাহ্মণের কাছে বোকাই নন, তাঁদের আর্থিক এবং সময়ের অপচয়ও ঘটে। পথে বিপদের সম্ভাবনাও থাকে। এটা
কুসংস্কার।
অনেক হিন্দু বারাণসীর
শ্মশানঘাটে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান। তাঁরা মনে করেন, বারাণসীর গঙ্গাতীরে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলে তাঁরা সত্বর
মুক্তিলাভ করবেন। অন্যত্র মৃত্যু হলে, মৃতের পরিবারবর্গ মৃতের দেহাবশেষ গঙ্গায় নিক্ষেপ করেন। যদি তাও সম্ভব না হয়,
তবে মৃতের কোনো আত্মীয় আশ্বিন মাসে পিতৃপক্ষে
গঙ্গাতীরে এসে মৃতের বিশেষ শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেন।
গঙ্গার মূর্তিতত্ত্ব :
ভারতীয় শিল্পকলার ধর্মীয় অনুশাসন অনুসারে গঙ্গা এক ইন্দ্রিয়পরায়ণা, সুন্দরী নারী। তাঁর হাতে একটি উচ্ছ্বলিত জলপাত্র। এই
পাত্রটি অফুরন্ত জীবন ও উর্বরাশক্তির প্রতীক, যা মহাবিশ্বের গতিকে পুষ্ট ও সচল রাখে বলে হিন্দুদের
বিশ্বাস।
গঙ্গামূর্তির দ্বিতীয়
গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল তাঁর বাহন মকর। এটি একটি কুমির (দেহাংশ) ও মাছের (লেজ) সংকর।
পশ্চিমা জ্যোতিষশাস্ত্রের ক্যাপ্রিকন হিন্দু মকরের একটি রূপ। অন্যদিকে মকর
ঋগ্বৈদিক দেবতা বরুণেরও বাহন। এই কারণে গঙ্গা বৈদিক শিকড়ের ধারণাটি দৃঢ় হয়।
লাখ প্রশ্নের এক প্রশ্ন,
গঙ্গার জল ঠিক কতটা পবিত্র ! একজন
হিন্দু-সন্তান ছোটো থেকে বড়ো হওয়া পর্যন্ত, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দেখে যে, সব কাজেই গঙ্গাজল ছড়িয়ে পবিত্র করার রীতি। গঙ্গার জলে কি
এমন কোনো উপাদান আছে যা সকল কিছু পবিত্র করে দিতে পারে, নাকি এটা শুধুই ধর্মীয় নিয়ম। গঙ্গাজল নাকি সবকিছুই শুদ্ধ
করছে, পবিত্র করছে – গঙ্গা নিজে কতটা পবিত্র ! দেখা যাক। খোঁড়াখুড়ি চলুক।
(১) গঙ্গাজলে ভাইরাস :
হিন্দুরা গঙ্গাজলকে সবসময় পবিত্র ও পানযোগ্য বলে বিশ্বাস করে আসছে। হিন্দুধর্মীয়
অনুষ্ঠানাদিতে গঙ্গাজলকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখা হয়। কিন্তু এটা প্রমাণ করার
সত্যিকার অর্থে কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি আছে কি না ? ১৮৯৬ সালে ব্রিটিশ ব্যাকটেরিয়াবিদ আর্নেস্ট হ্যানবুরি
হ্যানকিন গঙ্গাজলকে পরীক্ষা করে একটি প্রবন্ধ লেখেন । বলা হয়েছে যে, কলেরা রোগের প্রধান কারণ ব্যাকটেরিয়া জীবাণুকে গঙ্গাজলে
রেখে দিলে তা তিন ঘন্টার মধ্যে মারা যায়। ঠিক এই ব্যাকটেরিয়াই আবার ছেঁকে নেয়া জলে
৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করতে থাকে। তিনি আরও উল্লেখ করা হয়েছে, গঙ্গা এবং পার্শ্ববর্তী যমুনা নদীর জল সেই সময়কার ভয়াবহ
কলেরা রোগের জন্য দায়ী ছিল, একইভাবে ১৯২৭
সালে ফরাসী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ার অণুজীববিদ কলেরা ও ডায়রিয়ায় মারা যাওয়া লোকদের
ভাসমান দেহের কয়েক ফুট নীচ থেকে সংগৃহীত জলে কোনো জীবাণু না পেয়ে বিস্মিত হন।
ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকারী ভাইরাসের উপস্থিতিকেই গঙ্গাজলের গুণ ও পবিত্রতার কারণ
হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
(২) পচন বিরোধী গঙ্গা :
নতুন দিল্লির ম্যালেরিয়া গবেষণা কেন্দ্র পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে যে,
গঙ্গার উপরিস্তরের জলে মশা জন্মায়নি এবং এই জল
যখন অন্য জলের সঙ্গে মিশ্রিত করা হলে সেখানেও মশার বংশবৃদ্ধিকে প্রতিরোধ করত। নদীর
জল সাধারণত যখন পচে যায় তখন অক্সিজেনের অভাবে ব্যাকটেরিয়া জন্ম দেয় -- যা জলে এক
পচা গন্ধ তৈরি করে। গঙ্গা জলকে যদিও সবচেয়ে ময়লাযুক্ত বিবেচনা করা হয়। অনেকদিন
ময়লায় ভরে থাকলেও এর জল পচে না। প্রকৃতপক্ষে, ব্রিটিশ চিকিৎসক সি. ই নেলসন নিরীক্ষা করে দেখছেন যে,
গঙ্গার অন্যতম অপরিষ্কার জায়গা হুগলি নদী থেকে
ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়া জাহাজ কর্তৃক সংগৃহীত জল পুরো যাত্রাপথ জুড়েই নির্মল,
পরিষ্কার ও সতেজ ছিল। একারণেই ইস্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানির জাহাজগুলো ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়া সময় তিন মাসের পানীয় জল হিসাবে শুধুই
গঙ্গাজল ব্যবহার করত। কারণ এটা থাকত সজীব ও সুস্বাদু ।
(৩) গঙ্গার ‘ফ্যান’ ভূমিরূপ :
নদীগর্ভস্থ ফ্যান বা Bengal Fan হল নদীর অত্যাধিক
মাত্রার পলি থেকে গঠিত এক ভূমিরূপ। গঙ্গার ফ্যান হল পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ
নদীগর্ভস্থ ফ্যান। এটি প্রায় ৩০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং প্রায় ১০০০ কিলোমিটার
প্রস্থ, যার সর্বোচ্চ পুরুত্ব
১৬.৫ কিলোমিটার বলা হয় যে, এই ফ্যান
বঙ্গোপসাগর জুড়ে বিস্তৃত। স্রোত পলিকে স্থানান্তরিত করেছে কয়েকটি নদী গর্ভস্থ
গিরিখাতের মাধ্যমে যেগুলোর কোনোটি ১৫০০ মাইলের চেয়েও দীর্ঘ। এই ফ্যানের যথেষ্ট
গুরুত্ব আছে ভারতে। কারণ এটা বিপুল পরিমাণ হাইড্রোকার্বনের গঠিত পদার্থ যেমন
বেনজিন, প্যারাফিন, কয়লার গ্যাস মজুতের সম্ভাবনার ইঙ্গিত বহন করে।
(৪) গঙ্গার দ্রবীভূত
অক্সিজেন : ডি. এস. ভার্গব গঙ্গা নিয়ে তিন বছরের গবেষণার ফল হিসাবে যা জানা যায় তা
হল, অন্যান্য নদীর তুলনায় গঙ্গা অত্যন্ত দ্রুত তার
জৈব রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদা কমিয়ে আনতে সক্ষম। ভার্গব বলেন, সাধারণত জৈব উপাদানগুলো নদীর অক্সিজেনকে নিঃশেষ করে,
তারপর পচতে শুরু করে। কিন্তু গঙ্গার এক অজ্ঞাত
উপাদান এই জৈব উপাদান ও ব্যাকটেরিয়ার উপর প্রভাব বিস্তার করে এবং তাদেরকে হত্যা
করে।গঙ্গার নিজেকে পরিশুদ্ধ রাখার গুণ পৃথিবীর অন্যান্য নদীর তুলনায় পঁচিশ গুণ
অক্সিজেনের মাত্রা বৃদ্ধি করে। আপন শক্তি আপনার হৃদয়ে সৃষ্ট হয়।
(৫) গঙ্গার জলসংকট :
বর্তমান সময়ে গঙ্গায় মারাত্মক জলের সংকট পরিলক্ষিত হচ্ছে। একদা উত্তরপ্রদেশের
বেনারসের চারদিকে গঙ্গার গড় গভীরতা ছিল ৬০ মিটার, কিন্তু এখন কোথাও কোথাও মাত্র ১০ মিটার। পাহাড়ি অঞ্চলে ধুলো
থেকে উদ্ভূত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গঙ্গোত্রী হিমবাহ অত্যন্ত ভয়ানক হারে ঢালুতে
পিছিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞগণ জলের সম্পদের ব্যবস্থাপনা, কলকারখানার বর্জ্য ফেলা, জলশোধন ব্যবস্থা এবং অধিক জনসংখ্যাকে দায়ী করেন। এটা শুধু
পরিবেশগত দুর্যোগের ঝুঁকিই সৃষ্টি করে না, অপরদিকে আধ্যাত্মিক সংকটেরও সৃষ্টি করে। বিদেশি বিশেষজ্ঞরা
মনে করেন যদি এমন অবস্থা আরও চলতে থাকে এবং পুনঃখননের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না-করা
হয়, তাহলে আমাদের এই জীবনেই আমরা অন্যতম একটি বড়ো
সভ্যতার সর্বনাশ প্রত্যক্ষ করব।
সম্প্রতি এক পর্যবেক্ষণে
জানা গেছে, ভারতের পবিত্র নদী গঙ্গার
জল এখন ক্যান্সারের উৎস হয়ে উঠেছে। ভারতে পবিত্র নদী হিসাবে পরিচিত গঙ্গার জল এখন
ক্যান্সারের উৎস হয়ে উঠেছে। ভারতের গঙ্গা তীরবর্তী এলাকায় চালানো জরিপে এ ভয়ংকর
সত্য প্রকাশ হয়েছে। জরিপটি করেছে ভারতের ক্যান্সার রেজিস্ট্রি প্রোগ্রাম। এতে বলা
হয়েছে, কারখানার বর্জ্যসহ সারা
বছর হাজারে হাজারে প্রতিমা বিসর্জনের নামে প্রতিনিয়ত গঙ্গায় ফেলা হচ্ছে। ফলে
ভারতের অন্যান্য স্থানের মানুষের তুলনায় গঙ্গা পাড়ের অধিবাসীদের ক্যান্সারে
আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। এনসিআরপি বলছে, গঙ্গায় যে সব বর্জ্য ফেলা হচ্ছে তাতে রয়েছে ভারি ধাতু ও
বিষাক্ত সব উপাদান। বিশেষ করে উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে গঙ্গার যে অংশ প্রবাহিত হচ্ছে
তাতে অনেক বেশি রাসায়নিক বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। ক্যান্সার রেজিস্ট্রি প্রোগ্রামের
সঙ্গে যুক্ত কোলকাতার চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যান্সার ইন্সটিটিউটের পরিচালক জয়দীপ
বিশ্বাস এ জরিপের ভিত্তিতে জানান, গঙ্গায়
শিল্প-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ফেলায় এ নদীর জলে এখন আর্সেনিক, ক্লোরাইড ও ফ্লোরাইডের মতো বিষাক্ত ভারী ধাতু রয়েছে। গঙ্গার
তীরবর্তী এলাকাগুলো পিত্তথলির ক্যান্সারের দিক থেকে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে।
আর প্রোস্টেট ক্যান্সারের দিক থেকে এ সব অঞ্চল ভারতে প্রথম অবস্থানে রয়েছে।
ক্যান্সার রেজিস্ট্রি প্রোগ্রামের জরিপে দেখা গেছে, গঙ্গা তীরবর্তী অধিবাসীদের প্রতি ১০,০০০-এর মধ্যে ৪৫০ পুরুষ এবং ১,০০০ মহিলা পিত্তথলির ক্যান্সারে ভুগছেন। এ সব এলাকার
মানুষের মধ্যে কিডনি, খাদ্যনালি, যকৃত, মূত্রথলি এবং
ত্বকের ক্যান্সারের প্রকোপও অধিক মাত্রায় দেখা গেছে। জয়দীপ বিশ্বাস বলেন, পুণ্য অর্জনের মানসিকতায় যারা গঙ্গার জলে স্নান করেন তারাও
ক্যান্সারসহ নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার বিপদের মধ্যে রয়েছেন।
পাপমোচন ও আত্মার
পরিশুদ্ধি অর্জনে তারা গঙ্গার জলে স্নান বা অন্যান্য মাঙ্গলিক কাজকর্ম করেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গঙ্গার জল যেভাবে দূষিত হচ্ছে, তাতে শঙ্কিত পরিবেশবিদগণ। গবেষকরা বলছেন, গঙ্গার জল কারসিনোজেনের উৎস, যা মানুষের শরীরে ক্যান্সারের কোশ তৈরি করে ও দ্রুত অকাল
মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। এ খবর দিয়েছে অনলাইন জি নিউজ। অ্যাটোমিক এনার্জি বিভাগের ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর কমপোজিশনাল ক্যারেক্টারাইজেশন অব ম্যাটেরিয়ালস’
সংস্থাটি গঙ্গার জলের নমুনা পরীক্ষা করে এমন
ভয়াবহ তথ্য মিলেছে। গবেষকরা বলছেন, নদীটির জলে
ক্রোমিয়াম-৬ ধাতু ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে । হায়দ্রাবাদভিত্তিক একটি পারমাণবিক গবেষণা
কেন্দ্রের অধীনে কাজ করছে ‘ন্যাশনাল সেন্টার
ফর কমপোজিশনাল ক্যারেক্টারাইজেশন অব ম্যাটেরিয়ালস’ । সম্প্রতি
কুম্ভমেলার সময় গঙ্গায় যে পরিমাণ বিষাক্ত ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়েছে,
তা অনুমোদিত সীমার প্রায় ৫০ গুণ বেশি। গঙ্গা
নদী এনডিএম-১সহ অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ‘সুপারবাগে’ পরিপূর্ণ বলে
গবেষকেরা জানিয়েছেন। গবেষকগণ বলছেন, উত্তরখণ্ডের ঋষিকেশ ও হরিদ্বারে মে ও জুন মাসে যখন কোটি কোটি পুণ্যার্থী
গঙ্গায় অবগাহন করেন, তখন অন্য সময়ের চেয়ে
নদীটিতে ৬০ গুণ বেশি সুপারবাগ থাকে। দিল্লির ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি ও
ব্রিটেনের নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞরা এই গবেষণা পরিচালনা করেন। তারা
জানান, ওই স্থান থেকেই
অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ‘সুপারবাগ’
ছড়ায়। তারা এটাকে বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে
অভিহিত করেছেন। তাদের মতে, পুণার্থীরা
যেখানে স্নান করেন, সেখানে বর্জ্য শোধন
কার্যক্রম এবং অশোধিত পয়ঃনিষ্কাষণ সংযোগও রয়েছে। ফলে তা সহজেই ছড়িয়ে পড়তে
পারে। এনডিএম-১ প্রথম নতুন দিল্লিতে শনাক্ত করা হয়েছিল। ২০০৮ সাল পর্যন্ত এটা
ক্লিনিক্যাল সরঞ্জাম ও হাসপাতালেই দেখা যেত। পরে তা দিল্লির জলে ছড়িয়ে পড়ে। এখন
সারা বিশ্বেই এটা দেখা যায়। এসব সুপারবাগের নতুন প্রজাতিও দেখা যাচ্ছে।
ফেব্রুয়ারিতে গঙ্গার উজানে যে পরিমাণ এনডিএম-১ পাওয়া যায়, জুনে পাওয়া যায় তার চেয়ে ২০ গুণ বেশি।
এখন প্রশ্ন হল গঙ্গা কি
রক্ষা করা সম্ভব হবে ? ভারতের গঙ্গাকে
বাঁচাতে এবার ‘গঙ্গা শোধন প্রকল্প’
তৈরি করতে যাচ্ছে মোদি-সরকার। গঙ্গার জলে থুতু
ও নোংরা জিনিসপত্র ফেলার ব্যাপারে কঠোর হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। জানা গেছে, গঙ্গার জলে যত্রতত্র থুতু আর বর্জ্য পদার্থ ফেললে সেই
ব্যক্তির তিন দিন থেকে তিন বছর অবধি জেল হতে পারে। নতুবা ১০ হাজার টাকা জরিমানাও
দিতে হতে পারে। যদিও এখনও মন্ত্রণালয় থেকে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি। জনবণ্টন
মন্ত্রী উমা ভারতী বলেছিলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে
পরিচ্ছন্ন আনতে নানা পরিকল্পনার কথা ভাবা হচ্ছে। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল
গঙ্গা। গঙ্গাকে মডেল করেই ভারতের আরও নদীগুলির রূপ ফিরিয়ে আনতে যথাযথ ব্যবস্থা
নেওয়া হবে।
গঙ্গা -- ভারতের নদীগুলির
মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র বলে পরিচিত এক নদী। প্রত্যেক হিন্দুর জন্যই পবিত্র শহর
বেনারসে (কাশী) এক বিশাল মিটিং হয়েছে, যা এই মহান নদীকে রক্ষার জন্য “গঙ্গা মুক্তি মহা
সম্মেলন” নামে মিটিং করা হয়েছে। এই
মিটিংয়ে অংশ নেওয়া মানুষ (হিন্দু পুরোহিত, সাধু ও বিখ্যাত সামাজিক নেতারা) এক ঘোষণা গ্রহণ
করেছেন, যাতে প্রশাসনের কাছে দাবি
করা হয়েছে নদীকে দূষণ থেকে বাঁচানোর জন্য. তারা একই সঙ্গে ঘোষণা করেছেন যে,
১৮ জুন দেশের ২০টি রাজ্য থেকে দশ লক্ষেরও বেশি
সক্রিয় কর্মী মিছিল করে দিল্লি অবধি যাবেন, যেখানে এই নদী সংরক্ষণের জন্য নতুন সমাবেশ করা হবে। দেশের
জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ যেসব মানুষ গঙ্গানদীর জলে স্নান করেন সেই সমস্ত
মানুষও সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত। মনে রাখতে হবে, গঙ্গা নদীর উপকূলে চল্লিশ কোটিরও বেশি লোক বাস করেন। এই
নদীর জলে অপরিষ্কৃত নর্দমার জল ফেলে দেওয়া হয় বিশাল পরিমানে, আর তারই সঙ্গে ধর্মীয় ঐতিহ্য মেনে মৃত মানুষের অস্থি
বিসর্জন দেওয়া হয়ে থাকে (প্রায়ই সম্পূর্ণ ভাবে দগ্ধ না হওয়া অবশেষ, এমনকি একেবারেই দগ্ধ না হওয়া মৃতদেহ পর্যন্ত), হাজার হাজার প্রতিমা বিসর্জনের ফলে নদীর নাব্যতা হারাচ্ছে
অবাঞ্ছিত দ্রব্যের নিমজ্জনের কারণে। প্রতিমার গোলা অস্বাস্থ্যকর রং জল মিশে জল
দূষিত হচ্ছে। যার ফলে নদীর মধ্য অববাহিকা অঞ্চলেই খুব বেশি রকমের দূষণ দেখতে পাওয়া
যায়. আর যখন এই নদী তার গতি পথের শেষে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে পৌঁছোয়, তখন তার জলের কাছে আসতেও ভয় করে – এতটাই তা থাকে নোংরা হয়ে। গঙ্গা এখন এক রাজনৈতিক সমস্যা।
১৯৮৫ সালে ভারত সরকার গঙ্গা রক্ষা করার জন্য একটি কর্মসূচি নিয়েছিলেন, এই কথা উল্লেখ করে রাশিয়ার স্ট্র্যাটেজিক গবেষণা কেন্দ্রের
বিশেষজ্ঞ বরিস ভলখোনস্কি বলেছেন -- “বিগত ২০ বছরে এই পরিকল্পনার বাস্তবায়নের জন্য ২৫ কোটি আমেরিকান ডলারের সমান
অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞের মতেই, সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে – পরিষ্কার করা হয়েছে শুধু এই নদীর জলে এসে যোগ হওয়া সমস্ত
নোংরা জলের একের তৃতীয়াংশ। আর দ্রুত বেড়ে ওঠা জনসংখ্যা, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাব ও নিজেদের
আয়ত্বের মধ্যে থাকা রসদের অনুপযুক্ত ব্যবহারের ফলে সমস্ত শক্তি প্রয়োগের ফলই হয়েছে
শূন্য। এখানে হিসাবের মধ্যে আনতে হবে যে, একটি দেশের পক্ষে প্রায়ই সমস্ত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয় না, বিশেষত, যখন কথা ওঠে
সীমান্ত পার হয়ে যাওয়া নদী নিয়ে। ভলখোনস্কি বলেছেন -- “ভারতের ও দক্ষিণ এশিয়ার দুটি মহান নদী সিন্ধু ও গঙ্গা
সীমান্ত পার হয়ে যাওয়া নদী -- ভারত এই দুটির বেশীর ভাগ অংশই নিয়ন্ত্রণ করে। আর
গঙ্গা প্রায় সারা অববাহিকা জুড়েই তাই যে-কোনো ধরনের কাজই ভারতের পক্ষ থেকে সিন্ধু
ও গঙ্গার উপরের অঞ্চলে করলে, তা প্রতিবেশী
দেশগুলির স্নায়ু বৈকল্যের লক্ষণ হয়ে দাঁড়ায়, এখানে সীমান্ত-দেশ বলতে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কথাই বোঝানো
হচ্ছে। কিন্তু এই দুই দেশের ক্ষেত্রে ‘উপরের’ দিকের দেশ হলেও, ভারত আবার চিনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘নীচের’ দেশ। কারণ চিন
গঙ্গার একটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জল সরবরাহের নদীকে নিয়ন্ত্রণ করে – তার নাম ব্রহ্মপুত্র। চিন বেশ কিছু বড়ো প্রকল্পের
বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছে নিজেদের দেশের নদীগুলির জলের ধারা পরিবর্তন করে দেশের
উত্তর–পশ্চিমের খরা কবলিত
অংশগুলিতে পাঠিয়ে সিনঝিয়ান উইগুর স্বয়ংশাসিত অঞ্চলে, আর এরই সঙ্গে ব্রহ্মপুত্রের উপরে জল বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং
বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে ঘোষণা করে। ফলে ভারত নিজেই চিনের কাজকর্মের উপরে নির্ভরশীল
হয়ে পড়েছে এবং পরিবেশ পরিস্থিতি গঙ্গার নীচের দিকে এলাকায় আরও খারাপ হতে পারে।
বরিস ভলখোনস্কি বলেছেন -- “পরিস্থিতি আরও
জটিল হয়েছে এই কারণে যে, যেমন আন্তর্জাতিক
আইনে, তেমনই প্রতিবেশী দেশগুলির
মধ্যে চুক্তি–অধিকারের ভিত্তি এই জল
সংক্রান্ত বিরোধ মেটানোর জন্য উপযুক্তভাবে নেই। হয় চিন নিজেদের দেশের নদীগুলি নীচে
যে সমস্ত দেশে গিয়েছে, তাদের স্বার্থ
সম্পূর্ণভাবেই উপেক্ষা করছে, নয়তো শুধু শান্ত
করার জন্য ঘোষণা করেই ক্ষান্তি দিচ্ছে, নিজেদের হাত বন্ধ করার জন্য কোনোরকমের আইন সংগত দলিল তৈরি করতে প্রস্তুত হচ্ছে
না”। ভারত সরকারের নতুন পরিকল্পনা ১৯৮৫ সালের থেকে এবারে বেশি সফল করে বাস্তবায়ন
করা হয়ও, তবুও গঙ্গা নদীকে
বাঁচানোর জন্য যথেষ্ট হবে না। তাহলে কি সভ্যতার অভিশাপ ? আমরা কি এতটাই অক্ষম ! ২০০৬ সালের গোড়ায় কলকাতা হাইকোর্টের
আদেশে গঠিত হয়েছিল গঙ্গা দুষণ নিয়ন্ত্রণ কমিটি। এরই মধ্যেই এই কমিটির প্রাসঙ্গিকতা
নিয়ে প্রশ্ন উঠছে । প্রশ্ন তুললেন কমিটির মধ্যে যাঁরা আছেন তাঁরাই। তাঁদের বক্তব্য,
হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে এই কমিটি কাজ শুরু
করে গঙ্গা দুষনের বিভিন্ন কারন চিহ্নিত করেছে, প্রতিকারের কথা বলেছে এবং এই ব্যাপারে কিছু সুপারিশ রূপায়ণ
করে গঙ্গার দুষণ কমানো বা বন্ধ করা যেসব সরকারি সংস্থার কাজ, তারা স্রেফ হাত গুটিয়ে বসে আছে। কার্যকর না-হওয়া কয়েকটা
সুপারিশ এই রকম –- গঙ্গা-তীরবর্তী
পুরসভাগুলিকে পাড় থেকে আবর্জনা সরাতে বলা হয়েছিল। সুপারিশ না-মানার দিক থেকে কলকাতা
পুরসভা সবচেয়ে এগিয়ে বলে কমিটির অভিযোগ। কলকাতা পুরসভার দাবি, ১৫০ ফুট পযঁন্ত গঙ্গার পাড় কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষের । তাই
ওখান থেকে আবর্জনা সরানোর দায়িত্ব নেবে না পুরসভা। বন্দর-কর্তৃপক্ষের দাবি,
আবর্জনা সরানোটা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না।
বুঝুন ঠ্যালা !
গঙ্গাকে দুষণ থেকে
বাঁচাতে গঙ্গার ৫০ মিটার পাড় পুরোপুরি প্লাস্টিক মুক্ত করতে হবে বলে সুপারিশ
করেছিল কমিটি । অধিকাংশ জায়গাতেই সেই কাজ হয়নি । গঙ্গার দু-পাড়ের সব বে-আইনি
দখলদারকে অবিলম্বে উচ্ছেদ করতে বলেছিল কমিটি । কাজের দায়িত্ত কার, তা নিয়ে চাপান-উতোর চলছে কলকাতা পুরসভা ও বন্দর-কর্তৃপক্ষের
মধ্যে। বন্দর কর্তৃপক্ষকে দেখতে বলা হয়েছিল, জাহাজ বা বার্জ থেকে কোনো বিষাক্ত পদার্থ যেন গঙ্গায় ফেলা
না হয়। কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট অবশ্য বলেই দিয়েছে, গঙ্গাকে দুষণমুক্ত করার কাজটা সরাসরি তাঁদের দায়িত্বের
মধ্যে পড়ে না। এই কাজ করার জন্য দুষন নিয়ন্ত্রন পর্ষদ আছে। কোন্ কোন্
শিল্প-কারখানা কোথায় কীভাবে গঙ্গার জলকে দুষিত করছে, তা চিহ্নিত করতে পর্ষদকে একটি বিশেষ সেল গড়ার নির্দেশ
দিয়েছিল কমিটি। পর্ষদের পক্ষ থেকে জানানো হল -- এ-রকম কোনো বিশেষ সেল পর্ষদের নেই।
গঙ্গা-দুষণ নিয়ন্ত্রণ কমিটি এমন কোনো নির্দেশ দিয়েছিল বলেও তাঁর জানা নেই ।
গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান
অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকার বর্জ্য জল বিশেষ প্লান্টে শোধন করে তবেই ফেলার কথা ।
কমিটির বক্তব্য, সব মিলিয়ে বড়ো জোর ৩০
শতাংশ বর্জ্য জল এইভাবে শোধিত হয়ে পড়ছে । বাকি সবই নোংরা, দুষিত জল সরাসরি গঙ্গায় মিশছে । নজিরগঞ্জ ক্যানাল, বালিখাল, আদিগঙ্গা, মারহাট্টা ডিচের
নোংরা জল গঙ্গায় মিশে তার জলকে রোজ দুষিত করে চললেও এদের গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যানের
আওতায় আনা হয়নি ।
ফিরিয়ে দিন গঙ্গার
পবিত্রতা। ভাবের ঘরে চুরি অনেক হয়েছে। এখনও সময় আছে, এখনও আদি শংকরাচার্যের গঙ্গা ফিরিয়ে সম্ভব। অবিলম্বে যা
করতে হবে – (১) যে-কোনো প্রতিমা ভাসান
বন্ধ করতে হবে, (২) যে-কোনো মৃতদেহ ভাসিয়ে
দেওয়া বন্ধ করতে হবে, (৩) ধর্মের নামে
গঙ্গায় যে-কোনো দ্রব্য-আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে হবে, (৩) কলকারখানার যে-কোনো ধরনের বর্জ্য ফেলা নিষিদ্ধ করতে হবে,
(৪) গঙ্গাতীরে মলমূত্র ত্যাগ নিষিদ্ধ করতে হবে,
(৫) মৃতদেহ দাহের জন্য শ্মশান সরিয়ে নিতে হবে
গঙ্গার কাছ থেকে, গঙ্গার ঘাটে মৃতদেহ দাহ
নিষিদ্ধ করতে হবে, (৬) গঙ্গার নাব্যতা বাড়াতে
চূড়ান্ত ড্রেজিং করতে হবে, (৭) যেসব রাজ্যের
মধ্য দিয়ে এবং দেশে গঙ্গা প্রবেশ করেছে তারা সকলে সহমত হয়ে বিরতিহীনভাবে একযোগে
একজোট হয়ে কাজ করতে হবে। তা না-হলে সেইদিন আসন্ন, যেদিন হা-হুতাশ করতে হবে। যে গঙ্গা একদা সভ্যতার বিকাশে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল, সেই গঙ্গাই
সভ্যতার ধ্বংসের কারণ হবে। দায়ী কে ? নিঃসন্দেহে আমরা।
অনির্বাণ
বন্দ্যোপাধ্যায়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন